অবেলার অভিলাষ - পর্ব ০৭ - শারমিন আক্তার সাথী - ধারাবাহিক গল্প


      তা‌মিম আয়াতের সাম‌নে এসে বলল,
__ছা‌দে চল?

__‌কেন?

__কথা আছে!

__এখন যাওয়াটা কি জরু‌রি?

__হ্যাঁ। 

তারপর আয়াত আর তা‌মিম মি‌লে ছা‌দে গে‌লো। ছা‌দে গি‌য়ে তা‌মিম আয়াত‌কে সরাস‌রি বলল,
__তুই তনয়া‌কে ভা‌লোবা‌সিস?

আয়াত বুঝ‌তে পার‌ছে তা‌মিম কিছু আন্দাজ কর‌তে পেরেছে বা তনয়ার বিষ‌য়ে সব জে‌নে গে‌ছে। তাই কোন ধর‌নের ভ‌নিতা না ক‌রে ব‌লে দি‌লো
__হ্যাঁ।

__‌কেন?

__ব্যবসায় কেন শব্দটা আসে ভা‌লোবাসা না!

ত‌া‌মিম আয়া‌তের শা‌র্টের কলার ধ‌রে বলল, 
__তুই আমার শত্রুতার শোধ তুল‌তে তনয়া‌কে ট্রাপ কর‌ছিস তাইনা?

আয়াত নি‌জের কলার থে‌কে তা‌মি‌মের হাতটা ছা‌ড়ি‌য়ে বলল,
__তোর মত নোংড়া ট্রিকস আমি খেলতে জা‌নিনা। ‌দেখ তা‌মিম ক‌লেজ জীব‌নে আমা‌দের ভিতর ঝা‌মেলা ছি‌লো কিন্তু সেটা ক‌লে‌জ জীব‌নেই শেষ। তারপর ম‌নে শত্রুতা পু‌ষে রাখা বোকামী হ‌বে। তুই য‌দি ম‌নে শত্রুতা পু‌ষে রা‌খিস ত‌বে সেটা তোর মনকে জ্বালা‌বে। তাই ওসব পু‌রো‌নো কথা ভু‌লে যা।

__কী ভুল‌বো? তোর কার‌নে পু‌রো ক‌লে‌জে আমার বদনাম হ‌য়েছে সেট না‌কি স্যার আমা‌কে ক‌লেজ থে‌কে বের ক‌রে দি‌ছে সেটা? আমার এত ক্ষ‌তি হল সেসব ভু‌লে যা‌বো? অসম্ভব!

__আ‌মি তো‌কে হাজার বার বল‌ছি আমি কিছু ক‌রি‌নি। সে‌দিন যেটা হ‌য়েছে সেটা হয় অন্য কেউ ক‌রে‌ছে নাহয় ওটা একটা এক‌সি‌ডেন্ট ছি‌লো। কতবার তো‌কে বোঝা‌তে চে‌য়ে‌ছি আমি কিছু ক‌রি‌নি তুই আমা‌কে ভুল বুঝ‌তে‌ছিস।
আচ্ছা আমি মানলাম নাহয় ভুল আমার ছি‌লো, সেই কাজটা আমি ক‌রে‌ছি কিন্তু তার প‌রিব‌র্তে তুইও কিন্তু আমায় ছে‌ড়ে দিস‌নি? তোকে যেমন ক‌লেজ থে‌কে বের ক‌রে দেয়া হ‌য়ে‌ছি‌লো তেমনি তুইও আমার স্বপ্ন ভে‌ঙে দি‌য়ে‌ছি‌লি। অমানু‌ষের মত আমায় মে‌রে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় ফে‌লে গে‌ছি‌লি। সে‌দিন য‌দি সময় মত স্থানীয় লোকজন আমায় হসপিটা‌লে না নি‌তো ত‌বে আমি হয়‌তো বেঁ‌চেই থাকতাম না।

‌তোর সেই আঘাত থে‌কে পু‌রোপু‌রি সুস্থ হ‌তে আমার সাত মাস লেগে গে‌ছি‌লো। তিনমাস আমি বিছানা থে‌কে উঠ‌তে পা‌রি‌নি। তখন সেনাবাহিনী‌তে লোক নেয়ার ইন্টার‌ভিউ চল‌ছি‌লো কিন্তু অসুস্থ থাকায় ইন্টার‌ভিউ দি‌তে পা‌রি‌নি। তার প‌রের বছর ইন্টারভিউ দি‌য়ে সব কিছু‌তে ভা‌লো মার্কস পে‌য়েও কেন চান্স পাই‌নি জা‌নিস? যখন ফি‌জিক্যাল টেস্ট নেয়া হ‌য়েছে তখন দেখা গে‌লো তোর মা‌রের কার‌নে আমার হা‌তে দু জায়গায় ভে‌ঙে গে‌ছি‌লো। তাই আমার হাত অতি‌রিক্ত প্রেশার নি‌তে পা‌রেনা। বাদ প‌রে গেলাম সেনাবা‌হিনীর ইন্টার‌ভিউ থে‌কে। নি‌জের ছোট বেলা থে‌কে দেখা স্বপ্ন নি‌মি‌ষেই শেষ হ‌য়ে গে‌লো। তখন কিন্তু চাই‌লে তোর না‌মে কেস দি‌তে পারত‌াম। কিন্তু এটা ভে‌বে‌ছি কোথাওনা কোথাও স্যার তো‌কে আমার কার‌নে ভা‌র্সি‌টি থে‌কে বের ক‌রে দি‌য়ে‌ছে। তাই পু‌লিশকে জানাই‌নি। এখনও তুই বল‌বি ‌যে, ক্ষ‌তি তোর বে‌শি হয়ে‌ছে।

__ওহ তাহ‌লে এস‌বের শোধ তুলতে তুই আমার বোন‌কে বেছে নি‌লি?

__উল্টা বোঝা কি তোর জন্মগত সমস্যা না‌কি স্বভাব?

__আ‌মি গতকাল‌কেই জে‌নেছি তুই তনয়ার ভাই। এর আগে তো আমি তোর কথা জানতামই না। তনয়াও কখ‌নো ব‌লে‌নি। আমি শুধু তনয়া‌কে ভা‌লোবা‌সি। তাই তনয়ার ভাই কে? সে আমার বন্ধু না শত্রু সেটা দেখার প্র‌য়োজন আমার নেই! আমি শুধু মাত্র তনয়ার সাথে সারা জীবন কাটা‌তে চাই। সে জন্য য‌দি তোর সা‌থে শত্রুতা ভু‌লে বন্ধুত্ব কর‌তে হয় ত‌বে আমি সেটা করতেও রা‌জি।

__কিন্তু আ‌মি তোর সা‌থে বন্ধুত্ব কর‌তে রা‌জি না। আর এত কথা শুন‌তে চাইনা। তো‌কে আমি আমার বো‌নের জীব‌নে আস‌তে দি‌বো না। যত তারাতা‌রি পার‌বি তনয়া‌কে তোর অফিস থে‌কে বরখাস্ত কর‌বি। তো‌কে যে‌নো তনয়ার চারপা‌শে না দে‌খি। আ‌মি তনয়াকে ভা‌লো ছে‌লে ‌দে‌খে বি‌য়ে দি‌বো।

__হ্যাঁ তো‌দের ভা‌লো ছে‌লের নমুনা তো ঐ রিসাদ। যে তোর বোন‌কে বি‌য়ের আগে বিছানায় নি‌তে চে‌য়েছি‌লো। তাই তো? তুই যেমন তো‌র পছন্দও তেমন। ইউজ‌লেস!

__মুখ সাম‌লে কথা বল আয়াত। (আয়া‌তের কলার ধ‌রে) এবার আয়াতও তা‌মি‌মের কলার ধ‌রে বলল,

__স‌ত্যি বল‌লে, সবারই জ্ব‌লে। খবরদার তা‌মিম তনয়া‌কে আমার থে‌কে দূ‌রে রাখা জন্য য‌দি তুই কোন নোংড়া চাল চে‌লে‌ছিস ত‌বে আমার থে‌কে খারাপ আর কেউ হ‌বেনা!

__‌সেটা দেখা যাবে! কালই আমি তনয়া‌কে বলব তোর অফিস থে‌কে রিজাইন নি‌তে। 

__হুহ তুই এ ছাড়া আর কী পার‌বি? পিছন থে‌কে অাঘাত করা যে, তোর পু‌রো‌নো রোগ (তা‌চ্ছিল্য হা‌সি দি‌য়ে)। আর শোন তনয়া‌ আগামী একবছর আমার কম্পা‌নি‌তে কাজ করার কনট্রাক নি‌য়ে‌ছে। কনন্ট্রাক ভাঙ‌লে ওকে আইনি ঝা‌মেলা পেহা‌তে হ‌বে। এখন তুই নিশ্চিয়ই চাই‌বি না তোর বোন জে‌লে যাক। আর শোন য‌দি দম থা‌কে তো যা করার সাম‌নে ব‌সে কর, ভিতু‌দের মত পিছ‌ন থে‌কে ছু‌ড়ি কেন বসা‌চ্ছিস? নি‌জের যদি উপর এত ভরসা থা‌কে ত‌বে তনয়া আমার অফি‌সে কাজ করাকালীনই তনয়া‌কে আমার থে‌কে দূ‌রে স‌রি‌য়ে দেখা।

__হ্যাঁ তাই দেখা‌বো ত‌বে তুই আগে কথা দে, তনয়া‌কে তোর ভা‌লোবাসার কথা ততক্ষন জানাতে পার‌বি না যতক্ষন না আমি তো‌কে জানা‌তে বল‌বো।

__হালুয়া না‌কি? তুই বল‌বি আর আমি শুন‌বো কেন? আমি কি সি‌নেমার নায়ক না‌কি যে, জে‌দের ব‌সে নি‌জের প্রেম‌কে নি‌য়ে বা‌জি লাগা‌বো। আমি তো পার‌লে তনয়া‌কে এখন চিৎকার ক‌রে ব‌লে দি, তনয়া আই লাভ ইউ। পার‌লে এখনই তনয়া‌কে বি‌য়ে ক‌রে সারা জীব‌নের জন্য নি‌জের ক‌রে নি। তোর ট্রা‌পে আমি পা দি‌চ্ছি না। যা করার কর গি‌য়ে। দে‌খি তুই তনয়া‌কে উস‌কে কোন রাজমহল বানা‌তে পা‌রিস। সবসময় বল‌দের মত চেঁচা‌লেই হয়না। ঠান্ডা মাথায় ভাব‌তে হয় আমি যা কর‌ছি তা ঠিক কিনা? গদ্রভ কোথাকার! 

আর আর কিছু না ব‌লে হনহন ক‌রে নি‌চে চ‌লে গে‌লো। আর তা‌মিম হা হ‌য়ে দা‌ড়ি‌য়ে রই‌লো। ও ভাব‌ছি‌লো আয়াত রাগ ক‌রে ওর চ্যা‌লেন্জ গ্রহন কর‌বে কিন্তু আয়াত তো পু‌রো পা‌ল্টি খে‌লো। তা‌মিম ভাব‌ছে কি কবে আয়াতের থে‌কে তনয়া‌কে দূ‌রে সরা‌নো যায়। তারপর ও নি‌চে চ‌লে যায়। 

ওরা নি‌চে চ‌লে যে‌তেই ছা‌দের বিশাল বড় পা‌নির টাং‌কির পাশ থেকে বে‌রি‌য়ে আসল, মেঘা আর তানভী। দুজন দুজনার দি‌কে হতভম্ব হ‌য়ে তা‌কি‌য়ে আছে।
(আয়াত আর তা‌মিম ছা‌দে আসার আগে ওরা দুজন কথা বল‌তে বল‌তে ছা‌দে চ‌লে আস‌ছি‌লো। ওরা ছা‌দের অপর পাশে বড় পা‌নির ট্রা‌কিংর পা‌শে ছি‌লো বিধায় আয়াত আর তা‌মিম ওদের দে‌খে‌নি। কিন্তু মেঘা আর তানভী, আয়াত আর তা‌মি‌মের সব কথা শুন‌ছে।)

 মেঘা বল‌ছে,
__আয়াত ভাইয়া আর তামিম ভাইয়ার মা‌ঝে এত তিক্ততা! আল্লাহ্!

__আ‌মিও সেটাই ভাব‌ছি। কি বল‌বো বুঝ‌তে পার‌ছি না। একবার ম‌নে হ‌চ্ছে আয়াত ভাইয়া তা‌মিম ভাইয়ার উপর শোধ তুল‌তে তনয়া‌কে ট্রাপ কর‌ছে। আবার ম‌নে হ‌চ্ছে স‌ত্যি তনয়া‌কে পাগ‌লের মত ভা‌লোবা‌সে। ঠিক বুঝ‌তে পার‌ছিনা।

__‌মেঘা বলল, স‌ত্যি এটাই যে ভাইয়া তনয়া আপুকে পাগ‌লের মত ভা‌লোবা‌সে। আর ভাইয়া আপনার তা‌মিম ভাইয়া‌কে একবার ছে‌ড়ে দি‌য়ে‌ছি‌লো ব‌লে যে বার বার ছে‌ড়ে দিবে সেটা ভাব‌বেন না।

—————

       তানভী বলল,
__এহ আপনা‌কে কে বল‌ছে আয়াত ভাইয়া তনয়া‌কে পাগ‌লের মত ভা‌লোবা‌সে? 

__‌কেউ ব‌লে‌নি। ত‌বে আয়াত ভাইয়া‌কে দেখ‌লে বুঝ‌তে পা‌রি। তনয়ার প্র‌তি তার ভা‌লোবাসার তীব্রতা এত যা‌ আপনার আমার চিন্ত‌ার বাই‌রে। কখ‌নো টেষ্ট নি‌য়ে দেখ‌বেন। ভাইয়া ১০০/১০০ পা‌বে।

__হুমম দে‌খি। (আপ‌নি তো জা‌নেন না আপনার ভাইকে অল‌রে‌ডি পরীক্ষা করা শুরু ক‌রে দি‌য়ে‌ছি। বেচারা আয়াত ভাইয়া পছন্দ করল তাও তনয়া‌কে যার কিনা তিন তিনটা ভাই আছে। তিনজ‌নের চা‌পে না আবার পৃষ্ঠ হ‌য়ে যায়। অবশ্য আমার নি‌জেরও আয়াত ভাইয়া‌কে অনেক ‌বে‌শি ভা‌লো লা‌গে। তনয়ার জন্য পার‌ফেক্ট সে। বা‌কিটা তনয়ার ইচ্ছা)(ম‌নে ম‌নে)

__‌মেঘা তানভী‌কে ধাক্কা দি‌য়ে বলল, কী হল আপনার?  কোথায় হা‌রি‌য়ে গে‌লেন?

__নাহ্ কিছুনা, চলুন নি‌চে চলুন।

১৭!!

       আয়াত নি‌চে গি‌য়ে তনয়া‌কে খুঁজ‌ছে। আস‌ছে পর থে‌কে একবারও তনয়ার সা‌থে কথা হয়নি। কিন্তু তনয়া‌কে দেখ‌ছে না কেন? না‌কি সকা‌লের বিষয়টার জন্য তনয়া এখনও রে‌গে আছে! আয়াত স‌ত্যিই বুঝ‌তে পা‌রে‌নি এভা‌বে তনয়ার ঠোঁ‌টে ওর ঠোঁট মি‌লে যা‌বে। সেটা তো একটা দূর্ঘটনা ছি‌লো। আয়াত চারপা‌শে চোখ বু‌লি‌য়ে হাঁট‌ছে। হঠাৎ হ্যাচকা টা‌নে কে যে‌নো আয়াত‌কে এক কর্ণা‌রে নি‌য়ে গে‌লো। আয়াত তা‌কি‌য়ে দে‌খে তনয়া ওর দি‌কে তা‌কি‌য়ে মিট মিট হাসছে। আয়াত তনয়ার হা‌সিটার দি‌কে তা‌কি‌য়ে ম‌নে ম‌নে বলল, ইস হা‌সিটা‌কে খে‌য়ে ফেলতে ইচ্ছা কর‌ছে। তনয়া আয়া‌তের বু‌কের উপর কনুই ঠে‌কি‌য়ে আয়াত‌কে দেয়া‌লের সা‌থে ঠে‌সে ধ‌রে বলল,

__আজব মানুষ তো আপ‌নি!

__‌কেন কি ক‌রে‌ছি আমি?

__কখন আস‌ছেন অথচ একবারও আমার সা‌থে কথা পর্যন্ত বলে‌ন নি। এমন‌কি একবার জন্ম‌দিনের উইশ পর্যন্ত ক‌রে‌নি। সকা‌লে আস‌লেন তখনও ক‌রে‌নি। কাল রা‌তে কি একটা ছাইপাশ মে‌সেস দি‌ছেন। ব‌লি মু‌খে উইশ কর‌লে কি আপনার শব্দ ভান্ডার থে‌কে শব্দ ক‌মে যে‌তো। 

আয়াত মুখ টি‌পে হাস‌ছে। তনয়া বলল,
__এভা‌বে হাস‌ছেন কেন?

__তু‌মি যেভা‌বে আমা‌কে ঠে‌সে ধ‌রে দা‌ড়ি‌য়ে আছো এভা‌বে কে দাড়ায় জা‌নো?

__‌কে?

__হয় ওয়াই তার হ্যাজ‌বেন্ড এর সা‌থে নাহয় গার্ল‌ফ্রেন্ড তার বয়ফ্রেন্ড এর সা‌থে। 

আয়া‌তের কথা শুনে তনয়া আয়া‌তের থে‌কে দূ‌রে দাড়া‌লো। আয়াত তনয়ার হাত ধ‌রে টান দি‌য়ে নি‌জের অনেকটা কা‌ছে টে‌নে নি‌জের সা‌থে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল,
__এখন কেন দূ‌রে যাচ্ছ? 

__স্যার ছাড়ুন কেউ এসে দেখ‌লে কী ভাব‌বে?

__কী ভা‌ববে তনয়া?

__ভাব‌বে আপনার আর আমার ম‌ধ্যে কিছু আছে!

__‌‌কেন কিছু নেই বু‌ঝি?

আয়া‌তের এমন প্র‌শ্নে তনয়ার মনটা এলো‌মে‌লো হ‌য়ে গে‌লো। মাথার ম‌ধ্যে পিছ‌নের সব‌ কিছু কিল‌বিল ক‌রে পোকার মত ঘুর‌তে লাগ‌লো। আর ভাব‌তে লাগ‌লো সত্যি তে‌া আয়াত স্যা‌রের সা‌থে কি সম্পর্ক আমার? কেন আমি তার উপর এত অধিকার দেখা‌চ্ছি? আমা‌দের মা‌ঝে তো কোন সম্পর্ক নেই! তবুও কেন ম‌নে হয় আয়াত স্যারের উপর পু‌রোটাই আমার অধিকার। নাহ আমি এসব কী ভাব‌ছি? আমি জাস্ট তার অফি‌সের বেতন ভুক্ত কর্মচারী এর বে‌শি তার সা‌থে আমার কোন সম্পর্ক হ‌তে পা‌রেনা। সে আমার অফি‌সের বস আর আমি তার এ্যামপ্ল‌য়ী। বাস! এ ছাড়া আমা‌দের মা‌ঝে কোন সম্পর্ক নেই। কোন সম্পর্ক হ‌তেও পা‌রেনা। আমি কোন মায়ার সম্প‌র্কে জড়াবো না। তাহ‌লে আমার স্বপ্ন গু‌লো ভে‌ঙে যা‌বে। আয়াত তনয়ার চো‌খের সাম‌নে তু‌ড়ি দি‌য়ে বলল,

__হ্যা‌লো মিস তনয়া! কোথায় হা‌রি‌য়ে গে‌লেন?

__হ্যাঁ---- হ্যাঁ--- বলুন স্যার!

__বল‌ছি স‌ত্যি কী আমা‌দের মা‌ঝে কিছু নেই বু‌ঝি?

তনয়া কি বল‌বে ভে‌বে পা‌চ্ছেনা। তাই নি‌জের কোমর থে‌কে আয়া‌তের হাতটা স‌রি‌য়ে আয়া‌তের থে‌কে নি‌জে‌কে ছা‌ড়ি‌য়ে যেই যে‌তে নি‌বে ওম‌নি আয়াত তনয়ার হাত ধ‌রে আবার টান দি‌য়ে কা‌ছে নি‌য়ে বলল,

__শুভ জন্ম‌দিন তনয়া। জা‌নো আজ তোমা‌কে অসাধারন ছন্দময়ী লাগ‌ছে। তোমাকে দে‌খে আজ "সৈয়দ শামসুল হক" এর *তু‌মি শুধু তু‌মি* ক‌বিতাটা ম‌নে পড়‌ছে। শুন‌বে?

‌নি‌জের অজা‌ন্তেই তনয়ার মুখ থে‌কে হ্যাঁ শব্দটা বে‌ড়ি‌য়ে গে‌লো। 

আয়াত ক‌বিতাটা বল‌তে শুরু কর‌লো------

     তোমার দেহে লতিয়ে ওঠা ঘন সবুজ শাড়ি।
            কপালে ওই টকটকে লাল টিপ।
            আমি কি আর তোমাকে ছেড়ে
                 কোথাও যেতে পারি?
তুমি আমার পতাকা, আমার কৃষির বদ্বীপ।

        করতলের স্বপ্ন-আমন ধানের গন্ধ তুমি
             তুমি আমার চিত্রকলার তুলি।
       পদ্য লেখার ছন্দ তুমি−সকল শব্দভুমি।
                সন্তানের মুখে প্রথম বুলি।

       বুকে তোমার দুধের নদী সংখ্যা তেরো শত।
             পাহাড় থেকে সমতলে যে নামি−
         নতুন চরের মতো তোমার চিবুক জাগ্রত−
            তুমি আমার, প্রেমে তোমার আমি।

       এমন তুমি রেখেছ ঘিরে−এমন করে সব−
          যেদিকে যাই−তুমিই শুধু−তুমি!
     অন্ধকারেও নিঃশ্বাসে পাই তোমার অনুভব,
          ভোরের প্রথম আলোতেও তো তুমি!

ক‌বিতাটা শু‌নে তনয়ার নিঃশ্বাস ভারী হ‌য়ে গে‌লো। না চাই‌তেও চো‌খে কেন জা‌নি হাজা‌রো জল কনা এসে ভীর কর‌তে লাগ‌লো। ‌ভিতর থে‌কে কান্না পা‌চ্ছে খুব। আয়াত তনয়ার চো‌খের নি‌চে আঙুল দি‌য়ে বলল,

__কাঁদ‌লে কাজল নষ্ট হ‌য়ে যা‌বে যে, প্লিজ কেঁ‌দো না। তোমায় কাজল দি‌লে ভা‌লো লা‌গে ত‌বে কাজল না দি‌লে আরো বে‌শি ছন্দময়ী লা‌গে। ‌কিছু মানুষ‌কে কাজল ছাড়া অনেক বে‌শি মোহময়ী লাগ‌ে। যেমন তু‌মি। তনয়ার ম‌নে হ‌চ্ছে নি‌জের উপর কোন নিয়ন্ত্রন পা‌চ্ছেনা। ভু‌লে যা‌চ্ছে নি‌জের প্রত্য‌য়ের কথা। কোন এক অদৃশ্য শ‌ক্তি তনয়া‌কে আয়া‌তের বু‌কে টানছে। ম‌নে হয় আয়াত ওর তীক্ষ নজড় দি‌য়ে তনয়া‌কে স‌ম্মোহন ক‌রে ফেল‌ছে। তনয়ার চিন্তা ভাবনা শ‌ক্তি ম‌নে হয় লোপ পে‌য়ে‌ছে। নি‌জের চিন্তা শ‌ক্তি বোধয় নষ্ট হ‌য়ে গে‌ছে। কিছু ভাব‌তে পার‌ছেনা।

তখন আয়াত তনয়ার চো‌খের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল,
__"রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর" এর *আমার মিলন লাগি তুমি* ক‌বিতাটি শুন‌বে?

তনয়া এবারও ঘো‌রের মা‌ঝে ব‌লে দি‌লো হুমম

__আয়াত তনয়ার ডান হাতটা নি‌জের হা‌তের মু‌ঠোয় নি‌য়ে ক‌বিতা বলা শুরু কর‌লো,

আমার মিলন লাগি তুমি
আসছ কবে থেকে।
তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়
রাখবে কোথায় ঢেকে।
          কত কালের সকাল-সাঁঝে
          তোমার চরণধ্বনি বাজে,
          গোপনে দূত গৃহ-মাঝে
               গেছে আমায় ডেকে।

ওগো পথিক, আজকে আমার
সকল পরাণ ব্যেপে
থেকে থেকে হরষ যেন
উঠছে কেঁপে কেঁপে
          যেন সময় এসেছে আজ,
          ফুরালো মোর যা ছিল কাজ -
          বাতাস আসে, হে মহারাজ,
               তোমার গন্ধ মেখে। 

তনয়া যে‌নো ঘো‌রে গভীরভা‌বে ডু‌বে গে‌লো। ওর ঘোর গভীর থে‌কে গভীরতম হ‌য়ে যা‌চ্ছে। আয়া‌তের চো‌খের ভ্র‌মের অতল গভী‌রে ত‌লি‌য়ে যা‌চ্ছে তনয়া। আয়াত নি‌জে যে কম ঘো‌রে আছে তা কিন্তু নয়। আয়া‌তের ম‌নে হচ্ছে বাতা‌সে আজ জাদুময় কিছু হ‌চ্ছে। যা ওকে তনয়ার দি‌কে টান‌ছে। হাজার চে‌য়েও নি‌জে‌কে আটকা‌তে পার‌ছেনা। আয়াত তনয়ার কা‌নের কা‌ছে মুখ নি‌য়ে আস্তে ক‌রে বল‌তে শুরু কর‌লো,

            আজ পূবলী হাওয়া বড্ড মাতাল,
                কর‌ছো কি কোন জাদু টোনা?
                টান‌ছে আমায় তোমার প্র‌তি,
               হা‌রি‌য়ে যা‌চ্ছি কোন ভ্রম ত‌লে।
          ও গো মায়াবী কি মায়া ধরা‌লে তু‌মি!
               দু‌নিয়া আমার পা‌ল্টে গে‌লো
             ‌গোছা‌নো মন অগোছা‌লো হল
                     এর দায় কে নি‌বে?
             তু‌মি? না‌কি পূবালী হাওয়া?

                                                 লেখাঃ সাথী 

তনয়ার নি‌জের উপর থে‌কে সমস্ত নিয়ন্ত্রন হা‌রি‌য়ে নিয়ন্ত্রনাধীন হ‌য়ে গে‌লো। নি‌জের মাথাটা নি‌জের অজা‌ন্তেই আয়া‌তের বু‌কে রাখ‌লো। আয়াত নি‌জেও হ‌য়ে গে‌লো বেসামাল, শক্ত ক‌রে তনয়া‌কে নি‌জের বাহু‌ডোরে আবদ্ধ ক‌রে ফেল‌লো। দুজ‌নেই মাতাল হ‌য়ে দুজনার প্রেম প্রণ‌য়ে হা‌রি‌য়ে আছে। দুজনই বুঝ‌তে পার‌ছে যা হ‌চ্ছে তা ঠিকনা। কিন্তু আবার এটাও ভাব‌ছে ভুল কিছুও হচ্ছেনা। তনয়ার ভারী নিঃশ্বাস আয়া‌তের বু‌কে লাগ‌তেই আয়াত তনয়া‌কে আরো শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রলো। ভা‌লোবাসার গভীর আবে‌শে একে অপর‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে দুজন দুজনার অনুভূ‌তির মুগ্ধতা‌কে অনুভব কর‌ছে। না কেউ কাউ‌কে ব‌লে‌নি ভা‌লোবা‌সি তাই ব‌লে কি ভা‌লোবাসা হয়না। 

ভা‌লোবাসায় ভা‌লোবা‌সি কথাটা বল‌তে হ‌বে এমন কোন শাস্ত্র আছে না‌কি! আবার এমন কোন শাস্ত্র নেই যেখা‌নে লেখা আছে বহু দি‌নের চেনা জানা না থাক‌লে ভা‌লোবাসা হ‌বেনা, সম্পর্ক হ‌বেনা। ভা‌লোবাসা অনেকসময় মুহূর্তে হ‌য়ে যায় আবার অনেক সময় সারা জীব‌নেও হয়না। ভা‌লোবাসা সময় দি‌য়ে হয়না ভা‌লোবাসা তার সা‌থে হয় যার সা‌থে মোহময়ী সময় কাটা‌নো হয়।

‌চোখ বন্ধ ক‌রে আয়া‌তের বু‌কের ধুক ধুক শব্দটা শুন‌ছি‌লো তনয়া। আয়াত অনুভব কর‌ছি‌লো তনয়ার অস্তিত্ব‌কে। দুজন দুজনাতে ঘো‌রে ডু‌বে আছে।
 হঠাৎ তনয়ার শাড়ির আঁচল ধ‌রে কেউ টান দি‌লো। তনয়ার ঘোর কাট‌লো। নি‌চে তা‌কি‌য়ে দে‌খে তানভি‌রের মে‌য়ে তৃ‌প্তি। তনয়া ত‌রিঘ‌রি ক‌রে আয়াত‌কে ছে‌ড়ে দি‌য়ে তৃ‌প্তি‌কে নি‌য়ে ভিত‌রে চ‌লে গে‌লো। আয়াত দেয়া‌লের সা‌থে হেলান দি‌য়ে কতক্ষন ভাবার চেষ্টা কর‌ছি‌লো এতক্ষন ঠিক কী হ‌চ্ছি‌লো? তনয়া কি স‌ত্যি আয়া‌তের বু‌কে ছি‌লো? কিছু বুঝ‌তে পার‌ছেনা আয়াত। কতক্ষন ঝিম মে‌রে ওভা‌বেই দা‌ড়িয়ে থে‌কে ভিত‌রে চ‌লে গে‌লো।

সব অনুষ্ঠ‌ান কেক কাটা, খাওয়া দাওয়া শেষ হ‌তে হ‌তে রাত বা‌রোটা বে‌জে গে‌লো। ততক্ষন তনয়া আয়া‌তের সা‌থে একটা কথাও ব‌লে‌নি। এমন‌কি আয়াতের দি‌কে তাকায়‌নি পর্যন্ত। আয়াত তনয়ার চো‌খের দি‌কে তা‌কি‌য়ে ওর চো‌খের ভাষা বুঝ‌তে চাইল। কিন্তু তনয়া সে তো আয়া‌তের চো‌খের দি‌কে তাকা‌য়ই‌নি।
সব শে‌ষে আয়াত মেঘা‌কে নি‌য়ে বা‌ড়ি চ‌লে গে‌লো। তানভির-লা‌বিব-তৃ‌প্তি, তা‌মিম, তানভী সবাইও বা‌ড়ি চ‌লে গে‌লো। তনয়া রু‌মে এসে ঘো‌রের ম‌ধ্যে বাই‌রের দি‌কে তা‌কি‌য়ে ভাব‌ছে আজ হঠাৎ ওর কি হল? নি‌জের প্র‌তি নি‌জের নিয়ন্ত্রন কি ক‌রে হা‌রি‌য়ে গে‌লো? তনয়া‌ তো এমন ছি‌লো না। ওর তো নি‌জের প্র‌তি প্রচন্ড নিয়ন্ত্রন। প্রচন্ড জোড় তনয়ার আত্ম‌বিশ্বাসে। না‌কি আয়া‌তের ভা‌লোবাসার জো‌ড়ের কা‌ছে তনয়ার অভিলা‌ষের জোড় হে‌রে যা‌চ্ছে। ত‌বে কি তনয়ার নি‌জের দেখা অবেলার অভিলাষ, আয়া‌তের তীব্র ভা‌লোবাসার অভিলা‌ষের কা‌ছে হে‌রে যা‌বে?

১৮!!

     স‌তে‌রো দিন পর।
জন্ম‌দি‌নের দু‌দিন পর থে‌কেই তনয়া অফি‌সে আসা শুরু ক‌রে। কিন্তু তনয়ার ব্যবহার কেমন যে‌নো বদ‌লে গে‌লো। আগে যেমন আয়া‌তের সা‌থে মন খু‌লে দুষ্ট‌মি কর‌তো তেমন দুষ্ট‌মি ক‌রেনা। প্র‌য়োজন ছাড়া আয়া‌তের সা‌থে কথাও ব‌লেনা। আয়া‌তের ম‌নে তীব্র অপরাধ বোধ তৈরী হ‌তে লাগ‌লো। ভাব‌ছে সে‌দি‌নের ওমন ব্যবহা‌রে হয়‌তো তনয়া আয়া‌তকে ইগ‌নোর কর‌ছে। কিন্তু কথা হ‌চ্ছে তনয়া সে‌দিন নি‌জে থে‌কে আয়া‌তের বু‌কে নি‌জে‌কে সমার্পন ক‌রে‌ছি‌লো। তাহ‌লে আজ কেন তনয়া আয়াতকে ইগনোর কর‌ছে। এসব হা‌বিজা‌বি ভাবনায় সবসময় বি‌ভোর থা‌কে আয়াত।

আর তনয়া ভাব‌ছে ও হয়ত আয়া‌তের উপর অন‌ধিকারচর্চা ক‌রে ফেল‌ছে। আয়া‌তের উপর প্র‌য়োজ‌নের অধিক অধিকার খা‌টি‌য়ে ফেল‌ছে। আর তাছাড়া তনয়ার তো আয়া‌তের উপর কোন অধিকারই নেই। তনয়া শুধু মাত্র আয়া‌তের অফি‌সের বেতনভুক্ত কর্মচা‌রী মাত্র। 

আর তাছাড়া তনয়ার নি‌জের কিছু ইচ্ছা আছে। তনয়া সম্প‌র্কের ডো‌রে বাঁধা পড়‌তে চায়না। তনয়া উড়‌তে চায়। নি‌জে‌কে অভিলাষী বানা‌তে চায়। কিন্তু নি‌জের স্ব‌প্নে, অভিলা‌ষে তনয়া‌ এতটা বি‌ভোর হ‌য়ে আ‌ছে যে, তনয়া ভু‌লেই গে‌ছে কিছু কিছু অভিলাষ অবেলারও হয়। কিছু অভিলাষ পূর‌নে কা‌রো ভা‌লোবাসাময় হাত দরকার। যে হাত তনয়ার হাতটা শক্ত ক‌রে ধ‌রে ওকে নি‌য়ে যা‌বে স্বপ্ন চূড়ায়। তনয়ার অভিলাষী হওয়ার অভিলাষ‌কে আমি নেহাৎ অবেলার অভিলাষ ছাড়া কোন নাম দি‌তে পা‌রছি না।

‌বেশ কিছু‌দিন ধ‌রে আয়াত টেনশ‌নে আছে কারন তনয়ার জন্মদি‌নে তা‌মি‌মের বলা কথানুসা‌রে তা‌মিম এত সহ‌জে আয়াত‌কে ছে‌ড়ে দেবার পাত্র না। তাহলে আজ এত‌দিন পরও তা‌মিম কোন পদ‌ক্ষেপ কর‌ছে না যার কার‌নে আয়াত বেশ ভা‌লোক‌রে বুঝ‌তে পার‌ছে তা‌মিম ভয়ানক কিছু কর‌তে চাই‌ছে। তনয়া‌কে হারা‌নোর ভয়টা দিন দিন আয়া‌তের মনটা‌কে ভীত আর দুর্বল ক‌রে ফেল‌ছে।

আজ থে‌কে আয়া‌তের বাবা অফি‌সে বস হিসা‌বে আবার বস‌বে। আয়াত ভাব‌ছে এত‌দিন কার‌নে অকার‌নে তনয়া‌কে কা‌জের বাহানায় নি‌জের কা‌ছে ডাক‌তে পার‌ছে যেটা আজ থে‌কে হ‌বেনা। 

এদিক র‌শ্মি বল‌ছে, আয়া‌তের বাবা মোটামু‌টি গম্ভীর মানুষ। আর তনয়া‌কে তো তার সা‌থেই বে‌শির ভাগ সময় কাজ কর‌তে হ‌বে। ঠিক কি কর‌বে সেটা ভে‌বে ভয় পা‌চ্ছে না। 

আয়া‌তের বাবা নি‌জের কে‌বি‌নে গি‌য়ে আয়াত‌কে ডাক‌লো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন