মায়াজাল - পর্ব ০৪ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৭!!

সায়েরার কাছে বাবার অনেক গল্প শুনে মনের ছটফটানি কিছুটা কমেছে বেলার। তারপর রুমে এসে বিছানায় বসলো। সায়েরা স্বামীর সাথে পরিচয়ের গল্প করেছে, তার দাদী মারা যাওয়ার পর কিভাবে বিয়ে হলো দুজনের সে গল্প করেছে, স্বামীর বেস্টফ্রেন্ডের পরিবার নিয়ে কাটানো ছুটির দিনগুলোর গল্প করেছে, দুই বছরের সংসারের ছোট ছোট গল্পও করেছে। শুধু মানুষটার নাম বলে নি। আর বলে নি কেন তিনি এই সুখের সংসার ফেলে চলে এলেন। আর কেনই বা বাবা বা তার পরিবার খোঁজ করতে আসে নি। এতো ভালোবাসার মানুষটা টুপ করে হারিয়ে গেলে তাকে খোঁজ করাটা স্বাভাবিক না?

বিছানায় বসে এসব ভাবতে ভাবতেই বেলার হাতে টান খেয়ে আবীরের বুকে উপরে এসে পড়লো। বেলা মুখ তুলে আবীরের দিকে তাকালো। মানুষটার ঘুম ভেঙে গেছে।

-এই বেলা? ঘুমাও না কেন? কতো রাত হলো?

-তোমার ঘুম ভাঙল কেন?

-তুমি পাশে না থাকলে শান্তিতে ঘুমাতেও তো পারি না। জানো না?

-আচ্ছা। এখন তো আছি? এখন ঘুমাও তো। 

-হুম। তুমিও ঘুমাও। এতোক্ষণ জেগে কি করছিলে?

-বাবার গল্প শুনছিলাম------।

-------------------------------

-আবীর? ঘুমাও এখন--। ঘুম পাচ্ছে আমার।

-হুম------।

সপ্তাহ খানেক পর।

৯ঃ৩০ বাজে। বেলা আবীরকে ডাকছে। আর ভদ্রলোক ঘোড়া বেঁচে ঘুমাচ্ছে। উঠার নাম গন্ধই নেই। ১০ টায় নাকি তার ইন্টারভিউ। এই সাতদিন বেশ কয়েকটা চাকরির জন্য এ্যাপ্লাই করেছে আবীর। কোথাও থেকেই ডাক আসে নি। গতকালই এই অফিসের নাম্বার থেকে কল করেছে ডেকেছে আবীরকে। হাতে কলমে পরীক্ষা করে তারপর চাকরি৷ আর এইদিকে আবীর ঘুম থেকে উঠছেই না। 

ঘড়ির কাঁটা ৩০ এর ছুঁতেই বেলা আবীরের মুখের উপর এক গ্লাস পানি ঢেলে দিল। বেচারা থতমত খেয়ে উঠে বসে বোঝার চেষ্টা করছে এই বিনা মেঘে বৃষ্টি আসলো কোথা থেকে। বেলা পানি ঢেলেছে বুঝতে পেরে হাত ধরে টেনে বেলাকে বিছানায় ফেলে বেলার মুখের দিকে ঝুঁকল আবীর।

-খুব সাহস হয়েছে না তোমার? আমার মুখে পানি ঢালা না?

-তুমিই তো উঠছো না। আমি কি করবো? ১০ টায় না তোমার ইন্টারভিউ?

-ওহ শিট? -------- ঠিক করে ডাকলে তো হতো?? আমার কতো দেরি হয়ো গেছে?

-ইশ! এখন আমার দোষ? আমি সেই এক ঘন্টা ধরে ডাকছি তোমাকে--।

-কচু ডাকছো----।

আবীর বেলার নাকে নাক ঘষে বেলার ঠোঁটের দিকে ঠোঁট বাড়ালো। বেলা আলতো করে আবীরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে বসলো। আবীর শুয়ে শুয়ে বেলার লাল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

-৯ঃ৩৫ বাজে। তোমার দেরি হচ্ছে না এখন?

-ইন্টারভিউটা পাশ করে গেলেই কি হয়ে যাবে? এর পর তো সার্টিফিকেটগুলো চাইবে। সেখানে আসাদ চৌধুরীর নাম তো থাকবেই বেলা----।

-যা হওয়ার দেখা যাবে তখন। এখন যাও তো। ফ্রেশ হয়ে রেডি হও। আর নিশান ভাইয়া গাড়ি রেখে গেছে---।

-ওই বাড়ির গাড়ি------।

-গাড়িটা নিশান ভাইয়ার আবীর। বাবার দেয়া না। নিশান ভাইয়ার নিজের টাকায় কেনা------।

------------------------------

-যাও তো? রেডি হও----। এমনিতেই সময় নেই। আর উনি শুয়ে আছে এখনো?

আবীর ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে ফরমাল গেটআপে নিশানের গাড়ি নিয়ে বের হল। আর বেলা আর সায়েরা আবীরের যাওয়ার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। আবীরের গাড়িটা একটু দূরে যেতেই বেলার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। কিছুই ভালো লাগছে না। বিতৃষ্ণা লাগছে। কেমন জানি ভয় ভয় করছে বেলার। কি হচ্ছে বা কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছে না। তবে কিছু একটা খুব বাজে ঘটতে চলেছে সেটা টের পাচ্ছে বেলা। সায়েরা বেলার চুলে হাত বুলাচ্ছেন। ভয় ভয় লাগছে সায়েরার নিজেরও। আবার ওদের জীবনে কি ঝড় আসতে চলেছে কে জানে?

গোটা একটা দিন কেটে গেছে। এর মধ্যে আবীরের নাম্বারে কম করে হলেও ১০০-১৫০ কল করে ফেলেছে বেলা৷ ফোনে কল ঢুকছেই না৷ সারাটা রাত অজানা এক ভয়ে দু চোখের পাতা একও করতে পারে নি বেলা। ভোরের আলো ফুটতে আবার কল করলো আবীরের নাম্বারে। এবারও যান্ত্রিক কণ্ঠে আওয়াজ এলো-

"আপনার ডায়েলকৃত নাম্বারটিতে এই মূহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে  না। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পরে আবার ডায়েল করুন--------।"

বেলা এবার একেবারেই ভেঙে পড়ল। আবীর কোথায় ইন্টারভিউ দিতে গেছে তার ঠিকানাও জানে না বেলা৷ জানলে হয়তো সেখানে খবর নেয়া যেত। সায়েরা মেয়েকে সামলানোর চেষ্টা করছেন। বেলা অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে চৌধুরী ম্যানশনে কল করলো। কয়েকবার কল যেতেই কেউ একজন রিসিভ করলো।

-হ্যালো?

-হ্যালো? মা? আমি বেলা--। আবীর কি ওই বাড়িতে গেছে? গতকাল সকালে বেরিয়েছে। ও এখনও ফিরে নি। প্লিজ একটু দেখুন না? হ্যালো?

ওইপাশ থেকে কল কেটে গেল। বেলাও ধপ করে ফ্লোরে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। বারবার মনে হচ্ছে আবীরের কিছু একটা হয়েছে। সায়েরা কিছুতেই বেলাকে সামলাতে পারছে না।

চৌধুরী ম্যানশনে কল কেটে দিয়ে মাইশাও চিন্তিত মুখে ড্রইংরুমে এসে দাঁড়িয়েছে। আসাদ চৌধুরী আর নিশান সোফায় বসে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। মাইশার মুখের দিকে তাকিয়ে নিশান আর আসাদ সাহেব দুজনেই কাজ বন্ধ করলেন।

-কি হয়েছে মামি? এতো চিন্তিত লাগছে কেন তোমাকে?

-বেলার কল এসেছিল---।

কথাটা শুনেই নিশান উঠে দাঁড়িয়ে গেল।

-বেলা ভাবি কল করেছিল? কি হয়েছে? কি বললো?

-আবীর---। আবীর নাকি গতকাল সকালে বেরিয়েছে---। এখনও বাসায় ফিরে নি-----।

-বাহ! এই না হলে ছেলে মানুষ করেছি মাইশা! ৭ দিন হয়েছে সবে বিয়ে করেছে! এর মধ্যেই বউ ফেলে চলেও গেল!

-মামা! কিসব বলছো! আবীর ভাই এমন করার ছেলেই না---। নিশ্চয়ই কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। গতকাল আবীর ভাইয়ের ইন্টারভিউ ছিল---। উফ! কি হচ্ছে! কোথায় খুঁজবো?

-খুঁজতে হবে না--। ওর মন চাইলে আপনিই চলে আসবে-----।

-মামা? তুমি কি পাথর হয়ে গেছ! বুঝতে পারছ তুমি! আবীর ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না-আবীর ভাইকে----। অবশ্য তোমাকে বলে কি হবে! তোমরা তো অর্থ-বিত্তের আর বংশমর্যাদার মোহে ভালোবাসা শব্দটাকে সম্মান করতেই ভুলে গেছ। তুমিও ঠিক বড় দাদুর মতো হয়েছ। -----

-নিশান? কি বলছিস তুই? বাবা কি করেছে?

-কি করেছে! কি করেনি সেটা বলো! আবীর ভাই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এই সাতদিন আমি পুরান বাড়িতে গিয়েছিলাম সবটা খোঁজ করতে---। হ্যাঁ গতকাল আমি গ্রামের চৌধুরী বাড়ি থেকে ফিরেছি। সেখানে যা জানতে পেরেছি---। সেটা বলার সাহস আমার ছিল না। এতোগুলো বছর ধরে তোমাকে তিলে তিলে কষ্ট পেতে দেখেছি--। সেই কষ্টটা তোমার নিজের মানুষগুলোর জন্য সেটা ভাবতেও পারি নি---।

-কি বলতে চাস নিশান? ঠিক করে বল কি জেনেছিস?

-বড় মামী কোথায় মামা?

-সে চলে গেছে---। তার টাকার দরকার ছিল--। সেটা নিয়ে সে চলে গেছে একেবারে---। কেন জিজ্ঞেস করছিস তার কথা? কেন?

-এসব তোমাকে বড় দাদু আর আমার দাদু বলেছে না মামা?

-কি বলতে---চাচ্ছিস তুই নিশান!

-বড় মামী মোটেও টাকা নিয়ে চলে যায় নি মামা--। তোমার আর মামীর বিয়ের খবরটা আমার দাদু দু বছর চাপা দিয়ে রেখেছিল ঠিকই। পরে সেই খবর বড় দাদুর কানে পৌঁছে। আর তখনই তোমাকে ব্যবসার কাজে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে মামীর বাড়ি যায়। সেখানে অনেক ধমকে, টাকার লোভ দেখিয়ে কাজ না হলে কি করেছে তোমার বাবা জানো? ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছে মামিকে। উনার তো বাবা মা ছিল না তোমার বাবার ফাঁদে পা ও দিয়ে ফেলেছে বেচারি। দাদু বলেছে কি জানো? কখনো নিজে থেকে তোমার সামনে এলে দাদুর মরা মুখ দেখবে মামি---। একটা বাবা-মা হারা সন্তানের জন্য এটা কতো বড় কষ্টের বুঝতে পারছো মামা! এখন বুঝতে পারছ মামি মরেও যায় নি--। তোমাদের টাকা নিয়ে চলেও যায় নি কোথাও--। তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। বাধ্য করা হয়েছিল চলে যেতে--।

নিশান চিৎকার করে কথাগুলো বলছে আর আসাদ সাহেব পাথরের মতো বসে রইলেন সোফায়। এতো বড় ভুলটা কিভাবে করলেন তিনি সেটাই বুঝতে পারছেন না। নিজের সবচেয়ে প্রিয় সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে এতোগুলো বছর অবিশ্বাস করে এসেছে। ঘৃণা করে এসেছে মনে মনে। যে দোষ মেয়েটা করেই নি তার জন্য না জানি কতো শাস্তি পেতে হয়েছে তাকে! নিশানের রাগ কিছুটা কন্ট্রোল হতেই আসাদ সাহেবের সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো।

-মামা! মামি চলে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু প্রতিনিয়ত তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা ও করেছে। হ্যাঁ এটা আলাদা কথা যে তার লেখা একটা চিঠিও তুমি পাও নি--। বড় দাদু তোমার নামে মামির লেখা সবকটা চিঠিই লুকিয়ে রেখেছিল এতোগুলো বছর। এতো বছর পর আমি ওই বাড়ি না গেলে চিঠিগুলো পেতামও না--। নতুন চিঠিও আছে বেশ কয়েকটা। এতো বছর খালি পোস্টবক্সে পড়েছিল অবহেলায়--। 

নিশান চিঠিগুলো এগিয়ে দিতেই আসাদ সাহেব চিঠিগুলো হাত বাড়িয়ে নিলেন। চিঠির উপরে প্রাপকের জায়গায় আসাদ সাহেবের নাম ও ঠিকানা লেখা। প্রেরকের নাম নেই।তবু লেখাগুলো দেখেই আসাদ সাহেব চিনতে পারলেন। প্রতিটা চিঠিতে প্রিয় একজন মানুষের উপস্থিতি টের পাচ্ছেন তিনি। লেখাগুলোয় হাত রেখে আসাদ সাহেবও ছেলেমানুষের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।

০৮!!

আসাদ সাহেব একটা একটা করে চিঠি পড়ায় মন দিলেন। একদম শুরু থেকে শুরু করলেন। ২১ বছর আগের লেখা চিঠিটা ভাঁজ খুলতে খুলতে চোখ জোড়া ভিজে আসছে আসাদ সাহেবের। 

"আসাদ,
আমি চলে যাচ্ছি। বাবা তোমাকে কি বলবে আমি জানি না। তবে আমার পক্ষে আরেকজন বাবার লাশ দেখা সম্ভব না। শরীরটাও ভালো নেই। কোথায় যাব-কি করবো জানি না৷ তবে জানি তুমি বাবাকে রাজি করিয়ে আমাকে ঠিক খুঁজে আনবে। তত দিন না হয় অপেক্ষাই করবো। আর একটা খুশির খবর তোমাকে দেয়া হয় নি। সকালেই জানতে পেরেছি- তোমার ছোট্ট প্রিন্সেস আসছে। তুমি খুশি তো?"

চিঠিটা পড়ামাত্র আসাদ সাহেব আবার ভেঙে পড়লেন। মাইশা আর নিশান কিছুতেই সামলাতে পারছে না।

-আসাদ? কাঁদছ কেন এভাবে? কি লেখা আছে চিঠিতে?

-সি ওয়াজ প্রেগন্যান্ট মাইশা। আমাদের বেবি------। ওই সময়টাতে তো ওর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল আমাকে---। ও এই ভরসায় চলে গেছে যে আমি ওকে ঠিক খুঁজে বের করে নিয়ে আসবো বাড়িতে। ওর সংসারে----। আর আমি কিনা‌?

-একটু শান্ত হও আসাদ। বাকি চিঠিগুলো পড়ো আগে--। দেখো কোন খোঁজ পাওয়া যায় কিনা---।

চোখ মুছে পরের চিঠিগুলো একটার পর একটা পড়া শুরু করলো আসাদ সাহেব।

"জানো?
এক সপ্তাহ আগে মেয়েটা দুনিয়ায় এসেছে। ঠিক তোমার মতো দেখছে হয়েছে তোমার প্রিন্সেস। তোমার মতো তেজদীপ্ত চোখ, সেই হাসি, আর সেই মেজাজ। বাব্বা! তাই তোমার দেয়া নামটাই রাখলাম। বেলা তাসমিহা। তবে বড় হলে বেলা নাম রাখায় কেউ ওকে রাগালে ওর পাশে কি তুমি থাকতে পারবে? আচ্ছা? বাবা কি এখনো জেদ ধরে বসে আছে? আমাকে নিতে আসবে না তুমি? এই শহরটায় আর কতোদিন থাকতে হবে তোমায় ছেড়ে? আর যে পারি না আমি।"

"আজ মেয়েটাকে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গেছিলাম। ভর্তি নেয় নি। বাবার নাম নেই বলে। চিন্তা করো? চৌধুরী বাড়ির সন্তান আমার বেলা। তার আজ এমন স্কুলে পড়তে হচ্ছে যেখানে নাম থাকা আর না থাকায় কিছু যায় আসে না। মেয়েটাও আজকাল জেদ ধরে না জানো? একদম চুপসে গেছে এসব দেখে। মা হিসেবে আজ সত্যিই নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে আমার। কিছুই ভাবতে পারি না আর।"

"মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক দুটো পরীক্ষাতেই তোমার মেয়ে বোর্ড টপ করেছে জানো? খবরটা তুমি জানলে হয়তো সারা শহর মিষ্টি বিলাতে তাই না? তবে জানো এতো ভালো রেজাল্ট দেখে অনার্সে ভর্তিটা সহজ হয়েছে ওর--। নইলে কি যে হতো?"

"শুনছো?
আজকে আমাদের ছোট্ট বেলার বিয়ে। ছেলেটা ভিষণ ভালো জানো? তুমি যেমনটা আমার খেয়াল রাখতে জামাইও ঠিক তেমনটা মেয়ের খেয়াল রাখে। বেলাকে বউ সাজানোর সময় আমাদের বিয়ের সময়টা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেদিন তো নিজে একা বিয়ের সাজ নিয়েছি। লজ্জায় মরে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল আমার। আমি বউ সাজছি আর সামনে তুমি হা করে তাকিয়ে দেখছিলে আমাকে। সাজ হতেই তুমি জাপটে ধরে রেখেছিলে অনেকক্ষণ। যেন ছাড়লেই আমি কোথাও হারিয়ে যাব। মনে আছে তোমার? মাইশা আপা আর দিনার ভাইয়া পরে আমাকে নিয়ে কতো হাসাহাসি করছিল! জানো? বেলাটাকে বউ সেজে কি যে সুন্দর লাগছে। তুমি যদি একবার দেখতে! আজীবন আমার এই আক্ষেপটা থেকে যাবে।"

"আর কতোগুলো বছর অপেক্ষা করলে তুমি আসবে আসাদ? আমি যে ক্লান্ত! আর পারছি না।"

শেষ চিঠিটা চারদিন আগে লেখা। সবকটা চিঠি বুকে জাপটে ধরে কাঁদছে আসাদ সাহেব। গত ২১ টা বছর মেয়েটাকে নিয়ে কি দুঃসহ যন্ত্রণাই না ভোগ করেছে তার ভালোবাসার মানুষটা। অপরাধ কি ছিল তার? ভালোই তো বেসেছিল তারা একে অপরকে? ভালোবাসার অপরাধে এতো বড় শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে দুজনকেই! কেন? কোথায়, কোন আইনে লেখা আছে দুটো মানুষ একে অন্যকে ভালোবাসতে পারবে না? কি অন্যায় ছিল সেই শিশুটার যে জন্মের পর থেকে বিনা অপরাধে হাজারটা শাস্তি পেয়েছে! অথচ তাদের ভালোবাসা তো পবিত্র ছিল। কোন ধরনের কালিমা স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারে নি তাদের দুই বছরের ভালোবাসাকে। মেয়েটার দাদি মারা যাওয়ায় দাফন কাফনের কাজ শেষ করেই তো বিয়েটা করে নিয়েছিল। প্রত্যেকটা নিয়ম-রীতি সব মেনেই তো হয়েছিল বিয়েটা! অথচ তাদের সন্তান আজ পর্যন্ত বাবার নামের অংশও হতে পারে নি। কেন? কেন? কেন? 

আসাদ সাহেবের বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে যেন। কিছু একটার তালমেল করতে পারছেন না। আর এই চিঠিগুলো কোত্থেকে এসেছে, কে পাঠিয়েছে তাই বা জানবে কেমন করে?

এসব ভাবতে ভাবতেই কলিং বেলের আওয়াজ ভেসে এলো। আসাদ, মাইশা আর নিশান তিনজনেই একটু যেন সম্বিত ফিরে পেল। দরজা খুলতেই দারোয়ান বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

-কি হয়েছে?

-স্যার দেখুন না? এতো বার বারণ করছি উনারা শুনছেনই না---। বারবার বলছে দুমিনিট কথা বলেই চলে যাব---। আমি আসতে দিতে চাচ্ছি না দেখে মেয়েটা কেমন তেড়ে আসছে পাগলের মতো----।

-আজীজ? ঠিক করে বলো কে এসেছে? কারা কথা শুনছে না?

-না মানে---। স্যার। এই যে উনারা দুজন---।

দারোয়ানের কথা শেষ হওয়ার আগেই মানুষ দুজন বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালো। দুমিনিট মুখের দিকে তাকিয়ে কি মনে হতেই আসাদ সাহেব ছুটে মেইন ডোরের সামনে এলেন। পিছন পিছন মাইশা আর নিশান। আসাদ সাহেবের চোখের জলেরা আবার বাঁধ ভেঙেছে। এই কান্না সুখের নাকি দুঃখের বুঝা গেল না। কয়েকবার চেষ্টা করে কিছু একটা বলতে গিয়েও পারলেন না আসাদ সাহেব।

-তুমি?

আর একটা শব্দও কারো কানে গেল না। সবাই হা করে সামনে দাঁড়ানো মানুষ দুটোকে দেখছে একবার। আর একবার আসাদ সাহেবকে।

-আসাদ?

মানুষটা উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরেই হয়তো ঢলে পড়ে যাচ্ছিল। আসাদ সাহেব তার দু বাহু জাপটে ধরে পড়া থেকে বাঁচালেন। কোনমতে কাঁপা হাতে গালে একটা হাত রাখলেন।

-সায়েরা? সায়রু? তুমি? তুমি ঠিক আছো?

-আসাদ! এতোগুলো বছর!

সায়েরা আর আসাদ এতোগুলো বছর পর প্রিয় মানুষটাকে পেয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। কি বলবেন কি করবেন কিছুই যেন মাথায় কাজ করছে না। বাকি সবার অবস্থা আরো করুণ।

এই যে বেলা! মেয়েটা এসেছে নিশানের সাথে কথা বলতে। আবীর তো নিশানের গাড়িটা নিয়ে গিয়েছিল গতকাল। গাড়ির খোঁজ করলপ হয়তো আবীর কোথায় কেমন আছে জানা যাবে--। এই কথাটা নিশানকে জানাতে এসেছিল। বেলার কাছে তো নিশানের নাম্বার নেই। আর কয়েকবার চৌধুরী ম্যানশনে কল হলেও কেউ ফোন তুলছিল না। তাই মায়ের সাথে এ বাড়িতে এসেছে বেলা। কিন্তু এখানে এসে যা ঘটছে তার কিছুই বুঝতে পারছে না। আসাদ চৌধুরীর সাথে সায়েরা বা তার কিসের সম্পর্ক সেটাও মাথায় ঢুকছে না। এতো ঝক্কির মধ্যে বেলাও ভুলে গেল কেন এসেছিল চৌধুরী ম্যানশনে।

নিশান আর মাইশারও একই অবস্থা। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে সায়েরাই যে আসাদ সাহেবের সেই ভালোবাসার মানুষটা সেটা খুব ভালোই বুঝতে পারছে। আর বেলা! এতো কিছু না ভেবে সবাই মিলে বেলা আর সায়েরাকে ড্রইংরুমে এনো বসালো সবাই মিলে।

আসাদ সাহেব সায়েরাকে শক্ত করে জাপটে ধরে বসেছিল অনেকক্ষণ। কেউ কোন কথা বলতে পারছে না। বেলা অবাক অবাক চোখে সব দেখছে। এই মানুষটাই কি তার বাবা?

-মা?

-বেলা! এই যে --- তোর বাবা---।

-বাবা?

আসাদ সাহেব হাতের ইশারায় বেলাকে কাছে ডাকলে বেলা আসাদ সাহেবের বসা সোফার সামনে বসে পড়লো। আসাদ সাহেব বেলার মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে গালে হাত রাখলেন।

-আমার বেলা! সায়েরা? ও আমাদের বেলা! কতো স্বপ্ন ছিল আমার ছোট্ট বেলাটাকে নিয়ে---। প্রথমবার ওকে কোলে নিয়ে বাবা হয়ে ওঠার স্বপ্ন---। ওর প্রথমবার বাসায় আসার স্বপ্ন---। প্রথম হামাগুড়ি দেয়ার স্বপ্ন--। হাঁটাহাঁটি করে প্রথম হাঁটতে শেখার স্বপ্ন---। দুর্বোধ্য ভাষায় ওর প্রথম বুলিতে বাবা ডাকার স্বপ্ন----। ওর বেড়ে উঠা--- সাইকেল চালানো--। সাঁতার কাটা-- স্কুলে যাওয়া--। কলেজ---। ভার্সিটি---। বিয়ে----। আমার সবকটা স্বপ্নই অপূর্ণ রয়ে গেল সায়েরা----। কেন সায়েরা?

-বাবা? শান্ত হও না প্লিজ?

-কি করে শান্ত হবো মা? এতোগুলো বছর আমি একটা ভুলকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলাম। একটা মিথ্যে আমার সমস্ত জীবনটাকে নরক করে তুলেছিল--। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার মানুষটাকে ঘৃণা করে এসেছি গত ২১ টা বছর---। আমার নিজের সন্তানটাকে বারে বারে অকথ্য ভাষায় বাজে ব্যবহার করেছি----।

-বাবা? সেসব তো না জেনে করেছ -------।

-কিন্তু করেছি তো---। আমার থেকে দূরে কতো কষ্ট না পেয়েছ তোমরা! আর আমি! কিছুই করতে পারি নি----।

আসাদ সাহেব বেলা আর সায়েরা দুজনকেই জড়িয়ে ধরে আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। নিজের ভুলের জন্য তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান দুজন মানুষ এতোটা কষ্ট সহ্য করেছে। বারবার অপমানিত হয়েছে মানুষের কাছে। কখনো না খেয়ে থেকেছে--। কখনো----। এতো কিছুই হত না যদি তিনি তার বাবার কথাটা অন্ধের মতো বিশ্বাস না করে নিজে খোঁজ খবর নিতেন। অবশ্য চেষ্টা করেন নি তেমনটাও না। তবে সেরকম করে চেষ্টা করলে অবশ্যই কারো না করো কাছে সত্যটা জানতে পারতেন--।

-আসাদ? যা হয়েছে ভুলে যাও--। আমারই এতো বোকামি করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত হয় নি--।

-কিন্তু তুমি তো বাড়ি ছেড়ে যাও নি সায়েরা--। যেতে পারো না। সেটা তো আমার বোঝা উচিত ছিল--।

-শান্ত হও না প্লিজ? এমন করলে শরীর খারাপ করবে তোমার---।

-একটু আগে নিশান তোমার চিঠিগুলো দিল---। ২১ বছর পর জানতে পারলাম বাড়ি ছাড়ার সময় তুমি প্রেগন্যান্ট ছিলে--। আমাদের ছোট্ট বেলাটা পৃথিবীতে এসেছে---। ওর বিয়ে-------।

-আসাদ?

-গ্রামের বাড়িতে থেকেও তোমার চিঠিগুলো হাতে পাই নি বিশ্বাস করো---। এই নিশানটা না থাকলে--। হয়তো আজীবন তোমাদের এভাবেই ভুল বুঝেই যেতাম---।

-নিশান?

- ও তানিম ভাইয়ার ছেলে---। ওর দাদু সারাজীবন বাবার পাশে ছিল। তানিম ভাইও আমাদের প্রত্যেকটা ব্যাপার সামলেছে বাবার চোখ থেকে--। আর নিশানের বাবা মা একটা এ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর ও আমাদের সাথেই ছিল। মাইশা ওকেও আবীরের মতো স্নেহ দিয়ে বড় করেছে---।

-মাইশা আপা?

সায়েরা এসে মাইশাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। 

-তোমার বিয়ের দিন পরিচয় হলেও মনে হয়েছিল কতো যুগ ধরে তুমি আমার বোন আপু----। এতোগুলো বছর মানুষটাকে সামলেছ--। কি বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দিব?

-সায়েরা--। পাগলটা তোমাকে তো অনেক বেশি ভালোবাসে--। তাই ভেঙে যেমন পড়েছিল তেমন বদলেও গেছিল অনেকটা। তুমি ফিরেছ যখন আবার সবটা ঠিক আগের মতো হয় যাবে--। আর আমি ওকে সামলাই নি বোন--। সে বন্ধু হয়ে আমার বিপদের সময়ে আমাকে শেষ আশ্রয়টা দিয়েছিল----।

সবার কান্নাকাটি দেখে নিশানও চোখের কোণা মুছলো। তার হাতে ছোট্ট একটা ডায়েরি ধরা। ডায়েরিটা তার বাবার। এতো কাহিনী তার জানা ছিল না। কিছু বাবার ডায়েরি পড়ে জেনেছে। কিছু নিজে খোঁজ নিয়ে বের করেছে। গ্রামে গিয়েছিল আবীরের বাবার খোঁজ করতে সামনে এসে গেল আসাদ সাহেবের পরিবারের খবর। এ যেন আজব কোন মায়াজালে আটকা পড়েছে সবাই!

ঘটনার আকস্মিকতা সামলে উঠতে বেলার একটু হুঁশ ফিরলো কোনমতে আসাদ সাহেবের হাতটা ধরে ডুকরে উঠলো।

-বাবা? আবীর?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন