সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছে অনল। অনামিকা ম্যাম তখন রান্না করছিলেন। রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে গভীরভাবে ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। তার ছেলেটা ভীষণ সুন্দর, ভীষণ মায়াবী। সেই সঙ্গে আনলিমিটেড দুষ্টু। মনটা ভালো। তবে নিহিকে সে যতটা চিনেছে, তাতে এমন নিচ কাজ অন্তত নিহি করতে পারে বলে তার মনে হয় না। সকলের সামনে অকপটে অনলকে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি তাও নিজের বাবার সামনে করেছে! ও চাইলেই পারত সব দোষ অনলের ঘাড়ে দিতে। কিন্তু ও তা করেনি। বরং সবার সামনে স্বীকার করেছে ভালোবাসার কথা। তাহলে কি এখনে কোনো গোলমাল আছে? নাকি নিহিকে বিশ্বাস করতে গিয়ে নিজের ছেলেকেই দোষী বানাচ্ছি! হিসেব মেলাতে পারেন না তিনি। সেদিনের পর থেকে নিহি আর কোনোদিন প্রাইভেট পড়তে আসেনি। ক্লাসেও চুপচাপ ছিল। হাসে কম। তাকায়ও না। হঠাৎ করেই চঞ্চল মেয়েটি যেন চুপসে গেল! কিছু তো অবশ্যই ছিল এবং আছে আড়ালে।
অনামিকা রহমানকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনল বলে,
"কী ভাবো আম্মু?"
হুশে এসে মৃদু হেসে উত্তরে তিনি বলেন,
"কিছু না। ভার্সিটিতে যাবে না?"
"যাব তো! সময় আছে এখনো।"
অনামিকা রহমান এসে অনলের পাশে বসে বলেন,
"আগে তো সময়ের অনেক আগেই যেতে।"
"বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম তো তাই।"
"এখন আড্ডা দাও না?"
"দিই তো। ত্রিশ থেকে পয়চাল্লিশ মিনিট আগে যাই এজন্য।"
"কিছুদিন আগেও কিন্তু তুমি প্রায় দেড় ঘণ্টা আগে কলেজে যেতে।"
"তাই নাকি?"
"হ্যাঁ।"
"কী জানি! হতে পারে। এত খুঁটে খুঁটে প্রশ্ন করছ কেন বলো তো?"
"হিসেব মেলাচ্ছি।"
"হিসেব? কীসের হিসেব?"
"আগে এত তাড়াতাড়ি যেতে। আর এখন কিছু সময় আগে যাও। কারণটা কী?"
"উহ্ আম্মু! কোনো কারণ নেই। দরকারি কোনো কাজ থাকলে বেশি আগে যাই।"
"তোমার সেই দরকারি কাজটা কি নিহিকে নিয়ে থাকত তখন?"
অনলের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন অনামিকা রহমান। অনল মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। হেসে হেসে বলে,
"কী যে বলো না আম্মু! ওর জন্য কেন যাব?"
"আমি তো বলিনি, তুমি ওর জন্যই যাও। আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছি।"
"আল্লাহ্! টিচার না হয়ে তোমার উকিল হওয়া উচিত ছিল। এখন উঠি আমি। রেডি হব।"
অনল চলে যাওয়ার পরও অনামিকা ম্যাম বেশকিছুক্ষণ বসে থাকেন।
শীতের ঠান্ডা বেশ ভালোই পড়েছে। গায়ে সুয়েটার জড়িয়ে পড়তে বসেছে নিহি। ফজরের নামাজ পড়ে আর ঘুমায়নি। ক্লাসের পড়া বাকি ছিল। সেটাই এখন কমপ্লিট করছে। অনলের জন্য মনের অস্থিরতা কমাতে নামাজ ম্যাজিকের মতো কাজ করছে। নামাজ পড়তে বসলেই দুনিয়ার সব কষ্ট, গ্লানি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আল্লাহ্-র দরবারে চাইলে আল্লাহ্ কখনো কাউকে ফিরিয়ে দেন না। হয়তো কখনো সময়টা বেশি লাগে তবে খালি হাতে আল্লাহ্ কাউকেই ফিরিয়ে দেন না। দরজায় দাঁড়িয়ে সালেহা বেগম বলেন,
"নিহি দরজা খোল।"
রুমের ভেতর থেকে নিহি বলে,
"দরজা খোলাই আছে মা। আসো।"
সালেহা বেগম ভেতরে এসে বলেন,
"পড়ছিস?"
"হ্যাঁ। কিছু বলবে?"
"একটু হাঁটতে বের হতাম।"
"এত সকালে? খুব শীত বাইরে।"
"পড়ার চাপ না থাকলে চল। সুয়েটার তো গায়েই আছে।"
"আচ্ছা বেশ! চলো।" বই বন্ধ করে হেসে বলে নিহি।
মা-মেয়ে মিলে ছাদে যায়। শীতের ঠান্ডা প্রবাহে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। নিহির ঠোঁট কাঁপছে অনবরত। সালেহা বেগম সেটা খেয়াল করে হাসেন। নিহি কপাল কুঁচকে বলে,
"হাসো কেন?"
ছাদের একটা চেয়ারে বসে উত্তরে বলেন,
"তোকে দেখে।"
"কেন? আমায় দেখে হাসির কী আছে?"
"বাচ্চাদের মতো ঠোঁট কাঁপছে তাই। বোস এখানে।"
নিহি মায়ের পাশে বসে। ছোট বেলাকার অনেক গল্প শুনায় সালেহা বেগম। নিহিকে খুব কম সময়ই একা থাকতে দেন তিনি। একাকিত্ব থেকে দূরে রাখেন। অনেক সময় নিহি রাত জেগে পড়ে আর মা পাশে বসে থাকেন। বিষণ্ণতা যেন নিহির ধারেকাছে ঘেঁষতে না পারে সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। রান্নাঘর আর সংসার সামলায় তমা। তবে নিহির কষ্ট এখনো একটি জায়গাতেই। নিজাম ইসলাম এখনো নিহির সঙ্গে কথা বলেন না। কলেজের সময় হওয়ায় দুজনই নিচে নেমে আসে। নিহি রেডি হতে চলে যায়। আর সালেহা বেগম নিহির জন্য নাস্তা রেডি করেন।
নিহিকে সকালের নাস্তা খাইয়ে দেন সালেহা বেগম। উপমা আসলে দুজনে এক সঙ্গে কলেজে যায়। কলেজের মাঠেই দেখা হয় দীপ্তর সঙ্গে। ব্যাডমিন্টন খেলছিল। নিহিকে দেখে দীপ্ত হাত নাড়িয়ে 'হাই' বলে। নিজের ব্যাগটা উপমার কাছে দিয়ে নিহি দীপ্তকে বলে,
"আমিও খেলব।"
"তুমি পারো?"
"অবশ্যই।"
দীপ্তর অপজিটে নিহি খেলে। খেলা দুজনেই অল্প সময়ে জমিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ করেই কক'টা লিসার মাথায় গিয়ে লাগে। ঐ সময়েই লিসা এসে পড়েছিল। লিসা মাথায় হাত দিয়ে 'আহ্' বলে শব্দ করে। নিহির দিকে রাগ নিয়ে এগিয়ে বলে,
"তোমার সাহস তো কম নয়।"
"আমি ইচ্ছে করে মারিনি।"
"চুপ! সাধু সাজার চেষ্টা কোরো না।"
"ইচ্ছেও নেই।"
"যেটা পারো না সেটা খেলতে আসো কেন?"
"কী পারি আর না পারি সেটা কাজেই প্রকাশ পাবে। আপনার কথায় নয়।"
"বেয়াদবি করবে না একদম।"
"বড়রা যদি ছোটদের যথাযথ সম্মান দিতে না পারে, তাহলে বড়দের থেকে সম্মান আশা করা বোকামি। তাছাড়া বেয়াদবের সঙ্গে বেয়াদবি করা ফরজ।"
"খুব ফাজিল মেয়ে তো তুমি।"
"সে আর নতুন কী?"
নিহির এমন স্পষ্ট কথায় লিসার রাগ বেড়ে যায়। সুমাইয়া লিসার পাশেই ছিল। সুমাইয়া লিসাকে বলে,
"হঠাৎ লেগে গেছে। চল ক্লাসে চল।"
"থাম তুই। কীসের ভুল হয়েছে? ইচ্ছে করে করেছে এমন।"
নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
"সামান্য লজ্জাটুকুও নেই না? এত বড় কাণ্ডের পরও বড় বড় কথা বলা বন্ধ হয়নি।"
"হাহ্! কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা সেটা আপনার বন্ধু বেশ ভালো করেই জানে। আর আপনারাও। তাছাড়া লোকে তো হাজারটা কথা বলবেই। সব কথা কানে কেন নেব আমি? দু'দিন না খেয়ে থাকলে তখন তো কেউ এসে খাবার দিয়ে যায় না। পারলে কী, কী ত্রুটি আছে সেসব খুঁজে বের করে। কে কী ভাববে, সেসব ধার আমি ধারি না। আর কিছু বলবেন? বললেও পরে বলতে হবে। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে একটুপর। আরেকটু খেলেই ক্লাসে চলে যাব।"
নিহি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই লিসা বলে,
"তোমাকে একমাত্র অনলই শায়েস্তা করতে পারবে। অনলকেই বলব আমি।"
নিহি থেমে যায়। পিছনে ফিরে লিসার কাছে এগিয়ে যায়। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যর হাসি ফুঁটিয়ে বলে,
"আসতে বলিয়েন এবার। আমি যেমন ভালোবাসতে পারি, তেমনই উচিত শিক্ষা দিতেও পারি। ভুলেও আমায় ক্ষেপানোর চেষ্টা করিয়েন না। তাহলে ফলাফল না আপনার জন্য ভালো হবে আর ঐ প্রতারক অনলের জন্য।"
লিসার উত্তরের আশায় আর অপেক্ষা না করে নিহি খেলতে শুরু করে। অনলও তখন কলেজে আসে। অনলকে দেখে লিসা সবকিছু বলে অনলকে। সঙ্গে আরো কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলে। অনল নিহির দিকে তাকিয়ে দেখে, নিহি হেসে হেসে খেলছে। দৌঁড়াচ্ছে। দেখে মনেই হবে না, কিছুদিন আগেও নিহির চোখে ছিল বিষাদ। দিব্যি আছে নিহি। অনল কিছু না বলে ক্লাসে চলে যায়।
পুরো ক্লাস না করেই টিফিন টাইমে বাড়ি যাওয়ার জন্য বের হয় নিহি। নিচ তলায় এসে অনামিকা ম্যামের সঙ্গে দেখা হয়। নিহি হেসে সালাম দিয়ে বলে,
"ভালো আছেন ম্যাম?"
তিনি মৃদু হেসে বলেন,
"হ্যাঁ, তুমি?"
"আলহামদুলিল্লাহ্।"
"বাড়িতে চলে যাচ্ছ যে?"
"একটু খারাপ লাগছে।"
"আচ্ছা যাও।"
নিহি চলে যায়। নিহির চোখেমুখে বিষাদের ছায়া। এত কীসের বিষাদ? কলেজ ক্যাম্পাস পাড়ি দিয়ে রিক্সায় ওঠে নিহি। বুকচিরে লুকিয়ে রাখা কান্নাগুলো বেরিয়ে আসে এবার। যতই ভালো থাকার অভিনয় করুক না কেন সবার সামনে, কষ্টগুলোকে কিছুতেই দূর করতে পারে না। আত্মসম্মান বজায় রাখতে পারলেও কষ্টগুলোকে দূরে রাখতে পারছে না। অনলকে দেখলেই বুকের ভেতর অসহনীয় কষ্ট হয়। কান্নাগুলোকে আটকে রাখতে কষ্ট হয়। কষ্টের সঙ্গে পেরে ওঠে না নিহি!
বাড়ির সামনে এসে ভাড়া মিটিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে নেয়। বাড়ির সবার সামনে ভালো থাকার অভিনয়টা এখন যে আবার করতে হবে! বাড়ির ভেতর ঢুকেই মাকে খুঁজে বের করে। সালেহা বেগম তখন টিভি দেখছিলেন। নিহি গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সালেহা বেগম বলেন,
"আহা! ছাড়। সিরিয়ালটা দেখতে দে।"
"সারাদিন শুধু সিরিয়াল, সিরিয়াল আর সিরিয়াল! সিরিয়াল দেখে দেখে ওদের মতো বজ্জাত শ্বাশুরী হচ্ছ।"
"তোর ভাবিকে জিজ্ঞেস করে দেখ, আমি বজ্জাত শ্বাশুরী নাকি ভালো শ্বাশুরী।"
নিহি উঠে ভেংচি কেটে বলে,
"আমার বয়েই গেছে।"
এরপর হাসতে হাসতে নিজের রুমের দিকে আগায়। হাসতে হাসতেই ঠোঁট উল্টে আবার কেঁদে ফেলে।
বিকেলে তিতিরকে নিয়ে ফোনে কার্টুন দেখছিল। তখনই তমা এসে বলে,
"নিহি বাইরে এসো তো।"
"কী হয়েছে?"
"পিয়ন এসেছে। তোমার চিঠি নিয়ে।"
নিহি শোয়া থেকে উঠে বসে। এই যুগেও কেউ আবার চিঠি পাঠায় নাকি? কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকলে সহজেই ফোন করা যায়। ম্যাসেজ করা যায়। এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়া তো রয়েছেই। সেই যুগে এসে চিঠি! তাও নিহির নামে। ভেরী ইন্টারেস্টিং! কৌতুহল নিয়ে নিহি বাইরে যায়। দরজার সামনে ডাকপিয়ন দাঁড়িয়ে আছে। নাম সই করে চিঠিটা নিয়ে ঘরে আসে নিহি। পেছন থেকে তমা বলে,
"লাভ লেটার হলে আমায়ও দেখিও।"
নিহি হাসে। ঘরে এসে আকাশী রঙের খামটা খোলে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে শুভ্র কাগজ। যেন বিশাল আকাশের বুকে এক টুকরো শুভ্র মেঘ! কাগজটিতে নীল কলম দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে মুক্তর দানার মতো লেখা। চিঠির শুরুতেই লেখা,
'এইযে এলোকেশী,
তোমার দীঘল কালো চুলগুলোকে সুন্দর করে আটকে রাখবে। যেন, কারো নজরে না আসে। আর এই মেয়ে, বাচ্চাদের মতো এমন কাঁদো কেন? আজকে রিক্সায় দেখলাম তোমায় কাঁদতে। এই এলোকেশী, তুমি কেঁদো না কখনো। জানো, আমি কখনোই কাউকে চিঠি লিখিনি। তুমিই প্রথম। বুঝতে পারছিলাম না, কী দিয়ে লেখা শুরু করব। অগোছালো লেখাগুলোকে নিজের মতো একটু সাজিয়ে নিও।'
চিঠির নিচে বা খামের কোথাও নাম-ঠিকানা কিচ্ছু লেখা নেই। নাম-ঠিকানা ছাড়া কেউ চিঠি কী করে পাঠায়? ভুল করে অন্যের চিঠি এসে পড়ল নাকি আমার কাছে? না, ভুল কী করে হবে? লেখাই তো আছে, আমায় সে কাঁদতে দেখেছে। ভুল হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না! তাহলে কে এই উড়োচিঠির মালিক?
.
.
.
চলবে................................