৩৫!!
-এসব কি হচ্ছে? রোদ? তুমি এখানে কি করছ? তোমাকে না বারণ করেছি ভোরের আশেপাশেও আসবে না? তবু ভোর হতে না হতেই তুমি চলে এসেছ ভোরকে বিরক্ত করতে? তোমার সাহস হয়ে কি করে আমার নিষেধ শর্তেও তুমি এই বাড়িতে ভোরের রুমে ঢুকেছ? তোমাকে এই বাড়িতে এলাউ করেছে কে? হ্যালো? তোমার সাথে কথা বলছি আমি? আমার কথা কি কানে যাচ্ছে না তোমার?
দরজার সামনে থেকে আতিক আহমেদের কথাগুলো শুনতে পেয়েও রোদ এতোক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবারে চোখ তুলে তাকালো। রোদের চোখের দিকে চোখ পড়তেই আতিক আহমেদ আর শায়লা আহমেদ দুজনেই চমকে উঠলেন। রোদ এবারে ভোরকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে এসে গ্লাস থেকে পানি নিয়ে ভোরের চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেয়ার চেষ্টা করলো। আতিক আহমেদ এবারে এগিয়ে এসে রোদের হাত চেপে ধরে টেনে উঠানোর চেষ্টা করলো। রোদ রাগের চোটে নিজের হাতটা ঝাড়ি দিয়ে আতিক আহমেদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আতিক আহমেদের দিকে ফিরে তাকালো এবারে।
-এই তোমরা ভোরের খেয়াল রেখেছ? কি অবস্থা করেছ মেয়েটার দেখতে পাচ্ছ? চোখ পর্যন্ত খুলছে না আমার ভোরটা। ওর যদি আজ কিছু হয় বাবা, তাহলে তোমাদের কাউকে ক্ষমা করবো না আমি কোনোদিন।
-রোদ? তোর বাবার সাথে কিভাবে কথা বলছিস তুই? আর ভোরের কি হয়েছে? ভোর মা?
-ওখানেই দাঁড়াও মা। ভোরের কাছে আসবে না তুমি। তুমি না, তোমরা কেউ আসবে না আমার ভোরের কাছে। তোমরা ওর কি খেয়াল রেখেছ চারদিনে দেখা হয়ে গেছে আমার। আর দেখার ইচ্ছে নেই। আমার ভোরের খেয়াল আমি একাই রাখতে পারবো। তোমাদের কাউকে দরকার নেই আমার।
-রোদ? কি বলছিস এসব? ভোরের কি হয়েছে দেখতে দে আমাকে-----।
-ভোরের কি হয়েছে তোমাদের জানার তো প্রয়োজন নেই। তোমরা তোমাদের জেদ ধরেই বসে থাকো। আমি ভোরকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি। শুধু একটা কথা জেনে রাখো মা। আজ যদি ভোরের কিছু হয়, জেনে রেখো, আজ তোমরা তাহলে শুধু ভোরকেই হারাবে না, ওর সাথে সাথে নিজের ছেলেকেও হারাবে।
-রোদ?!
আতিক আহমেদ আর শায়লা আহমেদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রোদ ভোরকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। রোদের সাথে সাথে ভোরের বাবা মা ও বেরিয়ে গেলেন কাঁদতে কাঁদতে। আতিক আহমেদ আর শায়লা আহমেদ দুজনেই কয়েক মূহুর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে উনারাও রোদের পিছন পিছন বেরিয়ে গেলেন। রোদ নিজের গাড়িতে করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভোরকে নিয়ে হাসপাতালে এলো। পুরো রাস্তায় একবারও ভোর চোখ মেলে তাকায় নি দেখে রোদের ভয় আরো বাড়ছে। ডাক্তাররা ভোরকে আইসিইউতে রেখে নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে শুরু করলো। গ্লুকোজ, স্যালাইন, অক্সিজেন মাস্ক এসবের ভিড়ে ভোরকে কেমন যেন অচেনা লাগছে রোদের। আইসিইউর ছোট্ট জানালাটা দিয়ে আর কিছু দেখার মতো সাহস আর হলো না রোদের। দরজার সামনেই ধপ করে বসে পড়লো রোদ।
বেশ কয়েকটা ঘন্টা কেটে যাওয়ার পর আইসিইউর দরজা খুলে যেতেই রোদ চমকে উঠে দাঁড়ালো। ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই বাকিরাও ডাক্তারকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে ভোরের কি অবস্থা জানার জন্য। ডাক্তার সবার মুখের দিকে এক নজর দেখে নিয়ে চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। রোদ এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এবারে আর পারলো না। ডাক্তারের সামনে এসেই দাঁড়িয়ে পড়লো।
-আঙ্কেল? ভোর কেমন আছে এখন? ওর সেন্স এসেছে তাই না? কেমন আছে এখন ও? আমার কথা জিজ্ঞেস করছে তাই না? আমি---আমি রোদ। আমাকে একবার যেতে দিন না প্লিজ ভোরের কাছে--। ওকে আজই নিয়ে যেতে পারবো তো না আঙ্কেল?
