সংসার - পর্ব ০৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৯!! 

-আরে এটা কোনো রান্না হলো নাকি? এই খাবার খাওয়া যায়? না লবণ হয়েছে ঠিক মতো, তার উপরে কি ঝাল রে বাবা! আর এই দেখো এটা নাকি আলুর দম! হলুদের বিচ্ছিরি একটা গন্ধ আসছে আলুরদম থেকে। এগুলো মানুষে খায়! আর এটা লুচি! নাকি গোল গোল আটার দলা! সকাল সকাল এগুলো খাওয়ার চেয়ে বাইরে থেকে অর্ডার করে দিলেই তো হতো। এতোক্ষণ না খেয়ে বসে থেকে এই অখাদ্য খাওয়া লাগতো না। 

নিজের রুম থেকে ডাইনিংরুমে আসার সময় তাহিয়ার কণ্ঠে এমন তাচ্ছিল্য ভরা কথাগুলো শুনে ডাইনিং রুমের দরজার বাইরেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল অরণ্য। কথাগুলো যে অনুকে বলছে সেটা বুঝতে একটুও দেরি হলো না অরণ্যের। চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাবা বা মা কি বলে সেটা শোনারই অপেক্ষা করে নিজের মাথাটা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে ছেলেটা। নইলে এতোক্ষণে তাহিয়ার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিত সেটা নিশ্চিত। কিন্তু যার জন্য মাথায় রক্ত রীতিমতো টগবগ করে ফুটছে অরণ্যের তার মুখটা দেখে তাহিয়ার উপরে রাগটা আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেল। সাথে হয়তো নিজের উপরেও খানিকটা রাগ হলো অরণ্যের। তাহিয়ার মুখে এমন বিশ্রি ভাষাগুলো শুনেও অনুর মুখে বিরক্তির কোনো ছাপ নেই, নেই কোনো অপমান বোধের লজ্জা। এ মেয়েটা এমন ভাবলেশহীন কেন? অরণ্যকে দেখাচ্ছে ও কতোটা উদাসীন এই মানুষগুলো, এই নামমাত্র সম্পর্কটার উপরে? নাকি বোঝাতে চাইছে অরণ্য বা ওর পরিবারের কারো বিষয়েই ওর বিন্দুমাত্র আগ্রহই নেই? নাকি জেদ করে সবটা সহ্য করার নাটক করছে অরণ্যই ওর একমাত্র আশ্রয় সেটা ভেবে। আসলেই কি অরণ্যই অনুর একমাত্র আশ্রয়! সাহিল না কি যেন নাম ছেলেটার? তার সাথে কি কোনো যোগাযোগই নেই ওর? আমাদের মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে হাত পুড়িয়ে গা জ্বালিয়ে রান্না করতে হবে কেন? 

-ওকে আর কি বলছিস তাহিয়া? নিজের বাড়ির খেয়ে টৈ টৈ করে ঘুরে বেড়িয়েছে। কাজের কাজ কিছু জানে নাকি! আজকালের মেয়েগুলোর এই এক দোষ। পড়ালেখার নাম করে কাজে ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তারপর শ্বশুরবাড়িতে এসব যাচ্ছেতাই রান্না করে বাপ মাকে গালি শোনায়! বলি তুইও তো শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে এভাবে আমাদেরকেও গালি খাওয়াবি তাহিয়া। শেষ বয়সে এসে এসব দেখতে হবে? 

-আরে থামো তো তোমরা! সকাল সকাল এসব তেলে ভাজা পোড়া খেয়ে  শরীরের কি হাল হবে সেটা একবার ভাবো। খেতে অখাদ্য হলোও চালিয়ে নেয়া যেত, কিন্তু এতো তেল মসলা! তাও এতো সকালে! বলছি এতো ভারি খাবার খেয়ে হসপিটালে এডমিট হতে হলে হসপিটালের বিলটা কি কারো বাবা এসে দিবে? সেই হসপিটালে এডমিটও হবো আমি, বিলও ভরবো আমি! হাউ ফানি! ইজন্ট ইট তাইয়্যেবা? আর তুমি আছো মেয়েকে রান্না শেখাতে?  টাকা ফেললে কত শত হাভাতে কাজের জন্য লাইন দিবে। আজকাল টাকা থাকলে সবই হয়, মান সম্মান, এমনকি পছন্দমতো খাবারটাও মুখের সামনে এনে দেয় টাকা। ওয়েট। আমি খাবার অর্ডার করছি এক্ষুণি। তাহু মা? তোকে এসব একদম খেতে হবে না বাবা। তুই কি খাবি বল? ড্যাড অর্ডার করছি ফুড পান্ডাতে। 

মায়ের অনুকে বলা কথাগুলোয় কিছুটা ধাঁধায় পড়ে গেলেও বাবার কথাগুলো আবার আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো অরণ্যের মনে। তাহিয়া সত্যি সত্যিই খাবার টেবিলটা থেকে উঠে যাচ্ছে দেখে যে অনুর মুখের ভঙ্গিটা যে বদলে গেছে সেটা আর কারো চোখে পড়েছে কি না কে জানে! তবে অরণ্যের চোখে যেমন পড়েছে, তেমনি বুকের বা পাশের কোথাও যেন চিনচিনে একটা ব্যথায় ঝড় তুললো অনামিকার এমন ব্যথাতুর দৃষ্টিটা দেখে। অনুর দিকে এক নজর ভালো করে চোখ বুলিয়ে দিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে শব্দ করে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো অরণ্য। এতো জ্বর নিয়ে মেয়েটা সবার জন্য নাস্তা রেডি করেছে আর সবাই মিলে এভাবে অপমান করছে মেয়েটাকে! ব্যাপারটা একদমই সহ্য হচ্ছে না অরণ্যের। কিন্তু রাগটা দেখাতেও পারছে না বেচারা। কারণ যার উপরেই রাগটা ঝাড়ুক না কেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইম্পপ্যাক্টটা যে অনুর উপরেই গিয়ে পড়বে সেটা অরণ্য বেশ ভালো করেই জানে।

-আরে অরণ্য? তুই আজ এখনো বাড়িতে! অফিসে যাস নি? আজ তো কোনো অফ ডে না। তাহলে? শরীর খারাপ করছে নাকি তোর? কি রে? এভাবে গুম মেরে বসে আছিস কেন? কিছু তো বল? এই অরণ্য?

তাইয়্যেবা জামানের কথাগুলোর কোনো উত্তরই দেয়ার কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে সামনে রাখা লুচি আলুর দমের প্লেটটা টেনে নিয়ে সবার আগে নিজেই খাওয়া শুরু করলো অরণ্য। প্রথম লোকমাটা মুখে নিতেই অরণ্য কয়েক মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। লোকমাটা কোনোমতে ঢোক গিলে পেটে চালান করে অরণ্য চোখ পিটপিট করে তাহিয়া দিকে একবার তাকাতেই দেখলো তাহিয়াও ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। অরণ্য চোখ ঘুরিয়ে বাবা, মা আর ফারহার প্লেটের দিকে একনজর তাকিয়ে আবার তাহিয়া দিকে তাকালো। কিছু একটা বলতে গিয়েও ছেলেটার চোয়াল জোড়া একে অন্যের উপরে চেপে বসতে চাইছে বারবার। এতো রাগ হচ্ছে যে কথা বলতেও পারছে না ছেলেটা। 

-টেস্ট না করেই 'খাবার ভালো হয়নি, এগুলো মানুষ খায়, বিচ্ছিরি গন্ধ, আটার দলা' কত শত সার্টিফিকেট দিয়ে দিলি তাহু? এক লোকমা যদি মুখে দিতি তাহলে এসব বলার কোনো প্রয়োজন হতো না। আর বাবা, মা? তোমরা কি চাইছ কি আমাকে বলো? বাইরে থেকে অর্ডার করবো খাবার এই তো? ওকে আমি অর্ডার করে দিব। তার আগে জাস্ট এক টুকরো লুচি আর এক পিস আলুর দম খেয়ে দেখো। তারপরও যদি ভালো না লাগে তাহলে আমিই আজ থেকে তোমাদের ব্রেকফাস্ট অর্ডার করে দিবো প্রতিদিন। তোমাদের কাউকে এসব আর খেতে হবে না। এটলিস্ট বাইরের তোমাদের টেস্টি আর হেল্থি খাবার আসা পর্যন্ত একটু ট্রাই করে দেখো। আই হোপ আজকে তাহলে বাইরে থেকে অর্ডার করার কথাটা বলবে না তোমরা। আর ড্যাড? তোমার হেল্থি ফুডের ব্যবস্থা কাল থেকে হয়ে যাবে। একবার টেস্ট করে দেখো। ভালো না লাগলে খেতে হবে না। আই প্রমিস।

কথাগুলো বলে কারো দিকে না তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিল অরণ্য। কে খাচ্ছে বা ডাইনিং রুমের বাকি পাঁচটা মানুষ যে ওর দিকে রীতিমতো হা করে তাকিয়ে আছে সেদিকেও ছেলেটার হুঁশ নেই। সে আয়েশ করে লুচিতে আলুরদম পেঁচিয়ে টপাটপ মুখে পুরছে। প্লেটের সবক'টা লুচি শেষ করে এবারে তৃপ্তির একটা ঢেঁকুর তুলে অনামিকার দিকেই তাকালো অরণ্য। অনু এখনো চুপচাপ টেবিলের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে দেখে অরণ্য ইশারায় পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে দিল। 

-এই জ্বরের মধ্যে না খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মানেটা কি? সবাইকে একসাথে বসে খেতে বলেছিলাম না কালকে? তাহলে না খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলে কেন?

-সার্ভ করছিলাম তাই-----।

-তো সকালবেলা উঠে এতোক্ষণ ধরে নাস্তা বানিয়ে আবার জনে জনে সার্ভ করলে নিজে খাবে কখন? চুপচাপ খেতে বসো। আর এখানে কারো কথায় কান দিবে না। রান্না অনেক ভালো হয়েছে। শুধু ভালো না। একদম পার্ফেক্ট হয়েছে। কেউ খেলে খাবে, না খেলে তাকে বলে দিবে কাল থেকে যেন নিজে রান্না করে নেয়। এখন তুমি খেতে বসো। আমি আসছি। 

অরণ্যের দেখিয়ে দেয়া চেয়ারটা টেনে অনামিকা বসতেই অরণ্য হাত ধুয়ে একটা টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে উঠে গেল। দু পা বাড়িয়েই তাহিয়ার বলা একটা কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল অরণ্য। তাহিয়া নিজেই নিজের সাথে কথা বলছে এমন একটা ভাব করে বকবক করছে প্লেটে সার্ভ করা লুচি আলুর দমের দিকে তাকিয়ে।

-উনার বউ রেঁধেছে বলে এখন নাকি আমাকে এসব খেতে হবে! আমি এসব খাই নাকি? ভাইয়া জানে না আমি কতোটা ডায়েট মেনটেইন করে খাই? সকাল সকাল এতো তেলে ভাজা খেয়ে শেষে কয়েক কিলো করে ওয়েট বাড়লে কি হবে! আর ওর বউ যে এতো এতো লুচি আর আলুর দম রেঁধেছ সেগুলো কে শেষ করবে? এতোগুলো একত্রে রাঁধে কেউ?

তাহিয়ার কথা শুনে অরণ্য চোখ জোড়া আবার রক্তবর্ণ ধারণ করলো নিমিষেই। নেহায়েতই ছোটো বোনটা বড্ড বেশিই আদরের অরণ্যের কাছে। নইলে ওর জায়গায় কথাটা অন্য কেউ বললে এতোক্ষণে কেলেঙ্কারি কান্ড ঘটিয়ে বাসতো অরণ্য সেটা নিশ্চিত। নিজের রাগটা কোনোমতে হজম করে নিয়ে সোজা অনুর দিকেই তাকালো অরণ্য। মেয়েটা ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল দেখে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলতে সুবিধাই হলো অরণ্যের। 

-তুমি এতো এদিক ওদিক না তাকিয়ে খেয়ে নাও। আর কারো খাওয়া নিয়ে টেনশন করা লাগবে না। আমি বাকিদের জন্য সকালের, দুপুরের, রাতের তিন বেলার খাবারই অর্ডার করে দিবো। আর কাউকে এই লুচি আলুরদম একদম দিবে না। আমি আজ সারাদিন এগুলোই খাবো। ব্রেকফাস্টে খেলাম, এরপর প্রি লাঞ্চে, লাঞ্চে, বিকেলে স্ন্যাক্সেট সময়, সন্ধ্যায়, ডিনারের আগে আর ডিনারের সময়। যতবার খিদে পাবে ততবার একাই খাবো। এরপর কেউ খেতে চাইলেও তাকে লুচি আলুরদম দিবে না। আর এগুলো শেষ হলে আমার জন্য আরো লুচি আর আলুর দম রান্না করবে তুমি। প্রতিদিন রান্না করবে। ওকে? কারো কিছু বলার আছে?

অরণ্যের এমন অদ্ভুত আবদারে তাইয়্যেবা জামান, আরহান চৌধূরী, ফারহা, তাহিয়া সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকালো। অরণ্য কথাগুলো বলেই ডাইনিংরুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেছে। অরণ্য বেরিয়ে যাওয়ার একদম ঘড়ি ধরা পাঁচ মিনিট পর ডাইনিংরুমে একটা হাসির দোল খেলা করে গেল। এতোক্ষণের চেপে রাখা হাসিটা এবারে বাঁধ ভাঙ্গলো সবার। আর বেচারি অনামিকা সবার এমন হাসিতে কিছুটা লজ্জাই পেল। ভদ্রলোকের এমন পাগলামিতে ওর নিজেরই হাসি পাচ্ছিল। দু একটা কথা যে ওর ও একদম বুকে গিয়ে লাগে নি তেমনটাও নয়। অথচ সেই তীক্ষ্ম ব্যথাটাও অনু বেমালুম ভুলে গেছে অরণ্যের এমন পাগলামিতে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তাহিয়ার কথায় আরেকবার লজ্জার রঙে লাল হয়ে গেল অনামিকা।

-দেখেছ ভাবি? তুমি কতো লাকি? তোমাকে কথাগুলো বলেছি আর গায়ে লেগেছে ওর। আজ কিন্তু সারাদিনই ভাইয়াকে লুচি আলুরদম খাইয়ে রেখো না যেন। ও যেমন জেদী আর কিছু খাবেই না আজ। কিন্তু আমি জানি একমাত্র তুমিই ওকে বদলাতে কারো। জানো? আমার বেশি হাসি পাচ্ছে কেন? কারণ কথাগুলো আমি বলেছি বলে বেচারা কিছু বলতেও পারছে না। আমার জায়গায় অন্য কেউ বা বাইরের কেউ তোমাকে এভাবে বললে তার কপালে আজ নির্ঘাত শনি ছিল। হা হা হা। কি প্রজেসিভ দেখলে ভাইয়া তোমাকে নিয়ে? আজ সারাদিন ই বোধহয় বাসায় থাকবে ও। আজ যে ভাইয়ার আরো কত রূপ দেখতে পাবো ভাবতেই এক্সসাইটেড লাগছে আমার। হি হি। আমার ভাবিকে কষ্ট দিয়েছ না বাচ্চু? আগে আগে দেখো আমিও কি করি।

১০!! 

-সবাই জলদী জলদী খাও। ভাইয়া এসে পড়লে আজ সারাদিন উপোশ করতে হবে। যা চটেছে ছেলেটা! উফ! নিজে খাবি খা, মাঝখান থেকে আমাদের খাবারে নজর দিবি কেন তুই? অসভ্য ছেলে একটা! 

অরণ্য চলে যাওয়ার পর তাহিয়ার গপাগপ লুচি আর আলুর দম খাওয়া দেখে অনামিকার হাসি চেপে রাখতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছিল। অনামিকাকে মুখ টিপে হাসতে দেখে লুচি আলুর দম মুখে পুরেই কিসব বলছে অনু ঠিক বুঝতে পারলো না। কিন্তু তাহিয়া সেসবে মাথা না ঘামিয়ে নিজের খাওয়ায় মন দিল। তাইয়্যেবা জামান আর আরহান চৌধূরীও খাওয়া শুরু করেছে দেখে ফারহাও ভয়ে ভয়ে খাওয়া শুরু করেছে এবারে। একে তো অরণ্যের হাবভাব মেয়েটার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে, তার উপরে উনার এই অদ্ভুত পরিবার আর তাদের অদ্ভুত সব কাজকর্ম দেখে রীতিমতো মাথা ঘুরছে ফারহার। অনামিকা নামের মেয়েটাকে কে সত্যি ভালোবাসে সেটাই লাখ টাকার কুইজের প্রশ্ন মনে হচ্ছে ফারহার কাছে। অরণ্য, যে কিনা অনামিকার খেয়াল রাখার জন্য ওকে বাসায় নিয়ে এসেছে, এটা জানার পরও যে ফারহা নিজের হাতে বলতে গেলে এক গ্লাস পানিও নিয়ে খায়নি কখনো। অন্যদিকে তাহিয়া, ভাবি বলতে অজ্ঞান বলা চলে যে মেয়েটা, সে কিনা যাচ্ছে তাই বিহেভ করছে অনুর সাথে, অরণ্যের সামনেই এমন চলছে, নাকি সবসময় সেটা নিয়েও এবারে কনফিউজড হয়ে যাচ্ছে ফারহা। বাকি রইলো অরণ্যের বাবা মা। উনারা অরণ্যের সামনে ইচ্ছে করেই তাহিয়াকে সাপোর্ট করছে। আর অনামিকা? এই মেয়েটাকে বাকি সবার চেয়েও আরো বেশি রহস্যময় লাগছে ফারহার। অরণ্য ওকে বউ বলছে, আর মেয়েটা নিজেকে বলছে অরণ্যের কাজের মেয়ে। কি চলছে ওদের সবার মধ্যে সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে ফারহার। কেমন গোলকধাঁধায় যেন তলিয়ে যাচ্ছে ফারহা। এই গোলকধাঁধা থেকে বের হবে কি করে এক উপরওয়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না।

এদিকে কয়েক লোকমা লুচি খাওয়ার পর শরীরটা আবার প্রচন্ড খারাপ লাগছিল বলে রান্নাঘরের ফ্লোরে  পাতলা একটা চাদর পেতে শুয়ে পড়লো অনামিকা। ক্লান্ত শরীরটা কখন কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে অনামিকা টেরও পায়নি। জ্বরের ঘোরে এক মূহুর্তের জন্য অনামিকার মনে হলো বরফ শীতল ফ্লোরটা থেকে কেউ ওকে তুলে নিয়ে নরম তুলেতুলে একটা বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। জ্বরের ঘোরের কারণে নাকি অর্ধ চেতন শরীর মনের উষ্ণতার কারণে অনামিকার মনে হলো ওর কপালে কেউ যেন পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কপালে কারো স্পর্শটা সত্যি সত্যিই অনুভব করায় ধড়ফড় করে চোখ মেলে তাকালো। আর তাকিয়েই রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লো অনামিকা। চোখ মেলেই সামনে তাহিয়া আর ফারহাকে কাচুমাচু মুখে তাকিয়ে থাকতে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করে রীতিমতো ঝটকা খেল অনামিকা। ও তো রান্নাঘরের ফ্লোরে চাদর পেতে শুয়েছিল! তাহলে অরণ্যের রুমে কি করে এলো? জ্বরের ঘোরে স্বপ্নের মতো লাগছে সবকিছু এখনও অনামিকার কাছে। কিন্তু তাহিয়া আর ফারহা এমন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কেন? 

-দেখি? ওষুধটা খেয়ে নাও তো? জ্বরটা অনেক বেড়েছে তোমার। তখনই তো বলেছিলাম। আমার কথা কে পাত্তা দেয়! হা করে তাকিয়ে না থেকে মুখ খোলো অনু। 

পাশ থেকে অরণ্যের কথাগুলো শুনে থতমত খেয়ে তাকিয়ে কি বলবে সেটাই ভুলে গেল। অরণ্যের চোখে মুখে রাগটা ফুটে উঠেছে আবারও। কিন্তু সেটা কেন? অনামিকা আবার কি কোনো ভুল করেছে?

-ভাবিকে এভাবে বলছিস কেন? কত জ্বর দেখছিস না? আমাকে দে। আমি ভাবিকে মেডিসিন খাইয়ে দিচ্ছি।

-তোর আলগা দরদ অন্য কারো জন্য তুলে রাখ তাহু। অনু ওষুধটা নিজেই খেতে পারবে। আর না পারলে আমি আছি। তোর এতো টেনশন দেখাতে হবে না। তোর পিৎজ্জা চলে এসেছে। বিল পে করে দিয়েছি। এবার মজা করে খা যা। 

-ভাইয়া? এভাবে বলছিস কেন?

-আমার মাথাটা এমনিতেই গরম হয়ে আছে তাহু। পিৎজ্জা আনিয়ে দিয়েছি। এবারে আর তোর কষ্ট করে তোর আদরের ভাবির হাতের অখাদ্যগুলো তোকে খেতে হবে না। ড্যাড তো অফিস বেরিয়ে গেল না খেয়েই। ব্যাপার না। কাল থেকে সবার জন্যই হেল্থি ফুড চলে আসবে। আজকের দিনটা ম্যানেজ করে নে। ওহ আচ্ছা? লাঞ্চে কি খাবি বলে দে। অর্ডার করে দিব আমি।

-আমি কিচ্ছু খাবো না। কিচ্ছু না।

তাহিয়া ধরা গলায় কথাগুলো বলে কোনোমতে ছুটে অরণ্যের রুমটা থেকে বেরিয়ে গেল। আর ফারহা এতোক্ষণ বোকার মতো অরণ্য আর তাহিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল। এবারে তাহিয়া বেরিয়ে যাওয়ায় ফারহাও রুমটা থেকে বেরিয়ে গেল। তাহিয়া আর ফারহা চলে যাওয়ার পর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রাগটা খানিক কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো অরণ্য। আর এতোক্ষণে অনামিকার মাথাটা জ্বরের চেয়ে বোধহয় রাগেই ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অরণ্য অনামিকার মুখের সামনে ওষুধটা বাড়িয়ে ধরতেই অনামিকা অরণ্যের হাতের দিকে একনজর তাকিয়ে সোজা অরণ্যের চোখে চোখ রাখলো।

-কি সমস্যা কি তোমার অনু? দেখ কাল সেন্সলেস ছিলে বলে মেডিসিন খাওয়াতে পারি নি। সকালে তো আমার কথাই শোনার প্রয়োজন বোধ করলে না। এখন দেখছ কেমন কাঁপিয়ে জ্বর উঠেছে? এবার আর একটা কথাও শুনবো না। খাও ওষুধটা। অনু?

-আপনার কি ধারণা মিস্টার অরণ্য চৌধূরী? একমাত্র আপনি যা ভাববেন সেটাই সবসময় ঠিক? নিজেকে কি ভাবেন আপনি? সবজান্তা? আশ্চর্য! এতোটুকু একটা বাচ্চা মেয়েকে এভাবে কাঁদিয়ে দিতে একটুও কষ্ট হলো না আপনার? তাহিয়া না আপনার নিজের বোন? নিজের ছোটো বোনের চোখে পানি এনে দিয়ে এখন আমাকে করুণা করতে এসেছেন? খাবো না আমি ওষুধ। আর আমার জায়গাটা আমি খুব ভালো করে জানি। তাই দয়া করে আমাকে আমার হালেই ছেড়ে দিন।

কথাগুলো শেষ করে কোনোমতে বিছানা আঁকড়ে পা নামার চেষ্টা করতেই অরণ্য অনুর একটা হাত টেনে ধরে আবার ধপ করে অনুকে বিছানায় বসিয়ে দিল।

-তোমার জায়গা তুমি ভালো করে জানো? কোথায় জায়গা তোমার? রান্নাঘরের ফ্লোরে? তাই তো? নিজেকে তুমি কি মনে করো হ্যাঁ? একটা বাইরের মেয়েকে নিজের কি পরিচয় দিলে তুমি? তুমি কাজের মেয়ে? এটাই কি সত্যিই তোমার পরিচয় অনু? চুপ করে থাকবা না একদম। আনসার মি ড্যাম ইট।

-আনসারটা আমার চেয়ে তো আপনার ভালো জানার কথা অরণ্য। আমার পরিচয়টা কি। নিজের বাবা মা মেয়ের পরিচয়ে বাড়িতে রাখতে পারছে না এতোটাই নিকৃষ্ট আমি। আর এতোটাই অবিশ্বাসের যোগ্য যে আমার কাজের পাহারা দেয়ার জন্যও আপনাকে আরেকজনকে কাজের লোক সাজিয়ে আনা লাগে।

-এনাফ অনু। অনেকক্ষণ ধরে তোমার এসব উল্টোপাল্টা কথা শুনছি আমি। সবকিছুর একটা লিমিট আছে এটা মাথায় রেখো। ওষুধটা খাও। আর একটাও বাজে কথা না বলে দিলাম।

অরণ্য মুখের সামনে আবার ওষুধটা এগিয়ে দিতেই অনু মুখ ফিরিয়ে নিল। অরণ্যেরও এবারে রাগটা চড়ে গেল। এই মেয়েটা একে তো কথা শুনছে না, তার উপরে জ্বরটা যে বাড়ছে সেটাকে পাত্তাও দিচ্ছে না। কথাগুলো ভেবেই অরণ্য চোখ লাল করে অনামিকার একটা হাত টেনে ধরে নিজের দিকে ফিরালো।

-শোনো মেয়ে, তোমাকে পাহারা দেয়ার জন্য আমার কাউকে আনানোর প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। পাহারা দিয়ে কি হবে? তুমি তোমার ওই এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে যাও কি না, এই ভয়ে পাহারা দিব? হাহ। শোনো অনু, তোমাকে যাওয়ার অপশন আমি তিনমাস আগেই দিয়েছিলাম। তুমি যাও নি। এখনও যাবে না সেই ভরসাটুকু আমার আছে। এন্ড আমি জানি আমি কি করছি, কেন করছি। ওকে? 

-তাহলে ফারহা কে বলুন? ওকে কি এমন কাজের জন্য আনলেন? ঘরের কাজ তো ওর জানেও না। তাহলে কিসের জন্য ওকে এনেছেন? কি কাজ ওর?

অনামিকার প্রশ্নটা শুনে অরণ্য নিজেও এক সেকেন্ডের জন্য নিজের কাছেই প্রশ্নটা করলো। আসলেই তো, ফারহা কোনো কাজ জানে না, তাহলে মেয়েটাকে বাড়িতে রেখেছে কেন? অনুকে তো হেল্প করতেই পারে না মেয়েটা। উল্টো কাজের কাজ আরো বাড়ায়। তাহলে? অনুকে জেলাস ফিল করানোর জন্য? অনামিকার নামের মেয়েটা কি আসলেই জেলাস? নিজের প্রশ্নটা নিজের মনেই চাপা দিয়ে অনামিকার হাতটা ছেড়ে দিয়ে পানি ভর্তি গ্লাসটা অনামিকার দিকে এগিয়ে ধরলো অরণ্য।

-ফারহার কি কাজ সেটা নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে। আমি জানি ওকে আমি কি কাজের জন্য এনেছি। আপনি এখন ওষুধটা খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন প্লিজ?

-ওহ! আমাকে বলবেন কেন? আসলেই তো আমি কে? আপনাদের বাড়ির সামান্য কাজের মেয়েই তো। এর চেয়ে বেশি কিছু তো না।

অনামিকা যে জ্বরের ঘোরে এসব বলছে সেটা বুঝতে দেরি হলো না অরণ্যের। তাই এবারে রাগের বদলে হাসি পেল অরণ্যের। এবারে একটু জোর করেই অনামিকার মুখে ওষুধটা পুরে দিয়ে পানির গ্লাসটা মুখের সামনে ধরলো অরণ্য। অনু একটু বিরক্ত হয়ে পানিটা ঢকঢক করে গিলে ফেললো। রাগ করে কিছু না বলেই চুপ করে বসে রইলো মেয়েটা। অনামিকাকে এভাবে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে অরণ্য এবারে হেসে ফেললো।

-এতো বেশি বুঝেন কেন ম্যাডাম? ফারহাকে নিয়ে আপনার কোনো টেনশন করতে হবে না। ওকে?

অরণ্যের কথা শুনে অনামিকা অরণ্যের দিকে চোখ পিটপিট করে তাকালো। জ্বরটা বাড়ার কারণে সব এলোমেলো লাগছে মেয়েটার কাছে। অরণ্যের হাসিটাও কেমন রহস্যময় লাগছে। বসে থাকতে কেমন ক্লান্ত লাগছে বলে বিছানার সাথে একটু হেলান দিয়ে বসলো এবারে মেয়েটা।

-আমি অতিরিক্ত বুঝি? নাকি আপনি? ফারহাকে নিয়ে আমি টেনশন করবো কেন? সামান্য কাজের মেয়ে, মালিকের কাজে বা অকাজে নাক গলাবো কেন আমি? আর আপনি কি ভাবেন নিজেকে? সব বুঝে বসে আছেন? 

-কি বুঝি নি বলুন? এই যে জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছেন সেটাও তো বুঝতে পারছি। একটু জ্বরটা কমলে সেই গিয়ে তো রান্নাঘরেই ছুটবেন। জানি না আমি? যাদের জন্য কষ্ট করে রান্না করবেন তাদের কাছেই আবার অপমানিতও হবেন।।তবু সেই তাদের চোখেই পানি দেখে নিজেও কেঁদে ফেলবেন। জানি তো আমি।

-বললাম না নিজেকে সবজান্তা ভাবেন আপনি? প্রমাণটা দেখলেন তো? যে মা বাব আমাকে গত তিন মাস নিজের মেয়ের মতো করে আগলে রেখেছে তারা হুট করে আমাকে অপমান করবে? টর্চার করবে? এসব সত্যি মনে হয় আপনার? যে ছোট্টো মেয়েটা সারাক্ষণ আমার জন্য পাগল, সারাদিন আমার পিছে পিছে ঘুরঘুর করে, সে আমাকে অপমান করেছে সেটা দেখলেন, অথচ আমি চোখ মেলেই দেখলাম মেয়েটা কেমন ভয় পেয়ে গিয়েছিল আমাকে এই অবস্থায় দেখে।

-মানে? 

-মানেটা বোঝার মতো ইচ্ছেটা কি আপনার আছে? সবসময় তো নিজের জেদ নিয়েই আছেন। কে কি বলছে, কেন বলছে, এসব নিয়ে ভেবেছেন কখনো? বাবা, মা, তাহিয়া সবাই আপনাকে কতোটা ভালোবাসে আপনি জানেন না? জানেন না উনারা কেমন মানুষ? তবু আপনার মনে হলো আসলেই উনারা আমার সাথে মিসবিহেভ করছে? বাহ! উনারা কতো ভালো আপনি ভাবতেও পারবেন না। আপনি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেও কেবল এই মানুষগুলোর জন্যই আমি এখনো আপনার জীবনে রয়ে গেছি, জানেন আপনি? অবশ্য আপনাকে এসব বলে লাভ কি? আপনি তো নিজের জেদটাই বুঝবেন। কেউ যে আপনার কথা ভাবে, আপনার ভালোর জন্য নিজেরা খারাপ সাজে সেটা বুঝবেন কেন? আপনি তো সবজান্তা। সর্বজ্ঞানী সবজান্তা সমীপেষু। 

শেষের দিকে বিড়বিড় আরো বকবক করতে করতে চোখ বুজে নিল অনামিকা। মেয়েটার শেষের দিকের কথাগুলো বুঝতে পারে নি অরণ্য। কিন্তু বাবা মা আর তাহিয়া যে পুরোটা দিন অনামিকার সাথে খারাপ ব্যবহার করার নাটক করেছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না অরণ্যের। কিন্তু কেন? অনামিকা জ্বরের ঘোরে কথাগুলো না বললে আসলেই কি এই নাটকটাকেই সত্যি মনে করে নিত অরণ্য? আর অনুই বা এতো রিএক্ট করে কথাগুলো বললো কেন? আসলেই কি জেদের কারণে অনুকেও ভুল বুঝেছিল অরণ্য?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন