৩৭!!
-তোমাদের ভোরকে দেখা হয়ে গেছে বাবা? এখন উঠে বসে পাকা বুড়ির মতো কেমন বকবক করছে দেখছ তো? এখন কয়েকদিন আমার বকা আর ডাক্তারের দেয়া ওষুধ সময় মতো খেলেই দেখবে আগের মতো ছুটোছুটি করতে পারবে। তাই বলছিলাম কি তোমরা বাড়ি যাও সবাই। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে রেস্ট নাও। বিকেলে নাহয় আরেকবার এসো। তখন আমিও বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসবো।
রোদ বাইরে থেকে প্লেট ভর্তি খাবার নিয়ে এসে দেখলো সবাই ভোরকে ঘিরে বসে আছে। সবাই ভোরকে এটা ওটা প্রশ্ন করছে, ভোরের মা ভোরকে না খেয়ে পাগলামি করার জন্য বকছে, রোদের মা সেটা সামলানোর চেষ্টা করছেন। আর বেচারি ভোর সবার মাঝখানে লজ্জায় জড়সড় হয়ে মুখ নামিয়ে বসে আছে। হঠাৎ রোদের কথাটা শুনে সবার এতোক্ষণে খেয়াল হলো গত তিনদিন ধরে নামমাত্র খাওয়া ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এমন কি তিনদিন ধরে হাসপাতালটাকেই ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছিলেন উনারা সবাই। কিন্তু ভোরকে চোখের আড়াল করতে এখনও কারো মন সায় দিচ্ছে না। রোদ অবশ্য সবাই কি ভাবছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামালো না। সে চুপচাপ এগিয়ে এসে ভোরের সামনে চেয়ার টেনে বসে ভোরের মুখে খাবার তুলে দিতে শুরু করেছে। আতিক আহমেদ অবাক হয়ে দেখলেন ভোরও লক্ষী মেয়ের মতো টুকটুক করে খাবারটা খেয়ে নিচ্ছে। একটুও খাবো না বলে বায়না করছে না দেখে কিছুটা স্বস্তি হচ্ছে আজ উনারও।
-আরে বাবা! তোমাদের মেয়েকে কিছু করবো না আমি। ভয় নেই। ফিরে এসে বহাল তবিয়তে দেখতে পারবে মেয়েকে। সো সাবধানে যাও। রিল্যাক্স মুডে ফিরে এসো। ততক্ষণ আমি ওর সাথে আছি। আশা করি তোমরা ওর যেমন খেয়াল রেখেছ, তার চেয়ে ভালো খেয়াল রাখতে পারবো।
-বারবার একই খোঁচা দিয়ে দিয়ে তুই ক্লান্ত হচ্ছিস না রোদ? গত তিনটা দিন তো একই খোঁচা মেরে যাচ্ছিস। এসব কি ঠিক কথা?
-ঠিক বেঠিক আমার জানার দরকার নেই বাবা। ভোরকে তোমাদের ভরসায় রেখে যেতে আর কোনোদিন সাহস হবে কিনা জানি না। তবে আশা করি ভোরকে আমার থেকে দূর করার বা আমাকে ভোরের থেকে দূরে সরানোর বাজে বুদ্ধিটা তোমার মাথায় আর আসবে না।
-পাগল নাকি! তোমাদের দুই পাগলের মাঝখানে আবার আসার ইচ্ছে আমার নেই। ভোরের এইচএসসিটা শেষ হওয়ার পর তোমাদের যা ইচ্ছে হয় তোমরা করো। আমি আর আপত্তি করবো না।
-বাহ। এইতো এতোদিনে পথে এসেছ। এখন তোমরা বাড়িতে যাও বাবা। আমি আছি ভোরের কাছে।
-খবরদার মেয়েটাকে বকাবকি করবি না রোদ।
-বাবা! আচ্ছা বকবো না তোমার আদরের ভোরকে। বাট তোমাদের নিজেদের শরীরের কথাটাও একবার চিন্তা করো প্লিজ?
-ওকে ওকে যাচ্ছি। চলো সবাই। বিকেলে আবার আসবো।
বাসার সবাই বিদায় নিয়ে চলে যেতেই রোদ ভোরকে আবার চুপচাপ খাইয়ে দিতে শুরু করেছে। এর মধ্যে হঠাৎ কেউ একজন এসে বাঁধ সাধলো রোদের কাজে। ভোর মুখ তুলে দেখলো তখনকার সেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা ডাক্তার ছেলেটা ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভোর একটু বিরক্ত হয়ে কোনোমতে খাবার চিবিয়ে গিলায় মন দিলো। খেতে একদমই ইচ্ছে করছে না কথাটা বললে নির্ঘাত সকালের চেয়েও আরো জোরে চড় খেতে হবে। এর চেয়ে কষ্ট করে খাবারটা খেয়ে নেয়াই ভালো হবে মনে হচ্ছে ভোরের।
-আরে আপনি কি করছেন? জোর করে উনাকে কিছু খাওয়ানোর দরকার নেই। আর তাছাড়া তিনদিন ধরে স্যালাইন, গ্লুকোজ চলছে। উনার খিদে লাগবে না এতো তাড়াতাড়ি।
রোদ একবার ডাক্তার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত দৃষ্টিতে চোখ সরিয়ে আবার ভোরকে খাওয়ানোয় মন দিলো। ছেলেটা আরো কিসব বকবক করছে সেসব শোনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই রোদের। ছেলেটার উপরে এমনিতেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে রোদের। তাই চাইছে না কথা বাড়াতে গিয়ে অহেতুক উটকো কোনো ঝামেলা হোক। কিন্তু এই ছেলেটার হার মানবে বলে মনে হয় না।
-মিস্টার রোদ? আপনাকে বলছি। পেশেন্টকে জোর করে এভাবে খাবার গিলিয়ে দিবেন না। আ'ম হার ডক্টর। ইউ হ্যাভ টু লিসেন টু মি।
-দেখুন মিস্টার ডক্টর। আমি খুব ভালো করে জানি আমি কি করছি। আর ভোরের কিভাবে খেয়াল রাখতে হবে সেটা আমাকে আপনার কাছ থেকে শিখতে হবে না আশা করি। আপনার কাজ ছিল ভোরের সেন্স ফিরিয়ে আনা। আর আমার কাজ হলো ওর খেয়াল রাখা। আপনার কাজ শেষ, আমার কাজ এখন থেকে শুরু। তাই দয়া করে আপনার অন্য কোনো পেশেন্টের কাছে যান, ভোরকে নিয়ে আপনার আর না ভাবলেও চলবে।
-কিন্তু---মিস্টার রোদ?
-আপনার অন্য কোনো কাজ না থাকলে এবার আসতে পারেন। আমি ভোরকে টাইম মতো ওষুধ খাইয়ে দিবো।
ডাক্তার ছেলেটা মুখ কালো করে রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই রোদ আরেক লোকমা ভোরের মুখে তুলে দিলো। ভোর এতোক্ষণ ছেলেটার সামনে 'আর খাবো না' ছোট্ট কথাটা বলার সাহস করতে পারে নি। এবার ছেলেটা বিদায় হতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু রোদ আবার খাইয়ে দিতেই বেচারি আবার মুখ পানসে করে খাবার চিবাতে শুরু করলো। রোদ সেটা খেয়াল করে ভ্রু কুচঁকে ভোরের মুখের দিকে তাকালো এবারে।
-কি সমস্যা? এভাবে প্যাঁচার মতো মুখ করে বসে আছিস কেন?
-আর খাবো না তো।
-তা খাবি কেন? তোর ডাক্তার তো খেতে বারণই করে গেলো। এখন আর আমার হাতে খেতে তোর ভালো লাগবে কি করে?
-আমার একটুও খিদে নেই সত্যি।
-বুঝেছি। তোর আর কষ্ট করে খাওয়া লাগবে না। যা।
-রোদ? শোনো না? তুমিও তো খাও নি কিছু।
-খিদে নেই আমার।
ভোর কিছু বলার আগেই রোদ উঠে গেছে। কিছুক্ষণ পর রোদ প্লেটটা ধুয়ে রুমে এসে দেখলো ভোর আবার মুখটা কালো করে বসে আছে বেডের উপরে। রোদ প্লেটটা রেখে ভোরের সামনে এসে বসতেই ভোর বিরক্তিমাখা চাহনি দিয়ে আবার মুখ নামিয়ে নিলো। মেয়েটার হঠাৎ কি হলো রোদ বুঝতে পারলো না। অবশ্য একটু পরেই বুঝতে পারলো ডাক্তার ছেলেটা ওদের কেবিনের বাইরেই ঘুরঘুর করছে। আর ভোর সেটা দেখে রীতিমতো রাগে ফুঁসছে। রোদ এবারে একটু এগিয়ে এসে ভোরের গালে হাত ছুঁইয়ে দিলো। ভোর বিরক্ত হয়ে হাতটা সরিয়ে দিতে গিয়েও পারলো না।
-কি হয়েছে ম্যাডাম ভোর? এমন করছেন কেন আজকে? আমার স্পর্শটা আর ভালো লাগছে না বুঝি?
-না লাগছে না। ছাড়ো।
-ওমা! সে কি? অবশ্য এখন তো জায়গায় জায়গায় আপনার দু একজন ফ্যান হয়ে গেছে। আমাকে আর ভালো লাগবে কেন?
-একদম বাজে কথা বলবা না বলে দিলাম। আগে কেউ আমার দিকে একবারের বেশি দুবার তাকালেও তুমি তাকে পিটিয়ে সোজা করে দিতে। আর এখন? তুমি খুব খারাপ হয়ে গেছ রোদ। খুব খুব খারাপ। আমাকে আর আগের মতো-----।
-হুম হুম? আগের মতো কি ম্যাডাম? সেন্টেন্সটা কমপ্লিট করুন প্লিজ?
-কি কমপ্লিট করবো? ওই ছেলে সেই কখন থেকে ঘুরঘুর করছে। একটু আগেই এসে বলে গেল, তার নাম সাদমান হাকিম। কোনো কিছুর দরকার হলে যেন তাকে বলি। বলি কেন রে? আমার কি কেউ নেই নাকি খেয়াল রাখার জন্য? অবশ্য ঠিকই তো--কে আছে আমার? আগে হলে এতোক্ষণে এই ছেলে আর আমার দিকে তাকানোর সাহস পেতো? আআআআ।
-ওরে সোনাপাখি। তুই কি চাস বল তো? তোর ওই পাংখা ডাক্তার তোর দিকে আর না তাকাক? তাই তো?
-হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। তাকাবে কেন ও আমার দিকে? আমাকে দেখার লোকের কি অভাব পড়েছে নাকি?
-ওহ্হো! ওকে। একটু এদিকে তাকা তো? আমার কথাটা শোন।
-তোমার দিকে তাকিয়ে কি হবে? ওই বদ ছেলে আবার তাকিয়ে আছে হ্যাবলার মতো। একটুও লজ্জাশরম নেই নাকি---?
ভোরের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই রোদ এগিয়ে এসে ভোরের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। রোদের হুট করে এমন কাজে বেচারি লজ্জা পেয়ে চোখ বুজে নিয়েছে। এবারে রোদ ভোরের কাছ থেকে একটু সরে এসে ভোরের লজ্জারাঙা মুখটা একনজর দেখে আলতো করে আরেকবার ভোরের ঠোঁটে আদরের পরশ বুলিয়ে নিলো। ভোর শক্ত করে রোদের হাত আঁকড়ে ধরে লজ্জায় লাল নীল হয়ে গেল আরেকবার।
-তোর হাকিম সাহেবের লজ্জা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকলে এই জীবনে আর তোর দিকে তাকাবে না। এবার খুশি ম্যাডাম?
-যাও। তুমি খুব খারাপ। হসপিটালের মধ্যে কি শুরু করলে?
-বাহ! তোকে ভালোবাসার অধিকার যদি বাড়িতে থেকে থাকে, তাহলে হসপিটালেও আছে। তোকে আদর করে ছুঁয়ে দেয়ার জন্য হসপিটাল বা রাস্তা সেটা আলাদা করে দেখতে হবে নাকি আমার?
-তুমি একটা খুব খারাপ রোদ।
-আর তুই আমার লক্ষী ভোরপাখি।
দেখতে দেখতে সপ্তাখানেক কেটে গেল। রোদের অক্লান্ত চেষ্টায় ভোর পুরোপুরি সুস্থও হয়ে উঠলো। ভোরকে সুস্থ করে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার পর নতুন করে ভোরের পরীক্ষার জন্য তোড়জোড় শুরু হলো রোদের। ভোরকে সকাল বেলা ঘুম থেকে তুলে দেয়া থেকে রাতে ভোরের ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত সবটাই সামলাচ্ছে রোদ। অত্যন্ত স্নেহে সে তার ভোরপাখিটাকে আগলে রাখলেও মাথায় চলছে হাজারটা প্ল্যান। সবগুলো প্ল্যানের উদ্দেশ্যই হলো ভোরকে ছোট বড় কোনো শাস্তি দেয়া। মেয়েটার কপালে কি যে আছে কে জানে!
৩৮!!
আজ ভোরের পরীক্ষার শেষদিন। রিটেন পরীক্ষা আগেই শেষ হয়েছে। গত কয়টা দিন প্রাকটিক্যাল ছিল। আজই শেষ দিন। পরীক্ষা শেষ, তাই প্রচন্ড আনন্দ হচ্ছে ভোরের। আনন্দ হওয়ার আরেকটা কারণ রোদ আমস্টারডামে যাবে না। বড়আব্বু শেষমেশ রাজি হয়েছে রোদের দেশের থাকার ব্যাপারে। এইযে এতোদিন ধরে রোদ ওকে নিয়ে পরীক্ষার হলে এসেছে, খাইয়ে দিয়েছে, ভোরের পড়ার সময়টায় ভোরের পাশেই বসে ছিল রাত জেগে-কেউ কোনো বাধা দেয় নি তাতে। এমনকি বড়আব্বুও না। বাড়ি ফেরার সময় গাড়িতে রোদের পাশের সিটে বসে কথাগুলো ভাবতে অন্যরকম একটা আনন্দ হচ্ছে ভোরের। পরীক্ষা শেষ হওয়ার চেয়েও, পরীক্ষার পরে রোদের সাথে ঘুরতে যাবে সেটা নিয়েই হাজারটা প্ল্যান চলছে মেয়েটার মাথায়। এদিকে ভোরের পাশে বসে একমনে গাড়ি চালানোয় ব্যস্ত রোদ। ভোর যে ওর পাশে বসে আছে সেটাও ছেলেটার খেয়াল আছে কিনা সন্দেহ হচ্ছে ভোরের। ভোর এবারে নিজের প্ল্যানিংগুলোকে আপাতত কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে রোদের একটা হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে ডাকলো। রোদ একবার ভোরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে আবার গাড়ি চালানোয় মন দিলো। ভোর এবারে রোদের শার্টের একটা কোণা খামচে ধরলো।
-এই? তুমি কথা বলো না কেন আমার সাথে? হুম হুম? কি সমস্যা কি তোমার?
-আপনিও তো কিছু বলছেন না ম্যাডাম। কি বলবো বলুন?
-এটা কেমন ধরনের কথা? এতো তাড়াতাড়ি সব কথা ফুরিয়ে গেছে? এখন আর বলার মতো কথাও খুঁজে পাচ্ছ না তুমি তাই না?
-একা একা আর কতদিন আমি বলবো? আজ নাহয় তুই বল। আমি শুনি।
-তোমাকে শুনতেও হবে না, কিছু বলতেও হবে না। যাও।
-হঠাৎ এতো রাগের ঝুলি নিয়ে বসলি কেন ভোরপাখি? আমি কি তোর রাগ করার মতো কিছু বলেছি?
-তা বলবেন কেন? আপনি তো আমার সাথে কথা বলার মতোই কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। কয়দিন পর হয়তো বলবেন আমাকে চিনতেও পারছেন না।
-তুই আজকাল এতো ঝগড়ুটে হয়ে যাচ্ছিস বল তো ভোর? কথায় কথায় খালি ঝগড়া শুরু করে দিস আমার সাথে! কিছু বলছি না বলে কি সাহস বেড়েছে তোর?
-আমি ঝগড়া করছি তোমার সাথে? তুমি এই কথাটা বলতে পারলে রোদ?
-তুই ঝগড়া করতে পারবি, আর আমি বলতে পারবো না? অদ্ভুত!
-বেশ করেছি ঝগড়া করেছি। একশ বার ঝগড়া করবো, হাজার বার ঝগড়া করবো। আমি আমার রোদের সাথে ঝগড়া করি, তাতে তোমার কি হ্যাঁ?
ভোরের কথায় রোদ হঠাৎ করেই গাড়িটা ব্রেক করলো। রোদের এমন কাজে ভোর বেচারি পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়ে থতমত খেয়ে রোদের দিকে তাকালো। রোদ এবার ভ্রু কুঁচকে ভোরের দিকে তাকালো।
-কি বললি তুই? আরেকবার বল তো শুনি?
-কোথায় কি বলেছি? এক কথা বার বার বলি না আমি। হুহ।
-বলবি? নাকি এখানেই তোকে রেখে চলে যাবো?
-ইশ! যাও দেখি। তুমি আমাকে ফেলে কি করে যাও আমিও দেখি একটু।
রোদ ভোরকে নিজের দিকে একটু টেনে নিয়ে নাকে নাক ঘষলো।
-তোকে ফেলে যাবো না এটা ভেবে এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। যা অন্যায় করেছিস তার শাস্তি তো তোকে ভোগ করতেই হবে ভোরপাখি। আর যে শাস্তিই হোক, সেটা তো তুই আগেভাগেই মাথা পেতে নিবি বলেছিলি। সে কথাটা আবার ভুলে যাস না, ওকে?
-কি করছ? সবাই দেখবে তো?
-দেখুক। আমার বউ আজ প্রথমবার আমাকে তার বলে দাবি করেছে। আমার তো সারা পৃথিবীকে চিৎকার করে জানাতে ইচ্ছে করছে কথাটা।
-কি জানাবেন জনাব?
-এই যে আমি এখন বউয়ের আপনের তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছি।
-আগে বুঝি আপনের লিস্টে নাম ছিল না?
-বউ তো স্বীকার করে নি। কি করে বুঝবো ছিল কি ছিল না?
-মুখে না বললে বুঝি জানা যায় না?
-উঁহু।
-সরো তো। না বললে যারা বুঝে না, তাদের সাথে কথা নেই।
-তাহলে তো তোর সাথেই আমার কথা বলা বন্ধ করে দেয়া উচিত ছিল বহু আগেই। কি করা যায় বল তো? দুজনেই মৌনব্রত পালন করে কাটাবো নাকি বাকিটা জীবন?
-তুমি কি করবে সেটা তো আমি জানি না। কিন্তু আমি এখন হাওয়াই মিঠাই খাবো। এনে দাও?
-হুম? কি?!
-দুটো হাওয়াই মিঠাই এনে দাও না রোদ? ওই দেখো? রাস্তার ধারে বিক্রি করছে। একটা সাদা কালারের আনবা, আরেকটা পিংক কালারের। আরো অনেকগুলো কালার পাওয়া যায় না কেন এগুলো? কি হলো? এনে দাও না?
-তোর কি ধারণা আমি এখন তোকে ফুটপাত থেকে এসব অখাদ্যগুলো কিনে দিবো? পাগলা কুকুরে কামড়েছে আমাকে?
-ওমা! হাওয়াই মিঠাই খেতে গেলে কুকুরে কামড়াতে হয় জানতাম না তো! এই রোদ? দাও না এনে? এরপর আমার ফুচকাও খেতে হবে তো? তারপর অনেকগুলো চকলেট কিনে দিবা, চিপস কিনে দিবা---। আর------।
-আমি যখনই ভাবি তুই একটু ম্যাচিউর হচ্ছিস, তখনই তোর উপরে কোথা থেকে আবার বাচ্চামেয়ের ভূত এসে ভর করে বল তো?
-ওমা! ভূত! আমাকে ভূতে ধরেছে? কি বলছ?
-নয়তো কি? এসব রাস্তার খাবার খেয়ে শরীর খারাপ হবে না ফাজিল মেয়ে? আবার হসপিটালে তোর হাকিমবাবুর কাছে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে নাকি খুব?
-ওমা! হসপিটালে যাবো কেন? আর শরীর খারাপ হলেও কিচ্ছু হবে না তো। এক্সাম শেষ তো----।
-আর একটা কথা বলবি তো ঠাস করে একটা থাপ্পড় লাগাবো বলে দিলাম ভোর। চুপ করে বসে থাক। এসব পচা জিনিস আমি আপনাকে কিনে দিচ্ছি না ম্যাডাম। সো বায়না করেও কোনো লাভ হবে না। আর এক্সাম শেষ বলে যা ইচ্ছে খেয়ে, যেমন ইচ্ছে চলে আপনি শরীর খারাপ করবেন আর আমি সেসব হা করে চেয়ে চেয়ে দেখবো সেটা ভেবেছিস নাকি?
-না না না। আমি এত্তো কিছু জানি না। আমাকে কিনে দিতেই হবে। আচ্ছা শুধু হাওয়াই মিঠাই আর চকলেট। আর কিচ্ছু লাগবে না। প্রমিস।
-আরেকবার বাচ্চাদের মতো বায়না করলে গাড়ি থেকে সত্যি সত্যি নামিয়ে দিবো বলে দিলাম ভোর। তারপর বাসায় ফিরবি কি করে সেটা তুই ঠিক করিস। দিবো নামিয়ে? নাকি চুপচাপ আমার সাথে বাসায় ফিরবি? কোনটা?
রোদের ধমক শুনে এবারে বেচারি ভয় পেয়ে চুপসে গেল। আর কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো। রোদ একবার ভোরের দিকে তাকিয়ে আবার ড্রাইভিং এ মন দিল। বাসায় ফিরেও রোদের সাথে একটা কথাও বললো না ভোর। রোদও একবারও ভোরের রাগ ভাঙ্গাতে এলো না দেখে প্রচন্ড অভিমান হলো ভোরের। সবার সাথে এটা ওটা কথা বলে সারাটা দিন কাটিয়েছে ভোর। রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়েছে। রোদ কিছু না বলেই বেরিয়ে গেছে সেই সন্ধ্যেবেলা। রাত কয়টা বাজে কে জানে। ভোরের কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেল গালে আলতো করে কারো উষ্ণ ছোঁয়া লেগে। ঘুম ভাঙ্গলেও ইচ্ছে করেই চোখ মেললো না ভোর। সারাদিন একবার কথা না বলে এখন মাঝরাতে চুপিচুপি ডাকতে এলে কথা বলবে কেন? ভোর কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই গলায় রোদের ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করে একবার কেঁপে উঠলো ভোর। নিজের সমস্ত ইচ্ছেশক্তি দিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করেও কতোটা সফল হচ্ছে বলা মুশকিল।
-ঘুমের ভান করে যত পড়ে থাকবি, ততই গভীর হবে স্পর্শগুলো। যত পালানোর চেষ্টা করবি, ততই শক্ত করে আঁকড়ে নিবো। এখন আর নাটক না করে আয় আমার সাথে। কিছুক্ষণ ছাদে গিয়ে বসি চল?
ভোর এবারও জবাব দিলো না দেখে রোদ আর কিছু না বলে ভোরকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো। ভোর এটা একদমই আশা করে নি। ভেবেছিল ও ঘুমিয়ে আছে ভেবে রোদ চলে যাবে। এখন উল্টো রোদ ওকে কোলে নিয়েই ছাদের দিকে রওনা হয়েছে দেখে ভোর অভিমান করে হাত পা ছুঁড়ে রোদের কোল থেকে নামার চেষ্টা করলো। একটু পরে ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ থেমেও যেতে হলো বেচারিকে।
-ম্যাডামের নাচানাচি করা কি শেষ হয়েছে? নাকি আরো কয়েক মিনিট প্রাকট্রিস করবেন? ওয়ান্ট সাম হেল্প?
-ছাড়ো বলছি আমাকে। নামাও আমাকে নামাও? আমি যাবো না কোথাও।
-তোকে যেতে কে বলেছে? আমিই নিয়ে যাচ্ছি দেখতে পাচ্ছিস না? অবশ্য ঘুমের ঘোরে আর রাগের চোটে তুই মাঝেমাঝে পাগল হয়ে যাস। তখন কিসব বলিস তুই নিজেও জানিস না। সো তোর সব কথা তত পাত্তা না দিলেও চলবে।
-কি বললে তুমি? আমি পাগল হয়ে যাই?
-নয়তো কি? একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে এতোক্ষণ কেউ রাগ করে বসে থাকে?
-রাগ করবো না কেন? হ্যাঁ? তুমি কত্তোগুলো বকেছ আমাকে? তার উপরে একবারও রাগ ভাঙিয়েছ? একবারও কথা বলেছ? আমার চকলেটও দাও নি। হুহ। কথা বলবো না আমি তোমার সাথে একদম।
-ওলে বাবা লে। কি রাগ মেয়েটার! কিন্তু পিচ্চি? রাগ করে উপোশ করে থাকা কি ভালো কাজ বল তো? তোকে না বারণ করেছি না খেয়ে------।
-এতোদিন আমি নিজের হাতে খেয়েছি হ্যাঁ? আজ খাবো কেন? জানো না আমাকে খাইয়ে দিতে হয়?
-এন্ড ম্যাডাম ভোর আবার ছেলেমানুষি শুরু করে দিলেন।
-তোমার সাথে আমি আর একটা কথাও বলবো না দেখে নিও। এখন নামাও আমাকে। আমি থাকবোই না তোমার সাথে।
রোদ আর কিছু না বলে ভোরকে নিয়ে সোজা ছাদে চলে এলো। এবারে ভোর একটু অবাকই হলো। আগেরবারের মতো এবারেও ছাদে বেডিং পাতা আছে। বেডিংয়ের উপরে লাল কাপড় দিয়ে কিছু ঢেকে রাখা আছে মনে হচ্ছে। কাপড়ে ঢাকা কি থাকতে পারে কথাটা ভাবার ফাঁকেই রোদ ভোরকে বেডিংটার উপরে নামিয়ে দিলো। ভোর ভ্রু কুঁচকে আছে দেখে রোদ ভোরের মুখটা দুহাতে তুলে ধরলো।
-তখন তোকে বকেছি বলে খুব রাগ করে আছিস না রে ভোরপাখি? তুই বল এতো জেদ করা কি ঠিক? রাস্তার ধারের ওসব খাবার খেয়ে যদি শরীর খারাপ হয় তখন?
-তো আমার হাওয়াই মিঠাই কিনে দিলে না কেন? আর চকলেট?
-চকলেট তো তোকে আমি এমনিতেই কিনে দিই, কি দিই না বল?
-দাও তো।
-আর হাওয়াই মিঠাইয়ের কথা বলছিস? তুই রাস্তায় দাঁড়িয়ে সবার সামনে হাওয়াই মিঠাই খাবি, সবাই হা করে সেটা দেখবে? আমি সহ্য করতাম কি করে সেটা তুইই বল?
-আমি বাসায় এসে খেতাম। একে তো কিনে দাও নি, তার উপরে কত্তোগুলো বকা দিয়েছ। আর এখন এসেছ কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে দিয়ে সাফাই গাইতে? মানি না আমি। আমার হাওয়াই মিঠাই চাই চাই চাই।
-ওকে।
-ওকে বললে হবে না। চাই মানে এক্ষুণি চাই আমার হাওয়াই মিঠাই।
-জো হুকুম মহারাণী।
-কি! তুমি হাওয়াই মিঠাই পাবা কোথায় এতোরাতে?
-তুই আমার কাছে কিছু চাইলি আর আমি দিবো না তা কি হয় বল? আজ তুই যদি বলতি, রোদ আমি আকাশের ওই চাঁদ চাই, আমি সেটাও তোর জন্য এনে দিতাম।
-কি?
-ওয়েট।
রোদ ঝুঁকে বেডিংয়ের উপরের লাল কাপড়টা সরাতেই ভোরের চোখ কপালে উঠলো। একেকটা ট্রে তে একেকটা জিনিস সাজানো। ভোরের জেদ করা হাওয়াই মিঠাই। একেকটা একেক রঙের। একটা ট্রে ভর্তি ছোটো বড় অনেকগুলো চকলেট। আরেকটা ট্রেতে ফুচকা সাজানো, আরেকটা ট্রে তে পেস্ট্রি। ভোর হা করে একবার ট্রেগুলো দেখছে, আরেকবার রোদকে। বেচারির এটা বুঝতে সমস্যা হচ্ছে এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব। ভোরের ঘোর কাটলো রোদ এগিয়ে এসে ভোরের ঘাড়ে হালকা করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়ায়।
-আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ফুচকা আর হাওয়াই মিঠাইগুলো বানিয়ে আনলাম। আর তোর পছন্দের যত চকলেট আছে সব খুঁজে খুঁজে আনতেই দেরি হয়ে গেল এতোটা। সরি রে পাখিটা।
রোদের কথাগুলো ভোরের কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে কিনা কে জানে। ভোরের শুধু মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে ওর চেয়ে বেশি সুখি বুঝি আর কেউ নেই, কেউ কখনো ছিলও না।