-রিল্যাক্স ইয়াংম্যান। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আর বাদবাকিটা উপরওয়ালার হাতে-----।
-উপরওয়ালার হাতে মানে? ভোরের কি হয়েছে আঙ্কেল? ভোর? আমি ভোরকে দেখবো----- প্লিজ আমাকে যেতে দিন ওর কাছে।
-অবশ্যই যাবে বাবা। কিন্তু সবাই একসাথে এই মূহুর্তে পেশেন্টের কাছে না যাওয়াটাই ভালো হবে বলে আমি মনে করি।
-ভোর কেমন আছে আঙ্কেল? আপনি কি লুকাচ্ছেন বলুন?
-আমরা আপনাদের কাছে কিছুই লুকাতে চাইছি না মিস্টার রোদ। আমি জানি না পেশেন্টের কি হয়েছে বা কেন এমনটা করেছে। লাস্ট চার পাঁচদিন যাবৎ উনি মে বি একদমই খাওয়া দাওয়া করেন নি। তার উপরে মেন্টাল স্ট্রেস, টেনশন, সব মিলিয়ে ব্যাড কন্ডিশনে হসপিটালে এডমিট হয়েছেন পেশেন্ট। হয়তো আর কয়েক ঘন্টা পরে হসপিটালে আনলে রোগীকে আমরা এডমিটও করতাম না।
-হোয়াট!?
-দেখুন, বুঝতেই পারছেন কেমন ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে পেশেন্ট এডমিট হয়েছে। আমরাও আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। পেশেন্টকে গ্লুকোজ, স্যালান পুশ করা হয়েছে। অক্সিজেন এবজর্ব করছিল না বলে আমরা আর্টিফিশিয়াল অক্সিজেনেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তবু পেশেন্ট কোনো রেসপন্সই করছে না। আমরা বুঝতে পারছি না কোথায় প্রবলেমটা হচ্ছে---।
ডাক্তারের কথা শুনে সবাই একে অন্যের মুখের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো একবার। ভোর সবার চোখের আড়ালে এতো কান্ড ঘটিয়েছে সেটাই যেন কারো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। রোদ এবারে প্রায় ডাক্তারের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লো। যদিও ডাক্তার তাড়াতাড়ি রোদকে টেনে তুলে দাঁড় করালো কোনোমতে।
-আরে আরে? কি করছ?
-আপনি প্লিজ আমার ভোরকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন আঙ্কেল। প্লিজ? আমি-- আপনি যত টাকা চান আমি দিবো---। প্লিজ শুধু একবার ভোরকে সু্স্থ করে দিন প্লিজ? প্লিজ আঙ্কেল?
-দেখো বাবা। আমরা ডাক্তার। জাদুকর নই যে জাদুর বলে কাউকে সুস্থ করে তুলবো। আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করেছি। বাকিটা আল্লার হাতে। তবে অনেক সময় হয় কি জানো? পেশেন্ট নিজের মনের বলে অনেক যুদ্ধ জয় করে প্রায় মিরাকেল ঘটিয়ে ফিরে আসে মৃত্যুর মুখ থেকে। আবার অনেক সময় আমাদের হাজার চেষ্টার পরও পেশেন্টের বাঁচার ইচ্ছেটা না থাকার কারণে আমরা আর তাকে বাঁচাতে পারি না।
-আপনি বলছেন ভোর নিজে রেসপন্স করতে চাইছে না?
-দেখো বাবা। পেশেন্টের মনে কি চলছে সেটা তো আমরা বলতে পারি না। খুব বেশি হলে অনুমান করতে পারি। এক্ষেত্রে আমার অনুমান বলছে- এই মেয়ে চায় না সু্স্থ হতে। এভাবে আরো কয়েক ঘন্টা চললে কোনো মেডিসিনে কোনো কাজই হবে না।
-না আঙ্কেল--। ভোর রেসপন্স করবে। ওকে জেগে উঠতেই হবে। উঠতেই হবে--।
-দেখো কি করতে পারো। যেভাবে হার্টরেট ফল করছে তাতে আমার টেনশন হচ্ছে ওকে নিয়ে। হার্টরেট নরমাল না হওয়া পর্যন্ত আমরা কিছু করতেও পারছি না। আর সেন্স না ফিরা পর্যন্ত তেমন কোনো আশার আলোও দেখাতে পারছি না আপনাদেরকে।
-আমি ভোরের কাছে যাবো ডক্টর প্লিজ।
-আমরা সাধারণত আইসিইউতে কাউকে এলাউ করি না। বাট--- আপনি যেতে পারেন। উইশ ইউ অল দা বেস্ট মিস্টার রোদ।
রোদ একনজর বাবার দিকে তাকিয়ে আইসিইউর দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লো। ডাক্তারও তাদের সবার দিকে একবার তাকিয়ে মনের জোর রাখতে বলে নিজের চেম্বারের দিকে চলে গেলেন। আতিক আহমেদ পাশের একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। ভোরকে তো উনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। তবু তার ছোট্ট ভোরের চেপে রাখা কষ্টগুলো কি করে তার চোখ এড়িয়ে গেল? নিজের জেদটাকে বজায় রাখতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ভোরকেই হারিয়ে ফেলবেন উনি? উনি তো শুধু চেয়েছিলেন ভোর ভালো থাকুক। রোদের জন্য হোক বা অন্য কারো জন্য কোনো আঁচ না লাগুক ভোরের হাসিখুশি মুখটায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেই কিনা মেয়েটাকে মৃত্যুর মুখের দিকে ঠেলে দিলেন? ভোরের যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে নিজেকে উনি ক্ষমা করবেন কি করে?
এদিকে বেশকিছুক্ষণ ভোরের বেড থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নিরবে চোখের পানি ফেলেছে রোদ। রুমে থাকা নার্স একটু পরে বেরিয়ে যেতেই রোদ একপা দুপা করে এগিয়ে এসে ভোরের বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। ভোরকে ঘিরে এতো সব ক্যাবল, সিলিন্ডার সব অসহ্য লাগছে রোদের। রোদ নিজেকে কিছুটা শক্ত করে ভোরের স্যালাইন লাগানো হাতটা আলতো করে নিজের দুহাতের মাঝে জড়িয়ে নিলো। ভোরের ঠান্ডা হাতের শিহরণটা যেন নিমিষেই রোদের শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে একবার কেঁপে উঠলো রোদ নিজেই। তবু নিজেকে সামলে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করলো রোদ। যাতে ওর কণ্ঠের কাঁপা ভাবটা ভোরকে আরো ভয় পাইয়ে না দেয়।
-ভোরপাখি? আর কতো বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকবি বউটা? উঠে পড় না সোনা? দেখ আমি চলে এসেছি তো তোর কাছে? একবার চোখ মেলে দেখ না পাখিটা? এই ভোর? ভোর? তোর না দুদিন বাদেই পরীক্ষা? এভাবে ঘুমিয়ে থাকলে কি পরীক্ষা দিবি বল তো? শেষে কি পরীক্ষায় গোল্লা পাওয়ার প্ল্যান করছিস নাকি তুই? ভোর? শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা? আমি কিন্তু এবার চলে যাবো বলে দিচ্ছি ভোর। এভাবে দু্ষ্টুমি করে পড়ে থাকবি তুই এখনও? এই ভোর? শোন না আমার কথাটা একবার? ভোর?
ভোরের কোনো পরিবর্তনই দেখা গেল না রোদের কথায়। রোদ এবারে ভোরের দিকে এগিয়ে এসে ভোরের কানের কাছে মুখ নিয়ে হালকা করে ফুঁ দিলো।
-আজকাল বড্ড বেশি জ্বালাচ্ছিস তুই আমাকে তাই না রে বউটা? খুব সাহস হয়েছে না তোর? একবার সুস্থ হয়ে নে তারপর কেমন মজা দেখাই দেখিস। আমাকে কাঁদিয়েছিস না তুই? এর শাস্তি তো তুই পাবি। অনেক শাস্তি জমা হয়েছে তোর। এখন লক্ষী মেয়ের মতো উঠে বস তো দেখি? কি রে? তুই এখনও কথা শুনছিস না আমার? এবার কিন্তু আমি রেগে যাচ্ছি ভোর। তুই উঠবি? নাকি আমি চলে যাবো? তুই কিন্তু জানিস আমি একবার চলে গেলে মরে গেলেও ফিরেও তাকাবো না তোর দিকে। কষ্ট হবে হয়তো খুব। কিন্তু আমার জেদটাও তুই জানিস ভোর।
এবারও কোনো সাড়াশব্দ নেই। রুমটার শুনশান নিরবতা ভেঙ্গে রোদ জোরে শব্দ করে চেয়ারটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
-তুই তাকাবি না তো আমার দিকে? শুনবি না তো আমার কথা? ঠিক আছে। শুনিস না। আজকের পর থেকে জেনে নিস রোদ বলে আর কেউ তোকে বিরক্ত করবে না। জ্বালাতে আসবে না কোনোদিন। বেঁচে থাকতে তো এই বেহায়া ছেলেটা তোর পিছা ছাড়বে না তাই না ভোর? তাই মরেই নাহয় তোকে মুক্তি দিয়ে যাবো আমি। তাতে অন্তত তুই আর তোর বড়আব্বু দুজনেই শান্তিতে বাঁচতে পারবি----।
-রোদ? যেও না-----।
রোদ ধুপধাপ শব্দ করে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই ক্ষীণস্বরে কথাগুলো শুনতে পেয়ে ছুটে ভোরের দিকে এগিয়ে এলো। ভোরের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ভোরের গালে হাত ছুঁইয়ে আবার ডাকলো রোদ। ভোর এবারেও জবাব দিলো না। কিন্তু মেয়েটার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু পানি জমা হয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে দেখে রোদ নিজেও কেঁদে ফেললো বাচ্চা ছেলের মতো।
-ভোর? এই ভোরপাখি? শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা? আমি রোদ। তোর রোদ। একবার তাকা না ভোর আমার দিকে। প্লিজ? আর একবার ডাক না নামটা ধরে? ভোর?
-আপনি প্লিজ বাইরে যান এখন। আমাদেরকে দেখতে দিন পেশেন্টকে--। প্লিজ?
-হোয়াট? নো। আমি ভোরকে একা রেখে আর কক্খনো কোথাও যাবো না। আমি ওর সাথেই থাকবো----।
-মিস্টার রোদ? প্লিজ? ভোরের কিচ্ছু হবে না। আই প্রমিস। আমাদেরকে আমাদের কাজটা করতে দিন প্লিজ।
ভোরের সাথে কথা বলতে বলতে রোদ খেয়ালই করে নি কখন ডাক্তার, নার্স সবাই আবার এসে জড়ো হয়েছে রুমটায়। এবারে রোদকে আইসিইউ থেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে আবার ভোরের হার্টরেট, পার্লস, এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি শুরু হলো রুমটায়। আর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভোরের প্রিয় মানুষগুলো অপেক্ষার প্রহর গুনছে ভোরের ফেরার। রোদের মতো বাকিরাও আজ একটাই প্রার্থনা করছে যাতে ভোর সু্স্থ অবস্থায় তাদের মাঝে ফিরে আসে। তাদের প্রার্থনা উপরওয়ালার দরবারে কবুল হবে কিনা সেটাই দেখার অপেক্ষা।
৩৬!!
চোখ মেলতেই নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে একটা ছোট্ট আলোর বিন্দু চোখের সামনে ভেসে উঠলো ভোরের। হালকা আলোর বিন্দুটা চোখে এসে লাগায় ভোরের চোখে কেমন ব্যথায় টনটন করে উঠলো একটু। ব্যথাটা সামলে উঠে কোনোমতে চোখ মেলে তাকিয়ে এবারে ধবধবে সাদা এপ্রোন পড়া কয়েকটা অপরিচিত মুখ দেখেই ভোর ভয় পেয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসার চেষ্টা করেও সফল হলো না। ভোর চোখ বড় বড় করে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এই রুমটাও ওর পরিচিত নয় একদমই। রুমে থাকা মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে কিসব বলাবলি করছে সেটাও যেন কানে পৌঁছাচ্ছে না ভোরের। দুজন সাদা পোশাক পড়া লোক এগিয়ে এসে ভোরের হাত ধরার চেষ্টা করতেই ভোর ভয় পেয়ে চোখ বুজে নিলো। ভোর চোখ বুজে মনে মনে শুধু একটা নামই নিলো।
-রোদ।
-ভোর? কেমন আছিস মা?
আতিক আহমেদের কণ্ঠ শুনে ভোর আরেকবার চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ভোর কিছু একটা বলতে চেয়েও পারলো না। মুখে কিছু একটা যেন পেঁচিয়ে আছে। ভোর কথা বলতে পারছে না দেখে কেউ একজন এগিয়ে এসে ভোরের মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্কটা খুলে নিলো। লোকটা ভোরের কাছ থেকে সরে আসতেই এবারে ভোর ধড়ফড় করে বেডের উপরে উঠে বসার চেষ্টা করতেই হাতে কিছু একটার সাথে হালকা করে টান খেয়ে ব্যথা পেল। আগের সেই লোকটা এগিয়ে এসে ভোরের দিকে কিছুটা ঝুঁকে আসার চেষ্টা করতেই ভোর পাশ থেকে আতিক আহমেদের হাত আঁকড়ে ধরলো। আতিক আহমেদও ভোরকে শান্ত করার জন্য কিছু বলছেন সেটাও ভোরের কানে যাচ্ছে না। ভোরের ব্যস্ত চোখজোড়া রুমটায় চক্কর খাচ্ছে রোদকে খুঁজতে। কিন্তু কোথাও রোদকে দেখতে না পেয়ে সামনের লোকটার দিকেই চোখ পড়লো ভোরের। কমবয়সী একটা ছেলে। সাদা এপ্রোন পড়নে। কেমন করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ভোরের দিকে।
-ম্যাম প্লিজ রিল্যাক্স। ইউ নিড রেস্ট। প্লিজ রিল্যাক্স।
-ভোরমা শান্ত হও। তোমার শরীরটা এমনিতেই অসুস্থ। একটু শান্ত হও।
-বড়আব্বু এটা কোথায়? এরা কারা? আমরা কোথায়? রোদ----।
-শান্ত হও ভোর। তুমি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে। তাই আমরা হসপিটালে নিয়ে এসেছি তোমাকে।
-হসপিটালে? কেন? আমি তো একদম ঠিক আছি। কিন্তু আমার হাতে এসব কিসের নল টল লাগানো? এগুলো সরাও। খোলো?
-ভোর? ভোর? বড়আব্বুর কথা শোনো মা? দেখো----।
-নাহ খোলো এসব। রোদ কোথায়? আমি উনার কাছে যাবো। আমি হসপিটালে জানার পরও উনি আসছে না কেন? উনাকে কেউ ডাকো না? কোথায় উনি? কখন আসবে?
-ভোরমা? রোদ কথা বলতে গেছে ডাক্তারের সাথে। এক্ষুণি চলে আসবে। সাদিক দেখো তো রোদ কোথায়?
-না না না। আমি জানি তুমি মিথ্যে বলছ। রোদ আসে নি না? উনি কি আমাকে না বলেই চলে গেছে? আমাকে একবার বলেও যায়নি যাওয়ার সময়? নাকি বলেছিল? উফ! আমার মনে পড়ছে না কেন? ও বড়আব্বু? বড়আব্বু? প্লিজ উনাকে বলো না চলে আসতে? এতো দূরে একা একা ওই পচা দেশে কি করে থাকবে উনি বলো? আমরা সবাই ই বা কি করে থাকবো? আমার পরীক্ষার সময় কে আমাকে সকাল সকাল ঘুম থেকে ডেকে দিবে? কে আমাকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাবে? কে আমার জন্য পুরোটা সময় পরীক্ষার হলের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করবে আমার বের হওয়ার?
-ভোর মা? কিসব আবোলতাবোল বকছিস এসব? ডক্টর ভোর এমন করছে কেন?
-ছাড়ো আমাকে। তোমরা সবাই খারাপ। আমি কারো সাথেই কথা বলবো না। আমার রোদকে এনে দাও। ও বড়আব্বু? রোদকে বলো না আসতে? তুমি না বললে ও চলে যাবে তো? আমি মরে যাবো তাহলে---। বলো না চলে আসতে। আমি তো কত বলেছি না যেতে। ও আমার একটা কথাও শুনে নি। ঠিক চলে গেছে আমাকে ফেলে। আআআআআ।
ভোরের এমন উদ্ভট কথাবর্তাগুলো সবাই শুনে রীতিমতো উদভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইলো। এর আগে ভোর এমন অদ্ভুত আচরণ কখনো করে নি বলে ভোর আর রোদ দুজনের বাড়ির লোকেরাই কিছুটা ঘাবড়েও গেছে। সবার থমকে থাকার সুযোগে ভোর এবারে বেডে উঠে বসে হাতের স্যালাইনের নলটা টেনেটুনে খুলে ফেলে বাচ্চা মেয়ের মতো কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার মতো এসে কোথা থেকে ঠাস করে একটা চড় এসে ভোরের গালে পড়লো ভোর বুঝতেই পারলো না। চড়টা এতো জোরে পড়লো যে ভোরের দুর্বল শরীরটা আরেকটুর জন্য বিছানার উপরেই ঢলে পড়ছিল। অবশ্য চড় যে মেরেছে সেই ভদ্রলোক ভোরকে পড়তেও দিলো না। ভোরের একটা হাত টেনে আবার বেডের উপরে বসিয়ে দিলো। ভোর গালে হাত দিয়ে ঝাপসা চোখে একবার মুখ তুলেই দেখলো মানুষটাকে। রাগী মুখটা দেখে ভোর ভয়ের চোটে কথা বলতেও ভুলে গেল, শুধু ব্যথার চোটে গালে হাত দিয়ে নিজের ফোঁপানি থামানোর চেষ্টা করলো।
-রোদ? আর ইউ ম্যাড? মেয়েটা অসুস্থ! এই অবস্থায়ও ওর গায়ে হাত তুলতে বাঁধছে না তোমার? ঠিক মতো উঠে বসতে পর্যন্ত পারছে না মেয়েটা। তোমার জন্য এতোক্ষণ কান্নাকাটি করছে, আর তুমিই কিনা?
-তোমরা একটু বাইরে যাও আব্বু। ভোরের সাথে আমার কিছু কথা আছে। বেশিক্ষণ সময় নিবো না।
-রোদ? মেয়েটার সবেই তো সেন্স ফিরেছে। এখনই তুমি এভাবে----।
-বাবা প্লিজ? ভোর আর আমার ব্যাপারটা আমাদেরকেই বুঝে নিতে দাও প্লিজ? ভোরকে এখান থেকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যাবো না। ট্রাস্ট মি। জাস্ট দশটা মিনিট সময় দাও আমাকে? তারপর তোমরা তোমাদের আদরের ভোরকে নিয়ে যত ইচ্ছে আহ্লাদ দেখিয়ো আমি কিচ্ছু বলবো না।
-রোদ? মেয়েটা একটু সুস্থ হোক। তারপর না হয় এসব নিয়ে কথা বলা যাবে---?
-ও রিয়েলি বাবা? তোমরা ওর অন্যায়টাকে প্রশ্রয় দিলেও আমি দিবো না। ওর জানতে হবে গত তিনটা দিন আমরা কেমন পাগলের মতো ওর রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কেমন অসহায়ের মতো দিন নেই রাত নেই, ঘুম খাওয়া সব ভুলে ওর চোখ খোলার অপেক্ষা করেছি। কি ভেবেছ তোমরা? ওর ছেলেমানুষি ভেবে আমি ওকে মাফ করে দিবো? কক্খনো না। তোমরা যাও। এর পর যা হবে সেটা দেখতে তোমাদের কারোই ভালো লাগবে না। প্লিজ যাও? ডক্টর? আমি আপনাদের সিনিয়ারের সাথে কথা বলে নিয়েছি। আপনারা দশ মিনিট কেউ এই রুমে আসবেন না। প্লিজ লিভ নাউ।
সবাই এক এক করে বেরিয়ে গিয়ে রুমটা একদম খালি হয়ে গেছে ভোর ভয়ে ঢোক গিললো। রোদের চোখ মুখে রাগের ছাপটা এখনো স্পষ্ট টের পাচ্ছে ভোর। একে তো সবার সামনে গালে এতো জোরে একটা থাপ্পড় কষিয়েছে, এবার একা কত মারবে সেটা ভেবেই ভোর কোনোমতে কান্না আটকালো। রোদ একপা দুপা করে এগিয়ে আসছে টের পেয়ে ভয়ে রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে মেয়েটা। রোদ সেটা টের পেয়ে আস্তে করে গিয়ে ভোরের সামনে বেডেই বসলো। বেশ কিছুক্ষণ পরেও রোদের স্পর্শ না পেয়ে ভোর ভয়ে ভয়ে একবার রোদের দিকে মুখ তুলে তাকাতেই রোদের চোখে চোখ আটকে গেল ভোরের। রোদের শান্ত চোখজোড়ায় এবারে রাগের ছিঁটেফোঁটাও নেই। আছে শুধু ভয়, হয়তো ভোরকে হারানোর ভয়ের সাথে অনেকখানি চাপা যন্ত্রণা। ভোর এসব ভাবার ফাঁকেই রোদ দুহাতে ভোরের মুখটা তুলে ধরলো।
-কেন এই বোকামিটা করতে গেলি ভোর? তোর কিছু হয়ে গেলে আমার কি হতো কথাটা একবারও ভাবলি না? এতোটা স্বার্থপর হতে পারলি তুই?
-আমি কি করেছি?
-কি করেছিস এখনো বলে দিতে হবে? তোকে বলেছিলাম না ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবি? খাবার নিয়ে একদম অনিয়ম করবি না? তাহলে? আমার কথা শোনার কোনো প্রয়োজনই মনে করিস না তুই, তাই না ভোর?
-আমি খেয়েছিলাম তো---।
-একটা মিথ্যে কথা বললে ঠাস করে আরেকটা থাপ্পড় মারবো ভোর। এহ! খেয়েছেন উনি। আপনি এতো খেয়ে আমাকে উদ্ধার করেছেন যে গত তিনদিন ধরে ডাক্তাররা রীতিমতো যুদ্ধ করেছে আপনার সেন্স ফিরিয়ে আনতে। এই মেয়ে এই? আমি সেদিন রাতে তোকে একনজর দেখার জন্য ওভাবে পাগলামি না করলে কি হতো ভাবতে পারছিস?
-কিসের তিনদিনের কথা বলছ কিছুই তো বুঝতে পারছি না। সেদিন মিনিকে খাইয়ে বিদায় করে শরীরটা কেমন খারাপ লাগছিল। সব অন্ধকার হয়ে আসছিল বারবার চোখের সামনে----।
-নিজে না খেয়ে রাস্তার বিড়ালকে খাইয়ে দিতে বলেছে তোকে? আবার গল্প শোনানো হচ্ছে আমাকে না? ইচ্ছে করছে থাপড়ে তার গাল আমি লাল করে দিই।
-একবার সবার সামনে আমাকে মেরেছে। আবার এখন ধমকাচ্ছে। এর চেয়ে মরে গেলেও তো ভালো হতো। এতো বকা শুনতে হতো না আমার। আআআহহা।
-চুপ।
ভোর আবার ন্যাকা কান্না জুড়ে দেয়ার আগে রোদ ভোরের ঠোঁটজোড়া নিজের ঠোঁটের বাঁধনে আটকে নিলো। ভোরও রোদের স্পর্শের উষ্ণতায় যেন ভালোবাসার সাগরে ডুব দিলো। একটু পরেই রোদ সরে এসে ভোরের মুখটা আলতো করে তুলে ধরলো দুহাতে।
-বড্ড সাহস বেড়েছে না তোর ভোরপাখি? এতো বেশি উড়াউড়ি করার শাস্তি তো পাবি। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।
-শাস্তি দিবে? উমম। দাও। তোমার সব শাস্তিই আমার ভালো লাগে। শুধু থাপ্পড় মেরো না প্লিজ? ব্যথা লাগে।
ভোরের ছেলেমানুষি কথাটা শুনে রোদ হেসে ফেললো। আলতো করে ভোরের কপালে একটা চুমো দিয়ে ভোরের দিকে তাকালো রোদ।
-এমন পাগলামিটা করলি কেন রে পাখিটা? পুরোপুরি সু্স্থ হতে কতো সময় লাগবে জানিস? সামনে পরীক্ষা তোর। ভুলে গেছিস নাকি? একটা পরীক্ষায়ও যদি কম নাম্বার পাস না মেয়ে, তারপর দেখাবো মজা। দেখে নিস তুই।
-ইশ! কম নাম্বার পাবো কেন? তুমি আমাকে কোলে জড়িয়ে নিয়ে পড়া কমপ্লিট করিয়ে দিবে।
-আহা! আমি কি আপনার জন্য দেশে বসে থাকবো নাকি? আমার আমস্টারডামে যাওয়া লাগবে না নাকি?
-তোমাকে যেতে দিলে তো। বড়আব্বু আর এবার তোমাকে যেতে বলবে না দেখো। হি হি।
-আহা! যে কান্ড করলি দেখলামই তো। আমি চলে গেছি ভেবে তো পাগলই হয়ে গেছিলি। কাকে কি বলেছিস হুঁশ ছিল তখন আপনার ম্যাডাম?
-ইশ! আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তুমি চলে গেছ ভেবে। ছি! বড়আব্বু কি ভাববে!
-এখন বসে বসে লজ্জাই পান আপনি ম্যাডাম। না খেয়ে অসুস্থ না হয়ে এই কথাগুলো আপনার বড়আব্বুর কাছে গিয়ে বললেই সব ঠিক হয়ে যেত।
-সরি----।
-আর এই মেয়ে? তুই ভাবলি কি করে আমি তোকে না বলে, তোকে একনজর না দেখেই চলে যাবো? হ্যাঁ? এতোটা স্বার্থপর এখনো হতে পারিনি তোর মতো বুঝলি?
-আমি কি করেছি?
-কি করেছ জানো না তুমি? সেদিন আর কয়েক ঘন্টা দেরি হলেই আমি তোকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলতাম। এই কথাটা তো আমি এতো সহজে ভুলবো না ভোর। যত যাই করিস, এই কাজটার শাস্তি তো তোকে পেতেই হবে। একবার শুধু সু্স্থ হয়ে ওঠ, তোর পরীক্ষাটা শেষ হোক। তারপর দেখ আমি কি শাস্তি দিই।
-আপনার দেয়া সব শাস্তিই মাথা পেতে নিবো জনাব।
-আচ্ছা? দেখা যাবে সময় হলেই। এখন চুপচাপ বসে থাক। আমি এক্ষুণি আসছি।
-রোদ? যেও না প্লিজ?
-আরে বাবা। এক্ষুণি আসছি তো। সবাই বাইরে এতোক্ষণে না হার্টফেল করে ফেললো কিনা দেখি গিয়ে---।
রোদ হেসে ভোরের কেবিনটা থেকে বেরিয়ে যেতে ভোর নিজেও হাসলো। রোদের সাথে কথা বলতে পেরে শরীরটা বেশ ফুরফুরে লাগছে ভোরের। আর রোদ যাবে না এর চেয়ে বেশি আনন্দের খবর আর কি হতে পারে ভোরের জন্য? রোদ অবশ্য শাস্তি দিবে বলেছে। কি শাস্তি সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করলো না ভোর। আপাতত রোদ ওকে ছেড়ে যাচ্ছে না এটা ভেবেই মনে মনে আকাশে উড়ছে মেয়েটা। কিন্তু রোদের মনে কি চলছে কে জানে!