ভোরের রোদ - পর্ব ১২ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


২৩!! 

-তোর কি ধারণা? তুই গদগদ কণ্ঠে আমাকে নিজের অন্যায়ের সাফাই গেয়ে শোনাবি আর আমিও ওমনি সব ভুলে তোকে মাফ করে দিবো? তুই ইচ্ছে করেই করিস বা অজান্তে, তোর কারণে তো আমাকে আমার বোনটাকে হারাতে হয়েছে রোদ। তোকে শাস্তি দিলে যেমন আমার বোনটাকে আমি ফিরত পাবো না, ঠিক তেমনি তোকে শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দিলেও তো আমার বোনটা ফিরত আসবে না। আমার বাচ্চাটাকে আমি মায়ের আদর, বাবার স্নেহ দিয়ে একটু একটু করে সব দুঃখ কষ্ট থেকে আসলে বড় করেছি। সেই বাচ্চাটাকেই আমার হারাতে হয়েছে শুধুমাত্র তোর জন্য রোদ। তোকে আমি তো মাফ করবো না। রশ্নি আমার সামনে এসে মাফ করতে বললেও করতাম না। কেন জানিস? আমার পিচ্চিটাকে আমি নিজের চোখে সামনে তিলে তিলে কষ্ট পেতে দেখেছি, তোর জন্য অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বাচ্চাটার চোখের নিচে কালি পড়তে দেখেছি, আমার কোলে মাথা রেখে নিজের সন্তানের মতো করে মানুষ করা বোনকে শেষনিঃশ্বাসটা ফেলতে দেখেছি রোদ। তোকে তো আমি ক্ষমা করবো না কোনোদিনই। কিছুতেই না। 

তাসমিদের নাক মুখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। হাতে একটা পিস্তল সোজাসুজি রোদের দিকে তাক করে ধরে সামনের দিকে টলমলে পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে কথাগুলো বলছিল তাসমিদ। ভোর ভয়ে পিছন থেকে রোদের শার্ট খামচে ধরেছিল। রোদ ভোরকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে সোজা তাসমিদের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। রোদ চায় না নিজের কোনো একটা বোকামির মাশুল ভুল করেও ভোরকে দিতে হোক। রোদ চেষ্টা করলেই হয়তো তাসমিদের হাত থেকে পিস্তলটা ছিনিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু কাজটা ভোরের জন্য রিস্কি হয়ে যাচ্ছে দেখে অপেক্ষা করছে রোদ। তাসমিদের আরো কিছুটা সামনে এগিয়ে আসার অপেক্ষা। কিন্তু এর আগেই যদি লোকটা রাগের বশে গুলি চালিয়ে দেয়?

-তুই কি ভেবেছিস সামান্য দুটে ভাড়াটে গুন্ডাকে টপকে এখানে আসতে পেরেছিস মানেই ভোরকে নিয়ে পালাতে পারবি? এতোই কি সহজ? এই যে দেখ আঁজলা ভরে যে পিচ্চিটার কবরে মাটি দিয়েছি, মাটির সেই গন্ধটাও এখনো হাতে লেগে আছে। এতো সহজে কি সেই গন্ধটা চলে যাবে? এতো সহজেই কি করে মাফ করবো তোকে? আমার বোনের খুনিকে মাফ করলে বোনটার সামনে কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো বল? 

তাসমিদ কিছুটা দূরত্ব রেখে রোদের দিকে পিস্তল তাক করে ট্রিগারে আঙ্গুল বসিয়েছে এমন সময় আরো দুজন লোক রুমে ঢুকলো। লোক দুজন তাসমিদের ভাড়া করা গুন্ডা। তাসমিদের রক্তাক্ত চেহারা আর হাতে পিস্তল দেখে কিছুটা ভড়কে গেল লোকদুটো। তাসমিদ ওদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করতেই একজন ভোরকে টেনে রোদের কাছ থেকে সরিয়ে আনলো, অন্যজন রোদকে শক্ত করে জাপটে ধরে রাখার চেষ্টা করলো। লোকগুলো পিছন থেকে আসায় রোদ খেয়াল করে নি। ভোরকে টেনে সরিয়ে নিতেই রোদ টের পেল লোক দুটোর উপস্থিতি। ততক্ষণে অন্যজনও রোদকে আটকে রাখার চেষ্টা করেও ততটা সফল হচ্ছে না। রোদ লোকটাকে উল্টে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলতেই তাসমিদের পিস্তলটা গর্জে উঠলো। ভোর ভয় পেয়ে চোখ বুজে নিল। রোদও আর চমকে গেল গুলির শব্দে। তাসমিদ যে বাতাসে ফায়ারিং করে ওকে সতর্ক করে দেয়ার চেষ্টা করছে সেটা বুঝতে সমস্যা হলো না রোদের। 

-চালাকি করার চেষ্টা করলে পরের গুলিটা ভোরের গায়ে গিয়ে লাগবে রোদ। আশা করি সেটা তুই চাইবি না।

-ভোরকে যেতে দে তাসমিদ। আর তোর ওই লোককে বল ভোরকে ছাড়তে। নইলে আমি ওর একটা হাড়ও আস্ত রাখবো না।

-হা হা। আগে নিজেকে তো বাঁচা? তারপর নাহয় ভোরকে নিয়ে ভাবিস। একটুও চালাকি করার চেষ্টা করলে----।

রোদকে কথাগুলো বলতে বলতেই তাসমিদ হঠাৎ করে থমকে গেল। খটখট করে বেশ অনেকের এদিকেই আসার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। এই জনশূন্য ফ্যাক্টরিতে এতো রাতে কে আসতে পারে কথাটা ভাবতে ভাবতেই রুমটা ভরে গেল সাদা শার্ট কালো প্যান্ট পরা লোকে। লোকগুলোর দিকে পিস্তল তাক করামাত্রই ঘরভর্তি সবগুলো লোক চোখের নিমিষে তাসমিদের দিকে পিস্তল তাক করলো। আর ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটলো যে তাসমিদ অবাক হওয়ারও বোধ হয় সময় পেল না। রোদ একবার তাসমিদের দিকে তাকিয়ে ভোরকে ধরে রাখা লোকটার নাক বরাবর ঘুষি দিলো। লোকটা ছিটকে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়তেই কেউ একজন এসে গুন্ডা দুজনকে টানতে টানতে রুমের বাইরের দিকে নিয়ে চললো। তাসমিদ থতমত খেয়ে শুধু ঘটনাটা দেখছে। কিছু যে বলবে সেই ক্ষমতাও যেন তার নেই। রোদ সেটা দেখে একটু হেসে তাসমিদের দিকে এগিয়ে এসে তাসমিদের হাতটা নামিয়ে দিলো।

-আমার ভোরের দিকে চোখ তুলে তাকানোর শাস্তিটা কি হতে পারে সেটা কল্পনা করতে পারলে কখনো এই কাজটা করার সাহস তুমি পেতে না মিস্টার তাসমিদ। কিন্তু তোমাকে কিছু করবো না আমি। রশ্নির ব্যাপারটায় আমি নিজেও দুঃখিত------।

-একদম ন্যাকামি করবি না রোদ। এতোগুলো লোক নিয়ে এসে কি ভেবেছিস জিতে গেছিস তুই? তোর এই লোকেরা কয়দিন আটকে রাখবে আমাকে? একদিন, দশদিন, এক বছর, দশ বছর? তারপর? এক না একদিন আমি আবার তোর সামনে এসে দাঁড়াবো।সেদিন আর কথা হবে না। সোজা গুলি হবে তোর কপাল বরাবর----।

-সেটা নাহয় সময়ই বলে দিবে। আপাতত ভোরকে কিডন্যাপিং করার জন্য কয়দিন জেলের বাতাস খেয়ে এসো-----।

-সাথে বাল্যবিবাহেরও একটা কেইস ফাইল করবো আমি এই লোকটার বিরুদ্ধে-----।

দরজার দিক থেকে একটু ভারি একটা কণ্ঠস্বর শুনে রোদ আর তাসমিদ দুজনেই তাকিয়ে বয়স্ক কাজীসাহেবকে দেখতে পেল। কাজীসাহেব এগিয়ে এসে ভোরের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

-আপনি ঠিক আছেন মামনি? 

-জি।

-আপনার বয়সী আমার একজন মেয়ে আছে। আপনার মুখটা দেখে মনে হলো যেন আমার মেয়েই কোনো বিপদের মধ্যে আছে। এই ছেলেটা যে জোর করে মেয়েটাকে আটকে রেখে বিয়ে করতে চাইছিল সেটা বুঝতে আমার দেরি হয় নি। মেয়ের ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি, এই মর্মে আমি বাদি হয়ে মামলা করবো এই লোকের বিরুদ্ধে। আমি পুলিশে খবর দিয়েই এসেছি--। অবশ্য আপনারা এসে পড়ায় ভালোই হয়েছে। 

রোদ কাজী সাহেবকে সালাম দিয়ে সাদা পোশাক পরা লোকগুলোর দিকে তাকালো। 

-এই লোকটাকে গ্রেফতার করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ আশা করি আপনারা পেয়েছেন? আমি এখন ভোরকে নিয়ে ফিরতে পারি?

-খবরদার কেউ এক পা ও সামনে আসবে না। আমি গুলি চালিয়ে দিবো। 

তাসমিদ সু্যোগ পেয়ে হাতের পিস্তলটা রোদের দিকে উঁচিয়ে ধরতেই পিছন থেকে কেউ একজন তাসমিদের হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিলো। সাদা পোশাক পড়া লোকগুলো তাসমিদের হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার সময়ও লোকটা চিৎকার করে কিছু বলছিল। সেদিকে পাত্তা দিলো না রোদ। সালাম জানিয়ে কাজীসাহেবের সাথে হ্যান্ডশেইক করলো। ততক্ষণে মেঘও এসে পৌঁছেছে পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরিটায়। সবার সাথে টুকটাক কথা সেরে সবাইকে বিদায় দিয়ে ভোরের দিকে তাকালো রোদ। মেয়েটা এখনো ভয়ে রোদের শার্টের পিছন দিকটা খামচে ধরে আছে। মেঘ রোদকে ইশারা করে ভোরকে নিয়ে যেতে বললো। রোদও মাথা নেড়ে আলতো করে ভোরকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বেরিয়ে এলো এই ভয়াল অন্ধকারে ঢাকা রুমটা থেকে। ভোরকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে মেঘের দিকে তাকালো রোদ। 

-থ্যাংকস এ লট ভাই। আজ তুই না থাকলে হয়তো আমি আমার ভোরকে আজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলতাম। থ্যাংকস ইয়ার।

-আরে ভাই, প্রিয়জনকে কাছে না পাওয়ার কষ্টটা আমি জানি। চাই নি তুইও আমার মতো তিলে তিলে মরিস। আর বড় ভাই হিসেবে ছোটো বোনকে সেইফ রাখার দায়িত্ব তো আছেই না বল? 

-সত্যিই মেঘ। তোর মতো বন্ধু পাওয়া আসলেই আমার ভাগ্য---------।

-ভোরকে ভাবি না বলে বোন বলছি তাতে কি তোর হিংসে হচ্ছে ভাই? এমন ফর্মালিটি করছিস যেন আমি অচেনা কেউ একজন। মনে হচ্ছে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখা, আর আমি তোর উপকার করেছি বলে তুই আনন্দে গদগদ হয়ে বারবার থ্যাংকস বলছিস। অদ্ভুত!

-মেঘ! বাদ দে। তোর সাথে ভাই কথায় জিতা মুশকিল। আমি ভোরকে নিয়ে রওনা হচ্ছি তাহলে।

-সাবধানে যা। আর ওকে একটু সামলে রাখিস। অনেক ভয় পেয়ে গেছে দেখছিসই তো। আবার নিজে রাগ করে বকিস না। 

-আরে না না। পাগল নাকি?

-এটা রাখ। কাজে লাগবে। 

-কি এটা মেঘ?

-আরে রাখ তো ভাই। পরে দেখে নিস। আশা করি পছন্দ হবে। 

-ওকে। আসি এখন। বায়।

মেঘের দেয়া শপিংব্যাগটা পিছনের সিটে রেখে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো। ভোরের দিকে এক নজর তাকিয়ে মেঘকে আরেকবার বিদায় জানিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো। অলরেডি নয়টা বেজে গেছে। ভোরকে এই অবস্থায় বাড়িতে কি করে নিয়ে যাবে সেটাই মাথায় আসছে না রোদের। আর এদিকে ভোর মাথা নিচু করে যে কাঁদছে থামছেই না। রোদ একটু পর পর ভোরের কান্নাভেজা মুখটা দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেললেও মুখটা তুলে একবারও রোদের দিকে তাকাচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে রোদ হাত বাড়িয়ে ভোরের চুলে হাত রাখলো। তাতে বোধহয় মেয়েটার কান্নার গতি আরো বেড়ে গেল। 

-ভোরসোনা? কি হয়েছে পাখিটা? এখনো কাঁদছিস কেন এভাবে? সব তো ঠিক হয়ে গেছে ভোর? এই? তাকা না আমার দিকে? ভয় পেয়েছিস সোনাপাখি? আমারও উচিত হয়নি আমার পাখিটাকে এভাবে একা রাখা। কোনো সিকিউরিটি ছাড়া। সরি রে ভোর। কি রে? তাকা না আমার দিকে? সরি বলছি তো?

ভোর এবারেও কোনো রেসপন্স করছে না দেখে রোদ গাড়িটা ব্রেক করে ভোরকে নিজের কোলে টেনে নিয়ে দুহাতে ভোরের মুখটা তুলে ধরলো। ভোর কোনো বাধা দিলো না। ভোরের বন্ধ চোখজোড়া বেয়ে উষ্ণ কান্নার বৃষ্টি ঝরছে দেখে রোদের বুকের ভিতরটা কেউ যেন নাড়া দিয়ে গেল। ভোরের ভিজে চোখজোড়া মুছে দিয়ে ভোরকে নিজের সাথে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো রোদ। 

-কেন কাঁদছিস এভাবে ভোর? সব তো ঠিক আছে। আর কিছু যদি ঠিক না ও থাকে তবে তোর রোদ সবটা আগের মতো করে দিবে। এই ভরসাটুকু অন্তত করতে পারিস ভোর। 

-বাসায় সবাই যখন জানবে এসব ঘটেছে তখন কি হবে ভাবতে পারছ? সবাই ভাববে---------।

-কেউ কিচ্ছু ভাববে না পাগলি। আমি সব ঠিক করে দিবো তো পরীটা। একটু কান্নাটা থামা প্লিজ? তোর কান্না আমার বুকে কতোটা ক্ষত তৈরি করে সেটা কি জানিস না ভোর? আর এই মেয়ে? এতো কাঁদবি কেন তুই? আমি কি মরে গেছি? আমি মরে গেলেও কাঁদবি না তুই, বুঝেছিস? অন্য কোনো দুনিয়ায় চলে গেলেও তোর কান্না আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবে না রে ভোর। তাই যা ই হয়ে যাক না কেন কখনো কাঁদবি না আর। মনে থাকবে?

-----------------------------------------

-আমার ভোরপাখিটা ভিষণ দুষ্টু হয়েছে না রে? কোনো কথাই শোনে না আজকাল। এতো সাহস কিন্তু একদম ভালো না ভোর। তোর সাহস আজ আমি বের করছি দাঁড়া না? এতো সাহস আমি কাঁদতে বারণ করছি তবু সে মরাকান্না করেই চলেছে। আজ তোর হচ্ছে দাঁড়া ভোর। 

রোদ আরো কিছু বলে ভোরকে চমকে দেয়ার আগেই রোদের মোবাইলটা সশব্দে বেজে উঠে ওদের দুজনকেই চমকে দিলো। ভোর রোদের উপর থেকে সরে আসার চেষ্টা করলেও রোদ ভোরকে সরতে না দিয়ে আরো কিছুটা নিবিড় কীে জড়িয়ে নিয়ে মোবাইলটার বের করে স্ক্রিনে নামটা দেখে কিছুটা আঁতকে উঠলো। ভোর আর রোদ দুজনেই প্রায় একসাথেই খেয়াল করলো ব্যাপারটা। ঘড়িতে সাড়ে নয়টা বাজ, আর কলটা করেছে আতিক আহমেদ, রোদের বাবা। এখন উনাকে কি জবাব দিবে সেটা ভেবেই ওদের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সত্যিটা না বললে বাবা আবার রোদের উপরে খেপে যাবে। কিন্তু সত্যিটা বললে যে কি হবে সেটা ভেবেই মেরুদন্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে রোদের। একটা দিনের জন্য এতো টেনশন কি যথেষ্ট নয়? নাকি আরো বাকি আছে কিছু?

২৪!! 

-সাড়ে নয়টা বাজে রোদ। আর কতোক্ষণ লাগবে তোমার ভোরকে নিয়ে বাসায় ফিরতে? এতো রাত পর্যন্ত মেয়েটা যে বাড়ির বাইরে আছে সেটা কি ভালো কথা? 

কলটা রিসিভ করতেই প্রথমে এই কথাগুলোই কানে গেল রোদের। কি বলবে ভেবে ঠিক করতে পারেনি বলে রোদ এখনো চুপ করেই আছে। তার উপরে ভোর রীতিমতো কাঁপছে। সকালে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে যে সামান্য একটু খেয়েছে তারপর নিশ্চয়ই মেয়েটা কিছু খায়ও নি। এভাবে সারাদিন না খেয়ে থাকলে তো শরীরটাও খারাপ হবে। আর পরীক্ষার আগে আজকের ট্রমাটা কাটতে কয়দিন লাগবে সেটা নিয়েই চিন্তা হচ্ছে রোদের। তার উপরে আবার যদি শরীর খারাপ হয় তখন এতোদিক একসাথে সামলাবে কি করে? 

-চুপ করে আছো কেন রোদ? আমার কথা কি তোমার কানে যায় নি? কতোটুকু পৌঁছেছ তোমরা? আর ভোর? ভোর কোথায়?

-ভোর আমার কাছেই আছে আব্বু। আর সরি। আমরা আজকে ফিরছি না। সরি আব্বু। ভোরের এতোটা জার্নি করা আজ উচিত হবে না। এখন রাখছি বাবা। আমি তোমাকে একটু পরে কল ব্যাক করছি।

রোদের কথায় মনে হলো আতিক আহমেদের মাথায় কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। রোদ ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার আগেই আতিক আহমেদ রাগে উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরির আকার ধারণ করলেন মোবাইলের অন্যপ্রান্তে। 

-তোমার সাহস কি করে হয় রোদ কোথাকার কার বিয়েবাড়িতে ভোরকে রেখে আসার? এই অধিকারটা তোমাকে কে দিয়েছে? অধিকার ফলাতে এসেছ তুমি? সারাজীবন তোমার জন্য মেয়েটার কোনো না কোনো ক্ষতি হয়েছেই। একদম জন্ম থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত তোমার কোনো সিদ্ধান্ত ভোরের পক্ষে ভালো হয়নি। আমি জানি আজও হবে না। তাই আমি চাই না তোমার কোনো গাধার মতো সিদ্ধান্তের জন্য আমার ভোর মায়ের কোনো ক্ষতি হোক। বুঝতে পেরেছ তুমি রোদ? তুমি ভোরকে নিয়ে এক্ষুণি বাসায় ফিরবে রোদ। এক্ষুণি মানে এক্ষুণি। নইলে আমি প্রয়োজনে পুলিশ কমপ্লেইন করে হলেও-----।

-অনেক বলেছ বাবা। এবার আমার কথা শোনো। বলছিলে না আমি সবসময় ভোরের জন্য ভুল ডিসিশন নেই? তোমরা কি করেছ তাহলে? একটা সাইকো ক্রিমিনালের হাতে আমার ভোরকে তুলে দিতে চেয়েছ। কি ভাবো কি তুমি? আমি কি বুঝি না? বোকা আমি? তাসমিদকে পড়াতে আসতে নিষেধ করায় তোমার এতো অবজেকশন কেন ছিল আমি বুঝি না ভেবেছ? কি ভেবেছ কি তুমি বাবা? আমাকে এটা সেটা বুঝিয়ে ভোরের থেকে দূরে সরিয়ে ওই তাসমিদের সাথে বিয়ে দিতে? এতোই সহজ বাবা ভোরের কাছ থেকে রোদকে আলাদা করে দেয়া? আর শোনো বাবা। আমি ভোরকে নিয়ে তোমাদের ওই বন্দীশালায় আর কোনোদিন ফিরবো না। প্রয়োজনে ভোরের পরীক্ষাও দেয়া লাগবে না। আমি রাস্তায় রাস্তায় পাথর ভেঙ্গে হলেও আমার বউকে মাথায় করে রাখতে পারবো। কিন্তু তোমাদের ভরসায়? নো ওয়ে। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে আমার। আর না।

-রোদ?

-ও হ্যাঁ? তোমার তাসমিদের খবর তো তোমাকে জানানো হয় নি বাবা। মেঘকে কল করে ওই হারামজাদার বর্তমান অবস্থাটা জেনে নিও। আর এটাও জেনে নিও কেন ওই শয়তানটার এই দশা করেছি আমি।

-রোদ? কি করেছ তুমি তাসমিদের সাথে? আর ভোর কোথায়? আবার-----।

-আবার নয় আব্বু। যে কাজটা আমার আগেই করা উচিত ছিল সে কাজটা আমি আজ করেছি। কিন্তু আফসোস! আমার ভোরের দিকে যে চোখ দুটো বাজে নজর দিয়েছে সেই দুটো চোখই এখনো অক্ষত রয়ে গেছে, যে হাত আমার ভোরকে অসম্মানের জন্য ধরতে চেয়েছে সেই দুটো হাতও আমি উপড়ে ফেলতে পারি নি। তবে বাবা তোমাদের কারো ভরসায় আমি আমার ভোরকে আর এক মূহুর্তের জন্যও ছাড়বো না। আমি ওর পাশে থাকার পরও এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, আর আমি না থাকলে কি হতো তাহলে একবার ভাবতে পারছ? না বাবা। আজকের পর আমার ভোরকে আমি নিজে আগলে রাখবো। নিজের মতো করে আগলে রাখবো। প্রয়োজনে ওকে নিজের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখবো। কিন্তু তোমাদের কাছে ওকে আমি আর কক্খনো দিবো না। কিছুতেই না। 

-রোদ? বেশি বাড়াবাড়ি না করে বলো তোমরা কোথায় আছো? একবার বলছ বিয়েতে গেছ, একবার বাড়ি ফিরবে না এসব কি?

-বিয়ে? হাহ্! বাবা তুমি এতো বোকা কেন বলো তো? কেউ ভোরের দিকে এক নজর তাকালেও আমার সহ্য হয় না জানো তো নাকি? তবু কি করে ভাবলে ওকে আমি কোথাকার কার বিয়েতে যেতে দিবো? কি করে ভাবলে ওকে একা ছেড়ে আমি বাসায় পড়ে পড়ে ঘুমোবো?  হাহ! তুমিও না বাবা! শোনো বাবা ভোর ভালো আছে এখন। আমার কাছেই আছে। কথা বলতে চাও? বলতেই পারো। কিন্তু আমার বউকে আমি আর আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিতে দিবো না। তুমি এবার যা ইচ্ছে করে নাও না কেন। লিগ্যালি শি ইজ মাই ওয়াইফ, সেটা তুমি মানো বা না মানো। রাখছি বাবা। 

-রোদ? 

বাবার কথাটা না শুনেই কলটা কেটে দিয়ে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলো রোদ। ভোরের কথা খেয়াল হতেই ভোরের দিকে তাকিয়ে দেখলো ভোর চোখ বড় বড় করে রোদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ভোরের ভ্যাঁবাচ্যাঁকা খাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে রোদ হেসে ফেললো। ভোরকে নিজের বুকের সাথে আরেকটু শক্ত করে মিশিয়ে নিলো রোদ। ভোরের কানে তখনও রোদের বলা কথাগুলোই বাজছে। শুধু কথাগুলোর মানেই ভোরের মাথায় ঢুকছে না কেন জানি।

-সব বলবো আজ আমার বউটাকে কেমন? আগে আমরা বাসায় ফিরি কেমন ভোরপাখি?

-একটু আগেই না তুমি বড়আব্বুকে বললা বাসায় যাবা না? তাহলে?

-আরে পাগলি! তোর বড়আব্বুর বাসায়ও না, তোর আব্বুর বাসাতেও না। আমাদের বাড়িতে। তোর আর আমার। শুধু আমাদের বাড়ি ওটা। যাবি?

-হ্যাঁ? কি! আমাদের মানে?

-ভোরের রোদ তো তার বউটার জন্য অনেক আগে থেকেই একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছিল। সেই টাকায় একটা ছোটোখাটো বাড়ি হয়েছে দুজনের। ভেবেছিলাম যেদিন সব বাধা পেরিয়ে লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়িতে আমার সামনে এসে দাঁড়াবি সেদিন তোকে বাড়িটায় নিয়ে আসবো। সেটা আর হলো কই? 

-তাহলে আজই বাড়িতে নিচ্ছ কেন?

-তুই লাল বেনারসিতে সাজলেও আমার বউ, এই বাচ্চা বাচ্চা স্কুলের ড্রেসটাতেও শুধু আমারই বউ। তোকে তোর বাড়িতে নিয়ে যেতে এতো কিছু কি ভাবার দরকার আছে বল? 

-আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কি বলছ তুমি এসব?

-আর একটু অপেক্ষা কর ভোরপাখি। সব বলবো। এখন একটু লক্ষী মেয়ের মতো চুপটি করে বসে থাক কেমন? আমি এই যাবো আর আসবো।

-এই এই? আমাকে একলা রেখে কোথায় যাচ্ছ? আমিও যাবো। আমাকে নিয়ে যাও যেখানে যাবা। আমার একা একা ভয় করবে-----।

-এই রে! পিচ্চি বউটা আমি সামনের রেস্টুরেন্টটায় যাচ্ছি। সকাল থেকে যে না খেয়ে আছে আমার বউটা সে খেয়াল আছে হ্যাঁ? শোন পাখি একটুও ভয় পাবি না। আমি যাবো আর খাবারটা নিয়েই চলে আসবো কেমন? রেস্টুরেন্টে এখন তো অনেক মানুষ থাকবে সোনাপাখি। এতোগুলো মানুষ তোকে এই অবস্থায় দেখবে আমি সেটা মরে গেলেও মানতে পারবো না রে। 

-ওপস! সরি সরি। আমি তো ভুলেই গেছিলাম----।

-শশশশশ। চুপ। আবার সরি কেন? চুপ করে বস তুই। আমি নাস্তাটা নিয়ে আসি।  তারপর আবার বাসায় যেতে হবে তো।

-হুম। আচ্ছা।

-ভোর?

-হুম?

-তুই না যেতে চাইলে জোর করবো না। তোর ইচ্ছে না করলে বল তোকে বাড়িতে দিয়ে আসবো আমি। সমস্যা নেই। পরে সময় করে-----।

-নাহ আমি যাবো। 

-সত্যি যাবি? ভয় পাবি না তো?

-ভয় পাওয়ার কি হলো? তুমি কি ভূতুড়ে বাড়িতে থাকো নাকি?

-ভূতুড়েই বটে। আমার চেয়ে বড় ভূত আর কে আছে বল তো? তোর ঘাড়টা টুপ করে মটকে দিলে কি করবি তখন? 

-ইশ! আমি বাচ্চা না ওকে? ভূত টূত বলে কিচ্ছু নেই। জানি আমি।

-তাই নাকি? আমার সাহসীরাণী। ভূত আছে কি নেই সেটা আজ দেখাবো তাহলে তোকে। পরে কিন্তু ভয় পেয়ে বেহুঁশ হলে আমার দোষ দিতে পারবি না বলে দিচ্ছি ভোর।

-হ্যাঁ! কি!! কি বলছ এসব?

-হা হা। এই আমার সাহসী রমণী! হায় রে! চুপচাপ বসে থাক। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবো। আশা করি এই পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোকে নিতে ভূতের দল চলে আসবে না।

-রোদ? ভালো হবে না। 

-ওলে বাচ্চাটা! মোবাইলটা তোর কাছে রাখ। ছোটোমার সাথে কথা বলে নে। আর খবরদার বাবাকে কিচ্ছু বলবি না। তাহলে কিন্তু-----।

-কি বলবো না?

-উফ! তুই বাড়িতে কথা বল তো কল করে। আমি যাই। দেরি হচ্ছে অনেক।

-হুম। আচ্ছা।

ভোরকে পাশে বসিয়ে দিয়ে আলতো করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়ালো। এদিকে রোদের কলটা কেটে দেয়ার পর আতিক আহমেদ নিজের মোবাইলটা আছড়ে ফেললো ফ্লোরে। ভোরের বাবা মা, আর রোদের মা সেটা দেখে ছুটে এলেন আতিক আহমেদের দিকে। 

-ভাইজান? কি হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? রোদ কি বললো? 

-তোমরা ওকে আস্কারা দিয়ে কতোটা মাথায় তুলেছ দেখছ এখন? ওই ছেলে নাকি ভোরকে নিয়ে আর বাসায় ফিরবে না। ওর সাহস হয় কি করে ভোরকে বাড়িতে না নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখার?

-ভাইজান কি বলছ এসব? কাল সকালেই দেখবে চলে আসবে। আর বিয়ে বাড়ির ব্যাপার। বুঝতেই পারছ----।

-ওরা কোনো বিয়েতে যায় নি। সবটাই মিথ্যে, বানানো গল্প ছিল।

-মানে! কি বলছ এসব ভাইজান? তাহলে যে আভা বলেছিল--------?

-সবটা মিথ্য ছিল। তাসমিদ নাকি ভোরকে কিডন্যাপ করেছিল। ভয় নেই। এখন ভোর সেইফ আছে। রোদের সাথেই আছে। কিন্তু আজকের দিনটার জন্য তোমরা রোদকে মাফ করলেও আমি কোনোদিন মাফ করবো না। ওর সাহস হয় কি করে এই পুরো ব্যাপারটা আমাদেরকে না জানিয়ে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেয়ার? আজ ভোরের যদি কিছু একটা হয়ে যেত?

-ভাইজান? মাথাটা ঠান্ডা করো। রোদকে ব্যাপারটা পরেও বুঝিয়ে বলা যাবে। ওর মাথায় তখন যা এসেছে ও তাই করেছে। কিন্তু ভোরকে তো ফিরিয়ে আনতে পেরেছ বলো? এখন শুধু একবার ভোরের সাথে কথা বললেই দেখবে টেনশনটা একটু হলেও কমবে। রোদ কিন্তু ঠিকই করেছিল। লোক চিনতে এতোটা ভুল করলাম আমরা?

-রোদ রোদ রোদ! আর কতোবার রোদের সাফাই গাইবে তোমরা? ভোরের জীবনে আজ পর্যন্ত যত বিপদ এসেছে সবগুলোই শুধু রোদের জন্য। তোমরা দুজনে মানো আর না মানো ভোরের জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো রোদ। রোদের কারণে আমরা ভোরকে কতবার প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলাম। তবু তোমরা সেই-----। 

-বারবার মেয়েটাকে ফিরেও তো পেয়েছি রোদের জন্যই ভাইজান। আমরা যতবার ভোরের বাঁচার আশাটাও ছেড়ে দিয়েছিলাম, ততবার ছোট্টো রোদের প্রার্থনাতেই হয়তো আল্লাহ ভোরকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেন নি। সেটা তো স্বীকার করতেই হবে বলো?

-আর যে জন্মের পর থেকে রোদই কালো ছায়া হয়ে ভোরের জীবনে ঘুরছে সেটার কথা ভুলে গেলে? রোদের খেলনা গাড়ির উপরে পা পিছলে বউমা যখন পড়ে গিয়েছিল মনে আছে সেদিনের কথা? ডাক্তাররা তো আশা ছেড়েই দিয়েছিল সেদিন। 

-ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল ভাইজান। কেন বুঝো না বলো তো? সেই তো বলতে গেলে অলৌকিকভাবেই আল্লাহর দয়াতে ভোর আর ওর মা বেঁচে গেছিল। তারপরেও তো সবাই আমরা বলেছিলাম মেয়েটা হয়তে বাঁচবে না। শুধু রোদই একমাত্র যে ভোরকে রাখা রুমটার বাইরে অপেক্ষায় বসেছিল ভোরকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে বলে। ভুলে গেলে সব?

-কিচ্ছু ভুলি নি আমি সাদিক। তুমি আর তোমার বউ কার না কার কথায় হুজুর ডেকে রোদের হাতে ভোরকে তুলে দিলে। দুটো অবুঝ শিশু ছিল ওরা! এটাকে নাকি আবার বিয়ে বলে! তোমাদের এই আস্কারাতেই ছেলেটা এখন মাথার উপরে উঠে গেছে। নইলে ওর সাহস হয় কি করে ভোরকে বাড়িতে আনবে না বলার? আমি কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। এর পরও যদি ওই ছেলে ভোরকে নিয়ে বাসায় না ফিরে, তাহলে দরকার করে আমি থানা পুলিশ করবো বলে দিলাম। তখন তোমরা কিছু বললেও আমি শুনবো না বলে দিলাম।

-আরে ভাইজান? কথাটা তো শোনো আমার?

আতিক আহমেদ গটগট করে নিজের রুমের দিকে চলে যাচ্ছেন দেখে ভোরের বাবা সাদিক আহমেদও ভাইয়ের পিছন পিছন ছুটলেন। ভোর আর রোদ একসাথে আছে শুনে আপাতত ওদেরকে নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। চিন্তা বড় ভাইজানকে নিয়ে। মিছেমিছি নিজের জেদ আর রাগের বশে আবার নতুন কি কান্ড ঘটিয়ে বসে থাকবে কে জানে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন