০৭!!
-নিহার? জানি আর কারো কাছে জীবনে অপরাধী হই বা না হই, তোমার কাছে আমি আজীবনের অপরাধী। গত ছয়টা বছরে কত শত অভিমান, অভিযোগ জমিয়ে রেখেছ সেটাও জানি। আজ হুট করে সবটা মিটিয়ে নিতে চাইলে কি তুমি হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এক পা এগিয়ে আসবে না নিহার? অতীতের সমস্ত তিক্ত ইতিহাস ভুলে তোমার কোলে মুখ ডুবিয়ে যদি একটু শান্তির আশ্রয় খুঁজে নিতে চাই, তাহলে কি তুমিও আমাকে ফিরিয়ে দিবে? নাকি আমার সমস্ত অন্যায়গুলো, তোমার প্রতি করা অবিচারগুলো পথ আগলে দাঁড়াবে তোমারও? কাউকে ভালোবেসে ঠকেছি তো, ভালোবাসতে হয়তো আর পারবো না কখনো। বন্ধু হয়ে, সহযাত্রী হয়ে পাশে থাকতে দিবে প্লিজ? নাকি অভিমান করে তুমিও দূরে সরে যাবে আমার থেকে? যেমনটা বাকিরা করে সবসময়?
বেশ অনেক রাত পর্যন্ত নীলার রুমে থেকে মেয়েটাকে খাইয়ে দাইয়ে ওষুধ খাইয়ে নিজের রুমে এসে বিছানাটা ঝাড়ায় মন দিয়েছে নিহার। সারাদিনই বলতে গেলে নীলার রুমেই ছিল। সকালের অগোছালো বিছানাটা তাই আবরার যাওয়ার পর থেকেই একইভাবে পড়ে আছে। লোকটা কত রাতে আবার এসে বিছানার এই অবস্থার মধ্যে ঘুমাবে কি করে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই একমনে বিছানা ঝেড়ে বালিশগুলো ঠিক করায় মন দিতেই পিছন থেকে কথাগুলো শুনে চমকে তাকিয়েই আবরারকে দেখে অবাক হলো। অবাক না শুধু, বলা চলে স্তব্ধ বিস্ময়েই তাকিয়ে রইলো নিহার আবরারের মুখের দিকে। ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা বাজতে চললো প্রায়। এই সময়ে আবরার কখনোই আসে না। বাড়িতে থাক বা না থাক ভোর হওয়ার আগে রুমের ধারেকাছেও আবরারকে গত ছয় বছরে ঘেঁষতে দেখে নি নিহার। সেটা ওদের বিয়ের প্রথম রাতের কথাই বলুক, বা গতকাল রাতের। তাহলে আজ এই মূহুর্তে লোকটা ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে কি করে? আর কিসব বলছে? নিহার যা শুনছে সত্যিই শুনছে তো? নাকি লোকটাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাচ্ছে নিহার! চাওয়া পাওয়ার বিশাল ব্যবধানে কি নতুন কোনো কল্প কাহিনী গড়ছে ওর উত্তপ্ত বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক?! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আবরারকে ওর পাশে বিছানায় বসতে দেখে নিহার প্রায় লাফিয়ে সরে এলো। স্বপ্ন দেখলেও এমন সাংঘাতিক স্বপ্ন সহ্য করার মতো ক্ষমতা নিহারের নেই। কল্পনার ফাঁকে ভুল করেও যদি আবরার চলে আসে তাহলে এর পরিণাম কি হবে সেটা ভাবার দুঃসাহসও নিহারের নেই। অবশ্য নিহার চমকে সরে আসার চেষ্টা করেও বেশিদূরে যেতে পারলো না। আবরার হাত বাড়িয়ে নিহারের একটা হাত চেপে ধরতেই নিহার থমকে দাঁড়িয়ে আবরারের দিকেই তাকিয়ে রইলো। কল্পনা আর বাস্তবতা সব মিলে মিশে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে গেছে বেচারির মাথার মধ্যে। তবু যেন আবরারের স্পর্শগুলো অন্য কথা বলে যাচ্ছে নিহারের কানে ফিসফিস করে। কারো হৃদয় চেড়া শব্দগুলো বড্ড বেশিই ভালো লাগছে নিহারের। সাথে একটু ভয়ও হচ্ছে। ঘোরটা কেটে যেতেই যদি স্বপ্নগুলোও হারিয়ে যায়?
-বড্ড বেশিই দেরি হয়ে গেছে না নিহার? ঠিকই তো! আর কতদিনই বা তুমি অপেক্ষার প্রহর গুনবে? কেনইবা গুনবে? কেনই বা অপেক্ষা করবে? তুমি তো চেষ্টা করেছিলে নিজের মতো করে। আমিই তখন তোমাকে সুযোগ দিই নি। আজ নিজে কি করে ক্ষমা পাবো আশা করছি? জীবনসঙ্গী হয়ে থাকা তো দূর, বন্ধু হয়ে কেউ পাশে থাকবে তার যোগ্যও তো আমি নই। নো প্রবলেম নিহার। অযথা মিছেমিছির এই সম্পর্কে তোমাকে আটকে রাখবো না আর। তুমি চাইলে------।
-তুমি কি সত্যি এসেছ আবরার? নাকি নতুন করে স্বপ্নে তোমাকে কল্পনা করার রোগে ধরেছে আমাকে? কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করলে হ্যালুসিনেশন নয়, সেরকম কিছু নয় তো?
এতো টেনশনের মধ্যেও নিহারের প্রশ্ন শুনে আবরার হেসে ফেললো। নিহার অবাক চোখে আবরারের দিকে তাকিয়ে থেকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে আবরারের পাশেই বসে আবরারকে ছুঁয়ে দেখলো।লোকটা সত্যিই এসেছে কিনা। আবরার থতমত খেয়ে হাসি থামিয়ে নিহারের হাতটা ছুঁয়ে দিলো।
-আমি সত্যিই এসেছি নিহার। স্বপ্ন না। বড্ড বেশি দেরি করে ফেলেছি হয়তো। তবু এসেছি। তোমার আশ্রয়েই এসেছি। ফিরিয়ে দিও না প্লিজ?
-কত বছরের প্রতীক্ষার পরে তুমি আসলে। আবার চলেও যেতে বলছ? এতোগুলো দিন অপেক্ষা করেছিলাম কি তোমার 'না চাইলে চলে যেতে পারো' শোনার জন্য? খুব স্বার্থপর তুমি বুঝলে? এতোগুলো দিন আমি তোমার পথ চেয়ে অপেক্ষা করেছি, আর দু মিনিট তোমার কথার জবাব দিলাম না বলে তুমি চলে যেতে বলতে পারলে?
-সরি নিহার? সরি? এই দেখো? কান ধরছি তো? সরি না প্লিজ?
নিহার একটু ভাব নিয়েই ঠোঁট বাঁকিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আবরার নিহার হাত টেনে ধরে নিজের কাছে এনে চোখে চোখ রাখলো। নিহার একটু চমকে উঠে আবরারের দিকে তাকাতেই আবরারের জিজ্ঞাসু চোখের দৃষ্টিতে বন্দী হয়ে গেল নিহারের চোখ জোড়া। আবরার আলতো হাতে নিহারের গালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিতেই নিহার কেঁপে উঠে আবরারের হাতটা ধরে ফেললো।
-সত্যি নিহার শেষবারের মতো একটা সুযোগ দাও? এতোগুলো বছরের ভুলগুলো শুধরে নিতে চাই আমি। তার জন্য কি শাস্তি দিবে, তাও মাথা পেতে নিতে রাজি আমি। শুধু দিনশেষে সমস্ত ক্লান্তিগুলো ভুলে তোমার কোলে মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমাতে চাই একটু। কত বছর একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারি না আমি জানো? প্রতিটা মূহুর্তে মনে হয় এর চেয়ে বুঝি মরে গেলেই কষ্টটা কম হতো আমার----।
-ছি! কিসব বলো? আমার মাঝে আশ্রয় খুঁজতে এসেছ? নাকি এসব আজেবাজে গল্প শোনাতে এসেছ রাতদুপুরে? যত্তসব! সরো তো? ঘুম আসছে আমার। তোমার এসব মাঝরাতের বকবক শোনার ইচ্ছে আমার নেই। মরে যাওয়ার ইচ্ছে এতোই যখন তাহলে আবার তোমার সঙ্গী বোতল আর গ্লাস নিয়ে বাগানেই চলে যাও না? আমাকে শোনাতে এসেছ কেন?
নিহার বিরক্ত হয়ে আবার সরে আসার জন্য ছটফট করছে দেখে আবরার নিহারের কোমড় জড়িয়ে আটকালো নিহারকে। মেয়েটা রাগ করে সরে যাওয়ার যত চেষ্টা করছে, আবরারও ততই নিবিড় করে নিহারকে নিজের সাথে বেঁধে নিচ্ছে। নিহার এবারে চোখ পিটপিট করে আবরারের দিকে তাকালো।
-কি সমস্যা তোমার? ঘুম আসছে বললাম না? তোমার মতো এতো রাত জাগার আমার অভ্যেস নেই বুঝলে? সরো এখন। নীলা কি করছে দেখে আসি। মেয়েটা কি করছে কে জানে-----।
-তুমি নিজেই এতো বকবক করে পালাতে চাইছ কেন বলো তো নিহার? আমি তো জাস্ট তোমাকে একটা প্রশ্নই করলাম। সেটার উত্তরটা দিয়ে তারপর যাও? আর তোমার রাত জাগার অভ্যেস আছে কি নেই সেটা গত ছ'সাত বছরে আমার ভালোই জানা হয়ে গেছে। নতুন করে আরো অনেক কিছু জানার আছে অবশ্য। বাট সেটা তোমার আনসারের উপরে নির্ভর করবে।
-এখনও যদি তুমি নিজের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে থাকো তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই।
-কি আনসার দিলে তুমি?! তোমার মাঝে হারাতে চাইছি শোনার পর তো তাড়িয়েই দিচ্ছ বারবার। এর জন্যই বলে খুব করে যেটা পাওয়ার লোভ হবে, তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে নেই। তখন আর তোমার নিজেরই দাম থাকবে না। হুহ।
-একদম ঠিকই বলেছ। খুব করে তোমাকে চাই বলেই এতো দূরে ঠেলে দাও। এখনও ধরা দিতে চেয়েও তোমার তাড়িয়ে দেয়ার কথাটাই আগে মনে পড়ছে।
-আরে?! নিহার?
কথাগুলো বলতে বলতে নিহারের চোখের কোণ বেয়ে কয়েক ফোঁটা কান্নার জল গড়িয়ে পড়তেই আবরার ব্যস্ত হাতে নিহারের মুখটা দু হাতে আলতো করে তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো।
-তোমাদের মেয়েদের চোখে এতো পানি কি করে আসে আমি বুঝি না বাবা। কিছু একটা বলা হয়েছে কি হয়নি ওমনি সাগর নদী সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আরে বাবা! কান্নাটা থামাও না এবার? এবার তুমি নিজেই ক্লিয়ার করে বলো কি চাও? তুমি যা চাও তাই হবে এবার থেকে। হ্যাপি?
-আমি সবসময়ই শুধু তোমাকেই চেয়ে এসেছি আবরার। যেদিন প্রথমবার তোমার বাবা আমাদের বাসায় তোমার আমার সম্বন্ধটা নিয়ে কথা বলতে এসেছিল, সেদিন প্রথমবার তোমার ছবি দেখে তোমাকেই চেয়েছি। প্রায় সব আয়োজন করার ফাঁকে তুমি যেদিন জানিয়ে দিলে তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো সেদিনও শুধু তোমাকেই চেয়েছিলাম। বাবার বন্ধুর ছেলে হওয়ার সুবাদে তোমার বিয়ের দাওয়াত পেয়ে যেদিন বুকে পাথর রেখে তোমার বরযাত্রী হতে গিয়ে ভাগ্যের ফেরে বউ হয়ে ফিরেছি সেদিনও শুধু তোমাকেই চেয়েছি। বিয়ের পর প্রথম রাতেই তুমি যখন সারারাত একবারের জন্যও রুমে এলে না তখনও শুধু তোমাকেই চেয়েছি। গত ছ'সাতটা বছরে নীল, বাবা, এই সংসার, সব কিছুর মাঝে শুধু তোমার অস্তিত্বটাকেই খুঁজে গেছি। বারবার সেই অস্তিত্বে তোমাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েও হারিয়ে ফেলেছি। তবুও আমার সমস্ত অস্তিত্বে তুমিই মিশে আছো সবসময়।
-সুযোগ পেলেই খোঁটা মারতে হবেই হবে তাই না ম্যাডাম? আপাতত খোঁচা না পেরে নিজের মতামত দিয়ে ফেলুন?
-আপনাকে চাই বুঝলেন? আমার সকাল, বিকেল, সন্ধ্যে, রাতে-প্রতি মূহুর্তে আপনাকে চাই। এতোগুলো বছর যে দূরে দূরে থেকেছেন তার প্রতিটা মূহুর্ত আমি জলদী জলদী পুষিয়ে নিতে চাই। একটা সেকেন্ডও ছাড় দিবো না এবারে। আপনি তাড়িয়ে দিতে চাইলেও যাবো না।
-এটা কি হলো? বন্ধুত্বের অফার দিলাম, ম্যাডাম তো দেখি ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিট অপশনটা বেছে নিয়েছেন। ব্যাপারটা কেমন হলো?
-উমমম। ব্যাপারটা যেমনই হোক, আমার অস্তিত্বে যে মানুষটা মিশে আছে, তাকে নিজের করে চাই। এবার আপনি নিজের মতামত দিন। লেটস বি ফ্রেন্ডস?
-ফ্রেন্ডশিপ উইথ বেনিফিট!?
আবরারের ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নটা শুনেই নিহার এবারে খিলখিল করে হেসে ফেললো। এতোগুলো বছরে এই প্রথমবার মেয়েটাকে এভাবে হাসতে দেখে আবরারের ঠোঁটের কোণেও হাসির রেখা ফুটে উঠলো। যে মানুষটা এতোগুলো বছর ওর জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে তার থেকে নিজেকে আর কতই বা আড়াল করে রাখবে আবরার? নাকি এমন দূরত্বটা আধো উচিত ওদের মাঝে?
অন্যদিকে, খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিহার ওষুধ খাইয়ে দেয়ার চুপচাপ শুয়ে রইলো নীলা। পায়ের ব্যথাটা আগের চেয়ে কিছুটা কম। শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমে চোখ বুজে আসতে শুরু করেছে নীলার। আধো ঘুম, আধো জাগরণের মাঝেও গত রাতের অনুভূতিটা আবার যেন স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে নীলার। সেই একই স্পর্শ, একই ঘ্রাণ, একই অনুভূতি। শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে স্বপ্ন না বাস্তব সেটা দেখারই শক্তি পাচ্ছে না মেয়েটা। ঘুমের ওষুধের কার্যকারিতার রেশ কাটিয়ে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়েই শেষে চোখ মেলে তাকাতে সফল হলো মেয়েটা। চোখ মেলেই এতো বড় একটা সারপ্রাইজ পাবে মেয়েটা আশাও করে নি। আধো আলো আধো আঁধারিতে কারো উপস্থিতি টের পাচ্ছে মেয়েটা। কিন্তু মানুষটা যে কে সেটাই খেয়াল করতে পারছে না বেচারি। লোকটা কি জিহান? নাকি অন্য কেউ?
০৮!!
-আজই এভাবে পাগলামি করার কি ছিল বলো তো নিহার? আমি কি পালিয়ে যাচ্ছিলাম কোথাও? নাকি ম্যাডাম ভেবেছেন আবেগের বশে যেভাবে ধরা দিতে এসেছি রাত পোহালে সব ভুলে আগের মতো হাওয়া হয়ে যাবো? হুম? পাগলি মেয়ে একটা!
আবরার বরফ শীতল হাত ছুঁইয়ে চাদর ভেদ করে নিহারের কোমড় জড়িয়ে কথাগুলো বললো। কথাগুলো শেষ হতেই নিহার একটা টু শব্দও করলো না। চুপচাপ চাদরটা গায়ে জড়িয়ে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে শোয়ার চেষ্টা করলো। আবরার নিহারের হঠাৎ এমন কাজে একটু অবাক হলো। নিহার উল্টো দিকে ঘুরার আগেই নিহারের কোমড় জড়িয়ে নিজের বুকের উপরে টেন নিল। নিহার আবার একবার ঠোঁট বাঁকিয়ে আবরারের বুকে মাথা রেখে চুপ করে রইলো। আবরার এক হাতে নিহারকে জড়িয়ে রেখে অন্য হাতটা নিহারের চুলের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে নিহারের চুলগুলো এলোমেলো হাতে যতটুকু মুঠোতে পুরতে পারলো সেটা ধরেই টেনে নিহারের মুখটা নিজের মুখের বরাবর আনলো। নিহার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছে দেখে আবরার এবারে নিহারের নাকে হালকা করে নাক ঘঁষে ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে সরে এলো।
-কি হলো ম্যাডাম? বলো না কেন কিছু? উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছো, ব্যাপার কি? এতেদিন আমাকে চাই বলে পাগল হয়ে গেছ, এখন কাছে পেয়ে আর ভাল্লাগছে না তাই না?
-মারছো কেন? লাগছে তো চুলে?
-আরো মারা উচিত তোমাকে মেয়ে। আমাকে পাগল করে এখন দূরে সরে যাওয়া হচ্ছে না? মানবো না বুঝলেন ম্যাডাম? এভাবে নিজে থেকে কাছে টেনে আবার নিজেই দূরে ঠেলে দেয়া একদম মানবো না।
-কি আর করবো? আমি আপনাকে পাগল বানাচ্ছি, পাগলামি করছি। কিন্তু আপনি তো সেই ফ্রেন্ড হয়েই থাকতে চাচ্ছেন। সেটা তো আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই সরে যাচ্ছি। ছাড়ুন।
-কেন? হাজবেন্ড ওয়াইফ কি ফ্রেন্ড হতে পারে না?
-না পারে না। আর বিয়ের পরে পরপুরুষের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করার মতো রঙ আমার মনে লাগে নি।
-আরে! মানে কি! আমাকে পরপুরুষ মনে হয় তোমার?
-নইলে নিজের বউয়ের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চাও কোন লজিকে?
-আচ্ছা বাবা। ভুল হয়েছে। মনে হচ্ছে তুমি আবার সালমান ভাইয়ের ফ্যান। এক লাড়কা অর এক লাড়কি কাভি ভি দোস্ত নেহি হো সাকতে, টাইপের আর কি। থাক বাবা। বন্ধু হতে হবে না। তবু গাল ফুলিয়ে সরে যেও না। বুকেই থাকো।
-দরকার নেই। ছাড়ো। আমি তো পাগলামি করে আপনাকে নিজের করে আটকে রাখতে চাইছি। আর করবো না। প্রবলেম নেই। এতোগুলো দিন অপেক্ষা করেছি দরকার হলে আরো করবো। তবু জোর করে আপনার কাছে আসবো না আর। সরি।
-আরে?! নিহার?
নিহার এবারে নিজেকে আবরারের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো। আবরারও আর মূহুর্ত দেরি না করে নিহারকে শক্ত করে পিছন থেকেই জড়িয়ে নিয়ে নিহারের ঘাড়ে নাক মুখ ডুবিয়ে আদুরে একটা কামড় বসালো। নিহার একবার কেঁপে উঠে সরার চেষ্টা করতেই আবরার এবারে নিহারের কানের লতিতে কামড় বসালো।
-আমাকে জেদ দেখানো হচ্ছে ম্যাডাম? পাগলামি করা কাকে বলে এবার আমিই দেখাচ্ছি আপনাকে। তোমার পাগলামি দেখে যা মনে হয়েছিল তাই বলেছিলাম। তাই বলে সামান্য একটা ব্যাপারে এভাবে এতো রাগ করবা? তা তো হবে না ম্যাডাম। তুমি যদি রাগ করতে জানো, তবে তোমার হাজবেন্ডও রাগ ভাঙানোর ওস্তাদ।
-কে কার হাজবেন্ড? আপনি তো আমার ফ্রেন্ড হন। তা কোথায় শুনেছেন যে ফ্রেন্ডকে এভাবে জাপটে ধরে তার রাগ ভাঙায়?
-ফ্রেন্ডস হওয়ার রুলস তো তুমি নিজেই ব্রেক করলে। মানোও না আমাদের নতুন ফ্রেন্ডশিপটা। তাই তুমি যা চাও তাই মাথা পেতে গ্রহণ করলাম ম্যাডাম।
-দরকার নেই আপনার এতো মাথা পেতে নেয়ার। ছাড়ুন। আমি নীলার কাছে থাকবো আজকে। আপনি আরাম করেই ঘুমান।
-তাই? আমার নেশা ধরিয়ে এখন পালানোর ফন্দি আটছ মেয়ে? তা তো হবে না। ছ'সাত বছরের জমা সমস্ত আদর একসাথে চাইছিলে না তুমি? এতো জলদি পালাতে চাইলেই বা দিচ্ছে কে পালাতে? আর এই যে এবার তুমি পালাতে চাইছ তার শাস্তিও তো পেতে হবে। তার সাহস হয় কি করে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার?
-আবরার? আরে? ছাড়ো না?
-নোওওওও। নো মিন্স নো ম্যাডাম। যতক্ষণ উল্টোদিকে ঘুরে থাকবে ততক্ষণ জ্বালাতন চলবে, চলবেই।
-আরে?
আবরার কথাগুলো বলতে বলতে আবার নিহারের ঘাড়ে ছোট্ট কামড় এঁকে দেয়া শুরু করেছে। নিহারের রীতিমতো অতিষ্ঠ দশা। কোনোমতো ঘুরে আবরারের দিকে ফিরে কটমট করে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবরারের শক্ত বাঁধনে বন্দি হলো নিহার। নিহারকে কোনো কিছু বলার সুযোগটাও দিল না এবারে আবরার। তার আগেই হারিয়ে গেল ভালোবাসার রঙিন কোনো এক দুনিয়ায়। নিহারও এতোক্ষণে অভিমান ভুলে আবরারের রঙিন ভালোবাসার সাগরে গা এলিয়ে দিয়েছে। এতোগুলো বছর পর নাহয় নতুন করে স্বপ্নগুলো ডানা মেলুক ভালোবাসার আকাশে।
অন্যদিকে, আবছা ছায়ামূর্তিটা বাস্তব নাকি স্বপ্ন সেটা ভাবতে ভাবতেই আলতো ঠোঁটের ছোঁয়া এঁকে দিলো মানুষটা নীলার ঠোঁট জোড়ায়। নীলা নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঘুম কাটিয়ে চোখ মেলে তাকালো। জিহান! জিহানের মুখটা অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নীলা। ছেলেটা নীলার মুখের দিকে আরো কিছুটা ঝুঁকে নীলার ঠোঁটজোড়া নিজের উষ্ণ ঠোঁটের বাঁধনে আটকে নিল। আর সেই স্পর্শে নীলা যেন স্ট্যাচু হয়ে গেছে। এক বিন্দুও নড়ার ক্ষমতাই যেন নেই মেয়েটার এই মূহুর্তে। বাস্তব, স্বপ্ন, ঘুম, ওষুধের ঘোর সব মিলিয়ে কেমন অস্থির লাগছিল এতোক্ষণ। অথচ জিহানের আলতো স্পর্শটা যেন নীলার শরীর থেকে সমস্ত কষ্টগুলোকে শুষে নিতে শুরু করেছে নিমিষেই। এ কেমন অদ্ভুত রকমের অনুভূতি!
-কাল সকালে কি এই স্পর্শটাকে স্বপ্ন ভেবে ভুল হবে মাই ডিয়ার ওয়াইফি? উমমমম। একটা কাজ করা যায় এটা যে স্বপ্ন না সেটার প্রমাণ রাখতে তোমার গলার কাছে একটা লাভ বাইট এঁকে দেয়া যায়। শাওয়ার নেয়ার সময় যখন দেখবে তখন স্বপ্ন না সত্যি সেটা বুঝতে সুবিধা হবে তোমার। কি বলো বউ? ভালো হবে না কাজটা?
-একদম না। তুমি কেন এসেছ? চলে যাও এখান থেকে।
-কি ভাবো বলো তো? তুমি বললেই আমি চলে যাবো? চলে যাওয়ার জন্যেই কি তোমাকে বিয়ে করেছি? এমন একটা বাধা আসবেই জানতাম। তাই তো কাউকে না জানিয়েই কোর্ট ম্যারেজটা করে নিয়েছি।
-এবং আপনার ম্যারেজ রেজিস্ট্রি পেপারটাও আমি ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। যেমন আপনি নিজের জীবন থেকে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন।
-তাই। এতো বোকা কেন মেয়ে তুমি বলো তো? কারো সাথে ইন্টিমেট হওয়ার হলে আমি গাধার মতো মেইন ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে দেয়ালে চেপে ধরে---।
-জাস্ট শাট আপ। একটা কথাও শুনতে চাই না আমি আপনার। চলে যান এখান থেকে। নইলে আমি এক্ষুণি সবাইকে ডাকবো। বাবা আর ভাইয়া এসে যদি দেখে আপনাকে এই রুমে------।
-কি আর করা! ডাকো? তোমার হাজবেন্ডকে তুমি যদি মাইর খাইয়ে শান্তি পাও, তাইলে ডাকো? আমি হেল্প করবো সোনাবউ? ওয়েট? শ্বশুরমশাই? আবরার ভাইয়া------।
-যাও এখান থেকে। বের হও।
-নীল? আরে? চলে যাবো তো। তোমাকে এক নজর না দেখে শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই তো ছুটে এসেছি এভাবে বউটার কাছে। সেই কখন খেয়েছি, রাতে খাওয়াও হয়নি। তবু এভাবে তাড়িয়ে দিবে বউটা?
-একদম নাটক করবেন না মিস্টার জিহান। আপনার মুখোশটা না খুলে গেছে।
-কার যে মুখোশ কখন খুলবে টেরই পাবে না। শুধু চমকে উঠবে সত্যিটা জানার পর। একটু শান্ত হয়ে শোনো তো আমার কথাগুলো?
-আপনার আর কোনো নাটকে আমি ভুলবো না জিহান। আরেরকবার বোকাদের দলে নাম লেখাতে পারবো না।
-মানে এখনও আমাকে বিশ্বাস করবে না? ওদেরকেই এতোটা বিশ্বাস? আর আমি? আমি কেউ না তোমার?
--------------------------------------------------
-ঠিক আছে। করো না বিশ্বাস। যেদিন সবটা চোখের সামনে দেখবে, সেদিন নিজের ভুলের জন্য পস্তাবে। এর বেশি কিছু বলার নেই আমার।
কথাগুলো বলে আর এক মূহুর্তও অপেক্ষা করলো না জিহান। নীলার বিছানা থেকে উঠে এসে দরজার দিকে পা বাড়ালো। ছেলেটা যে রাগে রীতিমতো ফুঁসছে সেটা আবছা আঁধারিতেও বুঝতে পারছে নীলা। দরজা পর্যন্ত গিয়ে জিহান আবার ফিরে এলো। নীলার দিকে খানিকটা ঝুঁকে নীলার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে ছোট্ট দুটো শব্দ উচ্চারণ করে হন হন করে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। নীলার ঘুম জড়ানো চোখে জিহানের চলে যাওয়ার দৃশ্যটা ধীরে ধীরে আরো আবছা হয়ে আসছে। আর কানে বাজছে শব্দদুটো।
-ভালোবাসি, নীল।