আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে গল্প সম্বন্ধে আপনার মতামত অবশ্যই প্রকাশ করবেন। আপনাদের মতামত আমাদের এই ছোট প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। শীঘ্রই আরও নিত্য নতুন গল্প আপডেট আসছে, সঙ্গে থাকুন। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখক/লেখিকা'র নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত গল্পের ডায়েরি’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখক/লেখিকা'র কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় গল্পের ডায়েরি কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

সংসার - পর্ব ২১ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৪১!! 

-এই অনু? কয়টা বাজে সে খেয়াল আছে ম্যাডাম? রাতে ঘুমানোর খবর নেই, আর এখন ঘুম ভাঙ্গার কোনো লক্ষণ নেই। এই মেয়েটাকে নিয়ে যে কি করবো আমি? অনুউউউউউউউউ?

অরণ্যের শীতল আঙুলের ছোঁয়ায় আরো বেশ কিছুক্ষণ আগেই অনামিকার ঘুম উড়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে করেই চুপ করে গুটিশুটি হয়ে অরণ্যের বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে ছিল এতোক্ষণ। অরণ্য কি করে সেটা দেখার বৃথা চেষ্টা। অরণ্যও তো আর কম যায় না। অনুর চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে সুযোগ পেয়ে অনামিকার কানের কাছে মুখ নিয়ে জোর গলায় অনুর নাম ধরে ডাকলো। কানে এতো জোরে চিৎকার করায় অনামিকা ধড়ফড় করা উঠে বসলো বিছানায়। নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ পিটপিট করে অরণ্যের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে বাচ্চাদের মতো। লোকটার এমন কান্ড দেখে অনামিকার প্রচন্ড হাসি পেলেও নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে একটু রাগী থমথমে মুখে অরণ্যের দিকে তাকালো অনামিকা।

-সকাল সকাল কানের সামনে এমন চিৎকার করছ কেন হ্যাঁ? আল্লাহ গো! আমার কান! মনে হয় দুদিন পরে আর কানেই শুনতে পারবো না এই লোকটার জন্য। এভাবে কেউ ঘুম থেকে ডেকে তোলে?

-ঘুমের মানুষকে তো অনেকভাবেই ডেকে তোলা যায় সোনাপাখি। কিন্তু যে জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে তাকে এভাবে না ডাকলে তো উঠবে না। আর দেখি তো? কই তোমার কানে কি হয়েছে? 

-আমি জেগে জেগে ঘুমাচ্ছি? জেগে জেগে ঘুমায় কিভাবে হ্যাঁ?

-তা নয়তো কি? আমার আদরে ঠিকই তো ঘুমটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। তবু আরো আদরের লোভে চুপটি করে শুয়ে ছিলে। আরে বাবা, আরো আদর চাই সেটা বললেই পারো। এভাবে চুপটি করে ঘুমের ভান করে নিজের আদর নিয়ে পালাবে, তা তো হবে না।

-আমার আর কাজ নেই, আমি ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকতাম। নিজের মনে যা ইচ্ছে গল্প সাজিয়ে নিলেই হয়ে গেল আর কি।

-এই যে মিসেস অরণ্য আমার সাথে চালাকি করে লাভ নেই বুঝলেন? আমার আদুরে স্পর্শে আপনার শরীর যে আলতো কেঁপে উঠে সেটা দেখেই বোঝা যায় তুমি জেগে ছিলে, নাকি ঘুম। আপনি শুনতে চাইলে আরো পুংক্ষাণুপুংক্ষ ব্যাখ্যা করে রাতে বলবো ওকে? এখন উঠুন ম্যাডাম। 

-আজকে তাড়াতাড়ি ওঠার কথা, আজই এতো দেরি হয়ে গেল। ধ্যাত! সরো তো। সব তোমার দোষ। 

-বাহ! যত দোষ নন্দঘোষ! আমি কি একবারও বলেছিলাম 'ঘুমিও না'? নিজেই তো দেরি করলে। এখন আমাকে দোষ দিচ্ছ। বাহ রে বাহ! 

-এক লোকটার সাথে কথা বলার মানেই হলো নিজের পায়ে কুড়োল মারা। আপনি ঘুমান জনাব। আমি ফ্রেশ হয়ে দেখছি বাকিরা কি করছে। 

-এই অনু শোনো? শাওয়ার নিয়ে নরমাল একটা থ্রিপিস পড়ে নাও। ব্রেকফাস্ট করে এসে তারপর রেডি হবে। বুঝলে?

-দেখি আগে সবাই কি করছে, পার্লারের মেয়েরাও চলে আসবে। ওদের ও তো নাস্তার ব্যবস্থা করতে হবে।

-যেটা বলছি আগে সেটা করো। শাওয়ার নিয়ে থ্রিপিস পড়ে নাও। ব্রেকফাস্ট করে এসো জলদী। কে কি খাবে, কে ব্যবস্থা করবে, সেসব আপাতত আমার উপরে ছেড়ে দিন ম্যাডাম।

-তাহলে তো হয়েই গেল। সবাইকে আজ তাহলে উপোশ করেই কাটাতে হবে।

-কি বললা অনু?

-কই? কিছু না তো! আমি গেলাম। বায়।

অনামিকা আর এক সেকেন্ডও সেখানে দাঁড়ানোর দুঃসাহস দেখালো না। ওয়ারড্রব থেকে জামা বের করে নিয়েই ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। অরণ্যও হেসে বেড সাইড টেবিল থেকে নিজের মোবাইলটা নিয়ে কাউকে একটা কল করে কিছুক্ষণ কথা বলে কলটা কেটে বিছানা ছাড়লো। কিছুক্ষণ পরে অনামিকাকে ভেজা চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসতে দেখে অরণ্যও উঠে এসে অনামিকার সামনে দাঁড়ালো। অনামিকার হাত থেকে টাওয়ালটা নিয়ে নিজেই অনুর চুলগুলো মুছে দিল। অনামিকার কৌতূহলী মুখটার দিকে চোখ পড়তেই মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে অনামিকার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল অরণ্য। অনামিকাও মিষ্টি করে হেসে অরণ্যের দিকে তাকালো।

-হাফ এন আওয়ার টাইম দিলাম আপনাকে ম্যাডাম। এর মধ্যে ব্রেকফাস্ট করবেন আর যত কাজকর্ম আছে সব গুছিয়ে রুমে আসুন।

-আধা ঘন্টার মধ্যে কিভাবে সব কাজ গোছাবো? আমাকে কি রোবট মনে হয় আপনার?

-এখন বাজে কয়টা? উমমমম?  সাড়ে নয়টা। ঠিক দশটার মধ্যে কাজ শেষ করবেন। দশটা পাঁচের মধ্যে রুমে চাই আপনাকে আমার। আর হ্যাঁ? ব্রেকফাস্ট না করে রুমে এলে খবর আছে এটা মাথায় রাখবেন।

-মানে কি!? বাদ বাকি কাজগুলো কে করবে শুনি?

-সবাইকেই যার যার কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয়ে গেছে ম্যাডাম। আপনার কাজ হলো আপনি আর আপনার ননদ আগে নাস্তা করবেন। তারপর এসে রেডি হবেন। গো ফাস্ট। পরে নাস্তা করার টাইম না পেলে আমাকে দোষ দিতে পারবে না বলে দিলাম।

-এই লোকটা একটা অসহ্য! আপনার খাওয়া লাগবে না? নাকি এখন বলবেন তুমি খেলেই আমার খাওয়া হয়ে যাবে?

-ডায়লগটা দারুণ বউপাখি। বাট আফসোস! এই ডায়লগটা দিতে পারলাম না। আপনার আগে আমি কাজ শেষ করে আসতে পারবো। সো ডোন্ট ওরি। 

-যা ইচ্ছে করুন। আমার কাজ শেষ হলেই আসবো। এর আগে না।

-কোনো প্রবলেম নেই ম্যাডাম। যেখানেই থাকুন না কেন দশটা বাজার পর আমি নিজেই গিয়ে ধরে আনবো আপনাকে। সোজা কথায় না মানলে কি করে আনতে হয় আমার জানা আছে। সো অহেতুক তর্ক না করে নিজের কাজে যাও।

-উফ! এই লোকটাকে কি যে করি আমি?

অনামিকা 'আসবো না, আসবো না' করেও ঠিকই নিজের টুকটাক কাজগুলো গুছিয়ে নিয়ে রুমে এসেছে। নিচে আসলেই তেমন কাজ ছিল না। অরণ্যের কাজিনরা বাকি মেহমানদের কি লাগবে না লাগবে সামলে নিচ্ছে। ফুলির মাকে বাকি কাজগুলো বুঝিয়ে দিয়ে তাহিয়ার রুমে গেছে অনামিকা। পার্লারের মেয়ে দুটো তাহিয়ার শাওয়ার নিয়ে বের হওয়ার অপেক্ষা করছে। একটু আগেই ফু্লির মা মেয়ে দুটোকে নাস্তা দিয়ে গেছে। মেয়েগুলোর সাথে টুকটাক দু একটা কথা বলে অনামিকা গুটিগুটি পায়ে রুমে এসে বসেছে। দেরি হয়নি আসতে। তবু বুকের ভিতরে কেমন ধুকপুক করছে অনামিকার। কিন্তু ভদ্রলোকের তো দেখাই নেই। কথাটা ভাবতে ভাবতেই দরজা লক করার শব্দে মুখ তুলে তাকাতেই অরণ্যকে দেখতে পেল অনামিকা। অরণ্য পকেট থেকে একটা ছোটোখাটো লম্বাটে টাইপের খামে মোড়ানো বক্স বেড সাইড টেবিলের উপরে রেখে গায়ের শার্টটা খুলে বিছানায় ফেলে অনামিকার পাশে বসলো। অনামিকা ভ্রু কুঁচকে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোকের কাজকর্ম বোঝার চেষ্টা করলো। অরণ্য অনামিকার দিকে একটু এগিয়ে এসে বিছানায় একটা বালিশে হেলান দিয়ে অনামিকাকে বসিয়ে দিল ঠিক করে। অনামিকাকে ইশারায় কিছু একটা বলে বেডসাইড টেবিল থেকে বক্সটা হাতে নিয়ে আবার অনামিকার সামনে এসে বসলো।

-আরে অনু? পা দুটো একটু ভাঁজ করে সামনের দিকে রাখো। নড়াচড়া করলে আলতা ছড়িয়ে যাবে। আর নইলে ডিজাইনটা লেপ্টে যাবে। বিশ্রি একটা অবস্থা হবে তাহলে।

-মানে কি! এখন আলতা পড়বো? তাও এভাবে বিছানার উপরে বসে? পাগল হয়েছ?

-এই জন্যই আমি তোমাকে আগে বলি নি আলতার ব্যাপারটা। চুপ করে দশ মিনিট বসে থাকবে। তাহলেই চলবে ম্যাডাম।

-হ্যাঁ বলেছে আপনাকে। পুরো ঘরে ঘরে আলতার রঙ লাগানোর বুদ্ধি আর কি। নতুন বেডশিটটার বারোটা বাজানোর প্ল্যান করেছেন না জনাব?

-আমি দেয়ার সময় না ছড়ালেও তোমার নাচানাচির কারণে ছোটোখাটো এক্সিডেন্ট হবে বলেই মনে হচ্ছে। যতক্ষণ বেডশিটে আলতার রঙ লাগবে বলে বকবক করছ ততক্ষণে আমার আলতা লাগানো হয়েই যাবে। তুমি জাস্ট দু মিনিট চুপ করে বসো।

-তার মানে তুমি বলছ আমি সারাদিন বকবক করি? 

-ওহ অনু! লেট মি কনস্নেট্রেট ইয়ার! আর শোনো? ইচ্ছে করে ঝগড়া লাগানোর নাটক করো না তো। হাতে সময় বেশি নেই। স্পেশাল গেস্ট আসবে। তার আগেই তোমাকে আমি আমার মনের মতো করে সাজিয়ে দিবো আজকে।

-কে আসবে গেস্ট? তোমার অফিসের কেউ? উমমম? তোমার বস আসবে নাকি?

-বাপরে! দুটো মিনিট চুপ থাকতে পারে না এই মেয়েটা? আসলেই তো দেখতে পাবে কার কথা বললাম তাই না?

-হুহ। আর কিচ্ছু বলবোই না আমি। কারো যা ইচ্ছে হয় করুক। আমার কি? 

-কথাটা মনে থাকে যেন। মাত্রই বললে আমার যা ইচ্ছে আমি করতে পারবো।

অনামিকা কিছু না বলে মুখ বাঁকিয়ে অরণ্যের আলতা আঁকাই দেখায় মন দিল। অরণ্য গভীর মনোযোগ দিয়ে অনামিকার পা জোড়া আলতার রঙে রাঙিয়ে তোলায় ব্যস্ত। অনামিকার পায়ে আলতা লাগানো শেষ হলে আলতা শুকানোর জন্য কিছুক্ষণ সময় নিল অরণ্য। এর মধ্যেই অনুর হাতের মেহেদিটা মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ দেখলো। আলতা পুরোপুরি শুকানোর পর একটা সোনালী পাড়ের লাল গরদ কাতান শাড়ি অনামিকাকে যত্ন করে পড়িয়ে দিল অরণ্য। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে গয়না, সাজ আর খোঁপায় বেলী ফুলের গাজরা জড়িয়ে নেয়া শেষে অনামিকার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিল অরণ্য। কাজলের কৌটো থেকে একটু কালি অনামিকার কানের পিছনে ছুঁইয়ে দিয়ে অনামিকার কপালে ছোট্ট একটা চুমো এঁকে দিলো অরণ্য।

-আপনার সাজ কমপ্লিট ম্যাডাম। হায়! কারো নজর না লাগুক আমার বউটাকে। ভাবছি অনু? আরেকবার বিয়ে করে ফেলা যাক চলো? নতুন বউয়ের চেয়ে কম লাগছে না কিন্তু তোমাকে কোনো অংশে।

-দুনিয়ার সব অদ্ভুত কথাবার্তা আছে এই লোকটার কাছে। নিজে রেডি হওয়ার খবর নেই এখনো। একটু পরেই স্নিগ্ধ ভাইয়ারা চলে আসবে।

-ওহো তাই তো! দেখা যাবে বর বউ সবাই রেডি, বিয়েও হয়ে যাবে, শুধুই আমিই রেডি হতে পারলাম না।

-উফ! এই লোকটা এখনও মজা করার মুডে আছে! তাড়াতাড়ি রেডি হও না?

-জি ম্যাডাম। আমার তো আপনার মতো তিন ঘন্টা লাগবে না রেডি হতে। জাস্ট পাঁচ মিনিট লাগবে। 

-আমি তিন ঘন্টা লাগিয়েছি? নাকি তুমি নিজে এতো দেরি করেছ হ্যাঁ?

-হ্যাঁ বাবা! আমার দোষ। আমিই দেরি করিয়েছি। তুমি গিয়ে দেখো তোমার ননদকে সাজানো হলো কিনা। 

-যাচ্ছি। আপনি বসে থাকুন।

-তার আগে একটা কাজ করো তো অনু। নিচে আজকে নতুন করে স্টেজ সাজাতে বলেছিলাম। একটু চেক করো তো ভালো লাগছে কিনা স্টেজটা।

-এখন স্টেজের ডেকোরেশন চেক করবো? সিরিয়াসলি অরণ্য?

-আরে বাবা কেমন লাগছে সেটা দেখতে বললাম তোমাকে। গিয়ে দেখো সুন্দর হয়েছে কিনা সাজানোটা।

-ওকে ফাইন। যাচ্ছি।

অনামিকা কিছু বিরক্ত হয়েই রুম থেকে বেরিয়ে স্টেজের ডেকোরেশন দেখার জন্য পা বাড়ালো। মাঝে মাঝে অরণ্য কেন যে এতো উদ্ভট আচরণ করে কে জানে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সিঁড়ি বেয়ে নেমেই থমকে গেল অনামিকা। ওর কয়েক হাতের ব্যবধানে দাঁড়ানো মানুষগুলোও কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আবার সামনের দিকে পা বাড়িয়েছে। অনামিকার মনে হলো কেউ বুঝি ওর পা জোড়া মাটির সাথে শক্ত করে আটকে দিয়েছে। না সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পাচ্ছে, না নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে। স্বপ্ন নাকি কল্পনা সেটাও বেচারির মাথায় ঢুকছে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে সামনের দিকে এগিয়ে আসা মানুষ দুটোর দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসায় ভালো করে দেখতেও পাচ্ছে না মানুষগুলোকে। অথচ সমস্ত ঘনঘোর আবছা ভাব কাটিয়েও তাদের বলা শব্দগুলো কানে এসে বাজছে অনামিকার।

-মেয়ের এতো রাগ দেখেছ এখনও কথাই বলছে না। 

৪২!! 

-এখনও অভিমান করে দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে অনু? এতোদিন পর বাবা মা এসেছে, একবার গিয়ে জড়িয়ে ধরবে না? একবার গিয়ে বলবে না কতোটা মিস করেছ তাদেরকে? কতোটা ভালোবাসো এই দুটো মানুষকে সেটা তো তুমি নিজেই ভালো জানো। তবু রাগটা নিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিজেও কেন কষ্ট পাবে, আর তাদেরকেও কেন কষ্ট দিবে বলো? উনারা যে ভুলটা করেছে সেটা এবার তুমিও করবে? নাকি সব মান অভিমান ভুলে নিজেই এগিয়ে যাবে তাদের দিকে এক কদম? 

সামনে থেকে মা বাবাকে এগিয়ে আসতে দেখে পুরো স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল অনামিকা। এক পা এগিয়ে গিয়ে মা বাবার বুকে লাফিয়ে পড়ায় আকুতিটা যেন ওর নিজের মধ্যেই আটকে গেছে। বিস্ময়ের ঘোরে চোখের কোণের জমা বাষ্পবিন্দুও জমে জমে পানিতে রূপ নিলেও যেন গড়িয়ে পড়তে গিয়েও থমকে গেছে। যেমনটা অনামিকা নিজেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবা মায়ের দিকে। গলা ফাটিয়ে 'মা, বাবা' ডাকতে ইচ্ছে করলেও বুকের কোণে জমে থাকা অভিমানেরা গলা চেপে ধরেছে অনামিকার। হঠাৎই পাশ থেকে অরণ্যের কথাগুলো শুনে ঘোর কাটলো অনামিকার। একবার মুখ ফিরিয়ে অরণ্যের দিকে তাকাতেই অরণ্য মাথা নেড়ে সামনের দিকে ইশারা করলো। অনামিকাও আর দেরি না করে বাবা মা দুজনকেই একসাথে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। এতোগুলো দিন যে মানুষগুলোর উপরে অভিমানের পাহাড় জমে ছিল, তারা সামনে এসে দাঁড়াতেই সব অভিমান যেন বাষ্পের মতো উড়ে গেছে অনামিকার মন থেকে। এতোগুলো দিন পর মেয়েকে পেয়ে অনামিকার বাবাও চোখের কোণটা ঝাপসা হয়ে এসেছে। অরণ্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অনামিকার পরিবারের সাথে মিলন পর্ব দেখে একটু পরে এগিয়ে এসে অনামিকার পাশে দাঁড়ালো। অনামিকাও ততক্ষণে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। অনামিকার বাবা কিছু বলার আগেই এবারে অরণ্য নিজেই বলা শুরু করলো।

-বাবা কান্নাকাটির পালা আবার শুরু হওয়ার আগে চলুন স্টেজের দিকে যাই। নইলে আবার কান্না শুরু হলে বোঝা যাবে না শ্বশরবাড়িতে কে যাচ্ছে, অনু নাকি তাহু। মম ড্যাডও আপনাদের জন্য ওয়েট করছে।

-ঠিক বলেছ অরণ্য বাবা। আমার মায়ের কাছ থেকে এতোদিন দূরে ছিলাম, আর কিছুক্ষণ নাহয় সেটাই হোক। বাড়িতে গেস্টরাও সবাই চলে এসেছে দেখলাম। চলো অনুর মা? বেয়াই বেয়াইনের সাথে কথা বলার সুযোগ পাবো না।

বাবার কথায় মা ও অনামিকার চুলে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়িয়েছে দেখে এবারে অনামিকার প্রচন্ড রাগ হলো। এতোদিন পর বাবা মা এসেও কিনা দুই মিনিট সময় নেই! অনামিকা রাগে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিটমিট করলো।

-এটা কি হলো? আমি রেগে আছি জেনেও কেউ আমার রাগ ভাঙ্গানোর কোনো চেষ্টাই করলো না? দুজনেই কি সুন্দর বেয়াই বেয়াইনের সাথে দেখা করতে চলে যাচ্ছে? আমি তাদের কিচ্ছু না? আর তুমি আমাকে বললে না কেন বাবা মা আসবে? সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে এভাবে ষড়যন্ত্র করছ না? সবাইকে দেখে নিবো আমি। তোমাকেও, বাবাকেও, মাকেও। হুহ।

-অরণ্যকে একদম কিছু বলবি না অনু। তুই আমাকে রাগ দেখাস? অরণ্য বাড়িতে গিয়ে আমাকে আর তোর মাকে তাহিয়ার বিয়ের কথা বলে দাওয়ার দেয়ার পর থেকে কয়বার কল করেছি জানিস তুই? একটাবারও কল রিসিভ করেছিস? নাকি কলব্যাক করেছিস? সেদিন বাবা মা রাগ করে তোকে রেখে চলে যাওয়ার অভিমানটা বুকে চেপেই বসে আছিস এখনো। একবারও নিজে এসে সামনে দাঁড়িয়েছিস? একবারও জানতে চেয়েছিস বেঁচে আছি কিনা মরে গেছি?!

-বাবা!

-তুই ছাড়া তোর বাবা মা কিভাবে বেঁচে ছিল একবারও জানতে ইচ্ছে করে নি তোর অনু? তুই কি ভাবিস আমরা তোকে এখানে রেখে গেছি বলে তোর কোনো খবর রাখি নি? বাবা মা কতটা কঠোর এই কথাটা সন্তানরা উঠতে বসতে বলে। কিন্তু এই কঠোর হওয়ায় যদি সন্তানের এক বিন্দুও ভালো হয়, সে সুখে থাকে, তাহলে পৃথিবীর সব বাবা মা ই কঠোর হতে রাজি আছে। 

-মানে এখন আমি এসে তোমাদের রাগ ভাঙ্গাতাম? মানে আমাকে রেখে উনারা জাস্ট চলে গেছে। একবার দেখতে পর্যন্ত আসে নি এতো দিনে। আর এখন এসেছে বলে সব দোষ আমার হয়ে গেল? তোমরা নিজেরা যে আমাকে এতো কষ্ট দিয়েছ সেই বেলায়? 

-আমরা তো এতোদিন ধরেই কল করছিলাম। তুই নিজেই তো জেদ দেখিয়ে কলটা রিসিভও করলি না। এবারে বল, তাহলে কার রাগ ভাঙ্গানো উচিত? তোর নাকি আমাদের?

-ধুর! আমি কথাই বলবো না কারো সাথে। তোমার সাথে ও না। তোমাদের কারো সাথেও না। 

কথাটা বলেই অনামিকা রাগ দেখিয়ে বাইরের দিকে হাঁটা শুরু করেছে দেখে অরণ্য নিজেও ছুটলো অনামিকার পিছুপিছু। মেয়েটা আর রাগ করে নেই সেটা বুঝতে বাকি নেই অরণ্যের। অনুর বাবা মাও হেসে এতোদিন পর মেয়ের সাথে খুনশুটি করায় ব্যস্ত। বাইরের মেইন প্লটের বাইরে বাগানের দিকটায় বড় করে প্যান্ডেল সাজিয়ে স্টেজ করা হয়েছে। অরণ্যদের আর স্নিগ্ধদের গেস্টরা আস্তে আস্তে আসতে শুরু করেছে। স্টেজে পাশাপাশি দুটো মঞ্চের মতো করে সাজানো হয়েছে। দুটো মঞ্চই আপাতত খালি দেখে তাহিয়া আর ফারহার খোঁজেই চললো অনামিকা। অরণ্যও চললো অনুর সাথে। অনুর বাবা মা ততক্ষণে বেয়াই বেয়াইনের সাথে এটা সেটা নিয়ে আলোচনায় মেতেছে। অরণ্যও সুযোগ পেয়ে অনামিকার সাজটা যত্ন করে ঠিক করে দিল এক ফাঁকে। 

দুপুরে জোহরের নামাজের পড়ে স্নিগ্ধরা বরযাত্রী নিয়ে এলো। তাহিয়ার কাজিনের বেশ অনেকক্ষণ গেইটে রীতিমতো যুদ্ধ করার পর বেচারা স্নিগ্ধ  যুদ্ধ জয় করে সাজানো মঞ্চে আসার সুযোগ পেল। স্নিগ্ধ মঞ্চে আসার আরো কিছুক্ষণ পর অনামিকা, ফারহা আর বাকি কাজিনরা মিলে তাহিয়াকে স্নিগ্ধের পাশের মঞ্চের মতো জায়গাটায় বসিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি সাজানো দুটো মঞ্চকে আলাদা করেছে সোনালি একটা পর্দা। স্নিগ্ধের কৌতূহলী চোখ জোড়া হাজার চেষ্টা করেও সেই পর্দার অপর পাশে বসে থাকা লজ্জায় জড়সড় তাহিয়াকে দেখতে পাচ্ছে না। বেচারার চোখ মুখের অবস্থা দেখে সবাই হাসাহাসি করলেও অরণ্য নিজের কাজিনদেরকে ধমক লাগালে। এক একটা মূহুর্ত প্রিয় মানুষটাকে এক নজর দেখার যে আকুতিটা সেটা অরণ্যের চেয়ে আর ভালো কে জানবে! অরণ্যের ভয়ে সবাই আমতা আমতা করে তাহিয়া আর স্নিগ্ধের মাঝের পর্দা টা সরিয়ে নিতেই স্নিগ্ধ মুগ্ধ চোখে তার ভালোবাসার মানুষটাকে দেখলো। সেটা নিয়ে অবশ্য বাকিরা আরেক দফা হাসিতে যোগ দিল। 

একটু পরেই কাজীসাহেব এসে বিয়ে পড়িয়ে গেছেন স্নিগ্ধ আর তাহিয়ার। নিজের প্রিয় মানুষটাকে এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো বিয়ে করছে। তাই কবুল বলতে গিয়ে স্নিগ্ধ আর তাহিয়া দুজনেই একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসলো। কবুল বলা শেষ হলেই অরণ্য কোথা থেকে এসে তাহিয়ার ঠিক পিছনে এসে দাঁড়ালো।

-তাহু একটা কথা ভাবছিলাম বুঝলি। আর এক মাস পরে যে তোদের ম্যারেজ এনিভার্সারি এটা তো কেউ জানে না। তা বিয়ের এক মাস পরে তোদের ফার্স্ট ম্যারেজ এনিভার্সারি, ব্যাপারটা দারুণ না বল তো?

-ভাইয়া? কি করছ? কেউ শুনতে পেলে সর্বনাশ হবে।

-আরে কে শুনবে? সবাই নিজেদের মতো করেই ব্যস্ত।।এদিকে তোদের দুজনের ম্যারেজ রেজিস্ট্রিতে সাইন চলছে, ওদিকে সবাই চিকেন রোস্টে কামড় বসাচ্ছে। এদিকে তোরা দুজন কবুল বললি, আর ওদিকে গেস্টরা বোরহানি গলায় ঢেলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। বিয়ে বাড়িতে কারো কথা শোনার সময় আছে কারো?

-ভাইয়া? ভাবিকে ডাকবো কিন্তু এবার। এতো জ্বালাচ্ছিস কেন? একটু পরেই তো চলে যাবো? তারপর শান্তিতে থাকিস।

-শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তুই তো শান্তিতে থাকতে পারবি। তাই বেশি করে জ্বালাচ্ছি আর কি।

-তোমাদেরকে আবার তেজপাতা তেজপাতা করতে কাল তো আবার চলে আসবো। হু হু। তাহলে এখন আর জ্বালিয়ে লাভ কি?

-এই তাহু শোন না? একবার ভাবলাম আরো একমাস পরেই বিয়ের ডেইটটা ফিক্সজড করি। একেবারে ফার্স্ট ম্যারেজ এনিভার্সারিতে সেকেন্ড ম্যারেজ এনিভার্সারি হয়ে যেত তাহলে। শেষে আবার স্নিগ্ধের কথা চিন্তা করে মায়া হলো। আমি অনুকে এক নজর দেখে এক মাসের মধ্যেই বিয়ে করে ঘরে তুললাম, ও তো এতোদিন প্রেম করে শেষে এতোদিন আগে বিয়ে করেও বউকে পাচ্ছে না। বেচারা! তাই আর দেরি করি নি।

-তোকে নিজের বিয়েতে সাক্ষী রাখা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হইসে। এই এক কাজের কত বার যে ব্ল্যাকমেইল করলি ভাইয়া, আমার আজীবন মনে থাকবে।

-মনে থাকার জন্যেই তো করছি। তাইলে তোর ছানাপোনাদেরকে ভবিষ্যতে বলতে পারবি ওদের মামা কেমন ইন্টেলিজেন্ট ছিল। আর ওদের মা কত গাধা সরি গাধি ছিল।

-ভাইয়াআআআ। তোকে তো আমি------।

-ছি ছি তাহু! তুই না নতুন বউ? এভাবে বিয়ের দিনই এতো চিল্লাপাল্লা করলে সবাই কি ভাববে? ছি ছি তাহু? স্নিগ্ধ তুমি একটু বলো তো ওকে? বাপের বাড়িতে এসব করছে, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কি করবে তাহলে?

-হাতি গর্তে পড়লে ব্যাঙেও তাকে লাথি মারে। মার মার। আমারও দিন আসবে। তখন দেখে নিবো তোকে দেখিস। হুহ।

-নিজেকে তাহলে হাতি স্বীকার করছিস তো? হা হা হা।

-না। তোকে ব্যাঙ স্বীকার করছি----।

বিয়ের সময় থেকে শুরু করে বিদায়ের আগ মূহুর্ত পর্যন্ত অরণ্য আর তাহিয়ার এমন খুনশুটি চললেও স্নিগ্ধরা তাহিয়াকে নিয়ে যাওয়ার সময় না তাহিয়ার গলা দিয়ে একটা শব্দ বের হচ্ছে আর না অরণ্য কিছু বলে তাহিয়াকে রাগিয়ে দিতে পারছে। গাড়িতে ওঠার  আগে তাহিয়া সবার সাথে দেখা করে বিদায় নিয়ে অরণ্যকে আর অনুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। এই প্রথমবার অরণ্য তাহিয়াকে 'নাকি কান্না' করছে বলে কথা শোনাতে পারলো না। তাহিয়াকে ছেড়ে দিয়ে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে নিজের চোখ মুছতে মুছতেই পিছন থেকে বাবার ভারি গলার কথাটা শুনতে পেল অরণ্য।

-আমার মেয়েটা এখনও অনেক ছেলেমানুষ বাবা। কোনো ভুল ত্রুটি করলে একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিও। আজ থেকে আমার মেয়েটাকে তোমার হাতেই তুলে দিলাম।
Author, Publisher & Developer

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উফ!
মনে হচ্ছে আপনার ইন্টারনেট সংযোগে কিছু সমস্যা আছে। অনুগ্রহ করে আগে আপনার ইন্টারনেটের সংযোগ ঠিক করুন এবং তারপর আবার ব্রাউজিং শুরু করুন৷
AdBlock সনাক্ত করা হয়েছে!
আমরা শনাক্ত করেছি যে আপনি আপনার ব্রাউজারে অ্যাডব্লকিং প্লাগইন ব্যবহার করছেন৷ আমরা আপনাকে আপনার অ্যাডব্লকিং প্লাগইন বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করছি, কারন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমরা যে রাজস্ব আয় করি তা এই ওয়েবসাইট পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হয়।