২৩!!
সারারাত অনামিকাকে বুকে আগলে রেখে কখন ঘুমিয়ে গেছে অরণ্য নিজেও জানে না। অরণ্যের ঘুম ভাঙ্গলো বুকে কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে লাগায়। সচরাচর একজন সাধারণ মানুষের নিঃশ্বাসের উষ্ণতা যেমন হয়, তেমনটা নয়। হঠাৎ করে যেমন মরুভূমিতে বালির ঝড়ে সব উড়িয়ে নিয়ে যায়, কিছুটা তেমন ধরনের। ভারি নিঃশ্বাসগুলোর সাথে যেন প্রখর দাবদাহ। ধীরে ধীরে সেই উষ্ণতা যে বাড়ছে সেটা টের পেয়েই অরণ্য চোখ মেলে অনামিকা যে ওর বুকের কোণে গুটিশুটি হয়ে কাঁপছে দেখতে পেল। অরণ্য চোখের ঘুম কাটিয়ে তাড়াহুড়া করে অনামিকার কপালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে আঁতকে উঠলো। মেয়েটার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে মতন অবস্থা। অরণ্য অনামিকাকে খুব সাবধানে বালিশে শুইয়ে দিয়ে উঠে একটা বালতিতে পানি আর একটা রুমাল ভিজিয়ে এনে জলপট্টি দেয়া শুরু করলো অনামিকার মাথায়। বেশ কিছুক্ষণ পরেও মেয়েটার গা, কপাল দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে এমন অনুভব হচ্ছে অরণ্যের। মেয়েটার জ্বরটা যেন কমার বদলে আরো বেড়েই চলেছে। অরণ্য কি করবে সেটা ভাবার চেষ্টা করছে এর আগেই অনামিকা নিচু গলায় ঘুমের ঘোরে কিসব বিড়বিড় করছে শুনে অরণ্য একটু এগিয়ে এসে অনামিকার গালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে ডাকলো।
-অনু? কি বলছ বিড়বিড় করে? খারাপ লাগছে বেশি? একটু পানি খাবে? দিবো?
-একদম ধরবা না। কথাও বলবা না। কাছেও আসবা না।
অনামিকা চোখ না মেলেই একটু বিরক্তিমাখা কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতেই পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে দেখে অরণ্য জাস্ট হা করে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা ঘুমের ঘোরে কথাগুলো বললো, নাকি আসলেই কোনো কারণে রাগ করে বললো কিছুই বুঝতে পারলো না বেচারা। বিস্ময়ের ধাক্কাটা কোনোমতে সামলে নিয়ে অনামিকাকে আবার ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে বালিশের উপরে পড়ে যাওয়া রুমালটা তুলে নিয়ে আবার অনামিকার আগুনের মতো উত্তপ্ত কপালে জলপট্টি দেয়ায় মন দিলো অরণ্য। অনামিকার বিড়বিড় বন্ধ হলেও ঘুমের মাঝেও মেয়েটার চোখে মুখে একটা বিরক্তির ভাব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অরণ্য। কিন্তু মেয়েটার এই সাত সকালে অরণ্যের উপরে এমন বিরক্ত হওয়ার কোনো কারণই অরণ্যের তো নজরে পড়ছে না।
-বলেছি না ধরবা না একদম? কপালেও হাত দিবা না। কাছেও আসবা না। বুকেও জড়িয়ে নিবা না। একদম গুনে গুনে এক শ হাত দূরে থাকবা আমার থেকে।
-অনু? কি পাগলামি করছ? জ্বর এসেছে তো বাবা? জলপট্টিটা দিতে দাও?
-না। ধরবা ন। বললাম না? কাছেও আসবা না। তুমি খুবি খারাপ একটা লোক। আমি থাকবোই না তোমার সাথে। এক্ষুণি চলে যাবো। সরো।
-আরে বাবা! কি করেছি সেটা তো বলো? নইলে বুঝবো কি করে কেন রাগ করেছে আমার বউটা?
-একদম বউও বলবা না। খারাপ লোক একটা। আমি বলেছিলাম বিয়ে করতে? তাহলে করলে কেন বিয়ে?
-সরি ম্যাডাম, ভুল হয়েছে আপনার অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করে। পরেরবার আপনার কাছে পারমিশন নিয়ে তারপর বিয়ে করবো, কেমন?
-কি বললে?! আবার বিয়ে করবে তুমি? খুন করে ফেলবো না তোমাকে? সাহস কত বড় আবার বিয়ে করতে চায়! আর যদি একবার বলেছ-----।
-কি আর করবো বলো? তুমি তো কাছেও আসতে দিচ্ছ না। ছুঁতেও দিচ্ছ না। আদরও করতে দিচ্ছ না। বিয়ে করে লাভটা কি হলো যদি বউকেই না পাই? এর চেয়ে আরেকটা বিয়ে করলে ভালো হবে না?
-খুন করে ফেলবো। একদম কলিজা টেনে কুচিকুচি করে কেটে ড্রেনে ফেলে দিয়ে আসবো অসভ্য ছেলে। ওই ওই! আমি কাছে আসতে দিই না? নাকি নিজে আমাকে আসতে দাও না কাছে? আবার যদি বিয়ের কথা বলো জিভটা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো না? হা করো, হা করো বলছি? এখনই তোমার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। কত বড় সাহস! বলে আবার বিয়ে করবে!
ঘুমের মাঝেই অনামিকা উঠে বসে বহুকষ্টে চোখ মেলে তাকিয়ে সত্যি সত্যিই বিছানায় উঠে বসে অরণ্যের মুখের দিকে হাত নিচ্ছে দেখে অরণ্য চট করে অনামিকার হাত দুটো ধরে ফেললো। একে তো।জ্বর, তার উপরে ঘুমের ঘোরে মেয়েটার মাথায় কিসের ভূত চেপেছে কে জানে! অরণ্যের আর অনামিকাকে রাগানোর সাহসই হলো না। অনামিকাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নেয়ার পরও মেয়েটা ছোটার জন্য নাচানাচি করছে দেখে অরণ্য আলতো করে অনামিকার মাথাটা নিজের কাঁধে ঠেকিয়ে চুলে বিলি কেটে দিতে শুরু করলো। মেয়েটা তখনো রাগে ফুঁসছে রীতিমতো।
-অনু? এতো রাগ করছ কেন বলো তো? আমি আরো ১০০ বার বিয়ে করলেও তো তোমাকেই করবো নাকি? আর কারো যোগ্যতা আছে নাকি আমার লক্ষী বউটার জায়গা নেয়ার?
-তাহলে ওই মেয়েটাকে বাড়িতে এনে রেখেছ কেন? সারাদিন অসভ্যের মতো তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে কেন ওই বদমাইশ মেয়েটা? তুমি ডাকলেই কেন ছুটে যায়? কই আর কারো ডাক তো কানেই শোনো না যেন।
-কার কথা বলছো গো বউ? ফারহা?
-ওই ওই ওই! ওই মেয়ের নাম মুখে নিলেও জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। আরেকদিন ওর দিকে তাকালে চোখ উপড়ে ফেলবো। অসভ্য ছেলে! সাহস হয় কি করে আমার সামনে ওই বজ্জাত মেয়ের নাম নাও তুমি?
-আরে বাবা! শোনো না? ওকে তো এনেছি যাতে তোমার হেল্প হয়।
-একটাও বাজে কথা বললে না খুন করে ফেলবো তোমাকে। কাল সকালে যদি ওই মেয়েকে বিদায় না করো তাহলে সবগুলো চুল ছিঁড়ে ফেলবো তোমার।
-ওরে বাবা রে! বউটা কি পাগল হয়ে গেল নাকি গো? জ্বরের ঘোরে কিসব উল্টাপাল্টা বকছে?
-এই কি বললে? আমি পাগল? তুমি পাগল। ওই বজ্জাত মেয়েটা পাগল। ওই মেয়ের জন্য তুমি আমাকে পাগল বললে? আআআআআআআ। আমি থাকবোই না আর তোমার সাথে। এক্ষুণি চলে যাবো। আমার ব্যাগ কোথাও। এক্ষুণি চলে যাবো
-অনু? এই বউটা? কেন এমন করছ? জ্বরটা বাড়ছে তো আরো বাবা? মাথায় পানিই দিতে হবে মনে হচ্ছে। শুয়ে পড়ো না প্লিজ? পুরো শরীরটা যেন জ্বলে যাচ্ছে। একটু গা হাতটা মুছিয়ে দিই। ভালো লাগবে দেখো।
-তুমি খুব খারাপ। খুব খুব খুব খারাপ। সেদিন তোমার থাপ্পড়েও এতো কষ্ট পাই নি, প্রতিদিন ফ্লোরে বিছানা পেতে শুয়েও এতো ব্যথা পাই নি, যতটা না পেয়েছি তুমি ওই মেয়েটাকে বাড়িতে আনার পর। ওই মেয়েটা কে বলো তো? আচ্ছা তুমি কি সত্যি সত্যিই ওকে বিয়ে করবে? আমাকে তাড়িয়ে দিবে?
অনামিকার কণ্ঠস্বরটা আবার ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে। তবু মেয়েটার কথাগুলো ঠিকই কানে এসে পৌঁছেছে অরণ্যের। অনামিকা যে জ্বরের ঘোরেই এসব উল্টাপাল্টা বকছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না অরণ্যের। অনামিকা আবার বিড়বিড় করছে বুঝতে পেরে অরণ্য অনামিকাকে শুইয়ে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতেই অনামিকা অরণ্যের একটা হাত টেনে ধরলো। অরণ্য বিছানায় বসে অনামিকার চুলে আলতো করে বিলি কেটে দিতেই অনামিকা চোখ বুজে অরণ্যের কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইলো লক্ষী বাচ্চার মতো।
-একদম কোথাও যাবা না এখন। আমি ঘুমাই।
-কোথাও যাচ্ছি না তো পাগলি। মাথাটা একটু মুছে দিই? ভালো লাগবে দেখো।
-নাহ। তুমি কোথাও যাবা না। আমি ঘুমাই।
-আচ্ছা ঘুমাও। আমি চুল এলিয়ে দিই কেমন?
-হুম। একদম কোথাও যাবা না---।
শেষে আরো কিসব বললো মেয়েটা অরণ্য শুনতেও পায় নি। তার আগেই মেয়েটা বিড়বিড় করতে করতে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে, নয়তো অচেতন হয়েছে। জ্বরটা এতো বেশি যে মেয়েটা জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। অরণ আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে এসে অনামিকার মাথায় বেশ কিছুক্ষণ পানি ঢাললো। হালকা করে মেয়েটার গা, মাথা, হাত, পা মুছিয়ে দিয়ে ভালো করে শরীরটা কাঁথায় মুড়িয়ে দিয়ে আবার জলপট্টি দেয়ায় মন দিল। অনামিকার মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে কখন অরণ্যের নিজেরই চোখ লেগে এসেছে অরণ্য নিজেও জানে না।
অরণ্যের ঘুম ভাঙ্গলো নিচতলা থেকে বেশ চেঁচামেচির শব্দে। অনামিকা তখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে অরণ্যের কোলে মাথা রেখে। অরণ্য বিছানায় হেলান দিয়ে মেয়েটার কপালে জলপট্টি দিতে দিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধহয়। এবারে বাইরের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে বিছানা থেকে যে নামবে সেই উপায়টাও নেই বেচারার। কাঁথা পেঁচানো অনামিকা এমনভাবে অরণ্যের কোলে মাথা রেখেছে যে অরণ্য নিজেও অনামিকার সাথে পেঁচিয়ে গেছে। এখন উঠতে হলে অনামিকাকে ঘুম থেকে তুলে ঠিক করে শুইয়ে দিতে হবে, নয়তো এভাবেই অনামিকার জাগার অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে। কোনটা করবে সেটা ভাবতে ভাবতেই চিৎকার চেঁচামেচির শব্দগুলো একেবারে অরণ্যদের রুমের বাইরেই চলে এলো। চিল্লাপাল্লার শব্দে অনামিকা কেঁপে উঠছে দেখে অরণ্য আলতো করে অনামিকার চুলে বিলি কেটে দিল যাতে মেয়েটার ঘুমটা ভেঙে না যায়। কিন্তু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলা কথাগুলো শুনে অরণ্যের হাতটাও থমকে গেল।
-আমার ছেলেটার এতো বড় সর্বনাশ করে এখনো এতো বেলা পর্যন্ত নবাবনন্দিনীর মতো ঘুমানো হচ্ছে? ছেলে মেয়েগুলোর মাথা চিবিয়ে না খেলে কি এই রাক্ষসীর শান্তি হচ্ছ না? নিজেই যত সব নোংরামি করে বেড়াবে আর দোষ আমার ছেলের ঘাড়ে দিয়ে পার পেয়ে যাবে ভেবেছে ওই রাক্ষসী? আমার ছেলে কেমন আমি জানি না? আজ পর্যন্ত কারো দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছে নাকি ও কোনোদিন? আর তোরা সবাই ওই মিথ্যেবাদী মেয়ের কথায় আমার ছেলেকে কিনা পুলিশে দিলি! তাও আবার এমন কুকুরের মতো মেরে, পিটিয়ে? ডাক তোদের ওই সর্বনাশী মেয়েকে। আমার চোখে চোখ রেখে বলুক আমার ছেলে কি করেছে ওর সাথে। কিসের বদলা নিচ্ছে। কেন এমন মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আমার আর আমার বোনের সম্পর্কটাও নষ্ট করলো। এর জবাব আমার চাই। ডাক।
২৪!!
-বাইরে এতো চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ কেন অরণ্য? কে এসেছে? আর আপনিইবা কোথায় যাচ্ছেন?
অরণ্য খুব সাবধানে অনামিকাকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে সাবধানে কাঁথাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে দিয়ে মাত্রই বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছিল অরণ্য। বিছানা থেকে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে অনামিকার কথাগুলো শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে অরণ্য। অনুকে কি করে বলবে রিশাদের মা এসে পুরো বাড়িটা মাথায় তুলেছে চিৎকার চেঁচামেচি করে? যতটুকু শুনতে পেয়েছে তাতে আন্টির সামনে অনু গেলে কি কান্ড ঘটবে সেটা ভেবেই অরণ্য জোরে জোরে মাথা নেড়ে ব্যাপারটা নিজের মাথা থেকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। অনামিকা যে ওর উত্তরের অপেক্ষা করছে সেটা খেয়াল হতেই অরণ্য একটু বিব্রত হাসির রেখে ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে অনামিকার দিকে তাকালো।
-বলুন না কি হয়েছে? কেউ কি এসেছিল? এখন তো আওয়াজ পাচ্ছি না কারো। কে এসেছিল বলুন না?
অনামিকার নিচু ক্লান্ত কন্ঠস্বরের প্রশ্নটা শুনে এতোক্ষণে অরণ্য খেয়াল করলো খালামনির গলার আওয়াজ আর আসছে না। হয়তো তাহিয়ারা নিচে নিয়ে গেছে। কথাটা মাথায় আসতেই মনে মনে একটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন অরণ্য। অনামিকাকে অবশ্য কথাটা বললো না। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে অনামিকার কপালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে শরীরের উত্তাপ চেক করে অনামিকার চুলে হাত বুলিয়ে দিল অরণ্য।
-কেউ আসে নি পাগলি। বাইরে বোধহয় কিছু নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। সেটাই চেক করতে যাচ্ছিলাম।
-ওহ! আমার কেন জানি মনে হলো আমাদের রুমের বাইরেই কেউ বুঝি-----।
-আরে না রে পাগলি! আমাদের বাড়িতে কে চেঁচামেচি করবে বলো? বাইরেই হচ্ছিল ঝামেলটা। দেখছ না সব শান্ত হয়ে গেছে আবার? তোমার জ্বরটাও এখন আর নেই। আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও কেমন? আমি দেখছি তোমার জন্য কি নাস্তার ব্যবস্থা করা যায়।
-আরে না না না। কি বলছেন? আমি ঠিক আছি একদম। সবার ঘুম ভেঙ্গে গেছে না? আমাকে দুটো মিনিট সময় দিন, আমি এক্ষুণি নাস্তার------। আউউ।
-বলছি উঠতে হবে না এখন। মজা লাগছে না ব্যথা শরীরে নাচানাচি করতে? কি যে করো না তুমি অনু! চুপচাপ শুয়ে থাকো মেয়ে। রাতে যে জ্বর এসেছিল সে খবর আছে? একদম ওঠার জন্য ছটফট করবে না বলে দিলাম। নাস্তা রেডি হতে হতে চুপচাপ ঘুম দাও একটা। দেখি ডক্টরের মর্নিং শিফ্টের সিরিয়াল পাই কিনা। তাহলো আজ আর অফিসে যাবো না।
-আবার ডাক্তার কেন? জ্বর তো এমনিতেই সেরে যাবে।
-সেটা আমাকে ভাবতে দাও, কেমন? এখন পাকামো না করে ঘুমাও আরো কিছুক্ষণ। আর নিজে নিজে ওঠার চেষ্টা করলে খবর আছে বলে দিলাম। কিছুক্ষণ ঘুমাও না? আমি এক্ষুণি যাবো, আর এক্ষুণি ফিরে আসবো। প্রমিস।
-হুম।
অরণ্য হালকা ঝুঁকে অনামিকার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। রুমের দরজাটা টেনে দিয়ে নিচে ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে অরণ্য। ড্রইংরুমের হালকা গুঞ্জনটা যেন অনামিকার কানে না পৌঁছায় তাই এই ব্যবস্থা। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে ড্রইংরুমের কথাগুলো কানে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে অরণ্যের। সেই সাথে রাগটাও যেন ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে ছেলেটার। অরণ্য চেষ্টা করলো যাতে রাগের বশে কিছু উল্টোপাল্টা ব্যবহার না করে ফেলে খালামনির সাথে। রিশাদের কাজের শাস্তি খালামনিকে দেয়ার কোনো মানেই হয় না।
-আমাকে এখান টেনে নিয়ে এলি কেন প্রভা? তুইও ওদের দলে নাম লিখিয়েছিস তাই না? তোর ভাইকে ওরা এতো মেরে শেষে কিনা পুলিশে দিল আর তুই একটা বারের জন্য আমাদেরকে কল করে জানালিও না। দুটো দিন হয়েছে এসেছিস তার মধ্যেই ওই মেয়েটা এমন ব্রেইন ওয়াশ করে দিল যে নিজের ভাইয়ের জন্যও একবার ভাবলি না? ছি প্রভা! তুই আর রিশাদ আপন ভাইবোন সেটা কি ভুলে গেছিস?
-না ভুলি নি মা। ভুলি নি বলেই সারাটা রাত লজ্জায় দু চোখের পাতা এক করতে পারি নি। আমি জানি না তোমাদেরকে তোমাদের ছেলে কি পট্টি পড়িয়েছে, কিন্তু ওর মুখের ভাষাগুলো শুনলে তুমিও কাল রাতে ওকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিতে বাবা। আমি ওর ছোটো বোন হয়ে তোমাদেরকে কথাগুলো উচ্চারণ করে বলতেও পারবো না।
-এসব বানানো নাটক, ষড়যন্ত্র সেটা কি বুঝতে পারছিস না প্রভা? আমার ছেলেকে বদনাম করার জন্য করা নাটক। রিশাদ কাল রাতেই কল করে জানিয়েছে আমাকে। আজ আসার সময়ও ওর সাথে দেখা করে, কথা বলেই এসেছি আমরা। ও সবটা বলেছে আমাদেরকে। তোর বাবাও তোর মতোই চোখে দোনামোনার চশমা এঁটে রেখেছে। কিন্তু আমি তো মা, আমি জানি আমার রিশাদ এমন কিছু করতেই পারে না।
-ভুল জানো মা। আমিও জানতাম আমার ভাইয়া, আমার হিরো। ভাবতাম আমার ভাই কোনো মেয়েকে বিপদে পড়তে দেখলে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু আমার সেই হিরো ভাই যে আরেকটা মেয়ের সম্মান কেড়ে নেয়ার জন্য হায়েনার মতো খ
ঝাঁপিয়ে পড়ে, বোনের মতো ভাবির দিকে ললুপ দৃষ্টি দেয় সেটা আমি বুঝি নি গো মা। বুঝি নি।
-প্রভা?
প্রভার কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই ওর মায়ের শক্ত হাতের একটা থাপ্পড় এসে পড়লো প্রভার গালে। প্রভা গালে হাত দিয়ে ফোঁপাচ্ছে দেখে ওর বাবা এসে মেয়েকে বুকে টেনো নিয়ে মেয়ের কান্না থামানোর চেষ্টা করলেন। তাইয়্যেবা জামানও ততক্ষণে বড় বোনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আর বাকি ছেলেমেয়েরা ভয়ে জড়সড় হয়ে সবটা দেখছে। কিছু বলবে এমন সাহস কারো হচ্ছেই না যেন।
-বড়আপা? কি করছ কি তুমি? প্রভার গায়ে হাত তুলছ কেন? ও নিজে যেটা দেখেছে, যেটা শুনেছে সেটাই বলছে।
-তুই একদম চুপ থাক তাইয়্যেবা। আমার ছেলে মেয়েদেরকে কিভাবে শাসন করবো সেটা আমি তোর থেকে শিখবো না। নিজের ছেলে মেয়ে দুটোকে তো মানুষ করতে পারলি না। তাই আমি আমার মেয়েকে মারবো না কাটবো সেটার ব্যাপারে অন্তত তুই কিছু বলিস না। ছেলেকে যদি একবিন্দুও শাসন করতি তাহলে এমন চরিত্রহীন একটা ঠগবাজ মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনতে হতো না।
-বড় আপা!
-শুনে রাখ তাইয়্যেবা, আজকের মধ্যে যদি আমার ছেলেকে আমি ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে না পারি তাহলে তোদের কাউকেই আমি শান্তিতে থাকতে দিবো না। আমার ছেলেকে যদি কোনো অন্যায় না করে জেল খাটতে হয়, তবে মনে রাখিস তোরও একটা ছেলে আছে। ছেলের বদলে ছেলে, কথাটা মাথায় রাখিস।
-বড় আপা! কিসব বলছ? রিশাদকে কি কখনো অরণ্যের থেকে আলাদা করে দেখেছি আমি? কিন্তু যে অন্যায় করো তাকে তো শাস্তি পেতেই হবে আপা। সেটা তোমার রিশাদ হোক, বা আমার অরণ্য। অন্যায়ের শাস্তি সবার জন্য সমান আপা। অপরাধী আমাদের সন্তান বলে তো তার শাস্তি মাফ করে দেয়া যাবে না। একজন সাধারণ নাগরিকের সন্তান অন্যায় করলে যে শাস্তি, একজন জজের সন্তানেরও একই শাস্তিই হবে। এটাই আমাদের সংবিধানের আইন।
-আমাকে আইনও শেখাত আসিস না তাইয়্যেবা, সংবিধানের কোন ধারায় কি আছে সেটার জ্ঞানও দিতে আসিস না। তোর ওই চরিত্রহীন, লম্পট বউয়ের জন্য তো এসব? ওকে যদি আমি রাস্তায় নামিয়ে অপমান না করি তবে আমিও রিশাদের মা নই। কথাটা মাথায় রাখিস। আর এই যে প্রভা? তুই তো বাড়ি চল আগে আমার সাথে। তোকে আমি সেখানেই দেখে নিচ্ছি। তুমি সরো। মেয়েকে আহ্লাদ দিয়ে এমন মাথায় তুলেছ যে যার তার কথায় নাচতে নাচতে নিজেদেরই কখন ক্ষতি করে দিচ্ছে নিজেও জানে না। চল তুই আমার সাথে প্রভা। এই বাড়িতে আর এক মূহুর্তও নয়।
প্রভার মা প্রভার একটা হাত চেপে ধরে টানতে টানতে বাড়ির মেইন ডোরের দিকে পা বাড়াতেই অরণ্য সামনে এসে দাঁড়ানোয় থমকে দাঁড়িয়ে গেছে দুজনেই। এবারে অরণ্যের দিকে চোখ পড়তেই ভদ্রমহিলার চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হলো। প্রভার হাতটা ছেড়ে দিয়ে অরণ্যের গালেই একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন মহিলা।
-এতো হিংসে তোর আমার ছেলেকে যে ওর জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দিলি? ছোটোবেলা থেকে একসাথেই তো মানুষ হয়েছিস। তাহলে কেন অরণ্য? কেন করলি এমনটা?
অরণ্য কিছু বলার আগেই খালামনি আরেকবার অরণ্যকে মারার জন্য হাত তুলতেই প্রভা এবারে মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রভা মায়ের একটা হাত ধরে টানতে টানতে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠছে দেখে বাকিরাও ছুটলো পিছুপিছু। মেয়েটা কি করতে চাইছে কারোই মাথায় ঢুকছে না। এমন কি অরণ্য ও বুঝতে পারছে না প্রভা কি করছে।
-তোমার ছেলের কথা শুনেই সবটা বিচার করে নিলে তো মা? কারো কথা শুনতে হবে না তোমাকে আর। না আমার, না ভাইয়ার, না আন্টির, না আঙ্কেলের, না এতোগুলো মানুষ যারা নিজের চোখে তোমার ছেলের কুকীর্তির সাক্ষী হয়ে আছে। কারো কথাই বিশ্বাস করো না তুমি। নো প্রবলেম। যাকে গালাগাল দিয়ে এতো কথা বললে, এতো অভিশাপ দিচ্ছে একটা মায়ের মন, তাকে সামনে থেকে দেখে তুমিই নিজেই বলো ওই মেয়েটা তোমার ছেলেকে ফাঁসানোর নাটক করেছে। আর কিচ্ছু বলতে হবে না তোমাকে। শুধু ভাবির সামনে দাঁড়িয়ে একবার বলো যে তোমার ছেলে কিচ্ছু করে নি। আমি এই মূহুর্তে তোমাদের সাথে বাড়িতে ফিরে যাবো তাহলে। এর আগে নয়।
কথাগুলো বলতে বলতেই প্রভা মাকে টানতে টানতে অরণ্যদের রুমের দিকে নিয় গেছে। কাঁপা হাতে একবার সাহস করে দরজার হাতলটা ধরে চাপ দিয়ে দরজার লক খোলার আগেই সামনে থেকে দরজাটা খুলে গেল। সবাই স্তব্ধ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসা অনামিকার দিকেই তাকিয়ে আছে। অরণ্য, তাইয়্যেবা, আরহান, বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ স্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করছে রিশাদের মা আর অনামিকার মুখোমুখি হওয়ার ফলাফলটা দেখার জন্য। কি ঘটতে চলেছে নতুন করে তার জন্যই অপেক্ষা এবার।