অলকানন্দা - পর্ব ২০ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!৫৮!!

"পরিস্থিতি যেমনই ছিলো আমাদের বিয়েটা হয়েছে এটা সত্য। আমরা একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি মাহা। আমার এই পৃথিবীতে কেউ নেই। বিয়ে, ভালোবাসা এসবে আমার আগ্রহ ছিলোনা কোনোকালেই। বিশ্বাস করো মাহা এটা পবিত্র বন্ধনের শক্তি কিনা জানিনা তবে তোমার জন্য আমার মনে অদ্ভুত একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। এটা কি ভালোবাসা নাকি আমার মোহ তাও আমার জানা নেই। শুধু মনে হয় তোমাকে আমার চাই। যে করেই হোক চাই। আচ্ছা, আমরা কি এই সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে পারিনা?"

বাইরে নীল দিগন্তের দিকে তাকিয়ে একটানা কথাগুলো বললো সার্থক। এখন তার কিছুটা হালকা লাগছে। মাহা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কতক্ষণ। সেও এটাই ভাবছিলো। বিয়েটা যখন হয়েই গিয়েছে তাহলে একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। মাহা তো নিজেও অস্বীকার করতে পারেনা তার মনে একটু হলেও সার্থক জায়গা করে নিয়েছে। নয়তো ঝাঁকড়া চুলের মায়াবী চোখের এই ছেলেটার জন্য তার মন কেমন করে কেন! এই পৃথিবীতে সবাই তো তাকে ছেড়ে চলে গেলো। প্রথমে মা, পরে চৈতি। গতকাল বাবা! আপন বলতে কেউ তো আর নেই। সার্থকের বাড়িতে একটু স্থান হয়েছে। সেই সাথে আপন একটা মানুষ যদি পাওয়া যায় তাহলে একটা সুযোগ দিলে ক্ষতি কি! মাহা যখন ভাবনায় মত্ত তখন সার্থক তার দিকে ফিরে বললো,
"মাহা, আমাকে একটা সুযোগ দাও।"

অদ্ভুত আকুতি সার্থকের কন্ঠে। মাহা সার্থকের চোখে চেয়ে বললো,
"আমাদের বিয়ের সামাজিক স্বীকৃতি চাই।"

বহু কষ্টে আড়ষ্টতা ভেঙে এই কথাটা বলে মাহা চুপ করে গেলো। সার্থক নিজের উত্তর পেয়ে গিয়েছে। মুচকি হাসলো সে। ফোন বের করে কল করলো মুইংচিন কে। 

"হ্যালো, মুইংচিন কাজী ডাকানোর ব্যবস্থা করো।"

ওপাশে কি বললো শোনা গেলোনা। তবে লজ্জায় মাহার গাল দুটো লাল হয়ে যাচ্ছে। সে সাথে বুকে চিনচিন ব্যথা। বাবা! আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন! নিজের কষ্ট ভুলতে চতুর্দিক অবলোকন করতে শুরু করলো মাহা। বিরাট বারান্দা। ছোটবড় টবে নানা রকম ক্যাকটাস গাছ। কয়েকটা ক্যাকটাস গাছে আবার ফুলও ফুটেছে। সাদা আর বেগুনি রঙের। অভূতপূর্ব দেখতে। সার্থক মুইংচিনের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। মাহা ঘুরে ঘুরে দেখছে চারপাশ। ছোট ছোট ক্যাকটাস গুলো দেখতে ভিষণ সুন্দর। একটা হলুদ অলকানন্দার গাছ। সবুজ থোকায় থোকায় হলদে ফুলগুলোকে ভিষণ সুন্দর লাগছে। একটা মাছের অ্যাকুরিয়ামও আছে। তাতে কালো রঙের অদ্ভুত কয়েকটা মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাহা যারপরনাই অবাক। সার্থক অপরদের থেকে একেবারে ব্যাতিক্রম। মানুষ বাগানে লাগায় গোলাপ, ডালিয়া এসব। আর এই উদ্ভট লোক ক্যাকটাস লাগিয়ে রেখেছে। তাছাড়া মাহা অ্যাকুরিয়ামে গোল্ড ফিশ, গাপ্পি, অ্যাঞ্জেল ফিশ, ফ্লাওয়ারহর্ন ফিশ পছন্দ করে। কত সুন্দর লাগে দেখতে। মাহারও একটা গোল্ড ফিশ ছিলো। কিন্তু এখানে অ্যাকুরিয়ামে কালো কালো কিসব মাছ রাখা। মাহা বিরক্ত হলো খানিকটা। পাশে একটা অদ্ভুত ক্যাকটাসের মতো তবে ক্যাকটাস না এমন একটা গাছ দেখতে পেলো মাহা। 

!!৫৯!!

মাহা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখতে গেলো তাদের। কিন্তু তার আগেই ওর হাত টেনে নিজের হাতে পুরে নিলো সার্থক। চোখেমুখে উৎকন্ঠা। মাহা ভয় পেলো খানিকটা। 
"এসব গাছে কখনো হাত দিবেনা।"
"কেন?"
"এই যে এখন যে গাছে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলে এটা ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ।"

মাহা নিজের গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে সার্থকের পানে। কোঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে রাখা। হলদে ফর্সা মুখটা কি যে আদুরে লাগছে। সার্থকের ইচ্ছে করছে টুপ করে খেয়ে ফেলতে কিংবা গালে একটু আদর দিতে। নিজের ইচ্ছেটাকে দমন করলো সে। ভারী পুরুষালি কন্ঠে বললো,
"তুমি জানো ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ কি?"

মাহা মাথা নাড়লো। যার অর্থ মাহার জানা নেই। 
"ঠিক আছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকবে গাছটার দিকে।"

মাহা আগামাথা কিছুই বুঝলোনা। সার্থক কি বুঝাতে চাচ্ছে! মাহা কিছু বলবে তার আগেই তার ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে কথা বলতে নিষেধ করলো সার্থক। মাহা চুপ করে গেলো। সার্থক চোখের ইশারা করলো ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ গাছগুলোর দিকে তাকাতে। মাহা সেদিকে তাকাতেই আৎকে উঠলো। গাছগুলো এতক্ষণ মুখবন্ধ করে শান্ত অবস্থায় ছিলো। হঠাৎ একটা মৌমাছি উড়ে আসতেই হা করে ধারালো কাঁটা বের করে খপ করে মৌমাছিটাকে নিজের ভিতর নিয়ে নিলো একটা ভেনিস ফ্লাইট্র্যাপ ট্রি। ঘটনাটা ঘটেছে খুবই দ্রুত। মাহা এখানো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ মৌমাছির জায়গায় যদি তার আঙুল থাকতো! ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠছে তার। 
"দেখেছো। এরা কত ভয়াবহ।"

মাহার খুব বলতে ইচ্ছে করছে এতো ভয়াবহ গাছ বাড়িতে রাখার কি প্রয়োজন! যে কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। কিন্তু মুখে কিছুই বললোনা। এ বাড়িতে এসেছে একদিনও হয়নি এখনই যদি সে অধিকার দেখাতে শুরু করে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। তাছাড়া বাড়িঘর দেখে বুঝাই যায় সার্থক অনেক বড়লোক। ধনী লোকদের এমন অদ্ভুত ইচ্ছে থাকে। যা মাহা প্রতিনিয়ত টিভি, ফেসবুকে দেখে আসছে। মাহাকে আর ভাবার সুযোগ না দিয়ে সার্থক বললো,
"এসব গাছ আমার বাগানে রাখার কোনো ইচ্ছেই ছিলোনা। কানাডায় আমার ছোট একটা ক্যাকটাস বাগান ছিল। সেই অনুযায়ী এখানেও করি। মুইংচিন আমাকে এই ট্র্যাপ গাছ তিনটি উপহার স্বরূপ দিয়েছে। তারমতে এই ফ্লাইট্র্যাপ ট্রি আমাকে সবসময় সতর্ক রাখবে। গোপন শত্রুর কথা স্মরণ করিয়ে দিবে। ও এতো শখ করে দিলো আমি তাই আর ফেলতে পারিনি।"

সার্থক বলে চললো একটানা। মাহা জানেনা কেন তবে সার্থকের তার কাছে সাফাই দেওয়ার বিষয়টি ভিষণ উপভোগ করেছে সে। কখনো কেউ তো এভাবে তার কাছে সাফায় দেয়নি। কারো জীবনে মাহা কোনো সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিলোনা। তাহলে আজ সামনে দাঁড়ানো এত সুদর্শন, স্মার্ট লোকটা তার কাছে সাফাই গাইছে কেন! মাহা কি সত্যিই তার বিশেষ কেউ? 
"মাহা শুনছো?"
"হুম?"
"তুমি কি রাগ করেছো?"
"উঁহু।"
"আমি আজই এই গাছগুলো অন্যজায়গায় রাখার ব্যবস্থা করাবো।"
"সেসবের প্রয়োজন নেই সার্থক। আপনি প্লিজ এতোটা বিচলিত হবেন না।"

মাহার কথায় খানিক আস্বস্ত হয় সার্থক। বাইরে হালকা রোদ উঠেছে। খোলা বারান্দা হওয়ায় দুয়েকটা চড়ুই পাখি ভিতরে ঢুকে নিচে বসে রোদ পোহাচ্ছে। 

!!৬০!!

সার্থক হঠাৎ করেই টাউজারের পকেট থেকে একটা আংটির বক্স বের করলো। মাহার দিকে তাকিয়ে ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
"তোমার হাতটা একটু দাও মাহা।"

সার্থকের আড়ষ্ট ভঙ্গির এমন ডাকে মাহাও লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে বাম হাত এগিয়ে দিলো সে। সার্থক মাহার অনামিকা আঙুলে একটা ডায়মন্ডের আংটি পরিয়ে দিলো। কতক্ষণ সেদিকপানে তাকিয়ে বললো,
"আমাদের যাত্রা শুরুর চিহ্নটা তোমার আঙুলে পরিয়ে দিলাম মাহা। কখনো এই আংটিটা খুলো না।" 

সার্থক হাত ছেড়ে দিয়েছে। মাহা তাকিয়ে রইলো আংটিটার দিকে। একধ্যানে। শুরু হলো কি তবে একটা আঁধার আলোর খেলার? 
"ভাইয়া? ভাবিকে একটু ছাড়ো এবারে। আমাদের সাথেও গল্প করার সুযোগ দাও। নাকি তোমার বউকে শুধু তুমি নিজের কাছেই রাখবে?"

নিভার কথায় মুচকি হাসলো সার্থক। নিভা মজার ছলে সার্থকের মনের কথাটাই বলেছে। সার্থক সত্যিই পারলে মাহাকে সারাক্ষণ নিজের কাছেই রাখতো। নিভা এবার মাহাকে বললো,
"ভাবি, চলো আমার ঘরে। তোমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করি।"

মাহা কি বলবে বুঝতে পারছেনা। নিভা মেয়েটাকে তার কাছে ভালোই লেগেছে। হাসোজ্জল থাকে সবসময়। কথায় অনেক মাধুর্য। মাহার সাথে হয়তো আজই প্রথম পরিচয়। অথচ এমন ব্যবহার করছে যেন বহুদিনের চেনাজানা। সার্থকের ফোন বেজে উঠতেই রিসিভ করলো সে। মাহা তার পানে তাকিয়ে আছে। হয়তো অনুমতি চাচ্ছে। নিভার সাথে যাবে কি যাবেনা। সার্থক মাহাকে কিছু বললোনা। নিভার দিকে তাকিয়ে বললো,
"আমার ঘরে বসে গল্প করো তোমরা।"
"আচ্ছা, ভাইয়া।"

ঘরে বসে অনেকটা সময় গল্পে গল্পে কাটলো মাহার। নিভা প্রচুর কথা বলে। মাহা স্বল্পভাষী মানুষ। দুয়েকটা উত্তর দেওয়া আর কথা জিজ্ঞেস করা ছাড়া সে বিশেষ কিছুই বলতে পারলোনা। একসময় ঘুমিয়ে গেলো মাহা।

________________

চারপাশে অন্ধকার। একটা রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছে মাহা। আশেপাশে বিশাল জঙ্গল। চৈতির চিৎকার হঠাৎ কানে বেজে উঠলো মাহার। মাহা দিকবিদিকশুন্য হয়ে খুঁজতে শুরু করলো চৈতিকে। তবে নেই। চৈতি নেই। 

হাঁটছে মাহা। হাঁটতে হাঁটতেই ফোন বেজে উঠলো তার। সেই পুরানো স্মার্টফোন টা। একটা কল এলো। চৈতি কথা বলছে। কি বলছে জানেনা মাহা। তারপর.... 

তারপর আর মনে নেই। অন্ধকার আর অন্ধকার। মাহার ঘুম ভাঙলো সার্থকের ডাকে। নরম সুরে ডাকছে,
"মাহা, এই মাহা উঠো।"

মাহা তখনও চোখ বুজেছিলো। হঠাৎ সার্থকের ঠোঁটজোড়ার অস্তিত্ব নিজের কপালে অনুভব করতেই লজ্জা পেলো মাহা। সার্থক এখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাহার কি যে লজ্জা লাগছে! তার গাল গুলো বোধহয় লাল হয়ে যাচ্ছে। এতোক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলেও এবার ঘুমের ভান করে আছে মাহা। সার্থকের এহেন কাজে তার যে ভিষণ লজ্জা লাগছে। এখন সে কি করে সার্থকের সামনে মুখ দেখাবে। 

সার্থক আবার মাহাকে আলতো করে নরম সুরে ডাকলো,
"মাহা, এই মাহা উঠো।"

মাহা মনে মনে বললো,
"উঠবোনা ডাক্তার। আপনি এখানে থাকা অবস্থায় চোখ খোলা আমার পক্ষে সম্ভব না।"
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন