আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে গল্প সম্বন্ধে আপনার মতামত অবশ্যই প্রকাশ করবেন। আপনাদের মতামত আমাদের এই ছোট প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। শীঘ্রই আরও নিত্য নতুন গল্প আপডেট আসছে, সঙ্গে থাকুন। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখক/লেখিকা'র নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত গল্পের ডায়েরি’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখক/লেখিকা'র কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় গল্পের ডায়েরি কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

আড়ালে আবডালে - পর্ব ২২ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


৪৩!!

নিহির ইয়ারচেঞ্জ পরীক্ষা শেষ হয়েছে আজ দু'দিন হলো। পরীক্ষার আগে থেকে শুরু করে পরীক্ষা পর্যন্ত আমানই নিহিকে পড়িয়েছে। সবসময় ওর ছায়া হয়ে থেকেছে। যতক্ষণ পরীক্ষা হয়েছে ততক্ষণ কলেজের বাইরে অপেক্ষা করেছে। সর্বোপরি একদম আগলে রেখেছে। এর মাঝে ঐ নাম্বারে আর কোনো হুমকি বার্তা আসেনি। তবে সেই লোকগুলো আবারও উপমাকে হুমকি-ধামকি দিয়েছে। নিহিকে আমানের জীবন থেকে সরে যেতে বলেছে। হুমকির মাত্রা বাড়তেই থাকে। কখনো ফোনে, কখনো বা ম্যাসেজে। আমান চেষ্টা করেছিল সেই নাম্বারটাও ট্র্যাক করতে। কিন্তু ব্যর্থ হতে হয়েছে। হতাশায় ডুবে যায় উপমা। ওর নিরাপত্তার জন্য কিছু লোক সবসময় ওর আশেপাশে রাখে আমান। এর কিছুই নিহি জানে না। বলে রাখা ভালো আমান জানায়নি।

কাল ঢাকায় ব্যাক করবে ওরা। তখন তো উপমার সঙ্গে দেখা হবে। সবটা জেনে কি নিহি রাগ করবে?
"শুনছেন?"
নিহির ডাকে হুশ ফেরে আমানের। হাসি দিয়ে বলে,
"শুনছি। বলো।"
"চলেন কোথাও থেকে ঘুরে আসি।"
"কোথায় যাবে?"
"যেদিকে দু-চোখ যায়।"

আমান স্মিত হেসে বলে,
"চলো এমন এক জায়গায় যাই যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না।"
"সেই জায়গাটা কোথায়?"
"জানা নেই৷ তবে খুঁজে নেব।"
"প্লিজ মজা করা বাদ দেন৷ চলেন যাই।"
"কোথায় যাবে সেটা তো বলো।"
"জায়গা আপনি ঠিক করেন। কাল তো ঢাকায় ফিরে যাব। যাওয়ার আগে কোথাও থেকে ঘুরে যেতে চাই।"
"নিরবের খালামনির বাসা থেকে ঘুরে আসি চলো।"
"সেখানে কী আছে?"
"তেমন কিছুই নেই। আবার অনেককিছুই আছে।"
"তাহলে তো অবশ্যই যাওয়া উচিত।"
"কিন্তু লিমনকে কী বলে ম্যানেজ করবে?"
"ভাইয়া তো বাসায় নেই। শ্বশুরবাড়ি গেছে। কালকে আসবে। আর মামা-মামিকে বলব ফ্রেন্ডের জন্মদিন আজ।"
"জন্মদিন কি কারো আসলেই আছে?"
"ধুর! না। মিথ্যা বলব।"
"মিথ্যা বলাও শিখে ফেলছ?"
"শেখার কী আছে? প্রেম করার জন্য একটু আধটু মিথ্যা বললে কিছু হয় না।"
আমান হেসে বলে,
"ঠিকাছে। কে কে যাচ্ছি আমরা?"
"আপনি, আমি, তরু আর শিশির। সঙ্গে ক্যাবলাকান্ত তো ফ্রি।"

নিরব পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। নিহির কথা শুনে অসহায়ের মতো মুখ করে বলে,
"আমাকে ফ্রি বানিয়ে দিলেন ম্যাম?"
নিহি হাত দিয়ে চুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলে,
"আপনি দুধভাত।"
এবার নিরব হেসে ফেলল। সঙ্গে আমান আর নিহিও হাসলো।


আকাশ আজ পরিষ্কার। খুব বেশিই পরিষ্কার। রাশি রাশি তারা আকাশে জ্বলজ্বল করছে। একটি মাত্র চাঁদ থালার মতো পূর্ণাঙ্গ আকৃতির। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে মাটিতে। বড়ো বড়ো গাছপালার মাঝ বাগানে দাঁড়ালেও স্পষ্ট দেখা যাবে মুখাকৃতি। মেঠো পথ দিয়ে হাঁটছে তিনজন কপোত-কপোতী। আমান-নিহি, শিশির-তরু এবং নিরব-জান্নাত। নিরব আর জান্নাতের ভাব-ভালোবাসাও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সাহায্য করেছে আমান এবং নিহি। বাড়িতেও জানানো হয়েছে। খুব শীঘ্রই বিয়ে করে ফেলবে বলে জানিয়েছে দুই পরিবার। তাদের সিদ্ধান্তে দুজনই ভীষণ খুশি। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ কার না থাকে?

চাঁদের আলোয় মাঠ-ঘাট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বলে আলাদা লাইটের কোনো প্রয়োজন হয়নি। বর্তমানে সবাই এখন আছে জান্নাতদের বাড়ির কাছাকাছি জায়গাতে। এসেছে বিকেলেই। তবে হাঁটতে বের হয়েছে এখন। সামনেই একটা নদী আছে। ঘাটে বাঁধা আছে সারি সারি নৌকা। নিহি নৌকায় চড়তে ভালোবাসে। আমান সেটা জানে এবং এজন্যই এই জায়গাতে নিয়ে আসে। খোলা আকাশের নিচে এক নৌকায় দুজনে বসে গল্প করবে। নিহিকে জানিয়ে দেবে অজানা কথাগুলো। ভাবতেই মনের মাঝে দোলা দিয়ে যায়৷ আবার ভয়ও লাগে। কী জানি কী না রিয়াক্ট করে বসে!

হাঁটতে হাঁটতে ঘাটে চলে আসে সবাই। তিনটে নৌকায় দুজন করে উঠে বসে। নৌকার এক মাথায় আমান বৈঠা হাতে বসেছে। নিহি শেষ প্রান্তে বসতে গেলে আমান বলে,
"ওখানে নয়। মাঝখানে বসো। পড়ে যেতে পারো।"
"না, পড়ব না। এর আগেও আমি নৌকায় উঠেছি।"
"আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না নিহু!"

হালকা রাগ ও ধমক মিশ্রিত কণ্ঠে কথাটা শুনে নিহির আর সাহস হয়নি ওখানে বসার। নৌকার মাঝ বরাবর নারিকেল পাতার ছোটো পাটি বিছানো আছে। নিহি সেখানে গিয়ে বসল। পানিতে বৈঠা ফেলতেই গোলাকৃতির মতো পানি ছড়িয়ে পড়ল। চারপাশে থৈ থৈ করছে পানি। বিশুদ্ধ বাতাস বয়ে চলেছে। পূর্ণাঙ্গ চাঁদটার প্রতিচ্ছবি পানির মাঝেও ভেসে উঠছে। তরু, শিশির, নিরব এবং জান্নাত ওদের নৌকা অনেকদূর চলে গিয়েছে দেখে নিহি বলল,
"ওরা সবাই কত দূরে চলে গেল! আর আমরা এখনো এখানেই পড়ে আছি।"
"ইচ্ছে করেই যাইনি।"
"কেন?"
"তোমার অপেক্ষার প্রহর আজ শেষ করব তাই।"

নিহি আৎকে উঠে বলে,
"ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিবেন নাকি?"
"নিহু!" মেকি ধমক দিলো আমান।
নিহি চুপসে গিয়ে বলল,
"ধমক দেন কেন? আমি তো মজা করে বলেছি।"
"এসব মজা একদম করবে না। অন্তত আমার সাথে তো নয়-ই!"
"হু।"

অভিমানে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকায় নিহি৷ বৈঠা নৌকার ওপর রেখে তার পাশে আমান বসে। নিহি চমকে গিয়ে বলে,
"একি! উঠে আসলেন কেন? নৌকা ডুবে যাবে তো!"
"ডুববে না। তুমিই না তখন বলেছিলে যেদিকে দু'চোখ যায় সেদিকেই যাবে? তাহলে এখন নৌকা আমাদের যেদিকে নিয়ে যাবে আমরাও সেদিকে যাব।"
"যদি ডুবে যায়?"
"আমায় বিশ্বাস করো?"

আমানের চোখের দিকে তাকালো নিহি। ঘোর লাগানো দৃষ্টি তার। চোখে চোখ রেখে বলল,
"অনেক বেশি!"
"ব্যাস! তাহলেই হবে। এতটুকু ভরসা রাখো শুধু, আমি থাকতে তোমার কিছু হবে না।"
"আমি জানি সেটা। আচ্ছা কী যেন বলবেন বলেছিলেন?"
আমান চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ।নিহির হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে রেখেছে।নিহি উত্তরের জন্য আমানের দিকে তাকিয়ে আছে। আমান ঘাড় বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকায়। ঠোঁট কামড়ে বলে,
"আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি!"

সঙ্গে সঙ্গে নিহির দুটো আলগা হয়ে যায়। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। আমান আবার বলে,
"শুধু তাই নয়। বিগত চার বছর ধরে ভালোবাসি। কিন্তু কখনোই তাকে ভালোবাসার কথা বলতে পারিনি।"

নিহি নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। আমানের কথাগুলো মনে হচ্ছে প্রতিধ্বনি হয়ে কানে আসছে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। অন্য কাউকে ভালোবাসে সে? তাহলে এতটা দিন এসব কী ছিল? নাটক! নাহ্, আর ভাবা যাচ্ছে না। এরচেয়ে গলায় কলসি বেঁধে নৌকায় ডুব দিলেও এতটা কষ্ট হতো না। চোখের পানি চাঁদের আলোয় চিকচিক করে ওঠে। গলা ধরে আসছে। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে। যেকোনো মুহূর্তে হুহু করে কেঁদে ফেলবে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল নিহি।

আমান আবার বলল,
"তখন সে ক্লাস এইটে পড়ত। মাঝে মাঝেই তাকে দেখতাম ছাঁদে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। সে আমায় দেখতো না। এরপর..."

নিহি বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে। আমান হাত টেনে ধরে নিহির৷ পাছে আবার পানিতে ঝাপ দেয়! নিহি কোনোরকমভাবে বলে,
"আমি বাড়ি যাব!"
"বাড়িতে নিয়ে যাব। তার আগে আমি কথা শেষ করি।"
নিহি এবার কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে। দু'হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে বলে,
"আপনার এসব কথা শোনার সাহস হচ্ছে না আমার। বুকের ভেতর তীরের মতো বিঁধছে। আমি পারব না আপনার পুরো কথা শুনতে।"

'যদি গো তোমায় বলি
আমি তার নাম;
তুমি কি বাসবে ভালো,
দেবে তার দাম?'

আমানের সুরেলা কণ্ঠে পরিচিত গানের লাইনগুলো শুনে নিহি চমকে তাকায়। আমানের ঠোঁটে মুচকি হাসি।

'কাজল কালো দুটি চোখে
সে যখনই আমায় দেখে,
পড়ে না চোখেতে পলক;
আর আসে না কথা মুখে।

তার চলে যাওয়া
ফিরে একটু চাওয়া
এই বুকেতে ঝড় তুলে যায়!

যার ছবি এই মন এঁকে যায়
যার কথা ভেবে দিন কেটে যায়,
সে কি জানে শুধু তাকে
ভালোবাসে আমার হৃদয়!'

ডাগর ডাগর অশ্রুশিক্ত চোখে নিহি এখনো নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে।

'তুমি সুন্দর। চাঁদের আলোয় ঠিকরে পড়া তোমার হাসির ধ্বনি, নদীর কলকলানিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। তোমার ঐ দুটো টানা টানা চোখে অশ্রু বেমানান। তুমি হাসবে। তোমার সঙ্গে হাসবে ঈর্ষান্বিত প্রকৃতি৷ হাসবে অপরূপ ধরণী। যে ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল এতটা সময় দীর্ঘকাল, আজ তার সবটাই করব প্রকাশ। আমি ভালোবাসি তোমায়। তুমি কি দেবে সেই ভালোবাসার দাম?'

"তার মানে! তার মানে আপনিই সেই নাম না জানা উড়োচিঠির মালিক?" কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে প্রশ্ন করে নিহি।

আমান দু'হাত প্রসারিত করে মুচকি হেসে গায়,
'কবে জানবে তুমি?
কবে বলব আমি?
কেউ আছে গো;
তোমার আশায়।'

নিহি সঙ্গে সঙ্গে আমানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
________________

উপমার বাবার শরীরটা বেশ কয়েকদিন ধরেই ভালো যাচ্ছে না। ওষুধও শেষ। ওষুধের প্রেসক্রিপশন আর টাকা নিয়ে মাকে বলে বাসা থেকে বের হয় উপমা। রাত তখন সাড়ে দশটা। বাড়ির সামনেই রিক্সা পেয়ে যায়। দোকান থেকে ওষুধ কিনে আনার সময় খেয়াল করে কয়েকজন ওকে ফলো করছে। আসলেই ফলো করছে নাকি এটাও শিওর না। আন্দাজে কিছু বলাও যাচ্ছে না। দ্রুত পা চালিয়ে একটা রিক্সায় উঠে উপমা। মাঝ রাস্তায় এসে কয়েকজন ছেলে রিক্সা থামায়। এক প্রকার জোর করেই উপমাকে রিক্সা থেকে নামায়। বাড়ি এবং বাজারের মাঝ বরাবর এই রাস্তাটা নির্জনই বলা চলে। উপমা আৎকে ওঠে। নিয়ন বাতির আলোতে চেহারাগুলো ঝাপসা বোঝা যাচ্ছে। ওদের মধ্যে দুজন মেয়েও আছে। একজন মেয়ে ওর হাত ধরে বলল,
"চলো।"
"কে আপনারা? আমি কোথাও যাব না।" হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল উপমা।

ওরা আর কেউ কোনো কথা না বলে ক্লোরোফর্ম মাখানো রুমালটা উপমার মুখে চেপে ধরে। উপমা অজ্ঞান হওয়ার সাথে সাথে ওদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়।


ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দূরে কোথাও হুতুম পেঁচাও ডাকছে বলে মনে হচ্ছে। উপমা নড়াচড়া করতে গিয়ে বুঝতে পারল কিছুর সাথে শক্ত করে ওকে বেঁধে রাখা হয়েছে। মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। মুখও বাঁধা। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে না পারায় ফ্যাসফ্যাসে গোঙানোর শব্দ হচ্ছে। শক্ত রশি দিয়ে হাত বাঁধা আছে বোঝা যাচ্ছে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গেলেই অসহনীয় ব্যথা লাগছে।

হুট করেই মাথার ওপর সাদা লাইট জ্বলে ওঠে। আলো খুব বেশি নয়। তবে এতটুকু আলোতে বোঝা যাচ্ছে কেউ একজন ওর দিকে এগিয়ে আসছে৷ মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে সে একজন ছেলে!

৪৪!!

কাজল আঁখির ন্যায় কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশজুড়ে। এইতো বোধ হয় এখনই ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নামবে। পাখিরা ফিরে চলেছে ওদের আশ্রয়স্থলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এই তেজী রূপ পর্যবেক্ষণ করছিল আমান। আজমল আহমেদের অফিসে জয়েন করেছে তিন মাস ধরে। বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব বেশি হয়ে যাওয়ায় এই বাড়িতে থাকা। এখান থেকে আমানের অফিসটাই শুধু কাছে হয়। অনামিকা রহমান এবং অনলের কলেজ দূরে হওয়ায় তারা আগের বাড়িতেই থাকতেন। ছোট থেকেই আমানের একা থেকে অভ্যাস আছে। নিজের সব কাজ নিজেই করতে পারে। আগে অবশ্য শুধু ডিম ভাজিটাই পারত। বিদেশে পড়তে গিয়ে সব শিখে নিয়েছে৷ তাই একা থাকতে খুব বেশি অসুবিধা হয়নি ওর।

বারান্দায় বসে যখন আবহাওয়া অবলোকন করছিল তখন একটা ওড়না উড়ে এসে নিচে পড়ে। আমান উঁকি দিয়ে সরাসরি থাকা ফ্ল্যাটটির ছাদের দিকে তাকায়৷ একটা মেয়ে ছাদ থেকে উঁকি দিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে। প্রচণ্ড বাতাসে চুলগুলো উড়াউড়ি করছে। কিছু চুল এসে মুখ ঢেকে রেখেছে। তাই মুখটা দেখা যাচ্ছিল না। এবার নিচের দিকে তাকালো। লাল রঙের একটা ওড়না রাস্তায় পড়ে আছে। তখন আমানের হুশ আসে ওর নিজের পোশাকও তো ছাদে শুকাতে দিয়েছিল। তৎক্ষনাৎ দৌঁড়ে ছাদে যায় সে। কাপড় তুলতে তুলতে বৃষ্টি পড়া শুরু করে। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে আনমনে একবার পাশের ছাদে তাকায়৷ সেই মেয়েটা! এবার মুখটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে৷ চিলেকোঠার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে আমান। মেয়েটার অবাধ্য চুল হাওয়ায় উড়ছে। কপালে ভাঁজ পড়ে আছে। চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। কাপড়গুলো তুলে মেয়েটা দৌঁড়ে ছাদ থেকে নেমে যায়।

এক ধ্যানে কিছুক্ষণ মেয়েটার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে আমান। পা স্থির হয়ে আছে। বৃষ্টি এবার ঝুপ ঝুপ করে নেমেছে৷ অনমনস্ক থাকায় খেয়ালই করেনি৷ যখন খেয়াল হলো তখন আনমনেই হেসে ফেলে।

জানালার থাই গ্লাসে বৃষ্টি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। পাশেই একটা টেবিল। অনেকদিন বাদে প্রিয় একটা ডায়েরী বের করল আমান। কলমদানি থেকে কলম নিয়ে লিখতে শুরু করল,
'এলোকেশী
কে সে তুমি?
দমকা হাওয়ায় ওড়না উড়ালে;
উড়ালে এলোকেশ
এলোকেশে দিওয়ানা হয়ে এখন আমার
পাগল, পাগল বেশ!'

ডায়েরীটা বন্ধ করে একবার আনমনেই হাসলো। তারপর বারান্দায় গিয়ে নিচে দাঁড়ালো। ওড়নাটা এখনো সেখানেই পড়ে আছে। মেয়েটা এমন কেন? ওড়না নিতেও আসলো না! ছাতা মাথায় আমান নিজেই নিচে নামে৷ দারোয়ান সিকিউরিটি রুমে বসে ঝিমুচ্ছিল। বৃষ্টি হচ্ছে বলে বাইরেও কোনো মানুষজন নেই৷ চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ওড়নাটা নিয়েই ভেতরে চলে আসে আমান। সাবান দিয়ে খুব সুন্দর করে ধুয়ে পাশের রুমে ফ্যান ছেড়ে শুকাতে দেয়।

এরপর থেকে প্রায়ই আমান বারান্দায় আর ছাদে যেত। এলোকেশীকে দেখতে পেলেই লুকিয়ে পড়ত। কেন জানি আড়াল থেকে দেখতেই ভালো লাগত। এলোকেশী মুগ্ধময়ী প্রণয়িনী। তবে ছোট। এই ছোট মেয়েটার হাসিতেই যে এত মাদকতা এটা না দেখলে আমান জানতোই না। এইতো সেদিনের কথা। শরীরটা খারাপ লাগায় তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়িতে এসেছিল। বিকেলে যখন ছাদ থেকে কাপড় তুলতে যায় তখন দেখতে পেল সেই এলোকেশীকে। ছাদে ছোটাছুটি করছে ছোট ছোট কতগুলো বাচ্চাকে নিয়ে। আরেকজন মেয়ে সমানে বকেই চলেছে। এই মেয়েটাকে এর আগে অনেকবার দেখেছে আমান। এলোকেশীর চেহারার সাথে অনেক মিল। হয়তো বোন হয়। বকা খেয়ে এলোকেশী আরও খিলখিল করে হেসে ওঠে। সেই হাসিতে ঘায়েল হয় আমান।

আরেকদিনের ঘটনা। আমান অফিসে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল। তখন সামনের ফ্ল্যাটটির ভদ্রলোক আমানকে জিজ্ঞেস করলেন,
"ভাই কি বাজারের দিকে যাচ্ছেন?"
"জি ভাই৷" মুচকি হেসে উত্তর দিল আমান।
লোকটি বলল,
"সমস্যা না থাকলে যদি একটু লিফ্ট দিতেন। একচুয়ালি আমার বাইকের হুট করেই কী যেন হয়েছে। এদিকে হাতে বেশি সময়ও নেই৷ ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাতে না পারলে বুঝেনই তো!"

আমান আগের মতোই হেসে বলল,
"কোনো সমস্যা নেই ভাই। গাড়িতে বসুন।"
"থ্যাঙ্কস।" বলে সে গাড়িতে উঠে বসল। প্রথম পরিচিত হওয়ার পর্ব সে-ই শুরু করল। ডান হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
"হাই, আমি সৈকত।"
স্টিয়ারিং থেকে ডান হাত তুলে হ্যান্ডশেক করে আমান বলল,
"আমি আমান।"
"আগে তো এই বাড়িটা ফাঁকা ছিল। আপনি কি ভাড়া নিয়েছেন?"
"না। আমাদেরই বাড়ি এটা। তিন মাস হবে এসেছি।" হেসে বলল আমান।
"ওহ আচ্ছা। একাই থাকেন?"
"হ্যাঁ। যাতায়াতের সুবিদার্থে।"

যেতে যেতে আরও অনেক গল্পগুজব হয়। আমান সৈকতের চেয়ে বয়সে ছোট হওয়ায় তুমি করে বলতে বলল আমান। সৈকতও অনায়াসে তুমি তুমি করে কথা বলছিল। আমান তখন কৌশলে জিজ্ঞেস করে,
"আপনি তো ফুল ফ্যামিলি এখানে থাকেন?"
"না। আমি আর আমার স্ত্রী। তোমার মতোই অফিসের সুবিদার্থে এখানে থাকি।"
"তাহলে একটা ছোট মেয়েকে যে সেদিন দেখলাম। আপনার বোন?"
"কে? তুমি মনে হয় নিহির কথা বলছো।"
"আমি তো চিনি না তাকে৷ তার সাথে আরো একজনকে ছাদে দেখেছিলাম। চেহারার অনেক মিল রয়েছে।"
"ওহ। তাহলে মিহি আর নিহিকেই দেখেছ। মিহি আমার স্ত্রী। আর নিহি শালীকা হয়। আমার কোনো বোন নেই। ওকে আমার বোনের মতোই দেখি। কাল বিকেলে বাড়ি চলে গেছে।"
"ওহ।"
আমান কৃত্রিম হাসি হাসলো সৌজন্যতার খাতিরে। কিন্তু চলে গেছে শুনে মনটা কেন জানি বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল।

এভাবে সময় কেটে যায় আরো চার মাস। সৈকত আর মিহির সাথেও ভালো একটা সম্পর্ক হয়। এতদিনে নিহির কথা খুব করেই মনে পড়ত। কিন্তু তাই বলে কাজে ফাঁকি দিত না একদম। বাবার বিজনেসের হাল ধরেছিল শক্ত হাতে। কখনো কখনো অফিস থেকে ফিরতে রাত এগারোটাও পার হয়ে যেত। ফ্রি হয়ে মধ্য রাতে ডায়েরীটা নিয়ে বসত। মুক্তর মতো অক্ষরে লিখত,
'নিহু! নিহুপাখি। তুমি কি আমার হবে? কখনো জানতে পারবে আমার মনের কথা? আচ্ছা আমি কি তোমায় ভালোবাসি?'

শুক্রবার। বন্ধের দিন। বাজার করে বাড়ি ফিরছিল আমান। তখন মিহির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সাথে সৈকতও ছিল। ওদের বাজারের ব্যাগ অনেকগুলো দেখে কয়েকটা ব্যাগ নিজের হাতে নিল আমান। গল্প করতে করতে তিনজনে একসাথে বাসায় আসে। মিহি আর সৈকত বায়না ধরে আজকে দুপুরের খাবার আমানকে ওদের বাড়িতেই খেতে হবে। আমান রাজি হয়। কথার ফাঁকে ফাঁকে কৌশলে মিহির মুখ থেকে নিহির সব খবর জেনে নেয়। নিহির স্কুল, স্বভাব-চরিত্র সব শোনে। নিহির করা দুষ্টুমির কথা বলতে গিয়ে মিহি কখনো হেসে লুটোপুটি খেয়েছে। আরো এক দফা বেশি ভালোবাসা অনুভব করা শুরু করেছিল আমান।

পরেরদিনই সকালবেলা নিহির স্কুলে সামনে চলে যায়। দূর থেকে লুকিয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির প্রিয় হাসি মুখ দেখে মনে শান্তি লাগে। এভাবে প্রায়ই যখনই নিহিকে দেখতে মন চাইতো ছুটে চলে আসতো স্কুলের সামনে৷ লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে মনের তেষ্টা মেটাতো। কখনো মনের কথা জানানোর সাহস হয়নি। সাহস হয়নি বলতে মনে হয়েছিল এটা আসলে উপযুক্ত সময় নয়। একদিন স্কুল ছুটির সময় আমান নিহিকে দেখতে গিয়েছিল। নিহি তখন ক্লাসের এক ছেলের সাথেই ব্যাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিল আর উচ্চশব্দে হাসছিল। পাশেই আরো ছেলেমেয়েরা হাসাহাসি করছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল নিহি বোধ হয় রিলেশনশিপে আছে৷ বাড়িতে এসে বিষন্ন মন নিয়ে আবার লিখতে বসল সে।
'এলোকেশী,
তোমার হাসিতে মুক্ত ঝড়ে। আমার মনে শান্তি আনে। কিন্তু কেন আজ শান্তি নেই আমার মনে। কেন তোমার ঐ হাসি আজ আমার হৃদয়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করল? অন্য ছেলের জন্য কেন হাসবে তুমি? তবে কি তোমায় পাওয়ার আগেই আমি হারিয়ে ফেলেছি?'

কথাগুলো লিখতে লিখতে দু'ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিল আমান৷ এভাবে কেটে যায় আরো পাঁচদিন। এই পাঁচদিনে একবারও আমান নিহিকে দেখতে যায়নি৷ মনের ভেতর অশান্তি হচ্ছিল খুব৷ থাকতে না পেরে পরেরদিনই গেল নিহিকে দেখতে। সকালে নিহির দেখা পায়নি বলে বিকেলে ছুটির সময় আবার গেছে। কিন্তু তখনও ওর দেখা পাওয়া যায়নি৷ পাবে কীভাবে দেখা? সেদিন তো নিহি আসেইনি স্কুলে।

বিষণ্ণ বিষাদিত মন নিয়ে বাড়িতে এসে সারপ্রাইজড হয়ে গেল। যখন দেখল থাই গ্লাসের অপর পাশের বারান্দায় নিহি দাঁড়িয়ে! আনন্দে আত্মহারা হয়ে ডায়েরীতে লিখেছিল,
'তুমি আমার হও বা না হও
তাতে আমার কোনো আফসোস নেই।
আমি তোমায় ভালোবাসি,
আর ভালোবাসব।
না হয় সবসময় তোমার দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যাব আড়ালে আবডালে।'

এভাবে কেটে যায় অনেকটা সময়। নিহির এস.এস.সি শেষ হয়। পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পর পুরো অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছিল৷ অথচ এই খবরটাও কখনো জানতেও পারেনি নিহি। নিহির যেই কলেজে পড়ার ইচ্ছে সেই কলেজের নাম জানলো মিহির মুখে। জেনে আনন্দিতও হলো৷ কারণ সেই কলেজেই শিক্ষকতা করেন অনামিকা রহমান৷ এবং ঐ ভার্সিটিতেই পড়ে অনল। তবে কলেজে খুব একটা যাওয়া হতো না। যতটা যাওয়া হতো স্কুলের সামনে। তার কারণও অবশ্য ছিল। ঐ কলেজের কমবেশি সবাই আমানকে চিনত। তারচেয়েও বড় কথা পাছে অনল বা অনামিকা রহমান কিছু টের পেয়ে যায়!

এখন বলছি সেদিনের কথা যেদিন মুগ্ধ করা ঐ হাসিমুখে অশ্রু দেখেছিল আমান। গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল কলেজের সামনে। কিন্তু গাড়ি থেকে বের হয়নি। নিহিকে কাঁদতে কাঁদতে আসতে দেখে বুকের মাঝে মোচর দিয়ে উঠেছিল। ঐ মুখে হাসি থাকবে। অশ্রু নয়! সেদিনই প্রথম চিঠি পাঠায় নিহিকে৷ পিয়নকে এক্সট্রা টাকা দিয়ে নাম-ঠিকানাহীন চিঠি তার মাধ্যমে পৌঁছে দেয় নিহির কাছে। এরপরের কাহিনী আমার পাঠকদের জানা!


শুরু থেকে সবটা বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে শুনল নিহি। একটা মানুষ কী করে এতটা ভালোবাসতে পারে? এতটা সময় ধরে কী করে অপেক্ষা করতে পারে। আমান পানির ভেতর হাত নাড়াচ্ছে। নিহি তাকিয়ে আছে তার দিকে। জিজ্ঞেস করে,
"আপনি জানতেন না আপনার ভাই আমায় পছন্দ করত?"
"না। কারণ তোমার পেছনে আমি কোনো লোক লাগিয়ে রাখিনি কখনো।"
"যদি জানতেন?"
"নিজেকে গুটিয়ে নিতাম।"
"যদি তার সাথে আমার রিলেশন হয়ে যেত?"
"আগের মতোই ভালোবাসতাম। তবে আড়ালে থেকে। তোমায় নিয়ে যে কতশত কবিতা, লেখা আমার ডায়েরীতে ভর্তি তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।"
"আচ্ছা মীরাক্কেলভাবে বিয়েটা কী করে হয়ে গেল?"
"সেটা আমিও জানি না। তবে প্রতি ওয়াক্তে নামাজ পড়ে আমি আল্লাহ্-র কাছে তোমাকে চাইতাম। হয়তো আল্লাহ্-র ইচ্ছেটা এমনই ছিল।"
"বিয়ের পরও আপনি চিঠি পাঠাতেন। কিন্তু কেন?"
"বলতে পারো সেটা এক প্রকার ছোট্ট পরীক্ষা করার জন্য।"
"মানে?"
"মানে আমি তো এমনিতেই সন্দিহান ছিলাম যে, তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে কী-না। তার মধ্যে বিয়ের দ্বিতীয় দিনই তুমি ডিভোর্স চাইলে। আমি আরো ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম, চিঠি দেওয়া বন্ধ করব না। যদি তুমি অন্য কোনো রিলেশনে থেকে থাকো তাহলে চিঠির প্রতি অনীহা থাকবে তোমার। আর যদি রিলেশনে না থাকতে তাহলে হয় ঐ চিঠির মালিকের প্রতি আকৃষ্ট হতে নয়তো আমায় ভালোবাসতে।"
"পরে তো জেনেছেন আমি কোনো রিলেশনে ছিলাম না৷ তবুও কেন চিঠি পাঠাতেন?"
"ঐযে বললাম! তাছাড়া আরো একটা কারণ ছিল। আমি লক্ষ্য করছিলাম তুমি ধীরে ধীরে আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছো। আমি শিওর হতে চাচ্ছিলাম তুমি আসলেই আমায় ভালোবাসো কী-না!"
"কী? আপনি আমায় সন্দেহ করতেন?"
"না তো। শুধু ভয় দূর করেছিলাম।"
"আচ্ছা ঐ পিচ্চি ছেলেটা কে তাহলে? ওকে আমি অনলের বাইকেও দেখেছিলাম।"
"পিচ্চিটার নাম জিসান। আমি যেই ফ্ল্যাটে থাকি ঐ বাসার সিকিউরিটি চাচার ছেলে হয়। অনলের সাথেও ওর খুব ভাব।"
"হায় আল্লাহ্! আমি আরো ভেবেছিলাম চিঠিগুলো অনল দেয়। আচ্ছা সেদিন যে আমি ঐ পিচ্চিটার পিছু পিছু দৌঁড়াচ্ছিলাম তখন কি আমায় ফলো করছিলেন?"

এবার আমান হাসতে হাসতে বলল,
"আরে না৷ আমি অফিস থেকেই ফিরছিলাম। তোমায় বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পর জিসান ওর মায়ের ফোন থেকে ফোন করে আমায় সব বলেছিল।"
"কী বলেছিল?"
"বলেছিল, 'ভাইয়া ভাবি আজকে আমায় যেই দৌঁড়ানি দিছে! পা ব্যথা হয়ে আছে আমার। তুমিও ভাবির সাথে দৌঁড়িয়ে পারবে না মনে হয়'।" শব্দ করে হাসতে হাসতে বলল আমান।
__________________

উপমার মুখোমুখি বসে আছে ছেলেটা। স্তব্ধ চারপাশ। মুখ ঢাকা ছেলেটির। উপমার মুখের বাঁধন খুলে দিতেই সে জড়োসড়ো হয়ে যায়। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
"ক...কে আপনি?"
ছেলেটি চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বসে বলল,
"আমায় তো তুমি চিনবে না।"
"তাহলে আমায় এখানে নিয়ে এসেছেন কেন? কারা আপনারা? কী করেছি আমি?"
"তোমার দোষ একটাই। তুমি নিহির ফ্রেন্ড!"

উপমা এবার চুপ হয়ে যায়। ছেলেটি বলে,
"এখন খুব আফসোস হচ্ছে তাই না? আমিও তাই ভাবী। কেন যে তুমি নিহির ফ্রেন্ড হতে গেলে!"
"নিহিকে নিয়ে আপনার কী সমস্যা? নিহিকে চিনেন কীভাবে?"
"আরে, আরে! আস্তে। আস্তে প্রশ্ন করো। নিহির নাম শুনতেই ভয়েসের জোর দেখি বেড়ে গিয়েছে। ভয় করছে না এখন?"

ঢোক গিলে উপমা বলে,
"আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।"
"আমি দিচ্ছি।" ছেলেটার পেছন থেকে উত্তর দিল একজন। কণ্ঠটা মেয়েলি। পরনে কালো শাড়ি। আস্তে আস্তে মেয়েটা যখন এগিয়ে এলো তখন মনে হলো শাড়িটা আসলে কালো নয়। নেভি ব্লু। চুলগুলো কোঁকড়া কোঁকড়া কোমর পর্যন্ত। ছেলেটি চেয়ার থেকে উঠে গেল। মেয়েটি বসল সামনে। লাইটের অস্পষ্ট আলোতেও মুখটা ভীষণ পরিচিত। মেয়েটি খুব মিষ্টি করে হাসলো। খুশির হাসি। কোনো কিছু জয় করেছে বা জয় হবে এটা শিওর জানার পর যতটা হাসিখুশি একজনকে দেখায় সামনের মেয়েটিকেও ততটাই হাসিখুশি দেখাচ্ছে। চোখের কোটর থেকে চোখগুলো বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে উপমার। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
"সুমাইয়া আপু!"

মেয়েটি চোখ পিটপিট করে বলল,
"আহা! সুমাইয়া নয়। আমি সামিয়া। সুমাইয়ার যমজ বোন। আমাদের দুজনকে একই রকম দেখতে তাই না?"
"আপনি! আপনি সুমাইয়া আপুর যমজ বোন?"
"কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?"
তারপর পাশের ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
"আমাদের দু'বোনের ছবি বের কর তো ফোন থেকে।"
"আপনার সাথে নিহির কীসের শত্রুতা?" উপমার প্রশ্ন।

সামিয়া ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
"সমস্যা তো আগে ছিল না ডিয়ার। ঐ মেয়েকে তো আমি চিনতামই না। আর একজন অচেনা মেয়ে আমার খুব কাছের একজনকে কেড়ে নিয়েছে। আমার আমানকে কেড়ে নিয়েছে।"

শেষের কথাটা চেঁচিয়ে বলল। উপমা ভয় পেয়ে যায়। সামিয়া আবার বলে,
"এতটা সময় ধরে আমি আমানকে ভালোবাসি। আর শেষমেশ কী-না অন্য একটা মেয়ে এসে আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়ে যাবে?"
"আপনি আমান ভাইয়াকে ভালোবাসেন বা না বাসেন তাতে নিহির কী? বিয়েটা তো ওদের কারো ইচ্ছেতে হয়নি।"
"তাই? তা বেশ তো,নিহি চলে যাক আমানের জীবন থেকে। তাহলেই তো সমস্যা সমাধান।"
"কখনো না। ওরা কখনোই আলাদা হবে না।"

সামিয়া উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলল,
"বোকা মেয়ে! আলাদা হবে নাকি হবে না সেটা পরে দেখা যাবে৷ এইযে, তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি। সেটা কি এমনি এমনি? আমি তো জানি তোমার প্রতি নিহির ভালোবাসার গভীরতা। খুব গলায় গলায় পিরিত না দুই বান্ধবীর? অবশ্য এতে তো আমারই লাভ হয়েছে।"
"কী করতে চাচ্ছেন আপনি?"
"তেমন কিছু না। শুধু আমানের থেকে নিহিকে আলাদা করতে চাচ্ছি। আর সেটা তোমাকে হাতিয়ার করে। তোমার প্রাণের দাম নিশ্চয়ই আছে নিহির কাছে? এখন ঝটপট তোমার ফোনের লকটা খোলো। নিহির নাম্বারটা দাও।"
"দেবো না। প্লিজ নিহির কোনো ক্ষতি করবেন না আপনারা। আমায় ছেড়ে দিন।"
"ভালোভাবে বলছি। আমার কথা শোনো।" উপমার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল সামিয়া।
"আপনার পায়ে পড়ি আমি। ছেড়ে দিন আমায়। আমি তো কোনো ক্ষতি করিনি৷ কেন আমায় আটকিয়ে রাখছেন?" কাঁদতে কাঁদতে বলল উপমা।
"ভয় নেই মনে? লক খোলো। ভালোভাবে বলছি শোনো। নয়তো..."
"নয়তো?"
"নয়তো নিহির ছোট্ট গুলুগুলু ভাস্তি তিতির আর তোমার আদরের ছোট বোনকে লাশে পরিণত হতে হবে।"
"অসভ্যর বাচ্চা! জঘন্য মহিলা তুই। ওদের কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করলে জানে মেরে ফেলব তোকে।" উত্তেজিত হয়ে বলল উপমা।

সামিয়া উচ্চস্বরে হেসে জোরে থাপ্পড় বসায় উপমার গালে। ফর্সা গালে হাতের ছাপ পড়ে যায়। চেয়ারের হাতলে দু'হাত রেখে উপমার দিকে একটু ঝুঁকে দাঁড়ায় সামিয়া৷ দাঁত কটমট করে বলে,
"যেখানে তোর নিজের জীবনই ঝুঁকিতে আছে,সেখানে তুই আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিস?"
Author, Publisher & Developer

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উফ!
মনে হচ্ছে আপনার ইন্টারনেট সংযোগে কিছু সমস্যা আছে। অনুগ্রহ করে আগে আপনার ইন্টারনেটের সংযোগ ঠিক করুন এবং তারপর আবার ব্রাউজিং শুরু করুন৷
AdBlock সনাক্ত করা হয়েছে!
আমরা শনাক্ত করেছি যে আপনি আপনার ব্রাউজারে অ্যাডব্লকিং প্লাগইন ব্যবহার করছেন৷ আমরা আপনাকে আপনার অ্যাডব্লকিং প্লাগইন বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করছি, কারন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমরা যে রাজস্ব আয় করি তা এই ওয়েবসাইট পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হয়।