অলকানন্দা - পর্ব ১৯ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!৫৫!!

কারো বুকের ধুকপুক আওয়াজে ঘুম ভাঙলো মাহার। মাথাটায় প্রচুর ব্যথা করছে। চারিদিক ধোঁয়াশার মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন। থেমে থেমে স্পষ্ট হয় সব। নিজের পাশে সার্থক কে দেখে যারপরনাই অবাক হয় মাহা। দুর্বল স্বরে চিৎকার করে উঠে। মাহার চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সার্থক। সারারাত ঘুম হয়নি। মাথা ভারী লাগছে তার। উঠে বসে ডান হাতটা এগিয়ে জ্বর মেপে নেয় মাহার। কমে এসেছে দেখে শান্তি পায় সে। মাহা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। হলদে মুখটা কি যে আদুরে লাগছে! সার্থকের ইচ্ছে করছে গালে একটু আদর দিতে। নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে নেয় সে। 
"আ..আমি কোথায়?"
দুর্বল কন্ঠ মাহার। সার্থক সামান্য হেসে বলে,
"তোমার স্বামীর বাড়ি।"
"মানে?"
"আমি তোমার স্বামী। এটা আমার বাসা।"
"আমি এখানে কিভাবে?"
"বড্ড প্রশ্ন করো তুমি মাহা। চলো ফ্রেশ হয়ে নেও। ব্রেকফাস্ট করে ঔষধ খেতে হবে।"

নিজের দিকে তাকিয়ে আরো অবাক হলো মাহা। তার গাঁয়ে এসব কি! এটা তো ছেলেদের টি-শার্ট আর টাউজার। চিন্তিত, ক্লান্ত, দুর্বল স্বরে সে প্রশ্ন করে,
"আমার গাঁয়ে এসব কেন?"
"আমি তোমার স্বামী মাহা। আমি পরিবর্তন করে দিয়েছি।"

মাহা স্তব্ধ হয়ে আছে। এমন অকপট সত্যের উত্তরে কি বলবে সে। কোনো ভাষা তো খোঁজে পাচ্ছেনা! হঠাৎ তড়িৎ গতিতে সজাগ হয় মস্তিষ্ক। বাবা! বাবা তো আর নেই! মাহার একমাত্র আপন মানুষটাও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। মাহা কি নিয়ে বাঁচবে। অশ্রুরা এসে ভিড় জমালো মাহার নয়নে। মাহার কান্নার শব্দে ভরকে যায় সার্থক। 

"এই কান্না করছো কেন তুমি? আমি সত্যি তোমার সাথে কিছু করিনি মাহা।"

মাহার কান্না থামছেনা। সার্থকের বুকে যে ব্যথা হচ্ছে। 
"প্লিজ মাহা কেঁদো না। আমাকে বলো আমি কি কিছু করেছি?"

মাথা নাড়ায় মাহা। 
"আপনার কোনো দোষ নেই সার্থক। আমার বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে গতকাল। বহুদূরে।"

মাহার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। নিজেকে সামাল নেওয়া দায়। সার্থক বুকে আগলে নেয় মাহাকে। মাহাও যেন আশ্রয় খুঁজে পায়। 

________________

"মাহাকে তার মা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। হোসেন ভাই মারা গেছেন।"
"কি!"

মায়ের মুখে এমন কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় রেজওয়ান। খুব রাতে বাড়ি ফিরেছিলো ছেলেটা। তাই সাবিনা বেগম ছেলেকে কোনো কথা বলেন নি। তিনি তো জানেন রেজওয়ান কতটা চায় মাহাকে। নাস্তা খেয়েই রেজওয়ান ভেবেছিলো মাহার সাথে দেখা করতে যাবে। মায়ের মুখে এসব শুনে নাস্তা খাওয়া হলোনা তার। দাঁড়িয়ে গেলো সে। ছেলেকে বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সাবিনা বেগম বললেন,
"নাস্তা করে যা।"

অসহায় চোখে মায়ের পানে তাকালো রেজওয়ান। মা কি বুঝেনা রেজওয়ানের ঠিক কতটা কষ্ট হচ্ছে! সে আর কথা বাড়ায় নি। চুপচাপ পাশে রাখা ওয়ালেট আর রিভলবার নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে । সোজা পথে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই মাহার বাড়ি। রেজওয়ান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় চারতলায়। কিন্তু হতাশ হয় । দরজায় তালা দেওয়া। মাহার কাছে তো মোবাইলও নেই। কোথায় গেলো মেয়েটা!

!!৫৬!!

"ভাইয়া?"

এশার কন্ঠে পিছু ফিরে রেজওয়ান। শ্যাম বর্ণের মেয়েটার ভীতু চাহনি। বিচলিত কন্ঠে রেজওয়ান প্রশ্ন করে,
"মাহা, মাহা কোথায় গিয়েছে? জানো?"
"আমি সঠিক বলতে পারবোনা ভাইয়া। গতকাল ফুপি আপুকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।"
"মগের মুল্লুক নাকি! একটা জলজ্যান্ত মানুষ কে তার নিজের বাসা থেকে বের করে দিলো। আর তোমরা বসে বসে দেখছিলে। এতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন কি করে হও তোমরা!"

ধমকে উঠলো রেজওয়ান। এশা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয় মানুষটার মুখে এমন ধমক শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় এশা। মাথার চুলগুলো আলতো টেনে নিজেকে সামলায় রেজওয়ান। এমনিতেই সকাল থেকে মন মেজাজ বিগড়ে আছে। কিছু না বলেই নিচে নেমে আসে । চারতলায় একটা মেয়ে যে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে খেয়াল কি আছে তার! 

পুলিশ স্টেশনে ইনভেস্টিগেশনে মন নেই রেজওয়ানের। কোথায় খুঁজবে মাহাকে ! এদিকে কেসের তদন্ত। মোবারক জানিয়েছেন সিলেটে তিনি কোনো ক্লু খুঁজে পাননি। ফিরে আসবেন আগামীকাল। এদিকে স্যার সময় দিয়েছেন এক সপ্তাহ। এক সপ্তাহের ভিতর একটা রিপোর্ট জমা দিতে বলেছেন এসপি প্রলয়। বিভিন্ন চ্যানেল, নিউজ পেপারে লেখালেখি হচ্ছে এই ব্যাপারে। আতঙ্কিত দেশের মানুষজন। 
"আসবো মিঃ রেজওয়ান ?"
"আসুন। মিস তাজ।"

তাজ ভিতরে এসে বসলেন। হাতের ফাইলটা এগিয়ে দিলেন রেজওয়ানের দিকে। 
"এটা ২০১২ সালের তদন্তের ফাইল।"

রেজওয়ান বিস্মিত হয়ে বলে,
"কোথায় পেলেন?"
"পেয়েছি। কোনো এক সূত্রের মাধ্যমে। সম্পূর্ণ নয়। আংশিক তদন্তের বিস্তারিত আছে। ভিক্টিমের ডিএনএ রিপোর্ট আসতে দেরি হবে। আমাদের উচিত মাতব্বর শরীফের সাথে সেলে দেখা করা।"
"আমিও এই কথাই ভাবছিলাম মিস তাজ। ঘটনার কত সময় পেরিয়ে গেলো। অথচ আমাদের হাতে কোনো তথ্য নেই।"

তখনই ফোন বেজে উঠলো রেজওয়ানের। একটা অপরিচিত নাম্বার। 
"হ্যালো কে?"
"ভাইয়া, আমি মাহা।"
"মাহা, কোথায় তুমি? আন্টি এমন একটা কাজ করলো! তুমি আমাদের বাসায় চলে আসোনি কেন? এখন কোথায় তুমি?"
"আমি নিরাপদ আছি, ভাইয়া। চিন্তা করবেন না। বাবাকে কোথায় কবর দিয়েছে?"

অশ্রুসিক্ত গলায় বলে উঠলো মাহা।

"তোমাদের গ্রামে। নারায়ণগঞ্জ। কোথায় তুমি মাহা?"

"ভাইয়া, আপনি তো জানেন এই ঢাকা তে আমার আপন বলতে কেউই নেই। আপনাকে আমি আমার বড় ভাইয়ের স্থানে বসিয়েছি ছোট থেকেই। আপনি কি একটু গুলশান আসতে পারবেন। কিছু কথা ছিলো আপনার সাথে।"
"আমি আসছি।"

ল্যান্ডলাইনের ফোন দিয়ে রেজওয়ান কে কল করেছিলো মাহা। মাত্রই গোসল করে বাইরে এসেছে সে। সার্থকের ঘরটা ভিষণ বড়। দেয়ালে লাল রঙা কারুকাজ। রাজকীয় খাট, ওয়ারড্রব, পাশে বিশাল বুকশেলফ। ছিমছাম, পরিপাটি ঘর। 

"কার সাথে কথা বলছিলে মাহা?"
"রেজওয়ান ভাইয়া।"

রেজওয়ান নামটা শুনেই চরম বিরক্ত হলো সার্থক। অজানা কারণে রেজওয়ান কে বিরক্ত লাগে সার্থকের কাছে। চরম বিরক্তি লুকিয়ে স্নিগ্ধ চোখে মাহার পানে তাকালো সার্থক। কি অপরূপ তার অলকানন্দা! লাল টকটকে থ্রি পিসে কি যে মায়াবী লাগছে। মাথায় তোয়ালে প্যাঁচানো। সার্থক কে এমন গভীর চোখে তাকাতে দেখে লজ্জা, অস্বস্তি ঘিরে ধরে মাহাকে। দীর্ঘ সময় কান্নার ফলে চোখ দুটো টকটকে লাল তার। 

!!৫৭!!

"ভাবীকে নাস্তা খাওয়াবেনা ভাইয়া?"

নিভার হাসিমাখা কথায় ঘোর ভাঙে সার্থকের। মাহা যেন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হলো। 
"নিভা। ঘরে আসো।"

ঘরে ঢুকে নিভা। সোনালী চুলের বিদেশি রমনী। দেখে বুঝার উপায় নেই এই মেয়েটা কে। কারণ সার্থকের সাথে কোনো মিল নেই তার। সার্থক তার গম্ভীর কন্ঠে বলে,
"মাহা, ও আমার বোন। নিভা।"

মাহা কি বলবে বুঝে পেলোনা। লোকটা সেই কখন থেকেই মাহার সাথে এমনভাবে কথা বলছে যেন মাহা তার কতদিনের পরিচিত। আচ্ছা, মাহার তো এই পৃথিবীতে কেউ নেই। বিয়েটা তার সার্থকের সাথে হয়েছে। এই কথাটাও সত্য। সার্থকের কথা শুনে মনে হচ্ছে সে তাকে বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায়। মাহা যদি মেনে নেয় তাহলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে! 

"চলো ভাবি। নাস্তা করবে।"

মাহা জানেনা কেন। তবে সে তাকালো সার্থকের পানে। সার্থক মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই সে বাইরে বেরিয়ে এলো নিভার সাথে। বাড়িটা ডুপ্লেক্স। উপরে দুইটা রুম আর বিশাল বারান্দা। একরুমে তালা দেওয়া। অপরটা সার্থকের। বারান্দায় হরেকরকম ক্যাকটাস গাছ লাগানো। দুয়েক রকম ফুল গাছও আছে। দুইটা বেতের চেয়ার। মাঝে টেবিল। সম্পূর্ণভাবে দেখার সুযোগ হয়নি মাহার। নিভার সাথে নিচে চলে এলো সে। টেবিলে বসে আছে তিনজন পুরুষ। মাহা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তখনই নিচে নেমে এলো সার্থক। মাহার হাতটা আলতো করে ধরে বললো,
"চলো।"

সাহস পেলো মাহা। ডাইনিং টেবিলে সার্থক নিজের পাশে বসালো মাহাকে। রুটি, জেল, স্যূপ, গরুর মাংস, সবজি ভাজি হরেকরকম খাবারে সাজানো টেবিল। নিভা মুইংচিন কে দেখিয়ে বললো,
"ভাবি, মুইংচিন ভাইয়ার সেক্রেটারি। উনি চীনের বাসিন্দা। শান ধর্মাবলম্বী।"

ছোট ছোট চোখ আর চাইনিজ চেহারা বিশিষ্ট মুইংচিনের পানে তাকালো মাহা। বয়সে তো অনেক বড় হবেন মুইংচিন। মাহা কি বলে সম্বোধন করবে। ভাবনার মাঝেই মুইংচিন বললো,
"বাবি, আপনি আমাকে মুইংচিন বলেই দাকবেন।"

আদো আদো বাংলা বুলি। ভালোলাগে শুনতে। মাহা মাথা নাড়লো। নিভা এবার রবার্টকে দেখিয়ে বললো,
"ভাবি, ও আমার হাসবেন্ড। রবার্ট। রবার্ট ড্যানিয়েল নাইট। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার।"
"হ্যালো, বাবি।"

রবার্টের কথায় হালকা হাসলো মাহা। এবার সার্থক বললো,
"আর ও হচ্ছে আমার বন্ধু লুবান।"

শ্যামলা বর্ণের বলিষ্ঠ পুরুষ লুবান। মাহা সেদিকে তাকিয়ে বললো,
"আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।"
"ওয়ালাইকুম আসসালাম, ভাবি।"

বিভিন্ন কথার মাঝেই নাস্তা খাওয়া শেষ হলো সকলের। রবার্ট, লুবান বাইরে বেরিয়ে গেলো। নিভা, মুইংচিন রয়ে গেছে বাসায়। মাহা শান্ত হয়ে বসে আছে। কোথায় যাবে এখন! সার্থকের ঘরে কি! 

"মাহা?"

সার্থকের ডাকে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় মাহা। মাথা নিচু করে বলে,
"জ্বি?"
"আমার সামনে কখনো মাথা নিচু করে রাখবেনা মাহা। রাণীর মতো মাথা উঁচু করে থাকবে। ঘরে চলো।"

বলেই আর দাঁড়ালো না সার্থক। হনহনিয়ে উপরে চলে যাচ্ছে সে। মাহাও চললো পিছুপিছু। দুজন পরিচারিকা দূর থেকে তা দেখে মিটিমিটি হাসছেন। 

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো সার্থক। মাহা কিছুক্ষণ আগে এসে তার পিছনে দাঁড়িয়েছে। 
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন