আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে গল্প সম্বন্ধে আপনার মতামত অবশ্যই প্রকাশ করবেন। আপনাদের মতামত আমাদের এই ছোট প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। শীঘ্রই আরও নিত্য নতুন গল্প আপডেট আসছে, সঙ্গে থাকুন। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখক/লেখিকা'র নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত গল্পের ডায়েরি’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখক/লেখিকা'র কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় গল্পের ডায়েরি কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

প্রেমাতাল - পর্ব ২৫ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


৪৯!!

মা আর স্নিগ্ধ ফেরার পর ওরা সবাই মিলে মিটিং এ বসলো। তিতির বসলো একদম মুগ্ধর মার গা ঘেঁষে। মা ওকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল। প্রথম কথা উঠলো কাকে কাকে দাওয়াত করা হবে। মুগ্ধ বলল,
-"এত দাওয়াত ফাওয়াতের কি দরকার মা? আপাতত নিজেরা নিজেরাই করি। কয়েক মাস পরে নাহয় অনুষ্ঠান করবো, তখন সবাইকে দাওয়াত দিও?"
মা বলল,
-"হ্যা সেটা তো করতেই হবে। কিন্তু এখনও তো তোর চাচা,ফুপী,মামা খালাদের না বলে পারবো না। অন্তত যারা ঢাকায় আছে।"
-"না মা, কাউকেই বলোনা। লাগলে সামনের মাসেই অনুষ্ঠান টা করবো। তবু আজ কাউকে বলো না।"
-"কিন্তু বিয়ের জন্য সাক্ষী লাগে।"
-"আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডদের ডেকে নিচ্ছি। রিলেটিভ কাউকে চাচ্ছি না। জানি এসেই পিঞ্চ করতে শুরু করবে, আজকের দিনে আমি মেজাজ খারাপ করতে চাই না।"
-"আচ্ছা ঠিকাছে কিন্তু বাবা বিয়ে পড়াতে কাজী আসবে, রেজিস্ট্রি করতে উকিল আসবে, তোর ফ্রেন্ডরা আসবে তাই রান্নাবান্নার ব্যবস্থা তো কিছু করতে হবে।"
-"হ্যা, সেটা তোমার যা মন চায় করো।"
-"বাসায় প্রায় সবই আছে।শুধু টুকটাক কিছু বাজার লাগবে।"
-"আচ্ছা আমি আর স্নিগ্ধ যাচ্ছি বাজারে, কি কি লাগবে লিস্ট করে দাও।"
-"দুজন গিয়ে কি করবি? তুই একা যা। স্নিগ্ধকে অন্য কাজে পাঠাবো।"
স্নিগ্ধ বলল,
-"কি কাজ আম্মু?"
মা বলল,
-"ওইযে ফুলের কাজ করে না? তুই ওদের আনতে যাবি। বাসরঘর সাজাবার জন্য।"
তিতির লজ্জা পেল, কিন্তু কিছু বলল না। ছোট ভাইবোনদের সামনে মুগ্ধও যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেল। বলল,
-"আরে না মা। বাসরঘর সাজানো লাগবে না।"
-"একটা থাপ্পড় মারবো যদি সবকিছুতে না না করিস। বিয়ে যেমনভাবেই হোক সেটা প্রত্যেকটা মানুষের জীবনের খুব স্পেশাল একটা দিন। সেটাকে স্পেশাল করার জন্য কিছু তো করতেই হবে। এই দিন জীবনে বারবার আসবে না।"
-"আচ্ছা আচ্ছা যা মন চায় করো।"
-"উকিল আর কাজীর সাথে কথা বলেছিস?"
-"হ্যা, ওনারা সন্ধ্যা ৬ টায় চলে আসবে।"
-"আচ্ছা।"
মা এবার তিতিরের দিকে ফিরে বলল,
-"মা চলো আমরা একটু শপিং এ যাই। তোমাকে বউ সাজাতে হবে না?"
তিতির বলল,
-"না না, আন্টি আমি এখন শপিং এ যাব না।"
-"এখনো আন্টি বলছো? মা বলো।"
তিতির হেসে বলল,
-"হ্যা মা। আমার মা।"
-"হ্যা, এবার বলো শপিং এ কেন যেতে যাচ্ছো না?"
-"এখন বিয়েটাই সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্ট মা। কি পড়লাম কি সাজলাম সেটা আমার কাছে ইম্পরট্যান্ট না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট করে কি লাভ? সময়ওতো নষ্ট হবে। আপনার ছেলের কাছে আমার কয়েকটা শাড়ি আছে। সেখান থেকে একটা শাড়ি পড়ে নেব।"
মা তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-"মাগো, তোমার শ্বশুর বেঁচে থাকলে দেখতে কত কি করতো। আমাদের তো পালিয়ে বিয়ে হয়েছিল। খুব সাদামাটাভাবে হয়েছিল আমাদের বিয়ে। তাই মুগ্ধর বিয়ে নিয়ে আমাদের দুজনের অনেক স্বপ্ন ছিল। ইচ্ছে করছে না এমন চুপচাপ বিয়ে দিতে। যাই হোক, তুমি যখন চাইছো না শপিং এ যেতে আমি জোর করবো না। কিন্তু বউ তো সাজতে হবে মা। পালিয়ে গিয়ে আমাদের বিয়ে হলেও তোমার শ্বশুর আমাকে বেনারসি শাড়ি দিয়েছিল বিয়েতে। খুব যত্ন করে রেখেছিলাম মুগ্ধর বউয়ের জন্য। তুমি কি আজ ওটা পড়বে? আর মুগ্ধর বউয়ের জন্য যে গয়নাগুলো বানিয়েছিলাম সেগুলো?"
-"অবশ্যই পড়বো মা। আমি শুধু শপিং এ যেতে চাচ্ছিলাম না। আপনার বিয়ের শাড়ি পড়বো এটাতো আমার সৌভাগ্য।"
-"আচ্ছা ঠিকাছে তাহলে।"
বিকাল ৪ টা। তিতির মুগ্ধর ঘরের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখছে। সাজগোজ কিছু নয়, শুধু একটা লাল বেনারসি। মুগ্ধর মায়ের বিয়ের বেনারসি। আর কানে ঝুমকা, গলায় নেকলেস, হাতে চুড়ি, কপালে টিকলি-টায়রা, নাকে নথ আর চোখে গাঢ় করে কাজল লাগিয়েছে ব্যাস। ঘরের বিছানায় লাল রঙের একটা বেডকভার দেয়া হয়েছে। বিছানার উপর বেলী আর গোলাপ ফুল দিয়ে বাসরঘর সাজানো হয়েছে, সিম্পলভাবে সাজানো হয়েছে কিন্তু তিতিরের মনে হলো এত সুন্দর বাসরঘর এর আগে কোনদিনও দেখেনি ও। আজ রাতে এই বিছানায়ই মুগ্ধর হাতে তিতিরের মরণ হবে, সুখের মরণ। ভাবতেই লজ্জা লাগলো তিতিরের।
হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তিতির ফিরে তাকাতেই সাদা পাঞ্জাবী পড়া মুগ্ধকে দেখতে পেল। মুগ্ধ ওকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লো। ইশ কি সুন্দর দেখাচ্ছে তিতিরকে। মুগ্ধ তিতিরের দিকে এগিয়ে গেল। ও এমন হা করে তাকিয়ে আছে যে তিতিরের লজ্জাই করছে। মুগ্ধ কাছে এসে আঁচলটা তুলে ঘোমটা দিয়ে দিল তিতিরের মাথায়। তারপর মুখটা দুহাতে ধরে বলল,
-"পুরা বউ, তোমাকে যে কি সুন্দর লাগছে তিতির। বলে বোঝাতে পারবো না। অসাধারণ অসাধারণ। দাঁড়াও.."
একথা বলেই মুগ্ধ আলমারির দিকে গেল। আলমারি খুলে সিলেটের সেই লাল টিপের পাতাটা বের করলো। একটা টিপ উঠিয়ে তিতিরের কপালে পড়িয়ে দিল। তারপর বলল,
-"একদম পারফেক্ট বউ আমার।"
তিতির মুচকি হাসলো। বলল,
-"এই তুমি যে এমন সময় ঘরে এলে কেউ কিছু মনে করবে না?"
-"আরে না।"
-"আমি বাইরে যাই, কেউ যদি চলে আসে?"
মুগ্ধ তিতিরকে যেতে দিল না। বলল,
-"সবাই ব্যাস্ত, কেউ আসবে না। আর শোনো একটা কথা, আমি বোধহয় এ মাসে ছুটি পাব না। তাই হানিমুনের জন্য তোমাকে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।"
-"আমার কোন সমস্যা নেই।"
-"কাছে কোথাও গেলে যেতে পারতাম শুক্র, শনি বার।"
-"আমরা কোথায় যাব?"
-"কেন কাশ্মীর। সব ভুলে গেছো? আমরা প্ল্যান করেছিলাম না হানিমুনে কাশ্মীর যাব?"
-"ভুলিনি, মনে আছে। তবু যদি চেঞ্জ করো তাই জিজ্ঞেস করলাম।"
-"না চেঞ্জ করবো কেন? যেরকম প্ল্যান হয়েছিল সেরকমই হবে। যেহেতু ১২ দিনের ট্রিপ তাই এখনই যেতে পারছি না। এতগুলো দিনের ছুটি হুট করে পাওয়া সম্ভব না।"
-"আচ্ছা আচ্ছা সমস্যা নেই তো।"
-"তোমার পাসপোর্ট আছে?"
-"না।"
-"ওহ, তাহলে এর মধ্যে পাসপোর্ট টাও করে ফেলবো।"
-"আচ্ছা।"
"আচ্ছা তিতির, এসবের কোন মানে হয় বলো?"
-"কোন সবের?"
-"এইযে.... বাসরঘর রেডি, বিছানা রেডি, বর রেডি, বউ রেডি। অথচ শুধু একটা বিয়ের জন্য বসে থাকতে হচ্ছে, এর কোন মানে হয়? চলো শুরু করে দিই?"
তিতির মুগ্ধর বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
-"যাহ, যত্ত আজেবাজে কথা!"
-"এহ, আজেবাজে কথা আমি বলি? কাল রাতে কি বলেছিলে? আমি হাগ আর কিস ছাড়া কিছুই করতে পারি না! আর শুধু কি বলা! কি যে করেছো! আমার ইজ্জত যায় যায় অবস্থা, প্যান্ট ধরে টানাটানি! ছিঃ এই ছিল তোমার মনে?"
তিতির লজ্জায় লুটিয়ে পড়ছিল। নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ বলল,
-"আজকে রাতে যে তোমার কি হবে তিতির! রেডি থেকো। কাল সারারাত আমাকে কষ্ট দিয়েছো। সব শোধ তুলবো আজ রাতে। খালি বিয়েটা হয়ে যেতে দাও। খুব ভালভাবে বোঝাবো মুগ্ধ কি পারে আর কি পারে না।"
তিতির মুগ্ধর বুকে কিল মারতেই মুগ্ধ তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো। জড়িয়ে ধরলো মুগ্ধও। তিতির বলল,
-"তুমি আমাকে আর গান শোনাও না কেন? সেইযে সিলেট গিয়েছিলাম। দু'দিনে একটা গানও শোনাওনি।"
-"তখন কি গান গাওয়ার মত মন মানসিকতায় ছিলাম? তুমিও তো শুনতে চাওনি।"
-"তা অবশ্য ঠিক।"
-"দুজনেরই তো তখন বুকের ভেতর কষ্টের চাষবাস চলছিল।"
-"হুম।"
-"এখন শুনবে?"
-"হ্যা। কিন্তু কেউ শুনলে কি ভাববে?"
-"শুধুমাত্র বাংলা সিনেমাতেই সম্ভব অনেক দূর থেকেও গান শুনতে পাওয়া। এটা বাস্তব, তাই এখানে বসে গাইলে তা বাইরে যাবেও না। আর কেউ হুট করে আসবেও না।"
-"তাহলে শুনবো, গাও.. আমি কান পেতে আছি।"
-"এটা আমার অনেক অনেক প্রিয় একটা গান তিতির। কিন্তু তবুও এই গানটা আমি কখনো তোমাকে শোনাইনি। জমিয়ে রেখেছিলাম বিয়ের রাতে তোমাকে শোনাব বলে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি রাতে গান টান গাওয়ার যময় পাব না। তাই এখনই শোনাচ্ছি।"
তিতির লজ্জা পেয়ে সরে যাচ্ছিল,
-"উফফফ তুমি না!"
মুগ্ধ ওকে আবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে দেয়ালে হেলান দিয়ে গাইতে শুরু করলো,
"বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি
আজকে আমার প্রাণ পেয়েছে
অনেক নতুন ভাষা
অনেক দিনের স্বপ্ন যে
অনেক দিনের আশা
বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি
তোমায় পেয়ে হয় যে মনে
আর জনমেও সাথে ছিলাম
আমরা দুজন মনের সুখে
অনেক জনম ঘুরে এলাম
চিরদিনই থাকবে একই
আমাদের এই ভালবাসা
বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি
তুমি আমার অনেক আপন
মেনে নিয়েও বলে এমন
হওনা তুমি আরো কাছে
হওনা তুমি আরো আপন
এক সাগরে মিলবো বলে
তোমার আমার স্রোতে ভাষা।
বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি
আজকে আমার প্রাণ পেয়েছে
অনেক নতুন ভাষা
অনেক দিনের স্বপ্ন যে
অনেক দিনের আশা
বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি!"

৫০!!

তিতির বরাবরই এভাবে মুগ্ধর বুকে মাথা রেখে গান শুনতে পছন্দ করে। মুগ্ধর বুকের পাঁজর যেন প্রতিটা ধুকধুক এর মধ্য দিয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় তিতিরের গাল। আর গানের প্রতিটা কথা, সুর সাথে প্রিয় মানুষটার কণ্ঠস্বর কানের এত কাছে! গান শেষ করে তিতিরের কানে কানে মুগ্ধ বলল,
-"আজ রাতে তো তুমি শেষ।"
তিতির লজ্জায় লজ্জায় এখনই শেষ হয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে চলে যাচ্ছিল। মুগ্ধ হাত ধরে থামাতে গিয়ে খেয়াল করলো তিতিরের হাতে সুন্দর নকশা করা মেহেদি। বলল,
-"তুমি মেহেদি পড়েছো?"
-"হ্যা।"
-"আমি একদমই খেয়াল করিনি। কখন পড়লে? খুব সুন্দর হয়েছে। নতুন বউয়ের হাতে মেহেদি নাহলে কি হয়?"
-"জানো মাও এই কথাটাই বলেছিল। আমি পড়তে চাইনি প্রথমে, লজ্জা লাগছিল। পরে মা আর পিউয়ের জোরাজুরিতে পড়েছি।"
-"কখন লাগিয়েছো? আমি তো দেখলামই না।"
-"তুমি তখন বাজারে গিয়েছিলে। বাজার দিয়েই তো আবার চলে গেলে।"
-"হ্যা, কাজ ছিল তো। নিজের বিয়ের সব আয়োজন তো নিজেকেই করতে হচ্ছে।"
-"হুম, সেজন্যই দেখতে পাওনি।"
-"অল্পসময় রেখেছো তবু কি সুন্দর গাঢ় রঙ হয়েছে দেখেছো? তার মানে হচ্ছে তোমার বর তোমাকে অনেক ভালবাসবে।"
-"আমার বর তো আমাকে এমনিতেই অনেক ভালবাসে, মেহেদির রঙে কিছু যায় আসে না।"
মুগ্ধ ওকে কাছে এনে বলল,
-"ভালবাসা তো আজ রাতে টের পাবে সুন্দরী।"
তিতির এক ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। মুগ্ধ হাসতে লাগলো।
কিচ্ছুক্ষণ পর ঘর থেকে বের হতেই মুগ্ধর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল ড্রইং রুমে ইকরাকে দেখে। সাথে ফুপীও আছে। মা কি ওদেরকে বলেছে নাকি ওরা নিজ দায়িত্বে এসে হাজির হয়েছে? মা ভয়ে ভয়ে তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ কিছু বলল না। তবে আশেপাশেই থাকলো। কারন তিতির ওখানেই আছে, কখন যে ফুপী তিতিরকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে বসে তার ঠিক নেই।
যেমন চিন্তা করলো তেমনই হলো কিছুক্ষণ পরই ফুপী তিতিরকে জিজ্ঞেস করলো,
-"এভাবে বাবা-মা কে না জানিয়ে বিয়ে করছো তোমার ভয় করছে না?"
তিতির কি বলবে ভেবে পেল না আবার চুপ করে থাকলেও তো বেয়াদব ভাববে। ও ভাবতে ভাবতেই মুগ্ধ গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে উত্তর দিল,
-"ফুপী, সবার বিয়েতে যে বাবা-মা থাকবে এমন তো কোন কথা নেই। আমার বাবা-মার বিয়েতেও তো মায়ের বাবা-মা ছিল না। তো? তারা কি সুখী হয়নি?"
-"তোর বাবা-মায়েরটা তো অন্য ব্যাপার ছিল। ভাবীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল তাই।"
মা জানে মুগ্ধ আরো কথা বললে ওর মুখের লাগাম ছুটে যাবে। তাই মুগ্ধ কিছু বলার আগেই মা বলল,
-"ওদের ব্যাপারটা আমাদেরটার চেয়েও বেশি অন্য ব্যাপার। তোমরা তো সবটা জানো না তাই বুঝতে পারছো না।"
যেহেতু মা বলেছে তাই মুগ্ধ আর এব্যাপারে কিছু বলল না। পিউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-"পিউ তুই তিতিরকে নিয়ে তোর ঘরে বা আমার ঘরে যা। আমার ফ্রেন্ডরা চলে এসেছে নিচে। এক্ষুনি ওপরে চলে আসবে।"
পিউ তিতিরকে নিয়ে মুগ্ধর ঘরে গেল। ইকরা লুকিয়ে চোখেরজল মুছে নিল তবু মুগ্ধর চোখ এড়ালো না। ইকরা কাঁদছে, কাঁদুক! শুধু ভালবাসলেই তো আর হয়না। ভালবাসার সঠিক পথটাও জানতে হয়।
মুগ্ধর ফ্রেন্ড তমাল চলে এসেছে। তমাল বলল,
-"এতদিনে তাহলে বিয়ে করছিস।"
মুগ্ধ হাসতে হাসতে বলল,
-"কথা বলবিনা শালা, মেরে নাক ফাটিয়ে দেব। তুমি তো তোমার হিরোইনের সাথে বাচ্চাকাচ্চা ফুটিয়ে ফেলেছো আর আমি কেবল সুখের মুখ দেখলাম।"
তমাল মুগ্ধর কাধে হাত রেখে বলল,
-"সরি দোস্ত, আমার বোকামির জন্যই তোদের দুজনের জীবনে কাল নেমে এসেছিল। সেদিন আমার ওই কাজ করা উচিৎ হয়নি। সুপ্তিকে তো আমি ঠিকই বিয়ে করতে পেরেছি। কিন্তু আমার পাপে তোরা..."
মুগ্ধ তমালকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-"আরে থাম ভাই, ওইসব কথা বলে লাভ নেই। কপালে যা ছিল তাই হয়েছে, এখনো কপালে যা আছে তাই হতে চলেছে।"
তমাল চুপ, মুগ্ধ আবার বল,
-"সুপ্তি আর বাচ্চাদের আনিসনি কেন?"
-"সুপ্তি ওর বাবার বাড়িতে। পরে একদিন বউ দেখাতে নিয়ে আসবো।"
ওরা কথা বলতে বলতেই মুগ্ধর অন্য ফ্রেন্ডরা চলে এল। সবাই গল্পগুজব করছে। মা রান্নাবান্নায় ফিনিশিং দিতে গিয়েছে। ফুপী তাকে হেল্প করছে। ইকরা আর স্নিগ্ধও ড্রইং রুমের এক কোনায় বসে গল্প করছে। পিউ এসে ইকরাদের সাথে জয়েন করলো। তার মানে তিতির এখন একা। মনটা বারবার তিতিরের কাছে যেতে চাইছে। সবার চোখের আড়াল থেকে পা পিছিয়ে পিছিয়ে মুগ্ধ চোরের মত গিয়ে ঘরে ঢুকলো। তিতির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করছিল। আচ্ছা, এজন্যই তাহলে পিউ বেড়িয়ে গিয়েছে। মুগ্ধ আচমকা গিয়ে তিতিরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। তিতির লাফিয়ে উঠলো।
-"উফ তুমি না!"
-"ভয় পেলে কেন? কি ভেবেছিলে অন্য কেউ?"
-"নাহ, তবে হঠাৎ তো তাই চমকে গিয়েছিলাম।"
মুগ্ধ পেছন থেকেই তিতিরের কানের নিচে একটা চুমু দিল। তারপর বলল,
-"এই পৃথিবীতে মুগ্ধ ছাড়া আর কেউ কি আছে যে তোমার গায়ে টাচ করতে পারে?"
তিতির মুগ্ধর দিকে ঘুরে গলা জড়িয়ে ধরে চোখে চোখ রাখলো। মুগ্ধ তিতিরের কোমরে হাত রাখলো। বলল,
-"লেটস হ্যাভ আ কিস! ইট উইল বি দ্যা লাস্ট কিস অফ আওয়ার আনম্যারেড আইফ।"
তিতির চোখ নামিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। মুগ্ধ তিতিরের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে নিবিড়ভাবে চুমু খেল। তিতির ভেসে গেল অন্য কোন দুনিয়ায়। সিলেটের পর এই প্রথম মুগ্ধর এত কাছে আসা। যদিও কাল থেকে নাকি অনেক কিছুই হয়েছে সেসব কিছুই সেভাবে খেয়াল নেই তিতিরের। মুগ্ধ বলার পর সব মনে পড়লেও অনুভূতিগুলো তো আর পাওয়া যায় না। দুজনেই দুজনকে বেহুঁশ হয়ে চুমু খাচ্ছে। কেউই কেউকে ছাড়ছে না। কতক্ষণ যে পার হয়ে গেল কে জানে! হঠাৎ রিংটোন বেজে উঠতেই তিতির ছেড়ে দিল,
-"যাও তোমার ফোন এসেছে।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"আমার ফোন পকেটে, তোমার ফোন এসেছে।"
মুখে হাসলেও মুগ্ধর কলিজার ভেতর অজানা একটা ভয় একটা কামড় দিয়ে উঠলো। তিতিরের ফোনটা বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখা ছিল। তিতির ফোনটা হাতে নিয়েই ছুঁড়ে ফেলে দিল বিছানার ওপর। যেন ইলেক্ট্রিক শক লেগেছে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। মুগ্ধর দিকে ফিরে ভয়ে ভয়ে বলল,
-"ভাইয়া।"
মুগ্ধর সারা শরীরের রক্ত যেন পানি হয়ে গেল। যা বোঝার বুঝে গেল মুগ্ধ। ফোনটা তুলে তিতিরের হাতে দিয়ে বলল,
-"ফোনটা ধরো।"
-"না প্লিজ, আমি ফোন ধরবো না।"
-"তিতির, আমাদের কপালে যা আছে তাই হবে তুমি ফোনটা ধরো। আমার মনটা কেমন যেন করছে।"
-"না আমি ফোন ধরতে পারবো না।"
ওরা কথা বলতে বলতে কলটা কেটে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা মেসেজ এল। তিতির বলল,
-"ভাইয়া মেসেজ দিয়েছে। আমার ভয় করছে মেসেজ টা ওপেন করতে। কোন বিপদ কি হয়েছে? আমি কি চলে এসে ভুল করলাম?"
মুগ্ধ ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ ওপেন করলো। মেসেজটায় ছিল,
"Baba heart attack koreche kalke, amader kauke kichu boleni. Aj amra ter peye hospital e anlam, sathe sathe emargency te admit koreche.. Dr. boleche onk deri hoye gese, Allah ke dakte... R kichu paren r na paren plz ektu doa korben, apnader notun jibon shuker hok!"
মুগ্ধ তিতিরকে বলল,
-"তিতির, আমাদেরকে বের হতে হবে এক্ষুনি।"
তিতির মোবাইলটা হাতে নিয়ে মেসেজটা পড়েই ফ্লোরে বসে পড়ে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-"আমার পাপে সব হয়েছে, শুধু এই ভয়টা পেয়ে আমি এতবছর আসতে পারিনি।"
-"এসব বলার বা ভাবার সময় এখন না তিতির। প্লিজ তুমি ওঠো।"
তিতিরকে ধরে ওঠলো মুগ্ধ। তিতিরের দৃষ্টি এলোমেলো। কেঁদেই চলেছে, কিছু করার নেই.. পুরো পৃথিবীটা ভেঙে পড়েছে ওর মাথার উপর। ওর বাবা কি চলে যাবে? নাহ, আল্লাহ যেন এতবড় শাস্তি ওকে না দেয়। বাবাকে ও সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। বাবার কিছু হলে ও নিজেকে কক্ষনো ক্ষমা করতে পারবে না। আল্লাহ ওর পাপের শাস্তি যেন ওর বাবাকে না দেয়। মুগ্ধ বলল,
-"আরে কি হলো চলো? আর তার আগে শাড়িটা পালটে নাও। বাবা এভাবে তোমাকে দেখলে তার আরো ক্ষতি হতে পারে।"
তিতির গয়নাগাটি সব খুলল। তাড়াহুড়ো করে হাতের চুরি খুলতে গিয়ে খোদাই করা ডিজাইনের ঘষা লেগে হাত কেটে গেল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না তিতির। মুগ্ধ যে ঘরে আছে সেদিকে খেয়াল নেই তিতিরের, ওর সামনেই শাড়ি খুলতে লাগলো। উফফ এত সেপটেপিন কেন লাগিয়েছে শাড়িতে! মুগ্ধ হেল্প করলো।
সবগুলো সেপটেপিন খোলা হতেই মুগ্ধ আলমারি থেকে একটা শার্ট নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। দরজার বাইরে গিয়েই পাঞ্জাবিটা খুলে শার্ট টা পড়ে নিল। ওকে এভাবে চেঞ্জ করতে দেখেই মা কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-"কি হয়েছে মুগ্ধ? চেঞ্জ করলি? আর তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?"
-"তিতিরের বাবা হার্ট এট্যাক করেছে।"
মা নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। এর মধ্যে তিতির শাড়ি গয়না হাতে নিয়ে সালোয়ার কামিজ পড়ে বেড়িয়ে এল। ওগুলো মায়ের হাতে দিয়ে বলল,
-"আমাকে মাফ করবেন মা।"
মা বলল,
-"এসব কথা এখন রাখো। তাড়াতাড়ি যাও।"
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকাতেই মুগ্ধ বলল,
-"চলো।"
ওরা বেড়িয়ে গেল। সামান্য কজন অতিথিরা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।
মুগ্ধর ৭ তলার বাসা থেকে লিফটে উঠতেই তিতির তাকিয়ে দেখলো ম্যাক্সিমাম ফ্লোরে লিফট কল করা আছে অলরেডি। ৬ তলায় লিফটের দরজা খুলতেই তিতির মুগ্ধর হাত ধরে টেনে বের করলো। তারপর সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে লাগলো। অগত্যা মুগ্ধও দৌড় লাগালো। তিতিরের কান্না এক সেকেন্ডের জন্য থামেনি। গাড়িতে ওঠার পর থেকে তিতির বারবার ঘড়ি দেখছিল। মুগ্ধ বলল,
-"টেনশন করোনা। রাস্তায় জ্যাম নেই তাড়াতাড়িই পৌঁছে যাব। তান্নাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করো বাবা কোন হসপিটালে আছে?"
তিতির তাই করলো। তান্না কোন উল্টোপাল্টা কথা বলল না। সোজাসুজি বলে দিল কোন হসপিটালে আছে। মুগ্ধ বলল,
-"এ সব কিছুর জন্য আমি দায়ী। আমার কাছে আসার জন্য যদি আমি তোমার উপর প্রেশার ক্রিয়েট না করতাম তাহলে তুমি আসতেও না আর এই অঘটন টাও ঘটতো না।"
-"নিজেকে দোষ দিও না। তুমি প্রেশার ক্রিয়েট না করলেও আমি আসতাম। বাসায় আমার উপর দিয়ে যা যাচ্ছিল তা আমি মানতে পারছিলাম না আর। তাই আমি গিয়েছি। কিনতি এটাও সত্যি বাবা নির্বাক ছিলেন সবকিছুতে। মা আর ভাইয়ার অত্যাচারে যেমন বাবা বাধা দেননি তেমনি নিজে এমন কোন কথা বলেনি যাতে আমি কষ্ট পাই। আর আমি বাবাকে এতটা কষ্ট দিলাম? আমি মানুষ না। আমি সত্যিই একটা কুলাঙ্গার।"
-"এসব বলেনা তিতির। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
তিতির ঠোঁট কামড়ে ধরে কাঁদছে। চোখের পানি গাল বেয়ে বেয়ে পড়ে ওর জামা ভিজে গেছে। মুগ্ধর তো ক্ষমতা নেই এই কান্না থামাবার। আল্লাহ কেন এত কঠিন মুহূর্ত লিখে রাখে কপালে! মুগ্ধ বলল,
-"কাঁদেনা তিতির, কাঁদেনা। আমি বাবাকে হারিয়েছি। আমি বুঝি বাবা হারানোর কষ্টটা কেমন। তুমি অনেক ভাল আর অনেক লক্ষী একটা মেয়ে আল্লাহ তোমাকে এত তাড়াতাড়ি এতটা কষ্ট দেবে না, দেখে নিও কিচ্ছু হবে না বাবার। তুমি তো বাবার কাছেই যাচ্ছো। তোমাকে দেখলে বাবার বুকের কষ্ট একদম কমে যাবে।"
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-"আমাকে ভালবেসে তুমি শুধু কষ্টই পেলে। আমি একটু সুখ দিতে পারলাম না তোমাকে।"
মুগ্ধ বাম হাতটা তিতিরের গালে রেখে চোখ মুছে দিয়ে বলল,
-"পাগলী এভাবে ভেবো না। যা পেয়েছি তা হাজার জনম তপস্যা করেও সবাই পায়না। আমার কোন আক্ষেপ নেই। তুমি আমার ভাগ্যেই লেখা নেই। এটা আমি মেনে নিলাম আজকে, তুমিও মেনে নাও।"
তিতির মুগ্ধর হাতটা ধরে কাঁদতে লাগলো। আজ শনিবার, রাস্তায় কোন জ্যাম নেই কিন্তু রাস্তা শেষই হচ্ছে না। বনানী থেকে ধানমন্ডি এটুকু রাস্তা যেন আজ হাজার মাইলের দূরত্ব হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটা যেন একটা সেকেন্ডের ঘর পার করতে ৫ সেকেন্ড সময় নিচ্ছে।
Author, Publisher & Developer

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উফ!
মনে হচ্ছে আপনার ইন্টারনেট সংযোগে কিছু সমস্যা আছে। অনুগ্রহ করে আগে আপনার ইন্টারনেটের সংযোগ ঠিক করুন এবং তারপর আবার ব্রাউজিং শুরু করুন৷
AdBlock সনাক্ত করা হয়েছে!
আমরা শনাক্ত করেছি যে আপনি আপনার ব্রাউজারে অ্যাডব্লকিং প্লাগইন ব্যবহার করছেন৷ আমরা আপনাকে আপনার অ্যাডব্লকিং প্লাগইন বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করছি, কারন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমরা যে রাজস্ব আয় করি তা এই ওয়েবসাইট পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হয়।