"যে দৃশ্য দেখে তোমার কষ্ট হয়, সে দৃশ্য দেখার প্রয়োজন তোমার নেই। তোমার আশেপাশে উদাসীনতা মানায় না।"
সভ্য ইনারার হাত ধরে তাকে সিঁড়ি ঘরের দিকে নিয়ে যায়। ইনারা তখনো তাকিয়ে ছিলো জোহানের দিকেই। পিছনের দিকে হেঁটে যায় কিন্তু তার দৃষ্টি সরায় না।
সিঁড়িঘরে সাধারণত কেউ আসে না। সকলে লিফট দিয়েই উঠা-নামা করে। তাই এখানে কারও আসার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। সভ্য ইনারাকে এদিকে নিয়ে আসে কারণ সে ভালো করেই জানে রিহার্সাল রুমের ভেতরে ঢুকলে সকলে নানান ধরনের প্রশ্ন করবে।
ইনারাকে সিঁড়ি ঘরে এনে দরজা আটকে দেয় সভ্য। আর রাগান্বিত স্বরে বলে, "জানো দৃশ্যটা দেখে কষ্ট পাবে। তাও তোমার সেখানে দাঁড়িয়েই থাকা লাগবে?"
ইনারা তার দিকে তাকায় নম্র দৃষ্টিতে। চোখে অশ্রু জমে আছে তার। সে ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো করে তাকাল সভ্যের দিকে।
সভ্য খানিকটা বিচলিত হয়। মুহূর্তে তার সব রাগ হাওয়ার সাথে মিশে যায়। পকেটে হাত ভরে সে গলা পরিষ্কার করে বলে, "জোহানের সাথে দীপার সম্পর্ক আছে তা সম্পূর্ণ দেশ জানে। তুমি জানতে না?"
এবার কান্নাই করে দেয় সে, "আমি....আমি তো ভেবেছিলাম এমনিতেই গুজব।"
"আমি তোমাকে বলেছিলাম ওর থেকে দূরে থাকতে। দেখেছ, কষ্ট পেলে তো।"
"আপনি আমাকে বকছেন কেন?"
"আমি তোমাকে কোথায় বকা দিচ্ছি।"
"এই'যে ধমক দিয়ে কথা বলছেন?"
সভ্য বিরক্ত হয়। তবুও দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এক হাত ইনারার মাথায় রেখে, হাত বুলিয়ে বলে, "থাক কান্না করার প্রয়োজন নেই। তুমি আরও ভালো কাওকে পাবে।"
অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলো। ইনারা কান্না করতে করতেই জড়িয়ে ধরে সভ্যকে। সভ্য চমকে উঠে। ঠিক কি হলো সে বুঝে উঠতে পারেনি। ইনারা কাঁদোকাঁদো গলায় বলে, "আমার জোহানকেই লাগবে। উনি কেন এমন করল? আমার অপেক্ষা করল না কেন উনি?"
সভ্যের ইনারার বাচ্চামির উপর রাগ উঠা উচিত ছিলো। জোহান যে দিপার সাথে কেবল খ্যাতির জন্য আছে তা ভালো করেই সে জানে। এর আগেও জোহান এমন কিছু অভিনেত্রীদের সাথে সম্পর্কে গেছে। ব্যাপারটা অনুচিত, তাও সে জানে। কিন্তু ইনারাও এখন যা করছে তাও সম্পূর্ণ অবুঝের মতো কাজ। কারও ভক্ত হলেই যে সে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে তার হস্তক্ষেপ করার অধিকার পেয়ে যায় এমনটা নয়। এছাড়া এমন তো নয় যে জোহান তাকে আগের থেকে চিনে অথবা তাদের কোনো সম্পর্ক আছে। কাওকে মোবাইলে দেখে অথবা তার গান শুনে তাকে পছন্দ করা যায়। কিন্তু তার থেকে এত বড় কিছু আশা করাটা তো বোকামি। এমন বোকামি দেখে সভ্যের প্রায় রাগ উঠে। কিন্তু আজ ইনারাকে এ বিষয়ে কিছুই বলে না। সম্ভবত মেয়েটা তেমন ভাবে মা বাবাকে কাছে পায় নি এজন্য। এ কারণেই হয়তো মেয়েটা যাকে কাছের ভাবে তাকেই দূরে যেতে দেখে তাহলে কষ্ট পায়। হয়তোবা এ জন্যই!
হঠাৎ করে তার বুকেতে ইনারা ঝাঁপিয়ে পরাতেও সে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কেমন যেন অনুভূতি হয় তার। বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠে। এই অনুভূতিটাও তাকে দ্বিধায় ফালিয়ে দেয়। সে বলে, "আচ্ছা ঠিক আছে। এভাবে কান্না করার প্রয়োজন নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
সে সান্ত্বনার জন্য ইনারার পিঠে হাত রাখতে নিলেই সে উঠে যায়। যত দ্রুত উঠে ঠিক তত দ্রুত যেয়ে সিঁড়িতে বসে মুখ ফুলিয়ে বলে, "সাহস কি করে হলো উনার এমনটা করার? আমার...আমার অনেক রাগ উঠছে। ইচ্ছা করছে উনাকে আর ওই দিপাকে একসাথে নৌকাতে বেঁধে ডুবায় দেই। না একসাথে দিব না। আবার সে নষ্টামি করবে। তার সাহস কত বড় আমি থাকতে অন্যমেয়ের সাথে...। আর আমার কথা বাদ দিলাম। করিডরে এসব কে করে? খবিশগুলা। আর আপনিও একটা জিনিস। আমি কান্না করছি দেখছেন। কোথায় দৌড়ে যেয়ে চকোলেট আইস্ক্রিম নিয়ে আসবেন। তা না। আপনি তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কান্না দেখছেন। জ্ঞান বুদ্ধি আছে আপনার?"
সভ্য প্রথম চোখ দুটো গোল গোল করে তাকায় তার দিকে। মেয়েটা এক মুহূর্ত আগেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আর এখন তার এমন পরিবর্তন? সে হাসবে না মেজাজ খারাপ করবে নিজেও দ্বিধায় পড়ে যায়। সে ইনারার পাশে যেয়ে বসে হতাশ হয়ে বলল, "তুমি একটা জিনিসও বুঝছো? তুমি মাত্র না কান্না করছিলে? তাহলে এত জলদি তোমার মুড কীভাবে পরিবর্তন হয়ে গেল?"
"আমার প্রথমে কষ্ট লাগছিল। পরে চিন্তা করলাম আমি কষ্ট পেলে তাদের কী আসবে যাবে? তাই এখন আমার রাগ উঠছে। একবারে উচিত শিক্ষা দিব।"
চরম বিরক্ত হয় সভ্য, "তুমি যাস্ট ইম্পসিবল। নিজের এতটা সময় তোমার পিছনে ব্যয় করেছি। তোমার জন্য না'কি আমার খারাপ লাগছিল!"
সভ্য উঠে যেতে নিলেই ইনারা তার হাত ধরে নেয়। আবদারের সুরে বলে, "আমার ভালো লাগছে না। একটু এসে পাশে বসুন না।"
এতটুকু কথায় সভ্যের মন গলার কথা না। কিন্তু ইনারার এমন কাঁপা-কাঁপা কন্ঠ শুনে তার মন নরম হয়ে যায়। কিন্তু সে ইনারার পাশে যে বসে না। তার হাত ছাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। আর বলে, "আমার পিছনে আসো।"
ইনারাও কথা মেনে যায়। পিছু যায় সভ্যের।
ছাদে যায় দু'জন। বিশাল এক উদ্যান। চারপাশে খোলা জায়গা। আশেপাশে তেমন কোনো বিল্ডিং নেই। উঠে সভ্য স্বাভাবিকভাবে এগুলোও ইনারার অবস্থা খারাপ। সে গভীর নিশ্বাস ফেলতে থাকে, "ভাই লিফট থাকা সত্ত্বেও আপনি আমাকে এত কষ্ট করে পাঁচতলা উঠাইছেন। আসলে কি দয়া মায়া আছে আপনার?"
সভ্য রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে বলে, "লিফটে উঠতে কেউ দেখে নিলে সমস্যা হতো। বিশেষ করে গ্রুপের বা স্টাফদের মধ্যে। এছাড়া তোমার প্রিয় জোহানও তো সেখানে দাঁড়িয়ে দিপার সাথে..."
"হয়েছে।" ইনারা সভ্যের কথা থামিয়ে বলে, "হয়েছে বুঝতে পেরেছি।"
ইনারা সভ্যের পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। দু'হাত রেলিং এ রেখে তাকায় সামনের দিকে। আকাশ লালচে হয়ে গেছে। সূর্য ডোবার আগের দৃশ্য। কী সুন্দর! চারপাশে বাতাসের ছড়াছড়ি। কেন যেন আজ এই বাতাসের মাঝেও বিষাদ ছড়ানো। সে কখনো জোহানের জন্য এত কষ্ট পাবে ভাবে নি। প্রায় দুই বছর ধরে সে জোহানের পরিকল্পনা বুকে নিয়ে বেঁচে আসছে। তার সাথে হাজারো স্বপ্ন সাজাচ্ছে। আচ্ছা জোহান কী জানে না তাদের বিয়ের কথা? জানলে কীভাবে করতে পারে এমনটা? আচ্ছা তার কীসে বেশি কষ্ট লাগছে? জোহানের এমনটা করায় না'কি তার মা'য়ের স্বপ্ন পূরণ না করায়?
অনেকসময় ধরে নীরবতা ছড়িয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ করে সভ্য জিজ্ঞেস করল, "তুমি কী সত্যি খুব কষ্ট পেয়েছ?"
"খানিক সময়ের জন্য পেয়েছিলাম।"
"এখন আর কষ্ট লাগছে না?"
"না।"
"আমি বুঝতে পারছি না তোমার কষ্ট পাওয়ার কারণটা কি? এমনও না যে জোহানকে তুমি আসল জীবনেই চিনতে।"
"আপনি বুঝবেন না। ছোট বেলা থেকেই আমি কারো সাথে স্বপ্ন সাজালে, তা ভেঙ্গে যায়। ছোটবেলায় ভেবেছিলাম বড় হয়ে মা-বাবার সাথে সুন্দর একটা পরিবার হবে, হলো না। তারপর ভেবেছিলাম একদিন আমার মা'য়ের মতো .... " কথার তালে তালে ভুল কথা বলতে যেয়ে সতর্ক হয়ে যায় ইনারা। তার কথাটা সঠিক করে বলে, "আমার মা'য়ের ইচ্ছা ছিলো আমি অভিনেত্রী হবো। তাও মানা করে দিলো। কিন্তু আমার আপুকে ঠিকই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এখন আবার জোহান। আপনার জীবনে হয়তো সবাই আছে। তাই আপনি কখনো আমার পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারবেন না।"
"আমিও কিন্তু ছোট বেলা থেকেই আমার পরিবার থেকে দূরে থেকেছি।" ইনারা হতভম্ব হয়ে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্য না'কি কখনো নিজের মনের কথা কাওকে বলে না। কখনো তো তার বন্ধুদেরও বলে নি। তাহলে আজ কীভাবে?
সভ্য আবারও বলে, "এমন না যে আমার কেউ নেই। সবাই আছে। কিন্তু তবুও তাদের থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। সবসময়ই। প্রথমে সুরক্ষার উদ্দেশ্যে। তারপর পড়াশোনার জন্য। এরপর আমার ক্যারিয়ারের জন্য। তাই তোমার কষ্ট সম্পূর্ণ না হলেও একটু হলেও বুঝতে পারব।"
ইনারার এমন বিস্মিত মুখ দেখে ফিক করে হেসে দেয় সভ্য, "এভাবে মুখ করার প্রয়োজন নেই। আমি জানি তুমি আমার পরিবারের সম্পর্কে জানার জন্য কত কাহিনী করেছ। সুযোগ পাও নি। আজ আমি নিজেই জানালাম। এটা জানার চেষ্টা করো না যে তারা কে! তা তোমার জানার প্রয়োজন নেই। আর প্রয়োজন হলে সময় আসলে নিজেই জানতে পারবে। আচ্ছা তোমার মা'য়ের খুব কাছের ছিলে না তুমি?"
মা'য়ের কথা শুনতেই ইনারার সব বেদনা যেন হাওয়ায় মিশে গেল।
"অনেক। আজও তার জন্মদিনে আমি তার পছন্দের জায়গায় যাই। শ্রীমঙ্গলে।"
"আর কী পছন্দ ছিলো তোমার মা'য়ের?"
"সব। রান্না, নাচ, গান শোনা। মা আমাকেও প্রতি উইকেন্ডে নাচ শেখাত।"
"তুমি নাচ পারো?"
"আবার জিগায়। সেই লেভেলের নাচ পারি।"
"দেখে তো মনে হয় না।"
"এত বড় কথা! আপনি গান ছাড়েন আমি নেচে দেখাচ্ছি।"
"প্রয়োজন নেই।"
"আছে। আপনি কীভাবে আমার নাচে প্রশ্ন তুলতে পারেন? আমি নেচে দেখাবোই।"
ইনারা ভেংচি কেটে সভ্যের পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিজেই গান ছাড়ে। টপ'স, জিন্স এবং স্কার্ফ পরা ছিলো সে। এ গানের পঙক্তির সাথে এ পোশাকে নাচ একদমই মিলে না তার। তবুও সে গান ছেড়ে ছাদের ঠিক মাঝখানে এসে নাচতে শুরু করে।
যাও বলো তারে, মেঘের ওপারে,
বৃষ্টি বন্দনা, জুড়ে ধরণীতল ।
যাও বলো তারে, শ্রাবণ আষাঢ়ে,
মেঘের শতদলে ছুঁয়েছি ভেজা জল ।
মাতাল হাওয়ার ধ্বনি, বৃষ্টি কি শোনে না,
ময়ূর পেখম তোলে, ধিমতানা দেরে না ।
ধিমতানা, বাজে ধিমতানা, বাজে ধিমতানা, দে রে না
ধিমতানা, বাজে ধিমতানা, বাজে ধিমতানা, দে রে না
সভ্য ভাবলো ইনারার কথাটা এমনিতেই। সে কেবল সভ্যকে ভুল প্রমাণ করার জন্য নাচ প্রদর্শন করছে। সূর্যোস্তের সময় হয়েছে। তাই সে পিছনে ফিরে তাকাল সূর্যোস্ত দৃশ্য উপভোগ করার জন্য। সে ইনারাকেও ডাকতে নিলো যেন সে এসব পাগলামো বাদ দিয়ে এই সুন্দর দৃশ্যটা উপভোগ করতে আসে। কিন্তু পিছনে ফিরেই সে স্থির হয়ে যায়। দৃষ্টি ফেরানো যেন দায়। নামিয়ে নেবার পর সে কিছু মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায়। গানের তালে তালে তার নাচের চেয়ে বেশি মনোমুগ্ধকর মুখের খুশিটা। গানের তালে ইনারার এই নাচের প্রদর্শন মুগ্ধ করল তাকে। তার স্বর্ণোজ্জ্বল কেশ পিঠ ছড়িয়ে গেল। অপরূপ দেখাচ্ছিলো তাকে। সভ্য বেহায়ার মতো তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এই প্রথম সে একটা মেয়ের উপর এতটা আকর্ষণ বোধ করছে। তাও এতবার। কী আছে এই মেয়ের মাঝে?
সে পা বাড়াল। আকস্মিকভাবে সে নাচের মাঝেই ইনারার হাত ধরে নেই। তাকে থামায়। তার বাহু ধরে কাছে টেনে নেয় তাকে।
ইনারা চমকে উঠে সভ্যের এমন কান্ডে। সে বুঝে উঠতে পারে না কি হচ্ছে। সূর্যোস্তের লালচে আলো পড়ছিলো সভ্যের উপর। অন্যরকম দেখাচ্ছিলো তাকে। সূর্যের লাল রঙে আরও আকর্ষণীয় লাগছিল তাকে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় তার চোখদুটো। কেমন মুগ্ধতায় ভরা! কেমন মোহময়!
.
.
.
চলবে.................................