অস্তিত্বে তুমি - পর্ব ০৬ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


১১!! 

-হ্যালো সাদাফ? কোনো খবর বের করতে পারলি মিস্টার খন্দকারকে নিয়ে উনার চামচা শিহাব কোথায় গিয়েছিলেন? আবার নতুন কোনো একটা প্ল্যান চলছে ওই বদমাইশটার মাথায় আমি ড্যাম শিওর। কাকে কল করবি বললি যে সে কোনো নিউজ দিতে পারলো? ভাই চুপ করে থাকিস না প্লিজ? কিছু তো বল?

নীলাকে নিজের মোবাইলটা দিয়ে আর অপেক্ষা না করে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে নিহার। নীলা ফোঁপাতে ফোঁপাতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কয়েকবার জিহানের নাম্বারটা ডায়েল করেও বারবার ক্যানসেল করে দিয়েছে। জিহানকে কল করাটা কতোটা যুক্তিযুক্ত সেটাই নীলার মাথায় ঢুকছে না। যে জিহানের উপস্থিতি আজো প্রতিরাতে স্বপ্নের মতো ওর সমস্ত শরীর আর স্বত্তা দিয়ে টের পায়, সেই লোকটাই নিজের মামার সাথে মিলে এতো কিছু ষড়যন্ত্র করবে ব্যাপারটা মানতে নীলার কষ্ট হচ্ছে। বাবার বলা কথাগুলো ভুল হোক এটাই মনে প্রাণে প্রার্থনা করছে নীলা। যে শিহাবকে নীলার আশেপাশে একটা সেকেন্ডের জন্যও জিহান সহ্য করতে পারে না, হুটহাুট রেগে যায় যে লোকটার নাম শুনে, সেই শিহাবের সাথেই নিজের বিয়ে করা বউয়ের বিয়ে হতে চলেছে সেটা জানার পর জিহানের রিএকশনটা কি হবে সেটা চিন্তা করতেই করতেই কখন জিহানের নাম্বারে কল চলে গিয়েছিল নীলা খেয়ালই করে নি। মোবাইলটা হালকা ভাইব্রেট হওয়ায় নীলা কলটা রিসিভ হয়েছে টের পেয়ে মোবাইল কানে তুলে ধরতেই অপরপ্রান্ত থেকে জিহানের বলা কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল নীলা। জিহানের লোকেরা বাবা আর শিহাবকেও ফলো করছে? তাহলে বাবার আর শিহাবের কথাগুলো সব সত্যি ছিল? 

-হ্যালো, সাদাফ? কিছু তো বল প্লিজ? জানিস তো কি পরিমাণ টেনশনের মধ্যে আছি? একে তো খন্দকারদের সাথে টেন্ডারটা নিয়ে ঝামেলা চলছে। তার উপরে নীলা! মেয়েটা এতো বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বসে আছে! উফ! একটা কথা যদি আমার শোনার চেষ্টা করে। কি করে যে ওকে বোঝাই আমি!  আহহহ! আর এই শালার শিহাব! ওকেই কোনদিন শুট করে দিই আমি দেখিস। শালা এতো গন্ডগোল করে আমার সব প্ল্যানিং এ! আমি বুঝি না আমি নীলাকে নিয়ে যাই প্ল্যান করি ওই লোকের কাছে তার খবর পৌঁছে যায় কি করে! ডিজগাস্টিং!

-সো স্যাড মিস্টার জিহান! এবারও তাহলে ওই শিহাবই আপনার পাকা ধানে মই দিল রাইট? আপনার কাছে যেমন বাবা আর শিহাব কোথায় যাচ্ছে, কি করছে তার খবর পৌঁছে যায়, তেমনি সেইম জাদুটা শিহাবেরও আছে বুঝলেন। তাই আপনার এতো এতো প্ল্যানিং সব মাঠে মারা যায় বারবারই।

-নীল? নীল? তুমি? এটা? এটা কার নাম্বার? আমি তো ভাবলাম আমার ফ্রেন্ড কল করেছে? নীল? হ্যালো? আর ইউ দেয়ার? প্লিজ টক টু মি প্লিজ? নীল?

-কিছু বলার জন্য কল করিনি, একটা প্রশ্ন করবো বলে কল করলাম। ঠিক ঠিক আনসার দিবেন প্লিজ?

-নীল? আজ পর্যন্ত এমন কখনো হয়েছে তুমি কিছু জানতে চেয়েছ আমি আনসার করি নি? বরং প্রতিবার উল্টোটা ঘটে। তুমি রাগ করে গাল ফুলিয়ে রাখো। আর আমার তোমাকে সিচুয়েশনটা এক্সপ্লেইন করতে হয়, কি করেছি, কেন করেছি। তাই না বলো?

-ওকে। এবার তাহলে আপনার এই আফসোসটা যেন না হয় সেটাই করছি। আপনি বলুন তো কি চান কি আপনারা? ভালোবাসেন না, তবু কেন এমন করছেন? শুধুই আমার পরিবারকে কষ্ট দেয়ার জন্য? নাকি বিজনেসের রাইভাল পার্টি বলে তাদেরকে কম্পিটিশন থেকে সরাতে যতটা নিচে নামা যায় তার থেকেও নিচে নামতে পারেন আপনি আর আপনার মামা?

-নীল? আর ইউ ক্রেজি? কিসব বলছ? এসব আজাইরা কথা তোমার মাথায় কে ঢুকাচ্ছে বলো তো? ওই শিহাব রাইট? ওকে যদি আমি সামনে পাই তাহলে! আহহহহ! শোনো জান? নীল? তোমার ফ্যামেলির সাথে আমার রাইভাল পার্টির জন্য শত্রুতা নয়। অনেক ব্যাপার আছে যা তুমি জানো না। ইভেন বললেও বিলিভ করবে না তোমার ফ্যামেলির কারণে আমার জীবনে কি ভয়ংকর ঝড় ঘটে গেছে। 

-ওরা আপনার সাথে বা আপনার ফ্যামেলির সাথে কি করেছে আমি জানি না। কিন্তু যাই করে থাকুক একটা লিগ্যাল প্রসেসে সেটার বিচার চাইতে পারতেন আপনি। তা না করে নিজের মামার সাথে মিলে এই নোংরা পলিটিক্স করছেন আপনিও? ছিহ জিহান! যে লোকটা স্টুডেন্ট পলিটিক্সে জড়িত থেকেও নিজের আদর্শ থেকে কখনো পিছু হটে নি, সে কিনা নিজের রাইভাল পার্টির সাথে টেন্ডারে জিতার জন্য স্পাই লাগাচ্ছে তাদের পিছনে! বাহ!

-আমরা সবসময় যা দেখি তাই যদি সত্যি হতো তাহলে কি ভালোই না হতো তাই না নীল? সেদিন চোখের সামনে যা দেখলে সেটাকেই সত্যি মেনে বিয়েটা ক্যানসেল করে দিয়ে ভালো আছো তো? 

-আমার প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু আমি এখনও পাই নি মিস্টার জিহান চৌধূরী।

-আমার মামা মামী কি চায় সেটা নাহয় বাদ দাও নীল। তোমাকে প্রথমবার দেখার পর থেকে প্রতিটা মূহুর্তে আমি শুধু তোমাকে চেয়েছি নীলা। তোমার ছেলেমানুষি, পাগলামিগুলোকে নিজের বুকে করে আগলে রাখতে চেয়েছি প্রতিটা দিন। এখনও চাই, আজীবন চাইবো। আর রইলো বিজনেসে আর রিভেঞ্জের ব্যাপারটা। সেদিন কলেজে তোমাকে না দেখলে বা তোমার বাচ্চামি স্বভাবে এভাবে জড়িয়ে না গেলে এতোদিনে তোমার বাবা আর ভাই দুজনের কেউই বেঁচে থাকতো না।

-জিহান!

-সুইটহার্ট তুমি জানতে চেয়েছ তাই বললাম কথাটা। শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা এক বিন্দুও মিথ্যে নয় নীল। তোমাকে ভালোবাসি বলেই তাদেরকে ক্ষমা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি আমি। যতবার নিজের অতীতটা সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে ততবার নিজের উপরে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছি। বাট বিলিভ মি, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি যাতে আমার কারণে তোমার ফ্যামেলির কিছু না হয় এটা শিওর করতে। 

-স্টে এওয়ে ফ্রম মাই ফ্যামেলি জিহান। আমার বাবার, ভাইয়ার বা ভাবির কারো কোনো ক্ষতি করবেন না আপনি প্লিজ।

-উমমমমম। ওকে। করবো না। তুমি আমার কাছে ফিরে এসো। আর ওদের কাউকে নিয়েই মাথা ঘামাবো না আমি প্রমিস। আমার শুধু তুমি হলেই এনাফ।

-যে লোকটা আমার পরিবারটাকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে তার জীবনে ফিরে যাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়াই বেটার আমার জন্য। 

-নীল! কাজটা কিন্তু ঠিক করলে না। যে কোনো মূল্যে তোমাকে আমার হতেই হবে। তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী আশা করি কথাটা মনে আছে তোমার। বোকার মতো ভেবো না ম্যারেজ রেজিস্ট্রি পেপার তোমাকে ফেলে দিতে দিয়ে দিয়েছি। এতোটা গাধাও আমি নই।

-বিয়ে নিয়েও নাটক করবেন এবারে? সবার কাছে আমার পরিবারকে আর কত নিচে নামাবেন জিহান?

-উমমম। নিচে নামাবো কেন জান? আমার বউকে তার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে আসার প্ল্যান করছি। কতোদিন আর বউকে ছাড়া একাএকা থাকা যায় বলো তো? এতোক্ষণে খবরটা তোমার বাবার কানে পৌঁছে গেছে রাইট? তা শ্বশুরমশাই কি বলছে? আমার বউকে নিয়ে আসতে দিবে তো? বরযাত্রী নিয়ে আসবো কালকে? আবার বিয়ে করে নিয়ে যেতেও আপত্তি নেই আমার। তাহলে আগেই কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করার ব্যাপারটা কেউ জানতেও পারবে না। কি বলো নীলপাখি?

-কক্খনো না। যে মেয়ের সাথে ফার্মহাউজে ছিলেন তাকেই বিয়ে করে ঘরে তুলুন। একটু হলেও তাহলে আপনার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে। 

-ওহো! বউ দেখি জেলাস! ওফ! এই নীল? এখন একটু ভিডিও কলে আসো না প্লিজ? আমার বউটার জেলাসিভরা মুখটা দেখি একটু।

-আহহহহ। 

-এই এই এই নীল? হঠাৎ কল করলে কেন সেটাই তো বললে না? রাগ করে তো নিজের মোবাইল ভেঙ্গে বসে আছো। এটা কার মোবাইল? ভাবির? নাকি আবরার ভাইয়ের?

-সেটা জেনে আপনার লাভ কি? যে কারণে কল করেছি সেটা আপনাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করছি না। লোক লাগিয়েছেন না বাবা আর শিহাবের পিছনে? ভাইয়ার পিছনেও লাগিয়েছেন নিশ্চয়ই? তাদের খবর দেয়ার জন্যই অপেক্ষা করুন নাহয়।

-চ্যালেঞ্জ করছ মেয়ে? তোমার বাবা উল্টোপাল্টা কোনো প্ল্যান করলে এই মূহুর্তে তোমাকে গিয়ে তুলে আনতে পারি এটা জানো তুমি? কাজটা ভালো দেখাবে না আমিও জানি। বাট আমার বউকে আমার কাছ থেকে দূরে সরাতে চাইলে তোমার বাবার সম্মানের কথাও ভাবার কথা খেয়াল থাকবে না, কথাটা মাথায় রাখবেন সুইটহার্ট।

-রাখছি আমি। 

-এই নীল নীল নীল? শোনো না? 

