আড়ালে আবডালে - পর্ব ২০ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


কফির গরম ধোঁয়ার উষ্ণতা মুখে এসে লাগছে। তার অবশ্য কারণও আছে। নিহি যেখানে শুয়ে আছে, ওর মুখের পাশেই কফির মগ রাখা। যা ভাবছেন, তা নয়। কফিটা নিহির জন্য নয়। আমান নিহির পাশে বসে কফি খাচ্ছে আর ফাইল ঘাটছে। ফাইল ঘাটার সময়ই মূলত কফির মগটা নিহির মুখের পাশেই রাখছে। সকাল বোধ হয় তখন সাত'টা বেজে নয় কী ছয় হবে! আট-টার দিকে আমান অফিসে যাবে। নিহি এখনো ঘুমাচ্ছে। এটাই ভালো লাগছে না আমানের। তার কারণ কি নিহির ঘুম আমানের সহ্য হচ্ছে না? না, তাও নয়। আমান চাচ্ছে নিহি তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠুক। কারণে-অকারণেই রাগ দেখাক। কথায় আছে না, রাগের মানুষ রাগ না দেখলে দিন শুভ যায় না? আমানের অবস্থাও এখন ঠিক তেমন। আর তাই তো ঘুম ভাঙতেই কফি বানিয়ে নিহির রুমে চলে এসেছে। বিছানায় নড়াচড়া অনুভব করে নিহি চোখ মেলে তাকায়। চোখে তখনো ঘুমের রেশ। মিটিমিটি করে তাকাতেই আগে দেখতে পায় আমানকে। নিহি শোয়া থেকে উঠে বসে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
"আপনি এখানে কেন?"
"আমি না থাকলে কে থাকবে?" কফিতে চুমুক দিয়ে উত্তর দেয় আমান।

ঘুম থেকে উঠলে নাকি সবার মন ফ্রেশ থাকে। সতেজ থাকে। কিন্তু নিহির বেলায় অন্যরকম। ঘুম থেকে উঠার পর নিহির মনমেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। রাগ যেন মাথার প্রতিটি চুলের ডগায় ডগায় থাকে। তখন উল্টা-পাল্টা কথা তো দূরে থাক, কারো ভালো কথাও সহ্য হয় না। অতিরিক্ত প্রশ্ন তো একদম নয়। সেখানে এই লোক তিড়িংবিড়িং উত্তর দিচ্ছে! রাগ হবে না আবার? এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। দাঁতমুখ খিঁচে বলে,
"আপনি হুটহাট কেন আসবেন আমার রুমে?"
"আরে বাহ্! আপনি দরজা খোলা রাখতে পারেন আর আমি আসলেই দোষ?"
"আমি কি জানতাম আপনি এত বজ্জাত?"
"এখন তো জানলেন।"
"হ্যাঁ, জানলাম। আর সতর্কও হলাম।"
"সতর্ক হলেন মানে? আমি তো কিছু করিনি।"
নিহি চোখ পাকিয়ে তাকায়। আমান বলে,
"এই দেখো, কথাই বলা যায় না। সবসময় রাগ নাকের ডগায় এসে বসে থাকে।"
"এই আপনি যান তো।"
"যাব?"
"হ্যাঁ যাবেন।"
"সত্যিই যাব?"
"জি।"
"আসলেই যাব?"
"বললাম তো হ্যাঁ।"
"শিওর যাব?"
নিহি এবার ধমক দিয়ে বলে,
"কতবার বলব, হ্যাঁ! কথা কানে যায় না?"
"না গেলে হয় না?"

নিহি এবার বালিশ ছুঁড়ে মারে আমানের দিকে। আমান বালিশটা ক্যাচ ধরে ফেলে। এরপর বালিশ কোলে নিয়ে বিছানার ওপর বসে বলে,
"যাব এক শর্তে।"
"এরজন্যও আবার শর্ত?"
"হ্যাঁ।"
"আচ্ছা বলেন।"
"আমাকে সকালের উইশ করলে যাব।"
"করব না।"
"যাব না।"

বিরক্তির দৃষ্টিতে নিহি আমানের দিকে তাকায়। নিহির চেয়েও এক লেভেল ওপরের ঘাড়ত্যাড়া। কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলে,
"শুভ সকাল।"
"আহা! শুভ সকাল। চা নাকি কফি?"
"চা।"
"ওকে বানিয়ে আনুন।"
নিহি অবাক হয়ে বলে,
"কীহ্? আমি বানিয়ে আনব?"
"হ্যাঁ।"
"যেভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি তো ভেবেছিলাম আপনিই বানিয়ে আনবেন।"
"ইশ! আমার বয়েই গেছে।"

আমানের কথার ভঙ্গিতে নিহি শব্দ করে হেসে ফেলে। আমানও নিহির সঙ্গে শব্দ করে হাসতে হাসতে বলে,
"আপনারা মেয়েরা তো এভাবেই কথা বলেন, তাই না?"
"এহ্! বলছে।"
"আল্লাহ্! কী বলো? সত্যি না?"

নিহি এবারও শব্দ করে হাসে। আমান একটার পর একটা কথা বলে যাচ্ছে যেভাবে বেশিরভাগ মেয়েরাই কথা বলে। নিহির হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ। একটা মানুষ এত হাসায় কীভাবে? আমান হাসতে হাসতে থেমে যায়। নিহির দিকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
"সবসময় এভাবেই হাসবেন। সুন্দর লাগে দেখতে। আর! আর আমার ভালো লাগে।"

নিহির হাসি কমে আসে। আমান মৃদু হেসে ফাইলগুলো হাতে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। সকালে আমান অফিসেই নাস্তা করে। তাই রেডি হয়ে আট-টার দিকে অফিসে চলে যায়। আমান যাওয়ার পরই টুকটুকি আর আবুল আসে। আগে আসতো বিকেলের দিকে। রাতের রান্না করার জন্য। কিন্তু নিহি আসার পর থেকে এখন তিনবেলাই রান্নার দায়িত্ব ওদের। আবুল আর টুকটুকি আসতে আসতে নিহি উঠে পড়ে। ফ্রেশ হয়ে নেয়। উপমা আসবে একটু পরই। ফ্রেশ হয়ে নিহি অনলাইনে যায়। নোটিফিকেশন আসে তমা ছবি পাঠিয়েছে। হোয়াটসএপে গিয়ে দেখতে পায় ছবিটা কাল রাতেই পাঠিয়েছিল। চিঠির ছবি। ছবিটাতে ক্লিক করে নিহি।

'এলোকেশী,
তুমি-বিহীন নয়তো আমি পূর্ণ। তোমায় ছাড়া আমায় লাগে ভীষণ শূন্য।

তুমি কী বুঝতে পারো মনের আকুতি?
অনুভব করতে চাও আমার অনুভূতি?

গ্রহণ করবে আমায়,
নাকি..
নিরুত্তর হয়ে চলে যাবে,
আর;
আমায় রেখে যাবে নিরাশায়!'

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিহি ডাটা অফ করে রাখে। এখন আর এসব ভালো লাগে না। চিঠি নিয়ে মাথা ঘামাতেও ইচ্ছে করে না। অযথাই এক্সট্রা প্যারা নিয়েই বা লাভ কী! আর যেই এই চিঠি দিয়ে থাকুক না কেন, সে নিশ্চয়ই জানে না আমি এখন বিবাহিত। জানলে এই ভালোবাসা তখন আর থাকবে না। থাকা উচিতও নয়। ভালোবাসায় আর ভরসা হয় না।

আবুল আর টুকটুকি নাস্তা বানাচ্ছে। উপমা বাড়ির কাছাকাছি প্রায় এসে পড়েছে। নিহি গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। উপমা আসে তখন। রিক্সা থেকে নেমেই আগে নিহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নিহি উপমাকে আমানের বাড়িতেই নিয়ে আসে। উপমা ভেতরে গিয়ে বলে,
"তোর আপু কোথায়?"
"আয়, বলছি।"

নিহির কথার শব্দ পেয়ে আবুল আর টুকটুকি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসে। নিহি ওদের উপমাকে দেখিয়ে বলে,
"এই হলো উপমা। যার কথা কাল তোমাদের বলেছিলাম।"
আবুল আর টুকটুকি উপমাকে সালাম দেয়। উপমা সালামের উত্তর নিয়ে নিহিকে জিজ্ঞেস করে,
"উনারা কারা?"
"আবুল আর টুকটুকি। ভেতরে আয়।"

নিহি উপমাকে নিয়ে ভেতরের ঘরে যায়। দুজনই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। নিহি বলে,
"কী দিয়ে বলা শুরু করব বুঝতে পারছি না।"
"আরে বল।"
"উপমা কী থেকে যে কী হয়ে গেল!"

নিহি মনে মনে সব কথা গুছিয়ে নেয় আগে। এরপর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সব বলে। সব শোনার পর উপমা বিস্মিত। বিশ্বাস হচ্ছে না কোনো কথা। নিহি উপমাকে সময় দেয় নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য। রান্নাঘরে গিয়ে উপমা আর নিজের জন্য নাস্তা নিয়ে আসে। নিহি ঘরে আসতেই উপমা নিহির হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে বলে,
"তুই কি আমার সঙ্গে মজা করলি? সত্যি করে বল প্লিজ!"
"আমি সিরিয়াস উপু! এসব বিষয় নিয়ে কেউ মজা করে? তাছাড়া এখন আমরা আমানেরই বাসায়।"
"মানে? এটা তোর আপুর বাসা না?"
"না। অপজিটে যেই বাড়িটা দেখলি? ঐটাই আপুর বাসা।"
"সব মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে রে।"
"আমি নিজেও ঘোরের মধ্যে ছিলাম।"
"এগুলো সব সত্যিই তাহলে?"
"হুম।"
"আঙ্কেল কি এখনো মেনে নেয়নি?"
"মেনে নেবে কী? কথাই বলে না এখনো।"
"আর সে? যার সাথে তোর বিয়ে হয়েছে তার পরিবার মেনে নিয়েছে?"
"উনার পরিবার এখনো জানে না।"
"কেন? এখানে তাহলে কে থাকত?"
"উনি একাই। উনার বাবা-মা অন্য জায়গায় থাকে। উনার সঙ্গে এই পর্যন্ত আমার যা যা কথা হয়েছে তার সবটাই ছিল ঝগড়া। সে কখনো আমার পার্সোনাল কিছু জানতে চায়নি। আর আমিও না।"
"তুই তাকে মেনে নিয়েছিস?"
"না।"
"সেও তাহলে তোকে মেনে নেয়নি?"
"আমি বুঝি না তাকে। তার কথা খুব রহস্যময়, আবেদনময়। সে সরাসরি বলে না থাকার কথা। আবার যেতে দিতেও চায় না। কিছুদিন ধরে তো খুব বেশিই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে তাকে। তাকে দেখে মনে হয় আমাদের বিয়েটা হওয়ারই ছিল। একটুও ভাবান্বিত নয় সে।"
"সে আসলে কেমন?"
"ভীষণ হাসিখুশি, রসিক মানুষ। আর..."
"আর?"
"আর রোমান্টিকও আছে। এটা অবশ্য কালই জেনেছি।"
উপমা এবার আগ্রহ নিয়ে বলে,
"মানে? কীভাবে বুঝলি? কী হয়েছিল তোদের মাঝে?"

নিহি ভ্রু'দুটি কুঞ্চিত করে উপমাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
"তুই যা ভাবছিস তেমন কিছু নয়।"
"তবে?"
নিহি এবার কালকের ঘটনাও বিবৃতিসহকারে উপমাকে বলে। নিহিকে হাসানো, গান শুনানো সব বলে। সব শুনে উপমা পুলকিত হয়। চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে ওঠে। দু'হাত গালে রেখে বলে,
"আমি তাকে দেখব।"
"বাড়িতে নেই। অফিসে গেছে।"
"ছবি নেই?"
"আছে। উনার ঘরে।"
"চল, দেখব।"

নিহি উপমাকে আমানের ঘরে নিয়ে যায়। দেয়ালে বিশাল বড় ফ্রেমে আমানের একটা ছবি ঝুলানো। নিহি হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে,
"ঐটা উনার ছবি।"
উপমা এবারও গালে হাত রেখে অবাক হওয়ার মতো করে বলে,
"হায়, হায়! দুলাভাই তো পুরাই নায়ক।
দোস্ত, তুই ঠকিস নাই। এমন একটা জামাই পেলে আর কী লাগে?"
নিহি উপমার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
"সুন্দরের পূজারী হওয়া বাদ দে।"

উপমা মাথায় গাট্টা মারা স্থানে হাত বুলিয়ে বলে,
"শুধু সুন্দর বলে বলছি না রে। তার সম্পর্কে তোর মুখে যা, যা শুনলাম এরপর তো তাকে আমার ভালো ছাড়া খারাপ মনে হলো না। বরং অনেক, অনেক ভালো মনে হলো। তুই-ই বল, এই যুগে কয়টা ছেলেই বা নামাযী হয়? আবার, কয়টা স্বামীই বা এমন শান্তশিষ্ট হয়? আমি বলি শোন, বিয়ে যখন হয়েই গেছে তখন আর কিছু ভাবিস না। সে তোর জন্য পার্ফেক্ট। তোর যেই রাগ, সেই হিসেবে উনিই ঠিক আছে। তুই রাগ করলেও সে শান্তশিষ্ট থাকবে। আর সুন্দর বলে খুশি হয়েছি কারণ তুই যখন তাকে নিয়ে কলেজে যাবি তখন অনল দেখে জ্বলেপুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাবে।"
"দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ কর। এখন খাবি চল।"
"আমার কথা সিরিয়াসভাবে নিয়ে একটু ভেবে দেখিস।"
"ভাবার কিছু নেই। এখন সবকিছুই বাবার ওপর নির্ভর করছে।"
"কেন? সংসার কি তোর বাবা করবে?"

নিহি বাঁকা চোখে তাকায়। উপমা বলে,
"নিহি, একটু ভাব তুই। এটা যদি বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ডের মতো কোনো সম্পর্ক হতো তাহলে আমি নিজেও বলতাম, তুই আঙ্কেলের কথামতো চল। কিন্তু এটা বিয়ের ব্যাপার। একটা পবিত্র বন্ধন। যেভাবেই হোক না কেন বিয়ে তো হয়ে গেছে তাই না? তাহলে তুই নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে কেন আঙ্কেলের সিদ্ধান্তের জন্য বসে আছিস?"
"কী করব বল? আমি তো পারি না আর ভালোবাসতে। ভালোবাসায় ভালোবাসার চেয়েও বিষাদ বেশি। সে তো আমার কাছে ভালোবাসা পাবে না। দিনের পর দিন ঠকে যাবে।"
"কীভাবে বলতে পারিস এত শিওর হয়ে? ভালোবাসতে পারবি না তুই শিওর? শোন, ভবিষ্যতে কী হবে না হবে তার কিছুই আমরা জানি না। বাস্তব একটা উদাহরণ দেই তোকে। তোর যে উনার সাথে এমন হুট করেই বিয়ে হয়ে যাবে তুই এটা ভাবতে পেরেছিলি কল্পনাতেও?"
"না।"
"কিন্তু দেখ, এটাই হয়েছে। এক ছাদের নিচে বছরের পর বছর থেকেও ভালোবাসাটা এক সময় থাকে না। আবার অল্প সময়ের মধ্যেই বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা সাগরসম হয়ে যায়। তুই আগে নিজেকে সময় দে। সম্পর্কটা নিয়ে ভাব। আমার মনে হয়, তুই নিজেই এর সমাধান পাবি। বাই এনি চান্স তুই এখনো অনলের আশায় নেই তো?"
"কখনোই না। তার প্রত্যেকটা কথা আমার মনে আছে। তার সেদিনের পাল্টে যাওয়া রূপ এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। আমি ভুলতে পারি না তার সেদিনের প্রতিশোধ নেওয়ার হাসি।"
"ভুলিস না। সবকিছু ভুলতেও নেই। কিছু সময় শিক্ষা দিয়ে যায় আমাদের। যদি আর কিছু ভাবতে হয় তাহলে এই সম্পর্কটাকে নিয়ে ভাব।"

নিহি কোনো উত্তর দেয় না। শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে।
_________________________

সকালের পত্রিকা পড়ছিলেন নিজাম ইসলাম। সালেহা বেগম টেনে পত্রিকা নিয়ে যান। নিজাম ইসলাম রাগ দেখিয়ে বলেন,
"আরে কী করছ? পত্রিকা দাও।"
সালেহা বেগম দ্বিগুণ রাগ দেখিয়ে বলেন,
"রাখো তোমার পত্রিকা! ঐদিকে যে নিজের মেয়ের জীবন সংশয়ে আছে তার বেলায় কিছু না?"
"না, কিছু না। আমার এখন একটাই মেয়ে। মিহি। আর ও ওর সংসার নিয়ে ভালো আছে।"
"সবসময় জেদ দেখাবে না। এই বয়সে এসেও কীসের এত জেদ তোমার? তাও ছেলে-মেয়ের ওপর!"
"কারো ওপর আমার কোনো রাগ, জেদ নেই। তোমার মেয়ে সুখে থাকুক বা দুঃখে তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।"
"আমার আর এই জ্বালা ভালো লাগে না। তুমি নিজেও মেয়েটার ওপর রেগে আছো। আর আমাদেরও ওর সঙ্গে দেখা করতে দাও না। আমি আজ সাফ সাফ বলে দিচ্ছি, তুমি যা খুশি করো। আমি আমার মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। আর দেখাও করব।"

নিজাম ইসলাম চুপ করে থাকেন। সালেহা বেগম রাগে ফুঁসতেছেন। তমা চা টেবিলের ওপর রেখে বলে,
"বাবা, নিহি আপনার জন্য খুব কাঁদে। দয়া করে আর মুখ ফিরিয়ে রাখবেন না। আপনি তো আপনার ছেলেকে চিনেন। সে যেমন ভালো, তেমনই রাগী। নিহি যদি সত্যিই খারাপ কিছু করত তাহলে আপনার কি মনে হয় উনি নিহিকে সাপোর্ট করত? সেখানেই উনি নিহিকে মেরে ফেলত। উপায় না পেয়েই তো নিহি তিতিরের জন্য ডাক্তার আনতে গিয়েছিল। আর এরপরই কী থেকে কী হয়ে গেল! এখানে তো নিহি বা আমানের কোনো দোষ ছিল না। ওরা পরিস্থিতির শিকার।"

নিজাম ইসলাম তবুও চুপ করে থাকেন। তমা সাহস যুগিয়ে আরো কিছু কথা বলে।
"আমানও খুব ভালো ছেলে বাবা। মিহি আর সৈকত আমানকে অনেক আগে থেকেই চিনে। ওদের পাশে বাড়িতেই থাকে। আমানের খারাপ কোনো স্বভাব নেই। আমরাও ওর সঙ্গে কথা বলেছি। খুব বিনয়ী আর শান্তশিষ্ট। নিহিকে ও ভালো রাখতে পারবে। আপনি প্লিজ মেনে নিন। ওর পরিবার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিন প্রয়োজনে।"

নিজাম ইসলাম আর কিছু বলেন না। নিজের ঘরে চলে যান। তমা অসহায়ের মতো সালেহা বেগমের দিকে তাকায়। সালেহা বেগম নিজেও নিরুত্তর। নিজাম ইসলাম ঘর থেকে তমাকে ডেকে বলেন,
"আমার চা ঘরে দিয়ে যেও।"

তমার মন খারাপ হয় খুব। ভেবেছিল এত সুন্দর করে সব বোঝানোর পর অন্তত বুঝবে সে। তাও হলো না। তমা চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে যায়। নিজাম ইসলামের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে চলে আসে। দরজার কাছে আসতেই নিজাম ইসলাম বলেন,
"কাল তোমার শ্বাশুরীকে রেডি থাকতে বলিও। সকালে নিহির কাছে যাব।"

খুশিতে তমার মন নেচে ওঠে। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে নিজাম ইসলামের দিকে একবার তাকিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে যায়। সালেহা বেগমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
"মা! বাবা বলেছে কালকে নিহির কাছে যাবে।"
"সত্যিই বলছ?" অবিশ্বাসের স্বরে বলেন সালেহা বেগম।
তমা খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
"হ্যাঁ, মা।"
"আলহামদুলিল্লাহ্‌। আল্লাহ্ মুখের দিকে তাকিয়েছেন। নিহিটা যে কাল কী খুশি হবে তাকে দেখে!"
"আমার তো ভেবেই খুশি লাগছে।"
"শোনো নিহিকে বোলো না। আমরা গিয়ে সারপ্রাইজ দেবো। শুধু মিহি আর সৈকতকে ফোন করে জানাও। ওদেরও বলতে বারণ করে দিও।"
"ঠিকাছে মা।"


মাগরিবের নামাজ পড়ে আমান মাত্রই বাড়িতে ফিরেছে। অফিস থেকে এসেছিল দুপুরেই। উপমার সঙ্গেও আমানের দেখা হয়েছে। দুপুরের খাবার একসঙ্গে খেয়ে উপমা বাড়িতে চলে গেছে। 'গৃহদাহ' উপন্যাস পড়ছিল নিহি। টুপি খুলে আমান প্রশ্ন করে,
"নামাজ পড়েছিলেন?"
"হ্যাঁ।" নিহির উত্তর।

আমান বইটা ধরে বলে,
"দেখি কী উপন্যাস পড়েন?"
নাম দেখে বলে,
"মিস্ট্রি পড়েন না?"
"পড়ি।"
"প্রিয় লেখক কে?"
"অনেকেই আছে।"
"শুনি নাম।"
"হুমায়ুন আহমেদ, সমরেশ মজুমদার, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়।"
"ফেলুদা সমগ্র পড়া শেষ?"
"না, সব পড়া হয়নি। এখন চুপ করুন। পড়ায় মনেযোগ নষ্ট হচ্ছে।"
"আমি তো তাই-ই চাই।" বিড়বিড় করে বলে আমান।
নিহি জিজ্ঞেস করে,
"কী?"
"পরে পড়িয়েন। এখন একটু গল্প করি?"
"না।"
"হ্যাঁ।" বলে, আমান বইটা কেড়ে নেয়।
নিহি বলে,
"বই নিলেন কেন? বই দেন।"
"না, দেবো না।"
"রাগ হচ্ছে কিন্তু।"
"সে তো সবসময়ই হয়।"
"দিবেন?"
"না।"
ওদের কথা বলার মাঝেই আমানের ফোন বাজে। নিহি বলে,
"আপনার কল এসেছে। আমায় বই দিয়ে কথা বলুন।"
নিহি বইটা নিতে আসলে আমান এক হাতে নিহির দুই হাত আটকে ধরে, অন্য হাতে ফোন রিসিভ করে বলে,
"কীরে এতদিন পর তোর আমার কথা মনে পড়ল?"
ওপাশ থেকে কী বলে শোনা যাচ্ছে না। আমান আরো কিছুক্ষণ কথা বলে। পরিবারের সবার খোঁজ-খবর নেয়। নিহি নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কথা শেষ করে আমান নিহিকে বলে,
"এত মোড়ামুড়ি করেন কেন? একটু স্থির থাকতে পারেন না?"
"আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন? হাত ছাড়েন।"
"তো কী হয়েছে? অন্য কারো হাত ধরেছি নাকি? আমার বউয়ের হাত ধরেছি।"
"হাত ছাড়বেন আপনি?"
"না, না, না।"

নিহি এবার আমানের হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। ব্যথা পেয়েও আমান নিহির হাত ছাড়ে না। হাতে দাঁতের দাগ পড়ে গেছে। মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে যথেষ্ট ব্যথা পেয়েছে। তবুও হাসছে। আর হাতও ছাড়েনি। নিহি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু। আমান হেসে হেসেই বলে,
"শত আঘাত পেলেও আমি আপনাকে ছাড়ব না। আর এটা তো সামান্য কামড়! তাও আপনারই দেওয়া।"
"অদ্ভুত লোক তো আপনি।"
"জানি আমি।"
"এবার ছাড়ুন। কে ফোন দিয়েছিল?"
"ছোট ভাই।"
"আপনার ছোট ভাইও আছে?"
"হ্যাঁ। দাঁড়ান ফ্যামিলি ফটো দেখাই।"

আমান ফোনের গ্যালারি থেকে ফ্যামিলি ফটো বের করে ফোনটা নিহির হাতে দেয়। ফোন হাতে নিয়ে নিহির হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। আমান বাদেও এখানে আরো দুটো মুখ পরিচিত। খুব পরিচিত। নিহি কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,
"এটা আপনার ফ্যামিলি ফটো?"
আমান ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে,
"হ্যাঁ। দেখছেন না আমিও আছি এখানে। পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি হলেন আমার বাবা। যে অফিসের বেশিরভাগ কাজের জন্য দেশের বাহিরে থাকেন। ইনি হলেন আমার জান আমার মা। কলেজের টিচার। আর এই হলো আমার ছোট ভাই অনল।"

নিহির পায়ের নিচের মাটিকে ফাঁকা মনে হচ্ছে। পৃথিবী গোল নিহি জানত। তাই বলে এত?
.
.
.
চলবে......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন