ভোরের রোদ - পর্ব ১৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


২৯!! 

রোদ একটু সময় নিয়ে শাওয়ার করে রুমে এসে দেখলো ভোর ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর ঘুমন্ত মায়াবী মুখটা দেখতে বেশ ভালো লাগছে রোদের। এতোক্ষণে মেয়েটার মুখের উপর থেকে অভিমানের কালো মেঘটা কেটে গেছে। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে পিচ্চিটা এতো রাগ করে গাল ফুলিয়ে ছিল, ভাবতেই হাসি পাচ্ছে রোদের। মেয়েটাকে আর জ্বালাতন না করে পাশের রুমে গিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়বে ঠিক করলো রোদ। কিন্তু কেন জানি ভোরের রেখে পাশের রুমটায় যেতেও মন সায় দিচ্ছে না রোদের। একটা সেকেন্ডের জন্যও পাগলিটাকে চোখের আড়াল হতে দিতে মন টানছে না। কিন্তু রাতও তো বাড়ছে। আর বেশি ভাবনায় গেল না রোদ। এগিয়ে এসে ভোরের মাথার কাছে বসে মুগ্ধ হয়ে ভোরকে দেখলো কিছুক্ষণ। লাল টুকটুকে শাড়ির সাথে রোদের কালো শার্টটা পড়ায় ভোরের সৌন্দর্যটা যেন আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। রোদ কিছুক্ষণ ভোরকে দেখে আলতো করো ভোরের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে সরে এলো। আর সাথে সাথে ভোর ধড়মড় করে চোখ মেলে তাকালো। ভোরের এভাবে আঁতকে উঠে জেগে যাওয়ায় রোদ নিজেও চমকে গেছে ততক্ষণে। রোদ ভোরের মুখের দিকে একটু ঝুঁকে গালে হাত ছুঁইয়ে দিলো। ঘুমের ঘোরে ভোর হঠাৎ ভয় পেয়েছে কিনা সেটা ভেবে নিজেকে মনে মনে কয়েক শ' গালি দেয়া হয়ে গেছে ততক্ষণে রোদের। 

-ভোরপাখি? আ'ম সরি সোনা। এই দেখ আমি, রোদ। সরি সোনা, তোর কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে দিলাম। সরি রে।

-রোদ? তুমি এখনো ঘুমাও নি?

-এই তো যাচ্ছি ঘুমাতে। তুই ঘুমা সোনাপাখি। সারাদিন কত ঝামেলা হলো। টায়ার্ড না পাগলিটা? হুম? এখন লক্ষী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়ো কেমন? 

-ঘুম ভাঙ্গিয়ে এখন সে বলছে ঘুমিয়ে পড়ো? হুহ। এটা কেমন কথা?

-সরি গো বউটা। আমি বুঝতে পারি নি তুই এভাবে ভয় পেয়ে যাবি। সরি সরি।

-ইশ! এখন সরি বলেই শেষ? আমার যে এখন আর ঘুম আসবে না তার কি হবে?

-আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি তো সোনাপাখি। তুই ঘুমা। চোখ বন্ধ----।

-না। তুমি জানো না কাঁচা ঘুম ভাঙ্গলে আর ঘুম আসে না যে?

-তাই নাকি? সারাদিন যে বেহুঁশের মতো ঘুমান বাসায়? তখন? 

-আমি সারাদিন ঘুমাই?

-তো আর কি? সকালে উঠিসই তো দশটার পর। তার পরে আবার পড়তে পড়তেই আমার বুকে ঢলে পড়িস। দুপুরেও খাওয়ার পরে বকবক করতে করতেই ঘুমের দেশে হারিয়ে যাস। আর রাতের কথা তো নাই বা বলি। ঘুমের ঘোরে কিসব আবোল তাবোল বকিস না তুই! আর এই পুরো সপ্তায় কোনদিন রাতে ছাদ থেকে নিজের পায়ে রুমে ফিরেছিস বল তো?

-তো? নিজে নিজে আসবো কেন? এতোগুলো সিঁড়ি বেয়ে নামতে আমার কষ্ট হবে না? আমি এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়েকে তুমি কোলে করে রুমে দিয়ে আসতে না পারলে এতো শক্ত শক্ত মোটা মোটা হাত দুটো কেন বানিয়েছ হ্যাঁ? 

-কি বললি?

-তো কি? গায়ে তো মাশাল্লাহ কত শক্তি তোমার, তবু আমাকে একটু কোলে নিয়েই খোঁটা দিচ্ছ? আমার তোমার মতো শক্তি থাকলে একদমই এমন করতাম না। হুহ। একটু কোলে নিতে না পারলে এতো বডি বানিয়েছ কি করতে? 

-কিসব পাগলের মতো বকছিস আবার?

-কি বললে আমি পাগল? তোমার সাথে কথাই নেই যাও।

-ভোর? আরে?

রোদ কিছু বলার আগেই ভোর উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ভোরের রাগ দেখে এবারে রোদের হাসিই পেল। মেয়েটা এমন পাগলামি করে যে রোদ না পারে ওকে কিছু বলতে, আর না পারে এই পাগলিটার উপর রাগ করে থাকতে। রোদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ভোরের পাশেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভোরের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার রাগ করে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকা আর ভালো লাগছে না রোদের। রোদ হাত বাড়িয়ে ভোরের কাঁধ ছুঁয়ে দেয়ার আগেই মাথায় একটা দু্ষ্টুমি বুদ্ধি আসায় থেমে গেল। বালিশ থেকে মাথা সরিয়ে নিয়ে একটু এগিয়ে এসে ভোরের কানের কাছে মুখ নিয়ে আলতো করে ফুঁ দিয়ে নিজের মনেই হাসলো রোদ। ভোর অবশ্য রোদের নিঃশ্বাস কানের কাছে এসে পড়ায় একটু কেঁপে উঠলো ঠিকই, কিন্তু ফিরে তাকালো না। সেটা দেখে রোদ আরো নিবিড় হয়ে ভোরের দিকে সেঁধিয়ে এলো। যেন কোনো দূরত্ব না থাকে দুজনের মাঝে। 

-তুমি না ডাকলে আসবো না
কাছে না এসে ভালোবাসবো না
দুরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
নাকি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়?

কানের কাছে রোদের উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে পড়ছে ভোরের। সেই উষ্ণ স্পর্শে ঘোর ঘোর একটা অনুভূতি হচ্ছিল ভোরের। সাথে একরাশ ভালো লাগার অনুভূতি। কিন্তু ভোরের সমস্ত অনুভূতি কর্পূরের মতো উবে গেল রোদের কণ্ঠে এমন কথা শুনে। ভোর ভ্রু কুঁচকে রোদের দিকে ফিরে তাকাতেই রোদ ভোরের কোমড় পেঁচিয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে নিজের হাতের উপরে ভোরের মাথাটা আলতো করে রেখে ভোরের মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। ভোরও ভ্রু কুচঁকে রোদকে দেখছে আর বুঝার চেষ্টা করছে লোকটা কি বুঝাতে চাইছে। রোদ এবারে হেসে ভোরকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো।

-কি দেখছিস রে আমার পিচ্চি বউটা?

-কি গান গাও এসব তুমি? আগা নেই মাথা নেই গানের। আজব!

-দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরনো,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।

-কি বললে তুমি? 

-কই কি বলছি বউ? গান শুনাচ্ছি তোমাকে। পছন্দ হয়নি আমার বউয়ের?

-তুমি ছাড়ো তো আমাকে। ছাড়ো বলছি?

-আরে? 

-না না না। ছাড়ো তুমি। তুমি ইচ্ছে করে সবসময়ই এমন করো। তোমার সাথে কথাই বলবো না আর আমি। 

-আরে আরে! পাগলিটা! রাগ করছিস কেন আবার? 

-রাগ করবো না তো কি নাচবো? তুমি কিসব বলো সবসময়? আমাকে জ্বালিয়ে কি মজা পাও তুমি সবসময়?

-এটাকি ছেলেখেলা আমার এই স্বপ্ন নিয়ে
চাইলে ভেঙে দেবে গড়ে দেবে ইচ্ছে হলে,
আমি গোপনে ভালোবেসেছি,
বাড়ি ফেরা পিছিয়েছে
তোমায় নিয়ে যাবো বলে।
একবার এসে দেখো,
এসে বুকে মাথা রেখো
বলে দেবো চুলে রেখে হাত। 

-আবার?

-আরে! এতো ক্ষেপছিস কেন রে বউসোনা? গানটা কি সুন্দর না বল? নাকি তোর আমার গলায় গান শুনতে ভালো লাগছে না? কোনটা?

-না লাগছে না। তুমি চুপ করবে? নাকি আমি এখনই চলে যাবো?

-বাব্বাহ! চলে যাবি? কোথায় যাবি এতো রাতে?

-অন্তত যেখানে গেলে তোমার এই বিরক্তিকর গান শুনতে হবে না সেখানে। খুশি?

-এভাবে বলতে পারলি ভোর? আমি এতো শখ করে তোকে গান শুনাচ্ছি। তাও আমার পছন্দের গানটা। তুই সেটা না শুনেই এভাবে আমাকে-----।

-হুহ। পছন্দের গান শুনাতে আসছে সে আমাকে। দুনিয়াতে গানের অভাব পড়েছে যেন। আর এতো রাতে এই গানের মানে কি? অসহ্য!

-ভোর না হতে হতে তোমাকেই দেখার আশায়
শেষ ছবিটা দেখি বারে বারে আহা! দেখি,
আমি গোপনে ভালোবেসেছি,
বাড়ি ফেরা পিছিয়েছে
তোমায় নিয়ে যাবো বলে।
একবার এসে দেখো,
এসে বুকে মাথা রেখো
বলে দেবো চুলে রেখে হাত...

দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরনো,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।

ভোর এবারে রাগে একটা কথাও না বলে চোখ বুজে রোদের বুকেই শুয়ে রইলো। রোদও বুঝতে পারলো সেটা। ভোরের মুখটা একহাত দিয়ে উঁচিয়ে ধরে আলতো করে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই ভোর সরে আসার জন্য ছটফট শুরু করলো। রোদ এবারে হেসে ভোরের ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরলো। ভোরও চমকে থেমে গেল।

-না তুই নিজে আমাকে আদর করিস, আর না আমি আদর দিলে নিতে চাস। এমন করলে আমি কি বুঝবো বল তো? তুই আমাকে ভালোবাসিস না সেটা? নাকি আমার স্পর্শে তুই কমফোর্টেবল ফিল করিস না সেটা?

-দুনিয়ার সব অদ্ভুত কথা তোমার মাথাতেই ঘোরে তাই না?

-কি করবো বল? তুই তো কিছু বুঝতেই দিতে চাস না। না বললে আমাকে তো নিজের মতো একটা মিনিং খুঁজে বের করতে হবে তাই না?

-বেশি বকবক না করে ঘুমাও। আর একটাও কথা বললে সকালেই চলে যাবো বলে দিলাম।

-আরে! ভোর?

-বলেছি না কথা না একটাও।

-হুম।

রোদ ভোরের মাথাটা বালিশে আলতো করে রেখে সরে আসার চেষ্টা করতেই ভোর রোদের শার্টের একটা কোণা শক্ত করে ধরে ফেললো। রোদ ভোরের দিকে ফিরে ভ্রু নাচিয়ে তাকালো। ভোর রোদের এমন অবাক অবাক চাহনিকে পাত্তা না দিয়েই রোদকে এক টানে বিছানায় ফেলে আগের মতো গুটিশুটি হয়ে রোদের বুক লুকিয়ে নিলো। রোদ এক মূহুর্ত থতমত খেয়ে গেল। এই মেয়েটার মনে কখন কি চলে সেটা আজ কিছুতেই বুঝতে পারছে না রোদ। রোদের এসব ভাবার ফাঁকেই ভোর কিছুটা বিরক্ত হয়ে মুখ তুলে রোদের চোখে চোখ রাখলো।

-কি হলো কথা বলো না কেন তুমি?

-হুম?

-তুমি আমাকে একলা রেখে কোথায় চলে যাচ্ছ? আমার একা একা ভয় করে জানো না?

-হুম।

-তাহলে চলে যাচ্ছে কেন? আমি কি যেতে বলেছি তোমাকে? আজব!

-উহু।

-ওই? কি হুম উঁহু শুরু করেছ? কথা বলো না কেন তুমি?

-তুই তো কথা বলতে বারণ করলি। একটু আগেই তো বললি একটাও কথা বললে সকালেই-------।

-কি! আমি বলেছি বলে তুমি সত্যি সত্যি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে? তাহলে আমি বললে তুমি আমাকে ফেলে চলেও যাবে? 

-আরে না না পাখিটা। কথা বললে তো তুই ঘুমাতে পারবি না। তাই আর কি----।

-তুমি একটা কথাও বলবা না আর। এখন না, কাল সকালে না, কক্খনো না, কোনোদিন না। তোমার সাথে কোনো কথাই নেই আমার।

-আরে কি মুশকিল!

ভোর আবার রাগ করে সরে আসার চেষ্টা করতেই রোদ এবারে ভোরকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গায়ে হালকা চাদর টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো।

-আরো করো আমার মতো ছোট্ট একটা মেয়েকে বিয়ে! হুহ। আবার মুশকিল বলতে এসেছে----।

-ম্যাডাম, আমার বউকে আমি ঠিক সামলে নিবো। ডোন্ট ওরি। এখন আপনি ঘুমান। ঘুমের ঘোরে আবার ওলোটপালোট কথাবার্তা বলে আমার মাথাটা খারাপ করতে হবে না আপনাকে এখন।

-কি বললে তুমি? আমি উল্টাপাল্টা কথা বলছি?

-না গো সোনা। আমার বউ উল্টাপাল্টা কিছু বলতে পারে? পারে না তো তাই না? কিন্তু বউটার তো ঘুম পাচ্ছে না? এখন ঘুমাও কেমন? শরীর খারাপ করবে তো নইলে।

-হুম। ঘুম পাড়িয়ে দাও তাহলে?

-জি ম্যাডাম। দেখি? এখন চোখ বন্ধ করো?

ভোর এবারে লক্ষী মেয়ের মতো চোখ বুজে রোদের বুকে মুখ লুকিয়ে নিলো। আর দেখতে দেখতেই ঘুমিয়েও পড়লো একসময়। রোদ হেসে ভোরের চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে নিজেও ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল। সারাদিনের ক্লান্তির পর শরীর আর মন দুটোই ঘুমে কাহিল হলো দুজনের। 

৩০!! 

সকালবেলা হাত বাড়িয়ে ভোরকে ছুঁইয়ে দিতে না পেরে রোদ ধড়ফড় করে চোখ মেলে বিছানার দিকে তাকালো। ভোরকে পাশে দেখতে না পেয়েই পৃথিবীটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন থমকে গেল রোদের। এতো সকালে ভোর কোথায় যাবে ভেবেই প্রায় লাফিয়ে বিছানায় বসে পড়লো রোদ। আর উঠে বসেই একটু দূরে একটা মিষ্টি হাসির সুর ভেসে উঠতেই রোদের ভয়টা নিমিষেই কেটে গেল। হাসির উৎসের দিকে তাকিয়েই মুগ্ধ হতে হলো রোদকে। রোদের ভয় পাওয়া মুখটা দেখে মজা পেয়ে খিলখিল করে হাসছে ভোর। রোদ অবশ্য থমকে গেছে ভোরের সদ্যস্নাত মুখটা দেখে। হাসির দমকে মেয়েটা ভেজা চুলগুলে যে টাওয়াল দিয়ে মুছছিল সেটাও বোধ হয় ভুলে গেছে। ভেজা টাওয়ালটা হাতে ধরে রেখেছে, আর এদিকে চুল থেকে টপটপ করে ঝড়া পানিতে মেয়েটার জামাটা ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজতে শুরু করেছে। রোদ এবারে ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে এসে ভোরের সামনে এসে দাঁড়ালো। হালকা করে ভোরের হাত থেকে টাওয়ালটা নিয়ে নিজেই ভোরের চুল মোছায় মনযোগ দিলো রোদ। ভোর বাধ্য মেয়ের মতো রোদের সামনে দাঁড়িয়ে তখনো হাসছে মিটিমিটি করে। রোদ সেটা দেখে নিজেও হেসে ফেললো। 

-তুই কি আমাকে খুন করতে চাস ভোর?

-ওমা! তোমাকে খুন করতে চাইবো কেন?

-আমার তো মনে হচ্ছে তুই চাইছিস আমাকে খুন করতে। কেন বল তো? আমি তোর কি ক্ষতি করেছি ভোর? তোকে নাহয় ভালোবাসি, তার জন্য এভাবে মেরে ফেলবি তুই আমাকে? এতোটা পাষাণ তুই?

-কি! আমি আবার কি করলাম? 

-কি করিস নি? এভাবে না বলে তুই কোথায় গিয়েছিলি? জানিস না তুই এক মূহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল হলে আমি-----।

-ওমা! শাওয়ার নিতে গিয়েছিলাম। তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে। আমি কি তোমার ঘুম ভাঙিয়ে বলতাম যে শাওয়ার নিতে যাচ্ছি? অদ্ভুত কথা বলো তুমি রোদ।

-বলবি না কেন? আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, মরে তো যাই নি না? আমি যে উঠে তোকে পাশে দেখলাম না, কত ভয় পেয়েছিলাম জানিস তুই? জানিস তোকে হারানোর ভয়টা কতোটা জেঁকে ধরেছিল আমাকে? 

-কি মুশকিল! এতো ভয় পাওয়ার কি হলো? আমি তো ওয়াশরুমেই ছিলাম। একটু শান্তিতে শাওয়ারও নিতে পারবো না নাকি তোমার জন্য?

-আর এই মেয়ে? এতো সকালে তোকে শাওয়ার নিতেই বা কে বলেছে? আজব? এই ঠান্ডার মধ্যে ফাইজলামি শুরু করেছিস? আবার ঠান্ডা লাগানোর প্ল্যান করছিস তুই?

-এতো সকাল কোথায় পেলে? নয়টা বাজে। আর ঠান্ডা লাগবে কেন? ওয়াটার হিটার আছে তো বাথরুমে----।

-তোমাকে বেশি পাকামি করতে কেউ বলেছে? আমাকে ডাকলি না কেন? না বলে তুই শাওয়ারই বা নিলি কেন? বল?

-কি আশ্চর্য! শাওয়ার নিতেও তোমাকে বলতে হবে নাকি?

-১০০ বার বলতে হবে। বলবি না কেন?

-কেন? তুমি কি আমাকে গোসল করিয়ে দিবা?

বেখেয়ালে কথাটা বলেই সাথেসাথে লজ্জা পেয়ে দাঁতে জিভ কেটে রোদের হাত থেকে টাওয়াল একটু টেনে নামিয়ে মুখটা ঢাকলো ভোর। রোদও হেসে ফেললো রোদের কথাটা শুনে। ভোরের লজ্জা পাওয়া দেখে রোদ একটু দুষ্টুমি করার জন্য ভোরের মুখের উপর থেকে টাওয়ালটা সরিয়ে নিয়ে ভোরের মুখটা তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো। ভোর লজ্জা পেয়ে সরে আসার চেষ্টা করেও সুবিধে করতে পারলো না। 

-তা দিতেই পারি। আমার বউই তো তাই না? অবশ্য বউ তো সেটা চায় না। 

-আমমমম। না মানে আসলে। আমি সেটা বলতে চাই নি।

-কি বলতে চেয়েছিস সেসব বাদ দে। তার আগে তুই আমাকে বল তুই এতো সকালে শাওয়ার নিলি কেন? আমি তো কিছু করি নি। আর তুইও তো----।

-ছি! কিসব বলো তুমি সবসময়? 

-কি বলবো আর? না তুই ভালোবাসলি, আর না আমাকে ভালোবাসতে দিলি। তাহলে এতো সকালে নতুন বউয়ের মতো শাওয়ার নিতে ছুটলি কেন বল তো?

-তুমি একটা খুব খারাপ। কাল সারাদিন ওই পচা লোকটা আমাকে নোংরা ময়লা একটা রুমে আটকে রেখেছে। রাতে হাত মুখ ধুয়ে জামা পাল্টে শুয়েছি। তবু কেমন ঘেন্না লাগছিল আমার। মনে হচ্ছিল ওই খারাপ লোকগুলোর ছোঁয়া গায়ে লেগে আছে। ছি! তাই আমি ঘষে ঘষে ওদের সবার স্পর্শগুলো মুছে ফেলেছি। 

কথাগুলো বলতে গিয়ে ভোরের কণ্ঠস্বরটা ভারি হয়ে উঠছে সেটা বুঝতে পেরে রোদ ভোরকে আলতো করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটার মন খারাপ হওয়ার আগেই প্রসঙ্গটা পাল্টানো দরকার সেটা রোদ ভালোই বুঝতে পারলো। তাই ভোরকে আর কিছু ভাবার সময় না দিয়ে রোদ ভোরের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে হালকা একটা ফুঁ দিলো।

-কিন্তু কি বল তো ভোর? সারারাত তুই আমার সাথে ছিলি। আর এখন এতো সকাল সকাল শাওয়ার নিচ্ছিস জানলে কি হবে জানিস?

-কি? কি হবে?

-হয় তোর বড়আব্বু হার্টফেল করবে। নইলে নাবালিকা মেয়েকে রেপের অপরাধে আমাকে জেলে ভরবে।

-কি! তুমি তো খারাপ! ছি! 

-বাহ! তুমি ছি মার্কা কাজ করতে পারবা। আর আমি বললেই দোষ! বাহ! 

-রোদ?

-কি গো সোনাপাখি?

-ছাড়ো তো। এতোক্ষণ হয়েছে উঠেছ! এখন ব্রাশ করো নি! ইয়াক! যাও তো ফ্রেশ হয়ে আসো। খিদা লাগসে আমার।

-বলেছিলাম না দিন দিন আটার বস্তা হচ্ছিস? প্রমাণ পেলি এবার? সকাল হতে না হতেই খাই খাই শুরু তোর---।

-কি বললে তুমি?

-আমি এক কথা দুবার বলি না ম্যাডাম। যাই ফ্রেশ হয়ে আসি। নইলে বেশি খিদে পেলে কেউ আমাকে জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে।

-রোদ! তোমাকে আমি----।

ভোর রাগের চোটে কথাটা শেষ করতে পারলো না। রোদ সেটা দেখেও হেসে ফেললো। 

-হয়েছে মিসেস এংগ্রী কুইন। আপনি এখানে পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি ফ্রেয় হয়ে আসছি।

-হুহ। 

-আর ম্যাডাম। আমি বের হওয়ার আগে রুমের বাইরে পা রাখলেও এখন পা জোড়া ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে দিবো বলে দিলাম।

-হুহ। আমার বয়েই গেছে এই খারাপ লোকটার কথা শুনতে। আমি এই রুমে আর এক সেকেন্ডও থাকবো না। 

রোদ ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই ভোর নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেই গজগজ করছিল। রোদ কিছু একটা ভেবে ভোরের দিকে ঘুরে তাকালো।

-এই যে ভোর ম্যাডাম? একটু এখানে আসবেন?

-হুম? কেন?

-আসুন না প্লিজ? একটা জিনিস দেখাই।

-হুম।

ভোর আবার ঠোঁট বাঁকিয়ে রোদের সামনে এসে দাঁড়ালো। রোদ একটু হেসে ভোরের হাতটা টেনে নিজের কাছে এনে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো ভোরের কপালে। ভোর থতমত খেয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রোদ ভোরের কপালে কপাল ঠেকিয়ে হাসলো।

-তোকে খুব সুন্দর মানিয়েছে এই ড্রেসটায় ভোর। একদম আমার লালপরী লাগছে তোকে। আমার পিচ্চি লালপরী বউ। 

-তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও না যাও?

-যাচ্ছি গো পাগলিটা। নিচে যেতে ইচ্ছে করছে আমার পরীটার?

--------হুম।

-আচ্ছা যাও। আমি এক্ষুণি আসছি সোনাপাখি। কেমন?

-আচ্ছা।

রোদ ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে ভোরকে রুমে না দেখে ভোরকে খুঁজতে নিচতলায় ডাইনিংরুমের দিকে গেল। রোদ ডাইনিংরুমে এসে দেখলো ভোর উল্টোদিকে মুখ করে কিছু একটা করছে। রোদ পা টিপে টিপে এগিয়ে এসে পিছন থেকে ভোরকে জড়িয়ে ধরতেই ভোর চমকে উঠলো। রোদ আলতো করে ভোরের গালে চুমো দিয়ে ভোরের কাঁধে মুখ গুঁজলো।

-আরে? এই কি করছ?

-তোকে অনুভব করার চেষ্টা করছি। আবার কবে তোকে এতো কাছে পাবো কে জানে!

-কি? কেন?

-নাহ এমনি। তুই কি করছিস রে সোনাপাখি? তোকে এসব করতে কে বলেছে এতো সকালে? হুম?

-না মানে। আমি তো তেমন কিছু বানাতে পারি না। তাই ব্রেড টোস্ট আর অমলেট করেছি একটু। 

-হুম। তাহলে বউ আজকে নিজের হাতে নাস্তা বানিয়েছে? বাহ!

-ছাড়ো না? কাজ করছি তো?

-তোমার কাজ তুমি করো। আমি তো কিছু করছি না পাখি। তোমার কাজ করা দেখছি।

-আচ্ছা? তাই নাকি?

-হুম। তোমার না খুব খিদে পেয়েছিল? নাস্তা রেডি করে চেহারা দেখছ কেন?

-না মানে আমি-- ফ্রুট জুস বানাচ্ছিলাম তো তাই---।

-বুঝতে পেরেছি ম্যাডাম। আপনি এখন বসুন। আমি করে নিচ্ছি বাকিটা।

-না না না। আমি আজকে ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছি। তুমি অন্যদিন বানিয়ো। এখন সরো তো। তোমাকে খেতে দিই।

-যেভাবে বায়না করছিস মনে হচ্ছে এখানে আজীবন থেকে যাওয়ার প্ল্যান আছে তোর?

-আছেই তো।

-কি?

-কই কিছু না তো। বসো না তুমি?

রোদ ভ্রু কুঁচকে ভোরের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। ভোর বেশ উৎসাহ নিয়ে রোদের প্লেটে দু পিস টোস্ট একটা অমলেট তুলে দিয়ে গ্লাসে ওরেঞ্জ জুস ঢালতে শুরু করেছে। এর মধ্যেই রোদ খাওয়া শুরু করায় ভোর আড়চোখে দেখছে রোদকে। রোদ মুখ তুলে ভোরের দিকে তাকাতেই ভোর তড়িঘড়ি করে চোখ সরিয়ে নিয়ে জুসের গ্লাসটা রোদের সামনে রেখে নিজেও রোদের পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। ভোরের এমন ছেলেমানুষি দেখে রোদ বহু কষ্টে নিজের হাসি চাপলো। হাত বাড়িয়ে ভোরের মুখের সামনে এক টুকরো টোস্ট ধরলো।

-কি?

-ভিষণ ভালো হয়েছে খেতে বুঝলি? তুই এতো ভালো রান্না করিস আমি তো জানতামই না। ইশ! আগে জানলে তোকে আগেই নিয়ে আসতাম। 

-তুমি আমার সাথে এভাবে ঠাট্টা করতে পারলে? 

-আরে বাবা! ঠাট্টা করছি না তো সোনাপাখি। দারুণ ভালো বানিয়েছিস ব্রেকফাস্ট। শুধু----।

-শুধু কি?

-শুধু অমলেটে লবণ দিতে ভুলে গেছিস। 

-ছি! আম সরি রোদ। লবণ দেয়ার কথা আমার একদমই মনে ছিল না। ইশ! কি ভুলোমনা আমি!

-আরে কি বলছিস এসব পাগলি? কিছু ভুল হয় নি। ওয়েট। আমি ঠিক করে দিচ্ছি। 

-হুম।

রোদ উঠে রান্নাঘরের কাবার্ড থেকে টেস্টিং সল্ট আর ব্ল্যাক পেপার নিয়ে এসে অমলেটের উপরে হালকা করে ছিটিয়ে দিলো। ভোর মুখ কালো করে রোদ কি করছে সেটা দেখছে আর বুঝার চেষ্টা করছে। রোদ এবারে ভোরের দিকে ভ্রু নাচিয়ে অমলেটের প্লেটটা এগিয়ে দিলো। ভোর নিজেও ভ্রু কুঁচকে অমলেটের একটুখানি চামচ দিয়ে কেটে মুখে দিয়েই রোদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। রোদ মিষ্টি করে হাসলো এবারে।

-দেখেছিস আমার বউ কত ভালো রান্না করতে পারে?

-আবার ঠাট্টা করছ আমার সাথে? আমি তো বলেছিই আমি পারি না এসব বানাতে।

-আরে বাবা! দুষ্টুমি করেছি তো আমি। এখন খা তো বাবা। এতোক্ষণ না খিদে পেয়েছে বলে লাফাচ্ছিলি? এখন হা করে বসে আছিস কেন? হা কর?

-হুম। 

ভোর মুখ কালো করে বসে আছে দেখে রোদ নিজেই ভোরকে খাইয়ে দিতে লাগলো। ওদের দুজনের খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ দরজায় কলিংবেল বাজলো। একবার নয়, পর পর দু বার। ভোর আর রোদ একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। এতো সকালে কে আসতে পারে এই প্রশ্নের চেয়েও প্রথমে যে প্রশ্নটা রোদের মাথায় আসছে সেটা হলো- এখানে কে আসতে পারে? ওরা এখানে আছে কথাটা কেউ জানে না। তাহলে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন