১৩!!
-ছোট্ট একটা শব্দ, কবুল। আজ এতো সময় লাগছে কেন বলো তো নীলা? আগেরবার আমি সব ছেড়ে দিবো শুনে তো এক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনবার কবুল বলে দিয়েছিলে। আর আজ তোমার নিজের পুরো পরিবারকে এতোগুলো লোক ঘিরে রেখেছে, তবুও ছোট্ট শব্দটা বলতে এতো সময় লাগছে! ব্যাপারটা কেমন না বলো তো নীলা? পাঁচটা মিনিটে বিয়ের ফর্মালিটি শেষ করে আমাদের বাড়িতে ব্যাক করার কথা। আর তুমি এদিকে না হলেও হাফ এন আওয়ার লাগিয়েছ। বলছি ম্যাডাম? শ্বশুরবাড়িতে কি রাত ১২ টায় যাবেন বলে প্ল্যান করে বসে আছেন? আপনার বাবার হাত থেকে যে রক্ত ঝড়সে সেটা মে বি আপনি খেয়াল করেন নি। ওকে সাদিক? ম্যাডাম মে বি শ্বশুরমশাইয়ের হাতের ক্ষতটা দেখতে পাচ্ছে না। আরেকবার একটু হেল্প করো না প্লিজ?
ঘরভর্তি মানুষের ভিড়ে কাজী সাহেব যখন খোতবা শেষ করে জিহানের বিয়েতে মত আছে কিনা জানতে চেয়েছে জিহান এক নিঃশ্বাসেই তিনবার কবুল বলেছে উচ্চস্বরে। এবার নীলার কবুল বলার অপেক্ষা। আগেরবারের মতো এবারও নীলা চুপ করে বসে ফোঁপাচ্ছিল এমন সময় জিহানের কথাগুলো শুনে চমকে মুখ তুলে তাকালো।
-না না না প্লিজ? আমি---আমি----আমি বলছি। বলছি। পাপাকে কিছু করবেন না প্লিজ?
-নীলামা খবরদার না। আজ আমাদের সবাইকে মেরে ফেললেও এই অমানুষটাকে বিয়ে করবি না। আমি স্বেচ্ছায় মরে যাবো, তবু তুই এই প্রতারকের কাছে মাথা নত করবি না মা। এমনিতেই তো আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছিস। আর কি চাস জিহান? এই টেন্ডারটাও তুই রাখ। আমার মেয়েকে ছেড়ে দে। তোর কাছে হাত জোড় করছি।
-পাপা? আমাকে নিয়ে ভেবো না। তোমরা এই লোকটার কাছে কোনোভাবেই হার মানবে না পাপা। কিছুতেই না। আমি চাই আমার পাপা সত্যের পক্ষে লড়াই করে জিতুক। সেটা জীবনে হোক বা ব্যবসায়। আমার জন্য তোমরা কিছুতেই এদের কারো কাছে হার মানবে না পাপা।
জিহান মিনিট খানেক চুপ করে থেকে একটা তাচ্ছিল্যভরা হাসি মাখা মুখে আফসান খন্দকারের দিকে তাকালো। লোকটার চোখেমুখে মৃত্যুর ভয় বা হাতের কাটার ব্যথার ছিটেফোঁটাও নেই। লোকটার চেহারায় ফুটে উঠেছে নিজের সন্তানের জন্য অফুরন্ত ভালেবাসা, স্নেহ আর হারানোর বেদনা। বেশ কিছু বছর আগে এই তীক্ষ্ণ কাতরতা নিজের বাবা মায়ের চোখেও দেখেছিল জিহান। আজ নিজের সবচেয়ে বড় শত্রুকে এভাবে হাল ছেড়ে দিতে দেখে কেন জানি নিজের বাবা মায়ের মুখটাই চোখের সামনে ফুটে উঠছে জিহানের।
-হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই মিস নীলা? ওপস সরি! মিসেস নীলা চৌধূরী। অন্য একজনের জন্য বিয়ের সাজে সেজে আমাকে কবুল বলতে অসুবিধা হচ্ছে নাকি? অবশ্য তোমাদের তো ফ্যামেলিতে ব্যাপারটার চল আছে। সমস্ত আয়োজন, ধুমধাম, ব্যান্ড, গান, বাজনা, হলুদ সব একজনের সাথে করে অন্য কাউকে বউ করে ঘরে তোলার অতীত রেকর্ডও তো আছে তোমাদের। তাহলে আজ কেন এতো লজ্জা লাগছে বলো তো?
-জিহান? মুখ সামলে কথা বল। নিজের বোনের দোষ ঢাকতে আর কতজনের জীবনটা নষ্ট করবি? সেদিন কোন পরিস্থিতিতে নিহার এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছে সেটা তুই জানিস না।
-এনাফ মিস্টার আবরার। আপনার মুখ থেকে কোনো ডাস্টিফিকেশন চাই নি আমি। সেদিন কি ঘটেছিল সেটা আমার জানা আছে। কে বা কারা পিছন থেকে এসে পিঠে ছুরি মেরেছে সেটা আমার আজও মনে আছে। চোখ বন্ধ করলেই আমি তিন তিনটা মানুষের নিথর দেহগুলো ফ্যানের সাথে ঝুলতে দেখি। আহহহহ। অনেক হয়েছে। সাদিক? আমি ঠিক এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুনবো। এর মধ্যে যদি কেউ কবুল না বলে তাহলে কি করতে হবে সেটা আশা করি তোমাকে বলে দিতে হবে না। লেটস স্টার্ট। ওয়ান---।
জিহানের কাউন্টিং শুরু হতেই নীলার অজান্তেই মুখ দিয়ে 'নাআআআ' বলে একটা আর্তচিৎকার বেরিয়ে গেছে। জিহান অবশ্য সেদিকে মাথা ঘামালো না। সে নিজের মতো করে সোজা নীলার চোখে চোখ রেখে গুনছে। 'টু, থ্রি, ফোর'। জিহানের চার পর্যন্ত গোনা শেষ হতেই কাজীসাহেব আবার নীলাকে প্রশ্ন করলেন। জিহানের সাথে বিয়েতে নীলার মত আছে কি না। প্রশ্নটা শুনেই নীলার দুচোখ বেয়ে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। এবারে আর এক মূহুর্তও দেরি না করে নীলা জবাব দিয়ে দিল।
-আলহামদুলিল্লাহ, কবুল, কবুল, কবুল।
নীলার তিন কবুলের শব্দে জিহানের লোকেরা খুশি হয়ে উল্লাস করে উঠলো। কাজীসাহেব এবারে নিজের বিয়ের রেজিস্ট্রিটা এগিয়ে দিতেই নীলা আর এক মূহুর্তও না ভেবে সেখানে সাইন করে দিল। জিহানও এতোক্ষণের মুখের শক্ত ভাবটা মুছে ফেলে একটা হাসি দিয়েই রেজিস্ট্রিতে সাইন করে নীলার একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো বাড়ির বাইরের দিকে। জিহানের শক্ত হাতের টানে নীলাও হুড়মুড় করে এগিয়ে যেতে লাগলো জিহানের সাথে। দরজার সামনে এসে জিহান একটু থেমে পিছন দিকে ফিরে সবার দিকে তাকালো একবার।
-গাইজ টাইম টু গো। সাদিক? কষ্ট করে আমার শ্বশুরমশাইকে হসপিটালে এডমিট করিয়ে দিও প্লিজ? আমি নিজেই নিয়ে যেতাম। বাট সবাই তাহলে বলবে আমি ডক্টরকে ভুল ট্রিটমেন্ট করাতে টাকা দিয়েছি ব্লা ব্লা ব্লা। তাছাড়া মামা মামি নতুন বউকে বরণ করতে ওয়েট করছে কতোক্ষণ ধরে। এন্ড মিস্টার আবরার। আপনি আমার বোনের সাথে যতটা অন্যায় করেছেন তার হাজার গুণ এবারে আমি আপনার বোনকে ফিরিয়ে দিতে পারি। এন্ড মিস্টার আফসান খন্দকার? এবার টের পেয়েছেন নিশ্চয়ই আঘাতটা যখন নিজের সন্তানের গায়ে লাগে তখন চোটটা বাবা মায়ের গায়েই সবার আগে লাগে। হাহ। ওকে গাইজ। লেটস গো?
-জিহান? নীলা?
জিহান বেরিয়ে যেতে যেতে পিছন থেকে আফসান খন্দকার আর আবরারকে আর্তনাদ করতে শুনেও আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করলো না। স্তব্ধ নীলার হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে সোজা গাড়িতে বসলো। আর প্রায় সাথেসাথেই গাড়িটা স্টার্ট দিয়েছে জিহানের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানে নীলার জন্য কোন নতুন বিপদ অপেক্ষা করছে নীলা কল্পনাও করতে পারছে না। এতোদিন যে মানুষটাকে ভালোবেসেছে, তার প্রতি প্রচন্ড ঘৃণায় নীলার মন মস্তিষ্ক এতোটা তপ্ত হয়ে রয়েছে যে সামনে কি ঘটতে চলেছে সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবনাও নেই নীলার।
জিহানদের গাড়িটা বাড়ির মেইন গেইটের সামনে আসতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। বাড়ির চারদিকে ঝিলিক বাতির সাজে বাড়িটাতে বিয়ে বাড়ির একটা আমেজ ফুটে উঠেছে। জিহান গাড়ি থেকে নেমে নীলার দিকে তাকাতেই খেয়াল করলো মেয়েটা মুখ নিচু করে তখনো কেঁদেই চলেছে। জিহান কিছু না বলেই আগের মতোই নীলার হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে চললো বাড়ির মেইন ডোরের সামনে। রাগে, দুঃখে, ব্যথায় নীলার কান্নার বেগ আরো বাড়ছিল। জিহান সেসবে পাত্তা না দিয়ে নীলাকে সোজা এনে দাঁড় করিয়েছে বাড়ির প্রবেশ দ্বারে। জিহানের মামি, মামাতো বোন মুগ্ধা, আরো কয়েকজন প্রতিবেশি বউয়েরা নতুন বউকে বাড়িতে তুলবে বলে দাঁড়িয়ে ছিল। জিহান নিজেও নীলার পাশে দাঁড়িয়েছে। নীলার বিদ্ধস্ত চেহারা দেখে প্রতিবেশীরা একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেও মুগ্ধা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে নীলাকে ভালো করে দেখলো।
-জিহান এটা বউ এনেছ? নাকি রাস্তা থেকে কাউকে তুলে এনেছ? মা? এটা জিহানের চয়েজ? সিরিয়াসলি? এর চেয়ে মে বি আমাদের অফিসের পিয়নের বউকে আরো বেশি সুন্দর দেখতে। জিহান! বউ সুন্দর না হোক, পার্লার থেকে সাজিয়ে তো আনবি! সবার সামনে এই মেয়েকে প্রেজেন্ট করবি কি করে? ইশ! একে বরণ করতে নাকি এতোক্ষণ ধরে এতো কষ্ট করে আলতার ডালা সাজালাম, রুম সাজালাম। ভাবতেই তো কেমন লাগছে! ধ্যাত! আমার পুরো মেহনতটাই বেকার।
মুগ্ধার কথায় জিহান এবারে ভালো করে তাকালো।নীলার দিকে। কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। গত দশ বারো দিনের অর্ধাহার, নির্ঘুম রাত কাটানো, আর কান্না সব কিছুর ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে নীলার চেহারায়। বিয়ের কনে, অথচ একটু সাজ নেই, আলগোছে বাঁধা চুলগুলো জায়গায় জায়গায় বেরিয়ে নীলার কান্নাভেজা মুখে, কপালে লেপ্টে আছে। কি অদ্ভুত ক্রন্দসী রাজকুমারী লাগছে জিহানের নীলাকে! একটা মানুষ এতো কি করে কাঁদতে পারে সেটাই যেন রহস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে জিহানের কাছে।
-শুধু একটা বেনারসিকেই গায়ে পেঁচিয়ে নিলেই বিয়ের ড্রেসআপ হয়ে যায় না এটা তোমার বউকে বলে দিও জিহান। আর এবারে আলতায় পা ডুবিয়ে বউকে ঘরে ঢুকতে বলে উদ্ধার করো আমাকে। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার বউকেই দেখছে। ছি ছি ছি!
মুগ্ধার কথাগুলো সহ্য করার মতো মনের অবস্থাই নীলার নেই এই মূহুর্তে। তাই আর থাকতে না পেরে সামনের দিকেই পা বাড়িয়েছিল। সামনেই আলতা রাখা পিতলের একটা প্লেট। সেটার দিকেই পা বাড়াতেই মু্গ্ধা রীতিমতো ঠেলে নীলাকে সরিয়ে দিল। জিহান পাশ থেকে নীলাকে ধরে না ফেললে নীলা সোজা মাটিতেই পড়তো। জিহান রাগী চোখে মুগ্ধার দিকে তাকাতেই মুগ্ধা নিজেই রাগে গজগজ করে উঠলো।
-এই মেয়ের কি কমনসেন্স বলে কিছু নেই? চেহারা নেই, বুদ্ধি নেই, কোনো গুণ টুন আছে? মনে তো হচ্ছে না। এ কাকে বিয়ে করে এনেছো বলো তো জিহান? জুতো নিয়ে আলতার বাসনে পা দিচ্ছে? বলি তোমার পায়ের ছাপ দিবো? নাকি তোমার জুতোর?
-এসব আলতার কোনো রিচুয়েল তো নেই মু্গ্ধা। তাহলে অযথা এসব করছিস কেন? সরা তো এসব প্লেট ফ্লেট। ভিতরে ঢুকতে দে।
-নো ওয়ে। এই মেয়ে? জুতা খোলো? হাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখো এখনো? বলছি না আলতায় পা ডুবিয়ে হেঁটে বাড়িতে ঢুকতে হবে? এসব মিটিমিটি চালচলন এই বাড়িতে চলবে না বলে দিলাম। এতো ধীর হয় নাকি বাড়ির বউয়েরা? কই জুতা খোলো?
নীলা একটু নিচু হয়ে জুতা খোলার চেষ্টা করতেই জিহান নীলার হাত ধরে নীলাকে সাপোর্ট দিল যাতে নীলা ব্যালেন্স রাখতে পারে। পায়ের জুতো খুলে আলতার প্লেটে পা দিয়ে সামনের দিকে এক পা বাড়াতেই নীলা চোখ বুজে একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা হজম করার চেষ্টা করলো। ধারালো কিছু একটা যেন পায়ের মাংস কেটে ভিতরে ঢুকে গেছে এমন তীব্র যন্ত্রণায় আর এক পাও এগোতো পারলো না মেয়েটা। আর নীলা বাড়ির ভিতরে এক পা রেখেই থমকে গেছে দেখে মুগ্ধা আবার খোঁচা মারলো।
-এই রে! এর দেখি হাঁটতে ছমাস, নড়তে ছমাস। বাড়িতে ঢুকতেই তো পারবে না এই মেয়ে। এ নাকি চৌধূরী বাড়ির বউ!
মুগ্ধা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। সেসব আর বলা হলো না। কারণ এর আগেই জিহান নীলাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে। নীলার চোখে মুখে ফোটা তীব্র ব্যথায় কাতরানো জিহানের চোখ এড়ায় নি। কি ঘটেছে সেটা বুঝতে না পারলেও নীলার কষ্ট হচ্ছে এটা বুঝতে দেরি হলো না জিহানের। তাই আর এক মূহুর্তও অপেক্ষা না করেই নীলাকে নিয়ে রুমের দিকেই পা বাড়িয়েছে জিহান। পিছন থেকে মুগ্ধা কিসব বলছে সেদিকে কান দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না জিহান। মুগ্ধা যে তাতে আরো রাগে ফুঁসছে সেটা তাই জানতেও পারলো না জিহান বা নীলা কেউই।
১৪!!
-কি প্রবলেম কি তোমার নীলা? কিছু বলছ না কেন? আজব! আসার পর থেকে চুপ মেরে বসে আছো। ব্যাপারটা কি? পায়ে আবার ব্যথা পেয়েছ অথচ ওয়েনমেন্ট লাগাতে দিচ্ছ না। শরীর খারাপ লাগছে কিনা সেটাও বলছ না। প্রবলেমটা কি তোমার? তোমার ওই শিহাবকে বিয়ে করতে না পেরে কি রাগ হচ্ছে আমার উপরে? সেরকম হলে সোজাসুজি বলে দাও। এতে কাহিনী করার তো কিছু নেই।
জিহান নীলাকে পাঁজাকোলা করে তুলে এনে রুমে বসিয়ে দিয়ে নীলার ফ্রেশ হওয়ার জন্য টাওয়াল নেয়ার ফাঁকে নীলা পায়ের পাতা থেকে সাবধানে ছোট্ট একটা কাঁচের টুকরো বের করে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথাটা হজম করার চেষ্টা করলো। একে তো জোর করে বিয়ে করে প্রায় তুলে এনেছে লোকটা। তার উপরে বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই এসব! অথচ এতোদিন গভীর ভালোবাসার চাদরে আগলে রাখার ব্যাপারটা কি ছিল! শুধুই নাটক? নীলার কথাগুলো ভাবার ফাঁকে জিহান নীলাকে টাওয়াল আর নরমাল পড়ার জন্য সুতির একটা শাড়ি বের করে দিয়ে এটা ওটা হাজারটা প্রশ্ন করলেও নীলা একটা প্রশ্নেরও উত্তর দেয় নি। মেয়েটা কিছু না বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কাপড় চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই জিহান নীলার একটা হাত টেনে রাগে লাল হয়ে কথাগুলো বলেছে। নীলা চুপচাপ কয়েক সেকেন্ড জিহানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হাতে থাকা কাঁচের টুকরোটা জিহানের হাতে ধরিয়ে দিল।
-টর্চার করতে বিয়ে করে এনেছেন, সেটা করলেই তো হলো। এতো প্রশ্ন উত্তরের তো দরকার নেই রাইট? আর শিহাবের সাথে বিয়েটা করতে পারি নি বলে রিএক্ট করছি? বাহ! দারুণ উন্নতি হয়েছে আপনার চিন্তাভাবনার। জেনে খুশি হলাম। আর নতুন কি কি জানবো আপনার সম্পর্কে সেটা ভেবেই কৌতূহল হচ্ছে জানেন? কি আর করা! অপেক্ষাতেই থাকলাম আপনার নতুন রূপটা দেখার।
-নীল? আমি তো ভাবলাম পায়ে ব্যথা পেয়েছ তুমি। আগের ক্ষতটা সারে নি তাই হাঁটতে পায়ে ব্যথা পাচ্ছ মনে করলাম আমি। এটা তো দেখছি ভাঙা গ্লাসের টুকরো। এটা কোথা থেকে এলো? তোমার পায়ে কি হয়েছে? ও মাই গড! এটা তো রক্ত! আমি তো আলতা ভেবে এতোক্ষণ----। নীলা নীলা নীলা? উফ! এক সেকেন্ড দাঁড়াও এখানে। আমি ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি ওয়েট।
-লাগবে না। জুতো মেরে গরু দানের মতো হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা? আলতায় কাঁচের টুকরো মিশিয়ে রেখে পা কাটার পর ব্যান্ডেজ করার জন্য ছটফট করছেন। এক্টিংয়ের জন্য আপনাদের অস্কার পাওয়া উচিত, রিয়েলি।
-পাগল হয়েছ তুমি? আমি তোমার জন্য আলতায় গ্লাস ভাঙ্গা দিয়ে রাখবো? এটা মিন করতে চাইছ তুমি?
-উঁহু। একদম না। আমি জাস্ট বলছি আমি বাপের বাড়ি থেকে আসার সময় এই কাঁচের টুকরোটা সাথে করে নিয়ে এসেছি। আর সুযোগ পেয়ে আলতার প্লেটে দিয়ে দিয়েছি যাতে আমারই পা কেটে যায় আর আপনি আমাকে সেবা করে সুস্থ করে তুলতে পারেন।
-ত্যাড়া কথা ছাড়া আর কিছু বলতে পারো না? আমি একবারও বলেছি এটা তুমি নিয়ে এসেছ? অদ্ভুত! কেউ ইচ্ছে করে গ্লাস ভাঙ্গাটা আলতায় দিয়েছে নাকি কোইন্সিডেন্ট সেটা আমি বের করেই ছাড়বো। আর এখন বকবক না করে বসো। আমি ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।
-লাগবে না বললাম তো? আমাকে কষ্ট দিয়ে নিজের ইগো স্যাটিসফাইড করতেই তো বিয়েটা করেছেন তাই না? ভালোবেসে তো করেন নি? তাহলে আমার পা থেকে রক্ত ঝড়তে দেখে আপনার তো খুশি হওয়ার কথা। ব্যান্ডেজের কোনো দরকার নেই। এইটুকু রক্ত ঝড়লে মরে যাবো না নিশ্চয়ই।
-নীলা? বাড়াবাড়ি রকমের কথা বলতে শিখে গেছো না তুমি? চুপ করে বসে থাকো এখানে। ব্যান্ডেজ করে দেয়ার পর রুমেই শাড়িটা বদলে নাও। ওয়াশরুমে ঢুকতে হবে না। এন্ড ডোন্ট ওয়ারি। রাগ না ভাঙা পর্যন্ত আপনাকে বিরক্ত করবো না একদমই।
নীলা জিহানের কথার কোনো জবাব দিলো না দেখে জিহানও ভাবলো নীলা চুপচাপ ওর কথা মেনে নিয়েছে। অবশ্য আলমারি থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিতে নীলার সামনে থেকে সরে আসতেই জিহানের সেই ভুলটা ভাঙলো। জিহান ফার্স্টএইড বক্সটা নিয়ে ঘুরে তাকানোর আগেই নীলার ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করার শব্দ জিহানের কানে গেল। জিহান রাগে বেশ কয়েকবার জোর গলাতেই নীলার নাম ধরে ডাকলো। কিন্তু কে শোনে কার কথা? দুজনেই সমান জেদি। কেউ কারো কাছে হার মানতে নারাজ।
লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে রুমে ফিরে জিহানকে না দেখে নিশ্চিন্তে বিছানার একপাশে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়েছে নীলা। বেশ কয়টা দিনের নির্ঘুম রাতের পর শোয়ামাত্রই দুচোখ জুড়িয়ে ঘুম নেমেছে নীলার। জিহান নিচে মুগ্ধাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল নীলার বরণের আলতায় কাঁচের টুকরোটা এলো কি করে। মুগ্ধা কিছু না বলে উল্টো জিহানের সাথেই কিছুক্ষণ চিল্লাপাল্লা করলো এই বলে যে জিহান নীলার কথায় এখন মুগ্ধাকে সন্দেহ করছে। ইত্যাদি ইত্যাদি। জিহান কাঁচের টুকরোটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নীলার আর নিজের জন্য খাবার নিয়ে আবার রুমে ফিরে এলো। মুগ্ধার সাথে তর্ক করে মাথা খারাপ করার মানেই হয় না। অবশ্য রুমে এসে নীলাকে বাচ্চা মেয়ের মতো বিছানার ধার ঘেঁষে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে জিহান নিজের মনেই হেসে ফেললো। খাবারের প্লেটটা ফার্স্ট এইড বক্সটার পাশে বেডসাইড টেবিলের উপরেই রাখলো জিহান। তারপর সাবধানে নীলার পায়ে কাঁচ ফোটার কাটা অংশটা ধীর হাতে পরিষ্কার করে দিয়ে সাদা ব্যান্ডেজে বেঁধে দিল পাতের পাতাটা। নীলা একবার ব্যথা পেয়ে পা টেনে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেই আবার ঘুমের দেশে হারিয়ে গেল। কয়েকবার ডাকার পরেও মেয়েটার কোনো হেলদোল নেই দেখে জিহান নীলাকে আলতো করে নিজের বুকের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে খাবারটুকু খাইয়ে দিল। ঘুমের মধ্যে চোখ বন্ধ রেখেই নীলা খাবারটা খেয়েও নিয়েছে দেখে জিহান বহুকষ্টে নিজের হাসি আটকালো। এতো গভীর ঘুম মেয়েটার যে খাওয়ার মাঝে একবারের জন্যও চোখ মেলে তাকায় নি।
নীলাকে খাইয়ে দেয়া শেষ করে একটু কায়দা করে পানিও খাইয়ে দিল জিহান। তারপর নিজেও অল্প খানিকটা খেয়ে নিয়ে প্লেটটা নিচে রেখে এসে নীলার পাশেই শুয়ে পড়লো। নীলাকে এতোদিন পর বুকে জড়িয়ে ধরতে পেরে আবেশেই জিহানের চোখ জোড়া ভারি হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এতো শান্তির ঘুম বুঝি বহুদিন হয়নি জিহানের।
অন্যদিকে, জিহান আর ওর পুরো গ্যাংটা নীলাকে নিয়ে চলে যেতেই সাদিকও আফসান খন্দকারকে হসপিটালে নিয়ে যেতে চাইলো। আফসান খন্দকার নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সাদিকের গালে চড় কষিয়ে ছেলেটার শার্টের কলার চেপে ধরেছে। আবরার আর নিহার কোনো মতো নিজেদের ঘোর কাটিয়ে আফসান খন্দকারকে সামলানোর চেষ্টা করলো। নিহার ছুটে গিয়ে শ্বশুরের রক্ত বেয়ে পড়া হাতটা ব্যান্ডেজ করে দিলো। আফসান সাহেবের সেদিকে হুঁশই নেই যেন। উনি রীতিমতো তেড়ে যাচ্ছে সাদিকের দিকে। আবরার কষ্ট করে বাবাকে কোনোমতে আটকে রেখেছে।
-তোদের বস ওই জিহান মাস্তানকে বলে দিস আমার মেয়ের সাথে কাজটা মোটেও ভালো করে নি ওরা। মেয়েটাও আমার জন্য এতো পাগল যে ভেবেছে ওই জিহান আমাকে মেরে ফেলবে। এতো ক্ষমতা হয়েছে নাকি ওই দুই টাকার মাস্তানের? আমার মেয়েকে যেভাবে নিয়ে গেছে সেভাবে ফিরিয়ে দিয়ে যেতেও বাধ্য হবে ও। আর ওদের চৌধূরী ইন্ডাস্ট্রি! আমি যদি ওদেরকে বিজনেস থেকেই আউট না করে দিতে পারি তাহলে আমিও আফসান খন্দকার নই। জাস্ট গেট লস্ট। আর হ্যাঁ? আমার মেয়ের গায়ে যদি একটা ফুলের আঁচড়ও কেউ দেয় ওইবাড়িতে তাহলে আমি ভুলে যাবো এসব খুন খারাবি অনেক আগেই পিছনে ফেলে এসেছিলাম।
আফসান খন্দকার সাদিককে চিৎকার করে কথাগুলো বলতেই সাদিক এক নজর শিহাবের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি ফুটিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। হুট করে জিহান দলবল নিয়ে এসে নীলাকে বিয়ে করে চলে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি শকড হয়েছে সম্ভবত এই শিহাব। তার কত শত প্ল্যানে যে জিহান পানি ঢেলে দিয়েছে সেটা বোধ করি জিহান নিজেও জানে না। তাছাড়া নীলা আর জিহান আগেই বিয়ে করেছে জানার পর আর একটা টু শব্দও করে নি শিহাব। ওর মাথায় অন্য পরিকল্পনা চলছে, যত দ্রুত সম্ভব প্ল্যানগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। নইলে ওর এতোগুলো বছর ধরে তীল তীল করে গড়া সাম্রাজ্যটা এক নিমিষেই ধসে পড়বে। অফিসের বাকি স্টাফদের সাথে শিহাবও বেরিয়ে গেছে। আফসান খন্দকার বা আবরার কিছু না বলে শুধু সবার ধীর পায়ে বেরিয়ে যাওয়া দেখলো। রাত গভীর হওয়া পর্যন্ত আফসান সাহেব, আবরার আর নিহার তিনজনেই স্তব্ধ হয়ে ড্রইংরুমেই বসে ছিল। কারো মুখ থেকে একটা শব্দও যেন বের হতে চাইছে না আজ। সবার মনেই যেন একটা ভয়ই জেঁকে বসে আছে। ওদিকে নীলার সাথে কি ঘটছে! আর কখনো নিজেদের মেয়ের মুখটা দেখতে পারবে তো?
ড্রইংরুমের দেয়াল ঘড়িটায় কাঁটাকাঁটায় বারোটা বাজছে দেখে আফসান সাহেব উঠে ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। যাওয়ার সময় আবরার আর নিহারকে খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ার কথা বললে নিহারের এতোক্ষণে মনে পড়লে বিকেল থেকে কারোই কিছু খাওয়া হয়নি। নিহার চটজলদী আফসান সাহেবকে ডিনার করতে ডাকলে তিনি খাবেন না জানিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। নিহার আবরারকে খাওয়ার জন্য ডাকলে সেও খাবে না জানিয়ে রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে। নিহারও আর কিছু না বলে আবরারের পিছুপিছু রুমে এসেছে। শুয়ে পড়ার পর খিদে না থাকলেও দুশ্চিন্তায় ঘুমও আসছে না নিহারের। পাশ ফিরে আবরারের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল আবরারও এখনও জেগে। একটা কথা বলবে কি বলবে না করে করেও শেষে বলেই ফেললো নিহার। আর আবরার নিজের মনেই নিহারের বলা কথাগুলো মিলানোর চেষ্টা করলো।
-জানি না কথাটা বলা ঠিক হচ্ছে কিনা। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কেউ একজন তোমাদের দুই পরিবারের সম্পর্কটা নষ্ট করছে, মাঝখান দিয়ে তোমরা নিজেরা লড়াই করে মরছ। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে সিচুয়েশনটাকে আরো ঘোলাটে বানাচ্ছে। দুদিক থেকেই লাভ নিচ্ছে সে। অথচ তাকে কেউ ধরতেই পারছে না। আর এই ধোঁয়াশাটা তৈরি হয়েছে তোমার আর কায়রার বিয়ের দিনটাকে ঘিরে। কিছু তো একটা ঘটেছে সেদিন আবরার, যেটা আমরাও জানি না, জিহান ভাইয়াও জানে না। কি এমন ঘটেছিল যে দুটো পরিবার বিয়ের মতো পবিত্র একটা সম্পর্ক গড়ার বদলে একে অন্যের জানের দুশমন হয়ে গেছে?