অনুভবে - পর্ব ১৮ - নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা - ধারাবাহিক গল্প


সারাদিনে তার মজার, রাগের, বিরক্তির যা হয় সবই ইনারাকে ঘিরে। সত্যিই কী সে আজকাল কেবল ইনারার কথা বলে বেড়ায়। তার মাথায় কী শুধু তার কথাই ঘুরে? না, এটা তো ভালো লক্ষ্মণ নয়! 

সভ্যের মা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, "বল না, মেয়েটা কে? পছন্দ করিস? ভালোবাসিস?"
কথাটাতেই ক্ষেপে উঠে সভ্য, "মা প্লিজ! ক'দিনের দেখাতে কাওকে ভালোবাসা যায় না।"
"পছন্দ তো করা যায়।"
"এই পাগল মেয়েকে আমি পছন্দ করবো? অসম্ভব!"
তুমি বুঝতে পারছো না মা, মেয়েটা আসলেই আজব। সারাদিন উল্টাপাল্টা কাজ করতে থাকে আর আজব আজব কথা বলতে থাকে তাই ওর কথাই বেশি বলা হয়। এমন কার্টুন আমি জীবনে আগে দেখি নি।"
মা মিষ্টি হাসে। বলে, "আচ্ছা তুই নিজেকে যা বুঝ দিস, তোর ব্যাপার। কিন্তু কখনো নিজের অনুভূতিগুলোকে এড়িয়ে যাবি না। যেকোনো মানুষকে ভালোবাসা যায়, ভালোবাসা বাছাই করে হয় না। এছাড়া ওর কথা শুনে খুব মিষ্টি মেয়ে মনে হচ্ছে। ছবি দিবি। এখন খেয়ে নে, আমিও সবাইকে খাবার দিতে যাই। ঘুমানোর আগে আবার কল দিব।"
"আচ্ছা মা।" 

সভ্য কল কেটে কোলের থেকে গিটারটা সরায়। যায় বাহিরে। বারান্দায় দাঁড়াতেই তীব্র হাওয়ার কারণে বৃষ্টির পানিতে সে অধো ভিজে গেল। সে একবার ভাবলো ইনারাকে কল দিবে। আজ তাকে মাঝরাস্তায় এভাবে ছাড়ার পরই বৃষ্টি শুরু হয়। সে দ্রুত ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরাতে বলে। কিন্তু যেয়ে দেখে ইনারা আর নেই। কিন্তু মেজাজ গরমে আর কল দেয় না সে। মেয়েটা কীভাবে ভাবতে পারে তার এবং ঐশির মাঝে কিছু চলছে। নিজের ছেলে বন্ধু কেবল বন্ধু হতে পারে অথচ সে এবং ঐশি কেবল বন্ধু হতে পারে না? 

নিজের রাগের অনুভূতির কারণে আবারও অবাক হয় সভ্য। হাজারো মানুষ তাকে এবং ঐশিকে নিয়ে এমনই ভাবে। এসবে তার সহজে রাগ উঠে না। তবে ইনারার ব্যাপারে তার এমন রাগ উঠলো কেন?"
.
.
"ওই বেয়াদবটাকে মেরে মেরে তক্তার ভর্তা বানিয়ে আমি রাস্তার কুকুরদের খাওয়াব। কত বড় সাহস আমাকে মাঝরাস্তায় নামায় দিলো।" ইনারা বলল। সে কিছুক্ষণ আগেই সুরভীর বাসায় এসেছে। একদম ভিজে জবজবে হয়ে ছিলো সে। তারপর সুরভি গরম পানি করে তাকে গোসল করতে দেয়। তার হাতে একমগ গরম চা দিয়ে নিজে তোয়ালে দিয়ে তার চুল মুছতে মুছতে বলে, "তোরই তো দোষ। না জেনেশুনে তোকে বকবক করতে বলেটা কে?"
"তুই ওই অসভ্যের গুনগান গাইবি না, নাইলে তোকেও ওর মতো মেরে ভর্তা বানিয়ে দিব।"
"সভ্যের জন্য তো আমি ভর্তা হতেও রাজি।"
ইনারা চোখ ঘুরিয়ে তাকায় তার দিকে। বলে, "সারাদিন আমাকে বলোস আমি জোহান জোহান করি। এখন তুমি কি করতেছো?"
"আমি তো কেবল ভক্ত হিসেবে করি কিন্তু তুই তো অতিরিক্ত। জোহান কারে চুম্মা মারছে এতেই তোর কান্না পায়, ধ্যুর!"
ইনারা উঠে লাথি মারে তাকে আর বলে, "জ্বলায় লবণ মরিচ সব মার। শালী। প্রিয়রে ফোন করে বল আইস্ক্রিম আনতে আমার জন্য। আমি ছ্যাঁকা খাইসি।"
"ছেলেটা মাত্র কাজ করে বাসায় গেছে সম্ভবত। এখনই আনাবি?"
"হো। আমার মন খারাপ বল। এক দৌড়ে নিয়ে আসবে।"
"আচ্ছা দাঁড়া কল দেই। আমারও খেতে মন চাইছে। তোর ছ্যাঁকা খাওয়ার খুশিতে। হি হি।" 

ঠিক তাই হয়। প্রিয়কে বলার সাথে সাথে সে দশ মিনিটের মাঝে তাদের জন্য আইস্ক্রিম নিয়ে আসে। তারপর তিনজন মধ্যরাত পর্যন্ত ছাদে আড্ডা দেয় আইস্ক্রিম খেতে খেতে।
.
.
চারপাশ লাল রঙে ভেজা। মেঝেতে ভেসে আছে সে লাল রঙ। এ কী রক্ত! হ্যাঁ, রক্ত। পাশে শুয়ে আছে এক মহিলা। তার মাথা দিয়েই রক্ত বের হচ্ছে। তার পাশে দাঁড়ানো কয়েকটি লোক। হঠাৎ এক ছোট্ট মেয়ে 'মা' 'মা' করে দৌড়ে ঢুকলো দরজা দিয়ে। তার এই বাড়িতে সহজে এত লোক থাকে না। তাই হঠাৎ এত লোক দেখে সে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। পরক্ষণেই তার চোখ পরে মেঝেতে পরা সে রক্তাক্ত দেহটার উপর। মুহূর্তে তার দেহ শিউরে উঠে তার। মা'য়ের শরীর মাখা রক্ত দেখে তার বুকের স্পন্দন বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সে নিজের হাতের ব্যাগগুলো সেখানেই ফেলে দৌড়ে যায় তার মা'য়ের কাছে। তার পাশে বসে কাঁদোকাঁদো গলায় বলে, "মা...মা... তোমার কী হয়েছে? তুমি ব্যাথা পেয়েছে? কিছু বলো না মা।" 

সে আবার আশেপাশে তাকিয়ে বলে, "আমার মা ব্যাথা পেয়েছে আপনারা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান না কেন?" আবার সে তার মা'কে বলে, "মা আমি তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি চিন্তা করো না। কিছু হবে না তোমার। কিছু হবে না। উঠো তুমি, উঠো।"
মা উঠে না। তাকে টেনে সরানো হয়। তার বাহু ধরে টেনে দূরে নিয়ে আসা হয়। তাকে বলা হয়, 'তার মা আর নেই।" 

সে অনেক ডাকে মা'কে, 'মা... মা... উঠো। তুমি না উঠলে আমি কিন্তু খাব না। আমি অনেক কাঁদব। অনেক। তোমার আমার চোখের পানি না অপছন্দ? তাহলে উঠো না কেন?' 

তার মা তুঠে এসে আর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় না, তাকে জড়িয়ে ধরে না, তার কপালে চুমু দেয় না। সে কাঁদতে থাকে। চিৎকার করতে থাকে। তাকে যেতে দেওয়া হয় না তার মা'য়ের কাছে। বসতে দেওয়া হয় না তার মা'য়ের কাছে। 

ঘুম ভাঙে ইনারার। তার মাথায় ঘাম জমে আছে। সে আশেপাশে তাকাল। পাশে দেখতে পেল ঘুমানো সুরভীকে। এটা স্বপ্ন ছিলো? তার জীবনের জঘন্যতম দুঃস্বপ্ন। এই জঘন্যতম দুঃস্বপ্নটাই তার বাস্তবের এক অংশ। 

হঠাৎ নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হলো ইনারার। দম আটকে আসতে শুরু করলো। সে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে দাঁড়ায় ব্যালকনিতে। চারপাশ নিরবচ্ছিন্ন। আকাশে বিশাল এক চন্দ্রিমা আঁকা। ইনারা যেয়ে বসলো ব্যালকনির এক কোণে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো চন্দ্রিমাটির দিকে। হঠাৎ করেই গালের এক কোণে দিয়ে বয়ে পড়ে নোনাপানি। দুঃখের জল। আর থামে না। সে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে। অভিযোগের সুরে বলে, "মা তুমি কেন আমাকে ছেড়ে গেলে? কেন?"
হাতটা খামচে ধরে সে। এতটা জোরে খামচে ধরে যে রক্ত জমে যায়। তাও ছাড়ে না। তার চোখ কাঁপে, ঠোঁট কাঁপে, শরীর কাঁপে। তাও কষ্ট কমে না। এত বছর হয়ে গেল তার মা নেই, আজও কষ্টটা কমে না কেন?
.
.
সকালে ইনারা কাজে যেতেই দেখে রুমে সকলে উপস্থিত। সাঈদ ভাইয়াও। সকলে যেন খুব ব্যস্ত। হঠাৎ সকাল-সকাল এমন ব্যস্ততা দেখে ইনারা সামিকে জিজ্ঞেস করে, 
"কী হচ্ছে? সবাই এত চিন্তিত কোন দুঃখে?"
"বলো না ঐ টাকলা মামা...সরি মানে মিস্টার হক আছে না? সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী সাপ্তাহে কোম্পানির পঞ্চম বার্ষিকীতে আমাদের লাইভের নাচ প্রদর্শনটা সবার আগে করা হবে। হুটহাট করে। আমাদের প্রাক্টিস শুরু হলো সবে গতকাল। কী করে সম্ভব? এর উপর গানও প্রদর্শন করা হবে। আবার এলবামের কাজ। এখন সব গুছাতে হচ্ছে। কী যে বাজে অবস্থা! সভ্য সিডিউল মিলাচ্ছে।"
"ওহ।" 

ইনারা সভ্যের দিকে তাকায়। সভ্য তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। অথচ তাকে দেখতেই কেমন একটা ভাব নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ইনারা তো হতভম্ব। সে মনে মনে বলে, "দেখেছ কত বড় অসভ্য! নিজে আমাকে বৃষ্টি মধ্যে ফেলে আসছে এখন আবার এটাটিউড দেখায়। মানুষ তো না যেন এটাটিউডের খনি। কম পরে না। শালা অসভ্যের দলের রাজা, হনুমান, ব্যাঙের ছাতাকে ভর্তা বানাবো শুধু। সে কী ভাবে তার শুধু এটাটিউড আছে? আমি দেখেচ্ছি তাকে এটাটিউড কাকে বলে।"
সে নিজেও ভেংচি কেটে সামনের সোফায় যেয়ে বসে। আকস্মিকভাবে তার পাশে এসে বসে জোহানও। এসেই সে জিজ্ঞেস কঅরে, "কাওকে বলো নি তো?"
ইনারা বুঝতে পারে না কি বলছে জোহান, "কী?"
"আমার আর দীপার কথা?"
"মুড হয় নি বলার।"
"দেখ আমি তোমাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি...." ইনারা কথা কেটে বলে, "খবরদার হুমকি দেবার চেষ্টা করলেই মুড চেঞ্জ হয়ে যাবে বলে দিলাম।"
"আচ্ছা বাবা, তাহলে কী বললে আমাদের কথা জানাবে না তা বলো। তোমার কী লাগবে বলো?"
"বলব না।"
জোহানের মাথায় তখন সে কনসার্টে দেখা মেয়েটার কথাও ঘুরছিলো। তাই সে এই ফাঁকে জিজ্ঞেস করে নেয়, "আচ্ছা তোমার বোনের সাথে দেখা করবো আমি। সাথে সবাইকে দেখা করাবো। এটাতে খুশি? চলবে?"
জোহানের উদ্দেশ্য ছিলো এক তীরে দুই স্বীকার করার। কিন্তু ইনারা তার ইচ্ছা পূরণ হতে যেন দিবেই না। সে বলে, "আর আপনাকে কে বলল সে আপনার ফ্যান?"
"সারাদেশ আমাদের ফ্যান। সে হবে না? আচ্ছা সে কি আমাদের কোনো কনসার্টে আসে নি আগে?"
"বলব না।"
" আচ্ছা এটা না হলে তোমার চুপ থাকতে কী লাগবে তা তো বলো।" 

ইনারার তো এত সহজে ছেড়ে দেবার মানুষ না। তাই সে কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। অন্যদিকে আজ জোহান কথা বলেই যায়। তাকে মানানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। অথচ প্রতিদিন সে জোহানের সাথে কথা বলতে থাকে। কিন্তু জোহান উত্তর দেয় না। আজ ব্যাপারটা কেমন উল্টো। কিন্তু তার ব্যাপারটা ভালো লাগছে। কেমন যেন পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সে। 

সে এক ফাঁকে চোখ তুলে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্য তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। গতকালের কথা মনে করতেই সে ভেংচি কাটলো। দূর থেকেই ভেঙাতে শুরু করে। সভ্য বিরক্ত হয়ে চোখ নামিয়ে নিজের কাজ শুরু করতে থাকে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই আবার তাকায় তার দিকে। 

জোহান ইনারার ভেঙানিটা দেখে সভ্যের দিকে তাকায়। দুইজনকে দেখেই কপাল কুঁচকে নেয় ইনারা। সে যে সভ্যকে চিনতো তার তো এমন ব্যবহার পছন্দ ছিলো না তাহলে এই মেয়ের এমন ব্যবহার সে সহ্য করছে কেন?" 
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন