১১!!
-তাহু? তোর নামে একটা পার্সেল এসেছে। কি রে? ওঠ না? পার্সেলটা খুলে চেক তো কর কি এসেছে, কে পাঠিয়েছে? আরে এই তাহু? এই মেয়ে ওঠ না? এমন গুম হয়ে শুয়ে আছিস কেন? কি রে বাবা? ওঠ না? এই তাহু? তাহু? উঠবি তুই? নাকি তোর মাথায় পানি ঢেলে দিবো? দিবো?
অনামিকা জ্বরের ঘোরে বকবক করতে করতে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে ঘুমের কোলে ঢলে পড়তেই অরণ্য ধীর হাতে অনামিকার গায়ে একটা ভারি চাদর টেনে দিয়ে কপালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে দেখলো। মেয়েটার জ্বরটা আসলেই অনেক বেড়েছে দেখে অরণ্য অনামিকার চুলে আলতো করে হাত বু্লিয়ে দিয়ে মাথার পাশে বসে চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে নিজের মোবাইলে শপিং সাইটে গিয়ে ঢুকলো। অর্ডার প্লেস করা হয়ে গেলে অনামিকার কপালে কিছুক্ষণ রুমাল ভিজিয়ে জলপট্টি দিল। ঘন্টাখানেক অনামিকার পাশে বসে থেকে মোবাইলে পার্সেল ডেলিভারি হওয়ার কল পেয়ে একবার অনামিকার গায়ে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে দিয়ে রুমের দরজার দিকে পা বাড়ালো। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কিছু একটা মনে হতেই আবার ফিরে এসে অনামিকার ঘুমন্ত মুখটার দিকে একনজর তাকিয়ে কপালে ছোট্ট করে একটা ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিয়ে আর সেখানে দাঁড়ালো না অরণ্য। ডেলিভারিম্যানকে বিলটা মিটিয়ে দিয়ে নিজেই পার্সেলটা হাতে নিয়ে তাহিয়ার রুমের দরজায় এসে নক করেছে অরণ্য।
এদিকে, এতোক্ষণ বিছানায় চুপ করে বসে থাকলেও অরণ্যের ডাক শুনে তাহিয়া এবারে বালিশে মুখ ডুবিয়ে না শোনার ভান করে পড়ে আছে। আর এই দুই ভাইবোনের মান অভিমানের নাটকের সাক্ষী হয়ে বেচারি ফারহা আরেকবার বোকা বনে গেল। তাহিয়া কাঁদো কাঁদো মুখে অরণ্যের রুম থেকে ছুটে নিজের রুমে চলে আসতেই ফারহাও ওর পিছু পিছুই ছুটে এসেছে। এতোক্ষণ তাহিয়া গাল ফুলিয়ে বসে থাকলেও অরণ্যের ডাক শুনে বিছানায় মুখ ডুবিয়ে শুয়ে পড়েছে দেখে ফারহা আবার আকাশ থেকে পড়লো। এদের সবার এতো নাটকীয়তা কেন সেটাই বুঝতে পারে না মেয়েটা। এগুলো কি সব পরিবারেরই সাধারণ খুনশুটি? নাকি শুধু অরণ্যদের পরিবারই এমন পাগলামিতে ওস্তাদ?
-তাহু? তুই কি উঠবি মনি? নাকি স্নিগ্ধর বাবা মাকে কল করে বলবো উনাদের গুণধর ছেলে কাউকে না জানিয়ে আমার পিচ্চি বোনটাকে বিয়ে করে ফেলেছে? করবো কল? ওয়েট? তোমার শ্বশুরমশাইয়ের নাম্বারটা কত যেন তাহু? 01-----।
অরণ্যের কথাটা শেষ করার প্রয়োজন হলো না। অরণ্যের কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই তাহিয়া রীতিমতো লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসে চোখ বড় বড় করে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে দরজার দিকে তাকালো। নাহ! কেউ নেই। মা বাবা কেউ একজনও যদি জানতে পারে তাহলে কি হবে সেটা ভেবেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে মেয়েটার। অরণ্য সত্যি সত্যিই মোবাইলে কারো নাম্বার ডায়েল করছে ভেবে পড়িমরি করে উঠে অরণ্যের হাত থেকে মোবাইল আর পার্সেলের বক্স দুটোই নিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো তাহিয়া। এই ছেলেটা যে ওকে ভয় দেখানোর জন্য মোবাইলটা এমনি ডায়েল করছিল সেটাও মোবাইলটা হাতে নিয়ে টের পেয়েছে তাহিয়া। আর অরণ্যের ওকে এভাবে বোকা বানানোয় তাহিয়ার রাগও হচ্ছে প্রচন্ড। কিন্তু বেচারি কিছু বলতেও পারছে না। একটু চিল্লাপাল্লা শুনেই বাবা মা এসে পড়লে তো মহা কেলেঙ্কারি কান্ড ঘটে যাবে। তখন আবার না বিয়েটাই পিছিয়ে দেয় সবাই মিলে এই ভয়েই প্রতিটা সেকেন্ড কাটে তাহিয়ার। আর ওর এতো চিন্তার মাঝে এই ভদ্রলোকটি মজা নিচ্ছেন দেখে একটা পেপার ওয়েট মারতে মন চাচ্ছে তাহিয়ার। কিন্তু বেচারি নিরুপায়। কিচ্ছু করার জো নেই। একে তো বড় ভাই, তার উপরে তাহিয়ার সমস্ত ক্রাইমের একমাত্র সাক্ষী বলুক বা সাপোর্টার বলুক সবই অরণ্য। ওর মাথা ফাটিয়ে লসের বদলে যে লাভ হবে না সেটাই নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করছে তাহিয়া।
-কি রে তাহু? বললি না তো পার্সেলটা কে পাঠিয়েছে? আর কি আছে খুলে দেখলিও তো না? ব্যাপার কি বল তো? তুই আর স্নিগ্ধ নতুন কোনো সিক্রেট কার্যকলাপ শুরু করেছিস নাকি?
-মিস্টার অরণ্য চৌধূরী, ডোন্ট ট্রাই টু বি ওভার স্মার্ট ওকে? তোমার বউকে একটু কথা শুনিয়েছিলাম বলে আমাকে কি বকলে তুমি। আবার এখন এসেছ গিফ্ট দিয়ে রাগ ভাঙ্গাতে? নো ওয়ে। তোমার আর তোমার বউ, কারো সাথেই কথা নেই আমার।
-হাহ! আমার ঠ্যাকা পড়েছে তোর রাগ ভাঙ্গানোর জন্য তোকে গিফ্ট দিতে। আর কাকে কি বলবি, কি খাবি না খাবি সেটা তো তোর ব্যাপার। এসবে আমি আর কি বলবো?
-এহ! আসছে আমি আর কি বলবো বলতে! একটু শুধু বলেছিলাম লুচি আলুরদম ভালো হয়নি, তাতেই কত কাহিনী করে ফেললো সে। নিজে তো একাই সব খেয়ে সাবাড় করলো, যেন আর কারো বউ জীবনে লুচি বানায় নি। হুহ।
-উমমম। এটা ঠিক বলেছিস তাহু। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। তোর খেতে ইচ্ছে হয়নি, খাস নি। তাতে কি এমন হলো তাই না বল?
-সেটাই তো। এতো সকাল সকাল এতো তেল মসলা খেলে মটু হয়ে যাবো না বল? তখন স্নিগ্ধ যদি বলে আমি মোটা বউ নিয়ে সংসার করবো না, তখন আমার কি হবে রে ভাইয়া? এর চেয়ে আমি যেমন আছি তেমনই ভালো।
-আসলেই তো! ঠিকই তো। যেভাবে দিন দিন ড্রামের মতো ফুলছিস তাতে দুদিন পর হয়তো বাবাও তোকে চিনতে পারবে না। স্নিগ্ধ বেচারাই বা কি দোষ দিবি বল?
-ভাইয়া ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। নিজের বউয়ের সেবা করো গিয়ে যাও। আমার পিছনে লাগলে কেন আবার? বললাম তো তোমার বউকে নিয়ে আর একটাও কমেন্ট করবো না আমি। তুমি বউয়ের হাতের রান্না খেয়ে খেয়ে পেটু হও, কার কি তাতে? হুহ।
-তোর মতো তো পেটুক না আমি। একদিকে খাবো না বলে নাটক করছে, অন্যদিকে সব খেয়ে সাবাড় করে দিয়েছে। তোদের এই বস্তা পচা নাটকটা এবার ক্ষ্যামা দে মেরি বেহেন প্লিজ?
-কি! কি নাটক করলাম আমি?
-তুই তো আজীবনের নটাঙ্কিবাজ। বাট বাবা মা এই বয়সে এমন পাগলামি করলে কেমন লাগে? আমি অনুর সাথে কেন এতোদিন মিসবিহেভ করেছি সেটা তুইও জানিস, বাবা মা ও জানে, তাহলে এ নাটকটা কেন বল তো?
অরণ্যের কাছে ধরা খেয়ে তাহিয়া আপাতত আলোচনার দিকে গেল না। ধীর হাতে পার্সেলের বক্সটা খুলে চকলেটের একটা বড় বক্স হাতে পেয়ে আয়েশ করে একটা চকলেট মুখে পুরে আরেকটা ফারহার দিকে এগিয়ে দিল। ফারহা এদের দুই ভাইবোনের কথা হা করে শুনছিল এতোক্ষণ। অরণ্য যে এভাবে হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গবে সেটা বেচারি আশাই করে নি। এবারে সবাই যদি ফারহা অরণ্যকে সব বলে দিয়েছে ভাবে? এটা ভেবেই বেচারি মেয়েটা দরদর করে ঘামছে।
-আরে খাও না ফারহা? চকলেটগুলো অন্নেক মজা। আমি যতবার রাগ করি, ভাইয়া এই চকলেটটা এনে দেয়, আর আমার সব রাগ ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়, বুঝলা? তুমিও নাও না? এই বজ্জাত ছেলেটা না আমাকে বকেছে? তাই ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাবো আজকে। একটাও দিবো না।
ফারহা থতমত খেয়ে একবার অরণ্যের দিকে তাকিয়ে তাহিয়ার হাত থেকে চকলেট নিয়ে আবার চিন্তা করতে লাগলো।
-এই ভাবিটাকে নিয়ে যে কি করি আমি? আমি জানতাম ভাবি শেষমেশ সবটা বলে দিবে। হুহ। একটু মজা নিত দুটো দিন, তা না। ধ্যাত। আমার সব প্ল্যানিংই জলে গেল। এবার আবার তুই ভাবিকে বকবি আগের মতো তাই না ভাইয়া? ভাবি কিন্তু এসব কিচ্ছু জানতো না বিশ্বাস কর? আমার কথা বিশ্বাস না হলে ফারহাকে জিজ্ঞেস কর? এই ফারহা তুমি বলো তো? ফারহা এসব কিচ্ছু জানতো? তুমিই বলো?
তাহিয়ার প্রশ্নটা শুনে অরণ্য ফারহার দিকে তাকাতেই ফারহা জোরে জোরে মাথা নেড়ে অনামিকা কিচ্ছু জানতো না বোঝানোর চেষ্টা করলো। বেচারি মাত্রই মাত্রই চকলেট মুখে পুরে দিয়ে কথাই বলতে না পেরে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। তাহিয়াকে এখনই ওকে সাক্ষী বানাতে হলো? এবার অরণ্য কি জিজ্ঞেস করবে কে জানে!
-সব কিছু প্ল্যানিং করে হয় না রে তাহু। তুই প্ল্যানিং করে অনুর জন্য আমার মধ্যে নতুন করে কোনো ফিলিংস জাগাতে পারবি না। কেন জানিস? ওকে প্রথমবার দেখার পর থেকে আমার সবটা জুড়ে শুধু অনামিকাই আছে। আজীবন বুকের বা পাশটায় শুধু ওর মুখটাই থাকবে। কিন্তু আমি হাজার চেষ্টা করলেও এটা ভুলতে পারি না ও অন্য কাউকে চায়, অন্য কারো জন্য বাড়ি ছেড়েছিল, অন্য কারো হয়ে বাঁচতে চায় আমার অনুকে। ওকে নিজের বলে দাবি করবো কোন অধিকারে বল?
অরণ্যের কথাগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা তাহিয়ার কানেও এসে বাজলো। আপাতত চকলেট খাওয়া বন্ধ করে ভাইয়ের দিকে তাকালো তাহিয়া। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবার নিজেই বলা শুরু করলো তাহিয়া।
-আমরা যা দেখি বা শুনি তার থেকে বাস্তবতাটা একটু হলেও আলাদা হয় ভাইয়া। ভাবি হয়তো কাউকে ভালোবাসতো, কারো জন্য বাড়ি ছেড়েছিল। কিন্তু তার পরে কি হয়েছিল সেটা তো আমরা জানি না। তাহলে ভাবি তোকে ঠকিয়েছে এ কথাটা কেন ভাবিস তুই সবসময়? ভাবি হলুদের দিন চলে গিয়েছিল মানলাম। কিন্তু ফিরেছে তো। যে কারণেই হোক, ভাবি ফিরে এসেছিল। তোদের বিয়েটাও তো হয়েছে। বিয়েটা তো আর মিথ্যে নয় ভাইয়া? এতোগুলো দিনে তুই ভাবিকে লাগাতার যাচ্ছেতাই অপমান করেছিস, আর নয়তো সবার থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছিস। এর মধ্যে কি তোর একবারও মনে হয়নি কি হয়েছিল ভাবিকে জিজ্ঞেস করতে? একবারও মনে হয়নি জিজ্ঞেস করার যে এতো অপমান করার পরও কেন ভাবি এখানেই পড়ে আছে? তোর কাছে?
-সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নেই তাহু।
-কিছু প্রশ্নের উত্তর জানাটা দরকার ভাইয়া। রাগের বশে আমরা যা ভাবি বা করি তা কখনোই ঠিক হয়না। পরে শান্ত মাথায় ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আর ভাবির যদি তোকে ধোঁকা দেয়ারই হতো তাহলে পুরো ব্যাপারটা লুকিয়ে যেত তোর কাছে। তুই কখনো জানতেই পারতি না ভাবি কখনো কারো জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল বা হোয়াট এভার।
-হুম। শুনতে তো চাই ই। তার আগে এই সাহিলকে খুঁজে বের করতে চাই আমি। অনু আমাকে পুরো ব্যাপারটা বলুক না বলুক, সাহিলের কাছ থেকে হলেও জানবো যে ঠিক কি হয়েছিল সেদিন।
-আমার মনে হয় একবার ভাবিকে জিজ্ঞেস কর। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াটা আগে দরকার। তারপর নাহয় অন্য কাউকে নিয়ে ভাবিস। নয়তো একূল ওকূল দুকূলই যাবে। হুহ।
-কাকে দুকূল ভাসিয়ে দিলি বল তো? আর তোর ব্যাপারটা কি বল তো তাহু? স্নিগ্ধর সাথে কি ঝামেলা চলছে নাকি? ওরা আসবে আগামী সপ্তাহে, আর এদিকে তুই কিছুই জানিস না এ ব্যাপারে। কাহিনী কি? বিয়ে করে কি প্রেম ট্রেম সব ফিনিশ?
-আরে ধুর! সেদিন ক্যাম্পাসে এক সিনিয়ার ভাইয়া এসে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছিল আমার সাথে। তা দেখে এই ছেলে কি রাগ! তার কথা হলো সিনিয়ার হলে সিনিয়ার, তার সাথে কথা বলবো কেন? এইসব লেইম কথবার্তার কোনো মানে আছে বল? ফ্যামেলি রাজি না হলে যদি বিয়ে না হয় আমাদের এই কাহিনী বলে কাউকে না জানিয়ে বিয়েটা করেছে। এখন বিয়ের পরেও যদি এসব ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে তার সাথে আমার ঝগড়া করতে হয় তাহলে কেমন লাগে বল তো? হুদাই এমন কাহিনী করার চেয়ে কয়দিন কথা না বললেই ঠিক সিধে হয়ে যাবে। প্রতিদিন এসব আজাইরা প্যাঁচাল করতে আসবে না আর। এবার বুঝুক মজা। হুহ।
তাহিয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে আবার চকলেটের বক্স নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেছে দেখে হাসলো অরণ্য। এতো বড় বড় জ্ঞান দিয়ে নিজেই রাগ করে বসে আছে দেখে অরণ্য তাহিয়ার চুলগুলো একটু এলোমেলো করে দিয়ে নিজের রুমের দিকেই পা বাড়ালো। তাহিয়াকে এখন কিছু বললেও মেয়েটা কথা শুনবে না এটা অরণ্য ভালো করেই জানে। তাছাড়া ওদের ব্যাপারটা নাহয় ওরা নিজেরাই মিটিয়ে নিক। অরণ্য আপাতত নিজের রুমের দিকে পা বাড়িয়ে অনামিকার কথাই চিন্তা করতে লাগলো। আসলেই সবটা জানা দরকার অরণ্যের। আর কত দিন এই মিছেমিছি মান অভিমানের খেলা চলবে? এবার নাহয় সব অভিমান ঘুচিয়ে ওদের সংসার পর্বটা শুরু হোক। অরণ্য-অনুর সংসার।
১২!!
অনামিকাকে কি কি প্রশ্ন করবে সেটাই মনে মনে গুছিয়ে নিতে নিতে তাহিয়ার রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে অরণ্য। নিজের মনে প্রশ্নগুলো বারবার নাড়াচাড়া করেও যে ছেলেটা খুব একটা সাহস পাচ্ছে তেমনটাও নয়। এর আগেও বহুবার অনুকে প্রশ্নটা করবে ভেবেছিল অরণ্য। কিন্তু শেষমেষ আর করা হয়ে ওঠে নি। দুজনের মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। বারবার প্রশ্নটা করতে গিয়েও কিছু একটা হারানোর ভয়ে বারবার পিছিয়ে এসেছে অরণ্য। আজও বারবার অনুর কাছে যেতে গিয়েও পা থমকে আসছে অরণ্যের। তবু পা টেনে টেনে এক ধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে ছেলেটা। তিনমাস পর কেন কথাটা জানতে চাচ্ছে, অনু যদি জানতে চায় তাহলে কি জবাব দিবে সেটাই ভাবার মাঝে রান্নাঘরের দিক থেকে খু্টখাট আওয়াজ ভেসে আসায় থেমে গেছে অরণ্য। তাহিয়া আর ফারহা রুমে, মা বাবা দুজনেই বেরিয়েছে, বাকি রইলো অনামিকা। ওকে তো রুমে শুইয়ে দিয়ে এসেছিল অরণ্য? তাহলে রান্নাঘরে কে? কথাগুলো ভেবে অজান্তেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল অরণ্যের। ধীর পায়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে রান্নাঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে একটু বিস্মিতই হয়েছে ছেলেটা। অনু কোমড়ে আঁচল গুঁজে ব্যস্ত হাতে রান্না করছে। এই মেয়েটাকে না ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছিল অরণ্য? এতো জ্বর নিয়েও কেন যে এতো ছটফট করে মেয়েটা কে জানে? অনু চুলোয় ভাত বসিয়ে বেসিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে এবারে অরণ্য অনুর একটা হাত চেপে ধরে নিজের দিকে ফেরালো। এবারে অনামিকা যে একটুও চমকে ওঠে নি সেটাও চোখ এড়াল না অরণ্যের।
-তোমার সমস্যাটা কি অনু? জ্বরটা না বাড়ালে কি তোমার চলছে না? এতো জ্বর নিয়ে আবার তোমার পানি ঘাটতে আসতে হলো? তোমাকে না আমি ওষুধ খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে এলাম। তুমি রুম থেকে নিচে নেমে এলে কোন সাহসে? তাও আবার রান্না করছ? বেশি পাখনা গজিয়েছে তাই না মেয়ে?
-রান্না না করলে সবাই আজ খাবে কি? আমি নাহয় জ্বরে না খেয়ে শুয়ে থাকবো। বাকিরা? তাদের খাওয়া লাগবে না?
-বাকিদের খাওয়ার চিন্তা কেউ তোমাকে করতে বলেছে? নাকি তুমি একদিন রান্না না করলে সবাই উপোশ থাকবে হ্যাঁ? চুপচাপ রুমে যাও মেয়ে। আর একবারও যদি ফ্লোরে শুয়ে ঘুমাতে দেখি তাহলে সোজা বাড়ির বাইরে শুইয়ে দিয়ে আসবো। কথাটা যেন মনে থাকে।
-আমার ঘুম আসছে না এখন। তাছাড়া অনেক বেলা হয়ে গেছে। রান্না না করলে হয়তো কেউ না খেয়ে থাকবে না। কিন্তু নিজের কাজটা তো করতেই হবে। অযথা বাহানা দিয়ে কাজে ফাঁকি কেন দিবো?
-আমি খাবার অর্ডার করে দিবো। এদিকটা আমি সামলে নিবো। তুমি যাও। রেস্ট করো গিয়ে।
অরণ্য কথাগুলো বলতে বলতে অনামিকা একটু সরে এসে আবার বেসিনে সকালের আধোয়া প্লেট বাটির ধোয়ার জন্য হাতে স্ক্রাবার তুলে নিচ্ছে দেখে অরণ্য অনুকে টেনে আরেকবার বেসিনের সামনে থেকে সরিয়ে আনলো। অনামিকা আবারও ভাবলেশহীন চোখে অরণ্যের দিকে তাকালো।
-আমার কথা কি কানে যাচ্ছে না তোমার? বলছি একটা করছ আরেকটা? বললাম না রুমে যাও? এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জ্বর নিয়ে পানি ঘাটতে মজা লাগছে তোমার? নাকি জ্বরে আবার সেন্সলেস হলে ভালো লাগবে? কোনটা?
-কিছুই হয়নি আমার। আমি একদম ঠিক আছি।
-কেমন ঠিক আছো সেটা আমি দেখতেই পাচ্ছি। যাও রুমে যাও?
-আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন মিস্টার অরণ্য। এই রান্নাঘরটাই আমার রুম। কিচেনের ফ্লোরটা আমার বেড-----।
-ওহ জাস্ট শাট আপ। অতিরিক্ত জেদ মোটেও ভালো নয় অনু। যা বলছি চুপচাপ শোনো। রুমে যাও। কোনটা তোমার রুম সেটা আমাকে শেখাতে এসো না।
-আপনিও আমাকে শেখাতে আসবেন না, তাহলে আমাকেও জ্বর নিয়ে আপনাকে শেখাতে হবে না। আর আপনিও বা জেদ করছেন কেন? প্লিজ ছাড়ুন? দেরি হয়ে যাচ্ছে। অলরেডি বারোটা বাজে। এখনও দুপুরের রান্না, প্লেট বাটি ধোয়া সব বাকি আমার। জ্বরটা আবার আসার আগে কাজগুলো শেষ করতে হবে আমাকে।
-জেদ আমি করছি নাকি তুমি? গা টা আবার কেমন গরম হচ্ছে খবর আছে? যাও না প্লিজ? বললাম তো এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
-আপনি পারমিশন দিলে ভাববো, না দিলে ভাবতে পারবো না এমনটা তো নয়। আমি আপনার বাড়িতে আশ্রিত হতে পারি, কিন্তু কাজ না করে শুয়ে বসে থেকে আপনার অন্ন ধ্বংসও করবো না। আর নিজের রুমে যাবো? যখন ইচ্ছে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবেন, আবার যখন ইচ্ছে নিজের রুম বলে অধিকার ফলাতে বলবেন, তা কি করে হয়? কাজের মেয়ে হতে পারি, কিন্তু এতোটুকু আত্মসম্মানবোধ এখনও আছে।
কথাগুলো বলেই মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দেখে অরণ্য এবারে অনামিকার কোমড় জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নিল অনামিকাকে। অনামিকা সরে আসতে গিয়েও অরণ্যের হাতের বাঁধনে আটকা পড়ে একটু থতমত খেয়ে গেল। অরণ্যও অনুর চমকে ওঠার সুযোগটা কাজে লাগিয়ে আরো কিছুটা নিবিড় করে জড়িয়ে নিল অনামিকাকে।
-আ'ম সরি অনু। ভুল হয়েছে। মানছি তো? সব কিছু ভুলে আবার নতুন করে শুরু করা যায় না সবটা? এভাবে রাগ করে থেকো না প্লিজ? তুমি সেদিন কি বলতে চেয়েছিলে জানি না। সবটা শোনার আগে ওভাবে রিএক্ট করা উচিত হয়নি স্বীকার করছি। প্লিজ মাফ করে দাও?
-চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে কথাটা শুনেছেন কখনো অরণ্য? আপনার ব্যাপারটাও সেরকম হয়ে গেল না? আপনি রাগ করেছেন, তাতে কিছু যায় আসে না আমার। রাগ করে চড় মেরেছেন, দূরে ঠেলে দিয়েছেন নিজের, সেটাও মেনে নিয়েছি সহজেই। কিন্তু আপনি আপনার জীবন থেকেই আমাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছেন এটা আমার হজম হয়নি। সেদিন আমার কথাগুলো শোনার পর যদি আপনি সিদ্ধান্তটা নিতেন আমি একটুও কষ্ট পেতাম না বিশ্বাস করুন? কিন্তু আমার কথাগুলো শোনা তো দূর, আপনি সোজা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ছাড়াছাড়ির। আপনার বাড়িতেও রেখেছেন নেহায়েতই ভদ্রতার খাতিরে, করুণা করে। অথবা বাধ্য হয়ে। ছয় মাস নাকি এক বছরের আগে ডিভোর্সটা হতে লিগ্যাল কোনো ইস্যু আছে তাই হয়তো। বাট আপনি চিন্তা করবেন না। যখনই ঝামেলা মিটে যাবে তখনই আপনার ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিবো। আপনাকেও এই অযাচিত সম্পর্কটার বাঁধন থেকে মুক্ত করে দিবো। প্রমিস।
-অনু? এবার কিন্তু তুমি জেদ করছ। আমি সব মিটমাট করে নতুন করে শুরু করার কথা বলছি, আর তুমি আছো মুক্তি দেয়ার ভাবনায়। এসব কোন ধরনের কথা? আচ্ছা এখন এসব বাদ দাও। রুমে চলো তুমি। আমার কিছু কথা আছে, সেগুলো শোনো। তোমার কথাগুলোও আমার জানা দরকার। দুজনে নিজেদের মধ্যে ক্লিয়ার হয়ে নিই বিষয়গুলো। তারপর যা ভালো হয় করো।
-আমি মরে গেলেও আপনাকে আর কিছু বলবো না। কখনোই না। আর আপনার দয়ারও দরকার নেই আমার। না কিছু বলার আছে আপনাকে, না শোনার আছে আপনার কাছে। যতদিন আছি এভাবেই আপনাদের কাজের মেয়ে হয়েই থাকবো। আর কোনো পরিচয় আমার প্রয়োজন নেই।
কথাগুলো বলতে বলতে রীতিমতো গলা ভারি হয়ে এসেছিল অনামিকার। তাই অরণ্যের হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে নিয়ে বেসিনের ডুবো পানিতে হাত ডুবিয়ে প্লেট বাটি থুপথাপ করে ধোয়ার চেষ্টা করছে মেয়েটা। অরণ্যও এক মূহুর্ত থমকে গিয়েছিল অনুর কথায়। মেয়েটা আলতো আলতো কেঁপে উঠে প্লেট বাটি ধোয়ার চেষ্টা করছে দেখে অরণ্যও একদম অনামিকার গা ঘেঁষে এসে অনামিকার বেসিনের ঘোলা সাবান পানিতে ডোবানো হাত জোড়া নিজের দু হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে অনামিকার কাঁধে ঘাড়ে আলতো করে নিজের খোঁচা দাড়িগুলো দিয়ে ঘষা দিল। অনামিকা একবার কেঁপে উঠে নিজের হাত জোড়া অরণ্যের হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই অরণ্য আরো নিবিড় হয়ে অনুর সাথে মিশে দাঁড়িয়ে অনামিকার কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে হাসলো।
-তোমাকে আমার জীবনে আনতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাকে জানো? শুধু একনজর দেখে যাকে পাওয়ার জন্য এতো পাগলামি করেছি তাকে কি এতো সহজেই ছেড়ে দিব ভেবেছ? উঁহু। একদম না। যত দূরে পালাতে চাইবে তত আবেগ দিয়ে বাঁধবো তোমায়। যত পিছিয়ে যেতে চাইবে, ততই পা এগিয়ে আসবো তোমার কাছে। এই জেদটা সেই প্রথমদিন যদি দেখাতে তাহলে আমাদের জীবন থেকে অভিমানেই তিনটা মাস এভাবে হারিয়ে যেত না হয়তো। কি আর করা! মাই ব্যাড লাক। বাট ইউ নো হোয়াট আমার জিদ্দি বউ? তোমার এই জেদী রাগী ঘাড়ত্যাড়া মেজাজটাও দারুণ ভালো লাগছে আমার। তোমাকে শান্ত, লক্ষী বউয়ের চেয়ে এমন জিদ্দিমনি রূপেই একদম পার্ফেক্ট লাগছে। তবে ম্যাডাম অনামিকা চৌধূরী, এটাও ভুলে যাবেন না যে আপনার হাজবেন্ডও কম জেদী না। আপনি তার যতটা না জেদ, তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি ভালোবাসা। আপনাকে তো সে এতো সহজে ছাড়বে না। ইনফ্যাক্ট আপনি যত জেদই করুন, আপনার অতীত বলুন না বলুন, যাই ঘটুক আপনার অতীতে, আপনাকে সে ছাড়বে না। কখনোই না।
-আমি কাজ করছি অরণ্য। ছাড়ুন প্লিজ?
-একটু আগে কি বলছিলেন ম্যাডাম? আমার দয়ার, করুণার আপনার দরকার নেই। আপনাকে তো দয়া বা করুণা করছি না আমি। ভালোবাসছি, ভালোবাসতে চাইছি। সেটারও কি দরকার নেই? হুম?
অরণ্যের আলতো ঠোঁটের ছোঁয়ায় আলতো করে কেঁপে কেঁপে উঠছিল অনামিকা। রাগ, অভিমান, জেদ সবই পানি হয়ে ভেসে যাওয়ার আগে অনামিকা বেসিন থেকে নিজের হাত জোড়া তুলে নিয়ে অরণ্যের সামনে থেকে সরে এসে ঘুরে অরণ্যের দিকে তাকালো। অরণ্য মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে অনামিকার মুখের উপরে এসে পড়া চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে অনামিকার গালে আলতো করে আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিল। মেয়েটা আরেকবার কেঁপে উঠেছে দেখে অরণ্য একটু শব্দ করেই হাসলো এবারে।
-এক্ষুণি যদি কিচেন থেকে না বের হও মেয়ে, তাহলে স্পর্শগুলো আরো কত গভীর হবে কল্পনাও করতে পারবে না। সেই গভীর ভালোবাসার পরশগুলো হজম করার ক্ষমতা আছে তো ম্যাডাম?
-আপ-আপ-আপনি এগিয়ে আসছেন কেন এভাবে? দেখুন চুলোয় ভা-ভাত বসানো--। আমার রান্নাও হয়ে যাবে, বেশি সময় লাগবে না।
-জানি তো। আমি কি কিছু বলেছি তোমাকে? তুমি কাজ করতে চাইছ তো কিচেনে? করো। নো প্রবলেম। আমি তো আছি। এই অনু? তোমার কোনড়ের বা পাশের তিলটা এতো সুন্দর কেন বলো তো? ওহো সরি! বারবার চোখ চলে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ সামনে থাকলে হাতও চলে যাবে, পরে আবার আমার দোষ দিও না যেন।
অরণ্যের এতো বকবক আর আলতো স্পর্শের মাঝে আর বেশিক্ষণ কিচেনে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস বা শক্তি কোনোটাই পেল না মেয়েটা। মোটামুটি এক ছুটে গিয়ে তাহিয়ার রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো অনামিকা। অনামিকাকে এভাবে ছুটে এসে দরজা বন্ধ করতে দেখে তাহিয়া আর ফারহা দুজনেই হা করে বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। আর অন্যদিকে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে বেসিনের প্লেট বাটিগুলো হালকা হাতে ধুয়ে তুলে রাখছে অরণ্য। আর মনে মনে নিজের মনেই বিড়বিড় করছে অরণ্য।
"শাসনে যাকে বাঁধতে না পারি আদরে তো বাঁধাই যায়। আর কত পালিয়ে বাঁচো আমার থেকে আমিও দেখবো মেয়ে। জিদ্দি বউটার রাগ অভিমানগুলো যদি ভাঙ্গাতে না পারি তাহলে আমি অরণ্য চৌধূরীই না।"