সংসার - পর্ব ০৩ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৫!! 

সারাদিন ফারহার প্রত্যেকটা কাজের উপরেই নজর রেখেছে অনামিকা। ফারহা ঠিক কাজ করছে তেমনটাও না। টুকটুক করে অনুর পাশে পাশেই ঘুরছে মেয়েটা। অনামিকাকে এটা ওটা বলে ব্যস্ত করে দিচ্ছে মেয়েটা। অনামিকা নিজেই এটা ওটা করতে করতে বারবার ফারহাকে দেখছে। এই যেমন অনামিকার রান্না করার সময়ের কথাটাই ধরা যাক। অনামিকা রান্নার সব জোগাড় যন্ত করছে ধীর হাতে।  রান্নার আয়োজনের ফাঁকে ফারহার বকবক শুনতে শুনতে বারবার মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে অনু।  ফারহা অনামিকার পাশেই বসে দুনিয়ার বকবক করেই চলেছে। ওর মা কত ভালো রান্না করতে পারে, মায়ের হাতের রান্নার যত তারিফ সব অনামিকার কাছেই করে ফেলছে মেয়েটা। হাত বাড়িয়ে অনুকে যে তরকারি কুটে দিবে বা অন্য কোনো কাজে হাত লাগাবে সেই বিষয়ে মেয়েটার যে নূন্যতম আগ্রহ সেটাও মনে হচ্ছে না অনামিকার। এবারে ফারহার উপরে এতোটা বিরক্তিও কাজ করছে না। উল্টো মেয়েটার কাজকর্ম আর কথাবার্তা শুনে হাসি পাচ্ছে অনামিকার। অরণ্য আর ফারহার মধ্যে কি চলছে কিছুই বুঝতে পারছে না মেয়েটা। তবে এই লুকোচুরির খেলাটা দারুণ লাগছে অনামিকার। কিছু একটা লুকাচ্ছে এই দুজন। আর সেটাই খুঁজে বের করতে হবে অনামিকাকে। ছোট্টবেলায় যেমনটা করতো। কথাটা ভেবেই ঠোঁটের কোণে একটা রহস্যময়ী হাসির রেখা ফুটে উঠলো অনামিকার।

রান্না শেষ হওয়ার পর একটু তাড়াতাড়িই আজ সবাই খেতে বসেছে, একসাথে, এক টেবিলে। বহুদিন পর পুরো পরিবার একসাথে ডিনার করবে আজ। সাথে নতুন যুক্ত হয়েছে ফারহাও। সবাই খেতে খেতে টুকটাক কথাবার্তা বলছিল। অরণ্যের অফিসের কাজ কেমন চলছে, তাহিয়ার পড়ালেখা, আরহান সাহেবের অফিস, এসব নিয়ে টুকটাক আলোচনার ফাঁকে অরণ্য তাহিয়ার দিকে তাকালো। তাহিয়া যে খাওয়ার ফাঁকে একটু পর পর ফারহার দিকে তাকিয়ে মেয়েটার সাবলীল ভঙ্গিতে খাওয়া দেখছিল সেটাও নজর এড়ায় নি অরণ্যের। এই ফারহাকে দেখে কে বলবে মেয়েটা আজই প্রথম অরণ্যদের বাড়িতে এসেছে! তাও আবার হাউজ মেইডের কাজ করবে বলে? উল্টো মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো রিলেটিভের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। এতো আয়েশ করে খাচ্ছে যেন ও গেস্ট, বাকিরা ওর কোন জন্মের পরম আত্মীয়।

-কারো খাওয়ার দিকে এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকাটা অভদ্রতা তাহু। কিছু শিখ। অন্তত শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার আগে বেসিক ভদ্রতাগুলো শিখে নে। নয়তো দেখা যাবে শাশুড়ির বা ননদের দিকেও এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলে দু দিনেই ফিরত পাঠাবে বাড়িতে।

-ভাইয়া! আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি?

-নয়তো কি? মেয়েটা খাচ্ছে, সেটাও তোর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখতে হবে? জীবনে কাউকে খেতে দেখিস নি? নাকি নিজে খেতে পাস না কয়েকদিন ধরে? 

-ভাইয়া? আমি ড্যাবড্যাব করে তোর আনা এই নমুমার দিকে তাকিয়ে আছি। কেন জানিস? ওকে দেখলে যে কেউ বলবে এই মেয়ে আমাদের নতুন গেস্ট। এই মেয়েকে দেখে আর কিছু মনে হোক না হোক, যে কেউ এটা অবশ্যই বুঝবে যে এই ম্যাডাম আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।

-স্টপ ইট তাহু। মেয়েটা বিপদে পড়ে কাজ করতে এসেছে বলে এভাবে অপমান করবি বা ওর কাজকে ছোটো করে দেখবি?

-কি এমন কাজ করে তোর এই সো কলড সার্ভেন্ট? সারাদিন তো ভাবিই সব করেছে দেখলাম। এই মেয়ে আধো কোনো কাজ করেছে? রান্না থেকে শুরু করে একটু পর যে ভাবি বাসন মাজবে সব তো এই মেয়ে বসে বসে দেখবে। হাহ! ভাবিকেই জিজ্ঞেস কর না?

অরণ্য কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতেই তাইয়্যেবা জামান আর আরহান চৌধূরী দুজনেই খাওয়া ছেড়ে মুখ তুলে তাকালেন অরণ্য আর তাহিয়ার দিকে।

-অরণ্য চুপ করবি? তাহিয়া তুইও চুপ কর এবারে। কি শুরু করেছিস বাচ্চাদের মতো? একজনের বিয়ে হয়েছে, আরেকজন দুদিন পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে। অথচ দেখো বাচ্চাদের মতো এখনও ঝগড়া করেই চলেছে এরা! তোরা কি আজীবন এমন ছেলেমানুষই রয়ে যাবি?

-সরি মা। ভাইয়াকে বলো আমার সাথে এভাবে কথা না বলতে। আর নিজের আনা এই আরেক আজব কার্টুনকে বুঝাতে যে কাজের জন্য ওকে আনা হয়েছে, বকবক করার জন্য নয়, বা ভাবির আরো কাজ বাড়ানোর জন্যও নয়। অসহ্য!

-তাহিয়া! এসব কোন ধরনের বিহেভ! মেয়েটা আজই প্রথম বাড়িতে এলো। ধীরে ধীরে নিজের কাজ বুঝে নিবে। তুই এভাবে রেগে যাচ্ছিস কেন?

অরণ্য এতোক্ষণ চুপ করে দাঁতে দাঁত চেপে খাওয়ায় মন দেয়ার চেষ্টা করছিল। এবারে মুখ তুলে তাহিয়ার দিকে তাকালো।

-ফারহা তো তবু নতুন পরিবেশে নতুন মানুষদের সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছে। তুই কি করবি? দুদিন বাদে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে যাবি, তখন তুই কি করবি? বাড়িতে তো নিজে এক গ্লাস পানিও নিয়ে খাস না, কখনো ভেবেছিস বিয়ের পরে কি করবি? স্নিগ্ধর বাবা, মা, বোন, স্নিগ্ধ সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে একসাথে একটা পরিবার হিসেবে আগলে রাখতে পারবি? আমার তো মনে হয় না। শিখেছিস কখনো কিভাবে ঘরের কাজ করতে হয়? কিভাবে রান্নাবান্না, সবার সাথে মিলেমিশে থাকা, সবাইকে খুশি রাখার জন্য যে পরিবারের সবার ছোটো ছোটো চাহিদাগুলো কারো মুখ ফুটে বলার আগেই পূরণ করে দিতে হয়, কখনো শিখেছিস?

অরণ্যের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ফারহা রাগ করে খাবারের প্লেট থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর জন্য সরে আসতেই অনামিকাকে খাওয়া শেষ করে নিজের প্লেট হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দেখে তাহিয়া চুপচাপ গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। অনামিকা এতো কষ্ট করে সবার জন্য রান্না করেছে, অরণ্যের উপরে রাগ করে না খেয়ে উঠে গেলে অনু কষ্টে পাবে না? অনামিকা প্লেট নিয়ে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও একবার থেকে অরণ্যের দিকে তাকালো।

-একটা মেয়েকে কিছু কাজ কখনো শিখতে হয় না। কোনো ট্রেনিং নেয়া লাগো না, কিছু জ্ঞান মেয়েরা বাই বর্নই পেয়ে থাকে। তেমনই একটা গুণ হলো সংসার করা। সংসারের খুঁটিনাটি যত যা কিছু আছে সেটা মেয়েদের জানতেও হয় না, শিখতেও হয় না। আপনাআপনিই শিখে যায়। সে মেয়েটা যতই বাপের বাড়িতে নিজে এক গ্লাস পানিও নিজ হাতে না নিয়ে খাক না কেন। বা যতই চাওয়া মাত্রই মুখের সামনে খাবার এনে দেয়ার জন্য দু চারজন কাজের লোক থাকুক না কেন। যেদিন থেকে একটা মেয়ে কয়েকজন মানুষকে নিয়ে গড়া ছোট্ট সংসারটাকে নিজের ভাবতে শুরু করে সেদিন থেকে সংসারটাকে আগলে রাখার চেষ্টা করে, সবাইকে খুশি রাখার জন্য নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করে। 

অনামিকা কথাগুলো বলে আরেকবার অরণ্যের হতভম্ব মুখের দিকে একবার তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। মেয়েটা কি বলে গেল পুরো ব্যাপারটাই অরণ্যের মাথার উপর দিয়ে গেল। যে মেয়েটা এতো অপমানেও কখনো মুখ ফুটে কিছু বলে নি কখনো, এমনকি অরণ্যের দিকে সাহস করে চোখ তুলে তাকায় নি পর্যন্ত সেই মেয়েই এতো বড় কথাগুলো কি করে বললো! তাও আবার সোজা অরণ্যের দিকে তাকিয়ে! চোখে চোখ রেখে! কথাগুলো ভেবেই অরণ্য থ হয়ে অনুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। শুধু যে অরণ্যই অবাক হয়েছে তা ও না। অরণ্যের বাবা, মা, তাহিয়া এমন কি ফারহাও খাওয়া ছেড়ে অনামিকার বলা কথাগুলোই ভাবছে। 

-ওয়াও! ম্যাডামের রান্নাটা যেমন দারুণ হয়েছে, তেমনি ম্যাডামের কথাগুলোও অসাম ছিল। রান্না পুরো আমার মায়ের হাতের রান্নার মতো। আর কথাগুলো তো! উফ! কি বলবো? এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো আমিও কখনো হয়তো এভাবেই নিজের ছোট্ট সংসারটা আগলে রাখবো। ইশ! ভাবতেই তো কি দারুণ লাগছে! আর তাহিয়া ম্যাডাম? আ'ম সো সো সরি। আপনি ঠিকই বলেছেন আমি সারাদিন বসে অনু ম্যাডামের সাথে বকবকই করেছি। কি করবো বলুন? ফারহা এই বকবক করাতেই একেবারে ওস্তাদ। তবে ভাববেন না। ধীরে ধীরে অনু ম্যাডামের কাছ থেকে সব শিখে নিব। তখন আপনিও আর আমার উপরে রাগ করবেন না। দেখে নিবেন।

 ফারহার বকবক শুনে অরণ্য এবারে হতাশ ভঙ্গিতে আবার খাওয়ায় মন দিলো। এই মেয়েটা এতো বকবক করে কি করে এটাই রহস্য লাগছে অরণ্যের কাছে। বেশি বকবক করতে গিয়ে আবার কি গন্ডগোল পাকায় কে জানে! একে কিছু বলেও যে লাভ নেই এতোক্ষণে এই সিম্পল কথাটা অরণ্য বেশ ভালো মতোই বুঝতে পেরেছে। 

ডিনার শেষ করে অরণ্য নিজের রুমে বেশ কিছুক্ষণ ল্যাপটপে একটা প্রেজেন্টেশন রেডি করলো। কাজটা কমপ্লিট করতে বেশ রাতই হয়ে গেল অরণ্যের। অরণ্য ঘড়িতে টাইম দেখে ল্যাপটপটা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে এমন সময় দরজায় নকের শব্দে চমকে আবার বিছানায় উঠে বসলো অরণ্য। এতো রাতে কে আসতে পেরে ভাবতেই আরেকবার ব্যস্ত হাতে কেউ আবার দরজায় নক করলো। অরণ্য ধীরে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দিতেই ফারহাকে দেখে চমকে উঠলো। মেয়েটাকে কেমন একটা বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না অরণ্য। দেখে মনে হচ্ছে ফারহা কোনো কারণে ঘাবড়ে গেছে। কিন্তু এতো রাতো মেয়েটা ওর রুমে কি জন্য এসেছে প্রশ্নটা মাথায় আসতেই ফারহার হাতটা টেনে নিজের সামনে দাঁড় করালো।

-তুমি এতো রাতে আমার রুমে কি করছ? হ্যাভ ইউ লস্ট ইওর মাইন্ড? তোমাকে এতো রাতে আমার রুমে দেখলে অনু কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে ভাবতে পারছ?

-স্যার স্যার? ম্যাডাম---অনু ম্যাডাম --। আমি কি করবো ভেবেই পাচ্ছিলাম না। তাই এখানে চলে এসেছি। সরি স্যার।

-হোয়াট! মোবাইলে কল করার কথাটা মাথাা আসে নি, সোজা রুমে আসার কথাই মনে হলো তোমার? অনুর কি হয়েছে? 

-আমার তো একা একা ঘুম আসছিল না তাই অনু ম্যাডামের সাথে গল্প করতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ম্যাডাম শুয়ে পড়েছে। তো আমি একটুখানি গল্প করবো বলে ম্যাডামকে কতো ডাকলাম! ম্যাডাম উঠলোই না। 

-হোয়াট! আমমমম। ঘুমিয়ে পড়ছে হয়তো। 

-না স্যার। আমিও ভাবলাম ম্যাডাম হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। চলে আসবো ভাবলাম। পরে মনে হলো যাওয়ার সময় রুমে পানি নিয়ে যাই নি। আমার রাতে ঘুমানোর সময় পানি খাওয়ার অভ্যেস তো! ম্যাডামকে কয়েকবার ডেকেও কোনো রেসপন্স না পেয়ে হাত দিয়ে ঠেলা দিয়ে উঠানোর সময় বুঝলাম ম্যাডাম ঘুমান নি। ম্যাডামের প্রচন্ড জ্বর। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। 

-হোয়াট!

ফারহার কথাটা শেষ হতেই অরণ্য ছুটে বেরিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। রান্নাঘরের ফ্লোরে গুটিশুটি হয়ে অনুকে শুয়ে থাকতে দেখে অরণ্য অনুর মাথাটা নিজের কোলের উপরে তুলে অনুর মুখটা দু হাতে তুলে ধরার চেষ্টা করলো।

-প্লিজ অনু? তাকাও না? প্লিজ? এই অনু? একবার চোখ খোলো প্লিজ? অনু?

০৬!! 

-এই অনু? অনু প্লিজ তাকাও প্লিজ? একবার তাকাও না প্লিজ? অনু প্লিজ? টক টু মি প্লিজ অনু? 

গত কয়েকটা ঘন্টা অরণ্যের কাছে কয়েক বছরের সমান লম্বা কেটেছে। অনুকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে পাগলের মতো ওর কাছে ছুটে গেছে অরণ্য। মেয়েটার গা জ্বরে ফেটে যাচ্ছে সেটা অনুর গালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে ডাকার সময়ই টের পেয়েছে অরণ্য। এভাবে রান্নাঘরের ফ্লোরে শুয়ে থেকে মেয়েটার অসুস্থতাটা যে বাড়বে বৈ কমবে না এটা বুঝতেও অসুবিধা হলো না অরণ্যের। আরো কয়েকবার অনুর গালে হাত ছুঁইয়ে ডেকেও কোনো উত্তর না পেয়ে আর কোনো কিছু না ভেবেই অনুকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে পাশের গেস্টরুমের বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল অরণ্য। গেস্টরুমের বিছানায় অনুকে শুইয়ে দিয়ে গালে হাত ছুঁইয়ে ডাকলো আরো কয়েকবার। কিছু একটা ভেবে অরণ্য গেস্টরুমের ওয়াশরুমে ছুটে গিয়ে একটা মগে করে গক মগ পানি নিয়ে এসে পকেট থেকে নিজের রুমাল বের করে সেটা ভিজিয়ে হালকা নিংড়ে নিয়ে অনুর কপালে রেখে বেশ কিছুক্ষণ জলপট্টি দিল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও মেয়েটার হুঁশ নেই দেখে অরণ্য ভেজা রুমালটা দিয়ে অনুর মুখটা হালকা করে মুছিয়ে দিল। অরণ্য অনুর হাত, মুখ মুছে দিতে গিয়ে খেয়ালই করে নি ফারহা ততক্ষণে অরণ্যের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলার জন্য উশখুশ করছিল। অরণ্য অনুকে নিয়েই এতো বিজি হয়ে পড়েছিল যে ফারহাকে খেয়ালই করে নি।

-স্যার? ম্যাডাম কথা বলছে না কেন? 

-হুম? ও! ফারহা! আ'ম সো সরি। তোমার কথা আমার খেয়ালই ছিল না ফারহা। অনুর প্রচন্ড জ্বর এসেছে। মেয়েটা চোখও মেলছে না। সেন্সলেস হয়ে গেছে মে বি। 

-আমমমম। স্যার অনেক রাত হয়েছে। আপনি যান আমি ম্যাডামের খেয়াল রাখবো।

-হোয়াট! আর ইউ ক্রেজি? অনুকে এভাবে এই অবস্থায় আমি রেখে নিজে গিয়ে ঘুমাবো? তাও আবার তোমার ভরসায়? হাহ! এন্ড ডোন্ট টিচ হোয়াট আই সুড ডু অর নট। ওকে? নাউ গেট লস্ট।

অরণ্যের এতো সাংঘাতিক একটা ধমক খেয়েও ফারহা নখ কামড়ে অরণ্যের দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো। আরো কিছুক্ষণ অনুর কপালে জলপট্টি দেয়ার পর মেয়েটা হালকা নড়ে উঠায় অরণ্য আবার কয়েকবার অনুর গালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে ডাকলো। মেয়েটা জ্বরের ঘোরে হালকা নড়েচড়ে উঠলেও চোখ মেলতে বা কিছু বলতেও পারছে না দেখে অনুর মুখের উপরে আসা ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে মুখটা মোছার জন্য শুকনো টাওয়ালের জন্য এদিক ওদিক তাকাতেই ফারহাকে এখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অরণ্যের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল নিমিষেই।

-হোয়াট? বোকার মতো হা করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো না? আমি অনুর পাশেই আছি। জ্বরের কারণে শরীরটা দুর্বল তাই রেসপন্স করতে পারছে না। সকালের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে আশা করি। তুমি যাও।

-আমমমমমম স্যার? আমার তো এই রুমে থাকার কথা ছিল। এখন আমি কোথায় ঘুমাবো? 

-ওপস সরি! 

-তাই তো আপনাকে বললাম আপনি যান, আমিই ম্যাডামের খেয়াল রাখবো আজ রাতে। কোনো সমস্যা নেই। 

-নো থ্যাংকস। আপনি কষ্ট করে নিজের খেয়াল রাখুন, সেটাই যথেষ্ট। 

-বাট আপনি এখানে বসে থাকলে তো আমি ঘুমাতে পারবো না। ছি ছি! একটা অচেনা পুরুষ মানুষের সাথে এক রুমে ছিলাম জানলে মা তো আমাকে মেরেই ফেলবে। মায়ের কথা তো বাদ দিলাম, অনু ম্যাডাম সকালে যদি দেখে আমিও আপনাদের সাথে এই রুমে ছিলাম তাহলে তো হয়েই গেল! মা তো হয়তো আমি যা কিছু একটা বলে দিলে মেনে নিবে, কিন্তু ম্যাডাম? জীবনেও মানবে না।

-ফারহা---। জাস্ট স্টপ দিস রাবিশ। মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ। কি ভাষা এসব? সিরিয়াসলি? ইউ আর জাস্ট ডিজগাস্টিং। 

-সরি স্যার। একটু প্রাকটিক্যালি ভাবুন না? ম্যাডাম তো রান্নাঘরের ফ্লোরে ঘুমিয়েছিল। সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেস্টরুমে দেখে কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে কে জানে! তার উপরে আমরা তিনজনই যদি একই রুমে থাকি--। ধরুন ভুলেচুকে যদি ঘুমিয়ে পড়ি, আর আমার তো ঘুমের মধ্যে এদিক থেকে ওদিকে গড়িয়ে যাওয়ার প্রবলেম আছে। তো ঘুমের মধ্যে যদি--ইয়ে মানে---।

-ওকে মেরি মা! দুটো মিনিট আপনার এসব খেয়ালি পোলাও পাকানো বন্ধ করুন? আর আপনার রুম আপনাকেই মোবারক। আমি অনুকে নিয়ে এই রুম থেকেই চলে যাচ্ছি। আপনি ভালো করে দরজা, জানলা সব আটকে ঘুমান। ওকে? দয়া করে সকালে একটু তাড়াতাড়ি উঠার চেষ্টা করবেন।

-স্যার? সরি স্যার। আপনার বাড়ি, আপনি কোথায় থাকবেন সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু ম্যাডাম তো ঘুম ভাঙ্গলে রাগ করবে না? 

-থ্যাংকস ফর ইওর কনসার্ন ম্যাডাম। কাল সকালে কি হবে সেটা আমাকেই ভাবতে দিন প্লিজ? আপাতত রুমের দরজাটা লক করে ঘুমাও। সি ই টুমোরো। ওকে? বায়।

ফারহা কিছু বলার আগেই অরণ্য অনুকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেস্টরুম থেকে বাইরের দিকে পা বাড়িয়েছে। মেয়েটা হালকা করে হাত পা নাড়ছে এটা দেখেই কিছুটা শান্তি লাগছে অরণ্যের কাছে। অনুর মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে অরণ্য গেস্টরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অনুকে পাঁজাকোলা করে নিয়েই।

-স্যার? বাড়ির সবার সাথেই তো পরিচয় হলো। আপনার বাবা, মা, তাহিয়া আপু। শুধু অনু ম্যাডামের সম্পর্কেই কিছু বলেন নি। উনার খেয়াল রাখতে এনেছেন, নাকি উনার উপরে নজর রাখতে সেটাও বুঝতে পারছি না। উনি আপনার এসিস্ট্যান্ট নাকি আপনাদের ফ্যামিলিরই কেউ সেটাও তো ক্লিয়ার না আমার কাছে। 

ফারহার প্রশ্নটা শুনেই অরণ্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো দরজার সামনেই।

-অনুকে প্রশ্নটা করো নি? জানতে চাও নি ওর সাথে আমার কি সম্পর্ক?

-উমমমমম। জিজ্ঞেস তো করেছি। কি বললো কিছুই তো বুঝলাম না কি বললো। ম্যাডাম বলেছিল উনি নাকি কাজের মেয়ে। আমি তো বুঝলাম না কিছু।

ফারহার জবাবটা শুনে অরণ্যের চোয়ালটা আপনাআপনিই শক্ত হয়ে গেল। কিছু একটা ভেবে অনুকে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলো দরজার বাইরের দিকে।

-সি ওয়াজ লায়িং। ও কোনো কাজের মেয়ে নয়। শি ইজ মাই ওয়াইফ। 

অরণ্য কথাটা বলেই অনুকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। ফারহা জাস্ট বোকার মতো অরণ্যের অনুকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। এদের দুজনের মধ্যে কোথাও একটা দ্বন্দ্ব চলছে সবসময়ই। অথচ একজনের বিষয়ে অন্যজন এই দ্বন্দ্বের চেয়েও হয়তো হাজার গুণ বেশি প্রজেসিভ। একজন অন্যজনের সাথে হয়তো প্রয়োজনের কথাটুকুও বলে না সরাসরি। অথচ পাশের মানুষটার দিকে তৃতীয় কোনো পক্ষের সামান্য চাহনিটুকুও মঞ্জুর নয় এদের। এটাই কি ভালোবাসা? নাকি নিছক মায়া? মোহ? বা সাময়িক সুখের লোভে দীর্ঘস্থায়ী ধোঁকায় রাখা নিজেকে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ধীর পায়ে এগিয় এসে রুমের দরজাটা লক করে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল। 

অন্যদিকে অনুকে নিয়ে সোজা নিজের রুমেই এসেছে অরণ্য। অনামিকাকে বিছানায় ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে মগে করে পানি এনে আগের মতো হাত, মুখ, পায়ের তালু কয়েক বার করে মুছিয়ে দিচ্ছে অরণ্য। অনুর মাথার পাশে বসে রুমালের জলপট্টি দিতে দিতে অরণ্য হাজারটা না বলা কথা বলছে অনুকে। অনুর চোখে চোখ রেখে যত শত প্রশ্ন করার কথা অরণ্য ভেবে রেখেছিল সবগুলো কেমন যেন অরণ্যের চোখের পানির দাপটে ঝাপসা হয়ে আসায় নিরবেই চাপা পড়ে গেছে। অনামিকার ক্লান্ত, ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে অরণ্যের মাথায়।

"এভাবেই কি তোমার নিজের রুমটায় আসার কথা ছিল অনু? না অধিকার জমালে, না একবার চোখ মেলে চোখে চোখ রেখে বললে, সব কিছু চুলোয় যাক। শুধু এই মানুষটাকে তোমার চাই। কেন এভাবে এলে অনু? কেন নিজের দাবি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালে না এখনো?"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন