২৭!!
-বাহ! বউয়ের রুমটা তো দারুণ গোছালো। বড়রা বিয়ের ডেইট আর গিফ্ট নিয়ে আলোচনা করতে করতে একটা ঘুম দেয়া যাক কি বলো তাহু? আর টেনশন নিতে পারছি না বাবা! এখনো রাগ করে গাল ফুলিয়ে রাখতে চাইলে রাখতে পারো। আমার আর কিছুই করার নেই। ঘুম পাচ্ছে ভিষণ। ভাইয়ারা মে বি বাইরে থেকে দরজাটা লক করে গেছে। দরজা খুলে দিলে ডেকে দিও।
স্নিগ্ধ কথাগুলো বলতে বলতে সত্যিই এসে তাহিয়ার বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে চোখ বুজেছে দেখে তাহিয়া থতমত খেয়ে গেল। এতোগুলো দিন রাগ করে থাকলেও এবারে স্নিগ্ধের এমন ব্যবহারে রীতিমতো কান্না আসছে তাহিয়ার। এমন করতে পারলো ছেলেটা? আজকের দিনটাতেও ইচ্ছে করে ঝামেলা না করলে চলছিল না লোকটার? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তাহিয়ার চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসছিল। ঝাপসা চোখেও স্নিগ্ধের হটাৎ করে চোখ মেলে তাকানোটা খেয়াল করেই চোখ নামিয়ে অন্য দিকে ফিরে তাকালো তাহিয়া। বিছানাতে পা ঝুলিয় বসেছিল মেয়েটা, এবারে একটা দীর্ঘশ্বাসটা লুকানোর জন্যই কি না কে জানে বিছানা থেকে নেমে এক পা সামনের দিকে বাড়াতেই হাতে হ্যাঁচকা টান খেয়ে হুড়মুড় করে স্নিগ্ধের গায়ের উপরেই এসে পড়লো। কিছু বলার জন্য স্নিগ্ধের দিকে তাকাতেই যেন তাহিয়ার চোখ জোড়া আটকে গেল। স্নিগ্ধকে এর আগে কখনো পাজামা পাঞ্জাবি পড়া কি দেখেছে তাহিয়া? নাহ বোধ হয়। তাই হয়তো এতোটা অবাক, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে নিজের বিয়ে করা এবং পুনরায় বিয়ে করতে যাওয়া হবু বরের দিকে।
-এখন কেন জ্বলে গো সখী? আমাকে যে গত একটা মাস জ্বালিয়েছ তখন একবারও বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে নি? নাম্বারটা ব্লক করে রেখেছ, বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করেছ, মেসেজ, মেসেঞ্জার, ফেইসবুক, ওয়াটসএপ, ইমো সব জায়গায় ব্লক। আমার গত একটা মাস কেমন করে কেটেছে একটাবার ভেবে দেখেছ? শুধু রুমে ঢুকে আমার দু মিনিটের না তাকানোয় তোমার চোখে পানি চলে এলো, আর আমি যে এতোগুলো দিন তোমাকে এক নজর দেখার জন্য ছটফট করেছি, একটা বার তোমার কণ্ঠস্বরটা শোনার জন্য মরিয়া হয়ে ছিলাম সেই অনুভূতিটা কতটা কঠিন ছিল বুঝতে পেরেছ এবার?
-একটা মাস! এ আর এমন কি? আমি না থাকলেও নতুন কারো কি অভাব হয়েছিল তোমার জীবনে? নতুন কেউ এসেছে বলেই হয়তো আর পুরোনো মানুষটার দিকে তত নজর পড়ছে না।
-হুম? বাহ! বেশ ভালোই তো ব্যাপারটা! দুনিয়ার সব জায়গা থেকে আমাকে ব্লক করে দিয়েও একটা ফেইক একাউন্ট খুলে আমার সাথে ডেইলি চ্যাট করে ইনিয়ে বিনিয়ে ভালোবাসার কথা বলে আমাকেই দোষী বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে মেয়ে? নিজেকে কি বেশি চালাক ভাবো? নাকি আমাকে গাধা ভাবো?
-মা-মানে! আমি তোমাকে অন্য আইডি খুলে মেসেজ করতে যাবো কেন?
-তুমি করো নি? তাই? নুজাইফা শাহরিয়ার ফারিহা? এইটা তোমার আইডি না বলতে চাইছ?
-আমম। নু-নু-নুজাইফা? কে নুজাইফা? আমি কোনো নুজা-নুজাইফা বা ফারিহা কাউকে চিনি না।
-শোনো তাহুবেবি, তোমার প্রত্যেকটা কথা বলার স্টাইল, প্রত্যেকটা শব্দ চয়ন, প্রতিটা সেন্টেন্স আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। তুমি কি বলতে পারো, কেন বলো, কি মিন করো সব আমার জানা আছে। এই যে নামটা শুনে তোলাচ্ছে এটার মানে কি জানো? এটার মানে হলো ধরা পড়েছ গেছ সেটা তুমি বুঝতে পেরেছ। আর বুঝতে পেরেছ বলেই ঘাবড়ে গিয়ে তোতলাচ্ছ। বাট মাই ডিয়ার ওয়াইফি, ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয়নি। এই দুষ্টুমির জন্য আমি বকবো না তোমাকে আজকে। ওকে?
-কার না কার সাথে ইটিশপিটিশ করে এখন এসেছে আমার নামে দোষ দিতে। ছাড়ো তো আমাকে। একদম বানিয়ে বানিয়ে এসব বলবে না।
-সুইটহার্ট, কাজটা যে একমাত্র তুমিই করতে পারো সেটা আমি ফার্স্ট যেদিন নক করেছ সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই তো এতোগুলো দিন তোমায় একনজর না দেখে থাকলেও তোমার বাড়িতে এসে হানা দিই নি। নইলে তোমার কি ধারণা আমার বিয়ে করা বউ এমন শাস্তি দিবে আর তাকে আমি এখানে রেখে দিয়ে বাসায় শান্তিতে চুপ করে বসে থাকবো?
-বসে কোথায় ছিলে?
-তাই তো! বসে থাকবো কেন বলো? বউকে শায়েস্তা করার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি না বাসায়? একবার বিয়ে করি নিয়ে যাই, তারপর সব হিসেব নিকেশ বুঝিয়ে দিবো সুইটহার্ট। এতোগুলো দিনের শোধ যদি না নিয়েছি আমি----।
-কিসের ব্যবস্থা?
-সেসব শ্বশুরবাড়িতে গেলেই দেখতে পাবে। কিন্তু তোমার ভাইয়া কি বলে গেল? আরো একমাস পরে বিয়ের ডেইট ফিক্সজড করবে মানে কি? এই না না না। এসব মানবো না। আমার বউকে আমি পারলে আজই নিয়ে যাই, বাট কথাটা তো কাউকে বলতে পারছি না। ধ্যাত।
-বেশ হয়েছে। ছাড়ো। তুমি না ঘুমাবে? এখন এতো বকবক করছ কেন?
-এই কয়টা দিন যে রাত জেগে আমার সাথে টুংটাং চ্যাটিং করেছ সেটার কি হবে বলো তো? তোমাকে না বারণ করেছিলাম রাত জাগবে না? একে তো আমার কোনো কথাই শোনো না কখনো, তার উপরে কিছু বললেই না বুঝেই রিএ্যাক্ট করো। এসব কি ঠিক বলো তো?
-কি না বুঝে রিএ্যাক্ট করি হ্যাঁ? সিনিয়ার জুনিয়ার কারো সাথে দু মিনিট দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছ আা কারো থেকে শুনেছ ওমনি তোমার রাগ শুরু হয়। আমার উপরে রাগ না দেখিয়ে নিজের উপরে দেখাও। সেগুলো বুঝি খুব ঠিক?
-তোমার যে সিনিয়ারদের কথা বলো তুমি, তারা ২ মিনিটের কনভারসেশনের জের ধরে বন্ধুমহলে 'মেয়ে তো পটে গেছে, মামা' এসব চর্চা করে। আর জুনিয়ারগুলো তো মাশাআল্লাহ! ভার্সিটি লেভেলে উঠে সিনিয়ার আপু, ম্যাডাম বা সিনিয়ারদের গার্লফ্রেন্ডের উপরে ক্রাশ খাওয়া আজকাল ছেলেদের ট্রেন্ড হয়ে গেছে মে বি। ওদের আলোচনা শুরুই হয় কোন সিনিয়ার আপুকে কি ড্রেস পড়লে বেশি সুন্দরী দেখায় সেই বিষয়ে। সেসব তো তোমার কানে আসে না, কানে আসে আমার। এই সামান্য ব্যাপারটাও ব্যাখ্যা না করলে বুঝতে পারো না? না শুনেই 'তুমি সবসময় আমাকে সন্দেহ করো, ওভার প্রজেসিভ' এসব বলে রাগ করে চলে আসবা, কল, মেসেজ, ফেইসবুক সব ব্লক করে দিবা, আবার নিজেই ফেইক আইডি খুলে মেসেজ দিয়ে চেক করবা অন্য কারো সাথে রিলেশনে জড়াই কি না রাইট?
-তোমরা ছেলেরা সত্যিই ভিষণ খারাপ। খুব খারাপ। আর সবচেয়ে বেশি খারাপ তুমি। তখন কথাগুলো না বলে আজাইরা রাগ দেখাও বলেই তো আমারও রাগ উঠে।
-জি, আমি রাগ দেখাই, কজ আমি তোমাকে নিয়ে সত্যিই ভিষণ প্রজেসিভ। কেউ তোমার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকালেও আমার মাটিতে পুঁতে ফেলতে ইচ্ছে করে। এর মধ্যে তুমিও যদি অন্য কারো সাথে মিষ্টি হেসে কথা বলো তাহলে রাগটা কি স্বাভাবিক নয়?
-নিজের রাগটাই সব, আর আমি রাগ করলই মহা অপরাধ।
-জি ম্যাডাম। গুরুতর অপরাধ। আপনি আমাকে একটাবার সুযোগ দেন সরি বলার? বা কি হয়েছে সেটা ক্লিয়ার করার? আবার মনে মনে ঠিকই নিজেও সন্দেহ করেন। কি করছি, কোথায় যাচ্ছি, কার সাথে কথা বলছি-----।
-চুপ করো তো। আমি এমন কিছুই করি নি। ছাড়ো?
-তাই নাকি গো সুন্দরী? কিছুই যদি না করো তাহলে খোঁচা মারলে কেন নতুন কেউ এসেছে বলে? নতুন কেউ আসলে তোমাকে অনুষ্ঠান করে বিয়ে করে ঘরে তোলার জন্য এতো তোড়জোড় করতাম? এই যে এখন যদি বলি বিয়েটা করবো না, কারো কি কিছু বলার থাকবে? না কেউ জোর করে তোমার আমার বিয়েটা দিতে পারবে? বলো তো সুইটহার্ট?
-মা-মা-মানে! বিয়ে করবে না মানে কি?
-আরে ফ্যাক্টটা বলছি তোমাকে সোনাপাখি। আর এই যে মাসখানেক তুমি নিজে থেকে সরে গেলে আমার কাছ থেকে আমি কি পারতাম না অন্য কারো সাথে, অন্য কিছু নিয়ে মেতে থাকতে? তুমি কি ভেবেছ নুজাইফা আইডির একটা অচেনা অজানা মেয়ের সাথে রাতের পর রাত মেসেজিং করে তোমাকে ভোলার চেষ্টা করে নতুন কারো সাথে জড়ানোর চেষ্টা করছি? সম্পর্কগুলো শুধু নামেই হয়না তাহি। সম্পর্কে ভরসা, বিশ্বাস এই শব্দগুলোও ভিষণ জরুরি। তুমি রাগ করে থেকেও যে আমার সাথে ঠিকই যোগাযোগ করবে সেই বিশ্বাসটুকু আমার ছিল তাহি। আর সেজন্যই অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরেও তোমার একটা ছোট্ট টেক্সটের অপেক্ষায় থাকতাম। বা আমার টেক্সট দেখে তোমার রিপ্লাইয়ের----।
-আ'ম সরি স্নিগ্ধ। আমি আসলে বুঝতে পারি নি। বারবার মনে হচ্ছিল এতো সামান্য ব্যাপারে তুমি এতো রিএক্ট করো, সন্দেহ করো, ভবিষ্যতে হয়তো এই সন্দেহটা দূরত্বটা বাড়িয়ে তুলবে। তাই চেয়েছিলাম যাতে দূরে গিয়ে তুমি এই সন্দেহটা ভুলতে পারো।
-আমার সন্দেহ কমানোর চক্করে নিজেই আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করে দিলে? বাহ! চমৎকার!
-আ'ম রিয়েলি সো সরি।
-সরি টরি মানছি না। বিয়ের পর প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে, নিজের বউকে এভাবে একলা একরুমে পেয়েছি। একটা গানের কথা ভিষণ মনে পড়ছে বুঝলে?
-কি গান?
-ওই যে কি একটা গান আছে না? একেলা পাইয়াছি রে শ্যাম, এই নিথর বনে, আজ পাশা খেলবো রে শ্যাম। হা হা হা। দারুণ না গানটা? এই সিচুয়েশনের জন্য বেস্ট গান। পাশা খেলবে নাকি সুন্দরী?
-স্নিগ্ধ! একদম বাজে কথা বলবে না। কিসব বলো সবসময়? ছিহ!
-এ্যাঁই কি বাজে কথা বলছি হ্যাঁ আমি? আমার বউ, আজ সেজেছেও টুকটুকে লাল রাঙা বউ রূপে। প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে এলাম, বউকে একা পেলাম। কিছু তো পাওনা হয়েছেই নাকি? তার উপরে এতোগুলো দিন যে আমাকে বিনা দোষে শাস্তি দিয়েছ, সেটার ভরপাই ও তো করতে হবে তোমার নাকি?
-কিসের মধ্যে কি? সরো তো ছাড়ো? বিনা দোষে! হাহ!
-এই এই! কি বলতে চাও কি তুমি? কি অপরাধ দেখাও আমাকে তুমি। বলো বলো? বলতে না পারলে শর্ত চুপচাপ মেনে নাও মেয়ে। নইলে----।
-নইলে কি হ্যাঁ? ভয় দেখাও আমাকে?
-নইলে শ্বশুরবাড়িতেই থেকে যাবো। অথবা বাইরে সবাইকে গিয়ে বলে দিবো আমরা বিয়ে করেছি এক বছর হয়ে গেছে।
-স্নিগ্ধ! তোমাকে তো আমি------।
অন্যদিকে, স্নিগ্ধকে তাহিয়ার রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে সবার আড়ালে হুট করেই রুমে চলে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে অরণ্য। অনামিকা যে একটু রুমে এসেছে এটা অরণ্য খেয়াল করেছে। অনামিকা কোন একটা কাজে বারান্দায় গিয়েছিল। রুমে আসতেই অরণ্যকে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে দেখে অনামিকা একটু চমকে উঠলো। অরণ্যের ধীর পায়ে।ওর দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসাটা দেখতে পেয়েও যেন নিজের জায়গা থেকে এক পাও নড়তে পারছে না মেয়েটা। পা দুটো যেন বরফের মতো জমে গেছে। এই অনুভূতিটা কেন হচ্ছে কে জানে। এদিকে ভদ্রলোক এগিয়ে আসতে আসতে একদম অনামিকার সামনে এসে সামনে দাঁড়াতেই অনামিকার চোখের পাতারা আপনা আপনিই যেন একে অন্যকে জড়িয়ে বন্ধ করে নিয়েছে। ভয়ে মনে মনে যত দোয়া দূরুদ মুখস্থ আছে সবই আওড়ে যাচ্ছে অনামিকা। ভয়ে রীতিমতো হাত পা কাঁপছে অনামিকার। এর মধ্যেই গালে কারো আলতো হাতের স্পর্শ অনুভব করলো ও। আর সাথে মিষ্টি কয়েকটা শব্দ কানে এসে বাজলো।
-নিজের সবচেয়ে প্রিয় কিছুর ভাগ কাউকে দেয়া যায় না অনু। আমার সেরকমই একটা প্রিয় সম্পদ হলে তুমি। তুমি যেকোনো পরিস্থিতিতে আমার, তোমার এক চুলও ভাগ আমি কাউকে দিবো না। আমার, আমার, শুধু আমার তুমি।
২৮!!
"ওগো মনের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থেকো না,
ঘরের দুয়ারে এসো।
শুধু হৃদয় নদীর ঢেউ দিয়ে আজ,
চোখের জোয়ারে মেশো
ওগো মনের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থেকো না,
ঘরের দুয়ারে এসো।"
ছোট্ট একটা চিরকুটে লেখা কয়েকটা লাইন বারংবার আওড়াতে আওড়াতে একটু অন্যমনস্কই হয়ে গিয়েছিল অনামিকা। সামনে রাখা একটা শপিং ব্যাগ থেকে টুকটুকে লাল রঙা একটা ফ্লোরাল জর্জেট শাড়ি বের করে, ছোট্ট একটা হলুদ চিরকুটে লেখা কয়েকটা লাইন পড়ে বিছানার উপরেই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে অনামিকা। আজ দুপুরেই তাহিয়া আর স্নিগ্ধের বিয়ের ডেইট ফিক্সজড করা হয়েছে। ওদের বিয়ের ডেইট আরো এক মাস পরে ফাইনাল হয়েছে। স্নিগ্ধ শেষমেশ মুখ চুন করে বাড়ি ফিরার পর অরণ্যের সব কাজিনরাও বলতে গেলে শর্ট নোটিশেই বাড়ি ফিরে গেছে। একমাস পরে আবার তাহিয়ার বিয়ের জন্য সবাই একসাথে এসে হাজির হবে। পুরো বাড়িটা এক নিমিষেই যেন খালি হয়ে গেছে সন্ধ্যে নামতে নামতেই। সারাদিনের ব্যস্ততার ফাঁকে শূন্যতাটা টের না পেলেও রাতের ডিনারের পর রুমে একলা বসে শূন্যতাটা যেন গ্রাস করে নিতে শুরু করেছিল অনামিকাকে। এর মধ্যেই বিছানার উপরে রাখা শপিং ব্যাগ আর চিরকুটটা যেন আরো ভাবনার অন্ধকারে ডুবিয়ে দিচ্ছে অনামিকার।
-গিফ্টে শাড়ি পাওয়ার পর একটা মেয়ে যদি ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে গেলে কি ভেবে নিবো বলুন তো ম্যাডাম? গিফ্ট আপনার পছন্দ হয়নি? নাকি গিফ্ট দেয়া লোকটাকেই আপনার মনে ধরে নি? নাকি দুটোই অপছন্দের বলে কি করে পিছা ছুটাবেন ভাবছেন? বলুন বলুন?
অরণ্যের কথাগুলো শুনে ধ্যান ছুটতেই অরণ্যকে সামনে বসা দেখে থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো অনামিকা। অবশ্য অরণ্য ততক্ষণে অনামিকার একটা হাত টেনে অনামিকাকে আবার বিছানার উপরে বসিয়ে দিয়েছে। অনামিকা থতমত খেয়ে অরণ্যের দিকে তাকাতেই অরণ্যও ভ্রু কুঁচকে অনামিকার ভাবুক মুখটার দিকে তাকালো। মেয়েটা কি এতো ভাবছে সেটাই অরণ্যের মাথাতেও ঘুরপাক খাচ্ছে এবার।
-কি হলো অনু? এনি প্রবলেম? এমন মন মরা হয়ে বসে আছো? কিসব ভাবছ তখন থেকেই? কি ব্যাপার বলো তো?
-হুম? কই কিছু না। ওহ শিট! বেলকনিতে কাপড়গুলো রয়ে গেছে। আনতে ভুলে গেছি একদমই। আমি এক্ষুণি আসছি।
-আরে অনু?
অনামিকা নিজের কথাটা শেষ করেই বিছানা থেকে নেমে বারান্দার দিকে ছুটেছে। অরণ্যও পিছু পিছু এসে বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে অনামিকার ব্যস্ত হাতে কাপড়গুলো নেয়া দেখলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অনামিকা সবগুলো ধোয়া কাপড় নিয়ে রুমে এসে বিছানার উপরে রেখে ধীর হাতে গোছাতে শুরু করলো। অরণ্য ভ্রু কুঁচকে অনামিকার এমন চুপচাপ কাজটা দেখলো মিনিট খানেক। তারপর নিজেও অনামিকার মুখোমুখি বসে কাপড়গুলো ভাঁজ করা শুরু করলো। অরণ্যও কাপড়গুলো ভাঁজ করা শুরু করায় অনামিকা একটু অবাক হয়ে অরণ্যের হাত থেকে কাপড়টা টেনে নেয়ার চেষ্টা করলো। অনামিকা অরণ্যের হাত থেকে কাপড়টা নিবেই, আর অরণ্য ছাড়বেই না। রীতিমতো টানাটানি অবস্থা যাকে বলে।
-আরে কি করেছেন? আমি গুছিয়ে রাখছি তো। আপনার করা লাগবে না।
-দুজনে মিলে কাজটা করতে তো প্রবলেম নেই অনু? আর এমনও তো না যে কাজটা তোমাকেই করতে হবে, বা একাই করতে হবে? তাই না? দুজনেই গুছিয়ে রাখি, সময়ও বাঁচবে, তোমাকেও একটু হেল্প করা হবে।
-না না। আমার হেল্প লাগবে না। বেশি সময় তো লাগবে না। ছাড়ুন না?
-ওকে। তুমি এটা ভাঁজ করতে চাইছ তো? নাও। আমি অন্য কিছু ভাঁজ করছি। নো প্রবলেম। এই বেডশিটটা আমি সেট করছি, তুমি কাপড়গুলো ভাঁজ করো তাহলে---। আরে অনু? কি হলো?
-আউ! উফ!
অরণ্যের হাতে থাকা কাপড়টা অনামিকা ছাড়ছে না দেখেই ছেড়ে দিয়ে বেডশিটটা হাতে নিয়েছে অরণ্য। এদিকে হঠাৎ করে ছেড়ে দেয়ায় বাতাসের ঝাপটায় কাপড়ের একটা কোণা এসে হালকা ঝাপটা লাগলো অনামিকার চোখে। অরণ্য তাড়াতাড়ি হাতের বেডশিটটা ফেলে অনামিকার দিকেই ছুটে এলো। অনামিকার মুখটা দু হাতের আঁচলায় তুলে ধরে অনামিকার দিকে এগিয়ে এসে অনামিকার বাঁ চোখটায় ফুঁ দিতে শুরু করেছে অরণ্য। কাপড়ের হালকা ঝাপটা লাগায় বাঁ চোখটা কেমন দপদপ করতে করতে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল অনামিকার। অরণ্যের উষ্ণতায় অস্বস্তিটা কেটে যেতেই অনামিকার খেয়াল হলো অরণ্য একদম এগিয়ে এসে প্রায় মিশে গেছে অনামিকার সাথে। এতোটা কাছে চলে এসেছে দুজন যে দুজনের উষ্ণ নিঃশ্বাসগুলো একে অন্যের সাথে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে বারবার। অনামিকা একটু বিব্রত হয়ে সরে আসার চেষ্টা করার আগেই অরণ্যের ঈষৎ উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করলো নিজের চোখের পাতায়, ঠোঁটের কোণে। আর সেই ছোঁয়ায় কিছুক্ষণ মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে নিজের সমস্ত ঘোর কাটিয়ে অরণ্যকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিল অনামিকা। হঠাৎ ধাক্কাটায় যেন বাস্তবে ফিরে এসেছে অরণ্য। অরণ্য একটু পিছিয়ে এসেছিল অনামিকার বাঁধা দেয়ায়। চোখে মুখে বিস্ময় নাকি বিব্রত ভাব লোকটার সেটা মুখ তুলে দেখারও যেন সাহস নেই অনামিকার।
-কি হলো অনু? এনি প্রবলেম?
-আমমমম। আমার-আমার রুমটা গোছানো হয়ে গেলেই আমি রান্নাঘরে চলে যাবো।
-হোয়াট! রান্নাঘরে চলে যাবে মানে? ওয়েট? তুমি আবার ফ্লোরে---? অনু আর ইউ ম্যাড? কিসব বলছ?
-এই রুমে থাকারও তো কথা ছিল না অরণ্য। আপনার কাজিনেরা এতোদিন ছিল বলেই তো এই রুমটায় থাকা। ওদের সামনে যেন কোনো সিনক্রিয়েট না হয় তার জন্যই তো এতোগুলো দিন আমাকে রুমটায় সহ্য করেছেন। এখন তো আর সহ্য করার প্রয়োজন নেই। আমাকেও তো নিজের জায়গায় ফিরতে হবে।
-এই মেয়ে? নিজের জায়গায় ফিরতে হবে মানে কি? এই ঘরটা তোমার না? শুধু গেস্ট এসেছে বলে এই রুমটায় তুমি থাকছ? নইলে থাকতে না?
-থাকার প্রয়োজন হতো কি?
-অনু?
-মানিয়ে নেয়া আর মেনে নেয়া দুটো আলাদা জিনিস অরণ্য। কারো প্রতিদিনের অভ্যেস হয়ে যাওয়া আর না চাইতেও তাকে সহ্য করে নেয়া এই দুটোও আলাদা ব্যাপার।
অরণ্য এবারে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলো। তারপর সোজা অনামিকার মুখোমুখি হয়ে বসে চোখে চোখ রাখলো।
-কি চাইছ কি তুমি অনু? আমার কোনো কাজে তোমার মনে হয়েছে তোমাকে মন থেকে মেনে নিই নি? নাকি এমন কিছু করে ফেলেছি যাতে তোমাকে চাই না এমনটা মনে হচ্ছে তোমার? বলো প্লিজ অনু?
-বিশ্বাসটা একটা সম্পর্কের জন্য অনেক বড় একটা ব্যাপার অরণ্য। সম্পর্কে যখন বিশ্বাস ভরসা এগুলে না থাকে তখন হাজার ভালোবাসলেও কমতি থেকেই যায় অরণ্য। আপনি হয়তো রিশাদের কথাগুলো বিশ্বাস না করে আমাকেই সাপোর্ট করেছেন সেদিন। কিন্তু বলুন তো? রিশাদের কোন কথাই কি আমার বুকের ভিতরে আলোড়ন তোলে নি? সাহিলকে নিয়ে আমাকে নিয়ে প্রশ্নের জাল তৈরি হয়নি আপনার মনে একবারের জন্যও?
-আবার ওই লোকটার নাম কেন অনু? আই জাস্ট কান্ট টলারেট দা নেইম। তবু কেন বারবার তোমার ওই নামটাই মুখে আনতে হয়? তোমার জীবনে আগে কে ছিল কি ছিল আমার জানার প্রয়োজন নেই। কেন ছিল, কেন চলে গেছে তার কিচ্ছু আমি জানতে চাই না, কখনো প্রশ্নও করবো না। শুধু তোমাকে চাই অনু। তোমার অতীতে কে ছিল, কেন ছিল আমার জানার ইচ্ছে নেই। শুধু তোমার বর্তমানে, ভবিষ্যতে আমি থাকতে চাই অনু।
-সত্যিটা জানার আগেই মুখ ফিরিয়ে নিলে পরে সত্যি যখন সামনে আসবে তখন ফেইস করবেন কি করে? জানা আপনার প্রয়োজন হোক না হোক সবটা বলা আমার প্রয়োজন। এবং সবটা শোনার পরই নাহয় সিদ্ধান্ত নিবেন আমি আপনার অভ্যেস হবো, নাকি বোঝা------। আহহহহহ।
অনামিকা কথাটা শেষ করার আগেই অরণ্য অনামিকার হাতটা টেনে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে। অরণ্যেরা রাগে টকটকে লাল রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে নিজের হাতে ব্যথা পাওয়ার অনুভূতিটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভুলে গেল বেচারি।
-কেন রে? কেন অনু? সবসময় ওই একটা নামেই কেন তুমি আটকে যাও? কি চাও টা কি তুমি? তোমাদের ভালোবাসার রঙিন গল্প শুনে 'ওয়াও! হাউ কিউট লাভ স্টোরি' এই কমপ্লিমেন্ট দিই এটাই চাও তুমি? নাকি তোমাদের ব্রেকআপের সিনে "সো স্যাড" বলে মুখ ছোটো করে বসে থাকি, এই রিএকশন চাও? কোনটা? যেটা চাও সেটাই রিএক্ট করবো নো প্রবলেম। বাট ওই নামটা আমার সামনে আর মুখে নিবে না। না তুমি, না তোমার ফ্যামেলি, ফ্রেন্ডস, না কেউ। ওই নামটা তোমার দুনিয়ার কোনো একটা কোণাতেও আমি রাখতে চাই না। কি চাও কি বলো তুমি? কি করতে হবে ওই লোকটাকে ভুলতে বলো?
-কিছু চাই না। শুধু চাই আপনি ভালো থাকুন। ভালো থাকাটা আমি আশেপাশে থাকলে না পান, তাহলে আমি দূরে গেলেই নাহয় ভালো থাকুন।
-জাস্ট হোয়াট ডিড ইউ সে? আমার ভালো থাকা চাও তুমি? আমি কিসে ভালো থাকি সেটা সবাই বোঝে, শুধু তুমি ছাড়া। এই যে বাচ্চাগুলো এতোগুলো দিন পাগলামি করে গেল, ওরাও জানে আমি কিসে ভালো থাকি। মা, বাবা, তাহিয়া, এমনকি আমাদের পরিবারের কেউ না হয়েও ফারহা, ওই মেয়েটাও জানে আমি কিসে ভালো থাকি। একমাত্র তোমারই আমার ভালো থাকা বা থাকায় কোনো পার্থক্য হয় না।
-ওহ আচ্ছা। এর জন্যই তো ফারহাকে বাড়িতেই এনে রেখেছেন। ও তো সব জানে। কিসে আপনার ভালো, কিসে খারাপ। আমি তো কিছুই জানি না। তাহলে আমার থাকা আর না থাকা তো সমানই। আপনার ওই ফারহাকে নিয়েই থাকুন আপনি। আমি গেলাম।
-কি বললে তুমি? আরেকবার বলো?
অরণ্যের রাগী কণ্ঠস্বরটা শুনে অনামিকা চুপ করে বিছানায় পড়ে থাকা অগোছালো কাপড়গুলো গোছাতে শুরু করেছে। অরণ্যও রাগে রীতিমতো পাগল হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে ধরে দুটো থাপ্পড় লাগাতে। বহু কষ্টে নিজের রাগটা হজম করার চেষ্টা করলো অরণ্য। একটা কথা বোঝালে আরেকটা বোঝে এই মেয়ে। এর শিক্ষা তো ওকে দিতেই হবে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই একনজর অনামিকার দিকে তাকিয় নিজের মোবাইলে কারো নাম্বারে কল করলো অরণ্য। অনামিকাও কান খাড়া করে অরণ্যের রাগে ভারী গলায় বলা কথাগুলো শুনলো।
-রুমে আসো। এক্ষুণি।