কথা দিয়েছিলে ফিরবে - পর্ব ১০ - আফরোজা আক্তার - ধারাবাহিক গল্প


১৯!!

সকালবেলা বাসায় অনেকেই এসেছে নতুন বউকে দেখতে । বর্তমান যুগের প্রতিবেশী মানেই এক ঘর বেশি বুঝার পাবলিক । জুঁই তখন রান্নাঘরে ছিল । একে বিবাহিতা সে তার উপর এক বাচ্চার মা । দোষ তার বহুত হবে এটা সে জানে এবং বুঝেও গেছে৷। তাই নিজ হাতেই পরদিন কাজে লেগে গেছে সে । রান্নাঘরে শাম্মিও ছিল । আর শান্তা ইফসিকে নাস্তা খাওয়াচ্ছিলো । জুঁই ৫ কাপ চা নিয়ে বসার ঘরে সবার সামনে যায় । হলুদ এপ্লিকের শাড়িটায় জুঁইয়ের রুপ যেন ফেটে পড়ছিল তখন । সবার হাতে হাতে চা দিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সে । তখনই একজন মহিলা রেহানা পারভিনকে উদ্দেশ্য করে বলে , 

- হ্যাঁ গো নাফিসের মা , আপনার দেখি কপাল খুলে গেছে । ছেলে বিয়ে করছে তাও নাতিন সমেত । বউয়ের ডেলিভারি খরচ বেঁচে গেছে তাইলে । 

কথাটা জুঁইয়ের বুকের মাঝে গিয়ে বিধে । তখন নিজেকে অনেক অসহায় মনে হচ্ছিলো তার । তবুও দাঁড়িয়ে আছে সে । তখন পাশের জন বলে , 

- নাফিসের বুকে সাহস আছে বলতে হয় একে তো বিয়াত্তা মেয়েরে বিয়ে করছে সাথে মেয়েকেও নিয়ে নিছে । বাপ্রে বাপ । 

কথা গুলো জুঁইয়ের শরীরে কাটার মত বিধছে চোখের পানি গুলো টলমল করছে । এই একটা দুর্বলতাই তাকে হয়তো সারাজীবনের জন্যে কুড়ে কুড়ে খাবে । এমন সময় নাফিস সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় । আসলে সে ইফসির কাছে যাচ্ছিলো । পাশে দিয়ে হাটার সময় কথা গুলো নাফিসেরও কানে আসে । তাই সেও সেখানে প্রবেশ করে । নাফিসকে দেখে জুঁই আরও আগে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলো । হলুদ পাঞ্জাবিতে নাফিসকে মাশা-আল্লাহ অনেক সুন্দর লাগছিল । একজন সুদর্শন পুরুষ । নাফিস আর জুঁই এই জোড়া মনে হয় আল্লাহ পাক নিজ হাতে লিখে পাঠিয়ে দিয়েছেন । দুজন দুজনের চেয়ে কম না । এমন সময় ওই দুই মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলে , 

- আসসালামু আলাইকুম , কেমন আছেন আন্টিরা । 

নাফিসের সালামের উত্তর নেয় সবাই । তখন নাফিস আবারও বলে , 

- আমার বউকে দেখতে এসেছেন আন্টি ? 
- হ্যাঁ দেখতে আসলাম ।  বিয়ে করছো জানাইলা না তো । 
- আমি আর কি জানাবো বলেন আন্টি । এইসব খবর তো বাতাসের বেগে আপনাদের কানে পৌঁছায় । 
- নাহ শুনলাম আর কি । 
- নাহ ঠিকাছে , ব্যাপার না । তা আন্টি আপনার ছেলের দ্বিতীয় বউয়ের খবর কি , শুনলাম এইবারও আপনাদের সাথে ঝামেলা করে বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছে । 

নাফিসের কথায় মহিলা থতমত খেয়ে যায় । জুঁইয়ের চোখও বড় হয়ে যায় । রেহানা বেগমও ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে । নাফিস আবারও বলে , 

- আর এই আন্টির তো আরও ভালো অবস্থা , তাই না আন্টি । আন্টি আপনার বড় মেয়েকে শুনলাম আরেকটা বিয়ে দিয়েছেন এক মাস হলো । আমার বাপ মা তো দাওয়াতও খেয়ে এলো সেই বিয়ের । তা আমার বউয়ের তো এক বাচ্চা , আপনার মেয়ের তো জমজ বাচ্চা , আন্টি নতুন জামাই মেনে নিয়েছে ?  

জুঁইসহ সেখানে উপস্থিত সবাই আরও অবাক হয়ে যায় । এমন সময় শান্তাও আসে বসার ঘরে । এতক্ষণ ডাইনিং রুম থেকে সব শুনেছে সে । তাই এখন এসেছে । এসেই তার ভাইকে বলা শুরু করে , 

- ভাইয়া নাহ রে , নতুন জামাইয়ের বাড়ির লোকজন বলছে তারা মেয়ে নিবে কিন্তু বাচ্চা নিবে না । ওরা তো এখন আন্টির কাছেই তাই না আন্টি ? 
- ওহ আচ্ছা আচ্ছা , তা আন্টি এইবার বলুন তো , আমার বুকের সাহস কতটা হতে পারে । আপনাদের মত প্রতিবেশী যেই এলাকায় আছে না সেই এলাকার কোন ফ্যামিলি শান্তিতে থাকতে পারবে না । 

এটা বলার পর পরই রেহানা পারভিন নাফিসকে ধমক দিয়ে উঠে । 

- নাফিস,,,,,,,,,,?  
- কি হলো , গলা ফাটাও কেন ?  ভুল বলেছি নাকি । আমার কাছে আমার বউ সবার থেকে আলাদা । এইবার আপনারা বসে বসে ভাবুন সে কোন লেভেলের হলে আমি তাকে বাচ্চা সমেত বিয়ে করে আমার ঘরে উঠাতে পেরেছি । আর দয়া করে এখানে এসে পিন দিবেন না আগে নিজের ঘরের ঝামেলা মিটমাট করার চেষ্টা করবেন । না পারলে আমার সাহায্য নেবেন । 

নাফিসের কথায় সবাই এক এক করে চলে যায় । যা রেহানা পারভিনের একদম পছন্দ হয় নি । তিনি প্রচুর রেগে যায় । জুঁইকে নিয়ে নাফিস ডাইনিং রুমে চলে যায় । সেখানে শাম্মি , নাফিসের বাবা আর ইফসি বসেছিল । 
নাফিস টেবিলে বসে আছে নাস্তার জন্যে । ইফসিকে কোলে নিয়ে খেলা করছিল সে । 

- নাফিস , 
- জ্বি বাবা 
- একদম ভালো করছিস বাবা । 
- এদের ঘরে কাজ নাই বাবা , সকাল সকাল অন্যের ঘরে এসে আগুন লাগায় । যত্তসব থার্ড ক্লাস মহিলা । 
- থাক বাদ দে । 
- বাদ দিয়ে দিয়েই তো এই অবস্থা । আমি আর আগের নাফিস নেই বাবা , যে যা বলবে শুনবো । এইবার থেকে সোজা কথা হবে এইবার সে যেই হোক না কেন ? আমার নিজের মা বোন কিংবা সে জুঁইও হোক না কেন । 

ছেলের কথায় চুপ হয়ে যায় আনিস বেপারি । নাফিস তখন ইফসিকে রুটি খাইয়ে দিচ্ছে । জুঁই রান্নাঘরে রুটি ছেকছে । পিছন দিয়ে শান্তা এসে জুঁইকে জড়িয়ে ধরে । আর কাঁধে একটা চুমা দেয় । 

- কিছু বলবা শান্তা ? 
- তুমি কিছু মনে নিও না গো ভাবী , তারা এমনি । 
- মনে নেয়ার তো কিছু নেই । ওনারা তো ঠিক বলেছেন আর শুনো , এটা তো সত্যিই যে আমি এক বাচ্চার মা । আর তোমার ভাই আমায় এক বাচ্চা সমেত বিয়ে করেছে । আর আমরা সবাই সমাজে বসবাস করি । আর সমাজে এইসব হবেই । 
- হু , 
- যাও এইগুলো নিয়ে যাও । 

অন্যদিকে রেহানা পারভিন জিদে ফেটে যাচ্ছে । তারই ছেলে তারই সামনে ওনাদের সাথে এমন ব্যবহার করেছেন যা ওনার পছন্দ হয় নি । তিনি সোজা ডাইনিং রুমে এসে নাফিসের সামনে দাঁড়ায় । 

- তোকে কে বলছে ওনাদের সাথে এইভাবে কথা বলতে । 
- ভুল কি বললাম আমি । 
- ওনারা কি মিথ্যা বলছে নাকি , বিয়াত্তা মেয়ে বিয়ে করছিস , আবার বাচ্চাও নিয়ে আসছিস , ওনারা তো সত্যিটাই বলছে । 
- হ্যাঁ মা , আমিও তো সত্যিটাই বলেছি । ওনারা আমার বউয়ের সত্যিটা বলেছে আমি ওনাদের একজনের ছেলে আর আরেকজনের মেয়ের সত্যিটা বললাম । ক্ষতির তো কিছু দেখছি না । 
- নাফিস উড়িস না । বেশি উড়লে,,,,,,,,,, 
- পড়ে যাবো , তাই তো ? ইনশাআল্লাহ তোমাদের দোয়ায় পড়বো না । 
- এক অনাথের বাচ্চারে নিয়ে আদিক্ষেতা করস । 

এই ভাষাটা নাফিসের পছন্দ হয় নি । দাত মুখ খিটে মায়ের দিকে তাকায় সে । 

- খবরদার মা , আমার বাচ্চা অনাথ না । ওর মা আছে ওর বাবা আছে । ওর পুরো পরিবার আছে । তোমার মত একটা দাদি ওর না থাকলে ওর কিছু আসবেও না যাবেও না । খবরদার বলে দিলাম মা , পরবর্তী সময়ে তোমার মুখ থেকে আমার বাচ্চার নামে উল্টাপাল্টা কথা যাতে না বের হয় । নয়তো আমি নিজে তোমাদের অনাথ করে দিবো । একটা বাচ্চা যেমন অনাথ হলে দুনিয়া তাকে গ্রাস করতে চায় । তেমন করে অনাথ বাবা মায়ের অবস্থা এর থেকেও করুণ হয় । কথাটা মনে রাখবা তুমি । 

এইসব কিছু রান্নাঘর থেকে শুনছিলো জুঁই । চোখের পানি গুলো আপনা আপনি পড়ে যাচ্ছে চোখ দিয়ে । সবেমাত্র কাল বিয়ে করে এসেছে এই বাসায় । আর আজ এত কেয়ামত হয়ে যাচ্ছে । আর পারছিল না সে । শান্তা শাম্মি আর আনিস বেপারি নাফিসকে শান্ত করার চেষ্টা করছে । কিন্তু নাফিস এই মুহুর্তে প্রচন্ড চটে আছে । কারো কথা শুনছে না । 

- ভাইয়া ,,,,,,  তুই বস তো , নাস্তা খা তুই 
- গুষ্টি মারি আমি নাস্তা খাওয়ার , শান্তিতে খেতে দিছে নাকি আমাকে । 

এই বলে নাস্তার প্লেট টা ধাক্কা মেরে ফ্লোরে  ফেলে দেয় সে । তারপর সোজা রুমে চলে যায় । এইভাবে প্লেট ফেলে দেয়ায় সবাই তাৎক্ষনিক ভাবে চুপ হয়ে যায় । ইফসি বাচ্চাটাও ভয় পেয়ে যায় । দৌড়ে গিয়ে তার ফুপুর পিছনে লুকায় সে । শান্তা বুঝতে পেরে শাম্মির পিছন থেকে ইফসিকে কোলে তুলে নেয় আর নিজের রুমে নিয়ে যায় । অন্যদিকে শাম্মি ফ্লোর পরিষ্কার করতে লেগে যায় । আনিস বেপারিও মেজাজ খারাপ করে । 

- সকাল সকাল ঘরে অশান্তি লাগিয়ে দিছে । সে ভাবছে সব কিছু আগের মতই আছে , এখন নিজে এক করলে ছেলে যে উলটা ১০ করবে এটা আর বুঝে না । 

রেহানা পারভিন নিজের ঘরে চলে যায় । জুঁই আবারও পরোটা বানিয়ে ডিম ভেজে রুমে নিয়ে যায় । নাফিস তখন বারান্দায় ধুমছে সিগারেট টানছে । নাকে মুখে ধোঁয়া বের করছে । বিছানায় প্লেট রেখে নাফিসের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় জুঁই । আলতো করে নাফিসের কাঁধে হাত রাখে সে । নাফিস শুধু একবার জুঁইয়ের দিকে তাকায় । তারপর আবার সিগারেট টানায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে । তখন জুঁই বলে , 

- সিগারেট টা ফালাও আর ভেতরে আসো । 

নাফিস কথা বাড়ায় নি , কারণ সেও জানে জুঁই ভালো নেই এখন । সিগারেট ফেলে দিয়ে জুঁইয়ের সাথে রুমে আসে সে । 

জুঁই তখন নাফিসকে নিজের সামনে বসিয়ে রেখে নিজের হাতে নাফিসের মুখে পরোটার এক টুকরো তুলে ধরে । তখন নাফিস শুধুই তার কাদম্বরীর দিকে তাকিয়ে আছে । 

- খাওয়ার উপর জেদ করতে হয় না । তখন যা করেছো একদম ঠিক করো নি । খাবার গুলো ওভাবে ফেলে দিলে কেন ?  আল্লাহ পাক গুনাহ দিবে তো । 

জুঁইয়ের এমন শান্ত গলার মিষ্টি কথায় নাফিসের মন পুরো গলে যায় । সে তখন পরোটার টুকরোটা মুখে নিয়ে নেয় । তারপর বলা শুরু করে , 

- তোমার থেকে আমার খারাপ লাগাটা বেশি , কেন জানো ? সে আমার নিজের মা । সন্তান তখন কতটা অসহায় হয় যখন তার নিজের মা অন্যায় করে । 

কথাটা বলতে গিয়ে নাফিসের চোখে পানি এসে যায় । আর জুঁইয়ের চোখ দিয়ে পানিই গড়িয়ে পড়ে যায় । জুঁইয়ের চোখের পানি গুলো নিজ হাতে মুছে দেয় নাফিস । 

- হয়তো কিছু কথা শুনতে হবে আমার আড়ালে । একটু সহ্য করে নিও , কেমন ?  আমি তো সব সময় থাকবো না , যখন থাকবো না তখন সহ্য করে নিও । তবে কখনো মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না । ওনার খারাপ ব্যবহারের জবাব আমি তাকে দিবো । বুঝোই তো সে আমার জন্মদাত্রী । 

জুঁই তখন থাকতে নি । ঝাপটে নাফিসের বুকে গিয়ে পড়ে । বুকের মধ্যে এতক্ষণ লুকিয়ে থাকা চাপা ব্যাথাটা বাড়তে বাড়তে এতটাই বেড়ে গেছে যে আর ভেতরে থাকতে পারে নি । নাফিস জুঁইয়ের চাপা আর্তনাদ গুলোকে নিজের বক্ষে ধারণ করে নেয় । শক্ত করে চেপে ধরে রাখে জুঁইকে । 

- কাঁদবা না , অনেক তো কেঁদেছো । কষ্টে কষ্টে নিজের জীবনের ২৬ টি বছর পার করেছো । তারপর আমার দেয়া কষ্ট । ইফসির বাবার দেয়া কষ্ট । ইফসির দাদার বাড়ির কষ্ট । যথেষ্ট হয়েছে । আর কাঁদবা না । এখন থেকে হাসবে , শুধু হাসবে । আমাদের তিন জনের একটা ছোট একটা পরিবার । আমি তুমি ইফসি । আর কি লাগে । কাঁদবা না আর । 

জুঁই তখনও নাফিসকে জড়িয়ে ধরে রাখে । যদন আজ ছাড়তে মন চাইছে না নাফিসকে তার । নাফিসের জন্যে নিজের মনে যেই কষ্টটা ছিল তা যেন কোথায় ফুরুত করে উড়ে চলে গেছে । 

দুপুরের রান্না সব জুঁই নিজেই করেছে । আর ইফসি সারা বাসা জুড়ে দৌড়ে দৌড়ে খেলছে । কখনো শান্তা শাম্মির রুমে যায় , কখনো তার নতুন দাদার কাছে যায় , কখনো রান্নাঘরে যায় , কখনো তার পাপার কাছে যায় । ঘুরে ঘুরে সবার কাছে যায় । চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করেই নাফিসের মায়ের ঘরে মানে রেহানা পারভিনের ঘরে চলে যায় । রেহানা পারভিন তখন গোসল করে মাত্রই বের হয়েছেন । ইফসি তখন খাটের কোণায় গিয়ে দাঁড়িয়ে তার নতুন দাদিকে দেখছে । রেহানা পারভিন তখন চুল মুছতেছে আর ইফসি গিয়ে তার পাশে দাঁড়ায় । ইফসিকে দেখে রেহানা পারভিন কিছুক্ষণ ইফসির দিকে তাকিয়ে থাকে । তারপর কি যেন ভেবে বলে , 

- এইদিকে আসো , 

ইফসি বাচ্চা ভয়ে এগিয়ে যায় না তার দাদির দিকে । তারপর রেহানা পারভিন খাট থেকে নেমে গিয়ে ইফসিকে কোলে নেয় । আর নিজের খাটে বসায় । তারপর একটা চকলেট হাতে দেয় । তারপর নিজের চিরুনি দিয়ে সুন্দর করে মাথা আচড়িয়ে দেয় । 

চকলেট খেতে খেতে ইফসি বেরিয়ে যায় রুম থেকে । ইফসির মাথা আচড়ানো দেখে জুঁই ইফসিকে জিজ্ঞেস করলে ইফসি শুধু বলে দাদু দাদু । তাতেই জুঁই বুঝে যায় ইফসি কার কথা বলছে । তখন জুঁইও আর কিছু বলেনি । 

এভাবেই চলতে থাকে প্রায় ২ সপ্তাহ । বাসায় জুঁইয়ের সাথে শান্তা আর নাফিসের বাবা এরাই কথা বলে । রেহানা পারভিন সেদিনের পর থেকে ইফসিকে আদর করে তবে জুঁইয়ের সাথে কথা বলে না । জুঁই আর নাফিস সকালে অফিসে চলে গেলে ইফসি শান্তার কাছে থাকে । আর শান্তা কলেজে গেলে রেহানা পারভিনই রাখে ইফসিকে । ইফসিটাও এখন দাদুন দাদুন করে । 

তবে এই দুই সপ্তাহে নাফিস আর জুঁইয়ের সম্পর্কটা ভালোবাসার আছে ঠিক কিন্তু স্বামী স্ত্রী পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে নি এখনও । রাত কেটে যায় ইফসিকে মাঝে রেখেই । কত শত কথা , কিন্তু মুখে আসে না । কত শত চাওয়া পাওয়া কিন্তু চোখে আসে না । চোখে আসলেও কেউ দেখে না । 

অন্যদিকে , তাদের পাশের ফ্ল্যাটের একটা মেয়ে ইদানীং আসে নাফিসের বাসায় । ওই মেয়ের নাকি ইফসিকে খুব ভালো লাগে । 

বরাবরের মত আজ বাসায় শুধু রেহানা পারভিন আনিস বেপারি আর ইফসি । জুঁই সকালে যতটুকু পেরেছে করে দিয়ে গেছে । দুপুরের রান্না শেষে রেহানা পারভিন ইফসিকে গোসল করিয়ে সাজিয়ে দেয় । আনিস বেপারি এই জিনিসগুলো খেয়াল করেন । সেদিন সকালের পর থেকে রেহানা পারভিন অনেকটা বদলে গেছে । ইফসিকে অনেকটাই আদর করেন তিনি । ইফসিও দেখতে মাশা-আল্লাহ । তাই হয়তো মন কেড়ে নিয়েছে সবার । সাজিয়ে দিয়ে তারপর নিজ হাতে খাইয়ে দেয় ইফসিকে তিনি । 

বিকেলের দিকে ইফসি তার দাদার সাথে খেলছে । তখন সেই মেয়েটা আসে । 

- আন্টি কেমন আছেন ? 
- এই তো ভালো আছি , তুমি কেমন আছো । 
- ভালো আছি আন্টি । 
- ওহ , 
- আন্টি ইফসিকে একটু আমাদের বাসায় নিয়ে যাই ? 

রেহানা পারভিন কারো কাছে ইফসিকে দেয় না । হঠাৎ করে এই মেয়ে চাওয়াতেও তিনি না করে দেয় । 

- নাহ গো , নিও না । ওয় কান্না করে  ।
- কান্না করবে না আন্টি , নিচের থেকে ঘুরিয়ে আনবো । 
- ওয় ওর দাদার সাথেই বের হবে আরেকটু পরে । 
- আন্টি নেই না একটু । 

আনিস বেপারি খেয়াল করে রেহানা বেগম বার বার মানা করছে । তাই তিনিই অনুমতি দেয় ইফসিকে নিয়ে যেতে । তখন ইফসিকে কোলে নিয়ে মেয়েটা বাসা থেকে বেরিয়ে যায় । মেয়েটা চলে গেলে রেহানা পারভিন আনিস বেপারিকে ধরে বসে । 

- আমি বললাম না নিও না , তুমি কেন বললা নিতে । 
- আরে নিক না , থাকুক । 
- ওরে আমি কারো কাছে দেই ? 
- আরে কিছু হবে না । 

এমন সময় শান্তা আসে । চিল্লাচিল্লি শুনে সেও প্রশ্ন করে । 

- কি হয়েছে মা ? 
- সুমি এসে ইফসিকে নিয়ে গেছে । আমি বার বার না করলাম তোর বাবায় অনুমতি দিয়ে দিছে । 
- ওহ , তো কি হয়েছে মা ? 
- আরে আমি ওরে কারো কাছেই দেই না । 
- সুমি তো ইফসিকে অনেক আদর করে । আসার সময় দেখলাম ইফসিকে নিচে নিয়ে গেল । 
- দেখছিস নিচেও নিয়ে গেছে । 
- তো কি হয়েছে , সাথে সুমির ভাইয়ের ছেলেও আছে । 
- কিহহহহ , ওই উল্লুকটা ? সুমি ও-কে নিচে নিলো কেন ? 
- আরে বাদ দাও তো । ভাইয়া ভাবীও তো চলে আসবে আরেকটু পরে ওরা নিয়ে আসবে নে । 
- আমি ও-কে কারো কাছে দেই না । এই মহল্লার মানুষের যা মুখ । 

এই কথা শুনে আনিস বেপারি আর শান্তা তার দিকে তাকায় । উনাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে উনার মন শান্ত নেই । ইফসিকে যতক্ষণ না পর্যন্ত বাসায় দেখবেন উনি শান্তি পাচ্ছেন না । 

তাদের কথার এমন সময়ে রেহানা পারভিনের কানে ইফসির কান্নার আওয়াজ আসে । উনি দৌড়ে বারান্দায় যায় । গিয়ে দেখে ইফসি রাস্তায় বসে কাঁদছে । এই দেখে উনার মেজাজ আরও গরম হয়ে গেছে । 

- বলছিলাম না আমি , ওরে না নিতে । ওরে ফালাইয়া দিছে । 

মায়ের কথা শুনে শান্তার নাকে মুখে পানি উঠে যায় । 

- কি বলো তুমি মা , 
- গিয়ে দেখ বারান্দা দিয়ে , 

এই বলে তিনি নিজেই দরজা খুলে নিচে নেমে যায় । দোতলায় বাসা বলে নিচের সব কিছুই শুনা যায় । তিনি তাড়াতাড়ি নিচে গিয়ে দেখে ইফসির হাটু অনেকটা ছিলে গেছে । রক্ত বের হচ্ছে । নিচে বসে বাচ্চাটা মুখে দুই হাত দিয়ে কান্না করছে । দাদুনকে দেখে কান্নার মাত্রা আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেছে তার । আশেপাশে সুমিকে না দেখে উনার চরম মেজাজ খারাপ হচ্ছে । তাড়াতাড়ি গিয়ে ইফসিকে কোলে তুলে নেন তিনি । শান্তা আর আনিস বেপারিও নেমে আসে । 

- এই ওরে ফালাইছে কে ? কে ফালাইছে ওরে , 

তখন আরেকটা বাচ্চা বলে , 

- দাদু দাদু ওই ছেলেটা ইফসির চুল টান দিছে আর ইফসিকে ধাক্কা দিছে । 

রেহানা পারভিন তাকিয়ে দেখে ছেলেটা প্রায় বছর সাতেক হবে । উনি ইফসিকে কোলে নিয়েই ডাক দেয় ওই ছেলেকে । অত্যন্ত ক্ষেপে আছেন তিনি । 

- ওই এইদিকে আসো । তুমি ওরে ধাক্কা মারছো কেন ? 
-.............
- কি হলো , বলো , ধাক্কা দিছো কেন ? 
- ওয় আমার বল ধরে , 
- বল ধরলে ধাক্কা দিবা , বেয়াদব ছেলে । তোমার বয়স দেখো আর ওর বয়স দেখো । ওর পা টা ছিলে গেছে । অসভ্য ছেলে একটা । 

এমন সময় নাফিস আর জুঁই সেখানে রিক্সা থামায় । নাফিস নিজের মায়ের ভয়েস ভালো মতই চিনে । রেহানা পারভিন তখন সুমিকে কথা শুনাচ্ছে । 

- তুমি বললা বাসায় নিবা , নিয়ে আসলা নিচে । ওরে নিচে এসে তুমি কই গেছো ? 
- আন্টি আমি দোকানে গেছিলাম । 
- ওরে এইখানে রেখে কোন আক্কেলে দোকানে গেলা তুমি । ও যদি রিক্সার নিচে পড়তো , কিংব ড্রেনে পড়তো । 
- আন্টি আমি বুঝতে পারি নি । 
- ওরে নিয়ে আর কখনো নিচে আসবা না । আমি ওরে কারো কাছে দেই না । ওর বাবারেও নিষেধ করি আমি যাতে ওরে নিয়ে নিচে না নামে । 

নাফিস আর জুঁই এক নজরে রেহানা পারভিনের দিকে তাকিয়ে আছে । হঠাৎ করেই ইফসির পায়ের দিকে নজর যায় জুঁইয়ের । পা টা ছিলে রক্ত পড়ছে । তার বাচ্চার কান্নার আওয়াজ তার বুকে তীরের মত বিধছে । না পারছে কোলে তুলে নিতে না পারছে কিছু বলছে । নাফিস গিয়ে ইফসিকে কোলে তুলে নেয় । ইফসি পাপা পাপা বলে কাঁদতে থাকে । 

- নাফিস ওরে নিয়ে আয় । 
- তুমি আবার নিচে আসতা গেলা কেন , আর এইভাবে পরের ছেলেকে বকা ঠিক না । 
- পরের ছেলে যখন আমার নাতনিকে ফালায় , কথা কম বলিস । ঘরে আয় ওরে নিয়ে । 

নাফিস আর জুঁই আরও অবাক হয়ে যায় । উনি কি সত্যিই রেহানা বেগম । যে কিনা এত সহজে ইফসিকে নিজের নাতনি বলে স্বীকার করলেন । 

বাসায় এসে ইফসির পা সেভলন দিয়ে ক্লিন করে ব্যান্ডেজ করে দেয় নাফিস । তারপর রেহানা বেগম ইফসিকে কোলে তুলে সোফায় বসে থাকে । 

- দাদুন রে , ব্যাথা পাইছো ? 
- হু , 
- কতটুক ব্যাথা পাইছো দাদুন ? 
- নত্ত নত্ত দাদুন নত্ত 
- নত্ত নাই দাদুন , বাবা ব্যান্ডেজ করে দিছে না ? 

এমন সময় জুঁই ভাত মেখে নিয়ে আসে । রেহানা পারভিন এই প্রথম জুঁইয়ের সাথে কথা বলে । 

- আমার কাছে দেও আমি খাইয়ে দিতেছি , তুমি যাও । 
- নাহ মা , থাক । দেন আমি খাইয়ে দেই । 
- তুমি যাও রুমে । আর নাফিসরে জিজ্ঞেস করো কি খাবে । 
- আচ্ছা । 

জুঁই বেশ অবাক । রেহানা পারভিনের এতটা পরিবর্তন । ভাবতে ভাবতে রুমে আসে জুঁই । দরজার ভেতরে ঢুকতেই নাফিস পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে জুঁইকে । 

- কি ব্যাপার এত কি ভাবো ? 
- কিছু না তো , 
- মাকে দেখে অবাক হচ্ছো ? 
- বদলে গেলেন অনেকটা । 
- হ্যাঁ , ইফসিই মাকে বদলে দিয়েছে । 
- হয়তো , 

 নাফিস জুঁইকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে নেয় । অনেক্ষন জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সে । জুঁইও অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে নাফিসের চোখের দিকে । চোখের ভাষা গুলো চোখ দিয়েই বুঝে নেয় তারা । তখন নাফিস জুঁইকে খুব কাছে নিয়ে আসে । 

" ঠোঁটের প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হয় 
  চোখের প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হয় 
  তোমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয় 
  দূরে ঠেলে দিবে এটাই যে আমার ভয় " 

নাফিস আলতো করে জুঁইকে ছেড়ে দিয়ে সরে যেতে নিলে জুঁই নাফিসের শার্টে ধরে নাফিসকে নিজের কাছে নিয়ে আসে । কোন কিছু না ভেবে নাফিসের ঠোঁটের মাঝে নিজের ঠোঁট জোড়া মিলিয়ে দিয়ে নাফিসের ঘাড়ে নিজের হাত রেখে । নাফিস যেন তার বহুদিনের তৃষ্ণা নিবারনে নেমে যায় । সেই অবস্থাতেই জুঁইকে খাটে শুইয়ে দিয়ে তৃষ্ণা নিবারনের চেষ্টায় রত থাকে । আর জুঁই তার বড় নখের তীক্ষ্ণ আঁচড়ে নাফিসের পিঠে নিজের ভালোবাসার অস্তিত্ব একে দেয় । 

২০!!

- আম্মুন আম্মুন আম্মুন আম্মুন 

ইফসি তার মাকে ডাকায় অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়ে । রেহানা পারভিন তাকে শান্ত করতে পারছেনই না । সে বার বার বোঝাচ্ছেন যে তার আম্মুন ভেতরে কিন্তু ইফসি ডেকেই যাচ্ছে । দাদুনের কোল থেকে নেমে গিয়ে সোজা রুমের দিকে যাচ্ছে ইফসি । এইদিক দিয়ে রেহানা পারভিন বলা শুরু করে দেয় , 

- সেই কখন পাঠাইছি রুমে । জিজ্ঞেস করতে নাফিস কি খাবে । ওয় গিয়ে আটকিয়ে গেছে । বাচ্চাটার বোধ হয় ঘুম পাইছে । 

পরক্ষণেই তার মাথায় আসে রুমে তো নাফিস আর জুঁই এক সাথেই আছে । কি যেন ভেবে দৌড়ে গিয়ে নাতনিকে কোলে তুলে নেন তিনি । তারপর ইফসি আরও জোরে ডাকা শুরু করে । 

- দাদুন রে , ডাকো কেন ? 
- আম্মুন দাদুন আম্মুন । 
- আম্মুন রুমে পাপাও রুমে , এখন কি আর সহজে বের হবে তারা । তাগোরেও সময় দিতে হবে রে দাদুন । আয় তুই দাদুনের কাছে থাক । 

ইফসি লাগাতার আম্মুন আম্মুন করতে থাকে । ইফসির ডাক জুঁইয়ের কানে যেতেই সে নাফিসকে ইশারা দেয় উঠার জন্যে । 

- ইফসি ডাকছে কেন এভাবে ? দেখি সরো দেখে আসি আমি । 
- আরে দাঁড়াও , 

এই বলে আলতো করে জুঁইয়ের ঠোঁট জোড়া নিজের আঙুল দিয়ে মুছে দেয় নাফিস । 

- যাও সরো , 
- বেঁচে গেলে তুমি । 
- তোমার কাছে মরার জন্যে আমার অনেক সময় বাকি আছে , আসছি এখন । 
- হু , 
- চেঞ্জ করো , ফ্রেশ হও । 

জুঁই বের হয়ে এসে ইফসিকে কোলে তুলে নেয় । তখন রেহানা বেগম জিজ্ঞেস করে , 

- নাফিস কি খাবে বলছে কিছু ?  

শ্বাশুড়ির কথা শুনে তার মনে পড়ে যায় । তাকে তো পাঠানো হয়েছিল অন্য কাজে । কিন্তু সেখানে গিয়ে হয়ে গেছে অন্য কাজ । শ্বাশুড়ির কথায় মাথা নিচু করে থাকে জুঁই । জুঁইয়ের চুপ থাকা দেখে রেহানা পারভিন কিছু আন্দাজ করতে পারে তাই তিনিও বলে দেন , 

- অন্যকিছু খেলে আর কি খাওয়া লাগে ? তুমি ওরে সামলাও , দেখো মনে হয় ঘুমাবে তাই ডাকাডাকি করেছে । আমি রান্নাঘরে চাই । 

শ্বাশুড়ির কথায় লজ্জা পেয়ে যায় জুঁই । মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তার । অন্যদিকে একটা ভালো লাগাও কাজ করছে নিজের মনের মধ্যে । রেহানা পারভিনের ভালো ব্যবহার গুলো সত্যিই জুঁইয়ের মনকে পুলকিত করে দিয়েছে । 

ইফসিকে কোলে নিয়ে রুমে যায় জুঁই । নাফিস তখন ফ্রেশ হয়ে নিজের কাজ করছিল । ইফসিকে কোলে নিয়ে জুঁইকে দেখে নাফিস এগিয়ে যায় তাদের দিকে । 

- কি হয়েছে আমার মায়ের , এত কান্নাকাটি কেন ? 
- ওর পায়ে হয়তো ব্যাথা করতেছে নাফিস । যার জন্যে বিরক্ত করতেছে । 
- এন্টিসেপটিক দিলাম তো , মা আসো তো পাপার কাছে । 
- এক কাজ করো , তুমি ও-কে রাখো । আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি একটু । 
- আরে নাহ , যেতে হবে না । মা তো আছে সামলে নিবে । তুমি ও-কে ঘুম পাড়িয়ে দেও । 

সময়টা ভালোই পার হচ্ছিলো । ইফসি তার নতুন দাদার বাড়িতে বেশ ভালো আছে । জুঁই তার নতুন সংসারে ভালোই মানিয়ে নিয়েছে । এর মাঝে একদিন রেহানা বেগম আনিস বেপারি আর শান্তা শাম্মির বাসায় বেড়াতে যায় । সেখানে ইফসিকেও নিয়ে যেতে চায় রেহানা বেগম । কিন্তু ইফসি ঝামেলা করে তাই জুঁই দিতে চায় নি । 

- মা , নিতে হবে না থাক । 
- কেন নিতে হবে না কেন ? 
- মা ও তো জ্বালায় , ঝামেলা করে ইদানীং । 
- ও জ্বালাবে না তো কি তুমি জ্বালাবা নাকি ? 
- মা , আসলে আপনার শরীরও তো ভালো না , ওইদিকে গিয়ে যদি বিরক্ত করে ? 
- আমার দাদুন ভালো , তাই নারে দাদুন ? 

দাদুনের কথায় আবার মাথা নেড়ে সমর্থন করে ইফসি । তখন সবাই হেসে দেয় । নাফিস কোলে নিয়ে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ইফসিকে । 

- এই বুড়ি , ফুপুর বাসায় যাবা ? 
- হু হু , 
- জুঁই রেডি করে দেও , থাক ঘুরে আসুক । 
- জ্বালাবে কিন্তু । 
- শান্তা আছে তো , আর তাছাড়া শাম্মিও থাকবে ,  জ্বালাবে না । 
- হু , 

সবার কথা শুনে রেডি করিয়ে দেয় জুঁই ইফসিকে । রেডি হয়ে টুক টুক করে দাদুনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ছোট্ট ইফসি । রেহানা পারভিন ইফসিকে দেখে এক নজরে তকিয়ে থাকে । লাল রঙের ফ্রকে কি যে সুন্দর লাগছিল ইফসিকে । লাল রঙের রিবন দিয়ে দুটো ঝুঁটি বেধে দিয়েছ তার মা । একদম পরীর মত লাগছিল ইফসিকে । রেহানা বেগম তাড়াতাড়ি করে জড়িয়ে ধরে হাজারটা চুমা দেয় ইফসিকে । দাদুনের চুমু খেয়ে খিল খিল করে হাসে বাচ্চাটা । রেহানা বেগম ও-কে রাখবেন কোথায় । 

- হ্যাঁ রে দাদুন তোকে আমি রাখবো কইরে দাদুন । 

আনিস বেপারিও খুব খুশি । আসলেই বাচ্চারা ফেরেশতার রুপ হয় । আর একজন ফেরেশতার কাছে শয়তানও হার মানতে ব্যস্ত । আর এরা তো মানুষ মাত্র । জুঁই ইফসির কিছু জামা গুছিয়ে দেয় । একদিন থাকবে আর সে তো মিনিটের মধ্যে জামা পালটায় ৩-৫ টা । নোংরা হলেই পাল্টানোর জন্যে কান্নাকাটি করে । 

শান্তার কোলে চেপে আম্মুন আর পাপাকে বাই বাই বলে সে । 

- বাইইইইই বাইইইইইইই
- আম্মুন বাই বাই বলে না মা । আল্লাহ হাফেজ দিতে হয় , আসসালামু আলাইকুম বলতে হয় ।

তখন নাফিস বলে ওঠে , 

- আরে থাক , এইগুলো ওর মুখে দিয়ে আসবে এখন ? 
- না আসলেও অভ্যাস করতে হবে তো ? 

তারপর সবার সাথে ইফসিও চলে যায় । জুঁই দৌড়ে বারান্দায় চলে যায় । বারান্দা থেকে মেয়েকে দেখবে বলে দাঁড়িয়ে আছে সে । আর মেয়েও নিচে গিয়ে ঠিক বারান্দার দিকে তাকায় । মাকে দেখে ফুপুর কোল থেকে টা টা দেয় তার মাকে । 

ওদের বিদায় দিয়ে নাফিস বাসায় আসে , এর ফাঁকে জুঁই হাতের কাজ গুলো সেড়ে নেয় । বাসা পুরো ফাঁকা । হাফ ডে বলে তাদেরও ছুটি । কাল শুক্রবার অফ ডে ।

নাফিস এসে ড্রইং রুমে বসে আছে । ম্যাগাজিন পড়ছিল সে । কিন্তু চোখ তার জুঁইয়ের দিকে । জুঁই তখন রান্না ঘরে কাজ করছে ।  আজ যদি মন একটু বেহায়া হয়ে যায় ক্ষতি কিসে ?  বিয়ের প্রায় ২০ দিন হতে চললো , অথচ কেউই কারো কাছে ধরা দিচ্ছে না । নাহ জুঁই নিজে আসছে নাহ নাফিস যাচ্ছে । পর মুহুর্তেই নাফিসের গতকাল আওন্ধ্যার কথা মনে পড়ে যায় । জুঁই কাজের ফাঁকে ওড়না খুলে পাশে রাখে । নাফিসের নজর বার বার জুঁইয়ের দিকে যাচ্ছে । কিন্তু লজ্জায় যেতেও পারছে না । 

অন্যদিকে জুঁইয়ের মনটাও খচ খচ করছে । বাসায় কেউই নেই তারা দুজন বাদে । শাম্মি অনেকবার বলেছিল তাকে যেতে , সবার সাথে গেলেই পারতো সে । কিন্তু নাফিসের জন্যেই তার যাওয়া হয় নি । নাফিস একা হয়ে যাবে পুরো বাসায় তাই থেকে যায় সে । কিন্তু এখন যেন কেমন লাগছে তার নিজের কাছে । রান্নাঘর থেকে আড় চোখে নাফিসকে খেয়াল করে জুঁই । তখনই দেখতে পায় নাফিস তাকে পর্যবেক্ষণ করছে । নাফিসের পর্যবেক্ষণ তাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে বার বার । 

এশার নামাজের আজানের পর জুঁই ফ্রেশ হয়ে নেয় । নাফিস তখন অফিসের কাজ করছিল রুমে বসে । জুঁই নামাজ পড়ে উঠে দাঁড়াতেই নাফিস জুঁইকে ডাকে । 

- জুঁই,,,,,,,?
- হু বলো , 
- এই ফাইলটা চেক দেও তো । 
- দেও । 

লাইফ পার্টনারের পাশাপাশি তারা কলিগও বটে । অফিসের টুকটাক কাজ বাসাতে নিয়ে আসে । দুজন মিলে সময় বের করে কাজ গুলোও মিটিয়ে নেয় । 

ফাইল দেখার সময়ও নাফিস বার বার জুঁইকে দেখছিল । জুঁইয়ের ঠোঁট গুলো দেখছিল । জুঁইয়ের শরীরের পুরো পা থেকে মাথার চুল অবদি পর্যবেক্ষণ করছে নাফিস । 

রাতের খাবার শেষে নাফিস বারান্দায় সিগারেট টানতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । জুঁই রুমে এসে নাফিসকে বারান্দায় দেখে ঘড়িতে নজর দেয় । ঘড়িতে ১১ টা বেজে ২৫ বাজতেছে । এই সময়ে নাফিস বারান্দায় এটা ভেবে নিজের কাছেও সংকা লাগছে তার । ওড়নাটা গায়ের থেকে সরিয়ে রেখে বিছানায় বসে জুঁই । নাফিস কি চাইছে ?  নাফিসের মনে কি চলছে তা একটু একটু বুঝতে পারছে জুঁই । 

জুঁইয়েরও মন চায় নিজেকে নাফিসের কাছে সপে দিতে । কিন্তু লজ্জায় ঘেষতে পারে না । গতকাল সন্ধ্যায় যা হয়েছিল তা ভেবে মুচকি হাসি মুখে ফুটে উঠে জুঁইয়ের । বার বার নাফিসের দিকে তাকাচ্ছে জুঁই । আগের থেকে আরও সুন্দর হয়ে গেছে নাফিস । আগের থেকে শরীরটাও বেশ ভার দিয়েছে তার । স্বামী হিসেবে একদম পারফেক্ট একজন মানুষ সে । 

জুঁই আর থাকতে পারে নি । উঠে গিয়ে বারান্দায় নাফিসের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে । জুঁইয়ের অস্তিত্বের টের পেয়ে নাফিস মুচকি হাসি দিয়ে বলে , 

- আজ কাদম্বরী ঘুমায় না কেন ? 
- তুমি সিগারেট খাওয়া কমাতে পারো না ? 
- সিগারেট হচ্ছে নেশা । ভালো লাগে খেতে । 
- নেশ কি করে কাটানো যায় ? 
- এই নেশা কাটানোর নয় । এই নেশা কাটানোর জন্য অন্য নেশা লাগে । 
- কি নেশা সেটা ? 
- বলা যাবে না । 
- কেন ? 
- ওহে মোর কাদম্বরী তুমি কেন বুঝো না 
  নিকোটিনে পাই আমি সুখেরও সাধনা 
  নিকোটিনের জায়গা যখন ঠোঁটের মাঝে 
  নারী তুমি তখন আমার থেকে অনেক দূরে 

নাফিসের কথায় জুঁই আবারও বলে । 

- নারী যদি থাকে পাশে , 
- নারীর সংগ বড় সংগ 
  ভালোবাসায় বাধা 
  নারী যদি থাকে সাথে 
  নিকোটিন হবে সর্বনাশা 

জুঁই তখন সেইখানেই এক টানে নাফিসকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করায় । নাফিসকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ঠোঁট দিয়ে নাফিসের ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরে জুঁই । জুঁইয়ের ঠোঁটের স্পর্শে হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মুচরে অফ করে দিয়ে জুঁইয়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে । 

আজ যদি দুটো মন মিলে যায় তাহলে হয়তো কিছু পুরোনো মান অভিমান ভেঙে যাবে । আজ যদি সব কিছু এক পাশে রেখে দুটো শরীর নিজেদের ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে তাহলে হয়তো কিছু কষ্ট সুখে পরিণত হবে । হয়তো আজ প্রকৃতিও তাই চাচ্ছে । হয়তো আজ আকাশের পূর্নিমার চাঁদটাও তাই চাচ্ছে । বারান্দা থেকে রুমের দরজায় এসে জুঁইকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নেয় নাফিস । এ যেন এক অতৃপ্ত বাসনার কামনা পূরণের পূর্ব প্রস্তুতি চলছে দুজনের মাঝে ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন