কথা দিয়েছিলে ফিরবে - পর্ব ০৪ - আফরোজা আক্তার - ধারাবাহিক গল্প


০৭!!

 প্রায় মিনিট পাঁচেক পর ইফসি আম্মুন বলে ডাক দেয় । ইফসির মুখে আম্মুন ডাকে পিছনে ফিরে তাকায় জুঁই । ইফসিকে দেখে কলিজায় পানি আসে জুঁইয়ের । মনের মাঝে শীতল হাওয়া বয়ে যায় তার । জুঁই ইফসিকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ আদর করে । 

- আম্মুন কোথায় চলে গেছিলে ? 
- আমি তো তেলি(খেলি)
- কোথায় খেলেছো আম্মুন তুমি ? আম্মুন খুজেছি তো তোমাকে । 
- আমি তেলি(খেলি) আন্তেলের (আংকেলের) সাতে(সাথে)
- কোন আংকেল আম্মুন । তোমাকে না বলেছি অপরিচিত কারো সাথে কোথাও যাবে না । কেন তুমি আম্মুনকে কষ্ট দাও । 

এমন সময় ইফসির পিছনে এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ায় । ইফসিকে জড়িয়ে ধরে ভদ্রলোকের দিকে তাকায় জুঁই । ভদ্রলোকের চেহারার দিকে তাকিয়ে জুঁইয়ের পায়ের নিচ থেকে আরও একবার মাটি সরে যায় । ভদ্রলোকটি আর কেউ নয় , তার জীবন থেকে গত তিন বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সেই পুরুষটি । নাফিসকে দেখে জুঁই আরও একবার ভড়কে যায় । এই অফিসে এইভাবে নাফিসকে সে আশা করে নি । অফিসের অন্যান্যরা স্টাফরা নাফিসকে দেখে স্যার বলে সম্বোধন করে । তাদের এই সম্বোধন করা দেখে জুঁইয়েরও আর বুঝতে বাকি নেই যে নতুন employee তাহলে নাফিস । এই মুহুর্তে তার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো তাদের কার্যক্রম স্থগিত করে দিয়েছে । নাফিস এক দৃষ্টিতে তার সেই আগের কাদম্বরীকে দেখে যাচ্ছে । নাফিসের দৃষ্টি বরাবরই শান্ত আর তীক্ষ্ণ । জুঁইয়ের চোখ নাফিসের দৃষ্টির সীমানায় ঘুর ঘুর করছে । এই মুহুর্তে তার নাফিসের দৃষ্টি থেকে সরে যেতে হবে । বলতে গেলে এক রকম পালিয়ে যেতে হবে তাকে এখন । তাই ইফসিকে কোলে নিয়ে নিজের কেবিনের দিকে দ্রুত হেটে চলে যায় জুঁই । নাফিস সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে জুঁইয়ের চলে যাওয়া দেখতে থাকে । আর ছোট্ট ইফসি তার মায়ের কোলে থেকে মায়ের কাঁধের আড়ালে এসে নাফিসের দিকে দিকে তাকিয়ে হেসে দেয় আর এক হাত দিয়ে টা টা দিয়ে দেয় । বাচ্চাটাকে দেখে নাফিসের মনের কোথাও একটা জমাট বাঁধা পাহাড়টা পানি হয়ে বয়ে যায় অচিরেই ।

কেবিনে ঢুকে মেয়েকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে মাথা হাত দিয়ে বসে পড়ে জুঁই । তার কাছে খুব অবাক লাগছে চারপাশের জিনিস গুলো । যেই অতীতকে সে আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে দাফন করেছিল এখন সেই অতীত কেন বর্তমান হয়ে তার সামনেই প্রকট হচ্ছে । ইফসির নাফিসের কাছে যাওয়াটা , নাফিসের এই অফিসে ট্রান্সফার হয়ে আসাটা কি ইংগিত করছে তাকে সে এইটাই বুঝতে পারছে না । হঠাৎ তার নজর পড়ে তার মেয়ের দিকে । ইফসি খেলছে আর চকলেট খাচ্ছে । দেড় বছরের বাচ্চাকে কিই বা জিজ্ঞেস করবে সে । জুঁই তবুও মেয়ের দিকে এগিয়ে যায় , 

- আম্মুন , একটা কথা বলবা ? 

মায়ের কথায় চোখ গুলো বড় বড় করে তাকায় ইফসি । 

- আম্মুন , এই চকলেট টা কে দিয়েছে ? আম্মুনকে বলবা 
- আন্তেল দিয়েতে(আংকেল দিয়েছে)

জুঁই বুঝে যায় সবটা । এই মুহুর্তে মাথা কাজ করছে না তার । সে চাচ্ছেই না যে নাফিসের সাথে পরবর্তীতে তার আর যোগাযোগ কিংবা দেখা হোক ।  কিন্তু সব দিক বন্ধ দেখছে সে । হুটহাট চাকরি ছাড়াটা হবে ওর জীবনের সব থেকে বড় বোকামি । একমাত্র এই চাকরির জোরেই ও একা একজন নারী নিজের বাচ্চাকে নিয়ে সার্ভাইভ করছে । চাকরিটা ছাড়া এই মুহূর্তে তার পক্ষে সম্ভব না । এমন অবস্থায় কি করা উচিত তার সেইটাও তার মাথায় আসছে না । 

এইসবের মাঝেই পিওন এসে হাজির হয় । 

- ম্যাডাম আসবো ? 
- জ্বি আসুন , 
- ম্যাডাম এস এস কোম্পানির ফাইল নিয়ে নাফিস স্যার ওনার রুমে আপনাকে যেতে বলছে । 

আরও বড় ধাক্কা খায় জুঁই পিওনের কথা শুনে । এই পর্যন্ত চোখাচোখি ছিল এখন তো কথাতেও যেতে হবে দেখা যাচ্ছে । পিওনের সামনে নিজেকে কোন রকম শান্ত রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে পিওনকে জবাব দেয় জুঁই , 

- জ্বি আচ্ছা , আমি যাচ্ছি । 
- জ্বি ম্যাডাম

ফাইল হাতে কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জুঁই । ভেতরে যাবে কি যাবে না ভাবছে সে । পরবর্তীতে নিজের মাঝে এক উদ্যোম নিয়ে আসে সে । 

- যখন সবটা শেষ করে দিয়েছে তখন এখানে আর কিছুই থাকে না । যা হবে শুধুই প্রফেশনাল কাজের জন্য হবে । এর বাহিরে না আমি তাকে চিনি না তাকে আমায় চিনার সেই সুযোগ দিবো । 

এইসব ভেবে নিজেকে সব দিক থেকে এক পাশে এনে মনকে শক্ত করে নাফিসের কেবিনে পা রাখে জুঁই । 

- স্যার আসবো ?? 

নাফিস তখন সেই মুহুর্তে ল্যাপটপে কাজ করছে । চিরচেনা সেই কন্ঠস্বর তার কানে যাওয়ার সাথে সাথে মাথা তুলে তাকায় দরজার সামনে । তারসামনে এক নারী চরিত্র দাঁড়ানো । পরনে সাদা শাড়ি , খোঁপা করা চুল , হাতে এক জোড়া চিকন সিটি গোল্ডের চুড়ি । চোখে যেন হাজারো মেঘ জমা তাহার । মনে হচ্ছে কোন এক কাঙ্খিত মুহুর্তের অপেক্ষায় আছে যেই মুহূর্তের জন্যে এই মেঘ গুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে যাবে তার চোখ থেকে । 

ভাবনার রাজ্য থেকে ফিরতে বাধ্য হয় নাফিসকে কারণ সেই মুহুর্তে জুঁই আরও একবার স্যার বলে সম্বোধন করে তাকে । নাফিসের এপ্রুভালে জুঁই ভেতরে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়ায় । ফাইলটা এগিয়ে দেয় নাফিসের সামনে । চোখ জোরা তার টেবিলের কাচের উপর । কারণ সেই কাচের মাঝেই নাফিসকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে । নাফিস নিজেকে অনেকটা পরিবর্তন করে ফেলেছে । আগের নাফিস আর এখনকার নাফিসের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ । আগের প্রেমিক পুরুষটি আজ সময়ের সাথে সাথে  দায়িত্বশীল পুরুষ মানুষ হয়ে গেছে । 

নাফিস তখন ফাইলের বাহানায় সেই কাচের মাঝে তার কাদম্বরীকে দেখে যাচ্ছে । কেমন যেন চুপসে গেছে মেয়েটা । ক্যাম্পাসের সেই হাসি-খুশি মেয়েটা আজ লেপ্টে আছে এই সাদা শাড়ির মাঝে । নাফিসের খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কি ঘটে গেছে তার কাদম্বরীর জীবনে । কেন এই সাদা শাড়ি ? হঠাৎ নিজেই উপলব্ধি করতে থাকে , 

- ও কি বিধবা ? নাকি স্বামীর সাথে ডির্ভোস হয়ে গেছে ? জুঁই তো এতটা শক্ত ছিল না ? তবুও এতটা বদলে গেছে কিভাবে ? নরম স্বভাবের মেয়েটা আজ সময়ের কাছে হেরে গিয়ে আমার কাছ থেকে প্রতারিত হয়ে এখন হয়তো পাথর হয়ে গেছে । যেন তার চোখ বলে দিচ্ছে তার ভেতরে কতটা চিৎকার হচ্ছে । 

নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না নাফিস । অন্যদিকে লজ্জাও লাগছে জুঁইয়ের সাথে কথা বলতে । তবুও কেন জানি তার মুখ থেকে জুঁইকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বেরিয়ে যায় , 

- প্রাণবন্ত আমার কাদম্বরী
  আজ এই সাদামাটা নারী 
  রঙের মাঝে রাঙিয়ে থাকা 
  নারী কেন আজ পুরো ফাঁকা 

নাফিসের মুখ থেকে চার লাইন কবিতা শুনে অবাক হয়ে যায় জুঁই । বুকের মাঝের চিন চিন ব্যাথাটা আরও বেড়ে যায় । খুব কষ্ট হচ্ছিলো তার , খুব কষ্ট হচ্ছিলো । নাফিসের কাছ থেকে তখন যা আশা করেছিল তার ছিটেফোটাটাও পায় নি সে । আর যেখানে আশা গুলো ফিকে হয়ে গেছে তখন আবার নাফিস কেন তার কাছেই এগুচ্ছে । জুঁই আর এক সেকেন্ডের জন্যেও এখানে থাকতে চাচ্ছে না তাই সে চলে যেতে পিছনে পা বাড়ায় । ওমনি নাফিস তাকে আটকে দেয় , 

- দাড়াও জুঁই ,,,,,,,,,

জুঁই কেন জানি শুনেও শুনে নি নাফিসের ডাক । আরেক কদম দিতেই আরেকবার ডাকে জুঁইয়ের পা জোড়া সেখানেই থামতে বাধ্য হয় । 

- পালিয়ে যাচ্ছো ? 

নাফিসের এই কথার উত্তরটা অনেক ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় । কিন্তু সেই মুহুর্তে জুঁই তা করবে না । তবুও একবার ইচ্ছে করছিলো পেছন ফিরে নাফিসকে দেখতে । মন জিনিসটা বড্ড বেশি বেহায়া , কেন যেন অতীতকে আঁকড়ে ধরতে চায় বারে বারে । পিছন ফিরে তিন বছর পর প্রথম নাফিসের চোখের দিকে তাকায় জুঁই । কেন যেন চাইতেও গলা দিয়ে স্বর বেরিয়ে আসছে না তার । কিছু বলতে চাচ্ছে সে তবুও কথা বের হচ্ছে না । 

অন্যদিকে নাফিস তার কাদম্বরীর সবটুকুই বুঝতে পারে অনায়াসে । সে বুঝেও যায় তার কাদম্বরীর মাঝে ঝড় শুরু হয়ে গেছে । তাই নিজেই আরও একবার মুখ খুলে , 

- কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না আমায় ? আমার কাদম্বরী তো এমন ছিল না । নিজের মনের সবটুকু খুলে রেখে দিত সে আমার সামনে । তবে আজ কেন কাদম্বরীর মুখে কথা আসছে না ? তবে আজ কেন কাদম্বরী তার অভিমান গুলো আমার সামনে উপস্থাপন করছে না ? 

নাফিসের কথা শুনে বুকের মাঝে তোলপাড় করে উঠছে জুঁইয়ের । তবুও অনেক কষ্টে মুখ থেকে বের করে , 

- আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে স্যার , আমি কাদম্বরী নই । আমি নাদিরা ইয়াসমিন জুঁই , আমার এক সন্তান আছে । ভুল করছেন স্যার । আমি শুধুই এই অফিসের একজন কর্মচারী । 

জুঁই খুব সহজেই এই কথা গুলো বলে দেয় নাফিসকে । নাফিস কিন্তু খুব অবাক হয় নি । ওর জায়গায় অন্য কোন নারী হলে এতক্ষণে নাফিসকে ছুলে রেখে দিতো । কিন্তু এই নারী যে তার মনের রানী তার কাদম্বরী । যার মাঝে কিনা আছে অন্যরকম সব অনুভূতি । 

- জুঁই , আমি আমার কৃতকর্মের জন্য সত্যিই খুব লজ্জিত । সেইদিন উপায় ছিল না , বড্ড বেশি অসহায় হয়ে গিয়েছিলাম । দুটো দিকের মাঝে একটি দিক বেছে নিতে হতো আমায় । কোনদিকে যাবো , ভালোবাসা নাকি দায়িত্ববোধ । পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি । বাধ্য হয়েছিলাম তোমাকে ছেড়ে যেতে ।  কথা দিয়েও ফিরতে পারি নি আমি । 

নাফিসের কথা গুলো শুনে কেন জানি চোখের পানি গুলো আর আটকে রাখতে পারেনি জুঁই । এক দৃষ্টিতে নাফিসের দিকে চেয়ে আছে জুঁই । 

জুঁইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে হৃদয়ে ঝড় বয়ে চলছে নাফিসের । জুঁইয়ের চোখের পানি গুলো বলে দিচ্ছে তার ভেতরের চাপা হাহাকার । পাগল মন যেন বার বার পাগলামি করতে চাইছে আজ । 
এরই মাঝে জুঁই কিছু বলে ওঠে , কারণ তারও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব , 

- আমাদের মাঝে ভালোবাসার কমতি ছিল না 
শুধু তোমার মাঝে দায়িত্বের মিথ্যে বোঝা ছিল 
তুমি ছেড়ে তো গিয়েছো 
আঁধার রাতে একা করে দিয়েছো 
সেই রাতের মাঝেই আমি আমার সবটা তোমায় মুক্ত করে দিয়েছিলাম 
এখন এলে যখন তখন দেখে যাও এ বুকে কত হাহাকার জমাট বেঁছে আছে 

জুঁইয়ের কথা গুলো শুনে টপ টপ করে চোখের পানি পড়ে যায় নাফিসের চোখ থেকে । সেই চোখের পানি দেখে জুঁই আবারও বলে , 

- কান্না তোমায় মানায় না 
  কান্না তো সব আমার জন্যে 
  সেইবার কেঁদেছিলাম তোমার পা ধরে 
  তারপর প্রতিনিয়ত কাঁদতে হচ্ছে  
  নিয়তির হাতে পুতুল হয়ে 

দয়া করে অফিসে সবার সামনে আমায় ছোট করে দিও না । এক বাচ্চার মা আমি  সেই সাথে বিধবা নারী । নোংরা উক্তি তুলতে কারো মুখে বাধবে না । ভুলে যখন গিয়েছিলে এখন আর মনে করো না । রাস্তা দুটো আগেই আলাদা করে দিয়েছো এখন আর এই রাস্তায় আসার ভুলটা করো না । অকারণে বার বার কেবিনে ডাকতে যেও না । আসছি , 

জুঁই আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় নি সেখানে । হন হন করে চলে যায় । বিধবা শব্দটা শুনে নাফিসের কলিজাটাও কেঁপে ওঠে । 

- এত কষ্টও কি আল্লাহ পাক কোন নারীকে দিতে পারে । অন্যায় তো করেছিলাম আমি ওর সাথে । তবে কেন আল্লাহ পাক আমায় সাফল্যের দিকে ধাবিত করে ও-কে কষ্টের মাঝে ডুবিয়ে দিলেন । এটাই কি তাহলে ভাগ্য ? নাকি এটাকেই বলে ভবিতব্য ? 

কথা গুলো বলে নাফিস চেয়ারে বসে পড়ে । আর অন্যদিকে নুজ কেবিনের চেয়ারে বসে ঢুকরে কেঁদে দেয় জুঁই । ইফসি তখন পুতুল কোলে মায়ের দিকে এক নজরে তাকিয়ে রয় । 

০৮!!

রাত প্রায় ২ টা । ঘুম নেই জুঁইয়ের চোখে । বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে । আজ কেন জানি বিকেল থেকেই আকাশে মেঘ জমেছিল । আর সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়েছে সন্ধ্যার পর পরই । এখন অবদি বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে । আজ মনে হয় বৃষ্টিও জুঁইয়ের চোখের পানির সাথে পাল্লা দিয়ে ঝরে যাওয়ার শপথ নিয়েছে । জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর শ্রাবণ ভরা চোখে বাহিরের বর্ষণ দেখছে জুঁই । হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যায় তার । দিন টি ছিল শুক্রবার । বিকেলে দুজনে মিলে বেরিয়ে টি এস সি তে গিয়েছিল । আর সেখানে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছিল । 

- এই শুনছো , আমি ভিজে গেলাম তো ? 
- কাদম্বরীর ভিজে যাওয়া স্নিগ্ধ শরীরটা দেখলে খুব বেশি ক্ষতি হবে না , কি বলো ? 
- আর যদি কাদম্বরীর ঠান্ডা লেগে যায় ? 
- ফার্মেসি আছে তো । 
- অসভ্য 
- উহু , আমি তোমাতেই উন্মাদ ।
- পুরো ভিজে গেছি নাফিস , 
- আমার বুকে আসো , ঝাপটে ধরে রাখি তোমায় । 
- তোমার বুকটা আমার চাই , বুঝলে ? 
- তাই তো রাখতে চাইছি । 

সেইদিন পরম নিভৃতে জড়িয়ে নিয়েছিল নাফিস তাকে । সেইদিনের সেই স্পর্শে ছিল না কোন নোংরামি ছিল না কেন অশ্লীলতা । যা ছিল তা শুধুই ভালোবাসা আর যত্ন । 

- আম্মুন , আম্মুন ,,,, 

মেয়ের ডাকে ধ্যান ভেঙে যায় জুঁইয়ের । পিছনে ফিরে দেখে ইফসি উঠে গেছে । দৌড়ে মেয়ের কাছে যায় জুঁই । 

- জ্বি আম্মুন বলো,,,,,,,?  
- হিসি হিসি 

 ইফসিকে হিসি করিয়ে দিয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে । ইফসির ঘুমের মাঝে হিসি পেলে সে উঠে যায় । তাকে জুঁই সেইভাবেই তৈরি করেছে । মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে মেয়ের দিকে একদিকে চেয়ে আছে জুঁই । 

বাচ্চা নিয়ে নাফিস আর তার অনেক স্বপ্ন ছিল । নাফিস বরাবর চাইতো বিয়ের পর তাদের মেয়ে হোক । তা নিয়ে একদিন দুজনের মাঝে ঝগড়াও হয়ে যায় । 

- মেয়েই হবে দেখে নিও । 
- তুমি কিভাবে জানো আমাদের মেয়েই হবে ? 
- হবে হবে , দেখে নিও । আমার কাদম্বরীর কোল জুড়ে আরেক ছোট্ট কাদম্বরী আসবে । 
- তুমি বড্ড বেশি অগ্রিম ভাবো । 
- হয়তো , 

ইফসির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখের পানি গুলো গড় গড় করে পড়ে যাচ্ছে চোখ দিয়ে । কি অন্যায় ছিল সেদিন তার । কোন অপরাধের শাস্তি দিয়েছিল নাফিস তাকে । পাগলের মত ভালোবাসতো সে নাফিসকে । বুকের ভেতর সব ভেঙে চুড়ে যাচ্ছে তার । মেয়ের পাশ থেকে উঠে দৌড়ে সামনের রুমে বেতের সোফায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে জুঁই । কুশন মুখে চেপে চাপা চিৎকার করে কাঁদছে জুঁই । 

- নাফিস কি অন্যায় করেছিলাম আমি ? কোন অপরাধের শাস্তি দিয়েছিলে সেদিন আমায় ? আমার ভালোবাসার মাঝে কি কোন খাদ ছিল ?  কেন এমন হলো নাফিস ? কেন আমায় এত কষ্টের মাঝে ডুবিয়ে দিয়েছিলে নাফিস ? আজ তবে কেন আবার আমার আশেপাশে চলে এলে ? 

জুঁই জানে এর উত্তর নেই । নাফিস উত্তর দিতে পারবে না । নাফিসের কাছে সেদিনও উত্তর ছিল না আজও নেই । নাফিস শুধু মিথ্যা অযুহাতে নিজেকে আর তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে ।

অন্ধকার ঘরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে নাফিস । আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না তার । বুকের মাঝে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে । গলা থেকে কেন যেন আজ কথা বের হচ্ছে না তার । বার বার জুঁইয়ের মুখটা ভেসে উঠছে । এইটুকুন বয়সে এত কিছু সামলে নিয়েছে । কিভাবে ? প্রশ্নটা বার বার মাথায় ঘুরছে তার । একার জুঁই মুখটা আবার একবার তার মেয়ের মুখটা বার বার ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে । 

- কাদম্বরী তোমায় একা করে দিয়েছিলাম আমি । হাত ধরতে চেয়েও ধরতে পারি নি সেদিন । এক রকম ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম নিজের জীবন  থেকে তাকে । এখন উপলব্ধি করতে পারি আমার কাদম্বরীকে আমার জীবনে প্রয়োজন ছিল । 

এইসব ভাবছে আর বাম হাত দিয়ে চোখের পানি মুছছে নাফিস । বড্ড বেশি অভিমান হয় নিজের উপর , অভিমান হয় আরও একজনের উপর যার জন্যে আজ এত কিছু ।

শুক্রবার দিন , অফডে আজ । আজ মেয়েকে নিয়ে বের হবার কথা ভাবছে জুঁই । ঢাকাতে এসেছে প্রায় ১ মাসের বেশি হয়ে গেছে । কাজের প্রেশারে , বাসা দেখা , বাসায় উঠা , সব গুছানো , নিয়মিত অফিস করা এইসব করতে গিয়ে সে ভুলেই গেছে যে সেও একজন মানুষ , কোন যন্ত্রাংশ নয় । তাই আজ ভেবেছে মেয়েকে নিয়ে বিকেলের দিকে বের হবে । অনেকদিন হয়ে গেছে ইফসির জন্যে কেনাকাটা করে নি জুঁই । সেই কবে করেছিল তাও মনে নেই । নিজে কোন রকম চালিয়ে নিবে কিন্তু বাচ্চা মেয়েটাকে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকটা জামা কাপড় কিভাবে পরাবে সে । 

অন্যদিকে , 
নাফিস নাস্তা করতে বসেছে । টেবিলে নাফিসের বাবা মা আর ছোট বোন বসা । শুক্রবার দিন টা সবাই একসাথেই নাস্তা করে । এমতাবস্থায় , রেহানা পারভিন মানে নাফিসের মা আবারও সেই একই প্রসঙ্গে কথা তুলে দিয়েছেন , 

- নাফিস , 
- বলো , 
- তোর ছোট খালার মেয়ে আছে না , রিন্তি 
- হ্যাঁ , তো ?? 
- আমি ভাবছি ও-কেই তোর বউ করে আনবো এই ঘরে । 
- বিয়ে করে বউ আনার কি প্রয়োজন মা ? 
- কি প্রয়োজন মানে , নিজের দিকে দেখেছিস , ঠিকঠাক মত বিয়ে করলে আজ একটা নাতি পুতি হতো । 

এমন সময় শান্তা মানে নাফিসের ছোট বোন মায়ের কথার উপর নিজের কথাটাও ছেড়ে দেয় , 

- ঠিকঠাক মত তো বিয়ে করতে চেয়েছিল তখন যখন আপত্তি করে কসম দিয়ে ছেলের পা আটকে রাখতে পেরেছো , তাহলে এখন আর ওর বিয়ের প্রয়োজন নেই বলে আমি মনে করি । 

শান্তার কথায় আনিস বেপারি মুচকি হাসি দেয় আর রেহানা পারভিন তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে । 

- এক চড় মেরে সোজা করে ফেলবো , চিনিস তুই আমাকে । 
- না চিনার তো কিছু নেই , এই ভাইয়া তুই বিয়ে করিস না । দায়িত্ব বলেও জিনিস থাকে ভুলে যাস না । এক বোনকে সবে নামাতে পেরেছিস । আমায়ও নামাতে হবে ভুলে যাস না । তারপর আমাদের মায়ের জন্যে একটা আলিশান ফ্ল্যাট কিনবি । বউ আসলে তো আর এইসব পারবি না । তাই বলছি বিয়ে আর করবি কেন ?  

এইসব বলে পার্স হাতে শান্তা বেরিয়ে যায় । মূলত নাফিসরা দুই বোন এক ভাই , নাফিস বড় তার ছোট দুই বোন । এক বোনকে গত এক বছর আগে বিয়ে দিয়েছে এখন বাকি আছে শান্তা । শান্তা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এইবার ২য় বর্ষের ছাত্রী । নাফিস আর জুঁইয়ের সবটাই জানতো সে । মনে প্রাণে চেতেছিল জুঁই ভাবী হয়ে আসবে তাদের ঘরে । কিন্তু পরিস্থিতি সব উলটে দিল । যেদিন সব কিছু শেষ হয়ে যায় সেদিন রাতে নাফিস শান্তার ঘরে প্রায় ২ ঘন্টা শান্তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে । ভাইয়ের এমন হৃদয় ভাঙা আহাজারিতে সেরাতে শান্তার কলিজাও কেঁপে উঠেছিল । তাই সেও এখন আর এইসব শুনতে পারে না । শান্তা উঠে চলে যাওয়ার পর পরই রেহানা পারভিন চেচামেচি শুরু করে দেয় । 

- মেয়ের কি চোপা হয়েছে দেখছো তোমরা ? 
- ও তো ঠিক কথাই বলেছে । আজকে এত বিয়ে বিয়ে করে পাগল হচ্ছো কেন তুমি ? তখন তো,,,,,,,,,, 
- থামো তুমি , নাফিস শুন ? 
- প্রতিমাসে সংসার খরচ বাবদ সব টাকা পেয়ে যাবে শুধু আমায় আর দেখতে পাবে না , কথাটা মাথায় রেখে তারপর যা করবার করবে আশা করি । তুমি আমার মা , জন্ম দিয়েছো আমায় , তোমায় এর থেকে আর বেশি কিছুই বলতে পারবো না । শত হলেও আমি তোমার ছেলে , তুমি আমার মা । 

এইসব বলে নাফিস খাবার টেবিল থেকে উঠে যায় । আর রেহানা পারভিন সেখানেই বসে থাকে । আনিস সাহেবও উঠে যায় ।

বিকেলের দিকে ইফসিকে রেডি করিয়ে দিয়ে নিজে রেডি হয়ে দুজনে এক সাথে বেরিয়ে যায় । আজ ইফসি খুব খুশি , সে তার মায়ের সাথে বাহিরে বের হলে অনেক খুশি হয় তার থেকে বেশি খুশি হয় তাকে কেউ সাজুগুজু করিয়ে দিলে । দেড় বছরের ইফসিও বুঝে লিপ্পি দিতে হয় । আর জুঁইও ইফসিকে সাজিয়ে রাখে নিজের মনের মত করে । ইফসিকে বেশি সুন্দর লাগে দুই ঝুটিতে । আর জুঁইও তাকে ঝুটি করিয়ে রাখে । আর ইফসিও মাশা-আল্লাহ নিজের সাজ-গোজ এর ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক । এইটুকুন ছোট মেয়েকে তার মা যেভাবে রাখে সেইভাবেই থাকে । 

মা মেয়ে দুজনে রিক্সায় চড়ে ঘুরে । মেয়ে একবার তার মায়ের কোলে আবার একবার হাটে । সব থেকে অবাক করার কথা হচ্ছে ইফসিকে যেই দেখুক না কেন একবার না একবার ইফসির গাল ধরবেই । ইফসি দেখতে এতটাই মিষ্টি যে , যে কেউই একবার না একবার তাকে আদর করবেই করবে । আর এটাই জুঁইয়ের সব থেকে বড় ভয় । 

জুঁই ইফসিকে নিয়ে একটা শপিং মলে ঢুকে । ঘুরে ঘুরে দোকান গুলো দেখছিল । আসলে জুঁই একটু আনকমন ভালোবাসে বেশি । সে বরাবরই তার মেয়ের জন্য আনকমন জিনিস কিনতে ভালোবাসে । সব দোকান ঘুরে প্রায় ৭/৮ টা জামা কিনে ইফসির জন্যে । এই জামা গুলো দিয়ে ইফসির ভালোই চলে যাবে । ইফসি মায়ের পাশে থেকে আশেপাশে তাকায় । পাশেই সিরামিক শপ । গ্লাস করা দোকান গুলোর বাহিরে থেকে সব কিছুই দেখা যায় । শপের ভেতরে এক পাশে বড় বড় টেডি বেয়ার পুতুল গুলো রাখা আছে । ইফসি তা দেখে মায়ের কাছে বায়না ধরে । 

এখানের বিল মিটিয়ে ইফসিকে নিয়ে সেই দোকানে যায় জুঁই । তবে সেই সময়ে পুতুল গুলো কেনার মত সাহস তার ছিল না । পুতুল গুলোর গায়ে ট্যাগ লাগানো আছে । কোনটা ১২০০ তো কোনটা ১৫০০-৩০০০ এর মধ্যে । এমনিতেই ইফসির জামায় প্রায় ৩০০০ টাকা খরচ হয়ে গেছে । মাস মাত্র শুরু । বাসা ভাড়া , বাজার সব মিলিয়ে পুরো মাসটা চালাতে হবে তাকে । তাই সব দিক ভেবেই মেয়েকে পাশে রাখা ছোট পুতুলের কাছে নিয়ে যায় । কিন্তু ইফসি ওই বড় বড় পুতুলের মাঝে পান্ডা পুতুলটাই কিনবে । ২৫০০ টাকা দিয়ে ওই পুতুল কিনে দেয়ার মত বিলাসিতার আমেজ এই মুহুর্তে জুঁইয়ের মাঝে নেই । তখন বাধ্য হয়ে দোকানেই ইফসিকে ধমক মারে জুঁই । মায়ের ধমক খেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দেয় ইফসি । দুই হাত এক করে বুকের মাঝে ধরে রেখে কাঁদতে থাকে ছোট ইফসিটা । গড় গড় করে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে ইফসির চোখ দিয়ে । ইফসির কান্না দেখে দোকানদার জুঁইয়ের কাছে আসে । আর বলে , 

- ম্যাডাম , বাচ্চা যখন চাইছে কিনে দিন না ? 
- আপনি কি ফ্রীতে দিবেন ? 

জুঁইয়ের কথা শুনে দোকানদার চুপসে যায় । তখন জুঁই আবারও বলে , 

- বলুন , ফ্রীতে দিবেন ? 
- তা কিভাবে দিবো ম্যাডাম ? 
- তাহলে , এই মুহুর্তে ওই পুতুলটা কেনার সামর্থ্য আমার নেই । 
- আমরা ডিসকাউন্ট দিবো । 
- কতটাকা ডিসকাউন্ট দিবেন ভাই ? সর্বোচ্চ ১০০০ টাকা তারপরও ১৫০০ টাকা । ওর মায়ের যতটুকু সামর্থ্য ততটুকুর মাঝে থাকতে হবে ও-কে । 
- বাচ্চা তো বুঝে না । 
- তাই তো ধমক দেয়া , যাতে বুঝে যায় । 

দোকানদারের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিজের মেয়ের দিকে তাকায় জুঁই । কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে ইফসি । জুঁইয়েরও কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে । ইফসি কখনও এত বায়না করে না হয়তো পুতুলটা তার খুব ভালো লেগেছে তাই এত কাঁদছে সে । ইফসিকে কোলে তুলে নেয় জুঁই । ইফসি তখন দুই হাত মুঠোবন্দী করে মুখের সামনে নিয়ে কাঁদছে । 

- আম্মুন আবার কিনে দিবো , কেমন ? 

ইফসি কেঁদে যাচ্ছে । এমতাবস্থায় ইফসিকে নিয়ে দোকানের বাহিরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় জুঁই । ঠিক তখনই কেউ একজন পিছন থেকে ইফসির নাম ধরে ডেকে দেয় , 

- ইফসি,,,,,,,,,,,? 

ইফসির নাম অন্য কারো মুখে শুনে পিছনে তাকায় জুঁই । তখন দেখে সেই পুতুলটা হাতে নিয়ে নাফিস সেখানে দাঁড়িয়ে আছে । অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায় জুঁই । 

- নাফিস এখানে ? এই সময়ে ? এই দোকানে ? কিভাবে এলো ?  

এইসব প্রশ্ন গুলো নিজের মাথায় সাজাচ্ছে জুঁই । আর ওই ফাঁকে ইফসি জুঁইয়ের কোল থেকে নেমে গিয়ে নাফিসের কাছে যায় । পুতুলটা দেখে খুব খুশি হয় ইফসি । পুতুলটা তার থেকেও বড় তাই নাফিস ইফসিকে কোলে তুলে পুতুলটা তার হাতে ধরিয়ে দেয় আর ইফসি আনন্দে পুতুলটার গলা জড়িয়ে ধরে । 

জুঁই ইফসিকে ডেকে নিজের কাছে আসতে বলে । জুঁইয়ের কন্ঠস্বর শুনে নাফিস ইফসিকে কোলে নিয়েই জুঁইয়ের সামনে দাঁড়ায় । তারপর জুঁই আবারও বলে , 

- তোমাকে না বলেছি অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু নিতে হয় না । 

তখন নাফিস বলে , 

- দেড় বছরের একটা বাচ্চা এত কিছু বুঝবে কিভাবে জুঁই ? 
- বুঝতে হবে ও-কে । 
- আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের রুটিনটা আমাদের ক্ষেত্রেই মানায় এদের ক্ষেত্রে নয় জুঁই । বাচ্চাটা পুতুল চেয়েছে । 
- আর তুমিও কিনে দিলে , কেন ?  কোন অধিকারে ? 
- জুঁই,,,,,,,,? 
- ইফসি আসো আমরা বাসায় যাবো । 
- দাড়াও জুঁই , পুতুলটাও নিয়ে যাও । কারণ দেখো ইফসি আবার কাঁদছে । 

জুঁইয়ের এইবার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায় । পারে না এখানেই ইফসিকে থাপ্পড় মেরে দেয় । নাফিস ব্যাপারটা বুঝে 
জুঁইকে আবারও বলে , 

- ইফসির গায়ে একটা ফুলের টোকাও দিবে না তুমি । এটা ও-কে ওর আংকেল কিনে দিয়েছে । চুপচাপ এটা নিয়ে দোকান থেকে বের হবে । আর কোন কথা না । 

তখন জুঁইয়ের কোল থেকে নাফিস ইফসিকে আবার নিজের কোলে নিয়ে নেয় । তারপর পুতুল আর ইফসিকে নিয়ে নাফিস বের হয়ে যায় দোকান থেকে । না চাইতেও আপাতত এইসব মানতে হচ্ছে তাকে । না হয় ইফসিটা কাঁদতেই থাকবে আজ । শপিং মল থেকে বেরিয়ে নাফিস জুঁইকে বলে ওঠে , 

- বাসায় যাবে তো এখন ? 
- হ্যাঁ , 
- চলো নামিয়ে দিয়ে আসি । 
- নাহ , আমরা রিক্সায় করে চলে যাবো । 
- বাইকে উঠো । একা একা কিভাবে যাবা , আমি নামিয়ে দিয়ে আসি । 

জুঁই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ভাবে , রাতও প্রায় হয়ে গেছে । একা যাওয়ার থেকে নাফিসের সাথে যাওয়াটাই সেইফ হবে । তাই নাফিসের কথার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে নাফিসের বাইকে উঠে যায় জুঁই । ইফসিকে নাফিস তার সামনে বসায় । এই কয়েকদিনে নাফিস ইফসিকে খুব আপন করে নিয়েছে । প্রায় প্রতিদিনই অফিসে ইফসিকে দেখে নাফিস । পিচ্চি ইফসি সবার সামনে ঘুরে বেড়ায় । যেন ছোট খাট একটা জীবন্ত পুতুল সে । 

আর অন্যদিকে জুঁই ভেবে পাচ্ছে না কি হচ্ছে এইসব । আর কিভাবে হচ্ছে এইসব । আজ এত বছর পর পুরাতন ঘা আবার নতুন করে জ্বলছে । এইসব ভাবতে গিয়ে ধ্যানে হারায় জুঁই । তখন নাফিসের ডাকে তার ধ্যান ভেঙে যায় । নাফিস বাসার ঠিকানা জিজ্ঞেস করে । কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর জুঁই বাসায় ঠিকানা বলে । আর নাফিস সেই ঠিকানা অনুযায়ী বাইক নিয়ে গিয়ে থামায় ।

বাইক গিয়ে থামে জুঁইয়ের ভাড় বসার সামনে । জুঁই সেকেন্ড ফ্লোরে থাকে । জুঁই ইফসিকে কোলে নিয়ে শপিং ব্যাগ আর পুতুল নিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে । নাফিস সাহায্য করতে চাইলে জুঁই বাঁধা দেয় । নাফিস নিজ থেকেই বলে ওঠে , 

- আমায় বাসায় যেতে বলবে না  ? 
- তুমি কে হও আমার ? 
- মানে ? 
- মানে হলো , তুমি তো এখন পর পুরুষ । এখন পর পুরুষ বাড়িতে ঢোকাবো । ভালো দেখাবে ? 
- জুঁই,,,,,,,,,,,  ?
- হ্যাঁ জুঁই , আমি জুঁই চাই না এই সময়ে এসে আমার গায়ে কলঙ্ক উঠুক । 
- আমরা কি আবার এক হতে পারি না ?. 

নাফিসের কথা শুনে জুঁই অবাক নয়নে নাফিসের দিকে তাকিয়ে থাকে । তারপর তাচ্ছিল্যের সাথে হালকা হাসি দেয় , আর বলে , 

- নাফিস একটা কথা বলি ? 
- হ্যাঁ বলো , 
- আমি আমার আমিকে সাজিয়ে বড় যতনে তুলে দিয়েছিলাম তোমায় । ভেবেছিলাম আপন করে নিবে তুমি । আমার ভাবনার মাঝে ফারাক ছিল বিশাল । তাই তোমার বিস্তার আমার মাঝে হয় নি । আমাদের প্রেমের দাঁড়িপাল্লায় আমার প্রেমের ভাগ টা কম ছিল আর তোমার কথার ভাগ টাই বেশি ছিল । প্রেম নামের যুদ্ধের ময়দানে আমি আজ সর্বহারা এক হেরে যাওয়া বিধ্বস্ত নারী  ।। 

জুঁইয়ের কথায় নাফিসের শরীরের শিরা উপশিরা গুলো দাঁড়িয়ে যায় । কথা গুলো গল অবদি এসে আটকে গেছে তার । পরক্ষণেই জুঁই বলে ওঠে , 

- আসছি , ভালো থেকো । আর আজকেই শেষ , আর কখনো আমার মেয়েকে কিছু দিও না । ওর বুঝতে হবে ওর বাবা নেই , ও এতিম । ওর মা সামান্য মধ্যবিত্ত নারী যে কিনা মাসে ৩০ দিন অফিস করে রোজগার করে । ও-কে সব কিছুই বুঝতে হবে । আল্লাহ হাফেজ  

জুঁই উপরে উঠে চলে যায় । নাফিস সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে । পরিস্থিতি আজ কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে যেখানে তার কাদম্বরী নিজেই নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছে ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন