সংসার - পর্ব ০৮ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


১৫!! 

-এবার কোথায় পালাবেন ম্যাডাম? অনেক তো উড়োউড়ি করলেন, দুটো দিন পালিয়ে পালিয়ে বেড়ালেন। এবার কোথায় পালান আমিও একটু দেখি।

অনামিকা চিন্তিত ভঙ্গিতে রুমের সামনে আসতেই কেউ হ্যাঁচকা টানে অনুকে রুমে ঢুকিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরতেই মেয়েটা চমকে উঠলো। ভয়ে চোখ জোড়া শক্ত করে বুজে নিয়েছিল অনু। অনুর হাত জোড়া চেপে ধরা হাতের চাপটা হালকা হয়ে আসায় অনামিকা এবারে মুখ তুলে তাকাতেই অরণ্যের দিকে চোখ পড়লো। অরণ্য ঠোঁটের কোণে বাঁকা একটা হাসি ফুটিয়ে অনুর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসতে আসতে কথাগুলো বললো এবারে। আর অরণ্যের দুষ্টুমিমাখা হাসি, উষ্ণ নিঃশ্বাস চোখে মুখে এসে পড়া, আর এমন হুমকি ধামকিমূলক কথা শুনে আবার না চাইতেও চোখের পাতা জোড়া একে অন্যকে চেপে ধরেছে অনামিকার।অনামিকার হুট করেই এমন নিরব আত্মসমর্পণে অরণ্য যতটা না অবাক হতো তার চেয়ে বেশি হয়তো কনফিউজড হয়ে গেল। এতো সহজে হার মেনে নেয়ার মেয়ে অনামিকা নয়। তাহলে হলো টা কি এই মেয়েটার? আরেকবার অনামিকার বন্ধ চোখ মুখের দিকে অরণ্য ভাবলো, ও নিজেই বেশি ভাবছে না তো? অনুও হয়তো সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিয়ে নতুন করে শুরু করতে চায় সব? অরণ্য আরেকবার অনামিকার কেঁপে ওঠা বন্ধ চোখের পাপড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে অনামিকার চোখে হালকা করে ফুঁ দিল। অনামিকার আবার কেঁপে ওঠাটা দারুণ লাগলো অরণ্যের।

-অনু? কি হলো বলো তো? সবসময় পালাই পালাই করা মেয়েটা এতো শান্ত হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! সত্যিই দাঁড়িয়ে আছো? নাকি দিন দুপুরে দিবাস্বপ্ন দেখছি? কি গো বলো না? এই অনু?

-আমি মোটেও পালাই পালাই করি না। আমি নিজের যতটুকু কাজ সেটাই করি সবসময়। 

-তাই নাকি ম্যাডাম? তা কথাগুলো আমার দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বলুন তো দেখি?

-চোখে চোখ রেখে বললে কি হবে? যেটা সত্যি সেটা চোখ বুজে বললেও সত্যি, চোখ মেলে বললেও সত্যি।

-সেটা তো আমিও বলছি ম্যাডাম। চোখ বুজে বলার চেয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে, সোজা চোখে চোখ রেখে বললে একটু ফিল নেয়া যায় আর কি। কই? তাকান তো দেখি ম্যাডাম?

-নিন। তাকালাম। এবার হয়েছে?

অরণ্যের কথায় চোখ মেলে তাকাতেই সোজা চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। অরণ্যের গভীর চাহনিতে একবার কেঁপে উঠলেও সোজা চোখের দিকেই তাকিয়ে রইলো অনু। এই লোকটার গভীর চোখে হারিয়ে যেতে তো অনুরও ইচ্ছে করে। কিন্তু ওই যে অভিমান?! লোকটা সামনে না থাকলে নিজেই নিজেকে মনে মনে করে বকে অনু। কেন লোকটার সাথে রাগ দেখায়, কেন তার পাগল করা, মাতাল ভালোবাসায় সাড়া দেয় না, এসব ভেবে নিজেরই নিজেকে গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে অনামিকার। অথচ লোকটা সামনে এসে দাঁড়ালেই কোথা থেকে যে এই রাজ্যের অভিমান এসে ভর করে ওর মনে সেটাই ভেবে কূল কিনারা করতে পারে না মেয়েটা। এতো অভিমান শুধু লোকটা সামনে থাকলেই কেন হয় সেটাই গভীর রহস্যে রূপ নিচ্ছে অনামিকার মনে। এদিকে অনুর গভীর রহস্যের পর্দা উন্মোচন হওয়ার আগেই অরণ্য আলতো হাতে অনুর কপালের উপরে আসা চুলগুলো সরিয়ে দিল। অনামিকা একটু চমকে উঠলো কপালে অরণ্যের আঙ্গুলের ছোঁয়া লাগতেই। সেটা দেখে অরণ্য আরেকবার হাসলো অনামিকার চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই।

-এতো আলতো ছোঁয়াও যে মানুষটা কেঁপে ওঠে সে যে সারাদিন পালানোর জন্য ছুটোছুটি করবে এটা হয়তো স্বাভাবিক। উমমমম। বাট আমার কথা হলো এতো পালানোর কারণটা কি? আমি কি তোমাকে বড্ড বেশিই জ্বালাতন করছি? নাকি আমাকে জ্বালাবে বলে পণ করেই এসব করা হচ্ছে ম্যাডাম?

-আমি তো পালাই নি কোথাও। এখনও তো আপনার সামনেই আছি। তাহলে এ কথা কেন বলছেন?

-এখন সামনে আছো ঠিকই। হাতটা ছেড়ে দিলেই তো ছুটবে রুমের বাইরে। তাই না? তোমাকে রুমে আনার জন্য নিচে কতো কাহিনী করতে হলো মায়ের সামনে। সেটার শাস্তি কি হওয়া উচিত বলো তো?

-শাস্তি তো সম্ভবত অন্য কারো পাওয়া উচিত। কেউ না দেখেই বলে দিল আমি নাকি কাল রান্নাঘরে শুয়েছি। মায়ের হাতের বিনাদোষেই বকা খেলাম।

-জানি তো কাল আপনি এখানেই ছিলেন ম্যাডাম। বাট রুমে ছিলেন কি? সত্যি করে বলুন তো?

-রুমে ছিলাম না কে বলেছে আপনাকে? আমি সকাল সকাল উঠে গেছি। নিজে তো এতোক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছেন। জানবেন কি করে ছিলাম নাকি ছিলাম না? মানে নিজে জানেই না, আমাকে বকা খাইয়েছে মায়ের হাতে।

অনামিকা একবার বাচ্চাদের মতো করে ঠোঁট বাঁকিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই অরণ্য আলতো করে অনুর গালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে আবার নিজের দিকে ফেরালো। 

-মানে কি সুন্দর রুমে ছিলাম, আপনি জানেন না, ঘুমিয়েছেন মরার মতো-এসব বলে চালিয়ে দিচ্ছেন ম্যাডাম। বাট যেখানে রাত কাটিয়েছেন সেটাকে যে রুম নয়, বারান্দা বলে সেটা কি জানেন আপনি? আর কি যেন বলছিলেন? আপনি রুমে ছিলেন না কে বলেছে আমাকে? আমি যে কতো রাত পর্যন্ত আপনার আসার অপেক্ষায় জেগে বসেছিলাম আপনি জানেন? আপনি যে এইটুকু একটা দোলনায় আয়েশ করে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়েছেন সেটাও আমি জানি। আপনাকে মায়ের কাছে বকা খাইয়েছি বেশ করেছি। কাল অনেক টায়ার্ড ছিলেন বলে আর জাগাই নহ, নইলে তুলে ঠিকই নিয়ে আসতাম। বাট আজও যদি দোলনায় গিয়ে শুয়েছেন ম্যাডাম তাহলে সোজা দোলনা থেকে উল্টে ফেলে দিবো। তখন টের পাবেন কোমড় ভাঙ্গলে কেমন মজা লাগে।

-কি!

-কি নয় ম্যাডাম। বলুন জি। সেকেন্ড টাইম আর আপনাকে কোনো ধরনের ওয়ার্নিং দেয়া হবে না। এবার থেকে ডিরেক্ট একশন। কথাটা মাথায় রাখবেন। এন্ড নাউ মাই ডিয়ার সুইট ওয়াইফ, আপনার সাথে বকবক করতে গিয়ে যে আমার অফিসের দেরি হয়ে গেল সেটার ভরপাই কে করবে শুনি?

-কিসের ভরপাই? আর আপনি অফিসে না গিয়ে আমার সাথে বকবকই বা করছেন কেন? আমাকে ডেকেও আনলেন, আবার কথাও শোনাচ্ছেন? আজব!

অরণ্য এতোক্ষণে অনামিকার কাছ থেকে সরে এসে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলায় টাই বাঁধায় মন দিল। অনামিকাও এতোক্ষণে ছাড়া পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন।

-আমি আপনাকে কখন ডাকলাম ম্যাডাম? আমি কি বলেছি রুমে আসুন?! কই মনে পড়ছে না তো? এখন তো দেখছি আপনাকে নিয়ে সংসার প্ল্যানিং করার আগে ডাক্তারের এপয়েন্ট নিতে ছুটতে হবে।

-মানে কি? এই এই? কি বলতে চান কি আপনি? আপনি না ডাকলে আমি নিজেই নাচতে নাচতে আপনার কাছে ছুটে এসেছি নাকি? 

-ওমা! আপনি নাচতে নাচতে আপনার হাজবেন্ডের কাছে আসতেই পারেন। কে বারণ করেছে? বাট আমার কথা হলো নিজে থেকে এসেছই যখন, তাহলে অস্বীকার করছ কেন? আমি তো আপনার হাজবেন্ড ম্যাডাম। বাইরের কেউ তে নই।

-আহহহ। একদম উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না। আমার বয়েই গেছে নাচতে নাচতে আপনার কাছে আসতে। আপনার না দেরি না হচ্ছিল অফিসে যেতে? যাচ্ছেন না কেন? যান তো।

-এভাবে যান বলো না জান। একদম বুকে গিয়ে লাগে। উফ! বাড়ি ভর্তি মেহমান। নইলে কি যে করতাম।

-অরণ্য? আপনার আজকে অফিসে যেতে হবে না?

অনামিকার প্রশ্নটা শুনে অরণ্য কয়েক পা এগিয়ে এসে অনামিকার কোমড় জড়িয়ে নিজের সাথে হালকা করে জড়িয়ে নিল। আর বেচারি অনামিকা থতমত খেয়ে চোখ বড় বড় করে অরণ্যের দিকে তাকালো। এই ভদ্রলোকের মাথায় কখন কি চলে বোঝা মুশকিল। এখন আবার এই রোমান্টিক মুডে থাকার রহস্য কি?!

-তুমি বললে আজ নাহয় অফিসে যাবো না। কি বলো? ফাজিলগুলো সবাই এতোক্ষণে বেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যের আগে ফিরবে না। মা এনজিওতে যাবে। প্রভা যখন এসেছে তাহলে তাহিয়াও বের হবে ওকে নিয়ে। বাড়িটা খালিই থাকবে বলা চলে। সারাদিন তোমার অভিমান ভাঙ্গানোর সাথে সাথে একটু রোমান্স করারও সময় পাওয়া যাবে। কি বলো? বসকে কল করে বলে দিবো নাকি আজকে অফিসে যাবো না যে? তুমি বললে এক্ষুণি কল করছি-----।

-আরে? না না না না না।

অরণ্য কথাগুলো বলতে বলতে পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইলটা হাতে নিতেই অনামিকার গলা দিয়ে রীতিমতো চিৎকার বেরিয়ে গেল। অরণ্য সেটা দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই অনামিকা একটু ইতস্তত বিব্রত হেসে নিজেকে অরণ্যের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো।

-আমমম। আপনার তো সত্যিই অনেক দেরি হয়ে গেছে অরণ্য। অফিসে না আপনার জরুরি কিসের মিটিং আছে?! পরে তো বলবেন আমিই দেরি করিয়ে দিয়েছি না? আমি তো বাসাতেই-বাসাতেই আছি। আপনি ফিরে আসলে নাহয় আবার কথা হবে। ওকে?

-ব্যাপার কি ম্যাডাম? আমি যেতে চাইছি না, আর আপনি জোর করে পাঠাতে চাইছেন? ব্যাপারটা কি? ডাল মে কুছ তো কালা হ্যায় দয়া?

-কিছু কালা নেই। আপনি যান তো এখন। টায়ার্ড লাগছে। ঘুমাবো আমি।

অনামিকার ঘুমের কথা শুনে আর বিরক্ত করলো না অরণ্য। আলতো করে ছোট্ট করে একটা চুমো এঁকে দিলে অনামিকার কপালে।

-ওকে ম্যাডাম। আর বিরক্ত করবো না ম্যাডামকে। আপনি একটু রেস্ট করুন। আমি অফিসে যাই। খবরদার রুম থেকে এক পাও যদি বেরিয়েছ তো খবর আছে। চুপচাপ রুমেই ঘুমাও। আর বারান্দাতেও না। মনে থাকবে?

অনামিকা মাথা নেড়ে সায় দিতেই অরণ্য আরেকবার অনামিকাকে টেনে নিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আবার ছেড়ে দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো। যেতে যেতে দরজার সামনে এসে লকটা টিপে দিয়ে আরেকবার অনামিকার দিকে ফিরে তাকালো।

-মিটিং শেষ হলে জলদীই চলে আসবো ম্যাডাম। ততক্ষণে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে রিফ্রেশ হয়ে নিন। কিছু একটা তো চলছে আমার মনে। এসেই নাহয় শুনবো। এখন আসি। সত্যিই দেরি হয়ে গেছে। বায় মিসেস চৌধূরী।

অরণ্য শেষের দিকের কথাগুলো বলে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে দরজাটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। অনামিকাও এবারে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলো কিছু একটা নিয়ে। অরণ্যও টের পেয়েছে অনামিকার টেনশন করাটা। আজ নাহয় কাল হয়তো চেপে ধরেই জানতে চাইবে কি নিয়ে এতো মনমরা হয়ে থাকছে ও। কি জবাব দিবে তখন অরণ্যকে ও? সব সত্যিটা বলে দিবে? বললেও বিশ্বাস করবে তো অরণ্য? হোক না বছর খানেক আগেরই ঘটনা, সেটা যে আবার নতুন করে নতুন রূপে অনামিকার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা কি করে বলবে অনামিকা অরণ্যকে? এই ছোট্টো ঘটনাটা যে আরো ডালপালা বিস্তার করতে করতে কোনদিনে মোড় নিবে সেটাই তো অনামিকার মাথায় ঢুকছে না।

নিজের মনেই হাজারটা যুক্তি তর্ক করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়েই ঘুমিয়ে গেছে অনামিকা। কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে সেটা জানে না ও। কিন্তু ঘুমটা ভাঙ্গার কারণটা কি সেটাই বুঝতে পারলো না মেয়েটা প্রথমে। মনে হলো একটা হালকা শীতল স্পর্শ ওর পেটের কাছ থেকে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে দিয়ে ছুঁয়ে দিয়ে গেছে। স্পর্শটা এতোটাই হাড় হিম করা যে অনামিকা ঘুমের ঘোরেও ধড়ফড় করে উঠে হাত পা গুটিয়ে বসে শাড়িটা দিয়ে নিজের সমস্ত শরীরটা ঢাকার চেষ্টা করলো। ঘুমের মধ্যেই স্পর্শটা স্বপ্নের মতো মনে হলেও এবারে সেই ভুল ভেঙ্গে গেল অনুর সামনের দিকে তাকিয়েই। ওর থেকে মাত্র দু হাতের দূরত্বে তাকিয়েই চোখজোড়া বিস্ফোরিত হওয়ার জোগাড় অনামিকার। সামনে যা দেখছে তা সত্যি তো?

১৬!! 

-গুড আফটারনুন। ওয়েট? মিস অনামিকা তাহরা বলবো? নাকি মিসেস অরণ্য চৌধূরী বলবো? রিমেম্বার মি? ওয়ান ইয়ার ব্যাক, কফি শপের আড্ডা, আপনি, আপনার বয়ফ্রেন্ড? কিছু কি মনে পড়ছে ভাবিসাহেবা?

ঠিক দু হাতের দূরত্বে একজন মানুষ বসা, ঠিক মানুষ বললে ভুল বলা হবে হয়তো। এক কথায় বলতে গেলে যাকে অমানুষ ছাড়া আর কোনো বিশেষণে বিশেষায়িত করতে পারবে না অনামিকা, সেই অমানুষটার হাতের স্পর্শেই প্রায় ছিটকে বিছানার এক কোণে হাত পা গুটিয়ে গুটিশুটি হয়ে মুখ লুকিয়ে বসে আছে অনামিকা। এই লোকটা ওর রুমে কি করে এলো সেটা ভেবেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসতে চাইছে মেয়েটার। লোকটা শয়তানি ক্রুর একটা হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে একটু এগিয়ে বসার চেষ্টা করতেই অনামিকা চট করে বাম হাতটা বাড়িয়ে বেড সাইড টেবিলটার উপর থেকে ফুলদানিটা তুলে নিয়ে এমনভাবে তুলে ধরলো যেন লোকটা সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করলেই মাথায় ফুলদানিটা দিয়ে বাড়ি দিয়ে দিবে। অনামিকার এমন কাজে লোকটা যেন মজা পেয়েই শব্দ করে হেসে ফেললো এবারে।

-সো সিলি ইউ নো? বাট আই লাইক ইওর দিস ইনোসেন্ট স্টাইল। 

-খবরদার একদম সামনে আসার চেষ্টা করবেন না রিশাদ। আর এক ইঞ্চি সামনে এলেও আমি সত্যি সত্যিই আপনার মাথায় এই ফুলদানিটা ভাঙ্গবো বলো দিলাম।

-ওহ রিয়েলি!? মাথায় ফুলদানি ভাঙ্গবে? ওকে ক্যারি অন। এন্ড অল দা ভেরি ভেরি বেস্ট। নাউ মে আই টাচ ইউ ওয়ান্স মোর প্লিজ?!

-আমি কিন্তু এবার চিৎকার করে সবাইকে ডাকবো রিশাদ। আপনি যদি এ মূহুর্তে রুম থেকে বেরিয়ে না যান তাহলে কিন্তু------।

-তাহলে কি করবেন ভাবিসাহেবা? দেবর ভাবির সম্পর্কগুলো কতো রসালো হয় সেটাও কি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে নাকি? এতো ইনোসেন্ট  হওয়াও কিন্তু ঠিক না। আমি তাহলে তো আরো এট্রাক্ট হবো আপনার দিকে। সেটারও তো সুযোগ দিচ্ছেন না আপনি।

-স্টে এওয়ে ফ্রম মি মিস্টার রিশাদ। আমি কিন্তু এবারে মাকে ডাকবো------।

-ওকে। ডাকুন না? আমি হেল্প করবো? ওয়েট। আন্টি? আন্টি? উঁহু। কেউ কি আসলো? কেউ আসবে না ম্যাডাম। কেউ বাড়িতে থাকলে তবে তো আসবে।

অনামিকার মুখোমুখি বিছানায় আয়েশ করে পা তুলে বসে কথা বলা শুরু করেছে রিশাদ। অনামিকা এক সেকেন্ড কিছু একটা চিন্তা করতে গিয়েও রিশাদকে এভাবে বসতে দেখে জোর হাতে একটা বাড়ি দিতে লাগলো রিশাদের মাথা লক্ষ্য করে। রিশাদও সতর্কই ছিল। চট জলদী পিছিয়ে আসায় ব্যর্থ হলো অনামিকা। সেটা দেখে হো হো করে হেসে ফেললো রিশাদ।

-সিরিয়াসলি অনামিকা? এই বুদ্ধি নিয়ে কি করে অরণ্যের সাথে টিকে আছো সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আধো ওর সাথে সম্পর্ক টম্পর্ক আছে? নাকি আগের বয়ফ্রেন্ডের সাথেই চালিয়ে যাচ্ছ?

-মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ রিশাদ। একটাও বাজে কথা বলবেন। অরণ্য ফিরলে আজ আমি ওকে সবটা বলে দিবো।

-ওহ রিয়েলি!? তা কি কি বলবেন শুনি? বছর খানেক আগে একটা কফি শপে আপনাকে দেখেই ভালো লেগেছিল বলে প্রপোজ করেছি বলে আপনার এক্স বয়ফ্রেন্ড আমাকে সবার সামনে চড় মেরেছে, গায়ে হাত তুলেছে, সেটা বলবেন? পাবলিক প্লেসে রিশাদের গায়ে হাত তুলেছে কেউ। সেটাও আপনার জন্য। বলবেন?

-আপনি যেটা করেছেন সেটাকে প্রপোজ করা বলে না। বলে ইভটিজিং করা, ফাতরামি করা, অসভ্যতা করা। আর সাহিল আপনাকে মেরেছিল আমি না করে দেয়ার পরেও আমাকে বাজে প্রস্তাব দেয়ায়, তাও আবার কফিশপের মতো একটা পাবলিক প্লেসে। আপনি পাবলিক প্লেসে অসভ্যতা করলে তো পাবলিক প্লেসে অপমানিত হতেই হবে।

-আহহহহহ। তোমার দেখছি সবই মনে আছে। ওয়াও! ইম্প্রেসিভ! বাই দা ওয়ে, তখন জাস্ট অফার করেছিলাম, বাট এখন তো সেটা আদায় করেই ছাড়বো! ডিল ওকে ম্যাডাম?

-হোয়াট!?

-কি আশ্চর্য! সব তো মনেই আছে তোমার, আবার নতুন করে শুনতে চাচ্ছ? ওকে আবার বলছি। ফর ওয়ান ডে অর নাইট, আই ওয়ান্ট ইউ এজ মাই বেড পার্টনার। নাউ হ্যাপি? 

-অসভ্য, ইতর, ছোটলোক। বের হয়ে যা আমার রুম থেকে। নইলে অরণ্য জানলে কি করবে কল্পনাও করতে পারবি না।

-ওহ কাম অন অনামিকা। অরণ্য জানবে কি করে? এটা তো জাস্ট তোমার আর আমার ব্যাপার। আমি তো অরণ্যকে কিছুই বলবো না। তুমিও আশা করি কিছু বলবে না। কজ বললে আমাকেও তোমার এক্স হিস্ট্রি অরণ্যের সামনে তুলে ধরতে হবে। বেশ কয়েকটা ছবিও আমার মোবাইলে এখনো সেইভ আছে। তোমার আর তোমার পেয়ার সাহিলের। সেগুলো অরণ্যের মোবাইলে সেন্ড করবো? নাকি আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে? সংসার বাঁচাবে? নাকি সম্মান? ইউ ক্যান চুজ ওয়ান। বাট আমি সাজেস্ট করবো অনামিকা------।

রিশাদ নিজের আঙ্গুলগুলোকে বিছানায় হাঁটিয়ে অনামিকার দিকে একটু এগিয়ে আসার চেষ্টা করতেই অনামিকার এবারে একটু পিছিয়েই ফুলদানিটা দিয়ে বিছানায় বাড়ি মারলো। একেবারে অব্যর্থ নিশানা। ফুলদানির আঘাতটা সোজা রিশাদের আঙ্গুলে এসে লাগলো। নরম বিছানায় ফুলদানিটা ততটা জোরে আঘাত করতে না পারলেও রিশাদের হাতে বেশ ব্যথাই লাগলো। আঙ্গুল দুটো নাড়াতে নাড়াতে আরো কিছুটা পিছিয়ে এলো রিশাদ এবারে। অনামিকার থেকে যে সাবধানে থাকতে হবে সেটা এতোক্ষণে টের পেয়ে গেছে বজ্জাত ছেলেটা।

-কি ভেবেছিস কি তুই? তোর কথার জালে অনামিকাকে ফাঁসাবি? কক্খনো না। অরণ্যকে কি দেখাবি দেখিয়ে দে। ওকে আমি সব বলে দিয়েছি আগেই। আমি মরে যাবো। কিন্তু নিজের সম্মানটাকে বিসর্জন দিয়ে নয়, তোর মতো অমানুষকে খুন করে মরবো প্রয়োজনে। তোকে মেরে দরকার পড়লে ফাঁসিতে ঝুলবো, তবু একটা নরকের কিট কমুক এই সুন্দর পৃথিবীটা থেকে।

-ওয়াও! এংগ্রী ওমেন?! বাই গড! ইউ আর লুকিং সো সেক্সি রাইট নাউ। ওহ মাই গড! তোমাকে তো একবারের জন্য হলেও চাই আমার।

-তুই হাজার বার জন্ম নিয়ে, হাজার বার মরলেও আমাকে কখনো পাবি না। এক সেকেন্ডের জন্য, আমার শরীরের একটা লোমকূপ পর্যন্ত ছুঁতে পারবি না তুই কখনো। শুধু অরণ্যকে আসতে দে আজকে।

-ওহো! হাউ সুইট! অরণ্য এলে কি বলবে মিস অনামিকা? কেঁদে কেঁদে বাচ্চা মেয়ের মতো কমপ্লেইন করবে অরুর কাছে? কি বলবে? অরণ্য অরণ্য তোমার ভাই আমার সাথে সেক্স করেছে? নাকি রেইপ করেছে? 

-মুখ সামলে কথা বলো রিশাদ।

-আর কিসের সামলাসামলি ম্যাডাম? এখন দেড়টা বাজে। অরণ্য আর বাকি কাজিনরা বাড়িতে আসতে আসতে রাত দশটার মতো বাজবে। ততক্ষণে আমার কাজ তো হয়েই যাবে। রাইট? 

-গেট লস্ট রিশাদ।

-এই সামান্য ফুলদানি দিয়ে একজন হিংস্র রিশাদকে কতোক্ষণ আটকে রাখতে পারবেন ভাবি সাহেবা? এক সেকেন্ডের জন্য তো আপনার হাতটা কেঁপে উঠবে? সেই একটা সেকেন্ডই আমার জন্য এনাফ। তারপর রিশাদ যে কোনো হিংস্র বাঘ বা সিংহের চেয়ে কম যায় না, সেটাও আপনাকে বুঝিয়ে দিবো। নো প্রবলেম। লেটস ওয়েট ফর মাই টার্ন। ওকে?

-আহহহহহহহহহ। অরণ্য? কোথায় আপনি?

-অরণ্যকে ডাকছেন ভাবি? ওহ হ্যাঁ, ওকে কি করে এতো জাদু করে রেখেছেন সেটাও তো বলবেন তাই না? আর বলছেন আপনার এক্সের কথাও জানে! ওহ মাই গড! একটুও জেলাস হয়নি ও? কি বলেন? আপনি কোথাও বের হলে সন্দেহ করে না? এক্সের সাথে মিট করতে যাচ্ছেন বলে পিছু নেয় না? আমি হলে তো একবার মজা নিয়েই বাপের বাড়িতে ফেলে দিয়ে আসতাম। অন্য জনের ইউজড মাল আমি কেন সারাজীবন বয়ে বেড়াবো? 

-জাস্ট স্টপ ইট। স্টপ ইট, স্টপ ইট।

-ওহ কাম অন অনামিকা। এসব তো প্র্যাকটিক্যাল লাইফের কথাবার্তা। রাইট? আচ্ছা বলেন তো ভাবি, সিক্রেটটা কি? আপনি তো আপনার এক্সের সাথে ইন্টিমেট করেছেন, রাইট? তবু অরণ্য আপনার জন্য এতো পাগল? ও কি টের পায় নি? আসলে কি করে হলো ব্যাপারটা বলুন তো? কোনো ছেলেই তো বউয়ের অন্য কারো সাথে ফিজিক্যালি ইনভলবড হওয়ার ব্যাপারটা জানার পরও চুপ থাকার কথা না। অথচ আপনাদের তে রোমান্স রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। হোয়াটস দা সিক্রেট ম্যাডাম?

রিশাদের কথাগুলো এতোটাই অশ্রাব্য অশ্লীল রূপ নিচ্ছিল যে অনামিকার আর শুনতে পারলো না। চোখ বুজে রিশাদের দিকে ফুলদানিটা দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করতেই রিশাদ ক্ষিপ্র হাতে অনামিকার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে হাতটা টেনে অনামিকাকে নিজের দিকে টেনে নিল। অনামিকা ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে দেখে এবারে রিশাদ অনামিকার হাতটা মচকে পিঠের সাথে শক্ত করে চেপে ধরতেই অনামিকা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো। না চাইতেও চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা কান্নার জল টপটপ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো মেয়েটার। তবু নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলো মেয়েটা। ততক্ষণে একদম অনামিকার গায়ের সাথে সেঁধিয়ে এসেছে রিশাদ। অনামিকার একদম গা ঘেষে এসে গভীর ভাবে অনামিকার ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে গভীর নিঃশ্বাসের সাথে ঘ্রাণ টেনে নিলো নেশাগ্রস্থের মতো।

-বরাবারই অরণ্যের লাক নিয়ে আমি জেলাস ছিলাম। একসাথে এক কোচিংয়ে পড়তাম, ওর চেয়ে আমি ভালো স্টুডেন্ট। অথচ ও ক্লাসে ফাইভে, এইটে প্রত্যেকটা ক্লাসে ট্যালেন্টফুলে বৃত্তি পেত, আর আমি? সাধারণ কোটায়! কেন? এসএসসি, এইচএসসি? ও স্ট্যান্ড করলো, ওর ছবি পত্রিকাতে পর্যন্ত এলো! আমি ওর ধারে কাছেও আসতে পারলাম না। কেন? কি দোষ ছিল আমার? আর ওকে নিয়ে জীবনে কথা শুনতে হয় নি এমন একটা দিন আমার জীবনে নেই। মা বাবা হতে শুরু করে যত আত্মীয় স্বজন সবাই আমাকে ওর এক্সামপল দেয়। অরণ্য এই করেছে, অরণ্য সেই করেছে। এসব তবু সহ্য হচ্ছিল, বাট এ জব? ওই ছেলের লাক কেমন দেখো? অনার্স শেষ করতে না করতে জবও পেয়ে গেল! আর আমি শালার মাস্টার্স শেষ করে ঘরে বসে ডিমে তা দিয়েছি এতোদিন। আবার ওর বিয়ের দাওয়াতে যদি আসতাম কি হতো জানো? আরে দশ জন আত্মীয় এসে শুনিয়ে দিত, অরণ্য তো সেটেল্ড করেছে, বিয়ে করেছে, জব করছে, প্রোমোশন পেয়েছে। তুই বাল কি করলি জীবনে? হা হা হা।

-লিভ মিহ রিশাদ।

-ওওওওও সুইটহার্ট! আরো হার্টিং কি ছিল জানো? এটা শোনা যে অরণ্য যে মেয়েকে একবার দেখে ঘায়েল হয়েছে তাকেই বিয়েও করে ফেলেছে। কি হারামি ভাগ্য ছেলেটার দেখো? আরো মজার কি বলো তো? যখন এবারে এসে তোমাকে দেখলাম সেটা। উপরওয়ালা কি আমাকে দেখানোর জন্য সব অরণ্যের ঝুলিতে দিয়ে দেয় বলো তো? এই যে যেমন তুমি? আমি জাস্ট একটা রাতে জন্য তোমাকে চেয়েও পেলাম না, আর ও? ও প্রতিরাতে তোমাকে পায়! কতোরকম করে নতুন নতুন স্টাইলে আদর করে রাইট!? যে ভাগ্য লিখেছে তার আমার সাথে কি প্রবলেম বলো তো? আমি এসব না ইনসাফি মানবো না। জীবনে আর কিছু পাই না পাই, তোমাকে আমার চাই ই চাই। আজ এই মূহুর্তে চাই। শশশশশ। যত লাফালাফি করবে তত বেশি কষ্ট হবে। ওকে? 

-লিভ মি। রিশাদ ছাড়ো আমাকে?

-ওকে সুইট হার্ট। ছেড়ে তো আমি তোমাকে দিবোই। বাট আফটার ডান মাই জব। 

-অরণ্য---।

রিশাদ অনামিকার হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে এবারে অনামিকার ঘাড়ের কাছে দাঁত বসিয়ে দিতেই অনামিকা এবারে আতর্নাদ করে কেঁদে উঠলো। অবশ্য মেয়েটার আতর্নাদ গলা থেকে বের হওয়ার আগেই রিশাদ অনামিকার মুখটা অন্য হাত দিয়ে চেপে ধরেছে। অবশ্য রিশাদ অনামিকার চিৎকারে ভয় পেয়ে এমনটা করেছে তাও নয়। তার কানে একটা শব্দ এসে বেজেছে। তাই সতর্ক হয়ে খেয়াল করছে শব্দের উৎসটা খোঁজ করতে। তারপর নাহয় অনামিকার দিকে মন দেয়া যাবে। রিশাদের এমন সতর্ক নিস্তব্ধতার ফাঁকে শব্দটা অনুর কানে এসেও লাগলো। মনে হলো এটাই বুঝি ওর জীবনের শেষ আশার বাণী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন