আজও নিহির নামে একটা উড়োচিঠি এসেছে। আজ চিঠিটা গ্রহণ করেছে নিহির ভাবি তমা। নিহি তখনো ঘুমিয়ে ছিল। তমা এসে নিহিকে ডেকে বলে,
"দেখো আজও চিঠি এসেছে। তাও আবার কোনো নাম-ঠিকানা ছাড়াই।"
নিহি ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"পিওন আছে নাকি চলে গেছে?"
"সে তো চিঠি দিয়েই চলে গেছে। আজ আর তোমায় চায়নি। আমায় দিয়েই চলে গেল।"
নিহি গায়ের থেকে ল্যাপ সরিয়ে দৌঁড় দেয়। ড্রয়িংরুম পর্যন্ত গিয়ে আবার ঘরে ফিরে আসে। মানুষটা কে তা জানার উত্তেজনায় ওড়না ছাড়াই দৌঁড় দিয়েছিল। তাড়াহুড়া করে ওড়না খুঁজতে গিয়েও ওড়না খুঁজে পায় না। এদিকে পিওনকে ধরার জন্য মন-প্রাণ ছুটে যাচ্ছে। নিহিকে ব্যস্ত হতে দেখে তমা জিজ্ঞেস করে,
"কী খুঁজছ?"
"আরে ভাবি, ওড়না খুঁজে পাচ্ছি না।"
ওড়না খোঁজার মতো কোনো ধৈর্য না পেয়ে একটা জামা গলায় ঝুলিয়ে বের হয়। পেছন থেকে ভাবি বলে,
"এই নিহি, তুমি ওড়না না নিয়ে জামা নিয়ে যাচ্ছ তো!"
"কিছু হবে না ভাবি। এত সকালে মানুষজন সবাই ঘুমিয়ে আছে।" যেতে যেতে উত্তর দেয় নিহি। নিচ তলায় এসে আর পিওনের দেখা মেলে না। তাছাড়া বাম দিকে গেছে নাকি ডান দিকে গেছে সেটাও তো নিহি জানে না। নিহি মনকে প্রশ্ন করে, 'আচ্ছা বলতো পিওন কোনদিকে গেছে? ডানদিকে না বামদিকে?'
মন বলেছে ডান দিকে। মনের ওপর ভরসা করেই নিহি ডানদিকের রাস্তা ধরে। কুয়াশার জন্য সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আস্তে আস্তে কুয়াশা ভেদ করে নিহি এগিয়ে যায়। কুয়াশার মাঝে নিহি নিজেও হারিয়ে যায়। নোখ কামড়াতে কামড়াতে চারপাশে তাকায়। কয়েকজন রিক্সাওয়ালা পেটের দায়ে শীতের আরামের ঘুম বাদ দিয়েই রিক্সা নিয়ে বের হয়েছে। চায়ের টং দোকানগুলোতে চা বসানো হয়েছে। কয়েকটা দোকান খুলেছে মাত্র। 'শালা পিওন ব্যাটা কোথায় যে হারিয়ে গেল!'
পাশ থেকে একটা ছেলের হাসির শব্দ পেয়ে নিহি চকিতে ফিরে তাকায়। ছেলেটির গায়ে টকটকে গাঢ় লাল রং এর একটা সুয়েটার। মাথায়ও লাল রং এর একটা টুপি। বয়স আনুমানিক ১০/১১ হবে। এর আগে কখনোই এখানে এই ছেলেকে নিহি দেখেনি। আর দেখলেও বোধ হয় চিনেনা। তাছাড়া সবাইকে চেনার দায়িত্বও নিহির নয়। নিহি কোমরে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"হাসছ কেন তুমি?"
মুখ টিপে হেসে ছেলেটা উত্তরে বলে,
"আমি দেখেছি, শীতে মানুষ সুয়েটার পরে। আর তুমি দেখি ডাবল জামা পরেছ।"
নিহি কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে আসলেই তো তাই! নিশ্চয়ই খুব হাস্যকর লাগছে। তবুও ঈষৎ ভাব নিয়ে বলে,
"হু। তো?"
"রাগলে তোমায় দারুণ লাগে।"
নিহি হা হয়ে যায় ছেলেটার কথা শুনে। শেষে কী-না পিচ্চিপুচ্চি ছেলে নিহিকে লাইন মারছে! ওহ মাই গড! বাই এনি চান্স, এই উড়োচিঠিগুলো এই পিচ্চিটাই আবার দেয়নি তো? প্রশ্ন সব জমাট বেঁধে পেটের মধ্যে আকুপাকু করছে। গড়গড় করে প্রশ্ন না করা পর্যন্ত শান্তি নেই। চোখ দুটো ছোট ছোট করে নিহি মেকি দাম্ভিকতা নিয়ে প্রশ্ন করে।
"নাম কী তোমার?"
"নাম দিয়ে কাম কী?"
এইটুকু ছেলের ভাব দেখেছ? বাপ্রে বাপ! নিহি রাগ দেখিয়ে বলে,
"বেয়াদব! বড়দের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না?"
"জানি তো! কিন্তু তুমি বড় হলেও আমার ভাবি। আর ভাবির সঙ্গে বেয়াদবি করলে কিছু হয় না। তাছাড়া এটাকে তুমি বেয়াদবি বলছ কেন? এটা ফান। ফান মানে বুঝো? মানে মজা।"
ওরে ছেলে! এইটুকুন পিচ্চি আমাকে শেখাচ্ছে ফান মানে কী? লাইক সিরিয়াসলি! নিহি পূণরায় রাগ দেখিয়ে বলে,
"দেবো না কান মলে!"
ছেলেটা কান এগিয়ে দিয়ে বলে,
"দাও মলে। ভাবি হয়ে একটা আশা করেছ। পূরণ তো করা উচিত।"
"কী আজব! কীসের ভাবি? কার ভাবি?"
"তুমি ভাবি। আমার ভাবি। আর শুনো, আজ বেশি কথা বলার সময় নেই। স্কুলে যেতে হবে।"
তারপর পকেট থেকে একটা সূর্যমুখী বের করে দিয়ে বলে,
"এই নাও। আমি দেইনি। ভাইয়া দিয়েছে।"
ফুলটা নিহির হাতে ধরিয়ে দিয়েই ছেলেটা দৌঁড়ে কুয়াশার মাঝে হারিয়ে যায়। নিহিও পিছু পিছু দৌঁড় দেবে নাকি দেবে না তা নিয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। পরক্ষণেই ভাবল, এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে রাস্তায় দৌঁড়ালে বিষয়টা খারাপ দেখা যায়। ফুলটার দিকে একবার তাকিয়ে বিড়বিড় করে বাড়িতে চলে আসে। নিহিকে হতাশ হতে দেখে ভাবি জিজ্ঞেস করে,
"পেলে?"
"না গো! পিওনকে তো পাইনি। তবে এক ইঁচড়েপাকা ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে।"
"সে আবার কে?"
"চিনি না। ছোট ছেলে। আমায় ভাবি ডাকল। এই দেখো ফুল। এটা ঐ ছেলেটাই দিয়েছে। বলল ওর ভাই নাকি দিয়েছে।"
"কোন ভাই? জিজ্ঞেস করোনি?"
"তা আর পারলাম কোথায়? ফুলটা দিয়েই তো দৌঁড় দিয়েছে।"
"কোন পাগলের আমদানি হলো আবার!"
নিহি সোফায় বসে বলে,
"জানি না ভাবি। একজন উড়োচিঠি পাঠিয়ে আমায় চিন্তায় ফেলছে। এখন আবার আরেকজন ফুল পাঠিয়ে! আমি বুঝি এবার সত্যি সত্যিই ডিপ্রেশনে চলে যাব।"
তমা নিহির পাশে বসে। নিহির কাঁধে হাত রেখে বলে,
"আচ্ছা নিহি, এই উড়োচিঠি আর ফুলের মালিক একজনই নয় তো?"
নিহি উত্তেজনা নিয়ে নড়েচড়ে বসে। বলে,
"জানিনা তো! দাঁড়াও চিঠিটা নিয়ে আসি।"
নিহি ঘরে গিয়ে খামটা হাতে নেয়। আজও আকাশী রঙের খামে শুভ্র চিঠি। একই হাতের লেখা। চিঠির শুরুতেই লেখা,
'এলোকেশী,
এত সকালে বিরক্ত করার ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু কী করব বলো? আজ খুব ইচ্ছে হলো তোমায় সকালের উইশ করতে। তাই তো এত সকালে পিওনকে ঘুষ দিয়ে পাঠিয়েছি। তুমি আবার ভেবো না, আমি ঘুষের কথা বলে টাকার জোর দেখিয়েছি। আমি শুধু বোঝাতে চাচ্ছি, তোমার প্রতি আমার আগ্রহটা। তুমি কিন্তু ভুল বুঝো না আমায়!
এই এলোকেশী,
ওমন কপাল ভাঁজ করে চিঠি পড়ো কেন? মুচকি মুচকি হেসে চিঠি পড়তে পারো না? অবশ্য, তুমি তো এখনো জানোই না আমি কে! জানলে কি হাসবে? আচ্ছা শোনো, আমার না একটা ইচ্ছে আছে। জানো কী সেই ইচ্ছে? তুমি হয়তো ভাবছ আর বলছ, 'আরে উল্লুক, না বললে জানব কী করে?' আসলেই তো! না বললে জানবে কী করে? এই দেখো, নিজেকে উল্লুক বলায় তুমি কিন্তু হেসেছ। কী হেসেছ তো? বিশ্বাস না হলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই দেখো। আচ্ছা সে না হয় পরে তুমি প্রমাণ করে নিও। উল্লুক বললাম বলে আবার ভেবো না আমি সত্যিই উল্লুক! মেয়েরা তো এসব বকাই বেশি দেয়। তাই আমি তোমার হয়ে বলে দিলাম। আচ্ছা এবার ইচ্ছের কথাটা শোনো। আমার ইচ্ছে, একদিন তোমার ঘুমন্ত মায়াময় মুখটা দেবো। তোমার এলোকেশ যখন মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়ে তোমায় বিরক্ত করবে, তখন আমি যত্ন করে চুলগুলো সরিয়ে দেবো। তোমাকে একদম টের পেতে দেবো না। খুব বেশি কিছুই কি চেয়েছি এলোকেশী?
এলোকেশী,
তুমি সুন্দর। ভীষণ সুন্দর তুমি। আমার চোখে দেখা একমাত্র সুন্দর তুমি। তুমি পরীর জগতের কোনো অপ্সরী নও। তুমি আমার হৃদয়ের অপ্সরী। যাকে একটা পলক দেখলেই আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। যাকে নিয়ে আমার ভয় হয় ভীষণ। হ্যাঁ, আমার একমাত্র ভীতি তোমায় নিয়ে। আমার ভয় হয়, তোমার ওপর যেন কারো নজর না পড়ে। এই শোনো, তুমি চোখে কাজল দেবে। এই, কাজল দিতে বললাম বলে আবার ভেবো না কাজল তোমার ওপর সকল নজর দূর করতে সাহায্য করবে। কাজল কখনো কাউকে কোনো বদ নজর থেকে দূরে রাখতে পারে না। কারো ভালো বলো অথবা মন্দ এসবকিছু একমাত্র আল্লাহ্-র হাতে। আমি জানি তুমি নামাজ পড়ো। কমবেশি এসব তুমি জানো। তবুও আমি বলে দিলাম। আর কাজল দিতে বললাম এ কারণেই, যাতে তোমার ডাগর চোখে কাজল ঠিক সূর্যের ন্যায় দীপ্তি ছড়ায়। এই তুমি হবে আমার ডাগরিনী এলোকেশী?
এই যা! এতকিছু বললাম, আর যেটার জন্য এত বড় রচনা লেখা সেটাই বলা হয়নি।
শুভ সকাল এলোকেশী"
চিঠিটা পড়ে দম নেয় নিহি। একটা মানুষ কী করে এত সুন্দর চিঠি লিখতে পারে? এত সাজিয়ে-গুছিয়ে! প্রতিটা লাইন যেকোনো মেয়ের মন কাড়তে বাধ্য। কিন্তু বারবার মনে প্রশ্ন জাগে একটাই। কে এই লোক?
নিহি চিঠিটা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। প্রথম থেকে আবারও চিঠিটা পড়তে শুরু করে। পড়তে পড়তেই হুট করে আয়নার দিকে তাকায় দেখার জন্য যে, আসলেই কপালে ভাঁজ পড়ে নাকি। নিহি বিস্মিত! আসলেই কপালে ভাঁজ পড়ে রয়েছে। জানলো কীভাবে সে? প্রশ্ন করা বাদ দিয়ে নিহি আবারও পড়া শুরু করে। 'আরে উল্লুক, না বললে জানব কী করে?' এই লাইনটা পড়ে আবার আয়নার দিকে তাকায়। কী অদ্ভুত! নিহির ঠোঁটে মুচকি হাসি। এবার নিহি আনমনেই হেসে ফেলে শব্দ করে।
তমা নিহির রুমে এসে দেখে নিহি হাসছে। জিজ্ঞেস করে,
"ভূতে ধরল নাকি? হাসছ কেন?"
নিহি উত্তর দেয় না। হেসেই চলেছে। ভাবি আবার জিজ্ঞেস করে,
"আরে হলো কী? সেই যে চিঠি আনতে এলে। আর তো গেলে না।"
নিহি চিঠিটা ভাবির হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে বলে,
"পড়ো।"
তমা খাটের ওপর বসে চিঠি পড়তে শুরু করে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি লাইন পড়ছে। ঐ কাঙ্ক্ষিত লাইনটি পড়ে ভাবি নিজেও হাসে। চিঠি পড়া শেষ হলে নিহি জিজ্ঞেস করে,
"কী বুঝলে?"
"বুঝলাম তো অনেক কিছুই। শুধু এটাই বুঝলাম না চিঠির এই মালিক কে!"
নিহি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
"আমায় আর কেউ ডিপ্রেশন থেকে বাঁচাতে পারবে না ভাবি।"
তমা দৃঢ়তা নিয়ে বলে,
"তবে যাই বলো নিহি, এই চিঠির জন্যই কিন্তু তুমি অনলের কথা চিন্তা করার সময় পাচ্ছ না। অনলকে নিয়ে ভাবার সময়টা দখল করে নিয়েছে এই চিঠির মালিক। অনলের কথা ভাবার চেয়ে চিঠির মালিককে নিয়ে ভাবা অনেক বেশিই ভালো। কারণ, অনলকে নিয়ে ভাবলেই তুমি শুধু কষ্ট পাবে। আগের কথা মনে পড়বে। আর অন্যদিকে, চিঠির মালিককে নিয়ে ভাবলে হয়তো অস্থিরতা বাড়বে। জানতে ইচ্ছে হবে কে সে! তবে কষ্ট তুমি পাবে না। তবে একটা কথাই বলব, যেকোন পদক্ষেপ নেওয়ার আগে নিজেকে সময় দেবে। ভাববে তারপর সিদ্ধান্ত নেবে।"
নিহি এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
"হুম!"
নিহি রেডি হয়ে কলেজে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে ঐ চিঠি দুটো উপমাকে দেখানোর জন্য। রিক্সায় বসেই উপমা চিঠি দুটো পড়েছে। তবে নিহি আর তমার মতো উপমাও বুঝতে সক্ষম হয়নি কে এই লোক? নিহি হতাশ মানুষটিকে চিনতে না পারার জন্য। উপমা বলে,
"আচ্ছা নিহি একটা কথা বল তো, এর আগে তুই কোনো চিঠি পেয়েছিস?"
"সে তো কত চিঠিই পেয়েছি স্কুল লাইফে। কিন্তু এরকম নামহীন উড়োচিঠি তো পাইনি।"
"এটা অনল নয় তো?"
"ধুর যা! কী বলিস?"
"ওমন করিস না বেদ্দপ! হতেও তো পারে। নয়তো তুই-ই বল, এতদিন কেন এই উড়োচিঠি আসেনি? যেই অনলের সঙ্গে তোর ঝামেলা শুরু হলো সেই তারপরই চিঠি আসা শুরু করল।"
"উপমা! অনলের সঙ্গে চিঠির কোনো সম্পর্ক কী করে থাকতে পারে? তার সঙ্গে আমার ঝামেলার কিন্তু অনেকদিন কেটে গেছে অলরেডি।"
"হতে পারে সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তোর সামনে দাঁড়ানোর মতো মুখ তার নেই। এজন্যই নামহীন চিঠি পাঠাচ্ছে। হতে পারে না এমন?"
নিহি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভেবে বলে,
"পারে। কিন্তু..."
"কোনো কিন্তু নয়। খবরদার এই চিঠি নিয়ে আর মাথা ঘামাবি না। তার ফাঁদে ভুলেও আর পা দিবি না। হতেই পারে তোর ঘুরে দাঁড়ানোটা তাকে পীড়া দিচ্ছে। এজন্য সে তোকে আবার ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। তুই কিন্তু তাকে কোনো সুযোগ দিবি না।"
"রিল্যাক্স! উপমা শান্ত হ।"
"চুপ কর। কীসের শান্ত হব? আমি তো পারলে তাকে খুন-ই করে ফেলি।"
"হয়েছে। খুন-খারাবি করতে হবে না। কলেজে এসে পড়েছি। রিক্সা থেকে নাম।"
উপমা রিক্সা থেকে নামতে নামতেও একই কথা বলছে। নিহি চিঠি দুটো ব্যাগে ভরে ভাড়া মিটিয়ে দেয়। দুজনে হাঁটছে একসঙ্গে। কথা হচ্ছে সেই চিঠির মালিককে নিয়ে। কলেজে যাওয়ার পথে অনলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এতক্ষণ চিঠি নিয়ে ভাবলেও অনলকে দেখে নিহির অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। যত যাই হোক, মনের এক কোণে এখনো অনলের জন্য সুপ্ত ভালোবাসা রয়েছে। যা কখনোই নিহি অনলকে বলতে পারবে না। শুধু অনলই বা বলছি কেন? অন্য কাউকে বলার সাহসও করে উঠতে পারবে না। এই সুপ্ত ভালোবাসা অনন্তজীবন আড়ালে-আবডালেই বোধ হয় থেকে যাবে। থাক! সব ভালোবাসা প্রকাশ করতে নেই। সবাই ভালোবাসার যোগ্য সম্মান দিতে পারে না। সবাই ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যও নয়। যেতে যেতে অনলের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় নিহির। দ্রুত নিহি অনলের থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। উপমার হাত ধরে জোরে জোরে পা চালিয়ে কলেজে চলে যায়। এভাবে আর থাকা যায় না। কবে সাতদিন পূরণ হবে? আর কবে মুক্তি পাবে নিহি এই যন্ত্রণা থেকে? আদৌ হবে তো মুক্তি?
_______________________
দু'দিন কেটে গেছে নিহি আর কোনো উড়োচিঠি পায়নি। এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথাও নেই নিহির। তাছাড়া নিহি এখন বরাবর-ই এসব থেকে দূরে থাকতে চায়। সব কল্পনা-জল্পনা জুড়ে শুধু পড়াশোনাকেই রাখতে চায়। বাবার মনে একটু হলেও যেন নিহির জন্য মায়া হয়। একটাবারের জন্য হলেও যেন বাবা ক্ষমা করে দেয়। সাতদিন পূরণ হতে আর মাত্র দু'দিন বাকি আছে। এরপরই অনলের মায়া থেকেও মুক্তি মিলে যাবে।চোখে দেখার মায়া-ই বড় মায়া। চোখের আড়াল হলেই মায়া ছায়ায় মিলিয়ে যায়। নিহিরও সময় এসে পড়েছে চোখে দেখার আড়াল হওয়ার।
আজ শুক্রবার। কলেজ বন্ধ। বাবা বাজারে যাবেন আজও। নিহি মাথা নত করে বলে,
"আব্বু আমিও যাব তোমার সঙ্গে।"
তিনি কোনো উত্তর দেননি। নিঃশব্দে একাই বাজারে চলে গেছেন। এটা আজ নতুন নয়। সেদিনের পর থেকে বাবা আর কখনোই নিহির সঙ্গে কথা বলেনি। নিহির কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়। তবুও নিহিকে সব মেনে নিতে হয়। না, না মেনে নয় বরং মানিয়ে নিতে হয়। নিহি ছাদে যায়। খালি পায়ে ঠান্ডা ফ্লোরে কিছুক্ষণ হাঁটে। ঠান্ডা লাগলেও ভালো লাগছে। গাছগুলোর পাতায় হাত ছুঁয়ে দেয়। হাতে লেগে যায় কয়েক ফোঁটা শিশিরের ছোঁয়া। নিহি ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়ায়। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটিকে দেখতে পায়। আজও গায়ে লাল সুয়েটার। মজার ব্যাপার হলো এই সুয়েটারের জন্যই নিহি ছেলেটাকে চিনতে পেরেছে। ছেলেটা নিহির রুমের ব্যলকোনির দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো নিহির দেখা পাওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছে। নিহি ছাদ থেকেই ছেলেটাকে ডাকে,
"এই।"
ছাদের দিকে তাকিয়ে ছেলেটা কপালে হাত দিয়ে কী যেন বলে। নিহি শুনতে পায় না কিন্তু বুঝতে পারে। হয়তো অপেক্ষার জন্য আক্ষেপ করেই কপালে হাত রেখেছে। তবে যাই হোক, আজ তো এই ইঁচড়েপাকা ছেলেকে ধরতেই হবে। এই উড়োচিঠির মালিক কে তা আজ জানবই জানব! আজই চিঠির চ্যাপ্টার ক্লোজ করব। ইট'স ফাইনাল!
নিহি দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নামে। দৌঁড়ে দৌঁড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে এসে দেখে ছেলেটা নেই। যাহ্, বাবা! এর মাঝেই চলে গেল? এসেছিল কেন তাহলে? নিহি মন খারাপ করে চলে যাওয়ার সময় মেইন দরজার সামনে একটা খাম দেখতে পায়। তখন দৌঁড় দেওয়ার কারণে একদম খেয়াল করেনি। উৎসুক হয়ে খাম থেকে চিঠি বের করে নিহি পড়তে শুরু করে,
"এলোকেশী,
তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাও আমি কে? আচ্ছা, জানার পর কী করবে তুমি? আজ বেশ কিছু বলব না। শুধু গানের কয়েকটা লাইন তোমায় বলতে চাই।
'যদি গো তোমায় বলি
আমি তার নাম;
তুমি কি বাসবে ভালো,
দেবে তার দাম?'
শুভ সকাল এলোকেশী।"
.
.
.
চলবে...................................