ভোরের রোদ - পর্ব ০৩ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৫!! 

রোদ কয়েক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে ভোরের কাঁপুনি দেখে হেসে ফেললো। মেয়েটার লজ্জায় লাল ঠোঁটজোড়া যেন হাত বাড়িয়ে রোদকে কাছে ডাকছে। আর ভোরের ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা এক বিন্দু আইসক্রিম দেখে বেচারা রোদ ঠিক থাকেই বা কি করে? রোদ ভোরের কোমড়টা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিল ভোরকে। তারপর খুব আলতো করে ভোরের ঠোঁটের কোণের আইসক্রিমটুকু শুষে নিলো। ভোরের মুখটা লজ্জায় আরো লাল হয়েছে দেখে রোদ ছোট্ট করে একটা চুমো এঁকে দিলো ভোরের ঠোঁটে। তারপর এক হাতে ভোরের চিবুক তুলে ধরলো। পাগলিটার লজ্জায় রেঙে মুখটায় যেমন রক্তিম আভা ফুটে আছে, তেমনি ঠোঁটের কোণেও একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে আছে। রোদ ভোরকে এবারে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।

-এসব চলে তাহলে ম্যাডাম ভোরের মাথায় তাই না? তাই পড়ার দিকেও একটুও মন নেই ম্যাডামের। আজ না এলে তো জানতেও পারতাম না ঘটনাটা---।

-তুমি কি বলছো এসব?

-আচ্ছা ভোরপাখি? আইসক্রিমটা তো খাওয়ালি না? কি ভেবে এমন লাল হয়েছিলি একবার বল না শুনি? 

-ক-কই? কি-কিছু ভা-ভাব-ভাবছিলাম না তো?

-তাই? বুকের ভেতরের কেমন ধুকপুক করছে শুনছিস? এমন লজ্জা রাঙা মুখটা দেখে কি হয় বুঝিস না? আর কিছু যদি না ই ভাববি তাহলে তোর ঠোঁটটা এতো রক্ত লাল হয়ে গেল কেন? এই যে তোর গালে লালিমা ধরেছে? কেন?

-কি সব বলো খালি? আমি কিছু ভাবছিলাম না। ছাড়ো?

-বুঝলাম ভাবছিলি না। তাহলে এমন লাফালাফি করে পালাতে চাইলি কেন? আমি কি তোকে খেয়ে ফেলছিলাম নাকি? শুধু তো বলেছি যে চামচ ছাড়া যেখাবে পারিস আইসক্রিম খাওয়া। তোকে তো বলি নি তোর ঠোঁট থেকেই-----।

-ছি! কিসব বলছো? 

-যাব্বাহ! তুমি ভাবতে পারবা আর আমি বললেই দোষ?

-কে বলেছে আমি ভেবেছি এসব? হু। বললেই হলো---?

-ভাবিস নি? সত্যি?

-হু? না----। ভাবি নি----। এসব ভাবতে যাবো কেন?

-ও তাই? কিন্তু ম্যাডাম? আমি যে আপনার ভাবনাতেও মিশে আছি। আপনি যা ভাবেন সেটাও যে আমি বুঝতে পারি? এখনও স্বীকার করবেন না?

-জি না। আমি মোটেও এসব পচা কথা ভাবি নি।

-পচা কথার কি বললাম আমি?

-তো কি বলছ? আর চামচ ছাড়া আইসক্রিম কিভাবে খাওয়ায় হ্যাঁ?

-অনেকভাবেই তো খাওয়ানো যায়। অবশ্য সেটা ইচ্ছে থাকলে---।

-আচ্ছা? কিভাবে? বলো আমি শুনি---।

-ওই যে তুমি যেটা ভাবছিলি ঠোঁটের আদরে, অথবা হাতের আঙ্গুলে মাখিয়েও খাওয়াতে পারিস। আবার ধর---।

-তুমি একটা পচা। সবসময় এসব বলো। ছাড়ো।

-পচা বললি তো? চলেই যাবো দেখিস। আর আসবোই না। তখন বসে বসে কাঁদিস---। আর নইলে ভাবিস আহা! রোদটা থাকলে কত্তো আদর করতো----।

-আবার! আর এতো যাবো যাবো করছ কেন আজকে? বললা না থাকবে আজকে?

-আজকে না একেবারের জন্য চলে যাবো। হুহ। আর তোর ছি ছি শুনতে হবে না তাহলে---।

-কোথায় যাবা? সত্যি যেতে পারবা?

রোদ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ভোরকে আলতো করে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ভোরও কিছুটা অবাক হয়ে ভোরের পাশে বিছানায় বসলো। রোদ চুপ করে শুয়ে আছে ব্যাপারটা একদম পছন্দ হচ্ছে না ভোরের। তাই আলতো করে রোদের কাঁধে ধাক্কা দিলো। 

-এই রোদ ভাইয়া? কথা বলো না কেন? কোথায় যাবা তুমি? কেন যাবা? রাগ করেছ আমার সাথে? এই দেখো কান ধরছি? সরি তো?

রোদ হেসে ফেললো ভোরের কথা শুনে। বিছানা থেকে মাথাটা ভোরের কোলে রেখে ভোরের একটা হাত টেনে নিয়ে নিজের চুলে রাখলো। ভোরও বুঝতে পারলো রোদ চাইছে ও রোদের চুলগুলো একটু নাড়িয়ে দিক। তাই ভোরও আলতো হাতে রোদের চুলগুলো টেনে নাড়িয়ে দিয়ে নিজের মনে খেলা করতে লাগলো। লোকটা আজ এতো 'চলে যাবো চলে যাবো' করছে কেন সেটা ভাবার চেষ্টা করলো ভোর। রোদ একমনে ভোরের চিন্তিত মুখটা দেখতে লাগলো। 

-কি ভাবছিস ভোর?

-হুম? বলো না তুমি কেন চলে যাবার কথা বলছ আজকে?

-সেটা একটু পরেই জানতে পারবি--।

-বড় আব্বু তোমাকে বকেছে বলে চলে যাবা? তাহলে আমাকেও সাথে নিবা প্লিজ? আমিও যাবো---।

-তুই আমার সাথে যাবি? কেন?

-উমমমম। এমনি--। তুমি একা একা কি করবে? আমরা দুজনে একসাথে গেলে অনেক ঘুরবো। অনেক মজা হবে---।

-মজা হবে? থাকতে পারবি আমার সাথে? ভয় করবে না? আমি তো তোকে কথায় কথায় বকি। কখনো কখনো গায়েও হাত তুলি। আবার কখনো তোর ঠোঁটের উপরেও হামলা করি। পরে যদি আরো বেশি কিছু করে বসি? তখন? 

-বেশি কিছু কি?

-কতো কিছুই তো করতে পারি তাই না? ধর নিয়ে গিয়ে তোকে মেরে ফেললাম--। 

ভোর অবাক অবাক চোখে রোদের মুখের দিকে তাকালো। রোদ ওকে অকারণে মেরে ফেলবে কেন সেটাই বেচারি খুঁজে পাচ্ছে না। রোদ একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে ভোরের পেটের দিকে ঘুরে শুয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে ভোরের ঘ্রাণ নেয়ায় মন দিলো। রোদের এমন কাজে বেচারি এবারে কিছুটা চমকে রোদের চুল খামচে ধরলো। রোদ হেসে ভোরের পেটে মুখ গুঁজে চুপ করে রইলো। এদিকে ভোর বেচারি তো পুরো স্ট্যাচু হয়ে বসে আছে। 

-কেন যে একটা বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পড়তে গেলাম সেটা ভেবেই এখন আফসোস করছি বুঝলি?

-হ্যাঁ? কি? কার প্রেমে পড়েছ?

-একটা নাদুসনুদুস গোলুমলু বোকা মেয়ের প্রেমে পড়েছি। তাকে একদম ক্লিয়ার করে না করে বললে সে কিছুই বুঝে না রে। কি আছে আমার কপালে কে জানে!

-তাহলে বড় কাউকে খুঁজে নাও না? বাচ্চার সাথে প্রেম করবা কেন?

-সেটা করতে পারলে তো হতোই। কিন্তু বাচ্চাটার সাথে তো প্রেম করিনি। তাকে ভালোবেসেছি। যখন থেকে বুদ্ধি হয়েছে তখন থেকেই তাকে আঁকড়ে ধরে নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু কপাল দেখ? বাচ্চাটা ভালোবাসা কি সেটাও বুঝে না। কতদিন আর এভাবে তাকে জোর করে আটকে রাখবো বল?

-তোমার গায়ে তো অনেক শক্তি। তুমি ওকে ঘরে তালা বন্ধ করে রেখে দিও। মজা হবে। হি হি।

-কিসের মধ্যে কি? এই তুই চুপ করবি? নাকি তোকে আমি চুপ করাবো? গাধার মতো আবার হি হি করছিস! আশ্চর্য!

-আজব তো! রাগ করছ কেন? আমি তো তোমাকে ভালো একটা বুদ্ধি দিলাম----।

-আর একটা কথা বলবি তো ভোর---।

রোদ রাগে লাল হচ্ছে দেখেও ভোরের হাসি থামছেই না। রোদের সেই বাচ্চা মেয়েটা যে ভোর নিজে সেটা ভোর খুব ভালো করেই জানে। আর জানে বলেই ওর হাসি পাচ্ছে খুব। তাতে রোদ যে আরো রেগে আগুন হচ্ছে সেদিকে ভোরের হুঁশই নেই। মেয়েটা খিলখিল করেই হেসে চলেছে। রোদও এবার ভোরকে কিছু না বলে চুপ করে ভোরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইলো। একটু পরেই বাবার কাছে সত্যি সত্যি রোদের চলে যাওয়ার কথাটা জানতে পারবে মেয়েটা তখন কি এভাবেই হাসতে পারবে? কথাটা ভাবতে গিয়ে চুপ হয়ে গেল রোদ। গলাটা বুজে আসতে চাইছে ওর। ইচ্ছে করছে ভোরকে বলতে, তুই শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে থাক ভোর। আমি কোথাও যেতে চাই না তোকে ছেড়ে। কিন্তু রোদ চাইলেই কথাটা ভোরকে বলতে পারবে না। ভালোবাসার মানুষটাকে পেতেই যে তার কাছ থেকে দূরে গিয়ে থাকবে হবে রোদকে। কিন্তু কি করে থাকবে সেটাই রোদ বুঝতে পারছে না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রোদের একটু চোখ লেগে এসেছিল। ভোরের আলতো ধাক্কায় তাই কিছুটা বিরক্ত হয়েই ভোরের কোলে আরো মুখ গুঁজে দিয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরলো রোদ। ভোর এবারেও একটু শিউরে উঠে রোদের চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।

-এই রোদ ভাইয়া? উঠো না? বড় আব্বু এসেছে তো? লাঞ্চের জন্য ডাকছে তো? উঠো না?

-উঁহু। কথা বলিস না তো ভোর। একটু শান্তিতে তোর কোলে ঘুমাতে দে না বাবা---। 

-আরে! বড় আব্বু রেগে যাবে তো পরে? পরে আবার বকুনি খাবা---।

-হুম!

বাবার আসার কথাটা শুনে রোদ চমকে উঠে বসে ভোরের দিকে তাকালো। ভোর তো পুরো থতমত খেয়ে গেল রোদের ঘুমুঘুমু চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে। কাঁচা ঘুমটা ভাঙ্গায় চোখ মুখ খানিকটা লাল হয়ে আছে ছেলেটার। তবু কি অদ্ভুত সুন্দর মানুষটা! আর রোদের মাথায় চলছে অন্য কিছু। একটু পরে ডাইনিং টেবিলে কি ঘটতে চলেছে এই পিচ্চি মেয়েটা জানেও না। কথাটা শোনার পর ওর কি রিএ্যাকশন হবে সেটা রোদ জানে না। যা ই হয়ে যাক না কেন শেষ মূহুর্তে এসে পিছু হটার ছেলে রোদ নয়। তাই নিজেকে মনে মনে শক্ত করার চেষ্টা করছে। আর যাই হোক। বাবার কাছে কিছুতেই হার মানবে না রোদ। কিছুতেই না।

০৬!! 

প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে ভোর কৌতূহলী চোখে একেকবার একেক জনের দিকে তাকাচ্ছে। আট জনের বসার টেবিলে সবাই গোল করে খেতে বসেছে ওরা। ভোরের বড় আব্বু মানে রোদের বাবার পাশেই ভোর বসেছে। আর ভোরের মুখোমুখি বসা রোদ একদম কোনো দিকে না তাকিয়েই একটু পর পর অল্প করে কয়েকটা ভাত মুখে দিচ্ছে। ভোর আজকের ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছে না। রোদ সবসময়ই নিজের বাবার সামনে একদম গুড বয় হয়েই থাকে। তবে আজকের ব্যাপারটা কেমন যেন একটু খাপছাড়া লাগছে ভোরের কাছে। ছেলেটা একটা বারের জন্যও মুখ তুলে তাকাচ্ছে না। এমন কি ভোর খাচ্ছে না কেন সেটা নিয়ে বকাও দিচ্ছে না। উল্টো নিজেই আজ এমন করে খাচ্ছে যেন তার নিজেরই গলায় ভাতগুলো আটকে যাচ্ছে। একটু পর পর পানি খেয়ে যেন ভাতটা গলা থেকে নামিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। ভোর অবাক চোখে বড় আম্মুর দিকে তাকালো। উনিও বেশ শান্ত হয়ে ভোরের প্লেটে ভাত মেখে এতোক্ষণে ভোরের মুখের সামনে ধরেছেন। ভোর থতমত খেয়েই হা করলো। আর বড় আম্মু কেমন একটু উদাস ভঙ্গিতে ভোরকে খাইয়ে দিতে লাগলেন।

-ভোর মা? পড়াশোনা কেমন চলছে তোমার? স্যারের কাছে ঠিক মতো পড়ছ তো?

-জি বড় আব্বু। 

-অবশ্য এবার থেকে তোমার পড়ার মাঝে কেউ ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে না। তুমি শান্তিতে পড়তে পারবে। আর তোমার স্যাররাও তোমাকে বিনা বাধায় পড়াতে আসতে পারবেন। মাঝ রাস্তায় তাদের কাউকে মাথা ফাটানোর হুমকি দিবে না আর কেউ।

-জি বড় আব্বু? 

-ওমা রোদ তোমাকে এখনো বলেনি কিছু? রোদ তো নেদারল্যান্ডস চলে যাচ্ছে। আমস্টারডাম ইউনিভার্সিটি থেকে এম বি এ কমপ্লিট করবে। আর সাথে সাথেই আমাদের আমস্টারডামের বিজনেসটাও টেকওভার করবে। দু-আড়াই বছর থাকবে। পরে অবশ্য ভালো লাগলে আবার যেতে পারে। কি বলো রোদ?

রোদ এতোক্ষণ চুপ করে বসে ভাত নাড়াচাড়া করছিল। এবারে মুখ তুলে সোজাসুজি বাবার দিকে তাকালো। 

-আমি যাচ্ছি না বাবা। আমাকে পাঠানো হচ্ছে। দুটো ব্যাপারের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ আছে। আর হ্যাঁ। যে সাতটা দিন আছি সেই সময়টায় তোমার ভোরের পড়ায় কোনরকম বাধার সৃষ্টি করবো না আমি। কাল সকালেই তো বাড়ি ফিরে যাচ্ছি তাই তোমাকে আশা করি টেনশন করতে হবে না---।

ভোর রোদের আর বড় আব্বুর কথাগুলো শুনে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইলো। গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না মেয়েটার। ভোরের মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে। ওর রোদ ওকে ছেড়ে চলে যাবে। দূরে বহু দূরে চলে যাবে। সত্যিই ভোর আর চাইলেও রোদের বুকে মুখ লুকিয়ে ঘ্রাণ নিতে পারবে না আগের মতো। কিংবা ভোরকে রেগে গিয়ে চড় মেরে রাতে কানে ধরে সরি বলতেও আসবে না রোদ। রাত দুপুরে হুটহাট করে এসে কোলে তুলে ঘুমন্ত ভোরকে জাগিয়ে চাঁদ দেখাতে নিয়ে যাবে না। কিংবা কেউ ভোরের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলে রোদ রেগে লাল হয়ে ভোরের ঠোঁটের উপরে রাগ ঝাড়বে না। কথাগুলো মনে হতেই ভোর খাওয়া ভুলেই রোদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। রোদ আজ একটা বারের জন্যও ভোরের দিকে তাকায় নি। চুপচাপ আরো কিছুক্ষণ ভাত নাড়াচাড়া করে শেষে প্লেট ঠেলে রেখে হাত গুটিয়ে উঠে দাঁড়ালো রোদ। চলে যেতে গিয়েও কি মনে হতেই রোদ আবার সামনের দিকে তাকালো।

-চাচ্চু? কাল থেকে তাহমিদ সাহেবের ভোরকে পড়ানোর প্রয়োজন নেই। কথাটা উনাকে জানিয়ে দিও---।

-এটা কেমন ধরনের কথা রোদ? ভুলে গেছ তুমি প্রমিস করেছিলে ভোরের পড়াশোনার ব্যাপারে তুমি আর নাক গলাবে না। এভাবে মাসে মাসে টিচার চেইঞ্জ করতে করতে এখন পরীক্ষার একমাস আগেও যদি টিচার চেইঞ্জ করো তাহলে মেয়েটা তো শেষে পরীক্ষায় পাসও করবে কিনা আমার সন্দেহ হচ্ছে। ছোটো শোন? ওর কথা শোনার কোনো মানেই হয় না--। তাহমিদই ভোরকে পড়াবে। ছেলেটাকে ভালোই মনে হয়--। আর রোদের এমন বাড়াবাড়ি করার পিছনে কোনো কারণ তো অন্তত দেখানো দরকার। দুম করে পড়াবে না বলে ডিসিশন শোনানোর ও কে? নিজেকে কি তুমি আজকাল ভোরের গার্জেন ভাবো নাকি রোদ?

-আব্বু? ভোরের কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামাবো না বলেছি ঠিকই। কিন্তু সেটা আমস্টারডামে যাওয়ার পর থেকে--। আর গার্জেনই বলো, বন্ধু বলো, বডিগার্ড বলো বা চাকর। আই ডোন্ট কেয়ার। ভোরের জন্য যা কিছু ঠিক না তা আমি ওর আশেপাশেও আসতে দিবো না। ওই তাহমিদকে তো নয়ই। আর চাচ্চু? আমি যাওয়ার আগেই ভোরের জন্য টিচার ঠিক করে দিয়ে যাবো। সেই টিচার শুধু এখন না আমি আসার আগ ওকে পর্যন্ত পড়াবে। সেসব নিয়ে ভেবো না তোমরা। 

-রোদ খাবারটা শেষ না করে উঠছ কেন? তোমার ছোটমা কত কষ্ট করে খাবারগুলো রান্না করেছে সে খেয়াল আছে? আর খাবার অপচয় করা কি ধরনের বেয়াদবি! চুপ করে বসে খাও।

-তুমিও খুব ভালো করে জানো আব্বু আজকে আমার গলা দিয়ে কিছুই নামবে না আর---। ভোর? হা করে তাকিয়ে না থেকে খেয়ে রেস্ট কর যা। 

-রোদ?

রোদের বাবা রাগ করে কিছু বলার চেষ্টা করলেও রোদ সেটা শোনার জন্য আর এক মূহুর্তও থাকলো না। হাতটা না ধুয়েই সোজা সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেল। রোদের এমন করে চলে যাওয়ায় সবাই থ হয়ে গেল। আর ভোর? বেচারির সারা দুনিয়াটাই যেন থমকে গেছে রোদের চলে যাওয়ার খবরটা শুনে। সকাল থেকে রোদের এতোবার 'চলে যাবো' কথাটার মানে এবারে পরিষ্কার হলো ভোরের কাছে। খাবারগুলোও যেন গলায় গিয়ে আটকে যাচ্ছে ভোরের। কোনমতে মাথা নেড়ে বড় আম্মুকে মানা করায় উনিও আজ আর তেমন জোর করলেন না খাওয়ার জন্য। ভোর কোনোমতে সামনের গ্লাসটা থেকে এক চুমুক পানি খেয়েই ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে দোতলার দিকে ছুটলো। পিছনে বাবার আর বড় আব্বুর কথাগুলো কানে আসছে ভোরের। 

-ছেলেটা এতো জেদ দেখিয়ে না খেয়ে উঠে গেল। এখন ভোরের খাওয়া হলো না। এমন কেন রোদ বল তো? একটু নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না? নিজের রাগটাকে কমাতে পারে তো নাকি? ওদের দুজনের ভালোর জন্যই তো রোদকে আমস্টারডামে পাঠাচ্ছি---। 

-ভাইজান ছেলেটা যেতে না চাইলে জোর করে পাঠিও না। থাক না। রোদ চলে গেলে দুটো বাড়িই তো একেবারে শূন্য মদিনা হয়ে যাবে। আর আমস্টারডামের ব্যবসা তো ভালোই চলছে। ওখানে যাওয়ার দরকার তো নেই ভাইজান? কথা শোনো? এতো বড় শাস্তি দিও না রোদ বাবাকে---।

-তোর আর তোর বউয়ের জন্য এই ছেলেকে একটুও কিছু বলার জো আছে। উঁহু এবারে এসব হবে না। ও নিজেই চয়েজ করেছে এই অপশনটা। 

-কিন্তু ভাইজান?

-এই যে তোরা এখনও তাহমিদকে বাদ দেয়ার ব্যাপারটা মেনে নিলি সেটা দেখেই আমি আরো নিজের সিদ্ধান্ত বদলাবো না। এবারে রোদ কেঁদেকেটে যেতে রাজি না হলেও জোর করে হলেও পাঠাবো। এই ছেলে কোনদিন জেদ করে ভোরকে চেয়ে বসলে তোরাও নাচতে নাচতে এই বদরাগী ছেলের হাতে আমার ফুলের মতো ভোরকে তুলে দিবি। আর ছেলেটা পরে আরো বেশি করে মাথায় উঠে যাবে।

-হা হা হা। এটা বেশ বলেছ ভাইজান। আমি আর ভোরের মা তো ঠিক করেই রেখেছি------।

বাবার শেষের কথাগুলো ভোর শুনতে পেল না। তার আগেই মেয়েটা এক ছুটেই রোদের রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রোদের রুমের দরজাটা আজ বাইরে থেকে বন্ধ দেখে বেশ অবাকই হতে হলো ভোরকে। এই দরজা বন্ধ থাকার ঘটনাটাও আজ প্রথম হলো। অবশ্য আজ যে কতোকিছুই নতুন করে দেখতে হচ্ছে ভোরকে। ভোর তাই আর চিন্তা না করে দরজায় নক করতে শুরু করেছে। রুমের ভিতর থেকে রোদের কোনো শব্দ আসছে না দেখে বেচারি ভোর এবারে কিছুটা ভয় পেয়ে আরো জোরে জোরে নক করা শুরু করলো। কিন্তু একটা কর্কশ কণ্ঠ শুনে ভোরের হাতটা থেমে গেল অজান্তেই। 

-এখান থেকে চলে যা ভোর। আমাকে একদম বিরক্ত করবি না বলে দিলাম। 

-দরজাটা খোলো না রোদ ভাইয়া? শোনো না? 

-রোদ মরে গেছে। আর এই দরজাও খুলবো না। আর তোর জন্য তো কখনোই না। যা বলছি এখান থেকে?

-আমি কি করেছি? এমন করছ কেন তুমি? দরজাটা খোলো না প্লিজ? এই?

-তোর চাওয়াটা তো পূরণ হয়েই গেছে ভোর। আমি তো আর একটা সপ্তাহ আছি তোর দেশে, তোর শহরে। নাকি আজই বিদায় করতে চাইছিস?

-তুমি এসব কেন বলছ রোদ ভাইয়া? আমি কি করেছি? দরজাটা একবার খোলো না? তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে। সেগুলো শুনতেই হবে তোমাকে। আমারও অনেক কথা শোনার আছে তোমার কাছ থেকে--।

-এবার কি এসে তোর পায়ে ধরে বলবো যে, 'ভোর প্লিজ? আমাকে এখন বিরক্ত করিস না? কিছুক্ষণ একা থাকতে দে আমাকে?' ধরবো পা তোর?

-ছিহ! কিসব বলছ তুমি?

-তোর এই ছি তোর কাছে রাখ। আর জ্বালাস না একদম। তাহলে হয় বাইরে এসে তোকে ঠাটিয়ে গালে দুটো চড় লাগাবো, নয়তো সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো। দুটোর একটা হলেও মরে গেলেও আর এই বাড়িতে আমি পা ফেলবো না আমি। সেটাই চাস তো তুই?

রোদের কথাগুলো শুনে কেউ যেন ভোরের বুকে ছুড়ি দিয়ে কলিজাটা কেটে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছিলো। এবারে রোদের শেষ কথাটা শুনে ভোর আর এক মূহুর্তও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। এক ছুটে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মেয়েটা। রোদের মুখ থেকে এতো শক্ত কথাগুলো শোনার পর মরে যেতে ইচ্ছে করছে ভোরের। একটু আগেও তো সব ঠিক ছিল। এই আধ ঘন্টার মধ্যে সব বদলে কেন কি করে? ভোর না রোদের চলে যাওয়ার খবরটা মানতে পারছে, আর না রোদের এই নির্দয় ব্যবহার। কেন করছে লোকটা এমন? কেন বারবার ভালোবাসায় আগলে রাখার জন্য আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে আবার একা করে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে? এই মানুষটা যে ভোরের নেশা হয়ে গেছে। তাকে ছাড়া এতোগুলো বছর কি করে বাঁচবে ভোর? কি করে তার চলে যাওয়াটা আটকাবে ভোর?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন