সংসার - পর্ব ০১ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০১!! 

অনামিকার উপরে রাগ দেখাতে গিয়ে ভাতের প্লেটটা টেবিলের উপর থেকে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের রুমে চলে এসেছে অরণ্য। রাগটা তখনো শান্ত হয়নি অরণ্যের। তাই খেয়াল করে নি কখন ওর পিছন পিছন আরেকজনও এসে দাঁড়িয়েছে রুমের দরজায়। অরণ্যের দিকে মানুষটা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। এই কি সেই অরণ্য যে ছেলেটা অনুর সাথে বিয়ের কথাটা পাকা হওয়ার খুশিতে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছিল? এই কি সেই অরণ্য যে কিনা সবার বারণ স্বত্বেও অনুদের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল শুধু এক নজর অনুর গায়ে হলুদে রাঙা মুখটা দেখবে বলে? এই ছেলেটাই কি সেই আগের হাসিখুশি অরণ্য যে কিনা বিয়ের আসরে প্রায় সবার হাসি তামাশার পরেও অবাক চোখে নতুন বউটার রাঙা মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল? এই কি সেই অরণ্য তিনবার 'কবুল' বলতে গিয়ে যে ছেলেটার গলা বুজে আসতে চাইছিল প্রিয় মানুষটাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পাওয়ার আবেগে? অথচ এখন? এতো সহজে সামান্য কয়েকটা দিনের ব্যবধানে একটা ছেলে কি করে এতোটা বদলে যেতে পারে? এতোটা পাগলের মতো ভালোবাসা একেবারেই কি করে মুছে যেতে পারে কারো মন থেকে? কোথাও কি ভালোবাসার ছিঁটেফোঁটাও বাকি নেই?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অরণ্যের একদম পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন অরণ্যের মা, তাইয়্যেবা জামান। অরণ্য তখনো নিজের রাগ সামলাতে পারছিল না বলে দেয়ালে সজোরে একটা ঘুষি বসিয়েছিল। কাজটা করার এক মিনিটের মাথায় গালে ঠাস করে একটা চড় এসে লাগায় চমকে তাকালো অরণ্য। মাকে দেখে নিজেকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করলো অরণ্য। বুদ্ধি হওয়ার পর আজ জীবনে প্রথমবার মা যে ওর গায়ে হাত তুলেছে সেই ব্যাপারেও অরণ্যের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। আর তাইয়্যেবা জামানও অরণ্যের গালে কষিয়ে চড় মেরে নিজেই থ হয়ে গিয়েছিলেন। তাই ছেলেকে কি বলবেন সেটা ঠিকই করতে পারছিলেন না। অনুর জন্য যেমন কষ্ট হচ্ছে, তেমনি নিজের ছেলেটাকেও এভাবে একটু একটু করে বদলে যেতে দেখে কষ্ট হচ্ছে তাইয়্যেবা জামানের। এদিকে অরণ্য একটু হাসিহাসি মুখ করে মায়ের দিকে তাকালো। 

-মা? তুমি এতো রাতে এখানে? এখনও ঘুমাও নি কেন? উফ মা! এতো রাত জেগে থাকলে শরীর খারাপ হবে না তোমার? এভাবে ছেলেমানুষি করলে চলে বলো তো? শরীর খারাপ করে বিছানায় পড়ে থাকতে ভালো লাগবে বলো তো?

-অরণ্য? তুই এতো রাত করে বাসায় ফিরবি আর আমি কিনা মা হয়ে শান্তিতে ঘুমাবো? আজকাল তো মাঝরাতের আগে বাসায়ও আসিস না তুই। সকালেও সেই কাকডাকা ভোরে বেরিয়ে যাস বাসা থেকে। কার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াস এভাবে বাবা? আমাদের কাছ থেকে? নাকি তোর নিজের কাছ থেকে? এভাবে প্রতিদিন নামমাত্র কয়েক ঘন্টা ঘুমালে তোর শরীর খারাপ হবে না বল?

অরণ্য মায়ের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের গলা থেকে টাই খোলার জন্য হাত বাড়িয়েছে ততক্ষণে।

-মা আমি ঠিক আছি। আর কারো কাছ থেকে পালাতে চাচ্ছি না আমি। আমি শুধু স্পেসিফিকলি কারো সামনে পড়তে চাই না। তাই সবাই ঘুমিয়ে গেলে আসি। আর সবাই জেগে ওঠার আগেই বেরিয়ে যাই। এসবে অরণ্য চৌধূরীর কিছু হয় না মা। তুমি এতো টেনশন করো না তো।

-বউমাকে এভাবে আর কতো কষ্ট দিবি বল তো অরণ্য? এবার কি সব মিটমাট করে নেয়া যায় না? শুধুশুধু মেয়েটাকেও কষ্ট দিচ্ছিস, নিজেও তো তুই কষ্ট পাচ্ছিস বাবা।

-দয়া করে ওই মেয়েটার কথা আমার সামনে বলবে না মা। আর বউমা বউমা করবে না তো সারাদিন। ও এই বাড়িতে শুধু একটা পরিচয়েই থাকে। আর সেটা হলো ও এই বাড়ির কাজের মেয়ে। শুধুই কাজের মেয়ে। আর কিচ্ছু না। এর বাইরে ওই মেয়েটার আর কোনো পরিচয় না এই বাড়িতে আছে, আর না আমার জীবনে। বুঝতে পেরেছ? 

-অরণ্য?

অরণ্য টাইটা খুলে শার্টের স্লিভস ফোল্ড করতে করতে টাওয়াল হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে থেমে গেল। আবার মায়ের থতমত খাওয়া মুখের দিকে তাকালো। অরণ্যের কথায় তাইয়্যেবা জামান কেমন একটা দিশেহারা হয়ে গেছেন। ছেলের এতো বেপরোয়া আচরণ এর আগে কখনো দেখেননি তিনি। তাই হয়তো মানতে পারছেন না।

-এভাবে রুডলি কথা বলার জন্য সরি মা। বাট প্লিজ মা তুমি এসব কথা আমার সামনে আর বলো না। প্লিজ মা। 

-দিন দিন কি তুই অমানুষ হয়ে যাচ্ছিস অরণ্য? মেয়েটা তোর বিয়ে করা বউ। আমরা সবাই মিলে কতো হাসি আনন্দ করে ওকে এই বাড়ির বউ করে এনেছি। সেটা কি তোর এভাবে ওকে কাজের মেয়ে বানিয়ে দেয়ার জন্য? 

-পুরোনো কথা না তোলাই ভালো মা। ওর বাবা মা ও নিজেদের ঘাড়ের বোঝা আমাদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে লিটারেলি পালিয়ে গেছে। ওকে তো সেদিন একেবারের জন্যেই ওই বাড়িতে পাঠিয়েই দিয়েছিলাম আমি। উনারাই তো হাতে পায়ে ধরলো যাতে কাজের মেয়ের মতো ঘরের একটা কোণে ঠাঁই দেয়ার জন্য? তোমরাও তো দরদ দেখিয়ে রেখে দিলে বাড়িতেই। এতো তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলে মা?

-অরণ্য? তুই কি সত্যি আমার ছেলে? এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে আমি? একটা মেয়ে, শুধু একটা মেয়ে বলছি কেন? তোর বিয়ে করা বউ হয় মেয়েটা। ওকে তুই এভাবে কষ্ট দিবি কেন? বাড়িতে একটা কুকুর বেড়াল থাকলেও মানুষ তার সাথেও এতোটা খারাপ ব্যবহার করে না যতটা তুই অনামিকার সাথে করিস। এতোটা পাষাণ কি করে হলি তুই? তাও এই ফুলের মতো মেয়েটার সাথে----?

-মা প্লিজ? আমি শাওয়ার নিয়ে ঘুমাবো। প্রচন্ড টায়ার্ড লাগছে। সকালে আবার অফিসে যেতে হবে আমার। 

-সেই তো। তোকে কি কিছু বলা যাবে? তুই তো নিজের মন মর্জিই চালাবি সবসময়। আমার আর কি? প্রতিদিন চোখের সামনে মেয়েটার কষ্ট দেখতে দেখতে আর সহ্য হয় না আমার। আমিও তো মা। কি করে মেয়েটার এতো-----?

-কষ্ট? কার বলো তো মা? তোমার ওই সো কলড পুত্রবধূর? হা হা হা। হাসালে মা। গত তিন মাস ধরে যে হারে আগলে রেখেছ তাতে ও যে রীতিমতো ঘরের মালকিন হয়ে বসে আছে সেটা তো সহজেই বোঝা যায়। নইলে আমার জন্য প্লেট সাজিয়ে বসে থাকার অধিকার সামান্য একটা কাজের মেয়ে পায় কি করে তুমিই বলো?

-অরণ্য?

তাইয়্যেবা জামান এতোক্ষণ নিজেকে সামলে রাখতে পারলেও এবারে যেন তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। ফলস্বরূপ দ্বিতীয়বারের মতো অরণ্যের গালে ঠাস করে চড় কষালেন। চড়টা গালে পড়তেই অরণ্যের চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো এক মূহুর্তের জন্য। মায়ের এমন ব্যবহার অরণ্য কেন জানি মানতে পারছে না ও। সম্ভবত যেমনটা অরণ্যের এমন কঠোর ভাবটা তাইয়্যেবা জামান মানতে পারছেন না। অরণ্য নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো আবার।

-ওই মেয়েটা তোমার কতোটা ব্রেইন ওয়াশ করেছে বুঝতে পারছ মা? নিজের ছেলের গায়ে হাত তুলতেও আজ তোমার একটুও কষ্ট হলো না। একবারের জন্য হাতটা কাঁপলো না তোমার। তোমার নিজের ছেলের চেয়েও এই কাজের মেয়েটাই আজ তোমার কাছে আপন হয়ে গেল তাই তো? ওকে। ঠিক আছে। আমি আর কিছুই বলবো না তোমাকে। তোমাদের যা ইচ্ছে হয় করো। যত ইচ্ছে হয় মাথায় তুলে রাখো ওই মেয়েকে। আমি কিছুই বলবো না আজকের পর। 

-অনু আমার ব্রেইন ওয়াশ কি করবে? হ্যাঁ? কি করে করবে? আমি কি চোখে দেখতে পাই না? তোর মতো চোখের সামনে জেদের পট্টি পড়ে বসে নেই তো আমি। সারাদিন মেয়েটাকে দেখি কোনো না কোনো কাজে লেগেই থাকে। একলা হাতে রান্না করছে, কাপড় ধুচ্ছে, বাসন মাজছে, ঘর ঝাড়ছে, মুছছে। কখনো দু এক লোকমা ভাত মুখে তুলেছে কি কখনো না খেয়েই সারাজীবন গাধার মতো খাটছে এই সংসারটার পিছনে। আর তুই এটাকে রাণীর হালে থাকা বলিস? মাথায় তুলে রাখা বলিস? আমার বাড়ির বউ কেন এমন নিঃস্বের মতো থাকবে? কেন বলতে পারিস? মেয়েটাকে আমি এসব করতে মানা করলেও ও কি আমার কথা শোনো? ও শুধু তোর কথাগুলো মেনে নিয়ে এতো অপমান সহ্য করেও পড়ে আছে এই বাড়িতে। না কারো সাহায্য নিচ্ছে নিজের কাজে, না কারো সুযোগ। কিন্তু তুই সেসব শুনবি কেন? তাই না অরণ্য?

-সবসময় যা দেখো তাই সত্যি হয় না মা। এসবই ওই মেয়ের নাটক। ভালোই নাটক সাজিয়েছে তোমার ওই অনু। বলতেই হচ্ছে মা। হ্যাটস ওফ! হোয়াট এন এওয়ার্ড উইনিং পারফরমেন্স! রিয়েলি।

-হ্যাঁ নাটকই তো। জানিস দুপুরবেলা সবার সাথে খেতে বসার জন্য জোর করলেও এটা ওটা বলে প্রায় সময় ওর উপোশ করে থাকাটা নাটক। রাত গভীর হলেও তোর জন্য খাবার সাজিয়ে রান্নাঘরের এক কোণে চুপটি করে বসে তোর জন্য অপেক্ষা করে থাকাটা ওর নাটক। তুই খাবারটা খেয়ে গেলে এক মুঠো ভাত মুখে গোজাটাও ওর নাটক। আর তুই না খেলে ওর এক গ্লাস পানি খেয়ে গুটিশুটি হয়ে সেই রান্নাঘরের কোণে বিছানা পেতে শুয়ে পড়াটাও এক ধরনের নাটক। এতো নাটকের পিছনের সত্যিটা কি জানিস? সত্যিটা হলো তুই আসলেই কখনো মেয়েটাকে বুঝতে পারিস নি। কখনো একটা সু্যোগও দিস নি ওকে নিজের কথাটা বুঝিয়ে বলার। পুরোটা জানতে চেয়েছিলি একবারও মেয়েটার কাছে? কি বলতে চেয়েছে মেয়েটা সেদিন তোকে? চাস নি। কেন বল তো অরণ্য?

-তুমি ওর কথায় সহজেই ভুলতে পারো মা। কিন্তু আমি পারবো না। ও আমাকে ঠকিয়েছে মা। এটাও তো সত্যি। সেটা তুমি মানো বা না মানো।

-হ্যাঁ। তা তো ঠকিয়েছেই। ঠকিয়েছে বলেই বিয়ের প্রথমদিনই সাহস করে তোকে নিজের কথাগুলো বলতে চেয়েছিল। একটা কথা বল তো অরণ্য? তোরও তো একটা বোন আছে। দুদিন বাদে যখন তাহিয়ার বিয়ে দিবি, তখন ওর সাথে এমনটা ঘটলে কি করবি তুই? মানতে পারবি তো নিজের বোনের এমন অবস্থা হলে?

-মা?

-শোন অরণ্য। পার্টি থেকে দু একদিন খেয়ে এসে খাবারের প্লেট ছুঁড়ে ফেলে দেয়া অনেক সহজ, কিন্তু তার জন্য কারো কপাল কেটে যে রক্তটা ঝরলো সেটার দামটা তুই দিবি কি করে? কাটার চেয়েও বেশি যে আঘাতটা কারো হৃদয়ে গিয়ে লাগলো সেটার ক্ষতটা সারিয়ে তুলবি কি করে বল তো? পেট ভরা থাকলে খাবার ফেলে দেয়া যতটা সহজ, ঠিক ততটাই কঠিন হলো কারো মনে কষ্ট দেয়ার পর সেটা ভুলিয়ে দেয়া। কাজটা যে তোকে দিয়ে হবে না সেটা বেশ ভালোই বোঝা হয়ে গেছে আমার। কারণ মেয়েটাকে কষ্ট দেয়াটা আজকাল তোর নেশা হয়ে গেছে। তাই ওকে আঘাত না করে তুই থাকতেই পারিস না।

-মা। প্লিজ অনেক রাত হয়েছে। এবার যাও তো তুমি প্লিজ?

-যাচ্ছি রে বাবা। একটা কথা জানিস অরণ্য? আমিই অনুকে বলেছিলাম তোর জন্য যখন জেগেই থাকে তখন ডাইনিং রুমেই বসতে। প্রতিদিন এভাবে রান্নাঘরের ফ্লোরে গুটিগুটি হয়ে বসে থাকলে ঠান্ডা লাগবে না? মেয়েটা রাজি হচ্ছিলই না। আমি আর তাহিয়া এক রকম জোর করে ওকে বসিয়েছি আজ। ভেবেছিলাম অন্তত মেয়েটার সারাদিনের ক্লান্ত মুখটা দেখে যদি তোর মনে একটু মায়া হয়। কিন্তু কি করে জানবো বল যে মায়া, মমতা বস্তুগুলোই তোর মধ্যে থেকে হারিয়ে গেছে? আমার ছোট্টো অরণ্য থেকে আজকাল বড় মানুষ হয়েছিস তো তুই। তাই এসব ছোটো মানুষের মতো মায়া, দরদ তোর থাকবে কেন? তাই না? মেয়েটা আসলেই একেবারে রাণীর হালে আছে বুঝলি অরণ্য। ঠিকই বলেছিস তুই, ঠিকই বলেছিস।

-মা? শোনো?

অরণ্যকে কথাগুলো বলতে বলতে তাইয়্যেবা জামান রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। অরণ্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের চলে যাওয়া দেখলো। তারপর দরজা বন্ধ করে ওয়াশরুমে এসে সোজা শাওয়ারের নিচে এসে দাঁড়ালো। চোখে মুখে শাওয়ারের পানি এসে চোখ বুজে আসতেই অনামিকার ক্লান্ত শ্রান্ত মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে অরণ্যের। তখন কেন এতো রাগ হয়েছিল অরণ্য নিজেও জানে না। অনুকে খাবার টেবিলে মাথা হেঁট হয়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে সেদিনের অনুর বলা কথাগুলোই কানে বাজছিল অরণ্যের। খাবারের প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলার সময় ঘুমন্ত অনুর মাথায় লাগতে পারে কথাটা মাথাতেই আসে নি ওর। গত তিনমাসে মেয়েটাকে যতটা পারা যায় অপমান করেছে অরণ্য। তবু কেন মেয়েটা চলে যায় না বাড়ি ছেড়ে? তাহলে অন্তত প্রতিদিন এই মায়াকাড়া মুখটা দেখে ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হতে হত না অরণ্যকে। অরণ্য অন্তত এতোটুকু শান্তনা নিয়ে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারত যে মেয়েটা নিজের প্রিয় মানুষের সাথে সুখেই আছে। মেয়েটা কেন এতো অপমান মুখ বুজে মেনে নেয় সেটাই মাঝেমাঝে বুঝতে পারে না অরণ্য। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আরেকবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অরণ্য। 

লম্বা একটা শাওয়ার নেয়া শেষ করে অরণ্য চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। ঠিক করে চুল না মুছেই ভিজে টাওয়ালটা বিছানার উপরে ছুঁড়ে ফেলে ড্রেসিং টেবিলের মিররের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবার চেষ্টা করলো। মায়ের কথাগুলো এখনো কানে বাজছে অরণ্যের। অনুর কি সত্যিই ভিষণ লেগেছে? কথাটা ভাবতেই অরণ্যের বুকের ভিতরে ধ্বক করে উঠলো। যাকে আজীবন সব দুঃখ থেকে আগলে রাখবে বলে নিজের করে নিয়েছিল, নিজের মতো করে ভালোবেসে কষ্ট ভুলিয়ে দিবে বলে বউ সাজিয়ে বরণ করে নিয়েছিল নিজের জীবনে, সেই অনুকে নিজেই এতোটা কষ্ট দিচ্ছে অরণ্য। শুধু যে অনুকেই কষ্ট দিচ্ছে তা তো নয়, নিজেকেও সমান কষ্টই দিচ্ছে ছেলেটা। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল অরণ্য। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে হাঁসফাঁস করছে অরণ্য। চোখে রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে, এদিকে খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। এই আধো ঘুম আধো জাগরণেও চোখের সামনে একটা মুখই ভেসে উঠছে অরণ্যের। মুখটা আর কারো নয়, অনামিকার। অরণ্যের অনুর।

০২!! 

আধো ঘুম আধো জাগরণের মাঝে অনামিকাকে প্রথম দেখার স্মৃতিটা অরণ্যের চোখের সামনে ভেসে উঠলো আরেকবার। বাড়ির সবাই জানে উনারা নিজেরা সবাই মিলে অরণ্যের জন্য অনুকে পছন্দ করে বাড়ির বউ করে এনেছে। কিন্তু অনুর এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পিছনের ছোট্ট একটা গল্প আছে, যা অরণ্য ছাড়া আর কেউ জানে না। অনুকে অরণ্য প্রথমবার দেখেছে অফিসে যাওয়ার সময়। কোনো একটা ফুচকার স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বান্ধবীদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করে ফুচকা খাচ্ছিল মেয়েটা। খুব সম্ভবত ওদের চার বান্ধবীর মধ্যে ফুচকা খাওয়ার কম্পিটিশন হচ্ছিল সেদিন। কে কত বেশি ঝাল খেতে পারে বোধ হয় এমন কিছু নিয়ে ছিল কম্পিটিশন। ঝালের চোটে মেয়েটার দুধে আলতা রঙা মুখটা একেবারে টমেটোর মতো টকটকে লাল হয়ে গেছে। তবু কিন্তু খাওয়া বন্ধ করে নি। রাস্তার জ্যামে আটকে দৃশ্যটা দেখে অরণ্য এতো মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে কখন সিগন্যালটা ক্লিয়ার হয়েছে সেটা টেরই পায় নি অরণ্য। পিছন থেকে যে লাগাতার হর্নের উপরে হর্ন দিয়ে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে তাতেও হুঁশ ছিল না অরণ্যের। একটু পরেই অনেকগুলো গাড়ি একত্রে হর্ন বাজিয়ে পুরো জায়গাটা থমথমে করে তোলার আগে মেয়েটার নাম জানতে পারে অরণ্য। ফুচকাওয়ালা মামা অমায়িক হেসে ঘোষণা করেছেন, 'আজও অনামিকা আপু জিতসে।'

গাড়ির হর্নে হুঁশ ফিরে অফিসের দিকে রওনা হলেও অরণ্যের মনটা ছুটে যায় সেখানেই। অনামিকা। ছোট্ট করে বললে অনু। নামটা বড্ড বেশি মিষ্টি শোনাতে লাগছে অরণ্যের কাছে। অরণ্যের অনু। কথাগুলো ভাবতে গিয়ে নিজের মনেই হেসে ফেলে অরণ্য। বাড়ির সবাই ওর বিয়ের তোড়জোড় করছে সেটাও জানে অরণ্য। তাই আর সময় নেয়নি একদমই। পরিচিত এক চাচাকে অনামিকার নাম আর কলেজের ঠিকানা বলতেই বাকিটা উনি নিজেই ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। তারপর তো অনুদের বাড়িতে অরণ্যের জন্য সম্বন্ধটা নিয়ে যাওয়া, অরণ্যদের বাড়ির সবার অনুকে দেখতে যাওয়া, সেখানে সবার অনুকে পছন্দ হওয়া এবং সবশেষে বিয়ে। এতোটুকু পর্যন্ত দারুণ কাটছিল অরণ্যের দিনগুলো। গায়ে হলুদের দিন অরণ্য সবার আড়ালে ছুটে গিয়েছিল অনুকে একনজর দেখবে বলে। গায়ে হলুদে রাঙানো অনুকে দেখে কি যে একটা প্রশান্তি নিয়ে ফিরে এসেছিল সেটা শুধু অরণ্যই জানে। সবাই ভেবেছিল অনুকে ভালো লেগে গিয়েছিল বলে ছেলেটা এমন পাগলামিতে বাঁধছে ওকে। কিন্তু অরণ্যের যে প্রথম ভালোবাসা হয়ে অনামিকা নামের মেয়েটা এসেছিল সেটা কেউ জানতেও পারে নি। হয়তো অনামিকা নিজেও টের পায়নি কখনো।

সব কিছুই ঠিকঠাকই চলছিল। একরকম তাড়াহুড়োর মধ্যেই বিয়েটা হয়ে যায়। অনামিকার বাবা মায়ের এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের প্রস্তাবে সবাই ভাবনায় পড়লেও অরণ্যে এক কথাতেই রাজি হয়েছিল। সবাই পরে এটা নিয়ে  কত যে লেগপুল করেছে বেচারার! সেসব তত পাত্তা দেয়নি ছেলেটা। বিয়ের দিন অনুর সামনে বসে কথাগুলো ভেবেই হেসে ফেলেছিল অরণ্য। মেয়েটা গুটিশুটি হয়ে গোলাপির পাপড়ি ছড়ানো ফুলের বিছানার মধ্যমণি হয়ে বসে ছিল। পাতলা ওড়না দেয়া ঘোমটার আড়ালে মেয়েটার কেঁপে ওঠা টের পেয়ে অরণ্য হাত বাড়িয়ে ঘোমটা তুলে দিয়ে অবাক চোখে অনুর দিকে তাকিয়ে রইলো কতোক্ষণ। অনুও বেশ কিছুক্ষণ মুখ নামিয়ে চুপচাপ বসে থেকে অরণ্যের দিকে ওর মায়াবী চোখজোড়া তুলে তাকিয়েছে। দুজনের চোখাচোখি হতেই অরণ্য মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে অনুর কপালে ছোট্ট করে একটা চুমো এঁকে দিল। অনু অবাক হয়ে অরণ্যের দিকে তাকাতেই অরণ্য আবার হেসে অনামিকার গালে হাত ছুঁইয়ে দিল। 

-সারাদিনের ছুটোছুটিতে দেখছি মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে অনু। বুঝতে পারছি ভিষণ টায়ার্ড লাগছে তোমার। তবু যদি কষ্ট করে কিছুক্ষণ জাগতে পারো তাহলে একটু গল্প করতে পারি দুজন মিলে। আসলে ঘুম আসছে না আমার।

-হুম।

-একটা কথা বলবো অনু?

-জি বলুন না?

-নতুন বউয়ের সাজে তোমাকে দারুণ লাগছিল। হুর পরী দেখতে কেমন হয় আমার জানা নেই, তবে তোমাকে ওদের চেয়ে কোনো অংশে কম লাগছিল না। বিলিভ মি।

অরণ্যের কথাগুলোর মাঝে কি নেশা লাগা ভাব ছিল অনু নিজেও হয়তো জানে না। অবাক চোখে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা। আর অনুর অবাক চাহনিতে আরেকবার মুগ্ধ হলো অরণ্যে। অনুর হাতের উপরে নিজের একটা হাত রেখে আবার অনামিকার দিকে তাকালো অরণ্য।

-ভারি মেকাপের চেয়েও তোমার মুখটায় আরো হাজার গুণ বেশি সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে এই নরমাল সাজটায়। শাওয়ার নিয়ে আসার পর তোমার ভেজা চুলগুলোও তখনকার খোঁপার বাঁধনের আড়ালের চেয়েও বেশি ভালো লাগছে। আর এই যে একদম কোনো মেকাপ ছাড়া আনকোরা মুখটা দেখতে এতোটা মায়াবী লাগছে সেটা বলেও বোঝাতে পারবো না তোমাকে। 

অরণ্যের কথায় অনামিকা চোখ নামিয়ে নিতেই অরণ্য একটু এগিয়ে এসে অনুর কাছে এগিয়ে এসে বসলো।

-অনু? তোমার কি টায়ার্ড লাগছে? ঘুম পাচ্ছে?

-উঁহু।

-তাহলে একটু বারান্দায় গিয়ে বসবে? তোমাকে বউ করে আনবো বলে নতুন করে সাজিয়েছি সবটা। তাড়াহুড়োয় তত খেয়াল করতে পারি নি আর কি কি লাগবে। বাকিটা নাহয় তুমি নিজের মতো করে সাজিয়ে নিও। তোমার দুনিয়াটা নাহয় তুমি নিজে রঙতুলিতে রাঙিয়ে নিও।

-হুম।

-ওকে। বারান্দায় বসে গল্প করতে করতে বারান্দার ডেকোরেশনটা দেখাই তোমাকে এসো। 

অরণ্য বিছানা থেকে নেমেই অনামিকার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই অনামিকাও একবার মুখ তুলে বাড়ানো হাতটা দেখে ধীর হাতে হাতটা বাড়িয়ে দিল অরণ্যের দিকে। অরণ্যের হাতটা ধরে বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে মেয়েটা যে অবাক হয়েছে সেটা অরণ্য সহজেই বুঝতে পারলো। আর অনুকে অবাক করে দিতে পেরেই অরণ্যের গত কয়টা দিনের সমস্ত পরিশ্রম এক নিমিষেই যেন সফলতা পেয়ে গেছে। অরণ্য অনামিকার হাতটা ধরে বারান্দায় নতুন লাগানো দোলনাটায় বসিয়ে দিল। নিজে অনামিকার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে হালকা হাতে একবার দোলনাটা পিছনের দিকে টেনে এনে ছেড়ে দিতেই দোলনাটা দুলতে আরম্ভ করতেই অনামিকা আর অরণ্য দুজনের ঠোঁটের কোণেই এক চিলতে হাসির রেখা দেখা দিল। বেশ কিছুটা সময় দোলনাটা দুলিয়ে এবারে অনামিকার পাশে এসে বসলো অরণ্যে। অনামিকা মুখ তুলে তাকাতেই অরণ্য অনামিকার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মেহেদিরাঙা হাতটা আবছা আলোয় দেখলো কিছুক্ষণ। 

-জানো অনু? এতোগুলো বছর আমি অপেক্ষা করেছিলাম এমন কারো আসার যাকে একনজর দেখেই তার প্রেমে পড়ে যাবো। যার দিকে সারাটা দিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে পারবো এমন কারো জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম সেই কলেজ লাইফ থেকে। এতোদিনে আমার অপেক্ষার পালা শেষ করে কেউ একজন এসেছে। তাকে যত দেখি ততই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা? লাভ এট ফার্স্ট সাইট কথাটা বিশ্বাস করো তুমি?

-উঁহু। কারো সম্পর্কে কিছু না জেনে, শুধু তার বাইরের আবরণটা দেখেই কি ভালোবাসা হয়? সাময়িক ভালো লাগা আর ভালোবাসা দুটো আলাদা ব্যাপার।

-আমারও এমনই মনে হত। কারো মুখে ভালোবাসার কথা শুনলে মনে হতো, নিজের দুনিয়ায় মাস্ত আছি, খাই দাই অফিসে যাই, নিজের কাজ করি, এইতো বেশ। কেউ একজন হুট করে এসে এতোটা পাগল করে দিবে জানতাম না। জানো? একটা শিশু জন্মের পরই তার মাকে দেখে, মাকেই ভালোবাসে। এটাই হলো লাভ এট ফার্স্ট সাইটের কনসেপ্ট। প্রথম দেখাতেই কারো মুখটা আজীবনের জন্য স্মৃতিতে, মনে, হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া।

-কি জানি!

-বিয়ের পর বউয়ের সাথে চুটিয়ে প্রেম করবো বলে কত কথা জমিয়ে রেখেছি জানো? বাট এখন নতুন বউটাকে কাছে পেয়ে সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কি অদ্ভুত অনুভূতি! আচ্ছা তোমার কথা তো বললে না? সেদিন তোমাদের বাড়িতেও তো কোনো কথাই হয়নি আমাদের। নিজেদের সম্পর্কে তো জানাই হলো না আমাদের।

-হুম। আসলে এতো তাড়াহুড়োয় বিয়েটা হয়েছে যে কিভাবে কি হলো বুঝতেও পারি নি।

-ওকে। নো প্রবলেম। এখন আর কোনো তাড়াহুড়ো নয়। নতুন করে শুরু করবো আমরা। ওকে। লেটস স্টার্ট এ গেইম। 

-কিসের গেইম? 

-নিজেদেরকে জানার গেইম। তুমি কিছু নিজের ব্যাপারে বলবে, কিছু আমি বলবো আমাকে নিয়ে। এভাবে দুজনে ফ্রিও হবো, জানাও হবে। হুট করে তাহলে আর তোমার অকওয়ার্ড ফিলটা কাজ করবে না।

-না না। আসলে----।

-অপরিচিত একজন মানুষের সাথে হুট করে বিয়েটা হয়ে গেল। জানি কিছুটা হলেও নার্ভাস লাগছে। তার উপরে সারাদিনের টায়ার্ডনেস। সব মিলিয়ে কিছুটা অকওয়ার্ড লাগতেই পারে। নো প্রবলেম। চলো রুমে গিয়েই গল্প করি। গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেও সমস্যা হবে না তাহলে।

-হুম? আচ্ছা।

অনামিকা দোলনা থেকে নেমে এক পা সামনের দিকে বাড়াতেই অরণ্যে ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে। অরণ্যের এমন কাজে মেয়েটা যে অবাক হয়েছে সেটা বুঝতে পেরে অরণ্য হাসলো। অনুকে ফুলে সাজানো বিছানার উপরেই বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসলো। মেয়েটা আবার একমনে কিছু ভাবতে ভাবতে নখ খুঁটছে দেখে অরণ্য এগিয়ে এসে অনুর ভেজা কয়েক গাছা চুল মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিল। অনু মুখ তুলে অরণ্যের দিকে তাকাতেই অরণ্য অনুর কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে অনুর ভাবুক মুখটার দিকে তাকালো।

-জানো অনু? কলেজে যখন বন্ধুদের গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরতে দেখতাম, হুটহাট ওদের ক্লাস মিস করে আড্ডা দেয়া, বৃষ্টিতে ভেজা, এক নজর দেখার জন্য হুটহাট বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, এসব দেখে কেন জানি বিরক্ত হতাম। রীতিমতো জেলাস হতাম ওদের উপরে। অথচ কাউকে নিজের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দিতাম না। যারা ভালোবাসা নিয়ে বড়াই করে এটা ওটা বলে আমাকে জ্ঞান দিতে আসতো, দুদিন পরেই ছোট্ট কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে তাদেরই আলাদা হয়ে নিজেদের গালাগাল দিতে কত দেখেছি। এক সময় যার জন্য ক্লাস ফাঁকি দিয়ে, বাবা মায়ের হাজার বকা খেয়ে রাত দিন পিছন পিছন ঘুরতো, তাদেরকেই দেখেছি ব্রেকাপের জন্য গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ডকে কুকুর বা সাপের সাথে তুলনা করতে। এসব দেখে কলেজে বা ভার্সিটিতে প্রেম করার ব্যাপারটা মাথাতেই আসে নি কখনো। কি দরকার অন্য একজনের উপরে মনটা বিষিয়ে রেখে বলো?

-তাহলে যে বললেন লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলেও কিছু হয়?

-প্রেম করতে চাইনি বুঝলে। নিজের বউকে ভালোবাসতে চেয়েছি। প্রেম করে এক্সের সংখ্যা বাড়িয়ে আর গালাগালি করে পাপ কামানোর কোনো মানে হয় বলো? এর চেয়ে যত পাগলামি শখগুলো বউয়ের জন্যই তোলা রেখেছি। তাকে বড্ড বেশি জ্বালাতন করবো বলে। তার শখগুলো, স্বপ্নগুলো নিজের করে নিবো সমস্যা নেই। শুধু মানুষটা ব্যস্ততার শেষে আমার কাঁধে মাথা রাখলেই নাহয় খুশি হবো। হবেন কি আমার স্বপ্নসঙ্গিনী ম্যাডাম?

-আপনাকে কিছু বলার ছিল অরণ্য।

-জাস্ট এ মিনিট। একটু, এক মিনিট ওয়েট করো প্লিজ?

-কোথায় যাচ্ছেন?

-আরে! যাচ্ছি না। ভাবিরা বারবার করে বলে দিয়েছে নতুন বউয়ের মুখ দেখলে কিছু দিতে হয়। আমার বউয়ের স্নিগ্ধ মুখটা দেখে আমি ভুলেই গেছিলাম কথাটা। সরি ম্যাডাম। দুটো মিনিট ওয়েট করো।

অরণ্য উঠে গিয়ে আলমারির ড্রয়ার থেকে কিছু একটা নিয়ে আবার এসে অনামিকার পাশে বসে অনামিকার দিতে নিজের বাম হাতটা বাড়িয়ে দিতেই অনামিকাও কিছুক্ষণ চুপ থেকে অরণ্যের দিকে নিজের বাম হাতটা এগিয়ে দিল। অরণ্য অনুর বাম হাতের অনামিকায় একটা আংটি পড়িয়ে দিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল অনামিকার হাতে। মেয়েটা কেঁপে উঠে হাতটা টেনে নেয়ার চেষ্টা করতেই অরণ্য কিছুটা অবাকই হলো। ভ্রু কুঁচকে অনুর মুখের দিকে তাকালো। 

-কি হয়েছে অনু? এনি প্রবলেম?

-আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল। জানি না কথাগুলো শুনে আপনি কিভাবে রিএ্যাক্ট করবেন। আপনাকে আরো আগেই বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারি নি। 

-বুঝলাম না। কি এমন কথা যে আমি শুনলে রিএ্যাক্ট করবো? বলো শুনি।

অরণ্যের কৌতূহলী চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে কেমন অস্বস্তি হলো অনুর। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজের মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে অরণ্যের দিকে মুখ তুলে তাকালো মেয়েটা। বিছানার উপর থেকে নিজের মোবাইলটা নিয়ে গ্যালারি থেকে একটা ফটো বের করে অরণ্যের দিকে এগিয়ে দিল। অরণ্য মোবাইলের দিকে একনজর তাকিয়েই ভ্রু কুঁচকে আবার অনুর দিকে তাকালো। 

-ওর নাম সাহিল। আমাদের রিলেশনের প্রায় এক বছর হতে চললো। বাবাকে ওর কথা বলতেই এক রকম জোর করেই-----। আমি আপনাকে উনার কথা বলে দিতে পারি এই ভয়ে এতো তাড়াহুড়োয়-----।

-হোয়াট! যদি অন্য কাউকেই ভালোবাসো তাহলে আমাকে বিয়ে করার মানেটা কি! পুরো পরিবার মিলে আমাকে প্ল্যান করে এভাবে ঠকালে তোমরা! হাউ কুড ইউ!

-আ'ম সরি অরণ্য। আমি সত্যিই আপনাকে ঠকাতে চাই নি বিশ্বাস করুন। বিয়ের কথা ঠিক হওয়ার পর আমি অনেকবার সাহিলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। আমার মোবাইল, সিম সবকিছু এতোদিন মায়ের কাছেই ছিল। বান্ধবীদের থেকে যে হেল্প নিবো সেটাও হচ্ছিল না। সবসময় কেউ না কেউ আমার সাথে লেগেই ছিল গত কয়েকটা দিন। তবু কোনোমতে সাহিলের কাছে খবর পাঠানোর চেষ্টা করেছি। অনেক কষ্টে গায়ে হলুদের দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। সাহিলের কাছেই চলে যেতে চেয়েছিলাম একেবারের জন্য। কিন্তু----। আহহহহ।

-অনু?

সেদিনও নিজের রাগটা কন্ট্রোল করতে পারে নি অরণ্য। অনুর মুখে অন্য কারো নাম শুনে সজোরে একটা চড় কষিয়েছিল অনামিকার গালে। আচমকা চড়ে অনামিকার মাথাটা খাটের কোণায় গিয়ে পড়তেই মেয়েটা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেই ধড়ফড় করেই জেগে ওঠে অরণ্য। এই বাজে স্বপ্নটা ওর নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে বলা চলে। শুয়ে থেকেই পাশ ফিরে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময়টা দেখে নিল অরণ্য। রাত পোহানোর এখনো বহু দেরি। অনুকে একনজর দেখার প্রবল ইচ্ছেটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার বহু চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত বিফল হলো ছেলেটা। ফোনের গ্যালারি থেকে অনুর হলুদে রাঙানো একটা ছবি বের করে সেটার দিকেই অপলকে তাকিয়ে রইলো অরণ্য।

-কেন অনু কেন? কেন আমাকে এভাবে ঠকালে? তোমার সাথে একটা সুখের সংসার গড়ার স্বপ্নই তো দেখেছিলাম? কেন সেটাকে এভাবে একনিমিষেই গুঁড়িয়ে দিলে? এখনও কেন এতো অপমান সহ্য করেও আমার সামনেই পড়ে থাকো? তোমাকে এভাবে দেখতে কতো কষ্ট হয় জানো তুমি? এই সংসার নামের নাটকটা থেকে মুক্তি কোথায় বলতে পারো?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন