!!৬৪!!
রেজওয়ানের গলা দিয়ে খাবার নামলোনা। হরেকরকম খাবারে সুসজ্জিত টেবিল। গোশতের বহু আইটেম। তাছাড়া দেশি, বিদেশি বিভিন্ন লোভনীয় খাবার। মাহা সার্থকের পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে। আসলে মাহা বুঝতে পারছেনা তার কি বলা উচিত। খাবার টেবিলে নিভা, রবার্ট, মুইংচিন, লুবান বসে। তারা তাদের মতো কথা বলে যাচ্ছে। হাসি - তামাশা করছে। রবার্ট বাংলা জানেনা। তাছাড়া সে কথা কম বলে। খুবই অল্প। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে তার বাড়ি। সাদা ফর্সা গাঁয়ের রঙ। গোল্ডেন রঙের চুল, ব্লু চোখ। বাংলায় কথা বলতে পারেনা রবার্ট। ইংরেজিতে মত বিনিময়ে অভ্যস্ত সে। কিন্তু মাহার সাথে কথা হলেই ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলে রবার্ট। রেজওয়ানের চোখ পড়লো মাহার দিকে। মাথায় শাড়ির আঁচল। লাল টকটকে শাড়িতে কি যে অপরূপ লাগছে হলদে ফর্সা মেয়েটাকে! আচ্ছা, মাহা তো এখন অন্যকারো বউ! রেজওয়ানের কি পাপ হবে ওর দিকে তাকালে?
"মিঃ রেজওয়ান? খাচ্ছেন না যে? খাবার মজা হয়নি?"
সার্থকের প্রশ্নে রেজওয়ান বলে,
"না, না। আসলে আমার এখন খাওয়ার মুড নেই।"
"তা বললে হবে? আপনি মাহার বড় ভাইয়ের মতো। ওর বিশেষ দিনে একটু খাওয়া দাওয়া না করলে হবে? একটু পায়েস অন্তত খান।"
"হুম।"
পায়েসের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে আছে রেজওয়ান। ভাগ্যটা এতটা নির্মম না হলেও পারতো! লুবান অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহার দিকে। মাহা খেয়াল করেছে। অদ্ভুত লাগছে তার। রেজওয়ানের সাথে আলাদা একটু কথা বলা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু ব্যস্ততায় তা সম্ভব হয়নি। অনেকটা ঘোরের মাঝেই কবুল বলেছে মাহা। সার্থক যদিও বেহায়ার মতো প্রথমবারেই গড়গড় করে কবুল বলে দিয়েছে। ঘরে হাসির রোল পড়ে গিয়েছিলো তখন। মাহার কি যে লজ্জা লাগছিলো! নিভা তো হাসতে হাসতে বলেই ফেললো,
"ভাইয়া, তোমার বউকে কেউ ছিনিয়ে নিচ্ছেনা।"
সার্থক মুচকি হেসেছিলো তখন। বেহায়া লোক!
"লুবান? তোর সাথে আমার কিছু প্রয়োজনীয় কথা ছিল?"
লুবান থাই স্যূপ খাওয়া থামিয়ে বললো,
"কি কথা?"
"তোকে কয়েকমাসের জন্য কানাডা যেতে হবে?"
"হঠাৎ?"
"আছে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ।"
!!৬৫!!
লুবান আর কোনো শব্দ করেনি। চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। মাহা হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। যাক লুবানের থেকে রেহাই পাবে সে। খাওয়া দাওয়া শেষ হতে হতে রাত দশটা বেজে গিয়েছে। রেজওয়ানের প্রস্থান করার সময় হয়ে এলো। মনটা মানছেনা। মনকে কড়া করে বকে শক্ত করলো রেজওয়ান। সোফা থেকে বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়ালো রেজওয়ান।
"আসি, মাহা।"
মাহাও রেজওয়ানের সাথে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। রেজওয়ান অনেক চেষ্টা করছে মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে।
"রেজওয়ান ভাইয়া?"
"হুম, মাহা। কিছু বলবে?"
"আপনার সাথে কথা বলার তো সুযোগই পেলাম না আমি। আপনাকে অনেক কথা বলার আছে ভাইয়া।"
"আমারও কিছু প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন মাহা। আজতো সম্ভব না। তুমি কি আমার সাথে দেখা করতে পারবে?"
"আমি চেষ্টা করবো। যদি সম্ভব হয় কল করে জানাবো আপনাকে। সার্থক.. সার্থক খুবই ভালো ভাইয়া। আমার মতো এতিম, অসহায় মেয়েকে সহায়তা করেছে ও। কয়জনে করে এমনটা।"
রেজওয়ান মনে মনে বললো,
"তুমি যদি আমাকে একটা সুযোগ দিতে মাহা। আকাশের চাঁদটা তোমার পায়ে এনে রাখতাম আমি।"
মুখে বললো,
"সার্থক খুবই ভালো ছেলে, মাহা। তুমি ভালো থাকলেই হলো।"
"আমি আপনাকে আমার বড় ভাইয়ের মতো দেখে এসেছি ভাইয়া। আন্টিও আমাকে অনেক স্নেহ করেন। বাবা, চৈতিকে হারিয়ে এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা হয়েছি আমি। আপনাকেই কেবল একজন ভালো বন্ধু, গুরুজন হিসেবে মেনে এসেছি। আমার অনেক কষ্ট ভাইয়া। আমি কখনো কাউকে বুঝাতে পারবোনা। আমার জন্য একটু দোয়া করবেন ভাইয়া।"
মাহা অশ্রুসিক্ত চোখে বলে উঠলো। হলুদ ফর্সা মুখটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। বাবা ও বাবা, চৈতি রে..
সবার কথা মনে পড়ছে তার!
"প্লিজ, মাহা। কেঁদোনা। দোয়া করি সুখী হও। ভালো থেকো। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে স্মরণ করবে মাহা। আমি যে অবস্থায় পারি, যেভাবে পারি তোমাকে সাহায্য করবো।"
!!৬৬!!
বলেই প্রস্থান করলো রেজওয়ান। একবারের জন্যও পিছু ফিরে চাইলোনা। বহু উৎকন্ঠা নিয়ে সার্থকের ঘরে বিশাল খাটের উপর বসে আছে মাহা। নিভা কিছুক্ষণ আগেই বসিয়ে দিয়ে গেলো তাকে। সার্থক কি আজ নিজের অধিকার চাইবে? মাহার তো সময় প্রয়োজন। মনের অবস্থাও ভালোনা। সদ্য বাবা হারিয়ে মনের গভীরে ক্ষত হয়ে আছে। গভীর ক্ষত। তাছাড়া পবিত্র সম্পর্কে জড়ালেও এত তাড়াতাড়ি কি নিজেকে কারো অধীনে ছেড়ে দেওয়া যায়? ঘরে নীল আলো জ্বলছে মিটিমিটি। এসির টেম্পারেচারটা বোধহয় কম। নয়তো এতো শীত লাগার কথা না! রীতিমতো কাঁপছে মাহা। গাঁয়ে লাল টকটকে শাড়ি। সার্থকের দেওয়া। বহু কল্পনা শেষে ঘরে ঢুকলো সার্থক। হাত থেকে রোলেক্স ঘড়িটা খুলতে খুলতে এগিয়ে এলো মাহার কাছে। মাহার বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে। মাহার পাশের টেবিলে ঝুঁকে ঘড়িটা রাখলো সার্থক। নিস্তব্ধতা চারপাশে। শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। সার্থক ঝুঁকেই তাকালো মাহার পানে। আস্তে আস্তে বললো,
"চেঞ্জ করোনি যে? যাও চেঞ্জ করে আসো।"
"হু...হুম।"
মাহা কোনোমতে উঠেই সোফার উপরে রাখা একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গিয়েছে। অনেকটা সময় পর নীল রঙের সুতি একটা থ্রি পিস পরে বাইরে বের হলো মাহা। সার্থক পাঞ্জাবি পরিবর্তন করে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়েছে। অপরপাশটা খালি। মাহা বুঝলো ঐটা ওর জন্যই। সেও চুপচাপ শুয়ে পড়লো পাশটায়। ঘুম আসছেনা। কেমন যেনো অদ্ভুত লাগছে তার।
"মাহা?"
"হুম?"
"তুমি কি আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে মাহা?"
কেমন যেন করুণ আকুতি সার্থকের কন্ঠে। মাহার কি হলো সে নিজেও জানেনা। একছুটে সার্থক কে জড়িয়ে ধরলো সে। সার্থক হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাহার কোঁকড়া চুলে। মাহা চোখ বুজে সার্থকের বুকে মাথা দিয়ে আছে।
"মাহা?"
"হুম?"
"আমার জীবনটা অনেক অন্যরকম। আর পাঁচটা সাধারণ শিশুর মতো আমি বেড়ে উঠেনি মাহা। মাত্র দশ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছি প্লেন দূর্ঘটনায়। অতঃপর খালামণির কাছে মানুষ হয়েছি। আমার বড় হওয়া, বেড়ে উঠা, ডাক্তারি পড়াশোনা সবই কানাডাতে। নিভা আমার খালাতো বোন। খালামণির মৃত্যুর পর আমি অনেক ভেঙে পড়ি। তখন নিভা, রবার্ট মিলে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশে আসবে। আমিও পরিবেশ পরিবর্তন করে একটু ভালো থাকবো। তারপর কানাডা ছেড়ে, নিজের শহর ছেড়ে চলে আসি বাংলাদেশে।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সার্থক। অতঃপর আবার বললো,
"আমি খুব একা মাহা। আমার পৃথিবীটা খুব ছোট। বিশ্বাস করো সেদিন যখন তোমাকে প্রথম ট্রেনে দেখলাম। আমার পৃথিবী থমকে...
বলতে বলতেই মাহার মুখের দিকে তাকালো সার্থক। মাহা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। সার্থক হালকা হেসে চুমো খেলো মাহার কপালে। চোখ বুজলো সেও৷
.
.
.
চলবে............................