৩৩!!
-এই অনু? আর কতো পড়ে পড়ে ঘুমাবে বলো তো? সন্ধ্যে হয়ে আসছে তো বউপাখি। এই মেয়ে ওঠো না? অনু? অনুউউউউউউউউ? কখন রেডি হবে কখন বাইরে যাবো? অনুউউউপাখিইইইই? কখন উঠবে এই মেয়েটা? দুপুরে ঘুমাতে চাইছিল না, আর এখন উঠতেই চাইছে না। এই মেয়েটাকে নিয়ে যে কি করি আমি! এই অনু? তোমাকে মজা দেখাচ্ছি দাঁড়াও।
চারদিকে সন্ধ্যের আবছা অন্ধকার নেমে আসছে দেখে অরণ্য অনামিকাকে বেশ কয়েকবার ডেকে শেষে হাল ছেড়ে দিলো। আরো একবার অনামিকাকে ডেকে শেষে নিজেই উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে মুখ মুছতে মুছতে অনামিকাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখতে অরণ্য টাওয়ালটা পাশে রেখে অনামিকার পাশে বসলো। মেয়েটা এমন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে যে অরণ্য যে এতোবার ডেকেছে একদমই টেরই পায়নি অনু। অরণ্য অনামিকার গালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে আরেকবার ডাকবে এমন সময় খেয়াল করলো অনামিকার মোবাইলের স্ক্রিনটায় আলো জ্বলে উঠেছে। মোবাইলটা হাতে নিতেই বোবা স্ক্রিনে কারো নাম্বার থেকে ইনকামিং কল দেখে আরেকবার অনামিকাকে ডাকলো অরণ্য। অনামিকা এবারে পাশ ফিরে অরণ্যের গা ঘেঁষেই গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রইলো। অনুর এমন পাগলামি দেখে হেসে ফেললো অরণ্য। অবশ্য ততক্ষণে কলটা কেটে যেতেই মোবাইলের স্ক্রিনে ৮৬ মিসডকল দেখে অরণ্য জাস্ট হা হয়ে গেল। এতোবার কে করেছে ভাবতে ভাবতেই আবার স্ক্রিনে নাম্বারটা ভেসে উঠতেই নিজেই কলটা রিসিভ করলো অরণ্য। কিছু বলার আগেই অপরপ্রান্ত থেকে ভারি পুরুষ কন্ঠের ধমক ভেসে এলো।
-কতোক্ষণ ধরে কল করছি তোমাকে অনামিকা? কলটা রিসিভ করছিলে না কেন? কি প্রবলেমটা কি তোমার? সেকেন্ড টাইম এমন কাজ কক্খনো করবা না একদমই। আর এখন চুপ করে আছো কেন? অনামিকা? হ্যালো? হ্যালো অনামিকা?
-হ্যালো? কে বলছেন?
অরণ্য আর কিছু জিজ্ঞেস করার বা শোনার আগেই কয়েকটা বিপ বিপের শব্দে অরণ্য কান থেকে মোবাইলটা সরিয়েই দেখতে পেল মেয়েটার মোবাইলটাই অফ হয়ে গেছে। কয়েক বার অন করার চেষ্টা করেও ব্যাটারি লো শো করে মোবাইল অফ হয়ে যাচ্ছে। অরণ্য একবার হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে মোবাইলটা চার্জে লাগিয়ে এসে আবার অনামিকার পাশে এসে বসলো। আরো কিছুক্ষণ অনামিকাকে ডাকার পরও মেয়েটার ওঠার নামগন্ধ নেই দেখে অরণ্য নিজেই একটু ঝুঁকে এসে অনামিকার ঠোঁট জোড়ায় নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে গভীর আবেশে চুমো খেল। একটু পরেই ঘুমের ঘোর কাটিয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসলো। আর অরণ্যে সেটা দেখে রীতিমতো হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। অনামিকা একটু বিরক্ত হয়েই অরণ্যকে ধুপধাপ কয়েকটা কিল বসালো। অরণ্যও উঠে বসে অনামিকার অভিমানে লাল হয়ে আসা গাল ছোট্ট করে দুটো চুমো এঁকে দিল।
-গাল ফুলাচ্ছ কেন বউপাখিটা? এভাবে গাল না ফুলিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে জলদী রেডি হও।
-বাইরে যাবো তো ডাকলেই পারতে। এভাবে দম আটকে মারার প্ল্যান করছিলে কেন? আমি কি তোমার মতো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাই নাকি যে ডাকলে উঠবো না?
-এহ! আসছে। মিনিমাম এক ঘন্টা ধরে ডাকছি তোমাকে। তোমার তো চোখ মেলার নাম গন্ধও নেই। এমন অজ্ঞানের মতো ঘুমাচ্ছিলে যেন আমি কত রাত তোমাকে ঘুমাতে দিই না।
-ধ্যাত। সরো তো। এমনিতেই কয়েকদিন ঘুম হচ্ছে না ঠিক করে। তাই হয়তো ডেকেছ টের পাই নি। আর আপনি মোটেও ঘন্টাখানেক ধরে ডাকেন নি জনাব। বড়জোর এক দু বার ডেকেছেন। এর বেশি না।
-এক দুইবার না? আমি ওঠার সাথে সাথেই তোমাকে ডেকেছে। কতোক্ষণ ডাকার পরও যখন ওঠোনি তখন নিজে ফ্রেশ হয়ে এসেছি। তারপর দেখি তোমার মোবাইলে কেউ একজন কল দিয়েছে। আবার ডাকলাম। কতবার কল করেছে জানো! এইটি সিক্স মিসডকল! তুমি তো উঠলেই না। তাই কলটা রিসিভ করলাম।
-কে? কে করেছে? আর কি বললো?
-কি আর বলবে? এতোবার কল করার পর রিসিভ করলে যা বলার সেটাই বললো। এতোক্ষণ কল রিসিভ করো নি তুমি, আর ঝাড়ি খেলাম আমি।
-তা-তারপর?
-তারপর নাটকীয়ভাবে তোমার মোবাইলটা বন্ধ হয়ে গেল। এতোবার পাগলের মতো কল করলে মোবাইলের আর কি দোষ? দেখছে কল রিসিভ করছে না, তবু কল করেই যাচ্ছে তো করেই যাচ্ছে।
-ওহ আচ্ছা? আপনি যেন কয়বার কল করেছিলেন স্যার?
-এই এই? আমি তোমার হাজবেন্ড ওকে? আমি ইচ্ছে হলে হাজার বার কল করতে পারি। কে লোকটা! আমার বউকে এতোবার কল করার সাহস পায় কোত্থেকে হ্যাঁ?
-কথা বললে তুমি, কে আমি কি করে জানবো? সরো তো। সন্ধ্যে হয়ে গেছ এখন বসে বসে বকবক করতে হবে না। নইলে আমার আবার ঘুম পেলে ঘুমিয়ে যাবো।
-আরে এই? না না না। অনু? যাও না বাবা হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। হালকা কিছু নাস্তা করে রেডি হয়ে নাও। বের হতে দেরি হলে তো ফিরতেও দেরি হবে বাবা। তোমার তো কাল কলেজও আছে নাকি?
-হুম। আমি এক্ষুণি যাচ্ছি।
-এই অনু?
অনামিকা তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে নামার আগেই অরণ্যের ডাকে তাকিয়েই অরণ্যের ঠোঁটের কোণে বাঁকা একটা হাসি দেখে অনামিকা ভ্রু কুঁচকে তাকালো অরণ্যের দিকে।
-কি?
-তুমি যে বললে এই কয়দিন ঠিকমতো ঘুম হয়নি? আমি তো একটুও জ্বালাই নি কাল পরশু। তাহলে ঘুমের কি হলো তোমার?
-অসভ্য ছেলে! সারাদিন এসব চলে না মাথায়? এমনিতেই ঘুম হয়নি। একে তো আমি জেগে আছি তিনি পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছেন, এখন কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলতে এসেছে।
-আহারে আমার সোনাবউটা! ঘুম আসেনি যখন, ডাকো নি কেন আমাকে? একা একা জেগে থাকতে কষ্ট হয়নি আমার বউপাখিটার? হুম হুম?
-তোমার তো সকালে অফিস থাকে। তাই আর বিরক্ত করি নি।
-আচ্ছা যাও। আজ রাতে দুজনেই একসাথে জাগবো। তুমি, আমি, আকাশের ওই গোল পুরো চাঁদ, বারান্দার তোমার প্রিয় ঝুল দোলনায় বসে প্রেম করে কাটিয়ে দিবো সারা রাত।
- তুমি একটা খুব খারাপ অরণ্য। খুব খুব খুব খারাপ। কোথায় ঘুম আসছে না। বলবে আমি তোমার ঘুম পাড়িয়ে দিবো আদর করে, তা না?! উল্টো নিজে সুদ্ধো জেগে থাকার প্ল্যান করছে সে।
-দেখলে তুমিও চাও আমি আদর করি তোমায়। শুধু মুখেই এসব খারাপ, খুব খারাপ বলে ভাব নাও। বুঝি বুঝি।
-জি জনাব। একটু বেশিই বুঝেন। সকালে যে আপনার অফিস আর আমার কলেজ থাকে সেটা কি মনে থাকে মিস্টার সর্বজ্ঞানী সবজান্তা?
-আরে এসব অফিস,কলেজ একদিন মিস দিলে কিছু হয়না। বউয়ের ভালোবাসার কাছে এসব হাজার অফিস কলেজ কোরবান।
-ধ্যাত। তোমার সাথে কথা বলাই না উচিত না। কোত্থেকে কি বলো না বলো নিজেও জানো না। আর কিসব কথা! কেউ শুনলে নির্ঘাত পাগল বলবে।
-সখী হে, লোকে যদি পাগল বলে আমার তাতে যায় কি আসে?
তোমারো লাগিয়া পাগল হয়ে বাঁচিয়াছি মরিবার আশে।
-সো মিন অরণ্য! কবিতা না কবিতার মাথা! আর একবারও এসব আজেবাজে কবিতা শোনাতে এলে না খামচি দিবো ধরে বলে দিলাম। হুহ। এসেছে আমার কবি মহারাজ!
অরণ্যের আনা নীল জুম শাড়িটা পড়ে হালকা কাজল টেনে আর ঠোঁটে হালকা মিষ্টি লিপস্টিকের ছোঁয়ায় নিজেকে রাঙিয়ে বের হয়েছে অনামিকা। কোলাহলপূ্র্ণ ব্যস্ত শহরটা শান্ত হয়ে নিরব হয়ে আসা পর্যন্ত নিজেদের মতো করেই ঘুরে বেড়িয়েছে অরণ্য আর অনামিকা। ওরা যখন বাড়িতে ফিরেছে তখন প্রায় বেশ রাতই হয়ে গেছে। বাইরে এতো ঘুরোঘুরি করেছে যে টুকটাক যা খেয়েছে তবু খিদে পেয়ে গেছিল দুজনেরই। তাই বাইরে থেকেই খেয়ে এসেছে ওরা। বাইরে থেকে ফিরে কোনোমতে হাত মুখ ধুয়ে এসেই বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে অনামিকা। অরণ্যের সাথে পাগলামি করে ছুটোছুটি, হাঁটাহাঁটি করতে করতে টায়ার্ড না হলেও এবারে নড়তে পর্যন্ত ক্লান্তি লাগছে অনুর। অরণ্য ফ্রেশ হয়ে অনুকে এভাবে চোখ বুজে শুয়ে থাকতে দেখে হেসে বিছানায় অনুর গায়ের উপরেই নিজের দেহটা এলিয়ে দিল। অনামিকা ধড়ফড় করে তাকিয়ে অরণ্যকে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করতেই অরণ্য এবারে শব্দ করেই হাসলো।
-কি গো বউপাখি? টায়ার্ড লাগছে নাকি?
-এতো বড় বিছানা থাকতে আমার গায়ের উপরেই এসে ঘুমাতে হবে তোমার? সরো তো। এমনিতেই এতো টায়ার্ড লাগছে যে শাড়িটা চেইঞ্জ করতেও ইচ্ছে করছে না এখন।
-আহারে! ঘুমাচ্ছে কে জানপাখি? বলেছিলাম না আজ তোমার নির্ঘুম রাতের সঙ্গী হবো? তোমার রাত জাগার গল্প শুনবো আজ। আর আদরের পরশে তোমার সমস্ত ক্লান্তিগুলো শুষে নিবো নিজের মধ্যে। তোমার সবটুকু ক্লান্তি, সমস্ত টেনশন, ভয়,সবটা আজ আমায় দিয়ে দাও কেমন?
-কাল কলেজ আছে আমার। কি করো এই?
অনামিকার কাঁধের কাছ থেকে আঁচলটা সরিয়ে নিয়ে গলায় নাক ডুবিয়ে দুষ্টুমিতে মেতেছিল অরণ্য। এবারে অনামিকার আদুরে ঘোরলাগা কণ্ঠটা শুনে মুখ তুলে অনামিকার নাকে হালকা করে নাক ঘষলো অরণ্য।
-একদিন ক্লাস মিস দিলে কিছু হবে না। ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে নাকি কোনো?
-উঁহু।
-তাহলে আদর করতে না দিয়ে দুষ্টুমি করছ কেন হুম? এমনিতে সারাদিন আমাকে টেনশনে রেখে অনেকগুলো শাস্তি জমা হয়েছে আপনার ম্যাডাম। শাস্তির বদলে আদর করতে চাইছি তাতেও বাগড়া দিতে হবে?
-আমি কি করলাম? তোমারও তো অফিস আছে সকালে?
-শশশশ। এতো বকবক করে মুডের চৌদ্দটা না বাজালে চলছে না তোমার না? এখন বেশি বকবকের জন্য শাস্তি দিই?
-হুম? কি?
-শাস্তি শাস্তি শাস্তি। আমাকে যে আদরের মাঝে ডিস্টার্ব করছ তার শাস্তি---। কি শাস্তি দেয়া যায় বলো তোমাকে?
অরণ্যের শাস্তির কথায় অনামিকার মিষ্টি করে হেসে গলা জড়িয়ে অরণ্যের চোখে চোখ রাখলো। অরণ্য ইশারায় কি হয়েছে জানতে চাইলেই অনামিকা অরণ্যের ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে মুখ লুকিয়ে নিল অরণ্যের বুকে। আর স্তব্ধ অরণ্যের কানে বারবার এসে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো ছোট্ট একটা শব্দ।
-ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
৩৪!!
-এই ভদ্রলোকটি এখনও না ঘুমিয়ে দুষ্টুমি করছে কেন গো হ্যাঁ? কাল অফিসে যাবে না বুঝলাম। সারাদিন কি পড়ে পড়ে ঘুমাবেন জনাব? আর সারাদিন এতো হা করে তাকিয়ে থেকেও কি মন ভরে নি আপনার যে সারা রাত হা করে তাকিয়ে থাকবেন এবারে?
গলায় অরণ্যের উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে পড়ায় ঘুমটা হালকা হয়ে এসেছিল অনামিকার। এবারে অরণ্যের আলতো ঠোঁটের স্পর্শে সুড়সুড়ি লাগায় চোখ মেলে তাকিয়ে অরণ্যের দিকে তাকালো অনামিকা। অনামিকা ঘুমের ঘোর কাটিয়ে অরণ্যের দিকে তাকাতেই অরণ্য অনামিকার গলায় আদুরে কামড় বসিয়ে দিতেই অনামিকা আবার কেঁপে উঠে নিজের হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো। অরণ্যের ঘোর লাগা স্পর্শ আর উষ্ণ নিঃশ্বাসে এতো সুড়সুড়ি লাগছিল অনামিকার যে হাসি চেপে রাখতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছিল অনামিকার। একসময় আর হাসি চাপতে না পেরে খিলখিল করে হেসে ফেললো অনামিকা। অরণ্য কয়েক মিনিট মুগ্ধ হয়ে অনামিকার হাসিটা দেখে অনামিকার খোলা চুলে হাত ডুবিয়ে দিয়ে অনামিকার মাথাটা টেনে নিয়ে অনামিকার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। একটু পরেই আবার সরে এসে অনামিকার নাকের ডগায় ছোট্ট করে একটা কামড় বসিয়ে দিয়ে নিজেই হেসে ফেললো অরণ্য।
-আই লাভ ইউ অনু। আই লাভ ইউ সো সো সো মাচ।
অরণ্যের কথায় অনামিকা মিষ্টি করে হেসে অরণ্যের হাতের উপরে মাথা রেখে অরণ্যের মুখের দিকে তাকালো। অরণ্য কৌতূহলী চোখে অনামিকার দিকে তাকিয়ে অনামিকার কোমড় জড়িয়ে ধরতেই অনামিকা একটু লজ্জা পেয়ে অরণ্যের বুকে মুখ লুকিয়ে নিল।
-কি দেখছো এভাবে? ঘুমাও না কেন? আর কি ভাবছ বলো তো সারাদিন?
-আমার বউটার লাল টুকটুকে রাঙা মুখটা দেখছি। বউটাকে যত দেখছি তত প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। এই যে আমার আদরে তোমার ঠোঁটে, গালে, মুখে, সমস্ত শরীর জুড়ে আমার আদরের লালিমা রঙ ছড়ায়, আমি মুগ্ধ হয়ে সারাদিন তোমার সেই রূপটা দেখতে পারি। তুমি যে এখনও আমার বুকের মধ্যে লজ্জায় ডুবে আছে, আমার কি ইচ্ছে করছে জানো অনুপাখি? সারাজীবনের জন্য তোমাকে এভাবে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে চাই। সবসময় লুকিয়ে রাখতে চাই অনুপাখি।
-রাখুন। মানা করেছে কেউ? কিন্তু তার জন্য না তাকিয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়ুন। সকালে বাকিটা দেখা যাবে।
-এতো ঘুম কি করে আসে একটা মানুষের আমি বুঝি না বাবা। আমি তাকে কত আদরে ছুঁয়ে দিচ্ছি, বুকের মধ্যে লুকিয়ে আদরের পরশ বুলাচ্ছি, আর ম্যাডাম আছেন ঘুমের তালে। এই অনু? আবার ঘুমিয়ে পড়লে?
-ঘুমাতে দিচ্ছ কোথায় তুমি?
-আমাকে তোমার নেশায় মাতাল করে জাগিয়ে রেখে নিজে ঘুমোবে? নো ওয়ে। এই তাকাও তাকাও?
-কি?
-অনু?
-হুম?
অনামিকা ঘুমঘোর চোখে মুখ তুলে অরণ্যের দিকে তাকাতেই অরণ্য আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল অনামিকার কপালে।
-আচ্ছা যাও। এখন আর বিরক্ত করবো না ম্যাডামকে। লক্ষী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়ুন কেমন?
-ঘুম থেকে টেনে তুলে জিজ্ঞেস করছে ঘুমিয়ে গেছিলে কিনা, ব্যাপারটা তেমন হলো না মিস্টার অরণ্য?
-ইয়েস মিসেস অরণ্য। আমার বউকে আমি জ্বালাবো না তো কে জ্বালাবে বলো? এখন আর দুষ্টুমি না করে ঘুমান ম্যাডাম। কাল সারাদিন বিজি টাইম কাটবে সবার। রেস্ট করার সময় পাবো বলে মনে হয় না।
-বিজি টাইম কাটবে কেন? কলেজে তো যাবো না। তুমিও তো অফিসে যাবে না বললে। তাহলে?
-উমমমমম। কাজে বের হবো না বলে কি সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাবো ম্যাডাম? সামনেই তাহিয়ার বিয়ে। শপিং বাকি এখনও। কত প্রোগ্রাম জানো না? আর তোমাদের মেয়েদের তো আরো কত কাহিনী। হলুদের দিন হলদে পাখি সাজতে হয়, বিয়েতে কে যে বউ, আর কে কনের বান্ধবী বা ভাবি সেটা তো বোঝাই মুশকিল। আর বৌ-ভাতে! মনে হয় কোথাও ফ্যাশন ডিজাইনিং শো দেখতে এসেছি। ও মাই গড!
-একদম বাজে কথা বলবা না তো। বিয়েতে না সাজলে সাজবো কখন? আমার একটামাত্র ননদের বিয়ে! সাজবো না একটু? হুহ।
-সাজবেন তো অবশ্যই ম্যাডাম। শুধু হলুদের দিনটা আসতে দাও। হলুদের রঙে যদি তোমাকেও হলুদিয়া পাখি না বানিয়ে ছেড়েছি তাহলে আমিও অরণ্য চৌধূরী না।
-ইশ! বললেই হলো আর কি! আমার সাজটা নষ্ট করার ধান্দা সব। একদম হলুদ টলুদ মাখাতে আসবা না খবরদার বলে দিলাম।
-ওফ্ফো! সবসময় এতো বাগড়া দাও কেন মেয়ে বলো তো? আমার বউকে আমি নিজের ইচ্ছেমতো রঙে রাঙাবো। তোমার কি হ্যাঁ?
-না জান না পেহচান, হাম তেরি মেহমান। হুহ।
-এই কি বললে বিড়বিড় করে আবার বলো?
-কই কি বললাম? বললা যে ঘুমাও। হলুদের আরো দশ পনেরোদিন বাকি। আরো অনেক কাজও বাকি বিয়ের। সেগুলো কিভাবে করবে সেটা ভাবো আগে। শপিংয়ের জন্য অনেক সময় পড়ে আছে জনাব।
-জি না বউসোনা। শপিংয়ে আমরা কালই যাচ্ছি। বিয়েটা এক মাস পরে ফিক্সজড করায় তাহিয়া আর স্নিগ্ধেরও দেখা হচ্ছে না। ওরাও নিজেদের মতো কিছুক্ষণ সময় কাটাবে।
-শপিংয়ে গিয়ে কিসের টাইম স্পেন্ড করবে? শপিং করতে আর কতোক্ষণ লাগবে? দুই-তিন ঘন্টা বড় জোর! তাও তো শাড়ি, গয়না, মেকাপ এসব সিলেক্ট আর ট্রায়ালেই সময় চলে যাবে। আলাদা করে কথা বলার সময় কখন পাবে?
-এটা একদম ঠিক বলেছ। উমমমম। আমরা বাইরে একসাথে লাঞ্চ করে তারপর শপিংয়ে করবো। সন্ধ্যে হতে হতে শপিং শেষ হবে আশা করি। তারপর নিজেদের মতো সময় কাটাবো। তারপর ফিরে আসবো বাসায়। ওকে?
-শপিংয়ের পর এতো এনার্জি থাকবে ঘুরে বেড়ানোর মতো?
-উফ! এই মেয়েটাকে নিয়ে এই এক জ্বালা। কাল কি হবে সেটা নাহয় কাল দেখা যাবে? ওকে ম্যাডাম?
-জি জনাব ওকে।
-অনু?
-হুম?
-আজকের দিনটা অনেক সুন্দর ছিল। আর রাতটাও-----।
-অসভ্য লোক একটা!
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে স্নিগ্ধ আসার পরে অনামিকা, অরণ্য আর তাহিয়া সবাই বের হয়েছে। শপিং করতে করতে আসলেই সন্ধ্যে হয়ে গেছে। অরণ্য অনামিকার আর তাহিয়ার পছন্দমতো কেনাকাটা করে নিজেও আলাদা করে কিছু কিনেছে। সেটা অবশ্য অনামিকাকে দেখায় নি। সব মিলিয়ে সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড় করে শপিং শেষ করে গাড়িতে এসে বসলো সবাই। স্নিগ্ধ আর তাহিয়া পিছনে বসেছে আর অরণ্য ড্রাইভ করছে আর পাশে অনামিকা বসে।
-এবার কোন দিকে যাওয়া যায় বলো? নাকি সবার এনার্জি শেষ?!
-আরে না না। কত দিন পরে বের হলাম। নদীর পাড়ের দিকে যাই কি বলো? ওখানে কিছুক্ষণ ঘুরি, খাওয়া দাওয়া করি, তারপর নাহয় ব্যাক করবো।
-শিওর স্নিগ্ধ? ম্যাডামরা তো কিছু বলছে না। টায়ার্ড? নাকি শপিং করে মন ভরে নি এখনো? অনু তুমি কি বলো? আরো শপিং করবে? তাহলে শপিংমলের কোনো ফুডকোর্টে কিছু খেয়ে আবার----।
অরণ্যের কথা শুনে তাহিয়া আর অনামিকা দুজনের গলা দিয়েই জোরে 'নাআআআ' বলে চিৎকারের মতো বের হলো। অরণ্য আর স্নিগ্ধ দুজনেই থতমত খেয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে সবাই একসাথেই হেসে ফেললো। অনামিকা আর তাহিয়া একটু লজ্জা পেয়ে গেল।
-কি ব্যাপার বলো তো অনু? আজীবন শুনে এসেছি মেয়েরা সারাদিন শপিং করেও টায়ার্ড হয় না। আর তোমরা দুই ননদ ভাবি তো শপিংয়ের নাম শুনে এমন আঁতকে উঠছো যে মনে হয় ভূত দেখেছো। হা হা হা।
-একদম বাজে কথা বলবা না তো। কত শপিং করেছি জানো? আর দাঁড়ানোর শক্তিও নেই।
-এতো টায়ার্ড! তাহলে বাড়িতে ফির যাই? অন্য একদিন বের হওয়া যাবে।
- আরে নাহ! শপিং করার এনার্জি নেই, বাট বাইরে ঘুরতে আপত্তি নেই। বাড়িতে গিয়ে কি হবে।
-তাহু! তোরও কি সেইম কন্ডিশন? শপিং করতে টায়ার্ড, বাট বাইরে ঘুরতে যেতে এক পায়ে খাড়া! হা হা হা।
-অরণ্য? ভালো হবে না কিন্তু----।
-ওকে ওকে ম্যাডাম। সরি। স্নিগ্ধ কি বলো? নদীর পাড়েই কোথাও বসে খাওয়া দাওয়া করা যাক। কি বলো তোমরা?
সবাই সায় জানাতেই অরণ্য অনামিকার দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো। সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে এসেছে অনেক আগেই। তাহিয়া আর স্নিগ্ধ নিচু গলায় দুনিয়ার বক বক করছে। আর অনামিকা সেটা দেখে হেসে জানলা দিয়ে মাথা বের করে বাতাসের ঘ্রাণ নিলো বুক ভরে। অরণ্য গাড়ি চালাতে চালাতেই ব্যাপারটা খেয়াল করে অনামিকার হাতে চেপে ধরে গাড়ির ভিতরে টেনে নিল। অনামিকা চোখ কটমট করে অরণ্যের দিকে তাকাতেই অরণ্যই ধমকে উঠলো।
-গাড়ির বাইরে মাথা বের করছ কেন? মাথাটা গেছে? রাস্তায় কত গাড়ি দেখতে পাচ্ছ না? কিছু একটা হয়ে গেলে কি হবে ভাবতে পারছ? চুপ করে বসে থাকতে পারো না? বাচ্চা মেয়ের মতো এতো লাফালাফি করার কি হলো এখানে? আশ্চর্য! আর একবার গাড়ির বাইরে হাত বা মাথা বের করেছ তো অনু---।
-আরে ভাইয়া? বকছিস কেন ভাবিকে? সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বাইরের ঠান্ডা বাতাসে একটু মাথা বের করেছিল আর কি গাড়ি থেকে। কি হয়েছে? এমন করিস কেন সবসময়?
-তুই চুপ থাক তাহু। উল্টাপাল্টা কিছু একটা হয়ে যেতে পারে এটা তুইও ভালো করেই জানিস। সন্ধ্যে বেলা রাস্তায় গাড়িগুলো কি রকম স্পিডে চলছে ধারণা নেই তোর? আর ও কি বাচ্চা নাকি? এই সামান্য ব্যাপারটা বোঝে না? সবসময় ছেলেমানুষি করলে চলে?
অরণ্যের কথায় অনামিকা ভয়ে কেঁপে উঠে একবারে চুপসে গেল। তাহিয়া আবার কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু স্নিগ্ধ ওকে ইশারায় চুপ থাকার ইশারা করলো। তাহিয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল অনামিকার কাঁপা গলায় কথাটা শুনে। অরণ্য অনামিকাকে আরো কিছু বলে ধমক দিতে যাবে কিন্তু অনামিকার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ায় অরণ্য নিজেও থমকে গেল। রাস্তার হাজারো ব্যস্ত শব্দের ভিড়ে অনামিকার বলা ছোট্ট কথাটা অরণ্যের কানে এসে বাজলো।
-আ'ম সরি।