সংসার - পর্ব ০২ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৩!! 

অনুর পিকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল অরণ্য টেরই পায়নি। বুকের উপরে মোবাইলটা কয়েকবার কেঁপে ওঠায় ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে ছেলেটার। মোবাইলের এলার্মটা বন্ধ করে ধীরে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। ফ্রেশ হয়ে এসে একেবারে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েই রুম থেকেই বেরিয়ে এল অরণ্য। একহাতে ফরমাল স্কাই ব্লু শার্টের স্লিভসটা গুটাতে গুটাতে  বাড়ির মেইন ডোর পর্যন্ত এসেই অরণ্যের পা জোড়া থেমে গেল। কিছু একটা ভেবে অরণ্য ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। রান্নাঘরের হালকা করে ভেজিয়ে রাখা দরজাটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ফ্লোরে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা অনুর দিকে তাকালো অরণ্য। মেয়েটার ঘুমন্ত মুখটা দেখে অজান্তেই অরণ্য এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে ফ্লোরে অনামিকার পাশে বসলো। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এবারে একটু ঝুঁকে অনামিকার কপালের বাম পাশের চুলগুলো সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেই অনামিকা কেঁপে উঠতেই অরণ্য ধীরে নিজের হাতটা সরিয়ে নিল। মেয়েটাকে একটু উশখুশ করে আবার চুপ করে শুয়ে থাকতে দেখে অরণ্য আবার আলতো হাতে অনামিকার কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে কপালের বাম পাশের অনেক খানি কাটা জায়গাটা দেখে অরণ্যের চোয়াল আপনাআপনিই শক্ত হয়ে গেল। ধীর পায়ে উঠে বেরিয়ে গিয়ে সোজা নিজের গাড়িতে গিয়ে বসলো অরণ্য। নিজের উপরেই প্রচন্ড রাগ হচ্ছে অরণ্যের। কেন যে নিজের রাগটা সামলাতে পারে না এটা ভেবেই নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে  অরণ্যের। রাগের চোটে গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলেই সজোরে একটা ঘুষি বসালো অরণ্য।

প্রায় তিন মাস পর আজ অরণ্য দুপুরবেলা বাসায় ফিরেছে। বাবা মা আর তাহিয়া খেতে বসেছে। অনামিকা সবাইকে খাবার সার্ভ করছিল এমন সময় অরণ্যকে ডাইনিং রুমে ঢুকতে দেখে সবাই হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব করে অরণ্য নিজের রুমে চলে গেল। মিনিট পাঁচেক পর ফরমাল ড্রেসআপ ছেড়ে একটা টিশার্ট আর টাউজার পড়েই সবার সাথে এসে জয়েন করেছে। বাবা মা কিছুর বলার আগেই তাহিয়া নিজের হাতেই একটা চিমটি করে 'আউ' করে ছোটোখাটো একটা আওয়াজ করেই আবার নিজের মুখ চেপে ধরায় অরণ্যও ভ্রু কুঁচকে তাকালো তাহিয়ার দিকে।

-কি সমস্যা তাহু? নিজেই রাক্ষসীর মতো নখ দিয়ে নিজেকে চিমটি কাটছিস, আবার চিৎকারও করছিস। ব্যাপারটা কি? তোর গন্ডারের মতো চামড়াতে সামান্য চিমটিতেও ব্যথা লাগতে শুরু করেছে কবে থেকে? 

-ভাইয়া ভালো হবে বলে দিচ্ছি। তুই সবসময় এতো আজেবাজে বকিস কেন আমার সাথে? ভাবি সামনে বলে কিছু বলছি না বলে ভাবিস না তাহিয়া চুপ করে থাকার মেয়ে।

-ও রে আমার এংগ্রী কুইন আসছে! চুপচাপ খা। আর আমাকেও শান্তিতে খেতে দে।

-তা তুই আজকে এতো তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরলি যে? কোনো কাজ আছে নাকি বাসায়?

-আমার বাসায় জলদী এসেছি বলে কি তোর কোনো সমস্যা হচ্ছে তাহু? সমস্যা হলে বল চলে যাই। আশ্চর্য! আমাকে এর আগে কোনোদিন দুপুরে লাঞ্চ টাইমে বাসায় আসতে দেখিস নি? এমন রিএ্যাক্ট করছিস যেন এলিয়েন দেখছিস! মানে! তুই কি বড় হবি না কোনোদিন! গাধী কোথাকার!

-এলিয়েন থেকে কমও তো না। বিয়ের পর গত তিনমাসে তোর চেহারাটা দেখেছি নাকি? আমি তো ভাবলাম কোন দিন রাস্তার কোনো ছেলেকে ভাইয়া ভেবে বসবো। আসছে আমাকে গাধী বলতে! ব্যাটা বেয়াদ্দপ!

-বিড়বিড় করে কি বলছিস তাহু? তোকে না বারণ করেছি কানের সামনে এমন ঘ্যানঘ্যান করবি না? শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বরের সামনে এমন করিস। দিবে নি ধরে কয়টা পিঠের উপরে। তখন টের পাবি মজা!

-ও মা! ভাইয়াকে বারণ করো বলে দিচ্ছি। এমন করলে আমি কিন্তু খাবো না একদম।

-তা খাবি কেন? খাবার তো মাগনা আসছে না? বাবা, আমি, মা, বাড়ির সবাই সারাদিন অফিসে বাসায় খেটে খুটে মরবো, আর তুমি জেদ দেখিয়ে 'খাবো না' বলে প্লেট ঠেলে দিবে? ফাইজলামি করো না আমার সাথে? চুপচাপ খাও। 

-দিনদিন এতো এমন হয়ে যাচ্ছিস কেন রে ভাইয়া? অফিসে বসের ঝাড়ি খেয়ে এসে এখন রাগ আমার উপরে ঝাড়ছিস? এই ছোট্ট বাচ্চাটার উপরে! একটুও দয়া হয় না আমার প্রতি তোর? কেমন ভাই রে তুই?

-ছোট্ট বাচ্চা! হা হা হা। ওয়াও! ফ্যান্টাসটিক জোক ছিল এটা। ওয়েট স্নিগ্ধকে ফরওয়ার্ড করছি জোকস টা ওয়েট।

-ভাইয়া ভালো হবে না কিন্তু এবারে বলে দিচ্ছি।

-ওলে ছোট্ট বাচ্চাটা! রাগ করছিস কেন? তোকে একটা নিউজ তো দেয়াই হয়নি। নেক্সট উইকে স্নিগ্ধরা আসছে। মানে ওর বাবা, মা, শান্তা সবাই। 

-এ্যাঁ! আসছে মানে! কোথায় আসছে? কেন আসছে?

-তোকে পার্মানেন্টলি বিদায় করার সময় হয়ে গেছে। পড়ালেখা তো কিছু করবিই না ঠিক করেছিস। আর তাছাড়া স্নিগ্ধরাও চাইছে বিয়েটা এবারে হয়ে যাক।

-মা! বাবা! তোমাদের ছেলে কি শুরু করেছে বলো তো আজকে? হঠাৎ আমার পিছনে লাগছে কেন? আমি কি করলাম ওর সাথে?

-কি আশ্চর্য! তুই কি বিয়েটা করতে চাইছিস না তাহু? ওয়েট আমি স্নিগ্ধকে কল করে কথাটা বলছি। ওকেই নাহয় বল তুই কি চাস?

-ও মা! দেখো না? 

তাহিয়া কাঁদোকাঁদো গলায় মায়ের কাছে বিচার দিতেই এবারে তাইয়্যেবা জামান অরণ্যের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। গতকাল ছেলেটার গায়ে হাত তুলে কিছুতেই চোখে চোখ রাখতে পারছিলেন না। কিন্তু হুট করে অরণ্যের এতো স্বাভাবিক আচরণে কৌতূহলটাও দমন করতে পারছেন না তিনি। এতোদিন পর অরণ্যকে তাহিয়ার সাথে এভাবে খুনশুটি ঝগড়া করতে দেখে যতটা অবাক হলেন, ততটা নিশ্চিন্তও বোধ করছেন। ছেলের মনে কি চলছে জানে না তাইয়্যেবা জামান। তবে যাই চলুক, গতরাতে কথাগুলোয় যে একটু হলেও কাজ হয়েছে সেটা এই মূহুর্তে বেশ টের পাচ্ছে উনি। 

-অরণ্য? কেন খেপাচ্ছিস তাহিয়াকে? জানিসই তো ছোটো মানুষ। তোর দুষ্টুমি বুঝবে না। বাচ্চাদের মতো কান্না না জুড়ে দেয় দেখ।

-বাচ্চা হয়ে থাকলে তো হবে না মা। স্নিগ্ধর বাবা মা ওদের বিয়ের ডেইটটা ফিক্সড করতে চায়। আগামী সপ্তাহে আসতে চায়। তোমরা কি বলো?

-এখানে আমাদের বলার কি আছে? একজন অন্যজনকে পছন্দ করেছে, দুই পরিবার রাজি। বিয়ের কথা বলতে তো প্রবলেম থাকার কথা না। তুমি কি বলো আরহান?

আরহান চৌধূরী এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শুনছিলেন। ছেলে মেয়ের টম এন্ড জেরির মতো ছেলেমানুষি ঝগড়া, আর স্ত্রীর কথাগুলো শুনতে শুনতে খাবার খাচ্ছিলেন। এবারে তাইয়্যেবা জামানের প্রশ্নে একটু হেসে তাহিয়ার দিকে তাকালেন আরহান চৌধূরী।

-আমি আর কি বলবো? স্নিগ্ধকেই বিয়ে করতে চায় কি না প্রশ্নটা তো তাহিয়াকে করা উচিত। নাকি শুধু ভালোবেসেছে বলে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে তোমরা মা ছেলে মিলে? না না। বাবা তোমার পাশে আছি মা। বলো। স্নিগ্ধকে বিয়ে করতে চাও? নাকি অন্য কোনো পাত্র খুঁজবো?

-বাবা! তুমিও শুরু করলে? আমি কিচ্ছু জানি না। আমি গেলাম। তোমরাই শান্তিতে খাও। আমি খাবোও না।

-আরে! তাহু? মা শোন?

-তাহু? চুপচাপ বস এখানে? না খেয়ে চলে যাবি মানে? ফাইজলামি পেয়েছিস? বস বলছি? 

তাহিয়া রাগ করে প্লেটটা রেখে উঠে দাঁড়াতেই এবারে অরণ্যের ধমকে চমকে উঠলো। অরণ্যের দিকে চোখ পড়তেই ভয়ে গুটিশুটি হয়ে আবার নিজের জায়গায় বসে পড়লো। পুরো ডাইনিংরুমটা হুট করে পিন ড্রপ সাইলেন্ট হয়ে গেছে। অরণ্য মুখ নামিয়ে চুপচাপ খাওয়ায় মন দিলো। ও যে ইচ্ছে করে তাহিয়াকে ধমকেছে তেমনটাও নয়। এতোক্ষণ ওদের কথা বলার পুরোটা সময় অনু সবাইকে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছিল। অরণ্য আর তাহিয়ার খুনশুটিগুলো দেখে মেয়েটার ভাবুক ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির ঝলক দেয়া দিয়েছিল। সবাইকে খাবার সার্ভ করা হয়ে গেলে অনামিকাকে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে দেখেই এভাবে রিএ্যাক্ট করে ফেলেছিল। অরণ্যের এভাবে রেগে যাওয়ায় বাকিদের মতো অনুও চমকে উঠেছিল। লোকটার এতো রাগ কেন সেটাই বুঝতে পারে না অনামিকা। মাঝে মাঝে মনে হয় এই শান্ত মানুষটার সমস্ত রাগের একমাত্র কারণ ও নিজেই। লোকটা হয়তো রাগটা সবার সামনে প্রকাশ করে বলে সবাই জানতে পারে বা ভাবে ছেলেটা কি বদরাগী! কিন্তু অনু যে রাগ, ক্ষোভগুলো নিজের মধ্যেই চেপে রেখেছে সেগুলো তো বাইরে থেকে কেউ বুঝতেও পারে না। যদি বুঝতো, তাহলে ওকে কি বলতো? 

-মা? সবাইকে একসাথে খেতে বসতে বলো। আগের মতো সবাই একসাথে বসে খেয়ে নিব আজ থেকে। 

-সবাই তো খেতে বসেছে অরণ্য। 

-মা সবাই মানে সবাই। আমরা বসে বসে খাবো, আর যারা কাজ করছে তারা সার্ভ করে দিয়ে চলে যাবে তা তো হওয়া উচিত না। আজ থেকে সবাই একসাথে বসে খাবো। সবাইকে খেতে ডাকো।

-সবাই আর কে? অনুর খাওয়া বাকি। মেয়েটাকে তো কতোক্ষণ থেকেই বলছি খেতে বসতে? এই অনু? লক্ষী মা না? এবার তো খেতে এসো?

-সম্ভবত উনি একমাত্র না যে বাসায় কাজ করে। ফুলির মা ছিল না? উনাকেও ডাকো? খেয়ে নিক। যাওয়ার সময় মেয়ের জন্যও খাবার পাঠিয়ে দিও।

-কোথায় ফুলির মা? সে তো আরো দু মাস আগেই কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। বাড়িতে কোনো কাজ থাকে না, তার কাজ না করে মাইনে নিতে নাকি লজ্জা লাগে, তাই------।

-কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে আর কথাটা তোমরা আমাকে একবার বলারও প্রয়োজন বোধ করলে না?

-কেন? তোকে বলে কি হবে? কাজ তো হয়েই যাচ্ছে। সবাই মিলে হাতে হাতে কাজগুলো করে নিচ্ছি আমরা। তাছাড়া তোর এনে দেয়া কাজের বউ তো দারুণ কাজ করে। একা হাতে সবদিক সামলে নেয়। আর কাউকে লাগবেও না। অনু? খেতে বসো?

-আরে না না! মা আমি পরে খাবো। আপনারা খেয়ে নিন। 

খাবো না কথাটা বলতে বলতে অরণ্যের দিকে চোখ পড়তেই চুপচাপ একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো অনামিকা। প্লেটে খাবার নিতে নিতে ভাবছে মেয়েটা। এই লোকটার আজ হলোটা কি? এভাবে হুটহাট রেগে যাচ্ছে, এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন আস্ত চিবিয়ে খাবে। কেন? আর অরণ্যও অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছে। ভাবছে এই মেয়েটা এতো কিছু সহ্য করেও পড়ে আছে কেন? জেদ দেখাচ্ছে? নাকি অন্য কোনো প্ল্যানিং চলছে মেয়েটার মাথায়? নাকি সবটা নিছক অরণ্যের মনের ভুল?

০৪!! 

লাঞ্চ করে বড়জোর আধ ঘন্টা রেস্ট করে আবার বেরিয়ে গেছে অরণ্য। আগেরবার মতো ফরমাল ড্রেসআপ না, ক্যাজুয়েল একটা শার্ট আর গার্ভাডিং পড়ে শার্টের স্লিভ জোড়া ভাঁজ করতে করতে বেরিয়ে গেছে ছেলেটা। অরণ্য অনুকে খেয়াল না করলেও অনু ঠিকই লোকটার বেরিয়ে যাওয়া খেয়াল করেছে। এই ভর দুপুরে লোকটা কোথায় যাচ্ছে প্রশ্নটা মনের কোণে উঁকি দেয়ার আগেই মেইন ডোরটা বন্ধ করে দিয়ে চুপচাপ রান্নাঘরের ফ্লোরে গা এলিয়ে দিল মেয়েটা। গত কয়টা দিন ধরে শরীরটা বড্ড বেশিই ক্লান্ত লাগছে অনুর। তার উপরে রাতে কপালের খানিকটা কেটে যাওয়ায় হয়তো শেষ রাতের দিকে কিছুটা জ্বরজ্বর লাগছিল। এখন খাওয়ার পর সেই ক্লান্ত ভাবটা আবার ফিরে এসেছে। এতো ক্লান্ত লাগছে যে না চাইতেও চোখ জোড়া ক্লান্তিতে বারবার বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমের কাছেই হার মেনে নিল মেয়েটা। ক্লান্ত শরীরে আর কতোক্ষণই বা ঘুমের সাথে যুদ্ধ করবে?

অনামিকার ঘুম ভাঙ্গলো বেশ কয়েকবার কলিংবেল বাজার শব্দে। ক্লান্ত চোখ জোড়া মেলে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো মেয়েটা। অনামিকার রান্নাঘর থেকে মেইন ডোরের সামনে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরো দু বার কলিংবেল বাজালো। অনু প্রায় ছুটে এসে দরজাটা খুলে দিতেই অরণ্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক পা পিছিয়ে এলো। অরণ্য ভ্রু কুঁচকে একনজর অনামিকার মুখের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো।

-গেইটে দারোয়ান আছে। মেইন ডোর লক করার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিল? দিন দুপুরে বাড়িতে নিশ্চয়ই ডাকাত পড়ছে না? 

অরণ্যের এমন আগামাথা ছাড়া কথাগুলো রীতিমতো বোকার মতো ঠেকলো অনামিকার কাছে। গেইটে দারোয়ান আছে মানছি, তাই বলে বাড়ির মেইন ডোর খোলা করে সবাই দুপুরে ভাতঘুম দিবে এটা একটু বাচ্চাদের মতো বাহানা হয়ে গেল না কি? লোকটা ইচ্ছে করে এমন বোকার মতো কথা বলে? নাকি অনুকে খোঁচা দেয় এসব বলে একমাত্র উপরওয়ালাই ভালো জানেন! অনামিকা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়েই অরণ্যের পিছন পিছন একটা মেয়েকে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দেখে পা জোড়া থমকে গেল অনুর। ততক্ষণে মা, বাবা, আর তাহিয়াও এসে জড়ো হয়েছে ড্রইংরুমের সামনে। মেয়েটাকে দেখে সবাই একটু অবাকই হলেন। অনামিকাও ততক্ষণে মেয়েটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। সাদামাটা একটা শাড়ি পড়নে হলেও শাড়িটা একদম পাটভাঙা নতুন শাড়ি। গ্রাম্য ঢঙে শাড়িটা কোমড়ে পেঁচিয়ে আছে, তবু কোথাও যেন মেয়েটার পোশাকে, চাল চলনে শহুরে একটা টান রয়ে গেছে। সেটা সবারই চোখে পড়ছে। অরণ্য একনজর অনামিকার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে বাবা মায়ের দিকে তাকালো। তাইয়্যেবা জামান ছেলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ভাবছেন কি চলছে ছেলেটার মনে। আর এই মেয়েটাই বা কে!

-এমন অবাক চোখে তাকানোর কিছু নেই মা। ও হচ্ছে ফারহা। আমার অফিসের এক স্টাফের বোন। ওর ভাই ব্যাচেলর একটা লজে থেকে চাকরি করে। কিছুদিন আগেই মেয়েটার মা মারা গেছে। যাওয়ার মতো আর জায়গা নেই দেখে ভাইয়ের আশ্রয়েই এসেছে। কিন্তু --------।

-এতো বড় ঢাকা শহরে ওর কোনো আত্মীয় নেই? কোনো আত্মীয়ের বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা না করে বাড়িতে নিয়ে এলি কেন?

-এই ব্যস্ত শহরে কয়দিনইবা আত্মীয়ের বোঝা হয়ে থাকবে। তাই একটা কাজ খুঁজছিল। ফুলির মা তো নেই, তাই ওকেই নিয়ে এলাম। টুকটাক কাজ করবে, আর আমাদের বাড়িতেই থাকবে।

-মানে! এই মেয়ে বাসার কাজ করবে? তোর মাথাটা কি গেছে অরণ্য? 

-কেন করবে না? ফারহা? তুমি পারবে না ঘর ঝাড়ু দেয়া, বাসন মাজা এসব কাজগুলো করতে? ফারহা?

ফারহা নামের মেয়েটা একটু অবাক অবাক ডাগর চোখে বাড়িটা দেখছিল এতোক্ষণ। অরণ্যের প্রশ্নটা ওর কান পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা কে জানে। শেষে অরণ্য একটু জোর গলায় মেয়েটার নাম ধরে ডাকতেই মেয়েটা একটু চমকে মাথা নেড়ে জানালো পারবে। মেয়েটার এমন অদ্ভুত আচরণে সবাই অবাক হলো নাকি বিরক্ত হলো বোঝা গেল না। অরণ্য একটু ইতস্তত করে একটা সোফায় গা এলিয়ে দিল। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি যে ফারহার দিকে সেটা না দেখেও টের পেল অরণ্য।

-মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে। কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে আনো তো ফারহা। আমি তোমার থাকার রুমের ব্যবস্থা করছি।

-স্যার আমি তো চা বানাতে পারি না। কিন্তু কফি বানাতে পারি। ভাইয়া বলতো দারুণ হয়। আপনার জন্য এক কাপ বানাই?

ফারহার কফি বানানোর প্রস্তাব শুনে সবাই একবার ফারহার দিকে তাকাচ্ছে আর একবার অরণ্যের দিকে। এই মেয়েটার হাবভাবের সাথে বাসায় কাজ করার ব্যাপারটা কেন জানি যাচ্ছে না একদমই। তাহিয়া এবারে বেশ কিছুক্ষণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে ফারহার দিকে তাকালো।

-এই মেয়েটা সত্যিই কাজ করবে? আই মিন রান্না করা, ধোয়া মোছা এসব! সিরিয়াসলি ভাইয়া? তোর মনে হয় এই মেয়ে আধো এসব করেছে কখনো? দেখে তো মনে হচ্ছে না।

-প্রয়োজন যখন মাথা চাড়া দেয় তখন পারবে কি পারবে না এসব ভাবার সময় থাকে না। ফারহা ওদের গ্রামেরই একটা কলেজে পড়ালেখা করেছে। আমার ধারণা তোর চেয়ে ওর রেজাল্ট একটু হলেও ভালো। 

-ভাইয়া? আহহহ। আমি গেলাম। তোর যা ইচ্ছে কর গে। 

আরহান চৌধূরী ছেলেকে কিছু বলতে গিয়েও তাইয়্যেবা জামানের ইশারায় থেমে গেছেন। তাহিয়া ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমের দিকে চলে যেতেই বাকিরাও ধীর পায়ে নিজেদের রুমের দিকে পা বাড়ালো। অনামিকাও বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। অরণ্য আর মেয়েটার মাঝে কি চলছে সেটাই বারবার মনে কাঁটার মতো খচখচ করছে অনামিকার। উত্তর পাবে না জেনেও বারবার অরণ্যের বলা কথাগুলোই নিজের মনে ভাবার চেষ্টা করলো অনামিকা। লোকটার বলা কথাগুলো আসলে কতোটুকু সত্যি সেটাই ভাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে চুলায় চায়ের জন্য পানি বসালো অনামিকা। 

অন্যদিকে সবাই চলে যাওয়ার পর ফারহা পা টিপে টিপে অরণ্যের সামনে এসে দাঁড়াতেই অরণ্য মুখ তুলে তাকালো। মেয়েটা একটু ইতস্তত করে কিছুর বলার চেষ্টা করছে বুঝতে পেরে অরণ্য সোফায় সোজা হয়ে বসে তাকালো মেয়েটার দিকে।

-কিছু কি বলতে চাচ্ছ? বলার থাকলে বলো। নয়তো গিয়ে ম্যাডামকে হেল্প করো যাও। আশা করি কি জন্য তোমাকে নিয়ে এসেছি বাড়িতে ভুলে যাও নি?

-স্যার। আপনার বোন তো ঠিক কথাই বলেছে। আমি তো আসলেই কখনো এসব কাজ করি নি। কফি বানানো ছাড়া আর কোনো কিছুই তো পারি না। সবাই যদি বুঝতে পারে----।

-মনে হচ্ছে তোমার জবটা চাই না তাই না মিস ফারহা শেখ? আমার এসিস্ট্যান্টের পোস্টটা পাওয়ার জন্য এমনও ক্যান্ডিডেট আছে যারা বললে আরো কঠিন কোনো পরীক্ষাতেও হাসতে হাসতে পাশ করে ফিরে আসবে। আর তুমি এই সামান্য কাজগুলো করতে পারছ না? 

-সরি স্যার। আসলে আমি কখনো এসব করি নি। বাসার যা কাজ মাই করে।

-দ্যাটস গুড। কাজগুলো করতে গিয়ে অনুমান করতে পারবে তোমার মা সারাদিন কত কষ্ট করেন তোমাদের জন্য। যদিও তোমার খুব বেশি কষ্ট হবে বলে আমার মনে হয় না। যা ভাবছি তা যদি ঠিকঠাক মতো করতে পারো তাহলে ম্যাডাম তোমাকে কোনো।কাজই করতে দিবে না।

-ম্যাডাম তো এমনিতেও যেমন লুক দিলেন, মনে হয় না আপনাদের বাড়িতে দু দিনের বেশি টিকতে পারবো।

-দ্যান, দ্যাট ইজ ইওর ব্যাড লাক। তোমার বদলে তাহলে অন্য কোনো ক্যান্ডিডেটকে সিলেক্ট করতে হবে।

-নো নো নো স্যার। আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিব। প্রমিস। প্লিজ স্যার প্লিজ? আমার ফার্স্ট জব। এভাবে ডিসমিস করে দেবেন না প্লিজ?

-দ্যান মিস ফারহা শেখ। গো ব্যাক টু ইওর ওয়ার্ক?

-ওকে স্যার। ইয়েস স্যার। 

ফারহা হাতে ছোট্ট পুটলির মতো জিনিসটা কোলের মধ্যে শক্ত করে জাপটে ধরে অনামিকার যাওয়ার করিডোরটা দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবার কিছু একটা কনফিউশান নিয়ে অরণ্যের সোফার কাছে ফিরে এলো। অরণ্য ভ্রু কুঁচকে আবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

-এবার কি হয়েছে? অনুর চা বানানো শেষ হলে তারপর কি তুমি রান্নাঘরে যাবে? 

-একচুয়েলি আই হ্যাভ এ কোশ্চেন স্যার। একচুয়েলি কোশ্চেন না। কনফিউশান। আপনি হাউজ সার্ভেন্ট হিসেবে আমাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন বুঝলাম। বাট এই নতুন শাড়িটা কেন পড়তে দিলেন? সার্ভেন্টদের ড্রেসাপ তো এমন হয় না। ওরা কতো পুরোনো কাপড় পড়ে। যে কেউ তো দেখলেই বুঝবে আমি আসলে---। মানে বলছিলাম যে সবাই তো ধরে ফেলবে স্যার? তখন আপনাকে তো কিচ্ছু বলবে না। মাইর সব তো আমার পিঠেই পড়বে। 

-নাইস কোশ্চেন। তোমার মনে জাগা সেইম কনফিউশানটা যেন তোমার ম্যাডামের মনেও জাগে তার জন্যই তোমাকে এভাবে সাজিয়ে আনা হয়েছে। নইলে আমাকে তো পাগলে পায় নি যে কাজের জন্য মেয়ে নিয়ে আসবো আর তার হাতে দামি স্মার্টফোনটা আমি খেয়াল করবো না, রাইট?

-ওপস! সরি--সরি স্যার। মোবাইলের কথাটা আমার একদমই খেয়াল ছিল না। এবার কি হবে স্যার? ম্যাডাম তো মোবাইল দেখলেই টের পেয়ে যাবে আমি কাজের মেয়ে নই। না না। যদি চোর মনে করে সবাইকে দিয়ে মার খাওয়ায়? ও স্যার?

-ইডিয়েট একটা মেয়ে! একটা সামান্য কাজের জন্য এতো ভয় পাচ্ছে। এতো ভয় পেলে কাজটা করবে কি করে? জাস্ট গেট আউট আই সেইড। তোমার কিছু করাই লাগবে না। আউট?

-স্যার? ম্যাডাম চলে এসেছে। আমমম। সরি স্যার। আর ভুলভাল কিছু বলবো না। প্রমিস। এবারের মতো সরি। প্রমিস প্রমিস।

অরণ্য বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে আবার সোফায় গা এলিয়ে হেলান দিতে দিতেই অনামিকা ড্রইংরুমের দিকে এগিয়ে এলো। ফারহা নিজের মনে আল্লাহকে ডাকছে। ভাগ্যিস অনামিকা আসার আগেই করিডোরে দেখে ফেলেছিল ও। নইলে আজ সদ্য পাওয়া চাকরিটা তো যেতই, হয়তো ধোলাইও খেতে হতো ফ্রি তে। অনামিকাও চায়ের কাপটা টি টেবিলের উপরে রেখে একনজর অরণ্য আর ফারহার দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করলো এরা দুজন এতোক্ষণ কি গুজগুজ ফুসফুস করছিল। কি এমন কথা বলছিল যে অনামিকাকে আসতে দেখে থেমে গেছে? 

-স্যার? আপনার চা। ম্যাডাম কত তাড়াতাড়ি চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। আমাকেও শিখিয়ে দিবেন প্লিজ?

-মিস ফারহা? কাউকে বলুন আপনার জন্য গেস্টরুমটা খুলে দিতে। আপনার থাকার ব্যবস্থা কাল করে দিব। আজ প্রচন্ড মাথা ধরেছে। কিছুক্ষণ রেস্ট করবো। কেউ যেন বিরক্ত না করে।

-ইয়েস স্যার। আমি বলে দিবো। 

অরণ্য হতাশ একটা ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে একহাতে চায়ের কাপটা নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। এই মেয়েটা কি যে গন্ডগোল বাঁধাবে এটা ভাবতে গিয়ে সত্যি সত্যিই বেচারার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। আর অরণ্য চলে যেতেই অনামিকাও রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে দেখে ফারহাও ছুটলো ওর পিছু পিছু। হাতের মোবাইলটা কোনো এক ফাঁকে কাপড়ের পুটলিতে ভরে নিজের কাজেই মন দেয়ার চেষ্টা করেছে মেয়েটা। অনামিকা রান্নাঘরে গিয়ে দুপুরের এঁটো বাসন মাজা শুরু করেছে ততক্ষণে। ফারহাও কি করবে। গুটিশুটি হয়ে অনামিকার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে।

-আচ্ছা ম্যাডাম? আপনার নামটা তো জানা হলো না? সবার সাথে পরিচয় হলো? স্যারের বাবা, মা, বোন। আপনার সাথে তো পরিচয় হলো না? কে হন আপনি স্যারের?

-তোমার মতোই, কাজের মেয়ে। 

-হ্যাঁ! আপনিও স্যারের এসিস্ট্যান্ট? তাহলে আপনার খেয়াল রাখতে কেন বললো? 

-কি? বুঝলাম না। আমাকে কিছু বললে?

-হ্যাঁ? না না। নাম টা জানাই হলো না আপনার।

-অনু। অনামিকা।

-হি হি? অনামিকা? যার কোনো নাম নেই? দারুণ তো! হি হি। এর চেয়ে অনু নামটাই ভালো। অনু ম্যাডাম। 

এঁটো একটা প্লেট হাতে নিয়ে অবাক চোখে ফারহার হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে অনু। এই মেয়েটার কথাবার্তাগুলো এমনিতেই খাপছাড়া লাগছিল এতোক্ষণ অনামিকার কাছে। এবারে তো সবটাই মাথার উপর দিয়ে গেল। এসিট্যান্ট, খেয়াল রাখা কিছুরই মানে বুঝতে পারছে না মেয়েটা। শুধু এটা বুঝতে পারছে কিছু একটা প্ল্যানিং চলছে অরণ্য আর এই মেয়েটার মধ্যে। কিন্তু কি সেটা?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন