১৫!!
নাতাশা রুমের এক কোণে ফ্লোরে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে তখন থেকে। ঘড়িতে এখন কাঁটায় কাঁটায় দশটা বাজে। গত দুই ঘন্টা ধরে আবীর ওদের গত এক বছরের সংসার জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়গুলো মনে করানোর চেষ্টা করলো৷ ওদের বিয়ের ছবি হতে শুরু করে ওদের টোনাটুনির সংসারের সমস্ত পাগলামি একটু একটু মনে করানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু নাতাশার না কিছু মনে পড়ছে না কান্না থামছে। আবীর নাতাশার হাত ধরার চেষ্টা করতেই মেয়েটা এমন আঁতকে উঠে সরে গিয়ে দেয়ালের পাশে গুটিশুটি হয়ে সেধিয়ে গেলো। আবীর রাগের চোটে দেয়ালে একটা প্রচন্ড জোরে ঘুষি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। আর নাতাশা কাঁদছে।
নাতাশা হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে। এমন সময় চুলে হাতের স্পর্শে চমকে মুখ তুললো। আবীর খাবারের প্লেট হাতে নাতাশার সামনে এসে বসেছে। নাতাশা সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আবীর শান্ত চোখে তাকালো একবার ওর দিকে। তারপর প্লেট থেকে ভাত মাখিয়ে নাতাশার মুখের কাছে ধরলো। নাতাশা চুপ করে আছে দেখে আবীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
-নীলি--। নাতাশা তাই তো? বাড়ি ফিরতে চাও তো? ঠিক আছে। খেয়ে নাও। বাসার ঠিকানা দাও। আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসছি।
-সত্যি? স্যার আপনি সত্যি?
-হ্যাঁ নীলিমা। তোমাকে একটা কথা দিয়েছিলাম। তোমার হয়তো মনে নেই৷ কিন্তু নিজের ওয়াদাটা আমার মনে আছে---।
-কি কথা?
-সেসব নাই বা জানলে। তোমার তো বাড়ি ফিরা নিয়েই কাজ। আপাতত সেটা হচ্ছে। সেটাই নাহয় জানো--।
-সত্যি আপনি আমাকে সত্যি যেতে দিবেন---!
-আগে খেয়ে নাও সবটা---৷ সারাদিন অনেক ধকল গেছে--। ধরো মোবাইল---। বাসায় কথা বলো---।
-হুম----।
নাতাশা আবীরের বাড়িয়ে দেয়া মোবাইলটা তড়িঘড়ি করে হাতে নিয়ে বাড়িতে কল দেয়ায় মন দিলো। আর আবীর এক মনে নাতাশাকে দেখতে দেখতে খাইয়ে দিচ্ছে। খাইয়ে দেয়া শেষ হলে আবীর নাতাশাকে ওর নিজের বাড়িতে পোঁছে দিল। নাতাশার বাবা মা ওর আসার অপেক্ষা করছিলেন। মেয়েকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন। আবীরও সবার অলক্ষ্যে সেখান থেকে চলে গেল। নাতাশা মুখ তুলে আর মানুষটাকে দেখতে পেল না। রাতে বাবা মা নাতাশাকে ঘুমানোর জন্য ওর রুমে রেখে চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর নাতাশা উঠে বসে বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ডায়েরি বের করলো। ডায়েরিটা খুলতেই প্রথম পেইজের ভাঁজ থেকে একটা ছবি বেরিয়ে এলো। নাতাশা ছবিটা দুহাতে জাপটে ধরে বুকে চেপে ধরলো।
-আমি বুঝতে পারছি না আবীর। আমি কি করব একটু বলে দিবে? তোমাকে নিজের আদর্শ মেনেই তো এই মরণ ফাঁদে পা রাখা বলো? তুমিই তো আমার প্রথম আর শেষ ভালোবাসা। কিন্তু তনয়া আপু আর তুমি একজন অন্যজনকে ভালোবাসো সেটা তো এন এস আইয়ের সবাই জানে। আমি কি করে তোমাদের মাঝে এলাম আবীর? কি করে? আর তোমাদের ভালোবাসাটা কি এতোই ঠুনকো যে একজন তৃতীয় ব্যক্তি আসায় সেটা শেষ হয়ে যাবে? এখন তো তনয়া আপুও সুস্থ হয়ে ফিরেছে---। তাহলে--। তাহলে তোমাদের দুজনের মাঝখানে আমার----।
নাতাশা আর কিছু ভাবতে পারলো না। সারাদিন এতো কান্নাকাটির জন্যই কিনা কে জানে চোখ মুখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। কোনমতে আবীরের ছবিটা বুকে চেপে ধরে শোয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার আগেই শরীরটা ভার ছেড়ে নেতিয়ে পড়লো বিছানায়।
এক মাস পর।
আজ নাতাশার বিয়ে হয়েছে। কার সাথে বিয়ে হলো সেটা নাতাশা জানারও প্রয়োজন বোধ করে নি। গোঁ ধরে বসেছিল বিয়ে ও কিছুতেই করবে না। কিন্তু বাবা আর মা এমন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করলো যে শেষমেশ রাজি হতে বাধ্য হয়েছে নাতাশা। আর কার জন্যই বা অপেক্ষা করবে। আবীর সেদিন যে ওকে দিয়ে গেছে আর লোকটার চেহারাটুকুরও দেখা পায় নি নাতাশা।
একটা সুন্দর ফুলে সাজানো বিছানায় বসে নাতাশা আবীরের কথা ভাবছিল। অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে আলতো করে পেটে হাত ছুঁয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো নাতাশা। বারান্দাটা অন্ধকার। ওর জীবনের মতোই। সামনে কি হবে সেটা ভেবেই আঁতকে উঠছে ও। তবু নিজেকে শক্ত করছে আসন্ন ঝড়টার জন্য। একটু পরেই টের পেল কেউ আলতো করে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। নাতাশা ছিটকে লোকটার কাছ থেকে সরে এলো।
-খ-খবর-খবরদার একদম ছোঁবেন না আমাকে---।
-হোয়াদ্দা হেল! ছোঁবো না মানে কি? ইউ আর মাই ওয়াইফ--।
-হেল উইথ ইওর ওয়াইফ। বলেছিলাম তো বিয়েটা করতে চাই না আপনাকে--। তবু --। তবু কেন জোর করে বিয়েটা করতে গেলেন--। ওখানেই দাঁড়ান--। আর এক পা ও সামনে এলে------।
-কি করবে? ওহো---!! নাকি তোমার সেই প্রাক্তন হাসবেন্ড আসবে তোমাকে বাঁচাতে?
-আমার আবীর জানতে পারলে খুন করে ফেলবে শয়তান তোকে--। আর একবার যদি আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করিস---। তাহলে---।
-তাহলে?
-তাহলে খুন করে ফেলবো বলে দিলাম----।
-ওক্কে ডান---। আর ম্যাডাম হাসবেন্ডের প্রতি এতোই ভালোবাসা থাকলে তাকে ছেড়ে আমার কাছে আসতে গেলে কেন? এখন তোমার আবীর টাবিরকে ভুলে যাও। এখন আমি তোমার হাসবেন্ড। তোমার সবকিছুর উপরে শুধু আমার অধিকার---। আর কেমন খুন করতে পারো আমিও একটু দেখি-।
অন্ধকারে লোকটার মুখ দেখতে পাচ্ছিলো না নাতাশা। কিন্তু লোকটার সামনে এগিয়ে আসা টের পাচ্ছিল। লোকটা একদম সামনে চলে এসেছে বুঝতে পেরে সরার চেষ্টা করে নাতাশা। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। লোকটা নাতাশাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে। রুমটাও ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেটা টের পেয়েই নাতাশা হাত পা ছুঁড়ে লোকটার থেকে ছোটার চেষ্টা করলো। কিন্তু লোকটা ছাড়ার পাত্র নয়। সোজা নাতাশাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হাত চেপে ধরে গায়ের সমস্ত ভরটা ছেড়ে দিলো নাতাশার গায়ের উপরে। নাতাশা আর পেরে না উঠে একেবারে ভেঙ্গে পড়লো।
-প্লিজ এমন করবেন না। আপনার পায়ে পড়ছি। আমাকে প্লিজ আবীরের কাছে যেতে দিন না? প্লিজ?
-রিয়েলি? কখনো শুনেছ এতো দারুণ একটা-----।
-প্লিজ? দেখুন আম-- আম প্রেগন্যান্ট। প্লিজ? ছেড়ে দিন---।
কথাটা শুনেই বোধ হয় লোকটা একটু থমকে গেল। তারপর একটা তাচ্ছিল্যের হাসি শুনতে পেল নাতাশা।
-মিথ্যে বলে লাভ হবে না মিসেস শাহরিয়ার---। এসব কাহিনী শুনিয়ে আজ ছাড় পাবেন না---।
-দেখুন আমি মিথ্যে বলছি না। আমি--। আমি---।
কথাটা আর শেষ করতে পারলো না নাতাশা। আবার কান্না শুরু করলো। একটু পরে টের পেল লোকটা ধীরে ধীরে সরে গেছে ওর উপর থেকে। নাতাশা ফোঁপাতে ফোপাঁতে উঠে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজলো। একটু পরেই সুইচ অন করার শব্দ শুনেও মুখ তুললো না নাতাশা। লোকটা এসে এবার ওর সামনেই ফ্লোরে বসেছে সেটাও টের পেল। একটু পরে নাতাশার পেটে আলতো করে ছুঁয়ে দিলো লোকটা।
-নীলি? সত্যি কি আমাদের টোনাটুনির সংসারে নতুন অতিথি আসছে?
নাতাশা চমকে উঠে মুখ তুলতেই আবীরকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। আবীর উঠে নাতাশার পাশে বসে দু হাতে মুখটা তুলে ধরলো।
-কই বলো? সত্যি সত্যিই আসছে আমাদের একটা ছোট্ট পরী?
-আবীর?---তুমি----?
নাতাশা মাথা নেড়ে সায় দিতেই আবীর নীলিমার ঠোঁট জোড়া নিজের দখলে নিয়ে নিলো। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে একেবারে হেঁচকি তুলে ফেলেছে। আবীর নাতাশার মুখটা আবার তুলে ধরলো।
-এতো বড় একটা নিউজ আমাকে জানানোরও প্রয়োজন মনে করলে না?
-তুমি---। তুমি একটা খারাপ। আমাকে ওভাবে ফেলে---। আমি তোমাকে কত খুঁজেছি---। আর তুমি-- একবারও-----।
-শশশশশ। চুপ৷ আর একদম কান্নাকাটি না---। আমার পিচ্চি ঘুম পরীটার কষ্ট হচ্ছে না? শশশ। আর না ঘুমপরী--৷
-আমি। আমি কথাই বলবো না তোমার সাথে-।
-হুহ-। বলো না। আমি আমার মামনির সাথে কথা বলবো---৷ তোমার সাথে কথা নেই আমারও--।
আবীর আলতো করে নাতাশাকে শুইয়ে দিয়ে পেটের উপর থেকে বেনারসির আঁচলটা একটু সরিয়ে দিয়ে গভীর ভাবে চুমো খেল একটা৷
-বউটাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি অনেক--। সরি নীলিমা--। আবার আমার নীলিমা হবে ঘুমপরী? আরেকবার আমার জীবনে এসে শুধুই আমার হবে প্লিজ?
-তুমি? তুমি এতোগুলো দিন- একবারও এলে না কেন? কেন? কেন?
-পরীটাকে তো কথা দিয়েছিলাম। পরীটা সব ভুলে গেলে আবার নতুন করে ভালোবাসার গল্প শুরু করবো দুজনে। প্রয়োজনে শূন্য থেকেই শুরু হবে গল্পটা----।
-------------------------------
-সরি বউটা---। কেইসটা কোর্টে চলছিল--। চাই নি তুমি কোনভাবে আবার জড়িয়ে যাও এসবে--। সরি?
-কিন্তু আবীর?
-কিগো বউটা?
-তনয়া আপু?
-উফফফ। নীলি? তনয়া আর আমি কলেজ থেকেই খুব ভালো বন্ধু। ও আমাকে ভালোবাসতো। কিন্তু শুধু ও ভালোবাসতো বলে আমাকে তুমি এভাবে কষ্ট দিতে পারো না। আর তাছাড়াও তাহমিদ আর তনয়া বিয়ে করছে--। সো আপাতত তনয়াকে নিয়ে টেনশনটা বাদ দাও--।
-খারাপ একটা তুমি--। আগে---।
আবীর আলতো করে নীলিমার পেটে হাত ছুঁইয়ে দিতেই নীলিমা কেঁপে উঠলো।
-বাবু তোর পাপাই নাকি খারাপ। আপাতত তুই ঘুমা--। তোর মাকে পাপাই খারাপ বলার শাস্তি দিই--।
-যাও--। কিসব-------।
নীলিমা কথাটা আর শেষ করতে পারলো না। আবীরের ঠোঁট জোড়া ততক্ষণে ওর ঠোঁট নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিয়েছে। বুকের উপর থেকে যেন এক টনের একটা পাথর নেমে গেছে এতোক্ষণে নীলিমার। সমস্ত দোটানা আর সংশয় পিছনে ফেলে নীলিমা নিজের অস্তিত্বের সন্ধান ফিরে পেয়েছে আবার মানুষটার ভালোবাসায়। হ্যাঁ আজ থেকে নাতাশা আবার নীলিমা৷ নীলিমা আবীর আহমেদ। আর নীলিমা আর আবীরের টোনাটুনির সংসারটাও আজ সত্যিই ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়েছে। সুখে থাকুক ওদের টোনাটুনির সংসার। আর সুখে থাকুক ভালোবাসারা।
***(সমাপ্ত)***