নীলা জিহানের আর কোনো কথা না শুনেই কলটা কেটে দিল। জিহানও হেসে নিজের কাজে মন দিলো। কিছু একটা তো ঘটেছে আর নীলাদের বাড়িতে। সেটা জানতে আপাতত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে? 

দুটো দিন কেটে গেছে দেখতে দেখতেই। ঘরোয়াভাবে ছোটোখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে নীলা আর শিহাবের বিয়ের। আত্মীয় স্বজন বলতে নীলার বাবা, ভাই, ভাবি আর অফিসের কয়েকজন স্টাফ। টকটকে লাল বেনারসি পড়ে নীলা নিজের রুমেই পায়চারি করছে। গত দুদিনে জিহান না নিজে এসেছে না তার কোনো কল। লোকটা নীলার বিয়ের কোনো খবর না পায় এর জন্য সবরকম ব্যবস্থা করেছে বাবা। তাহলে কি আসলেই নীলা আর শিহাবের বিয়ের ব্যাপারটা জানে না জিহান? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দরজার নকের শব্দে চমকে উঠলো নীলা। দরজার ওপাশ থেকে আসা শব্দগুলো কেমন ভয়ের কাঁপন ধরালো নীলার শরীর আর মনে। জেগে থেকেও নীলার মনে হচ্ছে এর চেয়ে বড় কোনো দুঃস্বপ্ন বুঝি এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই।

-নীলামা কাজীসাহেব চলে এসেছে। এবার যে আমাদেরকে যেতে হবে মা?

১২!! 

-আমার সাথে বিয়ে হওয়া স্বত্বেও নিজের মেয়ের আবার নতুন করে বিয়ে দিচ্ছেন কোন আইনের বদৌলতে বলতে পারেন মিস্টার আফসান খন্দকার? তাও আবার যেখানে আমরা লিগ্যালি ম্যারেড সেটা জানার পরও আমার ওয়াইফকে জোর করে নিজের বাড়িতে আটকে রেখেছেন, আবার আমাকে না জানিয়ে তার বিয়েও দিয়ে দিচ্ছেন, এর শাস্তি কি হতে পারে সেটা জানেন?

আফসান খন্দকারের কথা শুনে নীলা ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে ড্রইংরুমে এসে গুটিশুটি হয়ে একটা সোফায় বসে ছিল নীলা। পাশের অল্প কয়জন মানুষ গুনগুন করে কি নিয়ে এতো কথা বলছে সেটা নীলার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। মুখোমুখি সোফায় বসা কাজী সাহেবের করা প্রশ্নগুলোও যেন কান পর্যন্ত আসছে না নীলার। তাই হয়তো ড্রইংরুমের ভিতরে গুঞ্জনটা আরো বাড়ছে মিনিটে মিনিটে। কাজী সাহেব আরেকবার নীলাকে কবুল বলার জন্য প্রশ্ন করতেই হুট করে ড্রইংরুমটায় পিন পতন নিরবতা নামলো। আর তার মিনিট খানেকের মাথায় জিহানের বলা কথাগুলো শুনে নীলা চমকে মুখ তুলে তাকাতেই জিহানকে কাজীর পাশেই সোফায় বসা দেখে চমকে উঠলো আরেকবার। জিহান আফসান খন্দকারের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল।

-কি ভেবেছিলে নীল? তুমি বা তোমার বাবা, ভাই, ভাবি কেউ কিছু না বললে আমি জানতে পারবো না তোমার বিয়ের ব্যাপারটা? দুটোদিন আমি শুধু তামাশা দেখেছি আর কি কি করতে পারে তোমার বাবা আর ভাই, ওই চিটারটার সাথে মিলে। আর তুমি? ওরা কেউ জানুক, বা না মানুক, তুমি আমার ওয়াইফ, তুমি কি করে পারলে এই টকটকে লাল বেনারসি সেজে বিয়ে করতে বসে পড়লে? ভাবতে পারো নি না আমি চলে আসবো যে রাইট? শিহাবের সাথেই বিয়ে করতে রাজিও হয়ে গেলে? একবারও মনে পড়ে নি আমাদের 'কবুল' বলার মূহুর্তটা? 

-জিহান? একদম নাটক করবি না এখানে। এখানে একটা শুভ কাজ হচ্ছে। এন্ড ইউ আর নট ইনভাইটেড হেয়ার। আর আমাদের মেয়ের কার সাথে বিয়ে দিবো সেটা নিয়ে তোকে কৈফিয়ত দিতে আমি বা বাবা কেউ বাধ্য নয়।

-ওহ রিয়েলি? আমার ওয়াইফকে তোমরা অন্য কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে আর আমি কিছু বলতেই পারবো না? ভারি মজার তো ব্যাপারটা? আচ্ছা কাজীসাহেবই বলুক শুনি। একটা মেয়ের হাজবেন্ড জীবিত থাকতে অন্য একটা লোকের সাথে বিয়ে দেয়া যায়েজ হলো কবে থেকে? আমাদের তো ডিভোর্সও হয়নি যে তোমরা নীলার উপরে নিজেদের অধিকার দেখাচ্ছ!

-তোর এসব ফেইক ডকুমেন্ট, ফেইক সার্টিফিকেট এখানে কোনো কাজে লাগবে না জিহান। জাস্ট গেট লস্ট। নইলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো।

-নীল? আমাদের ম্যারেজ রেজিস্ট্রির কথা তোমার বাবা আর ভাইয়াকে বলো নি? সো ব্যাড নীল। আর মিস্টার আবরার, ডকুমেন্টগুলো আসল না নকল সেটা নীলাকেই জিজ্ঞেস করে দেখ। আশা করি বিয়ের ডেইটটা ভুলে যায় নি নীলা।

-জিহান! আর একটাও বাজে কথা বলবি না।

-ডোন্ট শাউট মিস্টার আবরার। পুলিশ আর মিডিয়ার কাছে এই পেপারগুলোর কপি দিলে তারা লুফে নিবে এটা জানিস? তখন মান সম্মান কোথায় থাকবে বল তো? একে তো আরেকজনের বউকে জোর করে বিয়ে দেয়ার দায়ে জেলে যাবি, আর মিডিয়ায় ইজ্জত নিলামের কথা তো বাদই দিলাম। বাট হাজার হোক শ্বশুরবাড়ির এতো অসম্মান করতে চাইছি না। নীল? চলো তো? এসো? গাড়ি সাজিয়েই নিয়ে এসেছি তোমাকে নিয়ে ফিরবো বলে।

-জিহান? স্টে এওয়ে ফ্রম হার। নীলা তোর সাথে যাবে না। আর তোর এসব মিথ্যে বিয়ের গল্প নিজের কাছেই রাখ। বের হয়ে যা এখান থেকে।

আবরার এগিয়ে এসে জিহানের একটা হাত ধরে টেনে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার জন্য উদ্ধত হয়েছে এমন সময় প্রায় বিশ বাইশজন লোক কোথা থেকে এসে সবাইকে ঘিরে ধরেছে। সবার হাতেই হয় কোনো না কোনো অস্ত্র থাকায় অসিফ স্টাফরা সব ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছে। জিহান আবরারের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে এসে নীলার সামনে এসে দাঁড়ালো। জিহানের দু জন লোক এসে শিহাবকে টেনে নীলার পাশ থেকে সরিয়ে আনতেই জিহান ধপ করে নীলার পাশে বসে পড়লো। বাকি লোকগুলো সবাইকে ঘিরে রেখেছে। পুরো ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটেছে যে নীলা, আবরার, আফসান সাহেব, শিহাব বা নিহার কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারে নি। বিস্ময়ের দমক কাটতে নীলা নিজের সোফা ছেড়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতেই জিহান নীলার একটা হাত চেপে ধরে আবার নিজের পাশেই টেনে বসিয়ে দিলো।

-এতোক্ষণ ওই হারামিটার পাশে বসে বসে তামাশা দেখছিলে, তখন তো কোনো অসুবিধা হয়নি। এখন যেই আমি তোমার পাশে এসে বসলাম ওমনি উঠে পালাচ্ছ? চুপচাপ এখানে বসে থাকো নীলা। তোমার বাপ ভাইয়ের সাথে ডিলটা শেষ করি, তারপর আমার সাথে বাড়িতে যাবে। ততক্ষণ পর্যন্ত একটা কথাও না। গট ইট?

-কি চান টা কি আপনি? যখন ইচ্ছে এসে বলবেন বিয়ে করা বউ, যখন ইচ্ছে আরেকটা মেয়ের সাথে----।

-আর একবার যদি ওই ঘটনাটা টেনে আনো তাহলে কষে দুগালে দুইটা থাপ্পড় লাগাবো নীলা। ভালোবেসে নম নম করে বুঝাতে চাইছি তো তাই মাথায় চড়ে বসেছ না? কথা শোনার ধৈর্য্য যদি না থাকে তাহলে চুপ করে কান বন্ধ করে বসে থাকো। অযথা তোমার ফ্যামেলির মতো কথা প্যাঁচাবে না একদম। তোমাকে চাই, তার মানে এই নয় যে তোমাদের এসব আলতু ফালতু বিহেভিয়ার মেনে নিবো আমি। আর আজ যা করেছ সেটার পানিশমেন্ট তো বাড়িতে গিয়ে পাবে। এখানে নতুন করে আরেকটা সিনক্রিয়েট করিও না আমাকে দিয়ে।

-আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না। বুঝতে পেরেছেন আপনি? আর দুদিন পরে আপনি যে নিজের মামার কথায় আবার নতুন নাটক করবেন না তার গ্যারান্টি কোথায়? বিজনেসের নাম করে রীতিমতো গুন্ডামি শুরু করেছেন। আপনার এই লোকগুলোকে না এক্ষুণি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে বলুন। নইলে খুব খারাপ হয়ে যাবে জিহান।

-আমি তে জোর করতে আসি নি। তোমার বাবার কাছ থেকে টেন্ডারের ফাইল চুরি করতেও আসি নি। আমি আমার বউকে নিয়ে যেতে এসেছি। আর আমার কাজে যে বাধা দিবে তাকে সোজা উপরে পাঠিয়ে দিবো। বুঝতে পেরেছ? 

-ছাড়ুন আমাকে? 

-নীল? তুমিও এখন বিয়ের ডকুমেন্টগুলোকে নকল, ফেইল, জাল এসব বলে উড়িয়ে দিচ্ছ নাকি? ওকে ফাইন। সবাই যখন এখানেই আছে, কাজী সাহেবও আছেন, তাহলে আরেকবার বিয়েটা করে ফেলা যাক কি বলো? কাজীসাহেব? আপনি নতুন করে বিয়ে পড়ানো শুরু করুন তো। পাত্র বদলে যাবে শুধু। আমি, জিহান চৌধূরী, বাবা মৃত-----।

-আমি মরে গেলেও এই বিয়েটা করবো না মিস্টার জিহান।

নীলার কথাটা শুনে জিহান রাগী চোখে একবার নীলার দিকে তাকিয়ে আফসান খন্দকারের দিকে একনজর তাকিয়ে নিজের একজন লোককে কিছু একটা ইশারা করে আবার নীলার দিকে তাকালো।

-তুমি মরে গেলে তো এমনিতেও বিয়েটা করতে পারবে না নীল। তাছাড়া বউই মরে গেলে আমার লাভটা কি? এরচেয়ে অন্য কেউই মরুক। কি বলো?

-মানে? কা-কার? কার কথা বলছেন আপনি? প্লিজ এমন কিচ্ছু করবেন না আপনি।

-আমি তো কিছুই করবো না জান। যা করবে ওরাই করবে। হেই সাদিক? আমার শ্বশুরমশাই সবটা জেনে শুনেও কেমন চুপ করে আছে দেখতে পাচ্ছ? বাবার লাড়লি মেয়ে তো? বাবার অনুমতি ছাড়া বিয়েতে মত দিচ্ছে না বুঝলে? কি করা যায় বলো তো? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া?

সাদিক নামের লোকটা বিভৎস একটা হাসি দিয়ে হাতে ধরা ছুরির তীক্ষ্ণ ফলাটা দিয়ে আফসান খন্দকারের হাতে আচমকা একটা টান বসিয়ে দিতেই নীলা আঁতকে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বাবার দিকে ছুটে যাওয়ার আগেই জিহান নীলার হাতটা টেনে ধরে আটকালো। নীলা রীতিমতো কাঁদতে কাঁদতে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। জিহান অবশ্য সেটাকে মোটেও পাত্তা না দিয়েই কাজীসাহেবের সাথে নিচু গলায় কথা বলছে। আবরারকেও দু তিনজন লোক মিলে চেপে ধরে রেখেছে। তবু আবরার নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে চলেছে। আফসান খন্দকারের হাতের কাটা অংশটা দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝড়ার দৃশ্যটা নীলা আর আবরার দুজনকেই পাগল করে তুলেছে যেন। নীলা এবারে রাগে জিহানের কোটের কলার খামচে ধরে সোজা চোখে চোখ রেখে তাকালো জিহানের দিকে।

-কি চান টা কি আপনি? মেরে ফেলতে চান তো আমাকে? মেরেই ফেলুন। একবারেই শেষ করে দিন। তবু আমার পরিবারকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিন প্লিজ?

জিহান শান্ত দৃষ্টিতে এবারে নীলার কান্নাভেজা মুখটার দিকে অপলকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নিজের কোটের কলারটা নীলার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রুমে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের ভীত সন্ত্রস্ত মুখগুলোর দিক থেকে একনজর চোখ বুলিয়ে নিল জিহান।

-শাস্তি তো তুমি পাবেই নীল। তবে এতো সহজ শাস্তি? নো ওয়ে। তুমি মরবে, তীলে তীলে মরবে, এতো সহজে মুক্তি পাবে ভেবেছ? উঁহু। বাট এখানে নয়। আমার বাড়িতে। যেখানে আরো কতোগুলো মানুষ একটু একটু করে শেষ হয়ে গেছে শুধু তোমার ফ্যামেলির কারণে। তোমার এই ভাইয়ের কারণে, বাবার কারণে। তাদের প্রতিদিনের হাহাকারগুলো তোমার গলা চিড়ে বের না হওয়া পর্যন্ত তো তোমার মুক্তি নেই নীলা। কি ভেবেছিলে কি? কলেজের একটা বখাটে, গুন্ডা, মাস্তান তোমার প্রেমে পড়ে জেন্টেলম্যান হতে পারলে আবার তোমার দেয়া ধোঁকায় সে আগের রূপে ফিরতে পারবে না? এখন তুমি ঠিক করো। আমার সাথে যাবে? নাকি জেদ করে বসে থেকে সবার মৃত্যুর কারণ হবে। 

-আমি-----।

-সাদিক? ম্যাডামের মে বি সিদ্ধান্ত নিতে একটু প্রবলেম হচ্ছে। এদিকে শ্বশুরমশাইও কিছুতেই অনুমতি দিচ্ছেন না। কি করা যায় বলো তো?

সাদিক নামের লোকটা রক্তাক্ত ছুরিটা আবার তুলে আফসান খন্দকারের দিকে এগিয়ে নিতেই নীলা ছুটে গিয়ে আফসান খন্দকারের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে চিৎকার করলো নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে।

-আমি রাজি, আমি রাজি, আমি রাজি। পাপাকে কিচ্ছু করবেন না প্লিজ? আপনার সব কথা আমি মানতে রাজি প্লিজ? কাউকে কিচ্ছু করবেন না প্লিজ?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন