বসন্তের ফুল - পর্ব ২১ - তারিন জান্নাত - ধারাবাহিক গল্প


৪১!!

চমৎকার রাত।মেঘের আঁড়ালে উঁকি দিয়ে আজ চাঁদ ও উঠেছে।প্রবণ শীতলতা আঁকড়ে ধরে প্রেমাকে। গোল থালার মতো চাঁদের দিকে অপলক চেয়ে থাকে প্রেমা। প্রেমার চোখে বারবার ভাসিত হচ্ছে অভ্রের ম্লানমুখের সেই হাসিটা।
কাঠের মেজে হাত দ্বারা স্পর্শ করে। তেলতেলে। হালকা পানি পড়লে পিছলে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। প্রেমা উঠে দাঁড়িয়ে কাঠের রেলিং এর পাশে গিয়ে দাড়ায়। 
রাতে যখন আড্ডা দিচ্ছিলো তখন অভ্রের খেয়াল ফোনের মধ্যে ছিলো।কেমন চিন্তিত মনে হচ্ছিলো অভ্রকে। তেমন একটা কথা বলেনি। তবে সাইকান, জেরিনের সাথে তাল মিলিয়ে প্রেমাও টুকটাক গল্প করেছিলো।কিন্তু বেশিরভাগ মনোযোগ অভ্রের দিকে ছিলো তার। প্রেমার চোখমুখ ও এখন গম্ভীরতায় ছেঁয়ে আছে।

ভাবনার মধ্যে প্রেমার ফোনটা বেজে উঠে,কাঙ্খিত মানুষটির নাম ভেসে উঠতেই প্রেমার চোখ মুখের পরিবর্তন ঘটে মুহুর্তেই।
ফোন রিসিভ করার পর,কানে অভ্রের কণ্ঠধ্বনি প্রবেশ করতেই প্রেমা কেঁপে উঠে,বুকের মধ্যে তবলা বাজতে শুরু করে। মনে হচ্ছিলো এ তবলা বাজানোর শব্দ অভ্রও শুনতে পারবে।তাহলে হয়তো আর নিস্তার নেই,বারবার লজ্জায় মারবে তাকে। 
"এতো রাতে না ঘুমিয়ে বাইরে কী করছো? (অভ্র)
প্রেমা আবারও কেঁপে সচকিত হয়ে আশেপাশে খোঁজতে শুরু করে অভ্রকে। 
" কথা বলো।(অভ্র)
"জ্বি,হ্যাঁ না মানে..ঘুম..হ্যাঁ ঘুম আসছে না তাই।
প্রেমার অস্থির কন্ঠে অভ্র শিথিল হয়ে আসে,এবং চেয়ে থাকে প্রেমার দিকে। অভ্রের অবস্থান থেকে প্রেমাকে অনায়াসে দেখা গেলেও প্রেমা অভ্রকে দেখতে পাবেনা। অভ্র শান্ত গলায় বলে " রাত অনেক হয়েছে,যাও শুয়ে পড়ো। বারান্দা থেকে চলে যাও, 
কথাটা বলে ধুম করে লাইনটা কেটে দেয়, তাতে প্রেমার কষ্ট হয় তবে সেটাকে গায়ে মাখায় না।ভাবে অভ্র হয়তো কোনো কারণে আপসেট।
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে প্রেমা রুমে চলে যায়।প্রেমা যাওয়ার পরে 
অভ্র হাতের ফোনটা খুব জোড়ে ছুড়ে মারে রুমের দিকে। তাতে ফোনটার তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও অভ্র কিঞ্চিৎ শান্ত হয়। অস্পষ্ট স্বরে বলে " সরি প্রেমা।

সবঠিক ছিলো বিকাল পর্যন্ত।প্রেমার সাথে আজ রাতটা জেগে কাটানোর মাত্রাতিরিক্ত ইচ্ছে পুষিত ছিলো তার মন-কোটরে। একটা ফোনকল? শুধু একটা ফোনকল সব এলোমেলো করে দিয়েছে।ছন্নছাড়া। 
 
"ভাগ্য সহায় ছিলো বিধায় বাঁচলেন,নাহলে আমার হাতেই খুন হবেন আপনারা। (অভ্র)

চুল মুষ্টি করে ধরে জোরে টান দেয়। তাতেও সে ক্ষ্যান্ত হচ্ছেনা। টকটকে লাল চোখজোড়া বেঁয়ে পড়ছে তরল। যাকে বলা হয় চোখের অশ্রু। 

"আমি চাইনা আমার কষ্টটা আমার ভাই ভোগ করুক। তোমাদের ছায়াও আমি পড়তে দিবো না আমার ভাইয়ের উপর। জগন্য মানুষ (অাগুন্তুকদের উদ্দেশ্যে বলে) (অভ্র)

রাত দুইটা। গভীর রাতও বটে। নির্ঘুমে থাকা দু'জোড়া চোখে বেশ ভয়। জড়ো হাওয়াই গুটিসুটি মেরে বিছানায় শুয়ে আছে প্রেমা। পাশে জেরিন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। 
কতোই না শান্তিতে ঘুমোচ্ছে সে।অথচ তার চোখে ঘুমের বিন্দুমাত্র রেশ ও নেই। ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে বাইরের দিকে। চাঁদের আলো মিশ্রিত নীরব রুমটায় অদ্ভুদ শব্দ শুনতে পায় প্রেমা। টকটক আবার কটকট শব্দ।উভয় শব্দে প্রেমাকে অস্থির করে তুলে। 

প্রেমা ছোটবেলা থেকে কৌতূহলী। যেকোন বিষয়ে। একটা বিষয় শুনলে,দেখলে তা নিয়ে পুরো রিচার্স এ নেমে যায়।কিন্তু এখন ভয় অভ্রের ধমকানিতে। অভ্রের হঠাৎ রাগ হঠাৎ শান্ত মেজাজে প্রেমা এখনো অবগত নয়। কাঁথা সরিয়ে বিছানা ছাড়ে প্রেমা।

রুম থেকে বের হয়। শব্দটা নিচ থেকে আসছে। তাই ফোনের লাইট জ্বালিয়ে নিচে নামে। এখনো সেই শব্দ প্রেমার কানে এসে মাথা ঝিমঝিম করে তুলছে। 

সোফার কাছাকাছি আসতেই থেমে যায়। ডান দিকে বাড়ির বাইরে যাওয়ার দরজা।আর বাঁ দিকে রয়েছে একটা গলি। সেদিক থেকেই আসছে শব্দ। প্রেমা গলির ভেরতে প্রবেশ করে। ভয়ে শরীর কাঁপছে তার।যদি কোনো ভুত-টুত থাকে। গলির মধ্যে রয়েছে চারটা রুম।একদম শেষের রুম থেকে আলো বেরোচ্ছে। দৃঢ় পায়ে হেঁটে শেষের রুমটির দিকে এগোয়।
শব্দের গতি এখন আরো প্রখড়। প্রেমা দরজার আঁড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দেয়। দেখা যাচ্ছিলোনা।তাই মাথা আরো টানিয়ে উঁকি দিতেই ভয়ে আঁতকে উঠে। জোরে শ্বাস বেড়িয়ে আসতে নিলে দু'হাতে মুখ চেপে ধরে। কতো ভয়ানক দৃশ্য।

রুমে মধ্যে টেবিলের পাশে দাড়িয়ে আছে অভ্র। চুরি দিয়ে অনবরত টেবিলে আঘাত করে যাচ্ছে।চোখমুখ ভয়ংকর লাল। এক নাগাড়ে টেবিলে আঘাত করে হাঁপিয়ে যায় সে। ধপ করে পাশে চেয়ারে বসে যায় অভ্র।
ধারালো চুরিটা আবারও হাতে নেয়। হাওয়ার গতিতে বাইরের দিকে ছুড়ে মারে। তাৎক্ষণিক প্রেমা দ্রুত মাথাটা সরিয়ে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।আরেকটু দেড়ি হলে চুরি প্রেমার মাথায় এসে গেঁথে যেতো।

বিষণ কাঁপছে প্রেমা।ভয়ে হাত পা শীতল হয়ে আসছে। অভ্রকে হঠাৎ ভয় পাচ্ছে সে।ভয় পাওয়ার মতোই অবস্থা।প্রেমার মাথা ফাঁকা হয়ে আছে।কিছুই সে বুঝতে পারছেনা। রীতিমতো চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করছে। মাথা ঝিমঝিম করছে যথা সম্ভব নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করছে। যদি সেন্স হারায় তাহলে ধরা পড়ে যাবে। 
আরেকবার চুরিটার দিকে তাঁকায় প্রেমা। চুরি থেকে চোখ সরিয়ে দোওয়ালের দিকে তাকায়। পিলে চমকে উঠে আবারও।দেওয়ালে প্রেমার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট। তারমানে অভ্র ওকে দেখে ফেলেছে। ঠোঁট ভেঙে কান্না শুরু করে দেয় নীরবে।খুব করে চাইছে অভ্র যাতে না দেখুক। 

শেষ রক্ষা হয়নি। শক্ত হাতের চাপ অনুভুব করে নিজের কোমল হাতে। ভীতু চোখে মাথা তুলতেই অভ্রের ফর্সা মুখটা দেখতে পায় প্রেমা। অভ্রকে দেখে প্রেমা দরজা চিপে ঢোকে যেতে চাইলে অভ্র টান দেয়।মুহুর্তে অভ্রের বুকে গিয়ে থুবড়ে পড়ে। সাথে সাথে প্রেমা সরে যেতে চাইলে অভ্র আঁকড়ে ধরে।শান্ত স্বরে বলে,
"-ঘুমাতে বলেছিলাম না এখানে কী?(অভ্র)
অভ্রকে ধাক্কা দেয় জোরে।প্রেমা চলে যেতে নিলেই অভ্র হাত ধরে ফেলে আবারও।
- আসার আগে খেয়াল করা উচিত ছিলো তোমার।আসলে আর যেতে পারবেনা। (অভ্র)
প্রেমা চুপচাপ হাত ছাড়াতে শুরু করে, এ অল্প একটা কারণে এখন সে অভ্রকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। ভয়ও পাচ্ছে।যেটা অভ্র বুঝতে পারে৷হালকা হেসে পেঁছন থেকে চুলে খোঁপা করে দেয়। এবং ঘাড়ে থুতনি রেখে আবছা কন্ঠে বলে। 
- যতদিন কৌতূহল কমাবে না ততদিন 
তোমার সব প্রশ্ন ধুম্রজালে আঁটকে থাকবে।
সো,বি নরমাল।(অভ্র)
প্রেমার চোখের পাতা কাঁপছে প্রচন্ড এখন।অভ্রের স্পর্শেও সে ভয় পাচ্ছে। জমে যাচ্ছে। 
প্রেমার বাকরুদ্ধকর অবস্থা দেখে অভ্র হাসে। এরপর প্রেমার হাত ধরে সোফার কাছে এসে দাঁড়ায়,টেবিলের ড্রিম লাইটটা জ্বালায়। প্রেমাকে ধাক্কা দিয়ে সোফায় বসিয়ে অভ্র প্রেমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। প্রেমার ডান হাতটা নিজের হাতে নেয় এরপর বলে,
" তোমাকে বলেছিলাম না আমি ঘুমাতে পারিনা,আমার ঘুম হয়না। সেদিন ঘুম আসছিলো খুব।ঘুমাতে পারিনি। আজ ঘুমাতে চাই। তোমার সমস্যা হবে না তো?(অভ্র)

অভ্রের বিনীত স্বর শুনে প্রেমা মায়া হতে শুরু করে। এতোক্ষণের সব ভয় কেটে যায়।অহেতুক ভয় পেয়েছে সে। ওর অভ্রের ও ছাড়া কেউ নেই। প্রেমা অভ্রের দিকে তাঁকায় দেখে চোখ বন্ধ করে আছে।মুচকি হেসে প্রেমা অভ্রের কপালের দিকে তাকিয়ে নিচু হয়।তখনি অভ্র চোখ খুলে ফেলে। থেমে যায় প্রেমা।
-কন্ট্রোল ইউর'সেল্প প্রেমা।(অভ্র)
অভ্রের কথায় প্রেমা ঠোঁট বাঁকা করে নাক ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়ে। চোখে-মুখে রাগ দেখা যায়। প্রেমার মুখের অবস্থা দেখে অভ্র শুয়া থেকে উঠে বসে যায়।প্রেমার ডান হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ রাখে।এবং বলে,

-হ্যাপি কাপল, কলেজ লাইফ থেকে একে অপরকে প্রচন্ড ভালোবাসে।একে-অপরের জন্য প্রাণটাও দিতে পারে।কিন্তু পরিবারকে মানিয়ে সেসময়ে বিয়ে করা অসম্ভব ছিলো।অবশেষে সেল্প কন্ট্রোল হারিয়ে তারা লিভ ইন রিলেশনশিফে জড়িয়ে যায়। বিয়েটাও করেনি কিন্তু তাঁরা। তাদের ওই মিস্টেকের কারণে তাদের একটা বেবি হয়। যেটার প্রতি তারা উভয়ে অসন্তুষ্ট ছিলো। দেখো রিলেশনটা করেছিলো তারা অথচ বেবিটাকে তারা সবসময় ফেলনা মনে করে এসেছিলো। 
এটাকে কী বলবে তুমি?আদৌ কী ভালোবাসা বলা যায়?  তোমার দিক থেকে তুমি বলো?(অভ্র)

অভ্রের কথায় প্রেমা নাকমুখ ছিটকে বলে উঠে,
-ছিঃ কী জগন্য রিলেশন।এমন হলে রিলেশন না করাই ভালো। (প্রেমা)
প্রেমার কথায় অভ্র ছোট করে শ্বাস ছাড়ে,এবং বলে,
-কিন্তু একটু আগে তু...
-অভ্র। আমি তেমন কিছু করতে চাইনি,
অভ্র হেসে দেয়। গভীর একটা শ্বাস নিয়ে বলে,
-বাই দ্যা ওয়ে, কাল বাড়ি যেতে হবেনা আমি আংকেল বলেছি তুমি তোমার ফ্রেন্ডের বাড়িতে আছো।গ্রামে ফিরতে চাও না আপাততে। (অভ্র)
-এমনটা বলার কী দরকার ছিলো।আমি তো কাল চলে যেতে চেয়েছিলাম।আর তুমি?(অভ্র)
-ভয় হলে চলে যেতে পারো। বাট জেরিন আর সাইকান এখানে থাকবে। আমাকে কাল বাড়ি যেতে হবে।(অভ্র)
-না সেটা না,আচ্ছা তোমাকে কেউ খোঁজেনি?(প্রেমা)
প্রেমার কথায় অভ্র কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে 
"বাবাকে বলেছি সব আমাদের ব্যাপারে।তাই কেউ খোঁজলেও বাবা অজুহাত দিয়ে দিয়েছে।(অভ্র)
-কী? আংকেল জানে মানে? সব জানে?
- অভ্র মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়। 
প্রেমা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে অভ্রের মুখের দিকে।
-আচ্ছা আন্টিও সব জানে?
অভ্র মন খারাপ করে বলে,
-মায়ের ব্রেইনে প্রচুর সমস্যা। যে কোন বিষয় উনার মাথায় চাপ দিতে পারে।আমার ব্যাপারে ভীষণ সাবধান উনি। তাই এসব কিছু মা সহ্য করতে পারবেন না তাই বাবা সবটা চেপে গেছে। (অভ্র)
-আন্টিকে দেখলে তো মনে হয়না ব্রেইনে সমস্যা আছে।
-বছর খানেক আগে সুস্থ হয়েছে।তবে এখনো মেডিসিং চলে। (অভ্র)
-ওহ। (প্রেমা)
এরপর পর অভ্র আবারও প্রেমার কোলে শুয়ে পড়ে।সত্যিই তার একটা পুরো আট বা ছয় ঘন্টার একটা শক্ত ঘুমের দরকার। বিছানায় শায়িত হয়ে ছটপট করার চেয়ে প্রেমার কোলে শুয়াটাই অভ্রের জন্য উত্তম।
চোখ বন্ধ করতেই প্রেমা বলে উঠে, 
-অভ্র আমরা বিয়ে করবো কখন?(প্রেমা)
অভ্র চোখ বন্ধ রেখেই বলে, 
-অপেক্ষা করতে পারবেনা বছর খানেক?"
- ইয়ে মানে, এমনি বলছিলাম পারবো তো অপেক্ষা করতে। (প্রেমা)
প্রেমার কথায় অভ্র রসিকতার স্বরে বলে,
-আমার বউ হতে ইচ্ছে করছে? এতো তাড়াতাড়ি? পরে কিন্তু প্রস্তাবে।(অভ্র)
অভ্রের মৃদু স্বরে আবেগ মিশ্রিত কথায় প্রেমা লজ্জায় মিঁইয়ে যায়। ওরনাটা টেনে অভ্রের মুখ ঢেকে দিয়ে বলে,
-ঘুমাও ফাজি ছেলে।
প্রেমার কথায় অভ্র নিঃশব্দে হাসে। বিয়ের সব কিছু ঠিকঠাক করে রেখেছে অভ্র। শুধু কাঙ্ক্ষিত দিনটার অপেক্ষায় রয়েছে। মাঝখানে কিছু অদৃশ্য দেওয়াল রয়েছে সে দেওয়াল ভাঙতে হবে। তবেই সব করা সম্ভব হবে। আর যাই হোক পাপ সে করবেনা।
_________________

কাঁথা বালিশ সব আরিয়ানে মুখে ছুড়ে মারে অরি। আরিয়ান দাঁত কটমট করে অরির দিকে তাকিয়ে বলে,
-তোকে আমি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবো।
-আর তোকে আমি জেলে পুলিশদের চাকর বানাবো।(অরি)
-মুখ সামলে কথা বলো,মা-বাবা মানলেও আমি মানবো না তোকে। (অারিয়ান)
-তোর মানা দিয়ে আমি করবো শালা, চুপ থাক আমাকে ঘুমাতে দে,নয়তো থাপড়াবো।(অরি)
অরির কথায় আরিয়ান বাকরুদ্ধ। কতোটা বেয়াদব হলে এমন ব্যবহার করতে পারে ওর জানা নেই।তবে অরিকে সে সহ্য করতে পারছেনা।
-আমার বিছানায় আমিই ঘুমাবো।নাম তুই।নাহলে আমি চেঁচাবো(আরিয়ান)
আরিয়ানের কথায় অরি হেসে বলে,
-বাহ। চমৎকার তো।বাসর রাতে বর চেঁচাবে। মানে বাইরের লোক কি মনে করবে।আই মিন...(অরি)
-এ মেয়ে চুপ। খুন করে ফেলবো তোকে আমি। (আরিয়ান)
-আমি তোকে ছাড়বো নাকি? আমার বাবাতো তোকে ফাঁসিতে ঝুলাবে।(অরি)
অরির কথায় আরিয়ান চুপ মারে।এরপর বলে,
-তুই তোকারি করবানা আমার সাথে,আমি তোমার হাসবেন্ড হই। (নরম স্বরে)
তা দেখে অরি বাঁকা হেসে বলে,
-তুই আর আমি সেম বয়সের,আমি তোকে তুই করেই বলবো। যেমনটা আমি আমার ফ্রেন্ডদের সাথে বলি। 
আর যতদিন আমাকে মেনে নিবি না ততদিন তুই করেই বলবো।(অরি)
কথাটা বলে শুয়ে পড়ে অরি।আর আরিয়ান চুপ করে মেঝেতে বিছানা পাতে। ভাবে এমন সাংঘাতিক মেয়ের থেকে সে দূরে দূরেই থাকবে।
"-তোর জীবণটা আমি তছনছ করে দিবো শালা।(অরি মনেমনে কথাটা বলে চোখ বন্ধ করে) 

৪২!!

সতেজ এবং স্নিগ্ধতায় ভরপুর সকাল।বাড়ির ভেতরে আবছা আলো প্রবেশ করে। চারপাশে পাখির কলরব। 
স্পষ্টভাবে অভ্রের কর্ণ ভেদ করে পাখিদের কোলাহল। 

চোখ মেলে উপরের দিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে। কিছুসময় ঝাড়বাতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। নিজের অবস্থান খেয়াল  হতেই ঝাড়বাতি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শুয়া থেকে উঠে বসে। প্রেমা এলোমেলো ভাবে সোফায় বসে ঘুমাচ্ছে। মুচকি হাসি হাসে অভ্র। বিষণ শান্তি এবং পরিপূর্ণ হয়েছে ঘুমটা। আগে সকালে উঠার অভ্যাস ছিলো অভ্রের। রাতভর জেগে শেষ ভোরের দিকে চোখ নিভে আসতো। পরে সকালো দ্রুত উঠে যেতো।কিন্তু মাথার ভেতরে অস্বস্তি ভোগ করতো। সে তুলনায় আজ ঘুম বেশ আরামের হয়েছে। 
তীব্র কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে অভ্র দাঁড়িয়ে যায়। প্রেমাকে ঠিকভাবে শুইয়ে দিয়ে ওরনাটা জড়িয়ে দেয়। কপালে চলে আসা চুল গুছিয়ে একপাশে এনে রাখে।
প্রেমার মুখের দিকে হালকা ঝুঁকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে, 'আজ আমার জন্য 
একটু কষ্ট হয়েছে না, অনেক সরি ' (অভ্র)

প্রেমাকে নিচে রেখে অভ্র রুমে যায়।শাওয়ারের জন্য। 
হাত থেকে ফোন রাখতেই একটা মেসেজ আসে ফোনে। কপাল কুঁচকে মেসেজটা দেখে, 'বাসায় আসতে হবে না, আমি আসছি তোর সাথে দেখা করতে।'
এইটুকু লেখা দেখে অভ্র বুঝে যায় মেসেজটা কে করেছে। অতঃপর ওয়াসরুমে ঢোকে। 

আড়মোড়া ভেঙে আশেপাশে তাঁকায় প্রেমা।সে একা সোফায় বসে আছে। নিজেকে সোফায় দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয়। সোফার সাথে ঠেসে আবারও শুয়ে চোখ বন্ধ করে। তখনি গতরাতের কথা মনে যায়।অভ্র ওর কোলে শুয়েছিলো। রুমটির কথা মনে পড়লে প্রেমা দ্রুত উঠে গলির মধ্যে ঢোকে শেষের রুমটির নিকটে গিয়ে দাঁড়ায়। হতাশার শ্বাস ছাড়ে। অভ্র বোকা নয়। তার আগেই বুঝা উচিত ছিলো।
রুমটি তালাবদ্ধ দেখে ফিরে আসে প্রেমা। কিচেনের দিকে তাঁকাতেই দেখে সাইকান নাস্তা বানাচ্ছে।প্রেমা মুচকি হেসে কিচেনের এগোয়।
-নাস্তা বানাচ্ছো? (প্রেমা)
-হ্যাঁ,আপু কিছু লাগবে? (সাইকান)
-নাহ,তুমি আসলে কেন? আমিই বানাতাম।অযথা... 
-আরে আপু সমস্যা নেই আমরা বেশিরভাগ সময় এখানেই থাকি। নাস্তা বানানোতে আমি বেশ অভিজ্ঞত।
-তোমরা এখানেই থাকো? কেন?(প্রেমা)
প্রেমার প্রশ্নে সাইকান চমকে তাঁকায়।জিহ্বে ছোট একটা কামড় দেয়।অভ্র ঠিকই বলে ওর নাড়িভুড়ি মেয়েদের মতোই শর্ট। ভাগ্য ভালো এ মুহুর্তে অভ্র নেই,নাহলে অভ্রের হাতের চড় ওর গালে পড়তে সময় নিতো না।
-ওই মাঝেমধ্যে ছুটির দিন মানে শুক্রবারটা এখানেই কাঁটায় আমরা।সেসময় নাস্তা রান্না আমিই করি।(সাইকান বেশ আতংকিত হয়ে জবাব দেয়)
-আচ্ছা,(প্রেমা)
প্রেমা রুমে চলে যেতেই সাইকান হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।
রুমে এসে দেখে জেরিন ফ্রেস হয়ে সাজছে। প্রেমাকে দেখে সৌজন্য হাসি দেয়। প্রেমাও হেসে ওয়াসরুমে চলে যায়।প্রেমার মাথায় এখনো গতকাল রাতের কথা গেঁথে আছে।অভ্রের ব্যপারটা সে স্বাভাবিক নিতে পারছে না।অভ্র কিছু তো লুকাচ্ছে।কিন্তু কী?
নিজমনে প্রশ্নে করে।
রুমে এসে মুখ মুছতে মুছতে নানা প্রশ্নে বিভোর হয়ে পড়ে সে। যার ফলে অভ্রের উপস্থিতি সে ঠাওর করতে পারেনি। দরজায় দাঁড়িয়ে প্রেমাকে ভালোমতন পরখ করতে শুরু করে অভ্র। 
যে প্রেমার নিঃশ্বাসের বেগ শুনে মনের অবস্থা বলে দিতে পারে,সে প্রেমার চোখমুখের অবস্থা দেখে নিভৃত মনের গুঞ্জন ও শুনতে সক্ষম। 
দরজার করাঘাতে কৌতূহলপূর্ণ প্রশ্নের জগৎ থেকে বের হয়। ঘাঁড় বাঁকা করতেই চোখ আঁটকে যায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটির স্নিগ্ধরুপে। এতক্ষণ অন্য ভাবনার দুনিয়ায় বিচরণ করলেও এখন শুরু হয় অভ্রের সৌন্দর্য্যের রহস্য উন্মোচনে। 
আবারও শুরু হয় বুকের মধ্যাকার উতাল-পাতাল ঢেউ।
ঠোঁট টেনে হাসে প্রমা। 
- 'মে আই কাম ইন ডিয়ার' (অভ্র)
অভ্রের কন্ঠে বলা কথা অমৃত মনে হয় প্রেমার। যেনো ক্রমশই অভ্রের মুখ দ্বারা উচ্চারিত প্রত্যেকটি কথা সে শুনে যায়। কোন নিস্তব্ধ পরিবেশে বসে। 
-'ডিয়ার' (অভ্র)
আবারও কেঁপে অভ্রের দিকে তাকিয়ে রুমে আসার জন্য সম্মতিসূচক ইঙ্গিত করে। অভ্র মিটিমিটি হেসে এগিয়ে আসে।
-চলো,নাস্তা করবো। (অভ্র)
হাতের তাওয়ালের দিকে তাকিয়ে প্রেমা অভ্রের দিকে তাঁকায়।চুল থেকে টপটপ পানি পড়ছে।
-চুল মুছো নাই কেন?(প্রেমা)
-ইচ্ছে করে না। (অভ্র)
অভ্রের কথায় প্রেমা অভ্রের কাছে গিয়ে হাত আলগা করে চুল মুছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু অভ্রের লম্বাটে গঠনের কারনে অভ্রকে নাগাল পায়নি প্রেমা। সে এতোটাও খাঁটো নয়।কিন্তু অভ্র বেশ লম্বা। প্রেমার কান্ডে অভ্র হেসে বিছানায় বসতে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে যায়। রাতে বিছানায় প্রেমা ছিলোনা জেরিন ছিলো।আর প্রেমার বিছানা হলে অভ্র অবশ্যই বসতো।
দাড়িয়ে হালকা ঝুঁকলেই প্রেমা হাসে।এরপর অভ্রের চুল মুছে দেয়। ভীষণ মিষ্টি ঘ্রাণ আসে অভ্রের চুল থেকে।স্যাম্পু করছে হয়তো তাই।

চুল মুছে তাওয়ালটা মেলে দিয়ে অভ্র আর প্রেমা নিচে চলে যায় নাস্তা করতে।
চারজনে নাস্তা সেরে নেয়। 

-আমি দুপুরের আগে ফিরে আসবো,ততক্ষন পর্যন্ত তোমরা একসাথে থেকো। (অভ্র)
-কোথায় যাবে? (প্রেমা)
-বাড়িতে, (হেসে উত্তর দেয় অভ্র)
অভ্রের কথায় সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাঁকায় প্রেমা।কেন যেনো অভ্রকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনেমনে অভ্রকে অনুসরন করার সিদ্ধান্ত নেয়।

অভ্র যেতেই প্রেমার কৌতূহল আরো দ্বিগুন বেড়ে যায়। সাইকান আর জেরিনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রেমাও অভ্রের পিঁছু নেয়।
বাড়ি থেকে বেড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে বড় পিচঢালা রাস্তায় এসে পৌঁছায়। এতোক্ষণ সময় অভ্র ঠের পায়নি অভ্র। 
পিচঢালা রাস্তাও অভ্র হেঁটে যাচ্ছে তাই অগত্যা প্রেমাকেও হাঁটতে হচ্ছে।
অভ্র ফোনে কারো সাথে কথা বলতে বলতে অারো আধ ঘন্টা ধরে হাঁটে। প্রেমা উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে রাস্তা সমান জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটে। নিচু করে হাঁটার ফলে অভ্রের চোখে পড়েনি। 

মজার ব্যপার অভ্র রাস্তা থেকে নেমে আবারও জঙ্গলের ছোট এলোমেলো রাস্তায় নেমে আসে।যার ফলে প্রেমাকে পথ বদলাতে হয়নি।সে অবস্থায় হেঁটে চলে।
আরো কিছু সময় হাঁটার পর নিচে নামতেই বড় একটা পুকুর, এবং তারপাশেই একটা বটগাছ।এবং ছায়াযুক্ত স্থান। নিচে কয়েকটা ব্যাঞ্চ বসানো। 
অভ্র সেই বটগাছের দিকে যায়। আরেকটু এগোতেই একটা মেয়েকে দেখতে পাই। 
অভ্রের পেঁছন পেঁছন প্রেমাও নেমে যায়। এবং অন্য একটা গাছের আড়ালে গিয়ে লুকায়।
অভ্র মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মেয়েটি হঠাৎ অভ্রকে জড়িয়ে ধরার জন্য এগোয়।
তখনি অভ্র দু'পা পিঁছিয়ে যায় এবং হাত দ্বারা ইশারা করে থামতে বলে।সাথে সাথে মেয়েটি থেমে যায়।
মেয়েটির মুখ এখনো প্রেমা দেখতে পায়নি। 
কিন্তু তাতেও চোখের পানি আঁটকাতে পারেনি।
প্রেমার মনে শুধু একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।
'ওর অভ্র ওকে ঠকাচ্ছে না তো?(প্রেমা)
________________

বিছানায় শায়িত জিহাদ রহামানের দিকে তাঁকিয়ে আছেন আয়শা আহমেদ। এই মুখেই তিনি এতোদিন হিংস্রতার চাপ দেখে এসেছেন আয়শা। আর আজ অসহায়ত্ব এবং নিষ্পাপ চাহনি। 

আয়শাকে বাড়িতে না পেয়ে প্রচুড় ক্ষেপে যান জিহাদ সাহেব।ফলাফল বাড়ি ফিরেই বেধরম মার ক্ষেতে হয় আয়শাকে। 
 
এ বয়সেও মার খেতে হয় কী লজ্জাকর ব্যাপার।ভাবতেই আয়শার মনে তিক্তাতায় চেয়ে যেতো মনপ্রাণ। 
বিনাদোষে মার খেতে হয় স্বামীর। 
যদিও বা স্বামী-স্ত্রীর কোন সম্পর্কই নেয় ছিলো না উভয়ের মধ্যে। যা ছিলো তা কারো মনে প্রতিশোধের আগুন, আর না বুঝে ভুল করার শাস্তি। আজীবণ পস্তাতে হচ্ছে। 

একটা প্রবাদ আছে না,
ভাবিয়া করিও কাজ,
করিয়া ভাবিও না। 

আয়শা আহমেদ আজ বিষণ পস্তাচ্ছেন। যদিও বা উনি যা করেছেন সব জিদের উপরে। অহংকার এবং জেদ বেশ ভয়ংকর। অহংকার সত্যিই একসময় সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।
নিজের রুপের অহংকার ছিলো বেশ।আজ তার ফলাফল হাড়ে হাড়ে ঠাওর করতে পারছেন। 
  
জিহাদ সাহেবের রুম থেকে বেরুতেই, কারিমা বেগম আয়শাকে টেনে একপাশে নিয়ে আসেন।

-আপা আমারে মাফ করে দেন।(কারিমা)
-কেন কী হয়েছে?(অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন আয়শা)
-আপা ভাই সাহেবরে ওয়াসরুমে আছাড়টা আমি খাইয়েছিলাম। সাবানের প্যানা ফেলে। আপনারে এতো মারলো আমার সহ্য হয়নি তাই...(কারিমা)
-তাই বলে মানুষটার এই অবস্থা করলি?(রেগে)
-মাফ করেন আপা, আর হবেনা। দয়া করেন।(কারিমা)
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আয়শা আহমেদ নিজের রুমে চলে আসেন।যদিও বা মনেমনে দুঃখ-খুশী দু'টোই হচ্ছে।তবে তা অপ্রকাশিত রেখে দেন।
আর নয়। এবার তিনি আর এই অভিশপ্ত জীবণ   কাটাবেন না।  ফিরে যাবেন তাদের কাছে....
খোঁজে নিয়ে,মানিয়ে নিবেন নিজের শরীরের অংশীদারদের.......

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন