আড়ালে আবডালে - পর্ব ১০ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


আজ সকালেও বৃষ্টি হয়েছে। তবে ভোরের দিকে। তাই ঠান্ডাও লাগছে। সকালে রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি কলেজে আসে নিহি। গতকাল বিকেলে প্রাইভেটে গিয়েও অনলকে ভালোবাসার কথা বলতে পারেনি। এজন্য উপমা খুব রেগে আছে। কলেজে গিয়ে দেখল এখনো তেমন কেউ আসেনি। কয়েকজন বাদে ক্লাস পুরো ফাঁকা। দীপ্ত নিহিকে দেখে বলে,
"গুড মর্নিং নিহি।"
"গুড মর্নিং।" হেসে বলে নিহি।

দীপ্ত সামনের বেঞ্চে বসে পড়ছিল। নিহির উত্তর পেয়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দেয়। নিহিও একটা বই নিয়ে বসে পড়ে। উপমা না আসা পর্যন্ত পড়তে থাকুক। একটুপর পর দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখছে। উপমা কখনো লেট করে আসে না। আজকে কি তবে ইচ্ছে করেই লেট করছে? এই মেয়েটাকে নিয়েও আর পারা যায় না! ক্লাস শুরু হওয়ার ঠিক ১০ মিনিট আগে এসেছে উপমা। নিহি দ্বিতীয় বেঞ্চে বসেছিল। আর পাশে উপমার জন্য জায়গা রেখেছিল। উপমা সেখানে না বসে লাস্ট কয়েক বেঞ্চের আগে বেঞ্চে বসেছে। বই বন্ধ করে নিহি উপমার কাছে যায়। ওর পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বলে,
"আমার উপু বেবি রাগ করেছিস?"

উপমা ছাড়ানোর চেষ্টা না করেই বলে,
"সর তুই। ঢং করবি না একদম।"
"রাগ কেন করেছিস সেটা তো বল?"
"জানিস না তুই? কাল কী কথা ছিল?"
"এত রেগে কেন যাচ্ছিস? আমিই বা কী করতাম? অনেক ভেবেচিন্তেও বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে বলব।"
"তোর বলা লাগবে না। যা তুই।"

উপমার রাগ ভাঙাতে গিয়ে ঐদিকে ঘণ্টাও পড়ে যায়। এখনই স্যার চলে আসবে। তবুও উপমার রাগ এখনো ভাঙেনি। নিহি সামনের বেঞ্চ থেকে ব্যাগ নিয়ে এসে উপমার পাশে বসে। একটুপর পর উপমাকে খোঁচায়।উপমা রাগ দেখিয়ে ফিসফিস করে বলে,
"রাগাবি না। স্যারকে বলে দেবো কিন্তু।"
"বল। আমিও বলব।"
"তুই কী বলবি?"
"আমিও বলব যে, তুই আমায় খুঁচিয়েছিস।"
"সত্যি কথা তো বলতে পারিস না। মিথ্যে ভালোই শিখেছিস।"
"তোর থেকে শিখেছি।"

উপমা চোখ গরম করে তাকায়। স্যার অনেকক্ষণ ধরেই দুজনকে ফিসফিস করতে দেখছিল। এবার দুজনকেই দাঁড় করিয়ে বলেন,
"ক্লাসে এত ফিসফিস কীসের?"
দুজনই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নিহির ভীষণ হাসি পেলেও হাসি আটকে রাখছে। উপমা তো রেগে ফায়ার। স্যার দুজনকেই ক্লাস থেকে বের করে দেন। বাইরে গিয়ে নিহি হো হো করে হেসে ফেলে। উপমা ক্ষেপে বলে,
"খুব হাসি পাচ্ছে না? এবার, আমিও কী মজা দেখাই দেখ।" বলে, উপমা সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। পেছনে নিহিও আসতে আসতে বলে,
"ঐ দাঁড়া।কোথায় যাস? স্যার আমাদের বাইরে না পেলে বকবে পরে। শোন!"

উপমা কোনো কথাই শুনে না। নিচ তলায় আসতেই দেখতে পায় অনল অফিস রুম থেকে বের হচ্ছে। অনলের মুখোমুখি হয়ে উপমা থেমে যায়। কিছুক্ষণ পর নিহিও উপমার পিছনে এসে দাঁড়ায়। অনল চলে যাওয়া ধরলে উপমা বলে,
"দাঁড়ান। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।"
নিহি কিছুই বুঝতে পারছে না। অনল ভ্রু কুঁচকে একবার নিহির দিকে তাকায়। পরে উপমার দিকে তাকিয়ে বলে,
"আমার ক্লাস আছে এখন। টিফিন টাইমে কথা বলি?"
"না, এখনই বলব। বেশি সময় নেব না।"
"আচ্ছা বলো।"
"নিহি আপনাকে ভালোবাসে। কিন্তু কিছুতেই এটা আপনাকে বলতে পারছে না।"

উপমার কথা শুনে নিহির মুখটা হা হয়ে যায়। অনল নিজেও অবাক হয়ে একবার নিহির দিকে তাকায় তো আরেকবার উপমার দিকে তাকায়। নিহির অবস্থা এখন, পারে না শুধু মাটির ভেতর ঢুকে যেতে। উপমার হাত ধরে টানতে টানতে বলে,
"মিথ্যে। সত্যি না। আল্লাহ্! উপমার বাচ্চা আয় তুই।"
নিহি উপমাকে টানছে। উপমা বলেই চলেছে,
"সত্যিই বলেছি ভাইয়া। ওর মুখ থেকে শুনে নিবেন কিন্তু!"

ক্লাসের সামনে নিয়ে উপমার পিঠে কয়েটা কিল-ঘুষি দিয়ে নিহি বলে,
"অসভ্য মাইয়া! ক্যান বলতে গেলি?"
"উফ! নিজে বলবে না। আবার আমি বললেও দোষ।"
"তোরে বলতে বলছি আমি? আল্লাহ্! কীভাবে যাব আমি তার সামনে।"
"ইশ! ঢং কম কর।"
"তোরে তো আমি পরে দেখতেছি। ঘণ্টা দিছে, এখন ক্লাসে চল।"

টিফিন টাইম,

এখন নিহি উল্টো উপমার ওপর রাগ করেছে। তাই ক্যান্টিনে খেতেও যায়নি। লাইব্রেরীতে বই নিয়ে বসে আছে। উপমা রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে। অনল ক্যান্টিনে গিয়ে দেখে নিহি আর উপমা কেউই নেই। লাইব্রেরীতে এসে দুজনকেই পেয়ে যায়। টিফিনের সময় বলে সবাই খেতে গেছে। লাইব্রেরীতে এখন শুধু ওরা দুজনই আছে। অনলকে দেখে উপমা বলে,
"ঐযে রাগ ভাঙানোর মানুষ চলে এসেছে। আমি যাই এখন।"
"ঐ না। উপমা যাবি না।"

উপমা কোনো কথা শুনে না। চলে যায়। অনল নিহির পথ আটকে বলে,
"কী হু?"
নিহি থতমত খেয়ে বলে,
"ক..কই কী?"
"এমন চোরের মতো করছ কেন?"
"কী আজব! চোরের মতো করব কেন?"
"সেটাই তো আমার প্রশ্ন।"
"সরেন। বাইরে যাব।"
"কথা শেষ হয়নি আমার।"
"কী কথা?"
"উপমা যা বলল তা কি সত্যি?"

নিহি নিশ্চুপ। অনল আবার জিজ্ঞেস করে,
"সত্যি?"
"জানি না।" নিহির উত্তর।
"জানি না বললে তো হবে না। যেটা উপমা বলেছে এখন বলো আমায়।"
"কিছু বলার নাই। আমি যাব।"
"না বললে জড়িয়ে ধরব কিন্তু!"
"ঐ না।"
আচমকা অনল নিহিকে জড়িয়ে ধরে। নিহি বলে,
"ছাড়েন।"

প্রিন্সিপাল স্যার যাচ্ছিলেন লাইব্রেরীর পাশ দিয়ে। অনল নিহিকে ছাড়ার আগেই প্রিন্সিপাল স্যার লাইব্রেরীতে ঢুকে যায়। দুজনের অবস্থা তখন পাথরের মতো।
অনল আর নিহিকে লাইব্রেরিতে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় দেখে ফেলে প্রিন্সিপাল স্যার। দুজন ছিটকে সরে যায়। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে কী বলা উচিত স্যার বুঝতে পারছেন না। স্যার ধমক দিয়ে বলেন,
"এসব কী? এখানে কী করছ তোমরা? কলেজে আসো প্রেম করতে?"
একটু থেমে আবার বলেন,
"তোমাদের সাথে আমি কোনো কথা বলব না। কথা হবে তোমার গার্জিয়ানদের সাথে। তারাও জানুক তোমাদের কীর্তি।"

প্রিন্সিপাল স্যার চলে যাওয়ার পর নিহি কেঁদে ফেলে। অনল নিহিকে বলে,
"কেঁদো না তুমি প্লিজ। একদম ভয় পাবে না। যা হওয়ার হবে। আমি আছি তো তোমার পাশে। প্রয়োজনে আমরা বিয়ে করে ফেলব। তবুও কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।"
অনলের কথায় কিছুটা ভরসা পেলেও ভয় কমেনি। না জানি, বাবা কতটা কষ্ট পাবে!


প্রিন্সিপাল স্যারের অফিস রুমে বসে আছে নিহির বাবা নিজাম ইসলাম আর অনলের মা অনামিকা ম্যাম। একপাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে অনল আর নিহি। স্যার আগেই সব বলেছেন দুই পরিবারকে। নিহির বাবা নিজাম ইসলাম বলেন,
"স্যার যা বলল তা কী সত্যি?"

নিহি নিরুত্তর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজাম ইসলাম এবার ধমক দিয়ে বলেন,
"কথা বল।"
ধমক খেয়ে ভয়ে কেঁপে উঠে নিহি।
"রিল্যাক্স। আমি কথা বলছি ওদের সাথে।" বলেন স্যার।
স্যার এবার দুজনের দিকে তাকিয়ে বলেন,
"লাইব্রেরির ঘটনা তো তোমরা নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবে না? আমি নিজের চোখে দেখেছি তোমাদের।"
দুজনই নিশ্চুপ। স্যার আবার বলেন,
"এখন দুজনই আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। তোমরা কি দুজন দুজনকে ভালোবাসো?"

দুজনকে চুপ থাকতে দেখে অনামিকা ম্যাম নিহির উদ্দেশ্যে শান্তস্বরে বলেন,
"তুমি কি অনলকে ভালোবাসো নিহি? যদি ভালোবাসো তাহলে আমায় বলো।"
নিহি মাথা তুলে একবার ম্যামের দিকে তাকায়। তারপর অনলের দিকে তাকায়। নিজাম ইসলামের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেলে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে,
"হ্যাঁ।"
"আর অনল তুমি?" জিজ্ঞেস করেন স্যার। অনল স্যারের দিকে তাকিয়ে বলে,
"আমি নিহিকে ভালোবাসি না স্যার।"

নিহি অবাক হয়ে তাকায় অনলের দিকে। অনল এসব কী বলছে? অনল আবার বলে,
"আমি লাইব্রেরীতে গেছিলাম একটা বই আনতে। নিহি লাইব্রেরীতেই ছিল। আমায় দেখেই নিহি জড়িয়ে ধরে। আর তখনই স্যার লাইব্রেরীতে আসে।"

নিহির চোখজোড়া পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যায়। পায়ের নিচের মাটিকে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নিজের কানকেই নিহি বিশ্বাস করতে পারছে না। অনল কী এসব সত্যিই বলছে? অনল একটাবারও নিহির দিকে তাকায়নি। আর নিহি অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে অনলের দিকে।

স্যার বলেন,
"সবই তো শুনলেন আপনারা। এখন বলেন আমি কী করব?"
লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে নিজাম ইসলামের। নিহির থেকে তিনি এমন কিছু কখনোই আশা করেননি। তবুও সঙ্কোচ নিয়ে বলেন,
"যা আপনার সিদ্ধান্ত।"
স্যার বলেন,
"আমি নিহিকে টিসি দিয়ে দেবো। এমন স্টুডেন্ট আমার কলেজে রাখা সম্ভব নয়।"

কথা শেষ করে নিজাম ইসলাম নিহির হাত ধরে বাইরে নিয়ে যায়। পিছু পিছু অনলও আসে। নিহি অনলের দিকে তাকিয়ে দেখে অনলের ঠোঁটে হাসি। কোনোকিছু জয় করার হাসি। নিহি দাঁড়িয়ে পড়ে। নিজাম ইসলামকে বলে,
"আব্বু আমার অনলের সাথে কিছু কথা আছে।"
"দয়া করে আর সিনক্রিয়েট করিস না। মানসম্মান তো কিছুই বাকি রাখলি না।"

নিহি হাত ছাড়ানোর জন্য জোড়াজুড়ি করছে। নিজাম ইসলাম নিহির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায়। অনল এগিয়ে এসে নিহির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিহির কানের কাছে আস্তে করে বলে যায়,
"সেদিনের সেই থাপ্পড়ের প্রতিশোধ নেওয়া শেষ আমার।"
নিহি যেতে যেতে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকে অনলের দিকে।
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন