২১!!
রিশাদের কাঁপা হাতের অবর্থ্য নিশানা খুব সহজেই নিজের লক্ষ্য ভেদ করতে পারতো। কিন্তু সেটা হয়ে উঠলো না। কাঁচের ফুলদানিটা ফ্লোরে শত টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ায় আগেই রিশাদও শেষ মূহুর্তে কারো আচমকা থাপ্পড়ে ছিটকে রুমের মেঝেতেই পড়লো। আর প্রায় সাথে সাথেই কাঁচের বেশ কয়েকটা টুকরোও এলোপাথাড়ি গেঁথে গেল রিশাদের পায়ে, হাতে, কনুইয়ের। রিশাদ ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে মুখ তুলে তাকাতেই আরহান সাহেবের দিকে চোখ পড়লো। সদা হাসিখুশি মানুষটার চোখ মুখ দিয়ে আজ প্রথমবার মতো রাগের লালিমা রঙ ফুটে উঠতে দেখলো রিশাদ আর বাকিরা। রিশাদ কাঁচের ফুলদানিটা বেখেয়ালি অরণ্যের মাথা বরাবর লক্ষ্য করে ছোঁড়ার আগেই আরহান সাহেব কষিয়ে চড় বসিয়েছিলেন রিশাদের গালে। অরণ্যের কাজিনরা এতোক্ষণে রিশাদের আসল রূপটা প্রথমবারের মতোই বুঝতে পেরেই হয়তো আর এগিয়ে গিয়ে রিশাদকে ফ্লোর থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করলো না। উল্টো সবাই অরণ্যকে ঘিরেই ভিড় করেছে কিছু হয়েছে কিনা সেটা জানার জন্য। কাঁচের টুকরো হাতে পায়ে ঢোকার পরও সবাইকে অরণ্যের পাশেই গিয়ে দাঁড়াতে দেখে রিশাদের মাথায় যেন কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কোনোমতে কাঁতরে কাঁতরে উঠে দাঁড়িয়ে অরণ্যের দিকে এগিয়ে গিয়ে রাগে, ক্ষোভে চিৎকার করে উঠলো।
-তুই চাস টা কি অরণ্য? আজীবন সবার চোখে হিরো হয়ে থেকে আমাকে সবার সামনে ভিলেন বানাতে চাস? কার সাথে কি করেছি আমি? অনামিকার সাথে? কি করেছি? ওকে ডাক সবার সামনে? সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলুক কথাগুলো? নাকি নিজের বউয়ের দোষ ঢাকতে আমাকে বলির পাঠা বানাচ্ছিস? হাহ। একটা মেয়ের জন্য যে ভাইয়ের ভাইয়ের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় সেটা এতোদিন সবার মুখেই শুনে এসেছি। আজ নিজের চোখে দেখলাম।
অরণ্য রাগের মাথায় রিশাদের দিকে এগিয়ে আসার আগেই অরণ্যের একটা কাজিন সিফাত, ১৯/২০ বছরের ছেলে এগিয়ে এসে রিশাদের সামনাসামনি এসে দাঁড়াতেই রিশাদ আর অরণ্য দুজনকেই কিছুটা অবাকই হলো।
-তুমি কি বলতে চাও রিশাদ ভাইয়া? বড়ভাবি মিথ্যে কথা বলছে? কক্খনো না। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি তুমি প্রথম দিন থেকেই ভাবিকে কিছু নিয়ে বিরক্ত করছ। আমরা প্রথম যেদিন এলাম ভাবি কত হাসি খুশি ছিল। তুমি আসার পরেই ভাবির মুখটা শুকিয়ে যেত সবসময়। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ভাবিকে জিজ্ঞেসও করেছি। ভাবি শুধু মুখ কালো করে চুপ করে ছিল। সেদিন যে তুমি হুট করে রান্নাঘরে চলে গেলে? আমিও পিছন পিছন গিয়েছিলাম। কি বলছিলে আমি খেয়াল করি নি। কিন্তু মনে হলো তুমি যেতেই ভাবি ছিটকে একেবারে দেয়ালের সাথে সেঁধিয়ে গিয়েছিল---। কেন? নিশ্চয়ই তুমি ভাবিকে কিছু বলেছিলে।
-সিফাত? বাজে বকবি না একদম।
-আমি বাজে বকছি না। এই তোরাই বল---আমরা সবাই মিলে দুপুরে আড্ডা দিতে দিতে লাঞ্চ করবো বলে রেস্টুরেন্টে গেছি, তখন রিশাদ ভাইয়া কাউকে একবারও বলে গেছে যাওয়ার আগে? কখন গেছে আমরা জানিও না। পরে অরণ্য ভাইয়ার কল পাওয়ার পর না আমরা খেয়াল করলাম যে রিশাদ ভাইয়া সত্যি সত্যিই রেস্টুরেন্টে নেই----।
-তোদেরকে কি আমার কৈফিয়ত দিয়ে যেতে হবে? আমার আর্জেন্ট মিটিং ছিল একটা----।
-ওহ আচ্ছা। তাহলে দুপুরে লাঞ্চ করার পর আমরা সবাই টায়ার্ড, বাসায় আসতে চাইছিলাম। তুমি বারবার বারণ করছিলে কেন? অরণ্য ভাইয়া নিচে আমাদের সবার সাথে গেমস খেলবে বলে রাতে ভাবির সাথে ঝগড়া করার মতো নাটক করে নিচেই এসেছিল, গেস্টরুমে আমাদের সাথে শুয়েছিল, তবু তুমি এই রুমে এলে কেন? তারচেয়ে বড় কথা রুম তো লকড ছিল। তুমি রুমে ঢুকলে কি করে? তোমার কাছে ভাইয়ার রুমের চাবিইবা এলো কি করে? ভাবি তো রুমেই ছিল না। তাই এটা বলো না যে ভাবি দরজা খুলে দিয়েছে।
-নিজের লিমিটে থাক সিফাত। ছোটো ছোটোর মতো থাকবি। পাকামি করতে এলে কষিয়ে দিবো একটা চড়। সবাই মিলে আমাকে ফাঁসিয়ে দিতে চাইছিস তাই না? বাহ অরণ্য? একেবারে টিম রেডি করেই মাঠে নেমেছিস দেখছি! বাহ! ওরা কি জানে নিজের দুর্বলতা ঢাকতে আমাকে টোপ বানাতে চাচ্ছিস যে তুই?
রিশাদ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে অরণ্যের দিকে তাকাতেই এবারে আরহান চৌধূরী রিশাদের গালে আরেকটা চড় কষিয়ে দিলেন।
-অনেক ক্ষণ ধরে তোমার অসভ্যতা সহ্য করছি রিশাদ। আর না। নিজেকে কি ভাবো তুমি? তুমি আমাদের পরিবারেই একজন। তাই বলে তুমি একটা মেয়ের সাথে যা ইচ্ছে করতে পারবে? না। অনামিকা আমাদের বাড়ির বউ বলে নয়, কোনো মেয়ের সাথেই এতো জঘন্য কাজ করার অধিকার তোমাকে কেউ দেয়নি। সেই মেয়ে যতই খারাপ চরিত্রের, খারাপ কাজের সাথে লিপ্ত হোক না কেন, তাকে জোর করার অধিকার তোমার নেই। আর রইলো পড়ে তোমার কথা রিশাদ! তোমাকে ছোটোবেলা থেকে দেখে এসেছি। তাই বলে যে তোমার চরিত্রের ব্যাপারে অন্ধভাবে ক্যারেকটার সার্টিফিকেট দিয়ে অনামিকাকে দোষী বলবো এমনটাও নয়। তোমার বাবা মা যথেষ্ট ভালো মানুষ এটা মানতেই হয়। তোমার ছোটো বোনটাও আজ তোমার পক্ষ না নিয়ে প্রমাণ করলো যে রক্তের সম্পর্কের জন্য অন্ধবিশ্বাস না রেখে সত্যকে সাপোর্ট করা উচিত। আশা করি তোমার বাবা মা ও ব্যাপারটা সেভাবেই নিবেন যেভাবে প্রভা দেখেছে, বুঝেছে।
-আঙ্কেল বিশ্বাস করুন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে এখানে। আমি সত্যি কিছু করিনি-----।
-তুমি কি করেছ না করেছ সেটা তোমার কাজেই প্রকাশ পেয়ে গেছে রিশাদ। তুমি যদি নিরাপরাধ হতে তাহলে তুমি এতোক্ষণ, এতো রাতে এই রুমে থাকতে না। তোমার নিজের ছোটো বোনটা কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যেত না। তুমি যদি অন্যায় না করতে তাহলে অরণ্যের উপরে হামলা করতে না----।
-ওহ! সরি সরি সরি আঙ্কেল। আমার না ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন কিছু করবো না। প্রমিস। বাবা মাকে কিছু বলবেন না আঙ্কেল? প্লিজ আন্টি? প্লিজ অরণ্য? --------হা হা হা। এমন কিছুই শুনবেন আশা করেছিলেন না আঙ্কেল? আন্টি? সরি মাই ফুট! ওই দুই টাকার মেয়েটার জন্য তুই আমার গায়ে হাত তুলে কাজটা মোটেও ভালো করিস নি অরণ্য। এর ফল তো তোকে ভোগ করতেই হবে। আমার বোনের চোখেও আমাকে ছোটো করলি আজ তুই আমাকে। পৃথিবীতে এই একটা মাত্র মানুষের চোখেই তো আমি হিরো ছিলাম। আমার ছোটো বোনটার কাছে। তাতেও শান্তি হলো না তোদের না? তোর বউয়ের গায়ে সামান্য হাত লাগিয়েছি কি লাগাই নি তুই মাঝরাতে সবাইকে নিয়ে কন্সপিরেসি শুরু করে দিলি আমাকে সবার চোখে কালার করার জন্য! এর পর যা করবো তা তুই স্বপ্নেও ভাবতে পারবি না অরণ্য। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ। আর আমিও দেখি আমাকে আটকায় এমন ক্ষমতা কার আছে এখানে।
রিশাদ কথাগুলো বলতে বলতে পিছিয়ে যেতে যেতে দরজার কাছ পর্যন্ত এসেই আটকে গেল। পিছনে আরো কারো উপস্থিতি টের পেয়ে কষ্ট করে পিছন দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল রিশাদের। এতো রাতে এতোজন পুলিশ দেখে বেচারা ভয়ে আবার ভিজে বেড়ালটি হয়ে গেল। আবার যেন রাজ্যের ব্যথা যন্ত্রণা, কাতরতা সব দেখা দিল রিশাদের চোখে মুখে। আর বাকিরা হা করে রিশাদের এমন হঠাৎ ভোল বদলটা হজম করার চেষ্টা করলো। আরহান সাহেবও কয়েকপা এগিয়ে এসে রিশাদের ব্যথাকাতুরে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো।
-একটা সন্তান যদি কুসন্তান হয় তাহলে সবাই বাবা মায়ের দিকেই আঙুল তোলে সবসময়। বাবা মা যথেষ্ট শিক্ষা দিতে পারে নি, শাসন করে নি, ভদ্রতা, নম্রতা, আচার আচরণ কিছু শেখায় নি এসব বলে বাবা মাকেই গালিগালাজ করে। কিন্তু কি জানো রিশাদ? শিক্ষা যেমনই দিক না কেন সেটাকে কাজে লাগানো প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাপার। আর তাই সন্তানের কাজের দায় আমরা যতই বাবা মায়ের উপরে চাপিয়ে দিই না কেন, তার শাস্তিটা সেই কুসন্তানটিকেই দেয় বিচারে। তুমি যে এখন অফিসারদের সামনে এই ভালোমানুষ, নির্যাতিত ভিক্টিম সাজতে চাইছ সেটা কোনো কাজেই আসবে না। কেন জানো? এতোক্ষণ উনারা সবাই তোমার কথা শুনেছেন। এখন না, ঠিক যখন তুমি অরণ্যকে এ্যাটাক করলে তখন থেকেই দেখছেন। আর সিফাত তোমার কথাগুলো রেকর্ডও করে ফেলেছে আশা করি।
রিশাদ বিশ্রি কিছু গালিগালাজ করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই পুলিশের কয়েকজন অফিসার রীতিমতো টেনে হিঁচড়ে রিশাদকে নিয়ে যেতে লাগলো। সবাই হা করে দৃশ্যটা দেখছে। পুলিশদের সাথে রীতিমতো জঘন্য বিশ্রি ভাষা ব্যবহার করছে রিশাদ। পুলিশরা তবুও এক চুলও বিচলিত হয়নি। দাগী আসামির মতোই টানতে টানতে রিশাদকে নিয়ে চলে গেল তারা। আর বাকিরা হা করে দৃশ্যটা দেখলো। একটা মানুষ এতোটা নোংটা ভাষা উচ্চারণ করতে পারে কি করে সেটাই সবাই তাজ্জব হয়ে ভাবছে।
রিশাদকে নিয়ে পুলিশের লোকেরা চলে যাওয়ার পরও বেশ কিছুটা সময় সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিজেদের জায়গায়। একটু পরেই সবাই কোনোমতে ঘোর কাটিয়ে যে যার মতো রুমের দিকে চলে গেল। অরণ্য এক নজর স্তব্ধ হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে থাকা ফারহা আর তাহিয়ার দিকে তাকিয়ে হালকা করে গলা খেঁকারি দিলো।
-তোরা যা শুয়ে পড়। আমি অনুকে নিয়ে আসছি তোদের রুম থেকে। আর প্রভাকে একটু সামলে নিস। সকালে আঙ্কেল আন্টিকে আসতে বলেছি। আসার পরে কি হবে আমি জানি না। তবু এতো বড় ব্যাপারটা তো তাদেরও জানা উচিত। যা শুয়ে পড় এখন।
অরণ্য কথাগুলো বলতে বলতে তাহিয়ার রুমের দিকেই পা বাড়িয়েছে। অনুকে তাহিয়ার রুমে রেখে এসেই পুরো নাটকটা সাজিয়েছিল অরণ্য। মেয়েটা নিয়ে নতুন কোনো রিস্ক নিতে চায় নি অরণ্য। কিন্তু প্রভার জন্যও প্রচন্ড খারাপ লাগছে এখন অরণ্যের। হাজার হোক ছোটো একটা মেয়ে। এতো সব ধাক্কা কি করে সামলাচ্ছে কে জানে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অরণ্য তাহিয়ার রুমের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। আর ওর পিছু পিছু তাহিয়া আর ফারহা। তিনজনে তাহিয়ার রুমের ভিতরে চোখ পড়তেই থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইলো। এমন কিছু দেখবে সত্যিই আশা করে নি ওরা কেউই। অন্তত এতো রাতে এমন ঘটনা ওদের কল্পনারও বাইরে। অরণ্য, তাহিয়া আর ফারহা তিনজনই অবাক হয়ে খেয়াল করলো অনামিকা বিছানায় শুয়ে আছে। আর ওর পায়ের কাছেই পড়ে আছে-------।
২২!!
-প্রভা? এই প্রভা? কি হলো তোর? এভাবে ফ্লোরে বসে আছিস কেন? তাহু দেখ তো ওর কি হলো? ভুলভাল কিছু করে বসলো না মেয়েটা? উফ! শিট! ওর কিছু হলে আঙ্কেল আন্টির কাছে কি মুখে দাঁড়াবো বল তো? এই প্রভা? লক্ষী বোনটা না আমার? কি হয়েছে বল না? এই প্রভা?
অরণ্য রুমের দরজাটা খুলতেই ঘুমন্ত অনামিকার পায়ের কাছে প্রভাকে পড়ে থাকতে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল ছেলেটা। প্রভা অনামিকার পায়ের কাছে ফ্লোরে বসে থেকে মাথাটা এমনভাবে বিছানায় লুটিয়ে রেখেছে যে ভঙ্গিটা যে কাউকেই ভয় পাইয়ে দেয়ার মতোই। তাহিয়া আর ফারহা দুজনেই প্রায় ছুটে প্রভার কাছে গিয়ে গালে হাত দিয়ে বেশ কয়েকবার ডাকার পর প্রভা ধড়ফড় করে উঠে বসলো। অরণ্যও ততক্ষণে প্রভার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিল। এবারে বিছানায় বসে প্রভার চুলে মাথায় হাত বুলিয় দিল। প্রভা এবারে বাচ্চাদের মতে কেঁদে ফেলে অরণ্যের পা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতেই অরণ্য প্রভার হাতটা ধরে ফেললো চট করে। মেয়েটা তখনো কেঁদেই চলেছে দেখে বড্ড মায়াই হচ্ছে অরণ্যের।
-এই পাগলি মেয়ে? এভাবে কাঁদছিস কেন তুই? আর এভাবে পাগলের মতো ফ্লোরে বসে কি করছিস? ওঠ? অনুকে মেডিসিন খাইয়ে দিয়েছিলাম তো। ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। তোরাও ঘুমিয়ে পড়। রিশাদের ব্যাপারটা নিয়ে একদম কান্নাকাটি করবি না তুই। কাল আঙ্কেল আন্টি আসবে--। যা হবে কালই দেখা যাবে।
-ভাইয়া রে, আমি নিজের কানে না শুনলে হয়তো নিজেও বিশ্বাস করতাম না আমার নিজের ভাইটা এতোটা নিচ, এতোটা জঘন্য মেন্টালিটির----।
-প্রভা? বলছি না কান্নাকাটি করবি না একদম? যা হয়েছে ভুলে যা। ওর কাজের শাস্তি ও পাবে। কিন্তু তুই কেন এসব ভেবে কষ্ট পাবি? একদম কাঁদবি না ওকে?
-কাল আব্বু আম্মু এলে আমি ওদের সাথে চলে যাবো ভাইয়া। ভাবির সামনে দাঁড়ানোর মতো মুখ আমার নেই। আমার নিজের ভাই-----! আমি ভাবতেও পারছি না বিশ্বাস কর?
-প্রভা? কি পাগলামি শুরু করেছিা রাত দুপুরে? আমাদের তাহুমনির বিয়ে না সামনে? এখন চলে যাবি মানেটা কি? আর তোর ভাবি তো? ও একদম সুস্থ হয়ে যাবে তাহুকে বিদায় করার আগেই। দেখিস কেমন একা হাতে সবটা সামলে এই শাঁকচুন্নিটাকে বিদায় করে----।
-ভাবিকে মুখ দেখানোর মতো আমার যে উপায়ই নেই রে ভাইয়া।
-উফ! প্রভা! এসব বাদ দিয়ে তাহুর বিয়েতে কি ড্রেস পড়বি, ম্যাচিং গায়ে হলুদের শাড়ি, গয়না, লেহেঙ্গা এসব সিলেক্ট কর তো। আর এখন আপাতত আপনারা তিন জনই ঘুমান। রাত তো অনেক হলো। আমি অনুকে নিয়ে যাই।
আরেকবার প্রভার চুলগুলো হালকা হাতে নাড়িয়ে দিয়ে অনামিকার ঘুমন্ত মুখটা দেখে নিল অরণ্য। তাহিয়া আর ফারহার দিকে একবার তাকিয়ে অনামিকাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে নিজের রুমে ফিরে এসে বিছানায় শুইয়ে দিল এবারে। ঘুমন্ত অনামিকার ফ্যাকাশে মুখটা বড্ড বেশিই কষ্ট দিচ্ছে অরণ্যকে। অরণ্য রুমের দরজাটা লক করে এসে ফ্লোরে পড়ে থাকা ফুলদানির ভাঙ্গা টুকরোগুলো তুলে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে ফ্রেশ হয়ে এসে অনামিকার পাশে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। মেয়েটার ঘুমটা যে আজ ভাঙ্গবে না অরণ্য জানে। তবুও খুব সচেতন হাতে অনামিকাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়ে আলতো করে একটা ছোট্ট চুমো এঁকে দিল কপালে।
-দূরত্বটা কতোটা ভয়ংকর রূপ নিতে পারে দেখলে অনু? যদি প্রথম দিন রিশাদ তোমার সাথে অসভ্যতা করার পরই কথাগুলো আমাকে বলে দিতে তাহলে আজকের দিনটা কি আসতো? তুমি কি ভেবে কথাগুলো লুকিয়েছিলে আমি জানি না অনু। বাট যে সংসারটা তোমার, যে স্বামীটা তোমার তার কাছে কথাগুলো গোপন করার কি খুব দরকার ছিল? হয়তো ভেবেছ সাহিলের ঘটনায় যেভাবে রিএক্ট করেছি এবারও তেমনি করবো? দুটো বিষয় কি এক হলো পাগলি? সেদিন সাহিলের কথাশুনে মাথাটা ঠিক ছিল না তা নয়। তুমি ওর জন্য বাড়ি ছেড়েছিলে তাই রাগটা কন্ট্রোল করতে পারি নি। বাট তোমার দিকে যে বাজে নজর দিবে তাকে কি এমনি ছেড়ে দিব? রিশাদ আমার কাজিন হলেও ওর কি হাল করে ছাড়ি সেটাও তুমি দেখো। আমার অনুর দিকে হা বাড়ায়, কত বড় সাহস!
অনুকে বুকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে দুপুরের ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো অরণ্যের। অনামিকার ঘাড়ে কারো দাঁতের স্পষ্ট কামড়ের কালশিটেটা দেখেই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠেছিল অরণ্যের। বেখেয়ালে অনামিকার হাতটা টেনে মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো কিছু প্রশ্ন করার আগেই অনামিকার ব্যথায় কাতরানো দেখো অরণ্য কিছুটা অবাকই হলো। অনামিকার দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ব্যথা সহ্য করার পিছনের কাহিনীটা না বুঝলেও হাতটা ছেড়ে তাড়াতাড়িই অনামিকার মুখটা দুহাতে আবার তুলে ধরেছে অরণ্য। ততক্ষণে অনামিকার চোখ বেয়ে টপটপ করে কান্নার বিন্দুগুলো ঝড়তে শুরু করেছে। অনামিকার এমন চাপা কান্না দেখে অরণ্য আরো ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
-অনু? কি হয়েছে? ব্যথা লাগলো কি করে এমন? চোখ মুখ লাল, ঘাড়ে দাঁতের চিহ্ন, চুল এলোমেলো, হাতেও এতোটা লেগেছে তোমার। কি হয়েছে তোমার আমাকে বলো প্লিজ? প্লিজ অনু?
অনামিকা কোনোমতে মাথা নাড়িতে ফোঁপানোটা বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে কিছু হয়নি। তাতে অবশ্য বিশেষ কোনো লাভ হলো না। অরণ্য অনুকে আরো নিবিড় করে জড়িয়ে নিল। সাবধানে, যাতে মেয়েটা আবার ব্যথা না পায়। অরণ্যের এমন নিবিড় স্পর্শে কিনা কে জানে অনামিকা এবারে বাচ্চা মেয়ের মতোই কেঁদে ফেললো। অরণ্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অরণ্যের বুকের মধ্যেই আবার গুটিশুটি হয়ে নিজেকে প্রায় লুকিয়ে নিল মেয়েটা। এতোটা ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েটাকে এর আগে কখনো কি দেখেছে অরণ্য? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অনামিকার ফোঁপানোর সাথে আরো কয়েকটা কথা অরণ্যের কানে এসে বাজলো।
-বছর খানেক আগে সাহিলের সাথে আমার কলেজের সিনিয়র জুনিয়ার সম্পর্ক। ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র, বেশ হেল্পফুল, কেয়ারিং একজন মানুষ ছিল উনি। তার ব্যাচমেট, জুনিয়ার অনেকে মেয়ে রীতিমতো পাগল ছিল তার জন্য বলা যায়। লোকটা মিষ্টি করে হাসি দিয়েই সবার প্রোপোজ রিজেক্ট করে দিত। তাতে মেয়েগুলো মে বি আরো একবার নতুন করে ক্রাশ খেত।
-হঠাৎ ওর কাহিনী কেন?
-সেই লোকটা কি করে আমার মতো একজনকে নিজের জন্য চয়েজ করলো কে জানে। আবেগের বশে হোক, বা বয়সের দোষে, আমারও প্রচন্ড ভালো লাগতো সাহিলকে। লোকটার কথা বলার স্টাইল, হাঁটা, চলা, কথা বলা, সবই ভালো লাগতো আমার। সেই সাহিলই যখন আমাকে কলেজে সবার সামনে প্রপোজ করলো সেদিন না করার কোনো কারণই আমার কাছে ছিল না।
-হুম। তারপর?
-একদিন হুট করে সাহিল এসে বললো সে নাকি আমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও কফি খেতে যাবে। আমিও ক্লাস বাঙ্গ করে তার সাথে গেলামও। কলেজের কাছেরই একটা কফিশপ। সেখানেই আমি আর সাহিল কিছু একটা নিয়ে কথা বলতে কফি খাচ্ছি এর মধ্যে একজন এসে আমাকে প্রপোজ করে। সাহিল বরাবরই শান্ত মেজাজের ছেলে। ভালেভাবেই ছেলেটাকে আমাদের রিলেশনের কথা বলে ভাগিয়ে দেয়। ছেলেটাও চলে যায়। একটু পরে পাশের টেবিল থেকে এটা ওটা বলে বিরক্ত করছিল, টন্ট করছে, গান গাইছে ছেলেটা। সাহিল কিছুটা বিরক্ত হয়েই বিল পে করে চলে যাবে, আমাকে এটা বলে কাউন্টারে যায়। সাহিল যাওয়ার প্রায় সাথেসাথেই লোকটা আবার কোথা থেকে এসে আমার পাশে চেয়ার টেনে বসে। আমি বিরক্ত হয়ে চলে যেতে বললেও লোকটা ভিষণ আজেবাজে কথা বলে যাচ্ছিলো। শেষে বলে কিনা এক রাতের জন্য হলেও-------।
-হোয়াট!
-আপনার মতো আমিও এমনই রিএক্ট করেছিলাম সেদিন। সাহিল এসে আমার অবস্থা দেখে লোকটাকে কয়েকটা চড় থাপ্পড় দিতেই লোকটার গ্রুপেরও কয়েকজন এসে ঝামেলা শুরু করে। শেষে সাহিল আমাকে নিয়ে চলে আসে------।
-ওই হারামি---কে ছিল লোকটা! চিনতে পারবে? নাম, বা কোন কফিশপ আমাকে বল। বাকিটা আমিই খুঁজে বের করবো----। শুধু শুয়োরের বাচ্চাটাকে একবার পাই। তারপর দেখাছি তার কতো কারেন্ট---।
-আপনি জানতে চাইছিলেন না আমার সাথে এসব কি করে হলো? ওই লোকটা আজো আমার সাথে-- অসভ্যতা করতে চেয়েছে। আপনি আরেকটু পরে আসলে হয়তো---হয়তো আমাকে আর দেখতে পেতেন না কখনো---।
-কি বলছ? আমাদের বাড়িতে! কি করে? মানে----।
-কারণ লোকটার কাছে আপনার রুমের একটা এক্সট্রা চাবি সবসময়ই থাকে, ছিল।
-কি!
অরণ্য বিস্ফোরিত চোখে অনামিকার দিকে তাকিয়ে ছিল। মেয়েটা কি বলছে কিছুই আর অরণ্যের কানে গিয়ে পৌঁছায় নি। কারণ ততক্ষণে একটা মুখ অরণ্যের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আর সেটা রিশাদের।