২৯!!
অনামিকা কাপড় গোছানোর ফাঁকে একটু পর পর আড়চোখে অরণ্যের দরজার সামনে পায়চারি করা দেখছে আর হাট করে খোলা দরজা দিয়ে কেউ ঢুকছে কিনা সেটা খেয়াল করছে। অরণ্য নিজেও একটু পর পর বিরক্তিভরা চোখে অনামিকার কাজ দেখছে আরেকবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। আরো কয়েক মিনিট পর দরজার বাইরে ফারহাকে দেখতে পেয়েই অরণ্য একবার চট করে মুখ তুলে অনামিকার দিকে তাকালো। অনামিকা নিজের দিকে তাকিয়ে ততক্ষণে সবগুলো কাপড় গুছিয়ে মুখ তুলে তাকাবে এমন সময়ই অরণ্য ফারহার একটা হাত ধরে টেনে রুমে ঢুকিয়ে নিল। এতো রাতে অরণ্যের কল আসায় বেচারি এমনিতেই ভয়ে কাহিল হয়ে ছিল। এবারে রুমের সামনে আসতেই অরণ্য রুমে টেনে নেওয়ায় ভয়ে রীতিমতো হার্টফেল করে মরে যাওয়ার দশা হয়েছিল ফারহার। অবশ্য রুমে ঢুকতেই অরণ্যের আগে অনামিকাকেই চুপচাপ কাজ করতে দেখে ফারহা একবার অরণ্যের দিকে তাকালো, আরেকবার অনামিকার দিকে। এদের দুজনের মধ্যে।আবার নতুন করে কি ঘটেছে সেটাই ভাবার ব্যর্থ চেষ্টা করলো ফারহা।
-ফারহা? এতো লেইট করলে কেন আসতে বলো তো? তোমাকে কখনোই টাইমে পাই না। এসব করলে বিয়ের পরে ডেইলি দুজনের মধ্যে ঝামেলা লেগেই থাকবে। সেটা কি ঠিক হবে বলো তো সুইটহার্ট?
-বিয়ে! সুইটহার্ট! কিসব বলছেন স্যার?!
-আরে সুইটহার্ট! এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোমার অনু ম্যাডাম সবটা জেনে গেছে আমাদের ব্যাপারে বুঝলে? আর কতদিন এভাবে লুকোচুরি করে প্রেম করবো বলো? এক না একদিন তো সবার সামনে আসতোই ব্যাপারটা। তাই না?
-স্যার!
অরণ্যের কথাগুলোয় বিষম খাওয়ার জোগাড় হলো ফারহার। দু তিন মিনিটের জন্য বেচারি খুঁজেই পেল না কি বলবে। অনামিকার দিকে তাকিয়ে দেখলো অনামিকা চুপ করে বিছানার চাদরের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা পলক ফেললেই যে অনুর চোখের কোণে জমা থাকা বিন্দু বিন্দু অভিমানের কণাগুলো গড়িয়ে পড়বে সেটা ফারহা যেমন খেয়াল করলো, অরণ্যও দেখলো। অরণ্য ফারহার হাতটা টেনে ফারহাকে নিজের আরো কাছে টেনে নিয়ে অনামিকার মুখের দিকেই অপলকে চেয়ে রইলো। আর এদিকে অনামিকা নিজেকে শত চেষ্টা করে শান্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। চোখ জোড়া বারবার ঝাপসা হয়ে আসতে চাইছে, কোনোমতে চোখের পানিগুলো চোখের বর্ডারেই ধরে রাখার চেষ্টায় ফারহা আর অরণ্যের পাশাপাশি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকাটাকে ইগনোর করে যাচ্ছে অনু।
-এতো স্যার স্যার করছ কেন সুইটহার্ট? ওহ অনুকে দেখে ভয় পেয়েছ নাকি? আরে আমরা একসাথে হ্যাপি থাকলে তোমার অনু ম্যাডাম উল্টো খুশিই হবে। বিলিভ না হলে ওকেই জিজ্ঞেস করো দেখো? ও মাত্রই আমাকে বলেছে, তুমি তো আমার ভালো মন্দ সব খেয়াল রাখো। তাই আমি তোমার সাথে থাকলে অনুর কোনো আপত্তি নেই। কি অনু? ঠিক বললাম তো?
আরেকবার অনু-অরণ্যের রুমটায় নিরবতা নামলো। অনামিকা মুখটা আরো কিছুটা নিচু করে চোখ বুজে মুখটা আড়াল করার চেষ্টা করলো। এতোক্ষণের জমে থাকা অশ্রুবিন্দুগুলো এবারে হার মেনে গড়িয়ে পড়লো অনামিকার গাল বেয়ে। অরণ্য ফারহা হাতটা ছেড়ে দিয়ে এসে অনামিকার সামনে এসে বসে আলতো করে অনামিকার মুখটা তুলে ধরে অনামিকার কান্নাভেজা মুখটার দিকে তাকালো।
-এখনও কিছু বলার নেই তোমার অনু? এখনও চুপ করেই থাকবে? নাকি সত্যিই চাইছো আমি ওই মেয়েটাকে নিজের জীবনে তোমার জায়গায় এনে বসাই? কোনটা?
-আপনাদের দুজনের মধ্যে কি চলছে আমি আজও বুঝতে পারছি না স্যার। অনু ম্যাডামের দিকে কেউ তাকালেও আপনি সহ্য করতে পারেন না, কেউ উনাকে স্পর্শ করা তো দূর, উনাকে কিছু বললেও আপনি রেগে যান। নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করেন। আবার সেই আপনিই উনাকে এসব বলে কষ্ট দিচ্ছেন। কেন স্যার? আমাকে তো এনেছিলেন যাতে ম্যাডাম একটু জেলাস হোক, সব সময় আপনার আশেপাশেই থাকুক। আপনার উপরে অধিকার ফলাক। তাহলে এখন কেন এসব বলে ম্যাডামকে কষ্ট দিচ্ছেন এভাবে? ম্যাডাম তো আমি আসার পর থেকেই এক সেকেন্ডের জন্যও আমাকে আপনার আশেপাশে আসতেও দেয় না। যদিও কখনো আপনার সাথে কথা বলতে দেখে তাহলে মুখ চোখের কি অবস্থা হয় সেটা তো আপনিও ভালো করেই জানেন স্যার? তাহলে হঠাৎ এসব কেন?
-তুমি যাও ফারহা। যে সামান্য ব্যাপারটা তোমারও চোখে পড়ে সেটা তোমার ম্যাডামের চোখে পড়ে না কখনো। কি আর করবে। যে ধরা দিতে চায় না, তার পালানোর বাহানার কি অভাব হয়?
-ম্যাডাম? আমি আপনার সংসারে ভাগ বসাতে আসি নি। এন্ড সরি স্যার। আমি কালই চলে যাবো। এতোগুলো দিন নিজের চাকরির খাতিরে চুপ ছিলাম। কিন্তু আজ আর চুপ থাকতে পারছি না। আপনাদের দুজনের এমন নিরব অভিমান অভিযোগ আমি বুঝতে পারছি না। এতো জটিল ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকবে না। তাই আমি নিজেই রিজাইন করে দিচ্ছি স্যার। আপনারা দুজন প্লিজ নিজেদের ঝামেলাগুলোও মিটিয়ে নিন প্লিজ। এভাবে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়াবেন না আর।
-তোমার রিজাইন করা লাগবে না ফারহা। কাল আমার সাথে অফিসে যাবে। কাজ বুঝিয়ে দিব। তোমার কোয়ালিফিকেশন ভালোই ছিল। বাট বাচ্চামি চরম পর্যায়ের আর একরোখা ভাবটাও মাত্রা অতিরিক্ত ছিল। আসলেই কাজ করার মতো ধৈর্য্য আছে কিনা সেটা টেস্ট করার জন্যই এতোদিন এসব করানো। সরি ফর দ্যাট। এবার থেকে বাড়িতে মায়ের কাজেও টুকটাক হেল্প করবে বুঝলে? সকালে রেডি হয়ে থাকবে। এখন যাও।
-ইয়েস স্যার। আর অনু ম্যাডাম, বিলিভ করুন আমার আর স্যারের মধ্যে কিছুই চলছে না যেমনটা আপনি ভাবছেন।
ফারহা আর কিছু না বলে বেরিয়ে যেতেই অরণ্য রুমের দরজাটা লক করে আবার এসে অনামিকার পাশে এসে বসলো। মেয়েটা মুখটা নিচু করে তখনো চোখের পানি ফেলছে দেখে অরণ্য অনামিকার মুখটা দু হাতে তুলে ধরে অনামিকার চোখে চোখ রাখলো। অনামিকাও এবারে একটু ফুঁপিয়ে উঠে অরণ্যের দিকে তাকালো। অভিমানে গলা বুজে আসছে অনুর। না পারছে কাঁদতে আর না পারছে অরণ্যকে কিছু বলতে।
-এখনো চুপ করেই থাকবে পাগলি? কিছু বলবে না? ফারহার কাছে যাবো?
অরণ্য কথাটা বলে সরে আসার চেষ্টা করতেই অনামিকা অরণ্যের হাতটা খামচে ধরে আটকালো। অরণ্য এবারে একটু হেসে অনামিকার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে অনামিকার কপালে কপাল ঠেকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলো।
-তুমি এমন পাগলি কেন বলো তো অনু? দূরে যেতে দিতে চাও না? কাছে ডাকলে সাড়া দাও না। আমার উষ্ণতায় তোমায় জড়িয়ে নিতে চাইলে ধরা দিতে চাও না। তোমাকে এ জীবনে বোঝা আমার হবে কিনা কে জানে! নাকি সবসময়ই এমন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে মায়াবীনির রহস্য হয়ে?
-রহস্য থেকে পর্দা উঠার পর যদি আর এমন ব্যাকুলতা না থাকে? বারবার ছুটে আসার পাগলামিগুলে যদি হারিয়ে যায়? তাই তো ভয় হয়। ভয় হয় কাছে আসতে, ধরা দিতে।
-ওকে। তাহলে রহস্যটা নাহয় অজানাই থাক। সময় চাইছ যখন সময় নাও। যেদিন মন থেকে বিশ্বাস করতে পারবে এই মানুষটা আজীবন তোমার অপেক্ষার প্রহর গুনবে, তখন নাহয় তার কথাটা মনে করো। ততদিন নাহয় আমিও কারো লাজুক হাসিতে ধরা দেয়ার অপেক্ষায় থাকবো।
-হুম।
অনামিকা এবারে গোছানো কাপড়গুলো আলমারিতে রেখে রুমের লাইটটা অফ করে দিয়ে আবার বিছানায় এসে বসলো। অরণ্যও এবারে হাত বাড়িয়ে অনামিকাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে ছোট্ট একটা আদরের পরশ এঁকে দিলো অনামিকার কপালে।
-সেদিন জ্বরের ঘোরে কিসব পাগলামি করছিলে জানো? কত রাগ করেছিলে ফারহাকে নিয়ে এসেছি বলে। তোমার রাগটা দেখে চাইলে পরের দিনই ফারহাকে ওর বাড়িতে চলে যেতে বলতে পারতাম। বলি নি কেন জানো অনু? আমি চাইছিলাম তুমি সজ্ঞানে আমার চোখে চোখ রেখে কথাটা বলো। বলো যে কালই ফারহাকে বিদায় করো। নইলে কপালে দুঃখ আছে। অথচ আমার ম্যাডাম কি করলেন? তিনি তো উল্টো ফারহাকে নিয়ে থাকতে বলে নিজে চলে যেতে চাইছেন। এটা কেমন কথা অনু?
-আমি কি করবো?
-কি করবে মানে? সেদিনের মতো কলার চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে বলবে, তোমাকে ছাড়া অন্য কারো দিকে তাকানো যাবে না। বলবে, তাকালেও চোখগুলো খুলে নিবো। হা হা হা। সেদিন তোমার থ্রেটগুলো দারুণ ছিল। জ্বিভ কেটে কুঁচি কুঁচি করে ড্রেনে ফেলবে---। হা হা হা।
-ধ্যাত থামুন তো। আমি এসব কিছু বলি নি।
-বলো নি? জ্বরের ঘোরে আরো কত কি যে বলেছ মেয়ে। সেসব তোমার মনেও নেই।
-জ্বরের ঘোরে আমি নাকি অনেক কথাই বলি। বলেছি হয়তো। মনে নেই।
-হুম। জ্বরের ঘোরে ভালোই কথা বলো। অথচ এমনি সারাদিন পালাই পালাই করো। শোনো মেয়ে, আবার যদি কখনো বলেছ কিচেনের ফ্লোরে গিয়ে ঘুমাবে তাহলে কিন্তু কপালে দুঃখ আছে বলে দিলাম। তোমাকে কতোটা চাই সেটা না বুঝে সবসময় উল্টোটা বুঝলে এবার থেকে কিন্তু শাস্তি হবে বুঝলে অনু? সংসারটা যেহেতু তোমার তাই সেটা সামলাতেও হবে তোমাকে। এমন পালাই পালাই করলে চলবে না একদম। বুঝলে?
-হুম।
-আরে কোথায় যাও এখন? অনেক রাত হলো তো? না ঘুমিয়ে কোথায় চললে? এই অনু?
-আমমমম। একটু আসছি।
-লাইট দিব?
-আরে না না না।
-ওকে।
অনামিকা উঠে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ কাত হয়েও ঘুম আসছে না অরণ্যের। এমনটা কেন হচ্ছে সেটাও অরণ্য জানে। আজকাল অনুকে বুকে জড়িয়ে না নিলে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে শেষে বিরক্ত হয়েই উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকার শহরটার দিকে তাকালো অরণ্য। বেশ গভীর রাত। শহরটা যেন এক রূপকথার ঘুমন্তপুরীর রূপ নিয়েছে। এই ঘুমের দেশে বোধহয় অরণ্য একাই জেগে রয়েছে কোনো অজানা কারণে। রাতের ঘুমন্ত শহরটা দেখে একসময় আবার রুমে এসে দাঁড়িয়েছে অরণ্য। বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে পিছনের দিকে ঘুরতেই অরণ্যের চোখ জোড়া যেন আটকে গেল সমানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে। একপা দুপা করে তার দিকে এগিয়ে এসে অরণ্য মানুষটার মুখটা দুহাতে তুলে ধরে একটা প্রশ্ন করলো অরণ্য।
-এটা সত্যিই কি তুমি অনু? নাকি কোনো স্বপ্ন?
৩০!!
-মনের আকাশে মেঘ জমা শেষ হলে
বুকের মাটি যে ভেসে যাবে কত জলে।
তবু শুকনো হৃদয় প্রান্তরে তুমি শিশিরের মতো হেসো।
মনের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থেক না, ঘরের দুয়ারে এসো।
অরণ্য বারান্দা থেকে এসে রুমের লাল সবুজ ডিম লাইটের আবছা আলোয় অনামিকাকে ওয়াশরুমের বাইরে এসে দাঁড়াতে দেখেই অরণ্য যেন মূহুর্তের জন্য থমকে গেল। একটা ঘোরের মাঝেই অনামিকার কাছে এসে দাঁড়িয়ে অনামিকার মুখটা দুহাতে তুলে ধরে অবাক বিস্ময়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে শেষে একটাই প্রশ্ন করতে পারলো। অনু যে সত্যিই ওর দেয়া শাড়িটা পড়ে এসে সামনে দাঁড়িয়েছে সেটা অরণ্যের বিশ্বাসই হতে চাইছে না। তার উপরে টকটকে লাল রঙা শাড়িটায় অনুকে একদম নতুন বউয়ের মতো লাগছে। অরণ্য স্তব্ধ হয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে অনামিকাও কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেছে। বেচারিও লজ্জায় লাল হয়ে একটু ইতস্তত করে অরণ্যের দিকে তাকিয়েছে এতোক্ষণে। এভাবে হুট করে শাড়িটা পড়েছে কেন অনামিকা নিজেও জানে না। অরণ্যের এমন ঘোর লাগানো দৃষ্টিটা দেখে অজান্তেই কখন মুখ দিয়ে গানের লাইনগুলো বেরিয়ে গেছে অনামিকা নিজেও জানে না। আর এদিকে অনামিকার হালকা গলায় গানের লাইনগুলো শুনে আরো খানিকটা মুগ্ধ যেমন হলো, তেমনি ঘোরটাও কাটলো অরণ্যের।
-অনেক রাত্রি সাগরের মতো কেঁদে
মেঘেদের রঙে স্মৃতিতে দিয়েছি বেঁধে,
দুটি হাতের মালা সোহাগে এবার ধরা দিয়ে ভালোবেসো।
হুম হুম হুম হুম হুম হুম হুম হুম হুম হুম,
হুম হুম হুম হুম হুম হুম হুম হুম।
নিজের মনেই গানের লাইনগুলো অরণ্যও গুন গুন করে অরণ্য অনামিকা দুজনেই হেসে ফেললো একসাথে। কি পাগলামি করছে নিজেরাও বুঝতে পারছে না ওরা। একটু পরে হাসি থামিয়ে অরণ্য অনুকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে ছোট্ট করে একটা চুমো এঁকে দিলো অনামিকার কপালে।
-তোমাকে একদম বউ বউ লাগছে অনু। একদম প্রথম দিনের মতো। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমার নতুন বউ হয়ে বাড়িতে এসেছ। কতোগুলো দিন কেটে গেছে তাই না অনু? অথচ দেখো? আজও মনে হয় এই তো একটু আগেকার কথা। সবারই এমন ফিল হয়? নাকি আমারই এতো পাগলামি মাথায় চাপায় এমন লাগছে কে জানে?
-কি জানি! হয়তো সবার অনুভূতিগুলো আপনার মতো হয় না।
-অনু? তোমার সাথে বকবক করে রাত পার করবো বলে বারান্দায় দোলনা সেট করলাম। দোলনাটা এভাবে অকেজো পড়ে থাকলে কেমন দেখায় বলো তো? চলো বসি কিছুক্ষণ?
-এখন!
-হুম। রাত তো সবেমাত্র শুরু ম্যাডাম। সেদিন কতো কথা বাকি ছিল শোনার, কত কিছু বাকি ছিল বলার। জীবন সবাইকে এই সুযোগটা তো দেয় না বলো? নতুন করে সবকিছু শুরু করার। আমরা যখন সুযোগটা পেয়েছি তাহলে নতুন করেই নাহয় শুরু করি। কি বলো?
-হুম। কিন্তু আপনার অফিস?
-হায়রে মেয়ে! আমার অফিসের বস ও এতোবার অফিসে যাওয়ার ব্যাপারে প্যারা দেয় না, যতবার তুমি অফিস নিয়ে ইনকোয়ারি করো।
-নাহ মানে। আপনি যে বললেন কাল সকালে ফারহা আপনার সাথে অফিসে যাবে-----।
-হায়রে মেয়ে! আগে তো ভোর হতে দাও। তারপর দেখা যাবে কি হয়।
-হুম। ওকে।
-এক কাজ করো। তুমি গিয়ে বারান্দায় বসো। দু মিনিট লাগবে আমার। আমি দু কাপ কফি নিয়ে এক্ষুণি আসছি।
-এতো রাতে কফি কেন?
-এই হালকা শীতল বাতাস গায়ে মেখে গরম কফিতে চুমুক দিয়ে গল্প করবো তোমার সাথে। ঘুমন্ত শহর, আকাশে এক ফালি চাঁদ, মৃদুমন্দ বাতাস, তুমি আমি আর কফি। সিচুয়েশনটা একবার কল্পনা করে দেখো।
-জি। কল্পনা করে ফেলেছি। আপনি বসুন। আমিই কফি বানিয়ে আনছি।
-তুমি বানাতে পারবে জানি। বাট আমিও যে খুব একটা খারাপ বানাই না কফিটা সেটাও তো আপনার জানার দরকার ম্যাডাম। আর এই সামান কফিটা আমি বানিয়ে নিতে পারবো। এইটুকু ভরসা করতে পারেন।
-জি না জনাব। আপনি অপেক্ষা করুন।
-শশশশশশ। কথা কম। চুপচাপ বারান্দায় বসে থাকো কয়েক মিনিট। আমি জাস্ট যাবো আর আসবো।
-হুমমমম। ওকে।
-গুড গার্ল।
অরণ্য আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অনামিকাও একটু হেসে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। এই জায়গাটা অনামিকার সবচেয়ে বেশি পছন্দের। সময়ে অসময়ে, মন খারাপ হোক বা রাগ হোক, অভিমান হোক, এই একটা জায়গায় এসে স্বস্তি পায় অনামিকা। কেন কে জানে! জায়গাটায় অরণ্যের ছোঁয়া আছে বলে? নাকি প্রথমবার অরণ্য নিজের মনের কথাগুলো ওকে এখানেই বলেছিল বলে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সেই প্রথমদিনের সময়টাই যেন চোখের সামনে ভাসছে অনামিকার। সেই অরণ্যের সাথে দোলনায় বসে গল্প করা, অরণ্যের মুখে লাভ এট ফার্স্ট সাইটের কথাগুলো, আরে কত গল্প করা হতো হয়তো সেদিন। অথচ ছোট্ট কয়েকটা কথা পুরো সিচুয়েশনটাই বদলে দিয়েছিল সেদিন। হয়তে আজও বদলে যেত পুরো পরিবেশ, ওদের দুজনের এখনকার এই আবেগঘন মূহুর্তটা। তবু একটু হলেও নিজেকে হালকা লাগে অনামিকার। অরণ্যকে যতটুকু বলতে পেরেছে ততটুকুই মেনে নিয়ে নতুন করে শুরু করতে চলেছে ওরা। হয়তো সেদিন সাহিলের ব্যাপারে পুরোটা বলতে পারলে এতোগুলো দিন এতো মান অভিমান হতো না দুজনের। অবশ্য এখন কথাগুলো ভেবে আর কি হবে? যা গেছে তা তো গেছেই।
-একমনে আবার কি ভাবা হচ্ছে ম্যাডাম? মিসিং মি?
পিছন থেকে অরণ্য কণ্ঠটা শুনে অনামিকা দেয়ালে পিছ ঢেকিয়ে ঘুরে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে হাসলো। লোকটা দু হাতে দু কাপ কফি নিয়ে হাজির হয়ে গেছে। কফির কাপ দুটো দোলনার পাশে টি-টেবিলের উপরে রেখে অনামিকার সামনে এসে দাঁড়িয়ে অনামিকার দু পাশের দেয়ালে হাত দিয়ে অনামিকার মুখের দিকে তাকালো অরণ্য। অরণ্যের কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে অনামিকা আরেকবার মিষ্টি করে হাসলো।
-ভাবছিলাম কফি বানাতে গিয়ে ভদ্রলোক হারিয়ে গেলেন কিনা।
-আরেকটু হলে হারিয়ে যেতাম। কোথায় কি রেখেছ খুঁজে পেতে পেতেই তো এতো সময় লাগলো।
-তারজন্যই বলেছিলাম আমিই কফিটা বানিয়ে আনি।
-কেন গো বউপাখি? মিস করছিলে বুঝি? ইশ! এতো মিস করবে জানলে তো তোমাকেও নিয়ে যেতাম। দুজনে একসাথে মিলে কফি বানাতাম। কাজের ফাঁকে যে দুষ্টিমিগুলো করা হয়না, সেগুলোও পুষিয়ে নিতাম।
-কি!
-আরে এতো অবাক হয়ে তাকানোর কি হলো? বউকে কাজের সময় রান্নাঘরে টুকটাক ডিস্টার্ব করা হাজবেন্ডদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বুঝলে? এতোগুলো দিন মিস করে ফেলেছি। আশা করছি সামনে মিস করবো না।
-কিসব বলেন?
-এই অনু? কফি টেস্ট করে বলো তো কেমন হয়েছে। আমার হাতের কফি খাওয়ার জন্য মেয়েরা লাইন ধরে থাকে বুঝলে? টেস্ট করলে বুঝতে পারবে কেন।
-আমি এতো গরম কফি খেতে পারি না।
-রাগ করলে?
-হুম?
অরণ্যের প্রশ্নটা শুনে চমকে অরণ্যের চোখে চোখ রাখলো অনামিকা। অরণ্যের কথাটা শুনে সত্যিই রাগ লাগছিল অনামিকার। কিন্তু অরণ্য জানলো কেমন করে? কথাগুলো ভাবার ফাঁকেই অরণ্য একটু এগিয়ে এসে আলতো করে একটা চুমো এঁকে দিল অনামিকার ঠোঁটে। একটু পরেই মুখ তুলে অনামিকার লজ্জা লাল মুখটা দেখে অরণ্য অনামিকাকে নিয়েই দোলনায় বসে পড়লো। অরণ্য অনামিকাকে নিজের কোলের উপরে বসিয়ে একদম বুকের সাথে মিশিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছে।
-এতো রাগ করো কেন সবসময় পাগলি? আমি তো দুষ্টুমি করেছিলাম গো বউপাখি। একদম নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরো কেন বলো তো? এভাবে করলে চলবে কি করে?
-কি কিভাবে চলবে?
-এই যে এতো রাগ! আমাদের পুঁচকেগুলো তোমার আমার দুজনের রাগ পেলে তো আল্লাহ মালুম কি হবে!
-ধ্যাত! কি বলেন এসব?
-কি আর বলবো? ভাবছি বুঝলে অনু? এই যে পুঁচকেদের আসার নামেই এতো লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছ, ওরা আসলে কি করবে?
-কিসের মধ্যে কি, পান্তা ভাতে ঘি। ব্যাপারটা সেরকম হয়ে গেল না? কথা হচ্ছিল কফি নিয়ে।
-হুম তো? আর এই মেয়ে? এখনো আপনি আপনি করেই চলেছ ব্যাপার কি? একটা মাত্র হাজবেন্ড আমি তোমার। আমাকেও আপনি আপনি করে পরের মতো দূরে ঠেলে দিচ্ছ! এসব কি ঠিক বলো তো?
-তুমি করে বললেই বুঝি আপন হয়ে যায়?
-আপন হোক না হোক এতো পর পর তো লাগে না।
-কখনো তো বলো নি তুমি করে বলতে। তাই বলি নি। এখন বলেছ যখন তখন বলবো।
-বাহ বাহ! সো ফাস্ট! যেভাবে লজ্জায় লাল হয়ে গেছিলে আমি তো ভাবলাম 'তুমি' ডাক শুনতে গেলে কোন যুদ্ধ জয় করতে হবে।
-আপনি বলছিলাম বলেও সমস্যাশ এখন তুমি বলছি তাতেও সমস্যা। আমি কি করবো সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
-কি আর করবে? একটুখানি কফি টেস্ট করো। ভালো লাগলে গিফ্ট দিবে।
-ধ্যাত। সবসময় কিসব বলে?
-আমি কিন্তু এবারে কিছু বলিই নি ম্যাডাম। যা ভাবার আপনি নিজেই ভেবে নিয়েছেন।
-উফ! ছাড়ুন তো। কফি ঠান্ডা হয়ে শরবত হয়ে যাচ্ছে।
-আরে তাইতো! টেস্ট করে বলো কেমন লেগেছে।
অনামিকা একটু মিষ্টি করে হাসি দিয়ে কফিটা মুখে দিয়েই বুঝতে পারলো কফিটা অসাধারণ হয়েছে। কিছু না বলেই এক নিমিষে কফিটা শেষ করেই বেচারি লজ্জা পেয়ে গেল। অরণ্যও অনামিকার লাজুক মুখটা দেখে হেসে ফেললো। নিজের কফিটা শেষ করেই অনামিকার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল অরণ্য।
-কেমন হয়েছে সেটা না বলে এক চুমুকে কফির কাপ খালি করে দিলে বউপাখি? এবার তো বলো টেস্ট কেমন ছিল?
-অসাধারণ হয়েছে। অনেক মজা।
-কিসের? কফির নাকি----?
-ধ্যাত!
অনামিকা আরেকবার লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে দেখে অরণ্য আলতো করে অনামিকার মুখটা দুহাতে তুলে ধরলো।
-অনু? প্রথমদিন তোমাকে বলেছিলাম মনে আছে? আগে নিজেদেরকে বুঝি, নিজেদের অস্বস্তিটা কাটাই, তারপর নাহয় আগে বাড়া যাবে। এখনও কি অস্বস্তি হয় আমার স্পর্শে? এখনো অপরিচিত লাগে?
-উঁহু। না। এই মানুষটা অনেক বেশিই পরিচিত হয়ে গেছে আমার। তার স্পর্শগুলো, তার ঘ্রাণ, নিঃশ্বাসের উষ্ণতা, সবই কেমন পরিচিত লাগে।
-তাই? তাহলে আরো গভীর পরিচয়ের সময় এসেছে। যাতে কথায় কথায় এই বাহুবন্ধন থেকে পালানোর পথ খোঁজো।
অনামিকার লজ্জারাঙা নত মুখটার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসির রেখা ফুটে উঠতেই অরণ্য অনামিকাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে রুমের দিকে রওনা হলো। অনামিকা এতোদিনে ভরসা করে অরণ্যের গলা জড়িয়ে ধরে অরণ্যের চোখে চোখ রেখেছে। অরণ্যও মুগ্ধ চোখে অনামিকার লাজুক, কিন্তু শান্ত মুখটা দেখছে। অনামিকাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আলতো করে অনামিকার কানে চুমো এঁকে দিতেই অনামিকা অরণ্যের একটা হাত খামচে ধরলো।
-কি হলো অনু? এনি প্রবলেম?
-উঁহু। এক সেকেন্ড প্লিজ?
-ওকে।
অনামিকা অন্ধকারে পাশের একটা ড্রয়ার হাঁতড়ে কিছু একটা নিয়ে এসে আবার অরণ্যের সামনে বিছানায় বসলো। অরণ্য ভ্রু কুঁচকে অনামিকার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো মেয়েটা কি চাইছে। অনামিকা একটু ইতস্তত করে নিজের হাতের মুঠো খুলে অরণ্যের দিকে এগিয়ে দিতেই অনামিকার হাতের মুঠোয় বন্দি চিকচিক করা জিনিসটা দেখে অরণ্যের ঠোঁটের কোণেও হাসির রেখা ফুটে উঠলো। আর সাথে অনামিকার বলা কথাগুলোও কানে এসে বাজলো অরণ্য।
-এটা আরেকবার তুমি নিজ হাতে পড়িয়ে দিবে প্লিজ?