"এত ভয়ংকরভাবে আপনি কেন ভালোবাসেন?"
"এত ভয়ংকরভাবে আপনি কেন মায়ায় ফেলেছেন?" নিহির প্রশ্নের বদলে পাল্টা প্রশ্ন করে আমান।
নিহির কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। একটা মানুষ কীভাবে ভয়ংকর রকম ভালোবাসতে পারে তা নিহির জানা নেই। কেন এরকমভাবে মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে সেটাও নিহির জানা নেই। তাই অগত্যা নিহি নিশ্চুপ থাকে। আমান নিহির হাতে মেহেদী দিয়ে দেয়। হাতের এক সাইডে ছোট করে নিজের নামের অক্ষর লিখে দেয়। নিহি দেখেও কিছু বলে না। আমান বলে,
"এই মেহেদীর সঙ্গে নামের অক্ষরও যখন মুছে যাবে, তখন কি আপনিও আমায় আপনার মন থেকে মুছে ফেলবেন?"
"আমি চাইলেও কি পারব?"
"হয়তো পারবেন।"
"আপনি যা ভাবেন।"
আমানের ভীষণ রকম কষ্ট হচ্ছে এই বিরহ মেনে নিতে। তবুও সে সইবে। ভালোবাসার জন্য মানুষ কতকিছুই না করে? আর এ-তো ক্ষণিকের বিরহ মাত্র। যত দূরেই যাক, মন থেকে কখনো দূরে যেতে পারবে না।
দুই হাতেই মেহেদী পড়িয়ে দেয় আমান। নিহি শীতে কিঞ্চিৎ কেঁপেছে, আমান আড়চোখে খেয়াল করেছে। শালটা সুন্দর করে নিহির গায়ে জড়িয়ে দিয়ে দু'হাতে ফুঁ দেয়। নিহি হাসে। জিজ্ঞেস করে,
"ফুঁ দিচ্ছেন কেন?"
"মেহেদী শুকানোর জন্য।"
"শুকাবে?"
"কিছুটা।"
নিহি চুপ করে থাকে। আমান নিহির হাতে ফুঁ দেয়। টুকটুকি আর আবুল ঘরে আসে। টুকটুকি অবাক হয়ে বলে,
"ওমা! আপাজান কী সুন্দর কইরা মেন্দী দিছে।"
নিহি বলে,
"তোমাদের ভাইজান দিয়ে দিয়েছে। আমি এত সুন্দর করে দিতে পারি না।"
টুকটুকি আরো অবাক হয়। সঙ্গে আবুলও। টুকটুকি বলে,
"আল্লাহ্ গো! ভাইজান মেন্দীও দিয়া দিতে পারে?"
"ও ভাইজান, আমারেও শিখাইবেন? বিয়ার পর আমিও বউরে দিয়া দিমু।" বলে আবুল।
আমান মুচকি হেসে বলে,
"যখন বউয়ের প্রেমে পড়বি তখন আর শিখিয়ে দেওয়া লাগবে না।"
আবুল লজ্জায় পায়। নিহি আবুল আর টুকটুকিকে বলে,
"আমাকে একটা গল্প শোনাও তো দুজনে।"
আবুল মাথা চুলকে বলে,
"আপামুনি ছুডুবেলায় মা গল্প হুনাইতো। কিন্তু আমার তো মনে নাই। মনে থাকলে আপনেরে হুনাইতাম।"
"তাহলে তুমি শোনাও।" নিহি টুকটুকিকে বলে।
টুকটুকি এক গাল হেসে বলে,
"আমি একটু একটু পারতাম। কিন্তু মনে নাই কা আপাজান।"
নিহি হতাশ হয়ে বলে,
"তাহলে এখন কী নিয়ে গল্প করব? কাল তো চলেই যাব।"
"চইলা যাইবেন মানে?" আবুল আর টুকটুকি দুজনই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
আমান ব্যথিতস্বরে বলে,
"আজই তো চলে যেত রে। আমি বললাম বলেই তো আজ আছে। তোদের আপা খুব স্বার্থপর।"
নিহি মায়াময় দৃষ্টিতে আমানের মুখেরপানে তাকায়। আবুল আর টুকটুকি কাঁদো কাঁদো হয়ে নিহিকে যেতে বারণ করে। নিহি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজাম ইসলামের কথা বলে। বিয়ের শুরু থেকে সবটা ওদের বলে। এতকিছুর পরও বাবা মেনে নিয়েছে। একটা সুযোগ দিয়েছে। এই সুযোগ নিহি কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। করতে পারবে না। তাই নিহিকে যেতেই হবে। সবার মন ব্যথিত হয়। আবুল আর টুকটুকি ঘুমের বাহানা দিয়ে চলে যায়। নিহি আবুলকে গেস্ট রুমে আর টুকটুকিকে নিহির রুমে ঘুমাতে বলে। নিহি ওয়াশরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে আসে। মেহেদী শুকাতে অনেক সময় লেগে যাবে। গরম হলে অবশ্য এত সময় লাগত না। হাত ধুয়ে এসে নিহি হাত দুটো আমানের সামনে রেখে বলে,
"রং সুন্দর হয়েছে না?"
"সুন্দর মানুষের হাতে মেহেদীর রং সুন্দর না হয়ে যাবে কোথায়?"
"আপনি সবসময় বেশি বেশি বলেন।"
"অথচ আরো বলা উচিত আমার।"
"হয়েছে। ঘুমাবেন না?"
"ঘুম তো কেড়েই নিয়েছেন।"
"সবসময় এমন করবেন না তো! ঘুমান। আমি যাচ্ছি।"
নিহি চলে যাওয়ার সময় আমান হাত টেনে ধরে। নিহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আমান অনুরোধেরস্বরে বলে,
"থেকে যান না!"
"সম্ভব না।"
"আজকের রাতটা।"
"মানে?"
"কিচ্ছু করব না।"
"আপনি কি বেশিই করছেন না? এমন বাচ্চাদের মতোন করছেন কেন?"
"প্লিজ!"
"কী?"
"আজ রাতটা আমার ঘরেই থাকুন।"
"হাত ছাড়ুন।"
"প্লিজ!" কাতর হয়ে বলে আমান।
"হাত না ছাড়লে ঘুমাব কীভাবে? নাকি ঘুমাতেও দিবেন না?"
আমান নিহির কথা বুঝতে পারে না। জিজ্ঞেস করে,
"মানে? থাকবেন?"
"থাকব।"
প্রাণখোলা হাসি দেয় আমান। নিহি বিছানা ঝেড়ে একপাশে শুয়ে পড়ে। আমান চেয়ারে বসে থাকে। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিহি পিছনে ফিরে তাকায়। আমানকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
"ঘুমাবেন না?"
"আপনি ঘুমান। আমার ঘুম আসবে না। আর আসলেও পরে ড্রয়িংরুমের সোফায় নয়তো আবুলের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ব।"
"তার কোনো দরকার হবে না। এখানেই শুয়ে পড়ুন।"
"উঁহু।"
"তাহলে কী করবেন? সারা রাত বসে বসে মশা মারবেন?"
"না। দেখব।"
"এ্যা?"
"এ্যা নয় হ্যাঁ। আপনাকে দেখব।"
"আমার অস্বস্তি লাগবে। ঘুম আসবে না।"
"তাহলে পাশে শোয়ার পারমিশন দিচ্ছেন?"
"দিচ্ছি।"
"লাইট?"
"অন থাকুক।"
মাঝখানে কোলবালিশ রেখে আমানও একপাশে শুয়ে পড়ে। একসময় নিহির চোখে ঘুম চলে আসলেও আমানের চোখে ঘুম ধরা দেয় না। কিছুক্ষণ এপাশ, ওপাশ করে বিছানায় বসে। উঁকি দিয়ে একবার নিহির মুখের দিকে তাকায়। তারপর বিছানা থেকে উঠে চেয়ার নিয়ে নিহির সামনে বসে। হঠাৎ মাথায় আসে নিহির ঘুমন্ত মুখের ছবি তোলার কথা। তাই ফোন দিয়ে ঝটপট নিহির কয়টা ছবি তুলে নেয়। তারপর একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। নিহির মুখের সামনে একটু ঝুঁকে আলতো করে নিহির কপালে একটা চুমু এঁকে দেয়। পরে নিজেই মুচকি মুচকি হাসে। এক সময় বসে থাকতে থাকতে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে নিজেও।
নিহি রেডি হচ্ছে যাওয়ার জন্য। আমান বসে আছে রেডি হয়ে। আমান, আবুল, টুকটুকি সবারই মন খারাপ। রেডি হয়ে সকালের নাস্তাও সবাই একসাথে করে। যাওয়ার সময়ে নিহি আবুল আর টুকটুকির হাত ধরে বলে,
"তোমাদের অনেক মিস করব। ঝগড়া করার জন্য হয়তো মাঝে মাঝে একটু বকেছি, এরজন্য তোমরা কিছু মনে কোরো না।"
টুকটুকি বলে,
"আমরা তো আপনের এই বকা সবসময়ই খাইতে চাই আপাজান। আপনে যাইয়েন না।"
আবুলও বলে,
"হ, আপামুনি থাইকা যান। এইহানেই কুনো কলেজে পড়েন।"
উত্তরে তখন নিহি বলে,
"আমি তো সবই বলেছি কাল। সম্ভব নয় আমার পক্ষে। শোনো,তোমাদের ভাইজানের খেয়াল রেখো কেমন। ঠিকমতো যেন খায়। আর তোমরাও ঠিকমতো খাবে। ঝগড়া করবে না একদম। মনে থাকবে?"
নিহির চোখে পানি চিকচিক করছে। এত অল্পসময়েই মানুষ দুটো এতো আপন হয়ে গেছে যে, ছেড়ে যেতেই খুব কষ্ট হচ্ছে। আবুল আর টুকটুকি বাচ্চাদের মতো করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। নিহিও আর কান্নাগুলোকে আটকে রাখতে পারে না। ওদের জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। ওরা কেঁদে কেঁদে বলে,
"আমরা আপনের অপেক্ষায় থাকুম আপা। আপনে কিন্তু পরীক্ষা দিয়া চইলা আসবেন।"
নিহি দু'হাতে দুজনের পিঠে বুলিয়ে দেয়। আমান গাড়িতে অপেক্ষা করছে। ওদের থেকে বিদায় নিয়ে আপু আর দুলাভাইর থেকেও বিদায় নিয়ে নেয় নিহি। তারপর গাড়িতে গিয়ে বসে। আমান তাকাচ্ছে না নিহির দিকে। নিহি গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সারাটা রাস্তাই দুজন চুপচাপ থাকে। একসময় দুজনেই পৌঁছে যায় গন্তব্যে। নিহি গাড়ি থেকে নেমে বলে,
"আসুন।"
"কোথায় যাব?" প্রশ্ন করে আমান।
"বাড়িতে।"
"না। প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে যাব তাও খালি হাতে? এই বাড়িতে সেদিনই প্রবেশ করব, যেদিন আপনাকে স্ব-সম্মানে ঢাকঢোল পিটিয়ে বউ করে নিজের বাড়িতে তুলব। আব্বু-আম্মুকে আমার সালাম দিয়েন। অফিসে গিয়ে আমি ফোন করে তাদের সঙ্গে কথা বলে নেব। আপনি ভালো থাকবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন।"
একরকম অগোছালো কথা বলে এবং নিহিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চোখের পলকে গাড়ি নিয়ে উধাও হয়ে যায় আমান। যতক্ষণ দূর থেকে গাড়িটা দেখা যায়, ততক্ষণ নিহি দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই নিরবে বেড়িয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস। অদ্ভুত মানুষ একটা! নিহি উপরে চলে যায়। দরজায় নক করতেই তমা দরজা খুলে দেয়। নিহিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
"কেমন আছো?"
"ভালো আছি ভাবি। তুমি কেমন আছো?"
"ভালো। আমান কোথায়?"
"আমায় বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে।"
"সেকি! ভেতরে আসতে বলোনি?"
"বলেছি। আসেনি।"
"কেন?"
"বলল খালি হাতে প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে আসবে না। ছাড়ো, আব্বু কোথায়?"
"ঘরে।"
নিহি নিজাম ইসলামের রুমে যান। তিনি ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছেন। নিহি গিয়ে বিছানার ওপর বসে। কথা শেষ করে নিজাম ইসলাম নিজেই বলেন,
"আমান ফোন দিয়েছিল।"
"ওহ্। কলেজে কবে যাবে টিসি আনতে?"
"আজই।"
"আচ্ছা। তাহলে রেডি হয়ে নাও।"
"তুই খেয়েছিস সকালে?"
"হ্যাঁ, খেয়েই এসেছি।"
"তাহলে আমি কাপড়টা পাল্টে নিচ্ছি।"
"আচ্ছা।"
নিহি তমার ঘরে চলে যায়। নীলম অফিসে চলে গেছে। তিতির ফোনে কার্টুন দেখছে। তিতিরকে কোলে নিয়ে নিহি বলে,
"স্কুলে যেতে হবে না?"
"আজ তো তুমি আসবে। তাই যাইনি।"
নিহি তিতিরের কোমরে সুড়সুড়ি দিয়ে বলে,
"ফাঁকিবাজি না?"
তিতির খিলখিল করে হাসে। তমা ঘরে এসে আলমারি থেকে দুটো খাম বের করে। খামটা এখন পরিচিত নিহির। এবার খুব রাগ লাগে। সঙ্গে বিরক্তও হয়। জিজ্ঞেস করে,
"আবারও?"
"হুম। কালকের আর আজকের চিঠি।"
"ধুর! তুমি আর নিও না এইসব চিঠি। কে না কে ফাইজলামি শুরু করেছে।"
"সাধে কি আর নিই? যদি বাবার হাতে পড়ে যায় কখনো? সেই ভয়েই তো নিই।"
"এরপর আর চিঠি দিতে আসলে তাকে বলে দেবে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি আর এসব ফালতু টেনশন নিতে পারছি না।"
"তাহলে এই চিঠিগুলো কী করব?"
"রেখে দাও। পরে ইচ্ছে হলে পড়ব।"
ড্রয়িংরুম থেকে নিজাম ইসলাম ডাকেন। কলেজে যেতে হবে। নিহি তিতিরকে চুমু দিয়ে বাবার সঙ্গে কলেজে চলে যায়।
অফিসে মনমরা হয়ে বসে আছে আমান। কতগুলো ফাইল সামনে পড়ে আছে। একটাও চেক করতে ইচ্ছে করছে না। নিরব তিনবার এসেছে এর আগে। আমানকে একইভাবে বসে থাকতে দেখেছে। চতুর্থবারের মতো এসে প্রশ্নই করে ফেলে,
"কোনো সমস্যা স্যার?"
আমান দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
"ভালো লাগছে না নিরব।"
"কী হয়েছে স্যার? আমায় বলুন।"
"বলে আর কী হবে?"
"মন হালকা হবে।"
"নিহি চলে যাবে।"
"ম্যাম কোথায় চলে যাবে?"
"সিলেটে। পড়াশোনার জন্য।"
"তো ঢাকা থেকে সিলেটে কেন?"
"ওর বাবার ইচ্ছে।"
"ম্যাম যাবে?"
"অলরেডি চলেও গেছে।"
"সিলেট?"
"না। ওর বাবার বাসায়।"
"মন খারাপ করবেন না স্যার। আমি তো আপনাদের বিয়ের কথা কমবেশি সবই জানি। ম্যামের বাবা যখন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তখন কিছু না কিছু ভেবেই নিয়েছেন। পড়াশোনা শেষ করে তো আবার চলেই আসবে।"
"আসবে নাকি তাও বলেনি। তবুও অপেক্ষা করব আমি।"
নিরবের নিজেরও খুব খারাপ লাগে। নিহি আমানের জীবনে আসার পর থেকেই অফিসে এসে আমান ছটফট করত। বাসায় তাড়াতাড়ি যেত। নিরব জানে, আমান কতটা ভালোবাসে নিহিকে। তাই কষ্টটাও কিছু হলেও আন্দাজ করতে পারে।
কলেজের মাঠে হাঁটতে হাঁটতে নিহি বাবাকে প্রশ্ন করে,
"টিসি কি সঙ্গে সঙ্গেই দিয়ে দেবে?"
"হ্যাঁ। কাল আমি কলেজে ফোন করে বলেছি। তোর মামাকেও ফোন করেছি। উনি ওখানকার কলেজে তোর ভর্তির জন্য কথা বলে রেখেছেন।"
"তাহলে আমি কবে যাচ্ছি সিলেট?"
"কালই।"
"কালই!"
"হুম।"
"আচ্ছা আব্বু, আমি ফিরে এসে যদি তোমার কাছে কিছু চাই, তুমি আমায় দেবে?"
তিনি হেসে বলেন,
"এখনই চা। দেবো।"
"না, এখন নয়। আমি ফিরে এসেই চাইব। দেবে তো?"
"দেবো রে মা।"
"মনে থাকে যেন।"
"থাকবে।"
নিহি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে অনলকে দেখেছে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। সাকিব সবার আগে নিহিকে দেখতে পায়। অনলের কাঁধে হাত রেখে বলে,
"দোস্ত! নিহি এসেছে।"
সবাই একসঙ্গে পিছনে তাকায়। নিহি একবার ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সরাসরি নিজাম ইসলামের সঙ্গে অফিস রুমে চলে যায়। মিলন বলে,
"কাহিনী কী দোস্ত? এতদিন পর কলেজে আসলো! তাও ক্লাসে না গিয়ে আবার অফিস রুমে।"
অনল বিরক্ত নিয়ে বলে,
"আমি কী জানি?"
নিজাম ইসলাম প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে কথা বলছেন। বাবার থেকে অনুমতি নিয়ে নিহি উপমা আর দীপ্তর সঙ্গে দেখা করতে যায়। এখন ক্লাস নিচ্ছেন অনামিকা ম্যাম। নিহিকে দেখে তিনি ভেতরে আসতে বলেন। নিহি ভেতরে যায়। ম্যামের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
"আমি কি সবার উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলতে পারি ম্যাম?"
"শিওর।"
ম্যাম সরে দাঁড়িয়ে নিহিকে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেয়। নিহি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলে,
"আসসালামু আলাইকুম। আশা করছি, তোমরা সবাই ভালো আছো। তোমাদের সঙ্গে আমার পরিচয়টা খুব বেশিদিনের না। এমন অনেক স্টুডেন্টও আছো, যাদের এখনো আমি চিনি না। তবে আমি ড্যাম শিওর, আমাকে সবাই চেনো। আর কেনো চেনো সেটাও সবাই জানো। হয়তো সবার পরিচিত মুখ আমি হতে পারতাম না। হয়েছি কার জন্য? কলেজের সব মেয়ের ক্রাশ, অনামিকা ম্যামের ছেলে অনলের জন্য। হ্যাঁ, অনেকের চোখেই হয়তো আমি খারাপ। তবে, আমি জানি আমি কেমন। তোমরাও অনেকে জানো আসল সত্যটা কী! যাই হোক, সত্য-মিথ্যা বা আমাকে জাজ করার আল্লাহ্-র পরে একমাত্র অধিকার আছে আমার পরিবারের। এখন যে যা খুশি ভাবতে পারো তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। যে কথা বলার জন্য সবার সামনে এসেছি তা হলো, আমি আজ কলেজে এসেছি টিসি নিতে। হ্যাঁ, তোমরা ঠিকই শুনেছ। আমি টিসি নিতেই এসেছি। তোমরা হয়তো ভাবছ,যেখানে এই কলেজে পড়ার জন্য হাজারও স্টুডেন্টস পাগল সেখানে আমি কেন স্বেচ্ছায় টিসি নিতে এসেছি? তার কারণ একটাই, এটা আমার মায়ের আদেশ। তোমাদের অনেকের সাথেই হয়তো খারাপ ব্যবহার করেছি। মনে কিছু নিও না তারা। ভুল করে থাকলে সকলের কাছেই আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ভালো থেকো সবাই।"
উপমা আর দীপ্ত অবাক হয়ে এতক্ষণ নিহির কথা শুনছিল। নিহি মাইক্রোফোন রাখার পর অনামিকা ম্যাম প্রশ্ন করেন,
"টিসি না নিলে হয় না?"
"স্যরি ম্যাম।"
বেল বাজার শব্দ হয়। ম্যামের ক্লাশ শেষ। ম্যাম ক্লাসের সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিহিকে জড়িয়ে ধরেন। পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন,
"ভালো থেকো। নিজের ক্যারিয়ার গড়ো।"
ম্যাম ক্লাস থেকে চলে যান। তখন উপমা আর দীপ্ত হুড়মুড় করে নিহির কাছে আসে। নিহিকে টেনে বারান্দায় নিয়ে যায়। তখন নিজাম ইসলাম ফোন করেন। নিহি ওদের চুপ থাকতে বলে ফোন রিসিভ করে। নিহি বলে,
"বলো আব্বু।"
"কথা শেষ হয়নি?"
"তুমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। আমি আসছি।"
"তাড়াতাড়ি আসিস।"
"আচ্ছা।"
ফোন রাখার পরই উপমা বাঘিনীর মতো ক্ষেপে যায়। শাসিয়ে শাসিয়ে বলে,
"এসব কী? তুই চলে যাবি মানে? আমাদের আগে তো বলিসনি?"
"মন খারাপ করবি, তাই বলিনি।"
"এখন কি আমাদের খুব খুশি লাগছে? তুই কোথাও যাবি না। আঙ্কেল কোথায়? আমি আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলব।"
"পাগলামি করিস না উপু।"
উপমা কোনো কথা শোনে না।দীপ্তকে নিয়ে নিচে নামে। পেছন পেছন নিহিও দৌঁড়ে আসে। মাঠের কাছে এসে দুজনের হাত ধরে বলে,
"প্লিজ! আব্বুকে বলে কোনো লাভ নেই। এই কলেজে থাকা আর সম্ভব নয় আমার। একটু বোঝার চেষ্টা কর।"
"কী বুঝব বলো? তোমাকে ছাড়া আমরা থাকব কীভাবে?" রাগ দেখিয়ে বলে দীপ্ত।
নিহি বলে,
"দূরে যাওয়া মানেই কি সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়া? আমাদের প্রতিদিন ফোনে কথা হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ থাকবে। তারপর বন্ধ পেলে তো আমি ঢাকাতে আসব। তখন আমাদের দেখা হবে।"
"তুই ভুলে যাবি আমাদের।" কেঁদে কেঁদে বলে উপমা।
নিহি উপমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
"প্লিজ কাঁদিস না উপু! আমি আসব তো আবার।"
"আরে এখানে এত কান্নাকাটি হচ্ছে কেন?"
নিহি পাশে তাকিয়ে দেখে অনল। মুখ ফিরিয়ে নেয় তখনই। উপমা অনলকে দেখে আরো রেগে যায়। এইসব কিছুর জন্য তো অনলই দায়ী। উপমা নিহির হাত ধরে বলে,
"চল। কলেজ ছুটির পর তোর বাসায় যাব"
"কেমন আছো নিহি?" জিজ্ঞেস করে অনল।
নিহি নিশ্চুপ। অনল জিজ্ঞেস করে,
"কথা বলবে না?"
"আমি কেমন আছি তা জানা কি খুব জরুরী আপনার?"
"একদম না। এতদিন পর আসলে তাই জিজ্ঞেস করলাম। অসুস্থ ছিলে নাকি?"
"আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আমার।"
"তাহলে কী ইচ্ছে করছে?"
"আর কিছু বলবেন?"
"তেমনকিছুই বলার নেই। একটু খোঁজ-খবর নিতে আসলাম। চলো ক্যান্টিনে যাই। কফি খাই।"
"নো, থ্যাঙ্কস।"
অনল এবার হেসে হেসে বলে,
"কেন? পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যায়?"
"আপনি এখনো শোধরাননি। তবে শোধরাবেন। খুব শীঘ্রই। সময় এসেছে বলে!"
"তাই? অপেক্ষায় রইলাম। আমাকে কেউ শোধরাতে পারেনি। আর সেখানে তুমি! হাহা হাসালে। তবে যাই বলো,তোমার এই তেজী তেজী কথা, রাগ, জেদ আমার ভীষণ ভালো লাগে। কারণ তুমিই তো একমাত্র মেয়ে যে আমায় থাপ্পড় মেরেছিলে। সেই হিসেবে, আমি অপেক্ষা তো করতেই পারি তাই না সুন্দরী?"
"আপনার অপেক্ষার প্রতিদান আমি অবশ্যই দেবো। থাপ্পড়টা এখনো মনে আছে তাহলে? এরপরের আঘাত হাতে নয়, ঠিক এই বুকে করব।" অনলের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলে নিহি। অনল জায়গা থেকে নড়ে না তবে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। হালকা মৃদু বাতাসে অনলের কিছুটা চুল কপালে পড়ে। নিহি রহস্যহনকভাবে হাসে। অনলের মুখে ফুঁ দিয়ে বলে,
"জানেন তো, আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আমি ফলাফলও পেয়েছি। এবার আপনার পাওয়ার অপেক্ষা। প্রতিদান তো দেবোই। বাই, বাই।"
উপমা আর দীপ্তর থেকে বিদায় নিয়ে নিহি কলেজ থেকে চলে যায়। অনল নিহির কথার মানে বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকে। উপমা অনলকে বলে,
"নিহি একেবারের জন্য এই কলেজ থেকে চলে যাচ্ছে। আপনি খুশি তো এবার?"
অনলের উত্তরের জন্যও অপেক্ষা করে না উপমা। ক্লাসে চলে যায়।
__________________
সকাল নয়টা বাজে। বাস স্ট্যান্ডে এসে বসে আছে নিহি। রাতে ফোন করে বলেছে এখানে আসতে। আজই সিলেটে চলে যাবে। নয়টা বিশে নিহি বাস স্ট্যান্ডে আসে। নিহির সঙ্গে বাড়ির সবাই এসেছে। আমানকে দেখে নিহির মনটা খারাপ হয়ে যায়। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। এলোমেলো লাগছে খুব। তবুও মুখটায় কত মায়া। বাস ছাড়বে ৯:৩০-এ। আর মাত্র দশ মিনিট আছে। নিহির সঙ্গে সিলেটে যাবে ওর বাবা আর ভাই। ব্যাগ নিয়ে ওরা বাসে ওঠে। নিহি আমানের কাছে যায়। আমানের চোখের কোণে পানি। কতকিছু বলার আকুতি! নিহি জিজ্ঞেস করে,
"মন খারাপ?"
"নাহ্! ঠিক আছি আমি।"
নিহি সাদা ওড়নার আড়াল থেকে একটা মেহেদী বের করে। আমান প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। নিহি বলে,
"মেহেদী নিয়ে যাচ্ছি। আপনার নামের অক্ষরটা আমি মুছতে দেবো না।"
আমান নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলতেও পারছে না। জবান আটকে গেছে যেন! নিহি বলে,
"আমার একটা কথা রাখবেন?"
"হুম।"
নিহি ডান হাত সামনে বাড়িয়ে বলে,
"যতদিন না আমি কাউকে আমাদের বিয়ের কথা জানাতে বলব, আপনি ততদিন কাউকে জানাবেন না। অথবা, আপনি চাইলে জানাতে পারেন। কিন্তু কাউকে আমার নাম বলবেন না। আমার ছবিও দেখাবেন না। এমনকি আপনার পরিবারের কাউকেও না।"
"কিন্তু কেন?"
"কথা দিন আপনি। সময় নেই। বাস ছেড়ে দিবে।"
আমান নিহির হাতে হাত রেখে বলে,
"কথা দিলাম।"
নিহির ঠোঁটে হাসি ফুঁটে ওঠে। সবাইকে উপেক্ষা করে এবং আমানকে অবাক করে দিয়ে পা দুটো একটু উঁচু করে আমানের দু'গালে হাত রাখে। আমানের মাথাটা কিঞ্চিৎ নিচু করে কপালে চুমু এঁকে দেয়। আমানের পুরো শরীর যেন বরফের মতো জমে গেল। নিহি মুচকি মুচকি হেসে বলে,
"কালকে রাতের চুমুটা ফিরিয়ে দিলাম।"
"তার মানে কাল রাতে..."
"রাতে তখনো ঘুমাইনি আমি। আসছি।"
দু'পা এগিয়ে গিয়ে আবার পিছু ফিরে তাকায়। আমানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
"নিজের খেয়াল রাখবেন প্লিজ। দৃষ্টির দূরত্বই বড় দূরত্ব নয়। মনের দূরত্ব না হলেই হয়। আমি থেকে যাব আড়ালে-আবডালে।"
.
.
.
চলবে.......................................