নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ফোলা ফোলা চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছে আমানের। তবুও সময় বিলম্ব করেনি। ভোরের দিকে ঢাকায় পৌঁছে গেছে। নিরবকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়েছে। মিটিং শুরু হওয়ার দশ মিনিট আগেই অফিসে যেন আসে সেটাও জানিয়ে দিয়েছে। তারপর চলে যায় সোজা বাড়িতে। কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দেন অনামিকা রহমান। সারা রাস্তা নিজে ড্রাইভ করে এসেছে। একটুও ঘুমানোর সুযোগ হয়নি বলে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে আমানকে। অনামিকা রহমান অস্থির হয়ে বলেন,
"তুমি কাল রাতেই রওনা দিয়েছ?"
"হ্যাঁ।"
আমান ভেতরে যেতে যেতে প্রশ্ন করে,
"আব্বু কোথায়?"
"ঘুমাচ্ছে এখন। আমি রাতে আসতে বারণ করেছিলাম।"
আমান কোনো প্রতুত্তর না করে বাবা-মায়ের ঘরে যায়। বাবা আসিফ আহমেদকে একনজর দেখে ড্রয়িংরুমে ফিরে আসে। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে। অনামিকা রহমান কফি নিয়ে আসেন। আমান চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে বসে ছিল। মায়ের ডাকে চোখ মেলে তাকায়। এক গাল হেসে কফিটা হাতে নিয়ে মাকে পাশে বসায়। অনামিকা রহমান একটু রাগীস্বরেই বলেন,
"তুমি আমার কথা কেন শোনো না ইদানীং?"
"কোন কথা শুনিনি?" কফিতে চুমুক দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে আমান।
অনামিকা রহমানের রাগ হয়। আমানকে তিনি বকতে পারেন না। অনলের মতো আমান এত দুষ্টু নয়। অগোছালোও নয়। সবকিছু নিয়মমাফিক করে এবং বেশ গুছালো। তাই কখনোই আমানকে শাসন করার প্রয়োজন হয়নি। অনামিকা রহমান যে রাগ করেছে আমান বুঝতে পারে। মুচকি হেসে কফির মগ টেবিলের ওপর রেখে একহাতে মাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে মাথায় চুমু খেয়ে বলে,
"এত রাগ কেন হয়েছে আমার জানের?"
রাগ গলে পানি হয়ে যায় মায়ের। আমানের এক হাত নিজের হাতে নিয়ে চুমু খান। বলেন,
"এইযে সারা রাত ঘুম হয়নি। মাথা ব্যথা করবে না?"
"উঁহু! তবে করতো। এখন করবে না।"
"কেন করবে না?"
"এইযে আমার আম্মাজানের হাতের কড়া কফি খেয়েছি। মাথা ব্যথা এখন বাপ বাপ বলে পালাবে।"
তিনি হেসে ফেলেন। আমানের গালে হাত রেখে বলেন,
"কেন যে তোমার ওপর রাগ করে থাকতে পারি না!"
"সেই সুযোগ দিলে তো।"
"আমার রাজপুত্র।" কপালে চুমু খেয়ে বলেন তিনি।
আমান জিজ্ঞেস করে,
"তা তোমার ছোট রাজপুত্র কোথায়?"
"অনল তো সিলেটে গেছে।"
"কবে?"
"কাল সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। গাড়ি নাকি ছেড়েছে আরো রাতে।"
"আব্বু অসুস্থ অনল জানে?"
"নাহ্। তোমার আব্বু বলতে বারণ করেছে। অনেকদিন হলো ও তো কোথাও ঘুরতে যায় না। উনি অসুস্থ জানলে তো মাঝরাস্তায় থাকলেও ব্যাক করত।"
"ভালোই হয়েছে। একটু ঘুরুক। মন ফ্রেশ হোক। অফিসের মিটিং ও করতেও পারতো না।"
"ও তো বলেই দিয়েছে, অফিসের সব কাজ তোমার।"
"সে আমার ছোট নবাব ভাই বলে কথা!" বলে আমান ও মা দুজনই হেসে ফেলেন।
মায়ের সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে অফিসে চলে যায়। সকালের নাস্তা ওখানেই করবে। ঘুম না হওয়ায় একটু টায়ার্ড লাগছে। তবে মিটিং সাক্সেসফুল করবেই।
আলস্য শীতের সকালে নিহির ঘুম ভাঙে সকাল দশটা নাগাদ। তরু তখনো ঘুমাচ্ছে। আগের চেয়ে শীত এখন কমে এসেছে। তেমন শীত লাগছে না এখন। নিহি কিছুক্ষণ চোখ বুজেই শুয়ে থাকে। তারপর আমানের কথা মনে আসতেই বালিশের পাশ থেকে ফোন বের করে। আমানের দুইটা ম্যাসেজ এসেছে। একটা রাতে এবং আরেকটা সকালে। আমান ঢাকায় ফিরে গেছে জেনে ভীষণ খারাপ লাগছে নিহির। হুট করেই চলে যেতে হলো তাকে? প্রথম ম্যাসেজ দেখে মন খারাপ হলেও পরের ম্যাসেজটা দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে।
'শুভ সকাল মিষ্টি বউ।' ম্যাসেজটা বারবার পরে নিহি। আর মুচকি মুচকি হাসে। ফোনের রিংটোন বাজে। তরুর ফোন বাজছে। নিশ্চয়ই শিশির ফোন করেছে। তরুর ঘুম এখন কর্পূরের ন্যায় উড়ে যাবে। নিহি ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
দরজায় কড়াঘাত করছেন মামী। নিহি আর তরুকে ডাকছেন আর বলছেন,
"কীরে? আর কত ঘুমাবি? উঠ এবার।"
তরু তখন তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দিয়ে দরজা খুলে দেয়। মামী ঘরে প্রবেশ করে বলেন,
"নিহি কোথায়?"
"ওয়াশরুমে।" হাই তুলতে তুলতে উত্তর দেয় তরু।
"তুইও ফ্রেশ হ। সকালের নাস্তা কি দুপুরে খাবি?"
"আসছি যাও।"
মামী ঘর গুছাতে গুছাতেই নিহি ওয়াশরুম থেকে বের হয়। তারপর তরু ঢোকে। দুজনে একসঙ্গেই নাস্তা করতে আসে। টেবিলে এখন শুধু মামী আর লিমন। মামা সকালেই বাইরে চলে গেছেন। লিমনও মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। মামী খাবার সাজিয়ে দিচ্ছেন। তরু আর নিহি গোমড়ামুখে লিমনের সামনের চেয়ারে বসে। লিমন এক পলক তাকিয়ে খেতে খেতে বলে,
"মুখে কী হইছে তোদের?"
দুজনই নিশ্চুপ। লিমন তখন মামীর দিকে তাকিয়ে বলে,
"দেখছো ওদের? যুক্তি করে আসছে।"
মামী হাসেন। লিমন আবার বলে,
"কীরে কথা বলবি না?"
"না।" তরুর উত্তর।
"তুইও বলবি না?" নিহিকে প্রশ্ন করে সে।
নিহির উত্তরও,
"না।"
লিমন আর কিছু বলে না। চুপচাপ খায়। খাওয়া প্রায় শেষ হলে তখন বলে,
"যা দুজনই রেডি হয়ে নে।"
অবাক হয়ে দুজন ওর দিকে তাকায়। তারপর নিজেদের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে জিজ্ঞেস করে,
"কোথায় যাব?"
"জাফলং না যেতে চাইলি?"
নিহি ভেংচি কেটে বলে,
"না,এখন আর যাব না।"
"হয়েছে। আর রাগ দেখাতে হবে না। তোরা কি ভেবেছিস তোদের একা যেতে দেবো?"
তখন তরু বলে,
"একাও যাব না। তোমার সাথেও যাব না। আমরা যাবই না।"
লিমন ধমক দিয়ে বলে,
"বেশি কথা বলবি না। যা বলছি তাই কর। যা।"
আর কথা বাড়ানোর সাহস হয় না কারো। খাবার শেষ করে রেডি হতে চলে যায়।
_____________________
আড়মোড়া ভেঙে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় অনল। ভোরে সিলেটে পৌঁছেই ঘুম দিয়েছে। এখনো সবাই মরার মতো ঘুমাচ্ছে। কখন ঘুম ভাঙবে আর কখন যাবে? কিছুক্ষণ পায়চারি করে আবার ঘরে ফিরে আসে। মিলনের পিঠে আস্তে লাথি দিয়ে বলে,
"শালা ওঠ! আর কত ঘুমাবি?"
"দোস্ত আর একটু ঘুমাই!" ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে মিলন।
গায়ের থেকে লেপ টেনে সরিয়ে বলে,
"উঠবি নাকি পানি ঢালব? আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি। এসে যেন দেখি সবাই উঠেছিস। উঠ! লিসা, সুমু ওদের কল দিয়ে দেখ উঠেছে নাকি।"
এক রুমে ওরা তিনজন ছিল। অনল ফ্রেশ হতে চলে যায়। বাকি দুজন বসে বসে ঝিমায় কিছুক্ষণ। তারপর কল করে সুমাইয়াকে। ওরা-ও এখনো ঘুমাচ্ছে। সবাইকে তাড়াতাড়ি রেডি হতে বলে সাকিব কল কেটে দেয়। অনল ফ্রেশ হয়ে বের হলে ওরা-ও ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর সবাই একসঙ্গে খেয়ে প্রথমে চা বাগান দেখতে চলে যায়।
চা বাগানের প্রতিটি কচি সবুজ চা-পাতায় যেন মুগ্ধকর সৌন্দর্য। উঁচু নিচু পাহাড়ের গায়ে চা-পাতার চাষ। প্রতিটি পাতার ডগায় ডগায় শিশিরবিন্দু। পাহাড়ি মেয়েরা পিঠে ঝুড়ি বেঁধে পাতা সংগ্রহ করছে। অনল ক্যামেরা নিয়ে এসেছিল। এত সুন্দর দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দি করতে ভুলে না। কিছুক্ষণ চা-বাগানের ভেতর হাঁটাহাঁটি করে, সবাই মিলে ছবি তোলে। পাহাড়ি দোকানে একসঙ্গে ধোঁয়া ওঠা গরম চা পান করে। সবকিছুকেই বড্ড আপন আপন লাগছে অনলের। মনের ভেতর প্রশান্তি লাগছে। কাল রাত পর্যন্তও যেই অস্বস্তি, অস্থিরতা তাকে চেপে ধরেছিল আজ যেন সব চলে গেছে। মনে মনে দাম্ভিকতার সাথে হাসে অনল। নিহির থেকে নিজের মন ফেরাতে পেরেছে। শান্তি লাগছে। সিলেটে আসা বৃথা যায়নি একদম। বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে ভালোবাসা প্রকাশ করতে ইচ্ছে করছে। ওদের জন্যই তো নিহি নামক অস্বস্তি থেকে বের হতে পারল। চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস নেয় কিছুক্ষণ। এরপরের গন্তব্য জাফলং...
.
.
.
চলবে...................................