নীলিমা - পর্ব ০৭ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


১৩!!

আবীর, তনয়া, তাহমিদ, তিনজনেই বিস্ফারিত চোখে এতোক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেকেন্ড খানেক যেন বরফের পুতুলের মতো জমে ছিল সবাই। আর প্রায় সাথে সাথেই ঘোর কাটিয়ে জেগে উঠে তিনজনেই। লক্ষ্য একটাই চিফের হাত থেকে নীলিমাকে উদ্ধার করা। বুদ্ধিটা হুট করেই তনয়ার মাথায় এলো। তাহমিদের পকেটে হাত দিয়ে ছোট একটা ছুড়ি বের করে সেটা ধরিয়ে দিয়েই তাহমিদের ছুড়ি ধরা হাতটা নিজের গলায় রেখে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠলো তনয়া। ওর কাজে আবীর আর তাহমিদ দুজনেই খানিকটা চমকে উঠেছিল। কিন্তু তনয়ার প্ল্যানিং ধরতে বেগ পেতে হলো কাউকেই। তাহমিদ মুখে কপট রাগের রেখা ফুটিয়ে তুলে সামনের দিকে তাকিয়েছে। আবীরও তনয়ার একটা হাত চেপে ধরে হিংস্র চোখে এন এস আই চিফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ততক্ষণে তনয়ার কণ্ঠ শুনে আতিকুর রহমান চমকে নীলিমার কাছ থেকে সরে এসে দরজার দিকে তাকিয়েছে। তনয়ার গলায় ছুড়ি দেখেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে লোকটার।

-তাহমিদ! আমার মেয়ের গায়ে যদি একটা ফুলের আঁচড়ও লাগে, তবে তোমাদের দুজনের কাউকেই আস্ত রাখবো না---।

-ভুলে যাবেন না আপনার মেয়ের প্রাণ এখন আমার হাতে---।

-ছাড়ো তনুকে---। ছাড়ো বলছি। নয়তো তোমাদের এই এজেন্টকেও মরতে হবে--।

-প্রাণ ভোমড়া অন্য জনের হাতে থাকলে বড় বড় কথা বলতে হয় না মিস্টার আতিকুর রহমান--। নীলিকাকে ছেড়ে দিন--। নইলে--।

-নইলে? কি করবে তোমরা? তোমাদের একজন সামান্য এজেন্টের জন্য একজন ট্রেইন্ড এন এস আই এজেন্টকে খুন করবে? হা হা হা। আর সেটাও তুমি তাহমিদ! যে কিনা পাগলের মতো ভালোবাসে এই মেয়েটাকে? হা হা হা---। 

-------------------------------

-কি ভাবো কি বলো তো তোমরা? আমি এতোই বোকা! মেয়ে আমার উইক পয়েন্ট--। কিন্তু তাই বলে তোমাদের উইক পয়েন্ট জানবো না সেটা কি করে হয়!

-বাবা! ওরা সত্যি------।

-তনু! এই রোমিও ছেলে তোর কিছু করবে না মা। ভাবিস না। আমি এই মেয়েটাকে আগে দেখে নিই।

আতিকুর রহমান আবার মুখ ঘুরিয়ে নীলিমার দিকে তাকাতেই আবীর ক্ষিপ্র গতিতে তাহমিদের হাত থেকে ছুড়িটা কেড়ে নিয়ে তনয়ার গলার চেপে ধরলো। তনয়ার গলা ছুঁই ছুঁই করছে। তনয়া এবার সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে কঁকিয়ে উঠলো। 

-চিফ আপনার মেয়ের গলা কাটতে তার আশিকের হাত কাঁপতে পারে, কিন্তু আপনি তো জানেনই আবীরের হাত কাঁপে না কখনো----।

-আবীর! তুমি নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডকে---।

-মেলোড্রামা বন্ধ করুন স্যার--। আমি আমার ওয়াইফকে বাঁচাতে যে কাউকেই রাস্তা থেকে সরাতে পারি-। আর তনয়া! ও তো আমার বন্ধু। বন্ধুর ভালোর জন্য এটুকু তো করতেই পারবে--। কি বলেন?

-আবীর? আমার মেয়ের কিছু হলে--।

-আমার ওয়াইফের কিছু হলে আপনার মেয়েও বাঁচবে না বস--। আপনি যতটা নিজের মেয়েকে ভালোবাসেন তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি আমি আমার ওয়াইফকে ভালোবাসি----।

আতিকুর রহমান থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন। নীলিমার দিকে হাত বাড়াতে পারছেন না। কিন্তু সরেও আসছেন না। তাহমিদও আবীরের চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট টের পাচ্ছে। সেও আবীরের হাত থেকে তনয়াকে ছোটানোর চেষ্টা করলো। আবীর অন্য হাত দিয়ে ঝটকা দিয়ে তাহমিদকে দূরে ফেলে দিলে বেচারা আর উঠতে পারলো না। আতিকুর রহমান বিস্ফোরিত চোখে শুধু সব দেখছেন। আবীর এবার ছুড়িটা আরেকটু করে তনয়ার গলায় চেপে ধরলো। ছুড়ির খানিকটা তনয়ার গলায় চেপে বসে কিছুটা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। মেয়েটা ব্যথায় ককিয়ে উঠলেও সেদিকে হুঁশ নেই আবীরের। সে শান্ত দৃষ্টিতে চিফের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়ের গলা থেকে রক্ত পড়তে দেখেই আতিকুর রহমানের হাতে ধরা সিরিঞ্জটা পড়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে দরজাটার দিকে এগিয়ে এলেন হুংকার দিতে দিতে।

-আবীর! আমার মেয়ের কিছু হলে তোকে আমি----।

-বস! আপনার কারণে যতগুলো ছেলে মেয়ে মারা গেছে তারাও কারো না কারো এতোটাই আদরের সন্তান ছিল। আপনার কারণে যতজন মানুষ বোমা ব্লাস্টে মারা গেছে, তারাও কারো না কারো পরিবার ছিল---।

আতিকুর রহমান দরজা খুলে দিলেন। আবীরের এক নজরের জন্য নীলিমার দিকে তাকাতেই আতিকুর রহমান সুযোগ পেয়ে গেলেন। আবীরের হাত থেকে ছুড়িটা ছো মেরে নিয়ে আবীরের হাত লক্ষ্য করে কোপ বসালেন। হাতের ছুড়ি আতিকুর রহমানের দখলে চলে গেছে টের পেতেই আবীরও সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। তাই ছুড়িটার একটু খানি লেগে কেটে গেল হাতটা। এর বেশি কিছু হয়নি ওর। কিন্তু ততক্ষণে তনয়ার হাতটা আতিকুর রহমানের কবলে চলে গেছে। আতিকুর রহমান আবীরের দিকে লক্ষ্য রেখেই তনয়ার গলার ক্ষতে রুমাল দিয়ে মুছে দিলেন। 

-তুই ঠিক আছিস মা?

-ছাড়ো আমাকে বাবা। ধরবা না। তুমি বাবা নামটার যোগ্যই না---।

-এভাবে বলিস না মা। আমি তো তোর জন্যই এসব করছি বল? তোর ভালোর জন্যই তো----।

-এমন ভালোর চেয়ে আমি মরে যাওয়াটাই প্রেফার করবো---।

-তনু!

-ওদেরকে ছাড়ো--। নাশুকে ছাড়ো---।

-এই মেয়েটা আমার প্ল্যানিং সবটা জেনে গেছে--। ওকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব না----। খবরদার আবীর-। কোন চালাকি করার চেষ্টা করলেই তোমার পেয়ারের নাশুর কপালের ঠিক মাঝখানটায় একটা গুলি করবো--। এর বেশি কিছুই করতে হবে না----।

-বাবা!

আতিকুর রহমান মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে দেখে আবীর সন্তর্পণে নীলিমার চেয়ারের দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। এবারে দাঁড়িয়ে রইলো চুপ করে। মনে মনে তাহমিদের আসার অপেক্ষা করছে আবীর। ছেলেটাকে কৌশলে সরিয়ে দিয়েছে। এখন ও নিজের কাজটা ঠিক সময় মতো করতে পারলেই হয়। আতিকুর রহমান একবার ভ্রু কুঁচকে আবীরের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কি চলছে আবীরের মাথায়। হঠাৎ কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে আতিকুর রহমান পকেটে হাত দিয়ে নিজের পিস্তলটা বের করে আবীরের দিকে তাল করলেন।

-তাহমিদ কোথায় আবীর? ডাকো ওকে?

-ও কোথায় -------।

-একদম নাটক করবে না আবীর। নিজেকে বাঁচাতে আরেকটা খুন করতেও আমার হাত কাঁপবে না--।

-যেমনটা দিশারকে খুন করেছিলেন---।

-হাহ---। ওই ছেলেটাও বেশি উড়ছিল তোমাদের মতো--। নাশু ওর আন্ডারেই ছিল---। ফার্স্ট কেইসটায় ওরা দুজনেই মালেশিয়ায় আমাদের একটা ড্রাগ কনসাইনমেন্ট আটকে দেয়--। ড্রাগগুলো হেড কোয়ার্টারে জমাও দেয়--। নিয়ম অনুসারে সেগুলো ডিসপোজাল হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক--। কিন্তু এই মেয়েটা-----। মাতব্বরি করতে গেল---। 

-কি! কি করেছে নীলিমা?

-কি আর করবে! প্যাকেটে সিরিয়াল ছিল সেটা নাকি নোট করেছিল-। কাজ নেই আর কি আর---। অসভ্য মেয়ে---। এবারে বর্ডারে নতুন কনসাইনমেন্টটা আটকায় দিশার একাই। আর সেটার ডিটেইলস পাঠায় এই মেয়েটাকে---। আহহহ। আমার সমস্ত প্ল্যানিং ধরা পড়ে যায়--। তাই দিশারকেও সরাতে হলো পথ থেকে। তোমাদের লেভেলের ছেলেগুলোর এতো দেশপ্রেম উতলে উঠে যে সেটাই শেষে কাল হয় তোমাদের--। ফুল পিউপলস-----।

-দেশকে ভালোবাসা আর তার রক্ষায় জীবন দেয়া বোকামি না মিস্টার আতিক---।

-হাহ--। মরার পর কি বদলাতে পারলো তোমাদের সো কলড শহীদ দিশার! হুহ--। ওকেই একটা কেইসে দেশদ্রোহী বানিয়ে দিতে আমার জাস্ট কয়েকটা মিনিট সময় লাগবে--।

-দিশার না পারলেও আপনাকে শাস্তি আমরা দিবোই--। নিজের দেশের সাথে এতো বড় গাদ্দারি করেও পার পেয়ে যাবেন ভাবলে ভুল করবেন---।

-হা হা হা--------। আআআআ।

আতিকুর রহমান দানবের মতো হাসতে হাসতে টেরই পায়নি কখন নীলিমা ততক্ষণে ঠিক তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। নীলিমা উল্টো দিক থেকে এক ঝটকায় আতিকুর রহমানের হাত থেকে পিস্তলটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। আতিকুর রহমান পিছনে ঘুরে তাকাতেই পায়ে একটা গুলি খেল। ব্যথায় ককিয়ে উঠে ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়লো বিশালদেহী দানবটা। 

-এটা দিশার স্যারের মতো একজন দেশভক্ত অফিসারকে ধোঁকা দিয়ে মারার জন্য----।

তারপর আরেকটা গুলি করলো আতিকুর রহমানের অন্য পায়ে। 

-এটা দেশের হাজার হাজার ছেলে মেয়ের হাতে ড্রাগ তুলে দিয়ে ওদের জীবনটা নষ্ট করার জন্য----। আর  এটা বোমা ব্লাস্টে হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলার জন্য---। এটা নিজের দেশের সাথে নিমকহারামি করার জন্য--। তোমার মতো মানুষের হয়তো আদালতে বিচার হবে না--। তাই এটাই তোমার বিচার----। 

নীলিমা একটা একটা কথা বলে আতিকুর রহমানকে একটা একটা করে গুলি করছিল। সর্বশেষ গুলিটা আতিকুর রহমানের ঠিক কপালের মাঝখান বরাবর করলে আতিকুর রহমানের দানবের মতো বিশাল প্রাণহীন শরীরটা ফ্লোরে ধপ করে পড়ে গেল। আবীর আর তনয়া দুজনেই থ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাধা দেয়ার সময়টা পর্যন্ত পায় নি। অবশ্য বাধা দেয়ার কোন ইচ্ছেও কারোই ছিল না। গুলির শব্দ শুনেই তাহমিদ রুমে এসে ঢুকেছে। ফ্লোরে আতিকুর রহমানের বডিটা পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠলো একবার। বাইরে থেকে ঠকঠক করে অনেকগুলো বুটের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নিয়াজ মোর্শেদী ফোর্স নিয়ে চলে এসেছেন। বাকি কারোই সেদিকে হুঁশ নেই দেখে তাহমিদ চট করে নীলিমার হাত থেকে পিস্তলটা নিয়ে নিজের কোটের পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো। আর প্রায় মিনিট খানেকের মাথায় রুমটা ভরে গেল বিশ-ত্রিশ জন সেনায়। আর আতিকুর রহমানের লাশের সামনে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়ালেন এন এস আইয়ের সেকেন্ড কমান্ডার নিয়াজ মোর্শেদী।

১৪!!

আতিকুর রহমানের লাশের দিকে নিয়াজ মোর্শেদী অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে এবারে চোখ ফিরিয়ে একে একে বাকি সবার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। আবীর দুর্বল নীলিমাকে নিজের সাথে হালকা করে চেপে ধরে রেখেছে। তানমিদ মুখ শক্ত করে কিছু একটা ভাবছে। আর তনয়া পাথরের মতো এক দৃষ্টিতে নিজের বাবার লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কারো হাতেই কোন অস্ত্র নেই অথচ এই চারটা মানুষের ঠিক সামনে লাশটা পড়ে আছে। নিয়াজ মোর্শেদীর চোয়াল আপনাআপনিই শক্ত হয়ে গেল। আবীরের দিকে তাকালেন।

-কি হয়েছে এখানে আবীর? আর চিফ এখানে কি করে? উনি---। আর তোমাদের সকলের এই অবস্থা কেন! তনয়াই বা কি করে-----?

-স্যার!

-তনয়া কি করে এখানে এসেছে আর চিফ এখানে কি করছে সেটা আপনিও জানেন বস---। 

-তাহমিদ! আবীর আর ওর ওয়াইফকে চিফের লোকেরা নিয়ে এসেছে! 

-ইয়েস স্যার---। ড্রাগ মাফিয়া কেইসটায় সরাসরি জড়িত ছিল চিফ। আর আমরা সেটার অনেকটাই হয়তো জানতে পেরে গেছি তাই---।

-কিন্তু! উনাকে কে খুন করলো!

-----------------------

-কি হয়েছিল এখানে! জাস্ট আনসার মি ড্যাম ইট---।

তাহমিদ একবার নার্ভাস ভঙ্গিতে মাথা চুলকে আবীর আর তনয়ার মুখের দিকে তাকালো। তারপর আবার নিয়াজ মোর্শেদীর দিকে ফিরলো। 

-আসলে স্যার, এই কেইসের সাথে জড়িত আরেক জনকেও চিফ ধরে এনেছিলেন। 

-কাকে!

-স্যার আমাদের মিসিং এজেন্ট মিস নাশুকে। ও এই কেইসটার সাথে প্রথম থেকেই জড়িত ছিলেন। চিফের সমস্ত কালো কাজের খবর ও জানতো। তাই চিফ কয়েকবার ওকে খুন করারও চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটা পালিয়ে যায়। আন্ডারগ্রাউন্ড হয়। কিন্তু আজ চিফ আবীর আর নীলিমা ভাবির সাথে নাশুকেও ধরে আনে এখানে---।

-হোয়াট!

নিয়াজ মোর্শেদী চমকে উঠে তাহমিদের কথা শুনছেন। আর আবীর, নীলিমা, তনয়া তিনজনেই থতমত খেয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা টু শব্দ পর্যন্ত করছে না একজনও। নীলিমা কিছু একটা বলার জন্য মুখ খোলার চেষ্টা করতেই আবীর ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বললো। নীলিমাও তাই পাংশু মুখে চুপ করে গেল। 

-চিফ যে শুধু ড্রাগ কালোবাজারির সাথে জড়িত তাও না। উনি দিশারকে খুন করেছেন। তার সাক্ষী ছিল নাশু। তাই আবীর আর ভাবির সাথে ওকেও মারার প্ল্যান করে চিফ। আমরা চলে না এলে হয়তে উনি সফলও হতেন----।

-কিন্তু! চিফ! আর নাশুই বা কোথায়!

-আমরা কেইসটার ফাইনাল যে ডকুমেন্ট রেডি করেছিলাম সেটায় সহজেই প্রমাণ হয় চিফ দোষি। আর নাশুর কাছেও কিছু ডকুমেন্ট ছিল। চিফ ওদের তিনজনকেই ড্রাগ পুশ করে ডকুমেন্টস হাতিয়ে নেয়---। সেগুলো নষ্ট করে দেয়---। আর এন এস আইয়ের একজন ট্রেইন্ড অফিসার হিসেবে নাশু সেটা মানতে পারে নি---৷ শুট করেছে চিফ। 

-তাহলে তোমাদের এতোজনের সামনে দিয়ে ও পালালো কি করে তাহমিদ! গল্প শোনাচ্ছ আমাকে?

-আমমমম--। স্যার---। তনয়া এখনো সুস্থ নয়। আর আবীরকে তো দেখছেন ওকেও ড্রাগস দেয়া হয়েছে। সাথে নীলিমাকেও--। ও কি করে--।

-তুমি কোথায় ছিলে তাহমিদ! 

-আমমম। স্যার আমি তো আপনাদেরকে খবর দিয়ে তারপর এলাম----। 

-নাশু তবে পালালো কি করে! এইদিক থেকে বের হয়নি-। আর এই রুম থেকে----।

-স্যার! সি ইজ এ গ্রেট এজেন্ট। আর জানেনই তো ওর কেইস হিস্ট্রি আগেও তো মৃত্যুর মুখ থেকেও পালিয়েছে। সাথে দিশারকেও বাঁচিয়ে---।

-তাহমিদ! নিজের সংস্থার চিফকে খুন করে পালানোটা ঠিক কাজ নয়। সেটা তুমি বুঝতে পারছ?

-সে একজন প্রভাবশালী ক্রিমিনাল হলেও উচিত নয় স্যার? এটাতো আপনি আমােদরকে শিক্ষা দেন নি স্যার?

-কি ব্যাপার বলো তো তাহমিদ? আজকে আবীর চুপ, তুমি কথা বলছ! কি চলেছে এখানে সত্যি করে বলো--। নয়তো সবগুলোর চাকরি-।

-বস--। কিছুই চলছে না। আর চাকরি!! নিজের দেশের জন্য এমন চাকরিও কোরবান, আর হাজার আতিকুর রহমানও কোরবান---।

-আই ওয়ান্ট মিস নাশু এলাইভ--।

-সেটা তো পসিবল না স্যার। ওর সমস্ত ডিটেইলস চিফের কাছে ছিল। উনিই ওকে নিয়োগ করেছিল। উনার মৃত্যুর সাথে সাথে নাশু রহস্যেরও অমীমাংসিত সমাপ্তি ঘটেছে---।

-তোমরা তো ওকে দেখেছিলে---।

-স্যার? আমরা কখন বললাম ওর চেহারা দেখেছি! সি ওয়াজ ওয়ার্ড এ মাস্ক----।

নিয়াজ মোর্শেদী আবার ভ্রু কুঁচকে তাহমিদের দিকে তাকালেন। তাহমিদ মুচকি একটা হাসি দিতেই নিয়াজ মোর্শেদী আবীর আর নীলিমার দিকে তাকালেন। আবীরের কাঁধে হাত রাখলেন ধীরে। তারপর হালকা কণ্ঠে কেউ শুনতে না পায় এমন ভাবে কিছু একটা বললেন। আবীর থতমত খেয়ে চিফের দিকে তাকিয়ে থেকেই শেষে হাসিমুখে মাথা নাড়লো। নিয়াজ মোর্শেদীও নীলিমার মাথায় একবার হাত রেখে অন্য অফিসারদেরকে লাশ নিয়ে যাওয়ার আদেশ করে বেরিয়ে গেলেন। ততক্ষণে অফিসাররা আতিকুর রহমানের লাশটা সরানোর সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে। তাহমিদও আবীরকে একবার ইশারা করে তনয়াকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো জায়গাটা থেকে। মেয়েটা তখনো পাথরের মতো হয়ে আছে। 

সবাই বেরিয়ে যেতে আবীর নীলিমার মুখটা দুহাতে তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো। নীলিমা ভীত চোখে আবীরের দিকে তাকালো। 

-চলো নীলি? বাড়ি ফিরি?

-স্যার? আ-- আমি--- আমি আসলে--। 

-শশশশশ। চলো?

আবীর নীলিমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বেরিয়ে এলো। তারপর আলতো করে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দিলো। তারপর বাড়ির দিকে গাড়ি ছোটালো। ততক্ষণে বেশ রাত হয়ে এসেছে। চারদিকটা গুমোট অন্ধকারে ঢেকে গেছে। বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করাতেই নীলিমা বাইরে তাকিয়ে চমকে গেল। আবীর ওর দিকে এগিয়ে এসে সিটবেল্টটা খুলে নিজের কোলে তুলে নিলো। নীলিমা চমকে উঠে সরার চেষ্টা করলো। 

-আবীর স্যার? কি করছেন?

-এই নীলি? স্যার স্যার করছো কেন? আই এম ইওর হাসবেন্ড। নট ইওর বস ম্যাডাম-----। 

নীলিমা আড়ষ্ট হয়ে চুপ করে বসে আছে দেখে আবীর নীলিমার মুখটা তুলে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। আবীরের উষ্ণ স্পর্শে নীলিমা চমকে উঠে আবীরের হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললো। আবীর নীলিমার ঠোঁট থেকে সরে এসে শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো। যেন ছাড়লেই টুপ করে হারিয়ে যাবে মেয়েটা। নীলিমা সব ভুলে আবীরের বুকের ভিতরের হাতুড়ি পেটার মতো ধুকপুকানির শব্দ শুনছে। শব্দটায় যেন কিসের একটা ভয় মিশে আছে। কাছের কাউকে হারিয়ে ফেলার ভয়। আবীর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে নীলিমার চুলে আলতো করে হাতিয়ে দিতে লাগলো।

-নীলি জানো? আজকে বড্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। এক মূহুর্তের জন্য। মনে হচ্ছিল আমি বুঝি তোমাকে হারিয়েই ফেলেছি---। তোমাকে হারাতে হলে বেঁচে থেকেও মরে যেতাম---। উফফফ---। তাহমিদ আর তনয়া না থাকলে হয়তো-----।

তনয়ার নামটা শুনেই নীলিমা নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে আবীরের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। আবীরের কোলের থেকে নেমেই একেবারে গাড়ির দরজার কোণের দিকে সরে এলো। আবীর থতমত খেয়ে গেল নীলিমার এমন কাজে। নীলিমার দিকে হাত এগিয়ে নিতেই নীলিমা আরো সরে এলো। দরজাটা লক করা তাই বের হতে পারলো না।

-নীলি? এমন করছ কেন হঠাৎ?

-খবরদার আবীর স্যার---। আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টাও করবেন না। আমি কোন নীলিমা নই--। আমি--। আমি নাতাশা----। 

-নীলি? প্লিজ? আমার কথাটা---।

-স্যার আপনাকে শেষ--শেষবারের মতো বলছি---। জোর করবেন না আমাকে--। তাহলে---। তাহলে কিন্তু আমি---। 

-আমি তোমাকে জোর করছি নীলি?

-আমি---। আমি বাড়ি যাবো--।

-নীলি? এটাই তো তোমার বাড়ি-। আমাদের বাড়ি---।

-বাজে-বাজে কথা বলবেন না একদম। আপনি আমার সিনিয়ার অফিসার হতে পারেন-। আজকে আপনারা একটা ক্রাইসিস থেকে আমাকে বাঁচিয়েছেন বলেই যে তার ফায়দা নিতে হবে--।

-নীলি? কি বলছ? আমি-----।

-আর তাছাড়া তনয়া ম্যাডাম তো ফিরে এসেছেন---। আমাকে ছেড়ে দিন না প্লিজ? 

-নীলি? তনয়া আমার------।

-প্লিজ? আমি হাত জোড় করছি আপনার কাছে স্যার। আমি বাসায় যাবো। আমার বাবা মা অপেক্ষা করছে আমার জন্য----।

আবীর নীলিমার দিকে হাতটা বাড়িয়েই ছিল। কিন্তু নীলিমার কথা শুনে বেচারা একেবারে পুতুলের মতো অসার হয়ে গেল। একটু পরে হুঁশ হতেই নীলিমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। আর নীলিমা ছোটার জন্য ছটফট করছে। এই মানুষটাকে নিজের আদর্শ হিসেবে মেনে এসেছে নীলিমা। কিন্তু তবু একটা ভয় করছে ওর। ভয়টা কিসের জানে না ও। তবে নীলিমা একটা কথা জানে। সেটা হলো ও নীলিমা নয়৷ নাতাশা। আর আবীর ওকে নয় তনয়াকে ভালোবাসে। তাই যে করেই হোক নাতাশাকে নিজের বাড়িতে ফিরতে হবে। যে করেই হোক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন