৩৯!!
দেখতে দেখতেই দু বছরের বেশি সময় কেটে গেছে। ভোরের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ভোর এডমিশন টেস্টের জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে। রোদও আমস্টারডাম যাবে না বলে নতুন করে বাবার সাথে নিজেদের ফ্যামিলি বিজনেসেই জয়েন করেছে। দুটো পরিবারই এখন একসাথে থাকে। আগের মতো কেউ বাধা হয়ে নেই ভোর রোদের ভালোবাসার গল্পটায়। তবু আজকাল কেন জানি কোথাও যেন কিছু একটা নেই মনে হয় ভোরের। একই বাড়িতে থেকেও আজকাল রোদের সাথে প্রায় দেখা হয়না বললেই চলে। রোদ সেই সকালে বেরিয়ে যায়। ফিরে বেশ রাত করেই। ততোক্ষণ অপেক্ষা করে করে ভোর বেশিরভাগ সময়ই ঘুমিয়ে পড়ে। এইতো কয়দিন আগে ভোরের পরীক্ষার সময়ও কিন্তু এমনটা হয়নি। রোদ তখনো অফিসের কাজ সামলেও ভোরকে হলে দিয়ে এসেছে, আবার নিজে গিয়ে বাসায়ও পৌঁছে দিয়ে গেছে। সে রোদ যতই ব্যস্ত থাক না কেন, এই কাজে একটুও নড়চড় হয়নি। তাহলে আজ কেন? রোদের এই ব্যস্ততার পিছনের কারণটা ভোর বুঝতে পারছে না। আর বুঝতে পারছে না বলেই কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে ভোরের। কেমন দম বন্ধ করা অবস্থায় পড়েছে মনে হচ্ছে ভোরের।
আজও পড়া শেষ করে রোদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে চোখ লেগে এসেছিল ভোরের। হঠাৎ ঘুমটা ভাঙ্গতেই পড়িমরি করে উঠে বসলো ভোর। বেশ অনেক রাতই হয়েছে বুঝতে পেরে চুপিচুপি পা ফেলে এসে রোদের রুমে উঁকি দিলো ভোর। রোদ রুমেই আছে বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে রোদের মাথার কাছে ফ্লোরে বসে পড়লো ভোর। রোদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। হালকা আলোয় রোদের ঘুমন্ত মুখটাকে দেখে কেমন শান্তি শান্তি লাগছে ভোরের। কতদিন পর লোকটাকে এতোটা কাছ থেকে দেখছে ভোর! কিছুদিন আগেও যে মানুষটা হুটহাট ওকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিতো, সেই মানুষটারই হঠাৎ বদলে যাওয়াটা মেনে নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে ভোরের। চোখের সামনে প্রিয় মানুষটাকে এভাবে দূরে সরে যেতে দেখলে কার না কষ্ট হয়? ভোরেরও প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছে করছে রোদকে ঠেলে ঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞেস করতে কেন আর আগের মতো ভালোবাসো না? কেন আগের মতো ছাদে শুয়ে জোছনা দেখার সময় নেই তোমার? খুব কি বদলে গেছ? নাকি এখন আর ভালোবাসো না? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ভোর বুকচেরা দীর্ঘশ্বাসটা কোনোমতে নিজের বুকেই চেপে রোদের মুখটা খুঁচিয়ে দেখায় মন দিলো। আচ্ছা রোদ কি আগের থেকে একটু বেশিই সুন্দর হয়ে গেছে? চুলগুলো কি একটু বড় হয়ে গেছে আগের চেয়ে? কেমন এলোমেলো হয়ে মুখের উপরে চলে আসছে ফ্যানের বাতাসে? নাকি গালের খোঁচাখোঁচা দাঁড়িতে কেমন নায়ক নায়ক একটা ভাব ফুটে উঠেছে ছেলেটার মুখে? নাকি ছেলেটার আবেশ মাখানো ঠোঁটজোড়া আরো রক্তিম হয়েছে আগের চেয়ে?
রোদের রক্তিম ঠোঁটজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছিল ভোরের। ঘোরের মাঝেই রোদের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিতেই একটু পরেই টের পেল রোদের হাতজোড়া ভোরের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে রোদও ভোরের ঠোঁটে হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মিনিট খানেক পরেই রোদ যেন ঘোর কাটিয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসলো। ভোরও কিছুটা লজ্জা পেয়ে রোদের উপর থেকে সরে এসে অন্যদিকে ফিরে কিছু হয়নি এমন একটা ভাব করতে লাগলো। এভাবে রোদের কাছে হাতে নাতে ধরা পড়বে বেচারি ভুলেও কল্পনা করতে পারে নি হয়তো।
-এতো রাতে তুই আমার রুমে কি করছিস ভোর? কেউ দেখে ফেললে কি কেলেঙ্কারি কান্ড হবে ভাবতে পারছিস? এই সামান্য বুদ্ধিটুকু নেই তোর? এখনও কি আগের মতো ছেলেমানুষ রয়ে গেছিস? এবার অন্তত লাইফটা নিয়ে একটু সিরিয়াস হ ভোর।
রোদের এমন শক্ত শক্ত কথাগুলো শুনে ভোর রীতিমতো ঝটকা খেল। এর আগে রোদ কখনো এতো গম্ভীর স্বরে কখনো কথা বলে নি ভোরের সাথে। রাত বিরেতে রোদ নিজেই ভোরকে চমকে দিয়েছে এসে। কখনো সারারাত একসাথে ছাদে শুয়ে চাঁদ দেখতে দেখতে গল্প করেছে, আবার কখনো হুটহাট ভোরের কোলে মাথা রাখার বায়নায় ভোরের কোলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। তবে আজ ভোর আসায় কেন এমন কথা বলছে রোদ? রোদ বদলে গেছে বলে? নাকি সময়টাই বদলে গেছে?
-হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? রাতের কয়টা বাজে খেয়াল আছে কোনো? সকালে অফিসে যেতে হবে আমার। আর তোরও তো কোচিং আছে সকালে? যা ঘুমিয়ে পড়।
-তোমার কি হয়েছে রোদ? এমন করে কথা বলছ কেন?
-কেমন করে কথা বললাম? অদ্ভুত তো! রাত দুপুরে না ঘুমিয়ে কি পাগলামি করছিস বল তো ভোর? টায়ার্ড লাগছে আমার খুব। ঘুমাবো আমি। এখন যা। কিছু বলার থাকলে দিনের বেলায় বলিস। আর এতো রাতে আমার রুমে আসিস না আর কখনো। কেউ দেখলে কি ভাববে?
-দিনের বেলায় তুমি থাকো কোথায় যে তোমাকে কিছু বলবো? আর রাত হয়েছে তো কি হয়েছে? তোমার রুমে আসতে আমার দিন রাত দেখতে হবে নাকি?
-অবশ্যই দেখতে হবে। দিনে দিনে বড় হচ্ছিস নাকি আরো ছোট হচ্ছিস? এই সামান্য কথাটা কি আলাদা করে বুঝিয়ে বলতে হবে কেন আসবি না এতো রাতে? আশ্চর্য! আর কি বলার তাড়াতাড়ি বল। আমি সারাদিনই অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি। তোর ইম্পরট্যান্ট কথা শোনার জন্য তো আর সারাদিন ঘরে বসে থাকবো না।
-আমমম। এমন করছ কেন? আমি কি কিছু ভুল করেছি? সরি তাহলে। এভাবে রাগ করে থেকো না রোদ।
-মাঝরাতে কারো ঘুম ভাঙিয়ে যদি জিজ্ঞেস করিস যে সে এমন করছে কেন তাহলে সেই লোকটা কি উত্তর দিবে বল তো ভোর? সারাদিন কাজ করে টায়ার্ড। সকাল হলেই সেই একঘেয়ে জীবন শুরু হবে। তাই দয়া করে একটু ঘুমাতে দে এখন আমাকে প্লিজ।
-তুমি আমার সাথে রেগে আছো না? কি করেছি আমি বলো না?
-উফ! তুই যাবি এখন ভোর? তোর উপরে রাগ করে থাকবো কেন আমি? আজব কথাবার্তা! আর কিছু বলার না থাকলে যা তো এখন। ভালো লাগছে না কথা বলতে।
-আচ্ছা ঘুমাও তুমি। আর একটা কথা বলি? কালকে আমাকে কোচিং এ ড্রপ করে দিবা প্লিজ? আসলে কোচিংয়ের সামনে------।
-আমার হাতে এতো সময় নেই ভোর। তোর বড়আব্বুকে বলিস। উনি ড্রপ করে দিবে তোকে। আর নইলে আমি ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিবো অফিসে গিয়ে। তোর ক্লাস তো নয়টায় না? ওকে আমি দেখি কি করা যায়।
-লাগবে না কাউকে। আমি একাই যেতে পারবো।
-তাহলে তো ভালোই। ড্রাইভারকেও আর কষ্ট করে আসা লাগলো না। এখন যা ঘুমা। আর দরজাটা ভিতর থেকে লক করে দিয়ে যা। উঠতে ইচ্ছে করছে না আর। গুড নাইট।
ভোর কোনোমতে কান্না চেপে রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই রোদের মোবাইলের রিংটোনের শব্দ শুনতে পেয়ে ভোর দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে গেল। এতো রাতে কে কল করেছে সেটা ভেবেই ভোর কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো ভিতর থেকে রোদ কি কথা বলছে। কেননা কলটা বেজে উঠতেই একটু পরে রোদের কন্ঠটা শুনতে পাচ্ছে। কি কথা হচ্ছে সেটা শোনার জন্য দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করলো ভোর।
-হ্যাঁ বৃষ্টি বলো?-------কাল সকালে দেখা করতে চাইছ? উমমম। ওকে আই উইল ম্যানেজ। তুমি রেডি থেকো। আমি তোমার বাসা থেকেই পিক করে নিবো তোমাকে। উমমমম। নেক্সট প্ল্যানিং কাল দুজনে একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে করতে করে নেয়া যাবে। আজকের জন্য সরি ম্যাম। অনেক টায়ার্ড ছিলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাই নি।----- আরে না না। ডিস্টার্ব ফিল করবো কেন? আরে না না। তোমার সাথে কথা বলা তো হয়ে গেল। এখনই আবার ঘুমিয়ে পড়বো। ----ওকে গুড নাইট। এন্ড সো সরি তোমাকে এতোক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো।---ওকে---কাল পুষিয়ে দিবো----। জাস্ট কিডিং। গুড নাইট ম্যাডাম। সি ইউ টুমোরো।
রোদের কথাগুলো শেষ হয়ে গেলেও ভোর থমকে সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। নিজের কানকেই কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না ভোরের। কোনমতে ঘোরের মাঝেই নিজের রুমে ফিরে গেছে ভোর। পরদিন সকালে ভোর ঘুম ভাঙ্গতেই দেখলো রোদ চলে গেছে। ভোর হালকা নাস্তা করে নিয়ে রেডি হয়ে কোচিংয়ে চলে গেল। ক্লাসেও মন বসলো না ভোরের। ক্লাস শেষ হতেই কোচিং ফ্রেন্ড রিদির সাথে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আসছিল ভোর। মেয়েটা দুনিয়ার বকবক করছে পাশ থেকে। প্রতিদিন রিদির বকবকানিতে যোগ দিলেও আজ কথা বলতেই একদম ইচ্ছে করছে না ভোরের। কেন জানি মনে হচ্ছে ওদের পিছন পিছন কেউ আসছে। তার উপরে রোদের এমন হুট করে বদলে যাওয়ার চিন্তা। ভোরের এতো ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কোথা থেকে একটা গাড়ি এসে ভোরের একদম সামনে থামলো। গাড়িটা দেখে ভোর খুশি হবে নাকি কাল রাতের বকাগুলোর জন্য অভিমান করে পাশ কেটে চলে যাবে সেটাই ঠিক করতে পারলো না। বেচারি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই গাড়ির জানলা দিয়ে রোদের মুখটা দেখতে পেল। ততক্ষণে রিদিও ব্যাপারটা খেয়াল করে বকবকানি থামিয়ে কি ঘটছে দেখায় মন দিলো। রোদ এবারে মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে একনজর ভোর আর রিদির দিকে তাকালো।
-ভোর গাড়িতে উঠে আয়? তোকে বাসায় ড্রপ করে দিবো আয়।
-তুমি এখানে? তোমার না অফিসে অনেক কাজ আছে?
-উফ! ভোর? তুই বড্ড বেশি কথা বলিস। দেরি হচ্ছে তো। তাড়াতাড়ি আয়। আর মিস রিদি। আশা করি আপনি একাই বাসায় ফিরতে পারবেন। নাকি লিফট দিবো? আসলে আমরা তো উল্টো দিকে যাচ্ছি-----।
রিদি তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ালো।
-আরে না না ভাইয়া। আপনারা চলে যান। আমি একাই যেতে পারবো।
-ওকে। বায়। ভোর? উঠে আয় না বাবা? তোকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো আজকে। আরে! হা করে দাঁড়িয়ে আছিস এখনো? আয় তো?
রোদ কার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে কথাটা ভাবতে ভাবতে গাড়িতে উঠে রীতিমতো শকড খেল ভোর। পিছনের সেটা একদম পরীর মতো একটা মেয়ে বসে আছে। ভোর চোখ বড় বড় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে সত্যি মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে নাকি ভোর কল্পনা করছে পুরো ব্যাপারটা। সাম কাইন্ড অফ হ্যালুসিনেশন ওর সামথিং?
-ভাবি পছন্দ হয়েছে ভোর? একদম পুতুলের মতো না দেখতে? বৃষ্টি, মিট ভোর, আমার কাজিন। কিউট না দেখতে বাচ্চাটা? এই পিচ্চিটা নাকি ভার্সিটিতে এডমিট হবে। ক্যান ইউ বিলিভ ইট?
রোদের নিজেই এটা সেটা বকবক করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছে। আর বৃষ্টি নামের পরীর মতো দেখতে মেয়েটা মিষ্টি করে হাসছে। আর ভোর স্তব্ধ হয়ে রোদের পাশেই বসে আছে। রোদের কোনো কথাই আর এখন ভোরের কানে পৌঁছাচ্ছে না। রোদ একটা রেস্টুরেন্টের সামনে মেয়েটাকে নামিয়ে দিয়ে বিদায় জানিয়ে ভোরকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো। ভোর প্রায় ঘোরের মাঝে ধীরপায়ে ড্রইংরুমে আসতে আসতেই রোদ সবাইকে ডেকে জড়ো করে ফেলেছে সেখানে। ভোরের মা, বাবা, বড়মা, বড়আব্বু সবাই রোদের কথা আগ্রহ নিয়ে শোনার চেষ্টা করলেন। রোদও সবার মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে হাসলো।
-সবাই তোড়জোড় শুরু করে দাও। ছেলের বিয়ে বলে কথা।
রোদের কথায় সবাই হা হয়ে গেল। আতিক আহমেদ কিছুটা রেগে গিয়ে রোদের দিকে তাকালো এবারে।
-তুমি কি পাগল হয়েছ রোদ? কয়টা মাস পরেই তো ভোরের এডমিশন টেস্ট। এখন বিয়ের মানে কি? আর-----।
-বাবা? ভোরের সাথে তো বিয়েটা হচ্ছে না। পাত্রীকে দেখলে তোমাদের এতো পছন্দ হবে বলার মতো না। ভোরকে জিজ্ঞেস করো। ওর পছন্দ হয়েছে কিনা। কি রে ভোর? কিছু তো বল? বৃষ্টিকে কেমন দেখলি? মানাবে না তোর ভাইয়ার সাথে?
-রোদ? কিসব বলছিস?
-ওফ বাবা! এতো ভেবো না তো। মেয়েটা একদম পরীর মতো দেখতে। বৃষ্টির বাবাকে বলে দিয়েছি আমরা কাল যাচ্ছি পাকা কথা বলতে। প্লিজ ডোন্ট বি লেইট। ওকে। আমি অফিসে গেলাম।
রোদ কথাটা বলে আর কারো রিএকশন দেখার অপেক্ষা না করেই আবার বেরিয়ে গেল। অপেক্ষা করলে হয়তো সবার হা হয়ে থাকা মুখগুলো দেখতে পেত। আর ভোর? ভোর কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করলো। জীবন ওকে নিয়ে কি খেলা খেলছে কিছুই বুঝতে পারছে না ভোর। শুধু মনে হচ্ছে যা হচ্ছে একদমই ঠিক হচ্ছে না। একদম না।
৪০!!
গত সাতটা দিন ভোরের কি করে কেটেছে ভোর নিজেও জানে না। সেদিন রোদ ওভাবে সবাইকে বিয়ের কথা বলায় সবাই রিএ্যাক্ট করলেও পরদিন থেকে সবাই কেমন নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রথম কয়টা দিন ভোর বুঝতে না পারলেও এখন ঠিকই বুঝতে পারছে বেশ জোরেশোরেই বিয়ের আয়োজনটা হচ্ছে। এই যে গতকাল রাতে হলুদের অনুষ্ঠান হলো। কতো আয়োজন করে গান বাজনা বাজিয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মেতে ছিল সবাই। সবার হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে রাত যে গভীর হয়ে গেছে সেদিকে কারো খেয়ালই ছিল না। রোদ কোথা থেকে হলুদে ভূত হয়ে এসে ভোরকে একটু হলুদ ছুঁইয়ে দিতেই ভোর সেখান থেকে ছুটে চলে এসেছে নিজের রুমে। রোদের গায়ে লাগা হলুদের রঙটা তো শুধু ভোরের নামেরই হওয়ার কথা ছিল? তাহলে হুট করে সব বদলে গেল কি করে? সবাই কেন রোদের এমন হঠাৎ বদলে যাওয়াটাকে এতো সহজে মেনে নিলো? রোদের সুখের কথা ভেবে? সবাই যদি রোদের সুখের কথা ভেবে সবটা নিরব দর্শকের মতো মেনে নিতে পারে, তাহলে ভোর কেন পারছে না? কেন কেন কেন? কেন নিজের ভালোবাসার মানুষটার সবচেয়ে সুখের দিনে ভোর খুশি হতে পারছে না? রোদ আজীবনের জন্য অন্য কারো হয়ে যাবে বলে? নাকি আজকের পর হুট করে সেই মানুষটা অধিকার খাটাতে আসবে না বলে? নাকি সবটুকু অধিকার অন্য কেউ নিয়ে নিবে বলে?
ভোর কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দরজায় একটা আওয়াজ হতেই ভোর দু হাঁটু ভাঁজ করে মুখ লুকিয়ে নিলো যাতে ওর কান্নাটা কারো চোখে না পড়ে। কারো ধীর পায়ে এগিয়ে আসার শব্দে ভোর নিজের গলাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।
-মা, কত বার বলবো আমি খাবো না? বিয়ে বাড়িতে তোমরা সবাই আমাকে নিয়েই পড়লে কেন বলো তো? খাবো না। নিয়ে যাও----।
পাশ থেকে তবু মানুষটা চলে গেল না বলে ভোরের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। রাগের চোটে মুখটা তুলে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল ভোর। সামনে খাবার ভর্তি প্লেট হাতে বসে আছে রোদ। রোদ একবার মুখ তুলে ভোরের দিকে তাকিয়ে আবার ভাত মাখানো শুরু করছে দেখে ভোর থতমত খেয়ে রোদের দিকে কয়েক মিনিট তাকিয়ে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেলো।
-কি করছ কি তুমি এখানে? তোমার না আজ বিয়ে? গিয়ে রেডি হয়ে বরযাত্রী নিয়ে বউ আনতে যাও না? এখানে বসে আমার পিছনে সময় নষ্ট করার তো কিছু নেই। তাছাড়া আমি খাবোও না এখন। যাও তুমি এখান থেকে।
-আমি তোর কাছ থেকে পারমিশন নিতে আসি নি ভোর। চুপচাপ আমার পাশে এসে বস। আর হা কর। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। তোর এসব খাবো না শোনার সময় আমার নেই।
-তুমি তোমার কাজ করো না? কে ধরে রেখেছে তোমাকে?
-বেশি বকবক না করে এখানে এসে বসতে বললাম না তোকে? বস এখানে?
-না।
-আমাকে রাগাস না ভোর। এমনিতেই তোর উপরে প্রচন্ড রেগে আছি আমি।
-ভালো তো। আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে না তোমাকে। তুমি তোমার নতুন বউকে নিয়েই ভাবো।
রোদ প্লেট পাশে রেখে ভোরের হাত টেনে পাশে বসিয়ে দিয়ে ভোরের মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলো। ভোর মুখ ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই রোদ চোখ লাল করে তাকালো ভোরের দিকে।
-এক কথা বারবার বলতে ভালো লাগে না আমার ভোর। আর একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে বা না খেয়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করলেই চড় খাবি ভোর।
-আমি-----।
-ভোর?
রোদের ধমক শুনে ভোর এবারে কেঁপে উঠে আর কিছু না বলেই চুপচাপ খেয়ে নিলো। খাওয়ানো শেষ হলে রোদ হাত ধুয়ে ভোরের মুখ মুছিয়ে দিলো। প্লেটটা নিয়ে উঠে কিছুটা গিয়ে আবার ফিরে এলো রোদ। ভোরের সামনে দাঁড়িয়ে একমনে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করলো। রোদের চোখে চোখ পড়তেই ভোর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য দিকে তাকালো।
-তোর কাহিনী কি রে ভোর? এমন করছিস কেন? আমি কি এতোই খারাপ দেখতে যে আমার দিকে তাকালে তোর চোখ পচে যাবে? অদ্ভুত!
-অন্যের জিনিসের দিকে নজর দিতে নেই। একটু পরেই তো তুমি--সরি আপনি অন্য কারো সম্পত্তি হয়ে যাবেন। তাই চেষ্টা করছি যেন অন্যের সম্পত্তির দিকে তাকানোর বদ অভ্যাসটা না হয়।
-আমি অন্যের সম্পত্তি হয়ে যাচ্ছি? কে বললো তোকে?
-কে বলেছে জানেন না? নাকি মজা করছেন আপনি আমার সাথে? একটু পরে বউ আনতে যাবেন, আর এখন আপনি আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে এসেছেন? এতো দুমুখো কি করে হতে পারে একটা মানুষ বলবেন প্লিজ আমাকে?
-বউ আনতে যাচ্ছি বলে তোর কাছে আসতে পারবো না? এটা কোথায় লেখা আছে? আর আমার বউয়ের কাছে আসতে গেলে দুমুখোর কি হলো সেটাই তো আমি বুঝলাম না।
-বিয়েটা করে আসুন। আপনার বউই আপনাকে সব বুঝিয়ে দিবে।
-আচ্ছা। ওকে। একটা কথা বল তো ভোর? আমি তোর ভাই হলাম কবে থেকে?
-যাকে বিয়ে করছেন সে যদি আমার ভাবি হয়, তাহলে আপনি আমার ভাই হলেন না?
-ওওওওও। এই ব্যাপার তাহলে। আমার বউ তোর ভাবি হয় তাহলে?
-পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় কি বলেছেন সেটা মনে নেই আপনার?
-আমার তো সবই মনে আছে। ভাবছি বিয়েটা আজই করে ফেলি। তারপর তোকে দেখাচ্ছি আমার বউ তোর ভাবি হয় নাকি অন্যকিছু।
-বরযাত্রীরা রওনা হবে একটু পরেই। আর উনি এখন বিয়ে করে ফেলি শোনাতে এসেছে।
-ঠিকই বলেছিস। কিসব আবোলতাবোল বকছি আমিও আজকে। আর তাছাড়া তুই মানুষের কাছে আমাকে কাজিন বলে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলে, আমি পারবো না কেন? একশ বার পারবো। তাছাড়া আমি তোর কাজিন- এর বাইরে আর কোনো পরিচয় আছে কি আমার তোর লাইফে? নেই তো। তাহলে এতো রিএ্যাক্ট করছিস কেন? বাদ দে এখন এসব। তর্ক করার সময় আর নেই। পরীবউটাকে আনতে যাবো। কাবার্ডে শাড়ি রাখা আছে। রেডি হয়ে নে।
-আমি যাবো না।
-তোর মতামত জানতে চাই নি ভোর। রেডি হতে বলেছি।
-আমার শরীর ভালো লাগছে না। আমি যাবো না। অযথা জোর করে তোমার সময় নষ্ট করো না। আর আমি তো পালিয়েও যাচ্ছি না। বউকে নিয়ে এসো। আমি বাসায়ই থাকবো।
-উমমমম। ওকে। সুন্দর করে শাড়িটা পড়ে রেডি হয়ে থাকিস। নতুন বউকে দেখতে একটু সাজুগুজু করা লাগে বুঝলি। ওকে আসছি। একেবারে বউ নিয়েই ফিরবো।
সন্ধ্যেবেলা বিয়ের সব ফর্মালিটি শেষ করে সবাই বাড়ি ফিরে এসেছে। আত্মীয় স্বজনে বাড়িটা মেতে আছে। পাশাপাশি সোফায় রোদের পাশেই বৃষ্টি আর মেঘ বসা। মেঘ মুখটা কালো করে বসে আছে দেখে রোদ ভ্রু কুঁচকে মেঘের দিকে তাকালো।
-কি রে ভাই? তুই মুখ এমন কালো করে বসে আছিস কেন? মনে হচ্ছে তোর বউকে আমি বিয়ে করে নিয়ে গেছি? আজব?
-রোদ? আমি কেন টেনশন করছি বুঝতে পারছিস না? তোরা দুজনে কি করে পারলি ভোরকে এভাবে কষ্ট দিতে? বৃষ্টির কথা নাহয় বাদ দিলাম। ও ভোরকে ততটা জানে না যতটা তুই জানিস ওকে, চিনিস। কি করে পারলি রোদ? হাউ কুড ইউ ম্যান?
-আমি কি করে পারলাম? ও কি বলেছে জানিস? আমার বউ নাকি ওর ভাবি হয়। কথাটা বলার পরই গালে কষিয়ে দুটো চড় লাগাই নি সেটা কি করে পারলাম আমি তো সেটা ভেবেই কূল কিনারা পাচ্ছি না।।
-আরে!
-সরি বৃষ্টি। কিছু মনে করো না।
-রাখ তোর সরি। ভোর কোথায় সেটা বল। আমিই ওকে গিয়ে বুঝিয়ে বলছি সব।
-কোনো দরকার নেই। শরীর ভালো না বলে তো বাড়িতেই থেকে গেল। ব্যাপার না। ওর ব্যবস্থা করছি আমি।
-আর বাকি আয়োজনের কি হলো?
-ম্যাডাম এলেই সব শুরু করে দেয়া হবে। ভেবেছিলাম আরো কয়টা দিন সময় দিবো। বাট যা শুরু করেছে ও, আর একটা দিনও সময় দেয়া অসম্ভব।
-তুই নিজেই তো এতো বাড়াবাড়ি না করে ওকে সবটা বুঝিয়ে বলতে পারতি? নিজেই জেদ ধরে বসে থেকে শেষে এখন বাচ্চা মেয়েটার দোষ?
-শোন এতো বাচ্চা মেয়ে বলে মাথায় তুলিস না ওকে। সবই বুঝে সে, শুধু আমার বেলা এলেই-----।
-রোদ? সামলে---। কিসব বলছিস?
-বলছি কি আর সাধে? মনের দুঃখে বলছি রে ভাই। মনের দুঃখে বলছি। ও ছোটোমা? মেয়েকে নিয়ে এসো না? আর কতো রাত করবে? নতুন বউকে আর কতোক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখবে? আর শোনো? রেডি হয়ে থাকলে ভালো। নয়তো যেভাবে আছে সেভাবেই নিয়ে এসো। যত সাজানোর কাল সাজিও। আজ আর দেরি করো না ছোটোমা প্লিজ?
রোদ আর ভোরের মা দুজনেই হাসিমুখে ভোরকে আনতে চলে গেলেন। রোদের দেয়া টুকটুকে লাল শাড়িটা পড়েই বসেছিল ভোর। রোদের মা শুধু নিজের গয়নাগুলো পড়িয়ে দিয়ে ভোরের মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে ভোরকে নিয়ে সাজানো ড্রইংরুমে আসলেন। রুম থেকে ড্রইংরুমে আসার সময়টাতে ভোর যে হাজারো প্রশ্ন করে ফেললো ভোর বা রোদের মা কেউই সেসব প্রশ্নের উত্তরই দিলো না। শুধু যে উত্তর দিলো না তা নয়, উনারা যেন ভোরের কথাই শুনতে পাচ্ছেন না এমন একটা ভাব করে ভোরকে রোদের মুখোমুখি একটা সোফায় বসিয়ে দিয়ে আবার নিজেদের জায়গায় গিয়ে বসলেন। আর ভোর বেচারি মুখ তুলেই থতমত খেয়ে সেই মুরুব্বি কাজীসাহেবকে আর এতো মানুষ জনকে দেখতে লাগলো। এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতেও রোদের পাশে পুতুলের মতো সাজানে বৃষ্টিকে দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে ভোরের। কিন্তু ওর যে করারও কিছু নেই। পাশ থেকে কাজীসাহেব কিসব বলে যাচ্ছে সেসব কিছুই যেন ভোরের কানে পৌঁছাচ্ছে না।
-বলো মা 'কবুল'?
-কি?
পাশ থেকে কাজীসাহেব কবুল বলতে বলায় ভোর থতমত খেয়ে মুখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেলো সবাই একেকজন বত্রিশটা দাঁত দেখিয়ে হাসছে। কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পেরে ভোর রোদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেও সবার মতোই বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বসে আছে। ভোরের এবার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। রেগেমেগে উঠে যেতে গিয়েই আবার রোদের কথা শুনে বসে পড়লো।
-বিয়েটা না হওয়া পর্যন্ত একদম উঠবি না খবরদার। চুপচাপ বস। এবার বল কবুল?
-নিজে বিয়ে করেছ করেছ। আমাকে নিয়ে পড়লে কেন? আমি বিয়ে করবো না। কোনোদিন না। আর কার সাথে বিয়ে দিবে হ্যাঁ?
-আমি ছাড়া আর কার সাহস আছে তোকে বিয়ে করার? এখন কবুল বল তো বাবা? কাজীসাহেব পরে যদি ভাবে যে জোর করে বিয়ে করছি তাহলে তাসমিদের মতো আমাকেও জেলে দিবে। তখন হাজার কাঁদলেও কিন্তু লাভ হবে না। এখন বল তো ভোরপাখি, 'কবুল'?
-কিন্তু--- তুমি তো বৃষ্টি আপুকে-----।
-এই মেয়ে তুই কবুল বলবি? নাকি চড় লাগাবো তোকে ধরে?
-না না না। কবুল কবুল কবুল।
-কাজীসাহেব এবার আমাকে কি করতে বলুন। বিয়ের বাকি কাজটা শুরু করুন।
ভোরের কবুল বলার ভঙ্গিতে সবাই হেসে ওঠায় ভোর বেচারি লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বসে রইলো। একটু পরেই রোদের মুখে তিনবার 'কবুল' শুনেও সব কিছু কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে ভোরের কাছে। একটু পরেই যখন ম্যারেজ রেজিস্টারে সাইন করতে বলা হলো ভোরকে, ভোর তখনও কেমন একটা ঘোরের মাঝেই সাইনটা করে দিয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠানটা শেষ হতে বেশি সময় লাগলো না। ভোর কি হচ্ছে বোঝার জন্য মুখ তুলতেই দেখলো সবাই খুশি হয়ে একে অন্যকে মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছে, কোলাকুলি করছে। এমনকি আতিক আহমেদের মুখেও আজ হাসির ছোঁয়া লেগেছে। আর বেচারি ভোর মনে মনে ভাবার চেষ্টা করছে কিছু একটা গন্ডগোল করে ফেলেছে ও। এবারে সেই গন্ডগোলের শাস্তিটা কি হবে সেটা ভাবতে ভাবতেই বেচারির হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ভয়ের চোটে কোনোমতে ঢোক গিলে মুখ তুলে রোদের দিকে তাকাতেই দেখলো রোদ ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে মাত্রই। ছেলেটা রেগে আছে নাকি বিয়ে করে খুশি মুডে আছে সেটাই বুঝতে পারল না ভোর। রোদ এবারে মেঘের কাঁধে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সোফা ছেড়ে।
-চল মেঘ? বিয়ের কাজ শেষ। দুই বন্ধুতে একটু ঘুরে আসি। আমার একটা কাজও বাকি আছে। মা? তোমরা তোমাদের দুই বউকে নিয়ে যা যা ফর্মালিটি করার করে নাও। আমি আর মেঘ একটু আসছি।
পিছন থেকে কে কি বললো সেসব কথা একদম কানেই না তুলে মেঘের সাথে বাড়ির বাইরে কোথাও একটা চলে গেল ভোর। যাওয়ার সময় একবারও ভোরের দিকে তাকালোও না। আর ভোর এতোক্ষণে মনে মনে নিজেকে কয়েক শ গালি দিয়ে দিয়েছে। নিজের সাথে হয়তো রোদকেও দু চারটা বকাও দিয়ে দিয়েছে মনে মনে। কোথা থেকে কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না মেয়েটা। ড্রইংরুমে আরো অনেকক্ষণ ধরে ভোর আর বৃষ্টিকে বসিয়ে রেখে সবাই এটা ওটা নিয়ে হাসি তামাশা করলো। তারপর সবাই একে একে খাওয়া দাওয়া করার পর ভোর আর বৃষ্টির পালা এলো। খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ করে ভোরকে যখন রুমে আনা হলো তখন রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। ঠাট্টার সম্বন্ধের কয়েকজন বেশ অনেকক্ষণ পর্যন্ত ভোরের সাথে কথা বলে শেষে ভোরকে রেখেই চলে গেছে। ভোর এতোক্ষণে একটু স্বস্তি পেল। ঘোমটা খুলে মুখ তুলে রুমটা দেখলো। রোদের রুমটা সুন্দর করে ফুলে ফুলে সাজানো দেখে কেমন একটা লাগছে ভোরের। কতো কথা জানার আছে রোদের কাছ থেকে! অথচ এতো দেরি হয়ে গেল লোকটা আসছেই না। শেষমেশ ভোর বিরক্ত হয়ে উঠে এসে রোদের রুমটা ছুঁয়ে দেখতে দেখতে খেয়াল করলো কাবার্ডটা একটু ফাঁক করা। কাবার্ডটা পুরো খুলতেই একটা বক্স আর একটা চিঠির মতো কিছু পেল ভোর। ভোর বক্সটা নিয়ে এসে বিছানায় বসে কাগজটা খুলে পড়া শুরু করলো।
"ভোর,
সেদিন তোর ফ্রেন্ড যখন জানতে চাইলো আমি তোর কে হই তখন তুই কি পরিচয় দিয়েছিলি মনে আছে? ভাবছিস আমি তো সেখানে ছিলাম না। তাহলে তোদের মধ্যকার কথা আমি জানলাম কি করে? তুই আমার সাথে কলটা না কেটেই ওই মেয়েটার সাথে কথা বলছিলি। লুকিয়ে তোদের কথা শোনাটা হয়তো আমার অন্যায় হয়েছিল সেদিন। কিন্তু না শুনলে হয়তো কখনো জানতেও পারতাম না যে তোর জীবনে কাছের কেউ আমি আজো হয়ে উঠতে পারি নি।
বড্ড রাগ হয়েছিল সেদিন তোর উপরে জানিস? একবার ভেবেছিলাম সব ছেঁড়েছুড়ে কোথাও একটা চলে যাই। কিন্তু কোথায় আর যাবো বল? তোকে না দেখে এক দন্ডও শান্তিতেও বাঁচতে পারবো কি আমি? তোর সামনে পড়ে তোকে বিব্রত করতে চাই নি বলে অফিসে কাজের বাহানায় পড়ে থাকতাম সারাদিন। কিন্তু এই বেহায়া মনটাকে তো বোঝাতে পারতাম না। তাই দিনশেষে তোর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে একবার হলেও তোর রুমে ছুটে যেতাম। সেদিনও এসেছিলাম। সবে রুমে এসে শুয়েছি তার মধ্যেই তুই এলি রুমে। তুই প্রথমবার আমাকে নিজে থেকে চুমো খেলি। কি যে ভালো লাগছিল আমার জানিস? পরক্ষণেই আবার সেদিনের কথাটা মনে পড়ে গেল আমার। যদি ভালোই বাসিস ভোর তাহলে স্বীকার করতে দোষ কোথায় ছিল বল তো? রাগ করে অনেক বকে দিয়েছিলাম না রে পাখিটা? রাগ করে আছিস এখনো সেজন্য? সরি রে আমার ভোরপাখি। আর বকবো না কখনো, প্রমিস।
আর এই মেয়ে, তুই এতো বোকা কেন রে? তুই রুমের বাইরে আড়ি পেতে আমার কথা শুনবি সেটা বুঝি আমি টের পাবো না? এতো বোকা না তুই! বাইরে যে দরজায় কান লাগিয়ে দাঁড়িয়েছিলি, রুমে থেকেই কিন্তু তোর ছায়াটা আমি দেখছিলাম। এতো পাগলি কেন রে তুই?
আর বাকি রইলো বিয়ের কথা। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি কিন্তু এখনো তোর উপরে খুব রাগ করে আছি ভোর। তুই ভাবলি কি করে আমি আমার ভোরকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবো? তোর মেঘ ভাইয়া এতোদিন ধরে বৃষ্টির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল সেটা কাউকে জানতে পর্যন্ত দেয় নি জানিস? ওর কথাবার্তায় আমার কেমন একটা সন্দেহ হয়েছিল আগেই। কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়নি। নিজেদের সমস্যা থেকেই বের হতে পারছিলাম না। একদিন হুট করে ওকে চেপে ধরলাম। সে ও পরাজিত সৈনিকের মতো আমাকে বৃষ্টির কথা বললো। বললো কি করে ওদের প্রথম দেখা, দুজনের বন্ধুত্বটা কি করে ভালোবাসায় রূপ নেয়। আর কি করে বৃষ্টির বাবা মেঘকে পুলিশে দেয় আর বৃষ্টিকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয় স্টাডির জন্য। জানিস মেঘ কেন সেদিন বাবাকে আর আমাকে বারবার বোঝাচ্ছিল পুলিশি ঝামেলায় না জড়াতে? যেন তোর আর আমার মাঝেও ওদের মতো পরিস্থিতি তৈরি না হয় সেজন্য। বৃষ্টি কয়েকমাস হলো দেশে ফিরেছে। বৃষ্টির কোনো এক ফ্রেন্ডের কাছ থেকে খবর পেয়েছে মেঘ। কিন্তু যোগাযোগ করতে পারছিল না কোনোমতেই। তাই আমিই ওদের দুজনের মাঝে মেসেঞ্জারের কাজটা করেছি। বৃষ্টির বাবার আমার মতো ইয়াং বিজনেসম্যানকে নিয়ে সমস্যা ছিল না। উনার সমস্যা শুধু মা বাবা হারা মেঘকে নিজের মেয়ের জামাই করতে। সেদিন বৃষ্টিকে তোর সাথে দেখা করিয়ে রেস্টুরেন্টে ড্রপ করেছি তাও বুঝতে পারলি না বোকা মেয়ে? মেঘ অপেক্ষা করছিল ওর জন্য। আর তুই এতো বোকা করে রে ভোর? আমার তো তুই আছিস। তবু অন্য কাউকে বিয়ে করবো কেন? এক পিচ্চিকেই সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। তার উপরে আরেকজনকে নিয়ে আসবো? মাথা খারাপ নাকি আমার?
যাই হোক। তোর উপরে আমি খুব রাগ করেছি ভোর। তুই একা একাই রুমে বসে থাক। আমি আসছি না আজকে। বায়।"
পুরো কাগজটা পড়ে ভোর মনে হলো আকাশ থেকে পড়েছে। এতো রাতে রোদ কোথায় থাকতে পারে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না ভোর। এতো রাতে এখন একা একা বসে থাকা ছাড়া করার মতো কিছু খুঁজেও পাচ্ছে না। লোকটাকে সামনে পেলে মাথার সবগুলো চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতো ভোর সেটা নিশ্চিত। কিন্তু একা বাসরের মতো শাস্তি দিয়ে ভদ্রলোক কোথায় ডুব মেরেছেন কে জানে। সত্যিই কি রোদ আসবে না, কথাটা ভেবেই ভোরের বুকের ভিতরে ধ্বক করে উঠলো।