ভোরের রোদ - পর্ব ১৬ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৩১!! 

খুট করে একটা শব্দ করে রুমের দরজাটা খুলে গিয়ে কারো ধীর পায়ে হেঁটে আসার শব্দ পেয়ে ভোর চুপচাপ ঘুমের ভান করে নিজের বিছানায় শুয়ে রইলো। মিনিট খানেক পরেই মাথায় কারো পরম স্নেহের স্পর্শ অনুভব করতে পারে ভোর। তারপর আবার মিনিট খানেকের নিরবতার পর ভোরের রুমের লাইটটা অফ করে দিয়ে খুব ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় মানুষটা। মানুষটা চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করে ঘুমের নাটক করে আগের মতোই শুয়ে থেকে আবার চোখ মেলে তাকায় ভোর। মুখ ফিরিয়ে বেড সাইড টেবিলটার দিকে তাকাতেই খাবারের প্লেটটা চোখে পড়ে ওর। আর প্লেটটা দেখেই আবার হু হু করে কান্না এসে গলা বুজিয়ে দেয় মেয়েটার। গত চার দিন ধরে এভাবেই প্রতিদিন রাতে মা, বাবা, বড় আম্মু কেউ না কেউ খাবার রেখে যায় ভোরের জন্য। আর ভোরও ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে প্রতিদিন। সারাদিন সবার মধ্যমনি হয়ে থেকেও যে ভোর সবার থেকে কতোটা দূরে সেটা কেউ টেরও পায় না। ভোরের সবার সামনে ভালো থাকার এই অভিনয়ের আড়ালের কষ্টটাও তাই এভাবে চাপা পড়ে যায় হাজারো হারানোর যন্ত্রণায়। গত চারদিনে এক বারের জন্যও রোদের খবরটুকুও পায়নি ভোর। সেদিনের সেই কলিংবেলটা যে কত বড় ঝড় ডেকে এনেছিল ভোর আর রোদের জীবনে কথাগুলো ভাবতেই নিজের অজান্তেই কান্নার জল ভোরের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে এখনও। 

পরপর দুবার কলিংবেলের শব্দে রোদ আর ভোর দুজনেই চমকে উঠেছিল। ভোরের ভীত মুখটা দেখে রোদ নিজেই একটু হেসে ভোরকে অভয় দিয়ে দরজার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। এর মধ্যে আরো কয়েকবার কলিংবেলের শব্দ ভেসে এসেছে দরজার বাইরে থেকে। রোদ একটু সাহস করে দরজাটা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে যে মানুষটা রুমে ঢোকে সে আর কেউ নয়, মেঘ। মেঘকে দেখে ভোর আর রোদ দুজনেই রীতিমতো ঝটকা খেলো। রোদ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেঘ ধুমধাম কয়েকটা ঘুষি লাগালো রোদকে। রোদ বেচারা মেঘের ঘুষির হামলা থেকে নিজেকে বাঁচানোর সময় বা সুযোগ কিছুই পেল না। মেঘের ঘুষির বৃষ্টিই রোদকে জানিয়ে দিচ্ছে ছেলেটা কতোটা টেনশন করছিল এতোক্ষণ ধরে। আর কি যে রেগে আছে রোদের উপরে।

-হারামি তুই মোবাইল ইউজ করিস কি জন্য? অফ করে বসে থাকার জন্য? কাল সারা রাত আমি দু চোখের পাতা এক করতে পারি নি তোরা দুজন কোথায় কি অবস্থায় আছিস সেটা ভেবে ভেবে। আর এদিকে তুই হারামি বাড়িতে গেলি না, কোথায় আছিস, কেমন আছিস একটা কল করে জানানোরও প্রয়োজন বোধ করলি না? তুই মানুষ? ওই হারামি তুই মানুষ?

-ওরে ভাই মেঘ! তোর দোহাই লাগে আর মারিস না। এবার কিন্তু সত্যি ব্যথা লাগছে ভাই।

-ওরে হারামি! আমি কি তোকে আদর করছি যে লাগবে না? তোকে তো আমি আজকে মেরেই ফেলবো। 

-ভাই ভাই! মেঘ? রাগ করিস না ভাই। আর কখনো ভুল হবে না ভাই। পাক্কা প্রমিস। 

-শালা! রাখ তোর প্রমিস। তোর মোবাইলটা কই? দে আমাকে। আজ আমি তোর মোবাইলটা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিবো। তারপর আমার মাথা ঠান্ডা হবে। সারা রাত আমাকে টেনশনে রেখে সে এখন রাগ করিস না শুনাতে এসেছে আমাকে! দে শালা মোবাইল দে?

-ভাই সরি তো? মাফ করে দে না প্লিজ? আসলে মোবাইলে চার্জ ছিল না। মে বি অফ হয়ে গেছে। একদমই খেয়াল করি নি আমি। 

-হারামি! তোর মোবাইলের আগে তোকে গুঁড়ো করবো আমি। সামান্য একটা মোবাইলের খেয়াল রাখতে পারিস না তাহলে মোবাইল ইউজ করিস কেন তুই? হ্যাঁ? শোঅফ করতে মোবাইল রাখিস? তুই মোবাইল দে এক্ষুণি? নইলে আমি খুঁজে পেলে কিন্তু-----।

-ভাই? আমার পিচ্চি বউয়ের সামনে এভাবে বেইজ্জত করবি? এমনিতেও বউ জামাই মানে না, তার পরে এমন ধোলাই খেলে পরে তো বউ আমাকে মানুষ বলেই দাম দিবে না। তুই বন্ধু হয়ে আমার এতো বড় সর্বনাশ করবি মেঘ?

-শালা ড্রামাবাজ! যত নাটকই করিস আমি তোর উপরে অনেক রেগে আছি রোদ। অনেক। সর। 

রোদের কথায় এতোক্ষণে ভোরের কথা খেয়াল হলো মেঘের। রোদকে হালকা করে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়লো মেঘ। রোদের সাথে মারামারি করতে গিয়ে বেচারার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তৃষ্ণার কথা মনে পড়তেই হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাসটা ধরার চেষ্টা করতেই টেবিলের উপরের নাস্তার প্লেটের দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে গেল মেঘের। 

-বাহ! বাড়িতে সবাইকে টেনশনে রেখে তোরা দেখছি ভালোই পিকনিক করছিস এখানে? অসাধারণ!

-মেঘ? আম সরি তোকে জানাই নি রাতে ঠিকঠাক মতো ভোরকে নিয়ে পৌঁছে গেছি আর এখানেই ছিলাম। কিন্তু বাড়িতে সবাইকে টেনশনে রাখলাম কখন? আমি তো বাবাকে বলেই দিয়েছিলাম ভোর আমার সাথেই আছে। আর ভোরও তো সবার সাথে কথা বললো। তাহলে ওদের এতো টেনশন করার কি হলো আমি বুঝতে পারছি না।

-ভোর সবার সাথে কথা বলেছে মানে? আঙ্কেল যে বললো তুই ভোরকে জোর করে কোথায় নিয়ে চলে গেছিস। উনারা নাকি ভোরের সাথে কন্টাকও করতে পারে নি কাল সারাদিন? আঙ্কেল কেন এ কথা বললো আমাকে?

-বাবা এই কথা বলেছে? এই ভোর? তুই কাল ছোটোমা আর চাচ্চুর সাথে কথা বলিস নি? তোকে না মোবাইলটা দিয়ে গেলাম আমি? চার্জ বেশি ছিল না। কিন্তু কথা বলতে পারবি না এমনও বেহাল তো ছিল না মোবাইলের? কি রে? কথা বলছিস না কেন?

রোদ আর মেঘের আলোচনা শুনে এতোক্ষণ ভোর কাঁচুমাচু মুখ করে ডাইনিংরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে রোদ ভোরকে কথাগুলো বলতে বলতে ভোরের মুখের দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো ভোরের মুখের দিকে তাকিয়ে। রোদ এবারে এগিয়ে এসে ভোরের সামনে এসে দাঁড়ালো। 

-ভোর? কি হয়েছে? মুখটাকে এমন প্যাঁচার মতো করে রেখেছিস কেন? আরে? কি মুশকিল কাঁদছিস কেন আবার?

-আমি---। আসলে রোদ----। আমি সরি।

-আরে বাবা! সরি বলছিস কেন? আর কাঁদছিসই বা কেন? দেখি? আগে কান্না থামা প্লিজ? দেখি তাকা তো আমার দেখি? কি হয়েছে বল এবার?

-আমি---। আমি মাকে কল করিনি কালকে। আসলে----।

-হোয়াট! তো কালকে তোকে মোবাইল দিয়ে আমি খাবার আনতে গেলাম, তখন কি করছিলি তুই? তোকে না বললাম ছোটোমা, চাচ্চু, মা, বাবা সবার সাথে কথা বলতে? তুই যে কথা বলিস নি বাসায় সেটাও তো একবারও বলিস নি আমাকে? কি হয়েছিল? মোবাইল অফ হয়ে গেছিল নাকি? কি রে কথা বলিস না কেন?

-মোবাইল অফ হয়নি। আমিই অফ করে দিয়েছি-----।

-কি! কেন? তুই পাগল নাকি? তোকে কল করতে দিলাম আর তুই ফোন অফ করে বসে আছিস? এটা কোন ধরনের ফাইজলামি ভোর? 

-আসলে---আসলে আমি চাই নি যেভাবে কাল মেঘ ভাইয়া আমাকে খুঁজে পেয়েছে বড়আব্বুও আমাদেরকে সেভাবে খুঁজে পাক।

-আর ইউ সিরিয়াস ভোর?

ভোরের কথায় রোদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। রোদ আর ভোরের দুজনেরই হতভম্ব ভাব কাটলো টেবিলের উপরে নিজের মাথা বাড়ি দেয়ার শব্দ শুনে। 

-এই দুটোই পাগল হয়ে গেছে। হায় আল্লাহ! রোদ? ভোর নাহয় বাচ্চা মেয়ে তাই পাগলামি করেছে। কিন্তু তুই? তুই জানিস আঙ্কেল আন্টি, চাচ্চু, ছোটোমা সবাই সারারাত কতো টেনশন করেছে তোদের দুজনের জন্য? আঙ্কেল আমাকে কাল রাতে কতবার আমাকে কল করেছে জানিস তুই? কতোটা টেনশনে থাকলে মানুষগুলোর সারাটা রাত নির্ঘুম কেটেছে ভাবতে পারছিস? তোর কি উচিত ছিল না বাসায় অন্তত একবার কল করে বলা যে তোরা ঠিক আছিস?

-আমার মোবাইল-----।

-তোর মোবাইল অফ হয়ে গিয়েছিল রোদ, মানলাম। কিন্তু তোর এই বাড়িতে যে মাসে মাসে ল্যান্ডলাইনের বিল দিস, সেটা মনে ছিল না? আঙ্কেল কল না করিস আন্টিকে তো একবার কল করে বলতে পারতি নাকি?

-ওকে কিছু বলে লাভ নেই মেঘ। এই ছেলে কারো টেনশন, কারো ভয়, ভালোবাসা এই অনুভূতিগুলো কখনো বুঝেছে যে আজ বুঝবে?

-আঙ্কেল আপনি?!

রোদ আর ভোর দুজনেই মেঘের দিকে থতমত খেয়ে তাকিয়েছিল বলে পিছন দিক থেকে হঠাৎ করে আতিক আহমেদের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে পিছনের দিকে ফিরে তাকালো। মেঘও চমকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে ততক্ষণে। রোদের বাবা এই বাড়ির ঠিকানা কোথায় পেলেন সেটাই বুঝতে পারছে না মেঘ নিজেও।

-কি মেঘ? আমাকে দেখে অবাক হলে? ভাবছ আমি এখানে তোমার বন্ধুর এই সিক্রেট হাইডআউটের খোঁজ কিভাবে পেলাম? তোমাদের কি ধারণা ছিল তোমরা ভোরকে লুকিয়ে রাখলে আমি ওকে খুঁজে পাবো না?

-বাবা? তুমি------।

-তুমি কি ভেবেছ রোদ তুমি আমাকে না জানালে আমি কিছু জানবো না? তাসমিদ কেন আমাদের ভোরের জীবনে এসেছে রোদ? বলতে পারো রোদ?

-বাবা তাসমিদ একটা ফ্রড---। ওই লোকটা জোর করে----।

-তাসমিদ কার জন্য ভোরের জীবনে এসেছে রোদ?

-বাবা? আসলে---।

-তুমি না বললেও আমি সেটাও জানি। তাসমিদের বোনের নাম রশ্নি রাইট রোদ? নাকি ভুল কিছু বললাম?

-বাবা? লুক--। আই ক্যান এক্সপ্লেইন।

-কি এক্সপ্লেইন করবে তুমি আমাকে রোদ? যে তোমার জন্য আরেকবার ভোরের জীবনে নতুন বিপদ হয়ে এসেছিল ওই তাসমিদ নামের ছেলেটা? এটা এক্সপ্লেইন করবে যে তুমি রশ্নিকে রিজেক্ট করেছ বলে মেয়েটা সুইসাইড করেছে? আর সেই মেয়েটার ভাই বোনের মৃত্যুর বদলা আমাদের ভোরের উপরে নিতে চেয়েছে। একবার ভাবো তো রোদ কাল ভোরের যদি কিছু একটা হয়ে যেত তাহলে পারতে নিজেকে ক্ষমা করতে?

-বাবা?

-স্টপ নাউ রোদ। তুমি এখন তোমার ছোটোমা আর চাচার মতো এটা বলো না যে এবারও তোমার জন্য আমরা ভোরকে ফিরে পেয়েছি। আমরা ভোরকে ফিরে পেয়েছি তার ক্রেডিট যদি কারো পাওনা থাকে তাহলে সেটা মেঘের। আর যাই হোক তোমার কোনো ক্রেডিটই নেই। তোমার যদি কোনো ক্রেডিট থাকে তাহলে সেটা হলো ভোরকে বিপদে ফেলার ক্রেডিট।

-বাবা!

-অথচ তুমি বুঝাতে চাইলে রোদ? তুমি বোঝাতে চাইলে আমাদের ভুলে ভোরকে বিপদে পড়তে হয়েছে, আমরা আমাদের মেয়ের খেয়াল রাখতে পারছি না? ভুল মানুষের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে চেয়েছি? কিন্তু এই ভুল মানুষটা যে তোর কারণেই ওর জীবনে আসার সুযোগ পেয়েছে সেটার কি করবি রোদ? প্রতিবারের মতো এবারেও যে ভোর তোমার কারণেই এটা কি মানবে এবার? নাকি আবার নতুন করে তর্ক শুরু করবে?

-বাবা যথেষ্ট হয়েছে তোমার পাগলামি। মানছি তাসমিদের ব্যাপারটায় আমার দোষ ছিল। না রশ্নি সুইসাইড করতো, আর না তাসমিদ আমার উপরে প্রতিশোধ নিতে ভোরকে ব্যবহার করতে চাইতো। কিন্তু এটাও তো মানবে বাবা আমি ইচ্ছে করে এসব কিছুই করি নি? এটা তো মানবে আমি নিজের জীবনের চেয়েও ভোরকে------।

-তোমার ডায়লগবাজি শুনতে আমি এখানে আসি নি রোদ। আমি ভোরকে নিতে এসেছি। ভোর মা, চলো? বড়আব্বু তোমাকে বাড়িতে নিতে এসেছি। চলো?

ভোর থতমত খেয়ে একবার রোদের মুখের দিকে আরেকবার বড়আব্বুর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল এতোক্ষণ। চলে যাওয়ার কথায় ভয়ে রীতিমতো হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে মেয়েটার। আর এরপর কি হবে সে চিন্তায় ভোর, রোদ আর মেঘ তিনজনেরই হাত পা ঠান্ডা হতে যাচ্ছে। আতিক আহমেদের জেদের কাছে শেষপর্যন্ত ভোরের রোদকে হার মানতে হয় কিনা কে জানে!

৩২!! 

-তোমার বন্ধুটিকে বলে দাও মেঘ। ও যদি এখন আমাকে ভোরকে নিয়ে যেতে আটকায়, বা ওর ভয়ে যদি ভোর আমার সাথে না যায়, তাহলে আমি কিন্তু একটা তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে বসবো। এখান থেকে খালি হাতে একবার বেরিয়ে যেতে হলে পরেরবার কিন্তু আমি একা আসবো না মেঘ। প্রয়োজনে নিজের এই কুলাঙ্গার ছেলেকে আমি নিজেই জেলে দিবো, মামলা করো, এফ আই আর করবো ভোরকে কিডন্যাপিং করেছে এই মর্মে। তাহলে কিন্তু এবার তুমিও তোমার বন্ধুকে বাঁচাতে পারবে না মেঘ। আমি বেঁচে থাকতে মামলা তুলে নিবো না এই বদমাইশ ছেলের নামে। তাতে লোকে হাসুক, আমাকে পাগল বলুক, যা ইচ্ছে হয়ে যাক না কেন, এই ছেলের জন্য আমার ভোর মায়ের কোনো ক্ষতি আমি বরদাস্ত করবো না বলে দিলাম। 

আতিক আহমেদ কথাটা বলে মেঘের দিক থেকে চোখ সরিয়ে রোদের দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার ভোরের দিকে তাকালো। ভোর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিজের জায়গায়। কোথা থেকে কি হচ্ছে তার কিছুই যেন মেয়েটার মাথায় ঢুকছে না। স্বপ্নের মতো একটা রাত কাটিয়ে সকাল হতে না হতেই এ কেমন পরীক্ষা দিতে হচ্ছে ওকে! ভোরের চিন্তিত মুখটার দিকে তাকিয়ে আতিক আহমেদের মুখের কঠোর ভাবটা কিছুটা নরম হলো এবারে।

-ভোরমা? চলো? এখানে কেউ তোমাকে আটকাতে আসবে না আজকে। আর যদি আসেও তবু তোমার বড়আব্বু তোমাকে আজ এখান থেকে নিজের সাথে নিয়েই বাড়ি ফিরবে। বাড়িতে সবাই তোমার অপেক্ষা করছে মা। চলো বাড়ি ফিরি। আর কালকে কি ঘটেছে সেটা ভুলে যাও। অন্য কারো কাজের ফল তোমাকে আর কখনো ভোগ করতে হবে না আজকের পর থেকে।

-বড়আব্বু? আমি-----।

-ভয় পেও না মামনি। কেউ তোমাকে তাসমিদের ব্যাপারে কোন প্রশ্নই করবে না। কেমন? ব্যাপারটা একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাও, কেমন? আর এই যে রোদ সাহেব? আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। তোমার কি কিছু বলার আছে?

রোদ কিছু বলার আগেই মেঘ রোদের একটা হাত ধরে থামালো। রোদ আর আতিক আহমেদ দুজনেই মেঘের দিকে তাকালো এবারে।

-রোদ প্লিজ? কিচ্ছু বলিস না তুই প্লিজ? ভোরকে আঙ্কেলের সাথে যেতে দে।

-কিন্তু---মেঘ? আমার ভোর-----? তুই তো জানিস ও কতোটা ছেলেমানুষ? ওকে আমি একা কি করে ছাড়বো বল?

রোদের কথায় আতিক আহমেদ রেগে গেলেন এবারে।

-ভোরকে নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না রোদ। তুমি ওর থেকে দূরে থাকো। নয়তো আমাকে অন্য রাস্তা খুঁজতে হবে তোমার থেকে ভোরকে বাঁচানোর জন্য।

-সিরিয়াসলি বাবা? আমি আমার ভোরের কাছ থেকে দূরে সরে যাবো? কেন? তুমি চাও না বলে? হাহ। তুমি কি জানো না তোমার চেয়েও ভোরের উপরে আমার অধিকার বেশি?

-অধিকার? অধিকার ফলাতে এসেছ তুমি রোদ? কিসের অধিকার? ছোটবেলায় খেলার ছলে বিয়ে বিয়ে নাটকটাকে সত্যি ভেবে নিয়েছ নাকি তুমি? নাকি ভাবছ তোমার চাচ্চু আর ছোটোমার সেদিনের পাগলামিটার ফল আমার ভোরকে আমি সারাজীবন ভোগ করতে দিবো? শোনো ছেলে তোমাদের ওই ছেলেখেলার কোনো মানেই নেই সমাজের চোখে। ভোরের জীবনে ছেলেখেলার বিয়েটা নিয়ে নাটক করার আগে জেনে নিও লিগ্যালি ওটাকে বিয়েও বলে না। আর না তোমাদের বিয়ের কোনো প্রমাণ বা সার্টিফাইড কোমো ভ্যালু আছে। তবু যদি তুমি জোর করে ভোরের উপরে অধিকার ফলাতে চাও তবে---তবে তোমার নামে জোর করে নাবালিকা মেয়েকে বিয়ে করার অপরাধে মামলা করবো আমি। বাল্যবিবাহ আইন, শিশু অধিকার রক্ষার আইন, এসব নিয়ে ধারণা আছে তো তোমার? না থাকলে মেঘকে জিজ্ঞেস করো কেইস করলে কি পরিণতি হবে তোমার। তুমি ভোরের জীবন নষ্ট করতে চাইলে নিজের সন্তান বলে কিন্তু আমি ছাড় দিবো না রোদ। ইউ বেটার মাইন্ড ইট।

আতিক আহমেদের কথা শেষ হতেই মেঘ রোদকে টেনে কিছুটা সরিয়ে আনলো।

-আঙ্কেল প্লিজ? কেইস করার কথাটা ভুলেও মাথায় আনবেন না। একটা মামলা একজন মানুষের জীবনটা কিভাবে নষ্ট করে দিতে পারে সেটার সাক্ষী আমি নিজে। প্লিজ আঙ্কেল, জেদের বশে এমন কিছু করবেন না যাতে পরে আপনার সন্তানেরই ক্ষতি হয়। আর ভোরকে আপনি নিয়ে যান আঙ্কেল।

-মেঘ? কি বলছিস এসব? তুই পাগল হয়েছিস? ভোরকে আমি কিছুতেই----।

-রোদ প্লিজ? একবার বুঝার চেষ্টা কর। 

-আমি কিছু বুঝতে চাই না মেঘ। তুইও শেষ পর্যন্ত বাবার দলেই নাম লেখালি তাই তো? ওকে---। তোকেও চাই না আমার। তোদের কাউকেই চাই না আমি। বাবা, তোমার কেইস করার হলো করো, আমি ভোরকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। আর না ভোর আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে---। তোমার যা ইচ্ছে হয় তুমি করতে পারো। ভোর? আয় তো আমার সাথে---।

-রোদ? কাজটা কিন্তু ভালো করছ না তুমি। রোদ?

পিছন থেকে আতিক আহমেদের কথাগুলো ভেসে আসলেও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রোদ ভোরের একটা হাত ধরে টেনে দোতলার দিকে নিয়ে গেল। আতিক আহমেদও রাগে গজগজ করতে করতে দরজার দিকে পা বাড়াতেই মেঘ আতিক আহমেদের পিছনে ছুটলো।

-আঙ্কেল? আপনি প্লিজ রাগ করবেন না। জানেনই তো রোদ ভোরকে কতোটা ভালোবাসে। আপনি প্লিজ রাগ করে রোদের নামে মামলাটা করবেন না আঙ্কেল। একবার পুলিশের ওই লাল খাতায় কারো নাম উঠলে তার জীবনটা যে শেষ হয়ে যায় আঙ্কেল। একবার পুলিশের খাতায় নাম উঠলে না দেশের বাইরে কোথাও যাওয়ার সুযোগ থাকবে, আর না দেশে সম্মানের সাথে বাঁচতে পারবে। নিজের সন্তানের এতো বড় ক্ষতিটা আপনি বাবা হয়ে কেন করতে চাচ্ছেন আঙ্কেল? 

-তাহলে তোমার বন্ধুকে বোঝাও মেঘ। সে যেন ভোরের জীবনে কালো অধ্যায় হয়ে না থাকে আর। ওকে তো বলেছিই দু-তিন বছরের জন্য দেশের বাইরে যেতে। এর মধ্যে ভোরও কিছুটা ম্যাচিউর হবে, নিজের কথাগুলো নিজে বলতে শিখবে মেয়েটা। অন্তত রোদের ভয়ে চুপ করে ওর সব জেদ মেনে নিবে না।

-ভোর রোদের ভয়ে সবসময় সবটা মেনে নেয় না আঙ্কেল। চোখের সামনে থেকে আপনার মিথ্যে জেদের পট্টিটা সরিয়ে ফেললেই বুঝতে পারবেন কিছু জিনিস ভোর নিজের ইচ্ছেতেই করে।

-ছেলেমানুষি আর ভালোবাসা এক না মেঘ। রোদ নিজের জেদটা ভোরের উপর চাপিয়ে দেয় বলেই ভোরও সেটাকে নিজের ইচ্ছে ভেবেই মেনে নেয় সবসময়। কিন্তু আসলেই কি সেটা ভোরের ইচ্ছেয় হয়? নাহ। হয় না। আর এই কথাটা বুঝতে হলে ভোরকে রোদের কাছ থেকে দূরে যেতে হবে। যাতে ভোর নিজের ভালো মন্দ, পছন্দ অপছন্দটা নিজে ঠিক করতে পারে। রোদ ফিরে আসার পরও যদি ভোরের মনে হয় ভোর রোদের সাথেই থাকতে চায়, তাহলে আমি আর কোনো আপত্তিই করবো না। কিন্তু একেবারেই কোনো চেষ্টা না করেই হাল ছেড়ে দেয়ার লোকও আমি না মেঘ। এখন আমাকে কনভেন্স করতে সময় নষ্ট না করে তোমার বন্ধুকে গিয়ে বোঝাও। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি ভোরের জন্য। 

মেঘকে কথাগুলো বলা শেষ হতেই আতিক আহমেদ বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। আর মেঘ বোকার মতো উনার যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে রইলো। উনাদের বাপ ছেলের জেদের কাছে ভোর আর মেঘ নিজে যে কতোটা অসহায় সেটাই ভাবার চেষ্টা করছে মেঘ। রোদ আর ভোরের সমস্যা নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিজের সমস্যাগুলোও আজকাল যেন ভুলতে বসেছে মেঘ। তাতে লাভ না লোকসান হচ্ছে কে জানে!

এদিকে ভোরকে রুমে নিয়ে এসে দরজাটা লক করে দিয়ে বিছানার উপরে ধপ করে বসে নিজের মাথা দুহাতে চেপে ধরে বসে আছে রোদ। এ জীবনে সবার দেয়া সব শর্ত মানতে রাজি আছে রোদ। কিন্তু ভোরের কাছ থেকে দূরে যাওয়ার শাস্তিটা কি করে মানবে রোদ? যাকে পাওয়ার জন্য নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত রোদ, তার থেকে দূরে চলে যাওয়াটা শাস্তির চেয়ে কোন অংশে কম লাগছে না রোদের। ভোরও রোদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে নিরবে। রোদের গুমোট মুখটা দেখে কেমন ভয় ভয়ও করছে মেয়েটার। বড় আব্বুর সাথে না গেলে বড়আব্বু কি কান্ড ঘটাবে, আর চলে গেলে রোদ কি পাগলামি করবে ভাবতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ভোরের। এই কান্নাটাই যেন আজ ভোরের শেষ সম্বল। সামনের সময়টায় কি অপেক্ষা করছে ভোরের রোদের জন্য কে জানে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন