০১!!
গরম খুন্তির ছ্যাক এর প্রভাব খুব ভালো করেই টের পাচ্ছি হাতে। মেহেদী রাঙা হাত সাধারণতই সুন্দর লাগে। কিন্তু আমার হাতটি দেখতে খুব বিশ্রী লাগছে। নিজেই তাকাতে পারছিনা এত পরিমাণ বিদঘুটে দেখাচ্ছে। তার চেয়েও বেশি পরিমাণ যন্ত্রণা করছে হাতে। গরম খুন্তি দিয়ে ছ্যাক দিয়েছে আমার মা। উহু শুধু মা নয়। সৎ মা! আমার দোষ আমি হাতে মেহেদী দিয়েছিলাম।
ঈদের আগেরদিন স্বভাবতই সবাই হাতে মেহেদী দেয়। বিশেষ করে মেয়েরা। মেহেদীতে রাঙা হাত খুবই অপূর্ব লাগে। আমার ছোট বোন ঈশা আর ছোট ভাই ঈশান দুজনই মেহেদী নিয়ে এসে বলে,
- আপু আমার হাতে মেহেদী দিয়ে দাও তো। (ঈশা)
- বাব্বাহ্! আমার পিচ্চি বনুটা মেহেদী দিবে!
- আপু, শুধু ঈশা আপু না আমিও মেহেদী দিবো। (ঈশান)
- এই ছোট্ট ছোট্ট হাতে মেহেদী দিবা ঈশান বাবু?
- আপু আমি অনেক বড়! (ঈশান)
- ওমা! তাই?
- হুম
- আচ্ছা দাও মেহেদী দিয়ে দেই।
দুজনের হাতেই মেহেদী দেওয়ার পর তারা খুশিতে আমার দু'গালে চুমু খেল। শেষমেশ তারা বায়না ধরলো আমাকেও হাতে মেহেদী দিতে হবে। ওদের অনেক বুঝানোর পরও কাজ হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে হাতে মেহেদী দিয়েছি।
সেই মুহূর্তে আমার মা আমার রুমে এসে আমার হাতে মেহেদী দেখে সহ্য করতে পারেননি। তাই গরম খুন্তি দিয়ে আমার মেহেদী রাঙা হাতটিকে বিশ্রী করে দিয়েছে।
হাতে ফোস্কা পড়ে গিয়েছে। অসম্ভব রকম জ্বালা করছে।
রাত: ১২:২৪
দরজায় কে যেন নক করছে। দরজা খুলে দেখি বাবা, ঈশা আর ঈশান। রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। বাবার চোখ পানিতে চিকচিক করছে তা আমি ঠের বুঝতে পারছি।
- কি হয়েছে বাবা? কাঁদছেন কেন?
- তোর হাত দেখি আম্মু?
- কেন বাবা?
আমি ঈশা আর ঈশানের দিকে তাকালাম। সন্ধ্যার ঘটনাটা কি তবে বাবাকে বলে দিয়েছে ওরা। এই কথাটার চেয়েও বেশি ভাবাচ্ছে ওদের চোখের পানি। আমি বাবাকে রেখে ওদের কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে বসলাম।
- কি হয়েছে আমার পিচ্চি দুইটার?
- আপু, স্যরি আপু। আমরা জানতাম না মা এমন করবে। তাহলে তোমাকে মেহেদী দেওয়ার জন্য জোর করতাম না। (কান্না করে)
- ওলে বাবারে! আমার কিছু হয়নি তো লক্ষী! আমি ঠিক আছি।
ঈশান কান্না করে বলছে,
- আপু তোমার কষ্ট হচ্ছে না?
- হচ্ছে তো! কিন্তু হাত পুড়ে যাওয়ার জন্য না। এই যে আমার মিষ্টি দুই'টা পাখি কান্না করতেছে এজন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
এখন আমার এই মিষ্টি পাখি দুইটা যদি কান্না না থামায় তাহলে যে আমার আরো অনেক কষ্ট হবে।
- আমরা আর কাঁদবো না আপু। তুমি কষ্ট পেয়ো না।
আমি ওদের চোখের পানি মুছে দিয়ে গালে চুমু খেলাম।
- আমার লক্ষী পাখিরা!
আমি উঠে দাঁড়াতেই বাবা আমাকে চেয়ারে বসিয়ে জোর করে হাতটা টেনে নিলো।
বাবা ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
- আর কত সহ্য করবিরে আম্মু? তোর কষ্ট হয়না? কেন এগুলো সহ্য করিস?
- বাবা! আপনি অযথাই এত কাঁদছেন। তেমন কিছুই হয়নি আমার।
- চুপ কর! এত নরম বলেই তোর ওপর এত অত্যাচার করা হয়। প্রতিবাদ করতে পারিস না?
- বাবা! মা না হয় একটু শাস্তিই দিয়েছে তার জন্য কি প্রতিবাদ করতে হবে নাকি?
- শাস্তি? কিসের শাস্তি? তুই তো কোনো অপরাধ করিসনি আম্মু। তাহলে কিসের শাস্তির কথা বলছিস? তুই নিজেও প্রতিবাদ করবি না আর আমাকেও প্রতিবাদ করতে দিবি না।
- আমি চাইনা আমার কারণে অযথাই সংসারে কোনো ঝামেলা হোক। এজন্য আমি মনে করি চুপ থাকাটাই শ্রেয়।
বাবা আর কিছু বলেনি। হাতে মলম লাগিয়ে দিয়ে ঈশা আর ঈশানকে নিয়ে চলে গিয়েছে। বুঝেছি বাবা আমার ওপর অভিমান করেছে। কিন্তু আমারও যে কিছু করার নেই।
দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছি। ছোট বেলার কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি সে খেয়ালই নেই।
পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে মা'য়ের ডাকে।
- কিরে নবাবজাদি! ঘুম শেষ হয়নি তোর? তাড়াতাড়ি উঠ।
ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৫:২৩ বাজে। উঠে দরজা খুলে দিতেই মা বলা শুরু করে,
- আর কত ঘুমামি? সারা দিনরাত ঘুমিয়ে মন ভরে না?
না চাইতেও আমার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি ফুটে ওঠে। আমি মাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
- আমাকে কি করতে হবে বলো?
- কি করতে হবে মানে? আজ যে ঈদ সেই খেয়াল কি তোর আছে? যা আমাদের জন্য সেমাই, আর নাস্তা বানা। আর শুন, তোর বাবার কে যেন আজ বাড়িতে আসবে। তার জন্য রান্নাবান্না করিস ভালোমত। একটু পরই রেডি হয়ে পার্লারে যাবো আমি আর স্নেহা। সেখান থেকে ঘুরতে যাবো একটা পার্টিও আছে। আমাদের আসতে রাত হবে। তাই ঈশা আর ঈশানকে রেখে যাবো। কিছু টাকা দিয়ে যাবো। ওদের একটু আশপাশ থেকে ঘুরিয়ে আনিস।
- আচ্ছা।
আমি আমার সেই পোড়া হাত নিয়েই রান্নাঘরে চলে গেলাম রান্না করতে। হাত'টা নিয়ে বেশ যন্ত্রণায় আছি কোনো কাজ করতে গেলেই ব্যথা করছে। তবুও কষ্ট করে আগে সেমাই, চা, কফি, গরম দুধ, ডিম সিদ্ধ আর নুডলস্ রান্না করলাম। কারণ সকাল হলে ঈশা আর ঈশানের নুডলস্, গরম দুধ আর ডিম সিদ্ধ চাই।
বাবা আর মাকে চা দিয়ে স্নেহার ঘরে গেলাম ওর কফি দিতে। স্নেহা আমার বড় বোন। খুব বেশি বড় নয় তিন মাসের বড় আমার।
সকাল আট'টা নাগাদ মা আর স্নেহা বেড়িয়ে গেল। বাবা যায়নি কোথাও। আমি রান্না বসাতে যাবো সেই সময় বাবা এসে বলে,
- আম্মু রান্না করতে হবে না।
- কেন?
- যাদের আসার কথা ছিল ওরা আসতে পারবে না।
- তাতে কি হয়েছে বাবা? আপনি ঈশা আর ঈশান তো আছেন।
- না আম্মু। আমরা সবাই ওদের বাসায় যাবো।
- ওহ আচ্ছা। কখন যাবেন?
- নামাজ পড়ে এসেই যাবো।
- ঠিক আছে আমি ঈশা আর ঈশানকে রেডি করে দিচ্ছি।
- হুম আম্মু তুইও রেডি হয়ে নিস
- আমি কোথায় যাবো বাবা?
- আমাদের সাথে যাবি।
- না বাবা। মা জানতে পারলে খুব রাগ করবে।
- জানবে না আম্মু। ওরা আসার আগেই আমরা এসে পড়বো।
- কিন্তু....
- কোনো কিন্তু নয় আম্মু। যা তাড়াতাড়ি রেডি হ।
বাবা, আমি ঈশা আর ঈশান যাচ্ছি বাবার বন্ধুর বাড়ি। তাদের বাড়িতে নাকি তাদের কোন আত্মীয় এসেছে তাই তারা আসতে পারেনি। আমাদের যেতে বলেছে।
আমরা বাবার বন্ধুর বাসায় পৌঁছে গিয়েছি।
ঐ বাড়িতে যেতেই ঈশা আর ঈশান এখানে সেখানে ছুটোছুটি করছে। ওদের আটকে রাখা মুশকিল হয়ে পড়েছে। ঐদিকে বাবা ও তার বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ করে ঈশাকে দেখছি না। এত বিশাল বাড়ি কোথায় বা খুঁজবো ওকে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে যাচ্ছি। ঈশাকে দেখলাম দৌড়ে একটা রুমে ঢুকতে। আমি সে রুমে যেতেই কোথাও ঈশাকে দেখছি না। ওয়াশরুমের দরজা লক করা। তাহলে নিশ্চয় ওয়াশরুমেই গিয়েছে। আমি ওয়াশরুমের দরজা ধাক্কাচ্ছি। তবুও দরজা খোলার কোনো নাম নেই। বেশকিছুক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পর দরজা খোলার শব্দ পেলাম। আমিও রেডি শুধু দরজাটা একবার খুলুক আমাকে হয়রানি করার মজা বুঝাচ্ছি। এদিকে যে আমি ওয়াশরুমের দরজার সাথে হেলান দিয়ে আছি সেদিকে আমার কোনো খেয়ালই নেই। দরজা খুলতেই আমি হুরমুড়িয়ে ভেতরে পড়ে যেতে নিলাম, ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছি। মনে হচ্ছে পড়িনি কেউ ধরে রেখেছে। ঐদিকে হাতটাও জ্বালাপোড়া করছে মনে হচ্ছে ফোস্কাটা গলে গিয়েছে। আমি চোখ খুলতেই চোখ আমার ছানাবড়া। একটা ছেলে! শাওয়ার ছাড়াই ছিল। তার সাথে আমিও ভিজে চুপচুপা হয়ে গেছি। চিৎকার দিতে যাবো তখন ছেলেটা আমার মুখ আটকে ধরেছে হাত দিয়ে।
- চুপ! চুপ! চিৎকার করবেন না প্লিজ।
তার হাত মুখ থেকে সরানোর চেষ্টা করছি। সে অপলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে আমি তার থেকে ছুটার জন্য বৃথা চেষ্টা করছি। যখন তার ঘোর কাটলো আমাকে ছেড়ে দিলো।
সে চোখ নিচু করে বললো,
- স্যরি, আসলে বুঝতে পারিনি।
- না, না আপনি কেন স্যরি বলবেন? ভুলটা তো আমার। আসলে ঈশা মানে আমার ছোট বোন দুষ্টুমি করতে করতে এই রুমে এসে ঢুকেছে। ওকে খুঁজতেই আমার আসা আর তারপর এসব!
ছেলেটা হঠাৎ আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
- একি! আপনার হাতে কি হয়েছে?
- ও কিছুনা।
হাতটা ঢেকে আমি ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে গেলাম। কিন্তু এই ভেজা কাপড়ে নিচে যাবোই বা কিভাবে!
ঈশান হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে এসে বলে,
- আপু এটার ভেতর কাপড় আছে। পড়ে নাও।
প্যাকেট খুলে দেখি শাড়ি।
- তুমি কোথায় পেলে এটা ঈশান বাবু?
- তুমি পড়ো তো!
এটা বলেই ঈশান দৌড়ে চলে গেল।
এইদিকে আমিও কোনো উপায় না পেয়ে শাড়িটা পড়ে নিলাম।
মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল। ছোটবেলায় যখন শাড়ি পড়ার জন্য বায়না করতাম তখন মা তার ওড়না দিয়ে আমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিতো। কতই না মধুর ছিল সেই দিনগুলি। ঘরে আর মন টিকছিল না তাই ভাবলাম একটু ছাদে যাই। ছাদে টপে লাগানো ফুলগাছ গুলো দেখছিলাম। বাড়ির ভেতর আর বাহিরটা যত সুন্দর তার চেয়েও বেশি সুন্দর বাড়ির ছাদটা! পেছন থেকে একটা অপরিচিত লোকের কন্ঠস্বর পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম।
- শাড়িটা আনা তাহলে বৃথা যায়নি!(অচেনা মেয়ে)
- মানে? বুঝলাম না?
- মানে হলো, আমার ভাইয়া অনেক খুঁজে এই শাড়িটা এনেছে। কিন্তু কার জন্য এনেছে তা বলেনি।
- তোমার ভাইয়া কে?
- আহা! ন্যাকাষষ্ঠী। মনে হয় কিছুই জানো না?
- আমি সত্যিই কিছু জানিনা।
- আচ্ছা জানতে হবে না। এখন বলো তো ভাবি তোমার নাম কি?
- ভাবি কেন বলছো আমাকে?
- তাহলে কি বলবো?
- তোমাকে আমার সমবয়সী বলেই মনে হচ্ছে। নাম ধরেই ডাকবে। তাছাড়া আমি তো আর তোমার ভাইয়ের বউ নই
- তোমার নামটাই তো জানিনা।
- আমি রূপকথা। তুমি?
- রূপকথা!! ওয়াও। তোমার মতই তোমার নামটাও অনেক সুন্দর ভাবি।
বাই দ্যা ওয়ে আমি আরিশা
পাশ থেকে সেই ছেলেটা আরিশাকে ধমকের সুরে বললো,
- যাকে তাকে ভাবি বলিস কেন?
আরিশা তার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই এবার সে আমার খুব সামনে এসে রাগি চোখে তাকিয়ে বললো,
- এই শাড়িটা পড়ার সাহস কোথায় পেলেন আপনি?......
০২!!
ছেলেটার কথা শুনে রূপকথা থতমত খেয়ে যায়। কি বলবে বা বলা যায় ভেবে পাচ্ছে না। কিন্তু প্রচন্ডরকম ভয় পেয়েছে তা রূপকথাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রূপকথার এমন অবস্থা দেখে আরিশার ভাই ফিক করে হেসে দেয়।
- বাহ্ ভয় পেলে তো আপনাকে দারুণ লাগে।
- মানে?
- মানে কিছুনা। তবে শাড়িটায় আপনাকে বেশ মানিয়েছে।
- আসলে! আমি জানতাম না এই শাড়িটা আপনি এনেছেন। ঈশান মানে আমার ছোট ভাই এসে শাড়িটা দিয়ে গেল আর আমিও ভেজা ছিলাম তাই কিছু না ভেবেই পড়ে নিয়েছি। দুঃখিত আমি
- কেন? যদি জানতেন শাড়িটা আমি এনেছি তাহলে কি পড়তেন না?
- বিষয়টা তেমন নয়। আরিশা বললো আপনি কার জন্য যেন শাড়িটা এনেছেন। আর তার শাড়িটা আমার এভাবে পড়া উচিৎ হয়নি।
- হাহাহা! শাড়িটা আমি কারো জন্য এনেছি ঠিকই কিন্তু কাকে দিবো তা ভেবে আনিনি। কিন্তু যখন আপনি ভেজা শরীরে বেড়িয়ে গেলেন তখন হুট করে আমার মাথায় এলো শাড়িটা আপনাকেই দেই। আর ঈশানকে দিয়ে শাড়িটা আমিই পাঠিয়েছি।
- ওহ আচ্ছা!
- জ্বী। একটা কথা বলবো?
- হ্যাঁ বলুন
- আপনার হাতে কি হয়েছে?
প্রশ্নটা শুনে রূপকথা আঁচল দিয়ে হাতটা ঢেকে নেয়।
- কিছু হয়নি তো! আচ্ছা আপনার নাম কি?
- আমি আরিশ। কথা ঘুরিয়ে লাভ নেই বলুন কি হয়েছে হাতে?
- বললাম তো কিছুনা।
- আপনি তো দেখছি বড্ড ঘাড়ত্যারা। আরিশা দেখতো হাতে কি হয়েছে।
আরিশের কথা মত আরিশাও রূপকথার হাত দেখার বৃথা চেষ্টা করছে। কিন্তু রূপকথাও নাছোরবান্দা কিছুতেই দেখাবে না হাত। কারণ ও চায়না সত্যিটা ওদের সামনে আসুক। এক পর্যায়ে জোরাজুরি করতে গিয়ে রূপকথা ব্যথায় কুকিয়ে উঠে। না চাইতেও এবার হাতটা ঠিলে হয়ে যায়।
আরিশ রূপকথার হাতটা সামনে আনে।
- ওহ মাই গড! ফোস্কা পড়েছিল হাতে?
- হু
- কিভাবে?
- রান্না করতে গিয়ে।
- মিথ্যা কথা। হাত দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে পুড়িয়ে দিয়েছে।
- আরে না। কে ইচ্ছে করে পুড়াবে হাত
- তা তো আমি জানিনা। কিন্তু একটু আগে যেন কি বললেন? রান্না করতে গিয়ে পুড়েছে?
- হুম
- অদ্ভুত বিষয়! আপনি রান্না জানেন?
- অবশ্যই।
- বাহ্! এই যুগে তাহলে একটা মেয়ে পেলাম যে রান্না জানে।
- এমন শুধু আমি নই এরকম আরো অনেক মেয়েই আছে যারা রান্না জানে।
- হুম বুঝলাম। এখন চলুন
- কোথায়?
- হাত ব্যান্ডেজ করে দেই।
- না লাগবে না।
- খুব লাগবে। চলুন
রূপকথাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে আরিশ ওর হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে যায়। পেছন পেছন আরিশাও যায়। আরিশের রুমে নিয়ে গিয়ে খুব যত্নসহকারে হাতটা ব্যান্ডেজ করে দেয়। রূপকথা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরিশের দিকে। চেনেনা জানেনা হঠাৎ করেই একটা অচেনা মেয়ের প্রতি এত দরদ!
দরদ? উহু দরদ নয় এটাকে বোধ হয় সহানুভূতি বলে। কারণ আমার মত মেয়েকে সবাই সহানুভূতিই দেখাতে পারে।
আরিশ আর আরিশার সাথে গল্প করে জানতে পারলো ওরা দুই ভাই বোন অস্ট্রেলিয়া পড়াশোনা করে। আরিশা কলেজে পড়ে আর আরিশ ডাক্তারি পড়ে। ঈদের ছুটিতে কয়েকমাস বেড়াতে এসেছে।
ওদের সাথে কথা বলে রূপকথার খুব ভালো লাগলো দুই ভাই বোনকে।
আরিশ খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- আচ্ছা আপনার নাম তো রূপকথা। আনকমন একটা নাম এবং অনেক সুন্দর। একজন সুন্দর মনের মানুষই এমন নাম রাখতে পারে। কে রেখেছে এই নাম?
- আমার আম্মু।
- বাহ্ আন্টির চয়েজ তাহলে অপূর্ব বলতে হবে।
- হুম বলা যায়।
রূপকথার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল আরো অনেক কথা। কিন্তু আরিশের কৌতুহল এখনো শেষ হয়নি। আরিশ জানতে চাইলো এই নাম রাখার কারণ কি।
- আচ্ছা এই নাম রাখার কারণটা কি?
- শুধু কারণ নয় অনেক রহস্য ঘিরে আছে নামটায়।
- তাই! তাহলে শুনি কি রহস্য আর কারণ?
রূপকথা স্মিত হেসে জবাব দেয়,
- কিছু রহস্য উদঘাটন না করাই ভালো।
সন্ধ্যা: ৭:২০ মিনিট।
রূপকথা ড্রয়িং রুমে যায় ওর বাবাকে খুঁজার জন্য কিন্তু পাচ্ছে না। পেছন থেকে একজন মহিলা এসে জিজ্ঞেস করছে,
- কাউকে খুঁজছো?
- হ্যাঁ আসলে বাবাকে খুঁজছিলাম।
- তুমি রূপকথা?
- হ্যাঁ। আপনি?
- আমি আরিশের মা। তোমার বাবার বন্ধুর স্ত্রী।
- ওহ। তা বাবা কোথায় আন্টি?
- ওহ হো! তোমাকে তো বলাই হয়নি। তোমার আব্বু আর আরিশের বাবা ও তার বন্ধুরা এক জায়গায় ঘুরতে গিয়েছে। যাওয়ার আগে বলেছিল তোমাকে জানাতে কিন্তু একদম ভুলে গিয়েছি।
- ব্যাপার না আন্টি। বাবা আসলে বলবেন আমি ঈশা আর ঈশানকে নিয়ে চলে গিয়েছি।
আসি আন্টি।
- আসি মানে? না খেয়ে কোথায় যাচ্ছো?
- না আন্টি খাওয়ার সময় নেই। দেড়ি হয়ে গেলে যেতে পারবো না।
- আমি আরিশকে বলবো। আরিশ গিয়ে তোমাকে দিয়ে আসবে।
- না আন্টি প্লিজ।
আরিশের মা রূপকথার আর কোনো কথা না শুনে টেনে খাওয়ার টেবিলে নিয়ে যায় আরিশা ঈশা আর ঈশানকে নিয়ে ইতিমধ্যে টেবিলে বসে আছে। আরিশা নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে দুজনকে।
রূপকথা খেতে বসেছে ঠিকই কিন্তু মনের মধ্যে কু গাইছে। যদি মা আর স্নেহা ওরা বাড়ি যাওয়ার আগেই বাড়িতে এসে পড়ে তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। রূপকথা খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে আনমনে।
- তুমি খাচ্ছো না কেন?
আরিশের মায়ের কথায় হুস আসে রূপকথার। রূপকথা কিছু বলার আগেই আরিশা বলে,
- মা ও খাবে কি করে? ওর ডান হাতে তো ব্যান্ডেজ করা।
- ব্যান্ডেজ করা মানে?
কি হয়েছিল? কিভাবে কাটলো? বেশি কেটেছে?
আরিশের মা যেন অস্থির হয়ে পড়লেন। রূপকথা তাকে স্থির করে বললো,
- আন্টি শান্ত হোন। তেমন কিছু হয়নি। একটু পুড়ে গিয়েছিল।
আরিশের মা আর কথা বাড়ায়নি। হাত ধুয়ে ভাত মেখে রূপকথার মুখের সামনে ধরে আছে। রূপকথা খাচ্ছে না। ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উনার মুখের দিকে।
- কি হলো? খাও?
রূপকথাও আর দেড়ি করেনি। চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। রূপকথার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু রূপকথা কাঁদছে না। অনেক কষ্টে চোখের পানিগুলো আটকে রেখেছে। কিন্তু মায়ের কথা মনে হতেই যেন চোখের পানিগুলো উপচে পড়তে চাইছে। শেষমেশ নিজের সাথে যুদ্ধ করে রূপকথা পেরেছে চোখের পানিগুলো আটকে রাখতে। আজকে অনেক বছর পর রূপকথা তৃপ্তি করে খেয়েছে। নিজের মায়ের হাতে খেয়েছে মনে হচ্ছে রূপকথার।
কিন্তু এই মুহুর্তে রূপকথার দম আটকে আসছে। যতক্ষণ না চোখের পানিগুলো বের হচ্ছে ততক্ষণ শান্তি পাবে না।
রূপকথা উপরের রুমে চলে গেল। যেতে যেতে চোখের পানিগুলোও টপটপ করে পড়ছে। খেয়ালই করেনি যে আবারও আরিশের রুমেই এসেছে।
রূপকথা ব্যলকোনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে কাঁদছে।
- মা! মা গো। ও মা!! তুমি শুনতে পাচ্ছো? আজকে আমি অনেক খুশি মা অনেক খুশি। তুমি এসেছিলে আজ তাই না? হু আমি জানি তুমি আজ এসেছিলে। তুমি আজ আরিশার মায়ের মধ্যে এসেছিলে তাই না?
ও মা! মাগো তুমি একেবারে চলে আসো না আমার কাছে। আমি যে তোমায় খুব মিস করি গো! তুমি কি আমাকে একটুও মিস করো না? তোমার রূপকথা যে তোমাকে ছাড়া বড্ড অসহায় গো। তুমি কি বুঝনা মা? কিভাবে তুমি এতগুলো বছর আমাকে ছাড়া আছো কিভাবে মা?!!
রূপকথা ফ্লোরে বসে পড়ে। অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।
ঈশার গলার আওয়াজ পায়। ঈশা ডাকছে। রূপকথা উঠে দাঁড়ায়। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুখ মুছতে মুছতে রুমের মধ্যে যায়। টেবিলের সাথে ধাক্কা খায় কিছু একটা ভাঙ্গারও শব্দ পায়। চোখ থেকে আঁচল সরিয়ে ফ্লোরে বসে। জিনিসটা কি তা পুরোটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে পুতুল জাতীয় কিছু হবে। কাঁচের তৈরি করা অনেক সুন্দর। একটা কাঁচের টুকরা হাতে তুলে নেয় রূপকথা। কাঁচের টুকরায় আরিশের সাথে আর কার যেন নাম লিখা। শেষেরটুকু দেখা যাচ্ছে 'তি' লিখা।
আরিশ রুমে ঢুকে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোগুলো দেখে। আরিশের চোখ দুইটা লাল হয়ে গেছে। আরিশ প্রচন্ড রাগে রূপকথাকে দাঁড় করিয়ে রূপকথার ডান হাত চেপে ধরে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে ধরে।
- কি করলেন এটা? কেন ভাঙ্গলেন? জানেন এটা কি? এটার দাম জানেন? জানেন এটার মূল্য কত? আপনাকে বেঁচলেও এর মূল্য পরিশোধ হবে না। আমার রুমে ঢোকার সাহস পেলেন কোথায় আপনি? ভালো ব্যবহার করেছি বলে মাথায় চড়ে বসেছেন!! যত্তসব আউলফাউল লোক! বেড়িয়ে যান বলছি আমার রুম থেকে। আপনি একটা অশুভ ছায়া। আপনার এই অশুভ ছায়া আমার জীবন থেকে শেষ স্মৃতিটুকুও কেড়ে নিলো। আর কখনো আমার সামনে আসবেন না।
রূপকথার হাত থেকে প্রচন্ড রক্ত পড়ছে। প্রচন্ড জ্বালা করছে হাতে কিন্তু আরিশের থেকে ছুটার চেষ্টা করছে না। আরিশ ঠিকই বলেছে। আমি তো অশুভই, অলক্ষী। কিন্তু হাতের ব্যথার চেয়েও আরিশের কথাগুলো খুব লেগেছে অন্তরে। চোখের পানিগুলোও বাঁধা মানতে চাইছে না।
এতক্ষণে আরিশ রূপকথাকে ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে। রূপকথা নিঃশব্দে আরিশের রুম ত্যাগ করে কাউকে কিছু না জানিয়েই ঈশা আর ঈশানকে নিয়ে চলে যায় বাড়ি থেকে।
আরিশ কাঁচের টুকরোগুলোর দিকে হাত বাঁড়াতেই দেখে হাতে রক্ত লেগে আছে। কিন্তু ও তো কাঁচের টুকরোগুলো এখনো ধরেইনি। হঠাৎ মনে পড়ে রূপকথার কথা! ওর তো হাত পোড়া ছিল। টাটকা পোড়া হওয়ায় হাত থেকে রক্ত পড়েছে। এত জোরে হাতে চাপ দেওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু আরিশ এটা ভেবে পায় না যে রক্ত বের হয়ে গিয়েছে তবুও মেয়েটি একটা টু শব্দও করলো না! কি দিয়ে তৈরি এই মেয়ে?!!............