৪৭!!
সূর্য্যি মামা জাগার পূর্বে অভ্র জেগে যায়।চোখ মেলে নিজের অবস্থান দেখে নেই।সেই সোফাতেই রয়েছে এখনো।প্রেমা যাওয়ার পর এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে অভ্র। তাতে কী? ঘুমটা পরিপূর্ণ হয়ে হলো এই ঢের।
চোখ কচলিয়ে একবার সময় দেখে নেয় একবার। সকালের শাওয়ার আর নামাজ কোনটাই অভ্র ছুটতে দেয় না। আদায় করে নেয়। ঘড়িতে ছয়টা বাজার সাথে সাথে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
পৃথিবীর বুকের সবচেয়ে নজর কাড়া এবং মু্গ্ধকর দৃশ্য দেখা যায় ভোর-সকলে। আঁচল থেকে সৈন্দ্যর্য যেনো উঁপচে পরছে। অভ্র বাঁ দিকে তাকাল। সচিকত চোখে তাকিয়ে রয় বাঁ দিকে।
মাথা উরনা দিয়ে প্রেমাও দাঁড়িয়ে রয়েছে। সামনে নদীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ। উঁকিঝুঁকি মারছে। ঠোঁট টেনে হাসে অভ্র। যাইহোক এ বুকের ধুকপুকানি সে আজো অবধি আঁটকাতে পারেনি। যা প্রেমার উপস্থিতিতে বেড়ে যায়।
আংশিক দূরত্ব।তাতেও অভ্র তার বুকের ধুকপুকানিকে কাবু করতে পারছে না।
মাথায় শয়তানি বুদ্ধি আসে অভ্রের। মৃদু হেসে রুমে গিয়ে একটা বল নিয়ে আসে।
বলটা প্রেমাকে নিশানা করে ছুঁড়ে মারে।
পেঁছন ফিরতেই পিঠে ব্যাথা অনুভব করে।প্রেমা পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে দ্রুত ফিরে তাকাল। তখনি অভ্রের হাস্যজ্বল মুখে প্রেমার চোখ আঁটকে যায়। অজান্তে প্রেমার ঠোঁটেও মুক্তার হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠে।
অভ্রকে দেখে প্রেমার ব্যাথাটা নিমিষেই গায়েব হয়ে যায়। অদ্ভুদ শিহরন বয়ে যায় শরীর বেয়ে।
প্রেমার চাহনি মধ্যে অভ্র কিউট করে বলে উঠলো, 'গুড মর্নিং ডিয়ার,'
প্রতিউত্তরে প্রেমা শুধু হাসে।ঠোঁট আলগাই হচ্ছে না তার। যার জন্য সে নিরুত্তর থাকে। কোন মতে ঠোঁটের হাসিটা প্রসারিত করে মাথা নাড়ায়।
'- বলটা ছুঁড়ে মারো।
অভ্রের কথায় অন্যমনস্ক হয়ে বলটার দৃষ্টি ছুঁড়ে। সে বুঝতেই পারেনি অভ্র বল ছুঁড়েছিলে বলেই সে পিঠে ব্যাথাটা পেয়েছিলো। বলটা হাতে নিয়ে দাড়াল। অভ্রের দিকে ছুঁরে মারতেই
বলটা ক্যাচ ধরে ফেলে।
' আমি আবারও ছুঁড়ে মারছি,যদি তোমার গায়ে টাচ করে তাহলে তুমি হারবে,আর যদি টাচ না করে তুমি জিতবে, হুম?(অভ্র)
প্রেমাও শুনেও বুঝতে পারেনি,মৃদু কন্ঠে বলে,'কী??
প্রেমাকে উত্তরের অপেক্ষায় রেখে অভ্র বলটা ছুঁড়ে মারে। প্রেমা দ্রুত সরে গিয়ে চকিত দৃষ্টিতে তাকাল। বল ছুঁড়াছুঁড়িতে প্রেমা মজা পেতে শুরু করে। সেও বলটা কুড়িয়ে দ্রুত গতিতে বলটা ছুঁড়ে। মিস হয়ে যায়, তাতে প্রেমা কিঞ্চিৎ গাল বাঁকা করে,আর অভ্র হাসছে। অভ্র পুনরায় বল ছুঁড়ে বলল, 'আমিই জিতবো,তুমি হারবে।
প্রেমাও হেসে সরে দাঁড়ায়, এবং যার ফলে মিস হয়ে যায়, হাসতে হাসতে বলে উঠলো, 'আমিই জিতবো।
দু'জনে বল ছুঁড়াছুঁড়ির চূরান্ত মুহুর্তে অভ্র ইচ্ছেকৃত ভাবে হেরে যায়।এবং প্রেমাকে জিতিয়ে দেয়।প্রেমা খুশী মুহূর্তে পাহাড়ের তুঙ্গে পৌঁছায়।
এটাই দেখতে চেয়েছিলো অভ্র।প্রেমার হাসিমাখা মুখটা তাঁকে বিষণ আকৃষ্ট করে। রেলিং হাত ঠেকিয়ে দু'গালে রেখে আমোদিত স্বরে অভ্র প্রেমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে, 'কী চাই বলো? যা চাই তাই দিবো। চাঁদ,তারা,সূর্য,এসব বাদে।
প্রেমা শব্দ করে হাসে।সে কখনেই এসব চাইবে না।তাই প্রেমা বলে উঠে, 'এগুলা ন্যাকারা চাই,আমি এমন ন্যাকি না।
অভ্র রসিকতাপূর্ণ স্বরে বলে,
-'আচ্ছা,কিন্তু ঢঙ তো কম করো না। বরং বেশিই করে।
হালকা কড়া কন্ঠে প্রেমা বলে উঠে,
-'অভ্র!
-আচ্ছা বলো কী চাও? (অভ্র)
অভ্রের প্রশ্নে প্রেমা কিছুসময় মৌনতা পালন করে। কয়েক সেকেন্ড পার হওয়ার ভ্রু উঁচিয়ে আকাশের দিকে তাকাল, এবং আশেপাশের পরিবেশটা দেখে নিলো। তারপর গলা হালকা ঝেড়ে নরম স্বরে বলল,
-আমি ওই 'পদ্মবিল' যেতে চাই,প্লিজ না করো না।দেখো আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে। সঙ্গে কালো মেঘের আবরণ। বৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনা বেশি।আমি পদ্মবিল যেতে চাই। সঙ্গে একটা নৌকাও থাকবে।আর তুমি হবে আমার 'মাঝি'
রাজি তো?
প্রেমার কোমল স্বরের ধ্বনিতে অভ্র মাতোয়ারা প্রায়। নিজেকে অনেক ভাগ্যমান মনে হচ্ছে তাঁর। প্রেমা আর ওর মধ্যে অনেক মিল।অনেক!
আর যাই হোক,প্রেমার মধ্যে অন্যকোন চাওয়া নেই।সব সীমিত। একদিন এই সীমিত চাওয়ার মধ্যে দিয়ে এক শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ হবে।
-' ঠিক আছে,রেডি হয়ে নিচে এসো।
প্রেমা হেসে মাথা নাড়ায়। অভ্রের দিকে প্লেইন কিস ছুঁড়ে মারে, এবং দ্রুত রুমে চলে যায়।কাজটা করে প্রেমা নিজেই লজ্জায় মরিমরি অবস্থা।ভাবছে কতো নির্লজ্জ হয়ে গেছে।প্রেমা মনেমনে বলে উঠে,'সব দোষ অভ্রের।সেই তো আমাকে পাগল করে দিয়েছে।'
দু'হাত দ্বারা মুখ ঢেকে ফেলে।
প্রেমার আচরণে অভ্র গভীর শ্বাস টেনে হাসে। এ মেয়েটার সেল্ফ কন্ট্রোল ও নেই,
নিজ মনের সাথে বলে উঠে অভ্র।
___________
নাস্তা করে গল্প করছিলো চারজনে মিলে।তার মধ্যেই জেরিনের ফোনটা বেজে উঠে। তাত্ক্ষণিক জেরিন অভ্রের দিকে তাকাল।ফোন রিসিভ হচ্ছে দেখে অভ্র জেরিনের দিকে তাকাল।জিজ্ঞেস করল,'ধরছিস না কেন?'
জেরিন প্রেমার দিকে দৃষ্টি রেখে বলল, 'আংকেল! মানে প্রেমা আপুর আব্বু ফোন দিয়েছে।
প্রেমাও সচকিত দৃষ্টিতে জেরিনের দিকে তাকাল, এ কয়দিনে বাড়ির কথা তার মনেও পড়েনি। কতোটা স্বার্থপর সে। মনেমনে ভাবে।আবার নিজ মনে বলে উঠে, 'পৃথিবীর সকল মানুষই কোন না কোন দিক দিয়ে স্বার্থপর থাকেই। নিঃস্বার্থ সব বিলিন করে দেওয়া মানুষটি মধ্যেও স্বার্থ থাকে। এক চিলতে সুখের!
প্রেমা চোখ চিকচিক করে উঠে,তাকে যদি চলে যেতে বলে।অভ্র তো ওর অভ্যাস হয়ে গেছে।যাকে দু'দন্ড না দেখলে চোখ জ্বলে।বুক কাঁপে,চিনচিন ব্যাথা করে। গভীর শ্বাস টেনে অভ্রের দিকে তাকাল, অভ্র তখন জেরিনকে ইশারায় বলছিলে যাতে ফোনটা ধরে। সাথে একটা মেসেজও দেয়,যাতে লেখা রয়েছে কী বলতে হবে।
-আসসালামু আলাইকুম!
-ওয়ালাইকুম আসসালাম,মা তুমি কী প্রেমার বান্ধবী? প্রেমা তোমার ওখানে?
প্রেমার বাবার প্রশ্নে জেরিন অভ্রের দিকে তাকাল, এরপর বলে,'হ্যাঁ আংকেল প্রেমা এখানেই আছে।'আপনি কথা বলবেন?
-'হ্যাঁ,হ্যাঁ মা কষ্ট করে প্রেমাকে একটু ফোনটা দাও। (প্রেমার বাবা)
জেরিন প্রেমার দিকে ফোন এগিয়ে দেয়,ফোনটা হাতে নিয়ে অন্যদিকে পদাপর্ন করে প্রেমা।
প্রায় বিশ মিনিট পর মুখ গোমড়া করে ফিরে সোফায় বসল।প্রেমার মুখ দেখে অভ্র দ্রুত প্রেমার পাশে এসে বসে। জিজ্ঞেস করে,'কী হয়েছে প্রেমা? চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?
প্রেমা ভাঙা গলায় জবাব দেয়,
-কাল চলে যেতে বলেছে,তবে গ্রামে নয়।বাবা আলাদা ফ্ল্যাট কিনেছেন।সেখানে ফিরে যেতে বলেছে। তোমাকে আর জেরিনকে সহ দাওয়াত দিয়েছে।
প্রেমার কথায় অভ্র কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে থাকে,আবার হুট করে হেসে দেয়,এবং বলে,
-' তো কী হয়েছে,তোমার বিয়ে তো হয়নি,যে শশুড় বাড়ি যাবে।অবশ্যই তোমার মা-বাবা যেখানে আছে সেখানেই তোমাকে ফিরতে হবে।
এতে মন খারাপের কী আছে?
-'আমার মন খারাপের কারণটাও বুঝছে না,ছেলেটা! এমনি সব বুঝে। চাপা স্বরে কথাটা বলে মাঝখান থেকে উঠে রুমে চলে যায় প্রেমা।
অভ্র প্রেমার মন খারাপের আগা-গোড়া সব বুঝতে পেরেছে। শুধু চুপ থাকে। একটু একা থাকা দরকার প্রেমার।নিজ থেকে মনকে বুঝাতে না পারলে অন্য কারো কথায় মনকে সহজে বুঝ দেওয়া যায় না। উপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু শ্বাস ছাড়ে অভ্র।
______________
এক ঘন্টা পর প্রেমার দরজার সামনে এসে দাড়াল অভ্র। রুমে ঢোকে প্রেমাকে পায়নি।তাই সোফায় বসে অপেক্ষা করতে শুরু করে।আরো কিছুক্ষণ বাদে প্রেমা রুমে আসে।চোখেমুখে ঘাম।যেনো কোন কাজ করে এসেছে।
প্রেমা অভ্রকে খেয়াল করেনি,উরনা রেখে ওয়াসরুমে যাবে,এমন সময় অভ্র বলে উঠে,
-উরনা সাথে নিয়ে গেলে কী ক্ষতি বুঝিনা।
হঠাৎ অভ্রের কন্ঠ শুনে চমকে তাকাল প্রেমা।সোফায় বসে অভ্র মিটিমিটি হাসছে। তবে ফোনের দিকে চোখ রেখে।দ্রুত উরনা পরে নিয়ে ব্যস্ত স্বরে প্রেমা জিজ্ঞেস করে,
'তুমি এখানে?
প্রমার অযুক্তিকর প্রশ্নে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকালে অভ্র। সে এখানে থাকবে না তো কে থাকবে। তাই অভ্র তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, ' যেখানে যাচ্ছো যাও,আর প্যাকেটে যেটা আছে সেটা পড়ে তারপর এসো।
প্রেমা ভ্রু কুঁচিত করে তাকিয়ে থাকে,কিন্তু অভ্র তাকায়নি,সে ফোনে ব্যস্ত।কপট রাগ নিয়ে প্রেমাও বিড়বিড় করে কিছু বলে ওয়াসরুমে ঢোকে।প্রেমা যেতেই অভ্র হেসে উঠে। ওয়াসরুমের দরজার দিকে একটু সময়ের জন্য তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় অভ্র।রুম থেকে বের হয়ে দরজাটা বাইরে থেকে লকড করে দিয়ে,দাড়িয়ে থাকে। যেনো পাহারাদার সে।
গোসল করার পর প্রেমার নজরে আসে একটা প্যাকেট। হাতে নিয়ে খোলে দেখলো।ব্লাউজ, ফেটিকোট,এবং একটা শাড়ি।হালকা গোলাপি এবং সাদা রং মিশ্রিত। এসব দেখেই হেসে উঠে প্রেমা।অভ্র ছাড়া কে দিবে এসব।
ভেজা অবস্থায় দরজা খোলে বাইরে সোফার দিকে উঁকি দিলো। অভ্র নেই,দেখেই স্বস্তির শ্বাস নেয়। মৃদু পা টিপে দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে লক করে।
শব্দটা অভ্রের কানে আসতেই ঘুরে দরজার দিকে তাকাল।হালকা হেসে লক খুলে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায় সে।
প্রেমা শাড়ি পড়ে চুল খোঁপা করে আয়না বার বার নিজেকে দেখছে। লজ্জাই মিঁইয়েও যাচ্ছে।
অভ্র এভাবে দেখলে ওকে কী বলবে?
ফোনের মেসেজে আসে অভ্রের থেকে,
-শেষ হলে নিচে নেমে বাইরে চলে এসো।ডিয়ার!
এতুটুক পড়তেই প্রেমার শরীরের পশম দাড়িয়ে যায়।কী মারাত্মক! আত্মা কেঁপে উঠে কেন বারেবারে?
শেষ বার আবারো আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো।অতঃপর সোজা নেমে অভ্রের সামনে এসে দাড়াল। হাতে একটা সবুজ থলে।
অভ্র প্রেমাকে দেখে থমকে যায়।তবে সেটা ভেতরেই গেঁথে রাখে। প্রেমাকে বুঝতে না দিয়ে বলল,'হাতে কী?
প্রেমা দাঁত বের করে হেসে বলল, 'বিরিয়ানি' নৌকাতে বসে খাবো।
প্রেমার কথায় হাসে অভ্র। তারপর বাইকে উঠে প্রেমাকে উঠতে ইশারা করে। প্রেমার মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে যায়। শাড়ি পড়তে বলল,পড়েছে, তাও একটু প্রশংসা করলো না।ভালো বা খারাপ। প্রেমা ভাবে একটু জিজ্ঞেস করবে,পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেয়।যদি বেহায়া ভাবে তো?
- প্রেমা,আসো!
ভাবনা ভাঙে প্রেমার।অভ্রের দিকে এক পলক চেয়ে,বাইকে উঠে বসে।বিষণ মন খারাপ করে। অভ্র বাইকে স্টার্ট দেওয়ার আগে ঘাঁড় বাঁকা করে প্রেমার দিকে তাকাল,প্রেমার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। প্রেমা চোখ নামাতে নিলে,অভ্র প্রেমার মুখে ফুঁ দেয়।
মৃদু কেঁপে উঠে প্রেমা।অভ্রের ঘাঁড় খামছে ধরতে গিয়েও, থেমে যায়।উফ্ কী যে বেসামাল আমি। নিজেকে বলল প্রেমা।প্রেমার থেকে চোখ সরিয়ে অভ্র হাসে।
বাইক স্টার্ট দিয়ে অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে চলে আসে।বড় রাস্তার মোড়ে উঠে,মানুষ একদম কম এই রাস্তায়। তাই কোন জনযাট ছাড়াই বাইক চালানো যায়। আরো কিছুদূর যেতেই বামদিকে রাস্তার প্রবেশ করে।
আরেকটু যেতেই অভ্রের খটকা লাগে। কেমন যেনো অদ্ভুদ লাগছিলো।মনে হচ্ছে কেউ ফলো করছে। কিঞ্চিৎ ঘাঁরটাকে বাঁকাল।ঠিক তাই যেটা সন্দেহ করেছিলো সেটায়।
মাঝাপথে অভ্র বাইকটা থামিয়ে ফেলে,পেঁছনে বাইকে থাকা দু'জন খুব সাবধানে অভ্রকে ক্রস করে চলে যায়। তা দেখে অভ্র বাঁকা হাসে,মনেমনে বলল,
যাই করো না করো না কেন? আমাকে ধরা সহজ না।
বলেই বাইকটা পুনরায় বের হয়ে যায়,এবং রাস্তা দিয়ে অভ্রের নানার বাড়ির কাছে আসে,বাইকটা সেখানে রেখেই পেঁছনের রাস্তা দিয়েই 'পদ্মবিলে' চলে যায়।
আসার পথে প্রেমার প্রশ্নের কবলে পড়তে হয় তাঁকে। তখন অভ্র এক ধমকেই থামিয়ে দেয়।
পদ্মবিল এসে আচমকা অভ্র 'আসছি' বলে কোথায়ও উধাও হয়ে যায়।আধঘন্টা হয়ে যায় তবুও আসেনা। একসময় প্রেমা ভয়ে কেঁদে দেয়। বড় করে কয়েকবার ডাক দিয়েও সারা পায়নি, হঠাৎ.........
৪৮!!
দৃঢ়ভাবে কাঁধে কেউ স্পর্শ করতেই প্রেমা চমকে পেঁছন ফিরল।গভীর দৃষ্টি ছুঁড়ে বিপরীত ব্যক্তিটির দিকে৷ স্পর্শদাতার মুখটা তার চেনা-অচেনা দু'টোর মধ্যে পড়ছে। ভয় এবং সংকোচময় মুহুর্তে আঁটকে যায় প্রেমা। দু'পা পিছিয়ে গেলে,সেই আগুন্তকঃ প্রেমার কোমড়ে হাত রেখে কাছে টেনে আনে। প্রেমা চমকাতে গিয়েও চমকালো না,কারন এ স্পর্শ তার চেনা খুব করে চিনে!দৃষ্টি স্থির করে ফেলে সাথে সাথে
শ্বাসরুদ্ধকর কন্ঠে বলল,'অভ্র!
প্রেমার এতক্ষণের ভিতু চোখের চাহনিতে অভ্র বেশ মজা পায়। যখন প্রেমা চিনতে পারে শরীর কাঁপিয়ে হাসে।
-'উফ্ চিনে ফেললে?
অভ্রের রসিকতায় প্রেমা অসন্তুষ্ট হয়।নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালাল।অভ্র ভ্রুকুঞ্চিত করে প্রেমাকে দেখে,তার মৃদু আওয়াজে বলল, প্রেমা রিলেক্স! আমাকে ভালো করে দেখো,এতক্ষণ তো মুখ দেখলা,এবার পুরো শরীর দেখো।
অভ্রের কথার মধ্যখানে প্রেমা একচোট অভ্র দেখে নেই, থেমে যায় সে।হঠাৎ ধম ফাটানো হাসিতে মেতে উঠে প্রেমা। হাসিমাখা স্বরে বলল, 'তুমি লুঙ্গি পড়েছো? কেন? আবার মাথাটা গামছা দিয়ে বাঁধলে,মতলব কী?
প্রেমার প্রশ্নে অভ্র প্রেমাকে ছেড়ে দেয়,নিজের নকল দাঁড়ি তুলতে তুলতে বলল, ' তুমি তো বলেছিলে, তোমার মাঝি হতে।তাই লুঙ্গি, মাথায় গামছা বাঁধলাম।আর নকল দাঁড়ি লাগিয়েছি তোমার জন্য। দেখতে চেয়েছিলাম.….?
অভ্র কথা থামালে,প্রেমা ব্যাস্ত গলায় বলল, তো কী দেখলে?
মাথার গামছাটা খুলে কোমড়ে বেঁধে নেয়।লুঙ্গি তুলে গিট্টু দিয়ে, প্রেমার দিকে তাকাল,দেখে প্রেমা প্রশ্নাত্বক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, অভ্র ঠোঁটে মৃদু দুষ্টু হাসি ঝুলায়,এরপর প্রেমার দিকে এগোতে এগোতে বলল,'বলবো? কী কী দেখেছি?
প্রেমা মুখ কুঁচকাল,এটা তো তার উত্তর নয়,বরং অভ্র তার কথার ট্যারা জবাব বের করেছে। নাক ফুলিয়ে মৃদু পিছুপা হয়ে প্রেমা বলল,' থামো! বলতে হবে না,আমি বুঝেছি আগেই,
দাঁত সব করে হেসে বলল, 'ঠিক আছে,
প্রেমা আবারও অভ্রকে দেখতে শুরু করে,প্যান্টর উপরে লুঙ্গি পড়েছে,হাস্যকর। অভ্রকে এই অবস্থায় দেখবে ভাবেনি।'মাঝি'হতে বলেছিলো,কিন্তু সোজা মাঝির বেশ ধরে আসবে কে জানতো। মাথা ঝাঁকিয়ে প্রেমা নিজেকে স্বাভাবিক করে,অভ্রের উদ্দেশ্যে বলল,'নৌকা কোথায়?
প্রেমাকে পেঁছন ফিরতে ইশারা করে অভ্র,নৌকা 'পদ্মবিলে' বাঁধা,বড় বড় পাতার জন্য দৃষ্টিতে আসছেনা। প্রেমা নৌকা দেখে দৌড়ে সেদিকে গেলো। অভ্র হাসে, প্রেমার আচরণে।সেও প্রেমার পেছনে ছুটে গেলো নৌকার দিকে।
নৌকাতে উঠে অভ্র বৈটা দিয়ে নৌকা চালিয়ে মাঝখানে চলে যায়। ঠিক সেই মুহুর্তে আকাশ কাঁপিয়ে মেঘের গর্জন শুরু হয়, দুজনে নৌকার মাঝামাঝি অবস্থানে বসে আছে। প্রেমা শাড়ির আঁচল অভ্রের মাথায় তুলে দেয়।অভ্র আবার মাথা থেকে আঁচলটা সরিয়ে প্রেমার মাথা ঢেকে দেয়। এবং বলে,' ভয় পাচ্ছো?
প্রেমা মাথা নেড়ে না জানায়। অভ্র মায়াভরা হাসি হাসে।প্রেমা ভয় পেয়েছে সেটা তার জন্যই।
বাতাস বইছে। হিমশীতল বাতাস। প্রেমার অবাধ্য চুল বাতাসে এলোমেলো হয়ে যায়। হাত দিয়ে ঠেকিয়েও শান্তি পাচ্ছে না।একসময় অভ্র প্রেমার হাত জোড়া ধরে ফেলে।
পরমুহূর্তে সে নিজেই প্রেমার অবাধ্য চুলের গুচ্ছ নিজ হাতের মধ্যে নেয়,দৃঢ়তার সহে বেশ গুছিয়ে চুলে খোঁপা বেঁধে দেয়। প্রেমার কাছ থেকে সরলেই প্রেমা অভ্রের হাত ধরে ফেলে।
অভ্র প্রশ্নাত্বক চাহনি ছুঁড়ে প্রেমার দিকে,
খেয়াল করে প্রেমার চোখে পানি চিকচিক করছে। অভ্র অপরহাতে প্রেমার হাত চেপে ধরে বলল,' কী হয়েছে প্রেমা? তোমার চোখে পানি কেন? আমি কি কিছু করেছি।
অভ্রকে থামিয়ে দিয়ে প্রেমা বলে,' কালকের পর থেকে তো আমরা একসাথে থাকবো না,মানে আমি তো তখন মা-বাবার সাথে থাকবো।কিন্তু আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তোমাকে ছাড়া থাকার।অভ্যাস হয়ে গেছো তুমি। আই নিড ইউ এভরি মোমেন্ট। '
এতটুক বলা শেষ করেই প্রেমার চোখ দিয়ে আষাঢ়ি বৃষ্টি নেমে আসে। বিষণ কষ্ট অনুভব হচ্ছে তার। অভ্রকে ছাড়া তো প্রেমার নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হবে যেনো।
অভ্র নীরব থাকে একটুর জন্য।পরে মৃদু শ্বাস ছেড়ে আলতো হাসে। চোখমুখে তার প্রশান্তি।
-সিউর আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না?
প্রেমা দ্রুতু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়,তার কষ্ট হবে।দূরে থাকা তো দ্বায়।কাছাকাছি থাকলেও হতো।
অভ্র হালকা ধমকে বলে,
-মুখ নেই? মুখ দিয়ে বলো?
-হ্যাঁ, বিশ্বাস করো,আমার কষ্ট হবে। তোমাকে ছেড়ে থাকতে।
অভ্র ঠোঁট টিপে হেসে বলল,' তাহলে কাছে আসো,এখানেই তোমাকে একেবারে আমার কাছে নিয়ে আসবো।
অভ্রের কথায় প্রেমার গলায় কাটা আঁটকে যাওয়ার মতো অনুভব হয়। গম্ভীর মুখ করে চোখের পানি মুছে ফেলে।তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,' সবসময় মজা। এতো সিরিয়াস কথার মধ্যেও মজা করছে আমার সাথে। বিয়াদব ছেলে।
অভ্র এবার বেশ জোরে হাসে। প্রেমার সাথে যদি সেও ইমোশনাল হয়ে যায় তাহলে প্রেমা আরও বেশি কাঁদতো। সান্তনা বাক্য ও কাজে দিতো না,বরং কান্নার গতি বাড়াতো। তাই অভ্র উল্টোটা করেছে।তাতেই কাজ হয়েছে।প্রেমার কান্না অটোমেটিক থেমে যায়।
প্রেমা দাঁত খিঁচে ঝাঁটকা মেরে অভ্র হাত ছেড়ে দেয়।অভ্রের বুকে ধাক্কা দেয়। এবং নিজেও দূরে সরে বসে।
-'আজকেই চলে যাবো।খবরদার আমার সাথে আর যোগাযোগ রাখবে না তুমি।আমি অন্য একজনকে বিয়ে করে নিবো।তখন তুমি থেকো তোমার মতো।
এতক্ষণ সব স্বাভাবিক থাকলেও এখন প্রেমার কথাটায় অভ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। চোখ তুলে প্রেমার দিকে তাকাল। চোখ শিথিল করে আবার অন্যদিকে তাকাল। ফোঁড়ন কটে বলে,
-' কেউ চলে যেতে চাইলে আমি আঁটকানোর কে? ইচ্ছে হলে যাবে,তুমি যেভাবে খুশি সেভাবে থাকবা।আমার আপত্তি নেই।
যদিও অভ্র মন থেকে কথাগুলো বলেনি।তবে বলাটা জরুরি ছিলো। এটা একটা শাস্তিও বটে।সে নিশ্চিত এরপর থেকে চলে যাওয়ার কথা প্রেমা ভুলেও বলবে না।
প্রেমা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। অভ্রের খাপছাড়া কথা ওকে বিষণ জ্বালায়। যেনো আগুনের গোলা নিক্ষেপ করছে। নরম স্বরে বলে,
' সরি অভ্র। '
অভ্র চুপ থাকল। যেটা প্রেমাকে আরো অস্থির করে তুলে। পেঁছন ফিরে বিরিয়ানির প্যাকেটটা হাতে নেয়। অভ্র সামনে এসে বসে বাক্স থেকে বিরিয়ানি এর চামচ বের করে।
চামচ অভ্রের হাতে ধরিয়ে দেয়। 'খাও'
আমার খিদে পেয়েছে তাই উল্টাপাল্টা কথা বলছি। তোমার খিদে পেয়েছে তাই না।
অভ্র ঠোঁট বাঁকা করল।রাগত্ব স্বরে বলল, 'না'
প্রেমা এবার নরম স্বরে বললে,'সরি তো!'
অভ্র প্রেমার দিকে ফিরে,হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে একপাশে রেখে দেয়। প্রেমার দু'বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলে, ' এটা লাস্ট, এইভাবে যদি আর কখনো বলো, তো তোমাকে আমি মেরে ফেলবো।সত্যিই মেরে ফেলবো।তারপর নিজে মরবো।আমি এসব শুনতে চাই না। একদম না।
অভ্রের কথা থামলে প্রেমা অভ্রকে জড়িয়ে ধরে।
-তুমি আমার কথা সিরয়াসলি নাও না,আমি বলেছি এক আর তুমি বললে আরেক।
অভ্রের স্বরে শীতলতা নেমে আসে,একটু স্পর্শেই। মৃদু স্বরে বলে,
'একটা বছর অপেক্ষা করো। আমি তো বলেছিই সব তোমাকে।আমি তো আর উধাও হয়ে যাচ্ছি না।তোমার কাছাকাছি থাকবো। কাল থেকে আমিও তো আর ওই জায়গায় থাকবোনা।বাড়িতে চলে যাবো। রোজ কলেজে দেখা তো হবেই। আর যদি খুব একান্তে চাও তো,রাতে ফোনে কথাও হবে।মাঝে মাঝে মন অবাধ্য হয়ে গেলে,তোমার সাথে দেখা করতে যাবো।আগে যেতাম না? কতোদূর থেকে যেতাম শুধু তোমাকে দেখার জন্য। এমনি এমনি এসব কেউ করে?
শান্ত হও,কান্না থামাও আর আমাকে খাইয়ে দাও।
প্রেমা চট করে অভ্রের থেকে সরে আসে। এবার তাঁর মাথায় সব ঢোকেছে।শুধু শুধু কান্না আর মন খারাপ করেছিলো। এতো সিম্পলভাবে বুঝিয়েছে অভ্র।
প্রেমা অভ্রকে খাওয়াই,সাথে নিজেও খেয়ে নেই। প্রেমার ঘুম পাচ্ছিলো।চোখমুখের ঝিমুঝিমু অবস্থা দেখে অভ্র আর নৌকায় থাকেনি। দ্রুত উঠে যায় পদ্মবিলের মধ্যে থেকে।প্রেমা না ও করেলেও অভ্র মানেনি। আশেপাশে কারো উপস্থিত আবারও টের পেয়েছে অভ্র।আজ হয় চলে যাবে,নয়তো মেরে তারপর যাবে।
সাড়ে তিনটা! তারপরেও আকাশে মেঘ।বৃষ্টি
তো নামেই নি।প্রেমার আশায় জল পড়েছে।সে মনে প্রাণে বৃষ্টি চেয়েছিলো। প্রেমাকে শক্ত করে নিজের সাথে ধরে আছে অভ্র।
আরেকটু দূর যেতেই অভ্রের মুখ কুঁচকে যায়।যা সন্দেহ করেছিলো তাই হয়েছে।
বাইক থেকে তিনজন ছেলে নেমে আসে।মুখে শয়তানি হাসি। অভ্র একবার প্রেমার দিকে তাকাল,প্রেমাও ছেলেগুলোর দিকে চেয়ে আছে। তাৎক্ষণিক চেঁচিয়ে বলে উঠে,
-'অভ্র এরা তো সেদিন রাতের ছেলে গুলা।আরো একজন বেড়েছে দেখছি।
অভ্রের মাথায় হাত।আগ বাড়িয়ে কথা বলাটা কী জরুরি ছিলো?
ছেলেগুলো ভাবছে তারা তিনজন,আর অভ্র তো একজন। সাথে তো একটা মেয়েও আছে।
তাহলে কী দুজনকেই মেরে দিবে?নাকি...
পকেট থেকে একজন ছুরি বের করে। দুজন এগিয়ে আসে। অভ্র থমকে যায়।তার সাথে যা হওয়ার হবে কিন্তু প্রেমার কোন ক্ষতি মানবেনা।প্রেমাকে পালাতে বললেও পালাবে না।
ছেলেগুলো যতো এগিয়ে আসছে,অভ্র প্রেমাকে নিয়ে পিছিয়ে আসে। প্রেমাও বাঁচার জন্য উপায় খোঁজছে। আচমকা নিচে চোখ যায়। এবার প্রেমার মুখেও শয়তানি হাসি চলে আসে।
অভ্রকে ঝাঁটকা মেরে সরিয়ে নিচু হয়ে দু'মুঠো বালি মিশ্রিত মাটি নিয়ে ছেলেগুলোর চোখের দিকে ছুঁড়ে মারে। ছেলেগুলোর পা থেমে যায়।হাত থেকে ছুরি ফেলে তারা চোখ কচলাতে শুরু করে। তখনি অভ্র বলে উঠে, ' প্রেমা চলো তাড়াতাড়ি।
-'একদম না আমি এদের না মেরে যাবো না।সেদিন তোমার হাতে আঘাত করেছিলো,কুত্তা গুলা। সরো তুমি।
প্রেমা একপ্রকার পাগলের মতো ছুটে গিয়ে ছেলেগুলোকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। আরো বালি নিয়ে মুখে ছুঁড়ে মারে। পা দিয়ে কয়েকটা লাথি দেয় পেটে।
অভ্র একসময় প্রেমাকে টেনে নিয়ে আসে।দু'গালে হাত রেখে প্রেমাকে থামানোর চেষ্টা করে।প্রেমা বারবার তেড়ে যাচ্ছিলো।সেদিনের ক্ষোভটা আজ আবার জীবিত হয়েছে।
-' প্রেমা প্রেমা! থামো প্লিজ,কেন তুমি নিজেকে ঝড়াচ্ছো।পরে তোমার ক্ষতি করবে। এটা আমি সামলে নিবো।এখন চলো।
'-আগে বলো, কে? কারা তোমাকে বারবার মারতে আসে।বাল গুলার সাহস আসে কেমনে? তোমার গায়ে হাত দিলে আমি হাত কেটে ফেলবো।জবাব দাও কে করছে এসব?
প্রেমা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে গিয়েছে। কন্ট্রোল করা মুশকিল হয়ে পড়ে।অভ্র প্রেমাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে,' আগে চলো, পরে কোন এক সময় বলবো। তার আগে না।চলো!
অভ্র প্রেমাকে নিয়ে দ্রুত চলে যায়।মাথায় একটা ভাবনা প্রেমার কোন ক্ষতি হতে সে দিবে না।
কে এসব করছে সব জানা আছে অভ্রের।তাতে কী? সে আর তাদের কবলে পড়বেনা।একটা বছর শেষ হলেই সে অনেক দূর চলে যাবে।
যতোই হোক,পাপকে পশ্রয় দিবে না সে।