আয়াত তামিমকে (তনয়ার মেজ দাদাভাই) দেখে রাগে চোখ গরম করে ফেলল। তামিমও যে, আয়াতকে দেখে কম অবাক হয়েছে তা কিন্তু না। আয়াত তামিমকে কিছু বলতে যাবে এর মধ্যে তনয়া তামিমকে দেখে বলল,
__মেজ দাদাভাই! তুমি আসছো?
তনয়ার মুখ থেকে মেজদাদাভাই শব্দটা শুনে আয়াত কিছুক্ষন তব্ধ হয়ে যায়। সেই কলেজ লাইফ থেকে তামিম আর আয়াতের দা কুমড়োর সম্পর্ক। যাকে আয়াত দু চোখের পাতায় দেখতে পারতো না আর আজ সেই কিনা তার ভাই যাকে আয়াত নিজের হৃদয় বানিয়ে ফেলছে। আয়াত উপর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছে,
__হে আল্লাহ এ কেমন পরীক্ষায় ফেললে? এমনিতে কি আমার আর তনয়ার মাঝে কম সমস্যা ছিলো যে, নতুন করে তামিমকে পাঠালেন? এমনিতেই আমাদের ঘরের লোক বিশেষ করে মা তনয়াকে মানবে কিনা তা নিয়ে এতটা টেনশনে ছিলাম। তার মধ্যে তানভীর গত কাল করা প্রশ্ন দুটোর উত্তর খুঁজছি। তনয়ার পরিবারের সাথে তনয়ার সম্পর্ক কবে ঠিক হবে আর কবেইবা আমি তনয়াকে পাবো এত সব টেনশনে মধ্যে আবার তামিম!
বাকি সব সমস্যার সমাধান করতে পারলেও তামিমের বিষয়টা কি করে সমাধান করবো? তামিম কখনো তনয়ার সাথে আমার সম্পর্ক মেনে নিবে না। ও যদি তনয়াকে আমার উপর বিষিয়ে দেয়। তাহলে কি আমি তনয়াকে হারিয়ে ফেলবো? না না আমি বেঁচে থাকতে তনয়াকে হারাতে পারবো না। মাত্র অল্প কদিনেই তনয়া আমার অস্তিত্বে মিশে গেছে। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।
হঠাৎ রশ্মির ডাকে ধ্যান ভাঙলো আয়াতের। তনয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে তামিম তনয়ার সাথে কথা বলছে,
__মেজদাভাই মাফ করে দাওনা?
__আমি তোর উপর রাগ করিনি কিন্তু বাবা খুব কষ্ট পেয়েছে। সেদিন ওভাবে বাবাকে কষ্ট না দিলেও পারতি? তোর কারণে বাবার কত অসম্মান হল। রিসাদের বাবা ভালো মানুষ দেখে সবার সামনে কোন ধরনের সিনক্রিয়েট করেনি কিন্তু বাবাকে ফোনে কিন্তু অনেক কথা শুনিয়েছে।
তোর এমন কাজ করা ঠিক হয়নি ছুটকি!
__মেজদাভাই বিশ্বাস কর আমার কাছে আর কোন পথ ছিলো না।
_তানভী বলল, মেজদাভাই এখন এসব বলার সময়? কোথায় তুই এতদিন পর তনয়ার সাথে দেখা করছিস ওর ভালো মন্দ খবরা খবর নিবি তা না করে পুলিশের মত জেরা করছিস।
(আয়াত মনে মনে বলছে, সে আক্কেল তোমার মেজদাদা ভাইয়ের কখনো ছিলো না। কখন কোথায় কি বলতে হয় সেটা এখন জানেনা। সবসময় ভাবে ঐ সঠিক বাকি দুনিয়ার লোক ঘাস খায়। আহম্মক, গর্দভ কোথাকার!
আয়াতের সব চেয়ে বেশি অবাক লাগছে এটা ভেবে তামিমের মত বদরাগী ছেলেটা আয়াতকে দেখে এখনও কোন ধরনের সিনক্রিয়েট কিভাবে না করে পারলো! চিল্লাপাল্লা করাতো তামিমের প্রধান স্বভাব। নাকি মনে মনে কোন ফন্দি আটছে। কথাটা ভাবতেই আয়াতের চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট ফুটে উঠল। কারন তামিম যদি মনে মনে একবার শয়তানি ফন্দি আটে তবে সেটা ভয়ংকর রূপ ধারন করে।
যেমনটা কলেজে থাকতে আয়াতের সাথে করছিলো। তামিমের রাগের ফলস্বরূপ আয়াতকে টানা তিনমাস বিছানায় কাটাতে হয়েছিলো। সাথে ভেঙে গেছিলো আয়াতের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার স্বপ্ন। আসলে আয়াত আর তামিম ক্লাসমেট ছিলো। কিন্তু কোন একটা কারনে দুজনের সম্পর্ক সাপে নেউলের মত।)
তামিম তনয়ার হাত ধরে বলল,
__স্যরি ছুটকি। আসলে তুই তো জানিস আমি ঠিকভাবে কথা বলতে পারিনা। কখন কোথায় কি বলতে হয় সেটা জানিনা। কি অবস্থা তোর এখন?
__হ্যাঁ ভাই ভালো। তুমি কেমন আছো? মা-বাবা, ভাবি, তৃপ্তি কেমন আছে সবাই?
__হ্যাঁ সবাই ভালো আছে। তোর কি অবস্থা নিজের এ কি অবস্থা করছিস? ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করিসনা নাকি?
__না দাদাভাই ঠিক আছি। কিন্তু তুই কি করে এলি?
__তানভী বলল, আমি বলছি, আসলে দুপুরে যখন রশ্মি আমায় ফোন দিছিল, তখন মেজদাভাই আমার রুমে ছিলো। তখন তোর কথা শুনে আমার সাথে আসছে।
__ওহ।
__তানভী আয়াতকে উদ্দেশ্য করে বলল, আয়াত ভাইয়া ইনি আমার মেজদাদা ভাই। আর মেজদাভাই আয়াত ভাইয়ার অফিসেই তনয়া জব করে। রশ্মিও সেখানে জব করে।
__আয়াত তনয়ার জন্য নিজের রাগ পানি করে হাসি মুখে তামিমের দিকে হ্যালো বলে হাত বাড়ালো।
__তামিমও আয়াতকে না চেনার ভান ধরে আয়াতের সাথে হাত মিলালো।
তারপর তানভী ডাক্তারের সাথে কথা বলে সব বুঝে নিলো। তামিম আগেই চলে গেছে। ওর কিছু কাজ ছিলো। কিন্তু যাবার আগে তামিম আয়াতের সামনে এসে মৃদু স্বরে বলে গেলো, কি ভাবছিস সব ভুলে গেছি? নো ওয়ে! ছোট ভাই বোনের সামনে কোন সিনক্রিয়েট করতে চাইনা। তাই চুপ ছিলাম? বিষয়টা তানভী আর তনয়া খেয়াল না করলেও রশ্মি ঠিকই খেয়াল করেলো। এসব কথা শুনে রশ্মির মনে হাজারো প্রশ্নের দানা বাঁধতে লাগলো। কিন্তু তানভী আর তনয়ার সামনে বসে কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। তবে আয়াতের মুখে ভয়ের ছাপটা স্পষ্ট দেখতে পেলো।
১২!!
তনয়াকে নিয়ে বাড়ি আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আয়াত তনয়াকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে চলে গেলো। আসার সময় তনয়াকে বলে গেলো, সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যেনো অফিস না যায়।
কেন জানি তামিমকে দেখার পর আয়াতের খুব ভয় করছে। বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি তনয়া ওর থেকে দূরে চলে গেলো। তামিমের জেদ আয়াত খুব ভালো করে জানে। যদি তানভী, তনয়া আর তনয়ার বড় ভাইকে তামিম আয়াতের বিষয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলে? তখন কি হবে? নাহ, আয়াত ভাবছে যতদ্রুত সম্ভব তানভী, তনয়া আর তানভিরকে ওর আর তামিমের ভিতরের সমস্যা বলতে হবে। নয়তো তামিম কি না কি বলবে তার ঠিক নেই। ফলস্বরূপ আয়াত বরাবরের মত তনয়াকে হারিয়ে ফেলবে। আয়াত ভয়ে বারবার আল্লাহকে স্মরন করতে ছিলো।
তানভী তনয়াকে রাতের খাবার খাইয়ে বিছানায় শুয়ে দিয়ে নটার মধ্যেই বাড়ি থেকে বের হলো। আজ রাত বারোটায় তনয়ার জন্য অনেক বড় সারপ্রাইজ প্ল্যান করছে। সেসব কিছুর কাজ তো করতে হবে।
আর এদিকে আয়াত তামিমের টেনশনে তনয়ার জন্মদিনের কথাও বেমালুম ভুলে গেলো।
রাত ১১:০০
আয়াত বিছানায় বসে কিছু ফাইল দেখছে। কিন্তু টেনশনে কাজে খেয়াল দিতে পারছেনা। এত টেনশন জাস্ট নিতে পারছেনা আয়াত। অথচ যখনই তনয়ার কথা ভাবে আয়াতের মুখে প্রসস্ত একটা হাসি ফুটে। আর তখন নিজেই নিজেকে বলে তনয়ার জন্য সব টেনশন অনায়াসে সহ্য করতে পারবো। আয়াত নিজেই নিজের ভাবনায় অবাক হয়, কারন মাত্র কদিনে কিভাবে ও তনয়াকে পাগলের মত ভালোবেসে ফেললো সেটা নিজেও বুঝতে পারছেনা। মনে হয় তনয়াকে ছাড়া নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। তনয়ার জন্য হাসতে হাসতে সব কিছু করতে পারবে। আয়াত নিজের বুকে হাত রেখে বলল, আই লাভ ইউ তনয়া।
এর মধ্যে রুমে মেঘা এসে বলল,
__কি ভাবছিস ভাই?
__কিছুনা। তুই ঘুমাসনি?
__নাহ্। তুই আমার হবু ভাবির জন্য কি গিফ্ট আনলি সেটা দেখতে আসলাম।
__গিফ্ট কেন?
__কী? ভাইয়া কালকে না ভাবির জন্মদিন? তুই তো গতকাল বললি তনয়া আপুর জন্মদিন উপলক্ষে তোকে তার ভাই দাওয়াত করছে?
__ওহ সীট। আসলে আজকে সারাদিনের টেনশনে আমি তো ভুলেই গেছিলাম। আমি তো কিছু আনিনি রে!
__সম্পর্ক শুরু হবার আগেই জন্মদিন ভুলে যাচ্ছিস? না জানি সম্পর্ক হলে কি করিস!
__এত কথা না বলে তনয়াকে কি গিফ্ট দিবো সেটা বল?
__ভাই তুই কি রাত বারোটার সময় গিয়ে উইশ করবি?
__নারে। এত রাতে গেলে যদি অন্য কিছু ভাবে? তার থেকে বরং ফোনে উইশ করে দিবো। কাল বিকালে গিয়ে নাহয় গিফ্ট দিবো। তুইও যাবি আমার সাথে।
__আচ্ছা।
এদিকে তানভী নিজের প্ল্যানমত সব কাজ গুছিয়ে ফেলল। আয়াতও হাতে ফোন নিয়ে ঘড়ির দিতে তাকিয়ে আছে। বারোটা বাজলেই ফোন দিবে তনয়াকে।
—————
রাত ১২:০১
তনয়ার ফোনে সুন্দর কিছু ভিডিও, একটা ড্রেস আর দুটো শাড়ির পিক আর লম্বা একটা মেসেস আসল।
তনয়াকে কতক্ষন আগেই রশ্মি জাগিয়েছে। তনয়া আর তানভী কেবল একে অপরকে উইশ করবে তখনই তনয়ার ফোন টুং টাং করে উঠল। তনয়া শুধু মেসেস এর শেষটা পড়লো হ্যাপি বার্থ ডে। আর মেসেস গুলো আয়াত পাঠিয়েছে সেটা দেখল। পুরোটা পড়ার মত সময় পায়নি, বা কিসের পিক পাঠিয়েছে তাও দেখতে পারেনি। এর মধ্যে তানভী উইশ করল,
__শুভ জন্মদিন তনয়া!
__তনয়াও তানভীকে উইশ করল, শুভ জন্মদিন তানভী। তানভী তনয়ার চোখ চেপে ধরে রুম থেকে বাইরে ছাদে নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে চোখ ছাড়তেই দেখে পুরো ছাদ সুন্দর করে সাজানো। চারপাশে সুন্দর লাইটিং করা, আর টেবিলের মাঝখানে কেক রাখা। তনয়া তানভীকে কিছু বলতে যাবে এর মধ্যেই কেউ তনয়ার মাথায় হাত রাখলো। তনয়া তাকিয়ে দেখে ওর মা (নয়না মাহমুদ) ছল ছল চোখে তনয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মাকে দেখে তনয়া ঠিক কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। কারন পালিয়ে আসার এতদিন পর আজ প্রথম ওর মাকে দেখলো। ও যখন পালিয়ে এসেছিলো তখনকার থেকে এখনকার ওর মায়ের চেহারা অনেকটা নির্জীব লাগছে।
নয়নার চোখ দুটো বসে গেছে। হয়ত মেয়ের চিন্তায়। তনয়া নয়নাকে বলল,
__কেমন আছো মা?
নয়না নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। তনয়াকে জড়িয়ে ধরে তনয়ার সারা মুখে হাজারো চুমো এঁকে দিতে দিতে বলল,
__তুই কেমন আছিস মা? একি অবস্থা করেছিস নিজের? ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করিসনা নাকি? ওভাবে চলে আসলি! তারপর একবারও মায়ের খোঁজ নিলিনা? মা তার মেয়েকে ছেড়ে কিভাবে থাকে তা কি তুই বুঝতে পারিসনি? একবারও কি তোর মায়ের কথা মনে পড়েনি?
নয়নার মনে নিজের মেয়ের প্রতি জমে আছে শত অভিমান। তনয়া শুধু ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
__মাফ করে দাও মা। আমি বুঝতে পারিনি। আমি ভাবছি তুমিও বাবার মত আমার উপর রেগে আছো। ভাবছি তুমিও বোধয় বাবার মত আমায় ফিরিয়ে দিবে। তাই ভয়ে তোমার সামনে যাইনি।
__আরে পাগলী মা কি কখনো নিজের সন্তানের উপর রাগ করে থাকতে পারে? হ্যাঁ হয়তো ক্ষনিকের অভিমান হয় কিন্তু সেটা কিছু সময় পরই চলে যায়।
তনয়া আর কিছু বলেনা। চুপ করে মাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষন থেকে বলল,
__মা তোমার চেহারা এমন নির্জীব কেন হয়ে গেছে? ঠিকমত খাওয়া দাওয়া কি করনা?
__যার মেয়ে দিনের পর দিন বাইরে থাকে সে মা কি করে ঠিকভাবে খায় বলত?
__মা বাবা আসেনি?
তনয়ার প্রশ্নে নয়না চুপ হয়ে গেলো। কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। তনয়া আবার জিজ্ঞেস করল,
__মা বাবা কি আমায় আর ক্ষমা করবেন না?
তনয়ার মা চুপ করে আছে। পরিস্থিতি অনেকটা গম্ভীর হয়ে আছে।
এভাবে বেশ কিছুক্ষন থাকার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য তানভী বলল,
__বারে জন্মদিন কি খালি একা তনয়ার নাকি? আজ আমারও জন্মদিন।
তনয়া মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে মৃদু হেসে বলল,
__কিন্তু মা তুমি কিভাবে এলে?
__তানভী লুকিয়ে নিয়ে আসছে।
__তানভী বলল, কিরে সারপ্রাইজ কেমন লাগলো?
__তনয়া তানভীকে জড়িয়ে ধরে বলল, খুব ভালোরে। ঠিক তোর মত।
__যাক অবশেষে মানলি আমি ভালো। হা হা।
__তনয়ার মা বলল, তারাতারি তোরা কেক কাট তোর বাবা টের পাবার আগে যেতে হবে। এদিকে তনয়ার ফোনে ফোন দিয়ে তানভির, তামিম, লাবিবা (বড় ভাবি) আর তৃপ্তি (তানভিরের মেয়ে) তনয়াকে উইশ করছে। তনয়ার খুব ইচ্ছা করছে সবার সাথে মিলে কেক কাটতে যেমনটা এতটা বছর করে আসছে। কিন্তু আজ সবাইকে বড্ড মিস করছে। বুক চিড়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসল তনয়ার।
তারপর তানভী, তনয়া, ওদের মা আর রশ্মি মিলে কেক কাটলো। কেক কাটার পর তনয়ার মা তনয়ার কপালে চুমো খেয়ে বলল,
__যাইরে মা। কালকে বিকালে নাকি তানভী পার্টি দিচ্ছে, সেখানে তোর ভাইয়া ভাবি সবাই আসবে। আমি তো আসতে পারবো না। তুই নিজের খেয়াল রাখিস কেমন। আর ঠিকমত ঔষধ খাবি, নিজের শরীরের যত্ন নিবি, একদম টেনশন করবিনা। আল্লাহ্ সব ঠিক করে দিবে। আর আমাকে মাঝে মাঝে ফোন দিস।
__তনয়া ওর মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার কথায় হুম হুম করছে। এতদিন পর মাকে পেয়ে ওর ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করছেনা। মন চাইছে মায়ের কোলে মাথা রেখে অনেক গল্প করতে, ঘুমাতে। তনয়ার মা তনয়ার পছন্দের অনেক জিনিস রান্না করে নিয়ে আসছে। ইচ্ছা ছিলো তনয়াকে পুরোটা নিজ হাতে খাওয়াবেন কিন্তু সময় স্বল্পতার কারনে শুধু পায়েস টাকেই তনয়াকে খাইয়ে দিলো। রাত প্রায় পৌনে একটা বাজে তখন তনয়ার থেকে বিদায় নিয়ে তানভী ওর মাকে নিয়ে চলে গেলো।
তনয়ার খুব কান্না পাচ্ছে। যার ঘর ভর্তি লোক অথচ তার জন্মদিন পালন হচ্ছে অনাথদেরমত। মা কে বিদায় দিয়ে রুমে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ল। তখনই তনয়ার ফোনটা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে আয়াত ফোন করছে। তনয়া চোখটা মুছে, গলাটা স্বাভাবিক করে ফোনটা রিসিভ করল, ওপাস থেকে বলে উঠলো।
__শুভ জন্মদিন তনয়া। এই দিনটি তোমার জীবনে শতবার আসুক। দোয়া রইল।
__ধন্যবাদ স্যার।
__গিফ্ট পছন্দ হয়েছে?
__ইয়ে মানে! স্যরি স্যার দেখার সুযোগ পাইনি। ফোন রেখেই দেখবো।
__আচ্ছা ঠিক আছে দেখো। স্যরি ফর লেট। আসলে তখন তুমি তোমার পরিবারের সাথে ছিলে তো, তাই তখন আমি বাইরের মানুষ হয়ে তোমাদের মাঝে ঢুকে চিরক্ত চাইনি। তাই যখন রশ্মি বলল, সবাই গেছে তখন ফোন করলাম।
(আয়াতের মুখ থেকে বাইরের লোক কথাটা শুনতে তনয়ার খুব খারাপ লাগছিল। কেন খারাপ লাগছিলো সেটা তনয়া নিজেও বুঝতে পারছিলো না। ওর মন খালি বলছিল, আয়াত স্যার মোটেও বাইরের লোক না। সে তনয়ার কাছের খুব কাছের। কিন্তু কতটা কাছের সেটা তনয়া বুঝতে পারছে না।)
__হ্যালো তনয়া চুপ করে গেলা কেন? কিছু বল? ঘুমিয়ে গেলা নাকি?
__জি না স্যার ঘুমাইনি, বলুন। আচ্ছা স্যার একটা প্রশ্ন করবো?
__হ্যাঁ অবশ্যই কর।
__আপনার কেন মনে হল, আপনি বাইরের লোক?
(কথাটা শুনে আয়াত কিছুক্ষন চুপ করে গেলো। কারণ তখন যখন নিজেকে নিজেই বাইরের লোক বলছিল তখন আয়াতের খুব খারাপ লাগছিল। তনয়া সেটা ধরে ফেলবে বুঝতে পারেনি)। নিজেকে সামলে বলল,
__আমি তো ঘরের লোকও নই। কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করলে?
__স্যার সত্যি বলব নাকি মিথ্যা বলব?
__মিথ্যা বলো!! (দুষ্টমি করে)
__তাহলে আপনি বাইরের লোক।
__আর সত্যি বললে কথাটা কেমন হত?
__সত্যি বললে বলতাম। হ্যাঁ এটা ঠিক যে, আপনি ঘরের লোক নন কিন্তু তা বলে আপনি কিন্তু বাইরের লোকও নন! সত্যি বলতে স্যার আমি কেন জানি আপনাকে বাইরের লোক ভাবতে পারছি না। আর যখনই আপনাকে বাইরের লোক ভাবতে যাই আমার ভিতর থেকে ঠেলে কান্না চলে আসে কেন জানি। আপনাকে হৃদয়ের খুব কাছের লোক মনে হয়। এমন কেন হয় স্যার?
তনয়ার এমন কথায় অনেক চমকে গেলো আয়াত। আয়াত ভাবছে, আচ্ছা তনয়া এমন কথা কেন বলল? তবে কি একটু একটু করে তনয়ার মনে আমার জন্য জায়গা তৈরী হচ্ছে! আয়াতের খুশিতে চিৎকার দিতে মন চাচ্ছে। কিন্তু নিজের খুশি দমিয়ে বলল, সেটা তোমার মন জানে আমি কি করে বলব? আচ্ছা শোন রাত অনেক হল এখন ঘুমাও। আর শোন বাড়ির সবাইকে মিস করে কান্না করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। তিনি সব ঠিক করে দিবে।
__জি স্যার আল্লাহই এখন একমাত্র ভরসা। দেখি তিনি কী করেন?
__হুম আল্লাহ ভরসা। যাও ঘুমাও। শুভ রাত্রি।
__শুভ রাত্রি স্যার।
১৩!!
রাত দেড়টা নাগাদ তানভী ওর মাকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছালো। বাড়ির দারোয়ানকে তানভী আগেই ঘুষ দিয়ে পটিয়ে রাখছিল। বাড়ির দরজা খুলে চুপচাপ বাড়ি ঢুকে তানভী নয়নাকে বলে মা রুমে গিয়ে চুপ করে ঘুমিয়ে পড়াবা, আমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছি। নয়না রুমে গিয়ে দেখে তনয়ার বাবা (তালিব মাহমুদ) চেয়ারে বসে আসে। নয়নাকে দেখে গম্ভীর গলায় বলল,
__এতক্ষন কোথায় ছিলে?
নয়না তালিব মাহমুদকে খুব ভয় পায়। তার কথা শুনলে ওর ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়। তার মধ্যে নয়না একদম মিথ্যা বলতে পারেনা। কোন মতে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
__রা----রা------রান্না ঘরে ছিলাম।
__এত রাত পর্যন্ত রান্না ঘরে কি করছিলা?
__কি-----কি ----- কিছু কাজ ছিলো।
__আমি তোমায় দু তিন ঘন্টা ধরে সারা বাড়ি খুঁজেও পেলাম না। সত্যি করে বল কোথায় ছিলা? (ধমক দিয়ে)
__নয়না মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।
__কী হল কথা বলছো না কেন? (আবার ধমক দিয়ে) নয়না তালিব মাহমুদের ধমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। এর মধ্যে তানভী বলে উঠল,
__বাবা মাকে নিয়ে আমিই একটু বাগানে ঘুরছিলাম। আমার মনটা ভালো লাগছিলো না তাই।
তানভী হয়ত আঁচ পারছিলো তাই রুমে না গিয়ে আবার মায়ের রুমে আসল।
তালিব মাহমুদ তানভীকে বলল,
__বাহ্ তুমিও দেখছি বোনের মত মিথ্যা বলা শিখে গেছ। জমজ তো তাই দুজনার আচরন প্রায়ই এক। সাথে তোমরা দুজন মিলে নিজের মাকেও মিথ্যা বলা শিখাচ্ছো। তাইনা? আজ তোমরা তনয়ার সাথে দেখা করতে গেছিলা তাই তো?
তালিব মাহমুদের কথায় বিরক্ত হয়ে তানভী বলল,
__যখন বুঝতেই পারছো তনয়ার সাথে দেখা করতে গেছিলাম তখন জিজ্ঞেস কেন করছো? তুমি তোমার মেয়ের জন্মদিন ভুলতে পারো, কিন্তু আমরা আমার বোনের জন্মদিন ভুলিনি।
__না ভুলিনি আজ সেই কুলাঙ্গার মেয়ের জন্মদিন যে কিনা নিজের বাবা মায়ের মুখে চুন কালী দিয়ে পালিয়েছে। যে কিনা নিজের বাবার মায়ের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।
__কে কার সম্মান নষ্ট করছে আর কে নিজের সর্বনাশ হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে তা খুব ভালো করে জানি। বাবা রাত অনেক হয়েছে এত রাতে কথা না বাড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর হ্যাঁ খবরদার মাকে এ বিষয় নিয়ে কোন কথা শুনাবে না। সে তোমার স্ত্রী তোমার কেনা দাসী না যে, তাকে তুমি যা ইচ্ছা তাই বলবে।
তানভীর এমন কঠিন কথায় তালিব মাহমুদ হতভম্ব হয়ে গেলেন। কারন আজ পর্যন্ত তার মুখের উপর তার কোন ছেলে মেয়ে সামান্য কথা বলেনি। তানভী রাগ করে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে নিজে নিজে বলে,
__ইদানিং সবসময় সব কথায় বোনকে টেনে এনে বকা দেয়। কেন বোন কি বকা শুনানোর ড্রাম নাকি! আসছে বিশিষ্ট ভদ্রলোক তালিব মাহমুদ ওরফে ডিজিটাল হিটলার।
১৪!!
তনয়া বিছানায় শুনে আয়াতের দেয়া মেসেটা পড়ে হেসে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলো কিন্তু আয়াতের দেয়া গিফ্টগুলোর পিক দেখে তনয়ার মুখটা কেন জানি গম্ভীর হয়ে গেলো।