১৫!!
-তোকে একটু কাছে পেলেই বেহায়া মনটা কেন আরো বেশি করে কাছে পেতে চায় বলতে পারিস ভোর? কেন সেই বাড়াবাড়ি রকমের আবেগগুলোকে আমি বেঁধে রাখতে পারি না তোর সামনে এলে বল তো? কেন তোর মাঝে নিজেকে হারাতে ইচ্ছে হয় সবসময় আমার? কেন তোকে হারিয়ে দিয়ে জিততে চায় আমার যত্ন করে লুকিয়ে রাখা ভালোবাসাগুলো বল? কেন কেন কেন? কেন তোর এতো দূরে ঠেলে দেয়ার পরও তোকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয় আমার? কেন তোর ঘুমআদুরে মুখটা দেখলে রঙিন আদরে তোর শরীরটা ভাসাতে ইচ্ছে হয় বল? এই অহেতুক ইচ্ছেগুলোকে কি বলবি তুই? শুধুই কিছু ছেলেমানুষি? নাকি ভোরের নিস্তেজ মিষ্টি রোদের মতো তোর রোদের উষ্ণ ভালোবাসা? বল তো ভোরপাখি?
রোদের এতোগুলো প্রশ্নের একটাও ভোরের কান পর্যন্ত পৌঁছলো কি না কে জানে। ভোর তখনো রোদের উষ্ণ স্পর্শে অন্য কোনো দুনিয়ার আবেগে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। ভোরের এই নিরবতায় রোদ কি বুঝলো কে জানে। একটু থেমে ভোরের ঘাড়ের কাছ থেকে কয়েক গাছি চুল সরিয়ে দিয়ে ভোরের কাঁধে ঠোঁট বুলিয়ে দিয়ে ভোরের কানের লতিতে আলতো করে কামড় বসালো রোদ। রোদের এমন নেশা ধরানো স্পর্শে এবারে ভোরের ঘোরটা কেটে গেল। ভোর একবার কেঁপে উঠে রোদের দিকে নিজেকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে নিয়ে রোদের বুকেই মুখ ডুবিয়ে নিলো। রোদ আবারও হেসে ফেললো ভোরের এমন কেঁপে ওঠায়। আর হেসেই ভোরকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে ভোরের কানে ছোট্ট করে একটু চুমো এঁকে দিলো রোদ।
-তুই তো ডাহা ফেল করলি রে ভোর! এবার কি হবে বল তো?
-হুম?
-একটাও ছবি তুলতে পেরেছিস বলে তো মনে হয় না।
-হুম? এভাবে দুষ্টুমি করলে কিভাবে ছবি তুলবো আমি বলো?
-সেসব আমার জানার দরকার নেই। তুমি হেরেছিস। এবার নিজেই ঠিক কর কি পানিশমেন্ট দেয়া যায় তোকে।
-আগে তো নিজে জিতো। তুমি কয়টা ছবি তোলো আমিও দেখবো।
-ওকে দেখ তাহলে---। দেখি ক্যামেরার দিকে তাকা---।
রোদ ভোরের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে মোবাইলের ক্যামেরার ফোকাস চেক করতে করতেই ভোর রোদের কোল থেকে একটু সরে এসে রোদের গলা জড়িয়ে ধরে রোদের মুখের বরাবর হলো। ভোর একদম রোদের মুখের বরাবর হয়ে ওর মুখের দিকেই অপলকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরেও রোদ ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিজের কাজ করছে। ছেলেটা।এক বারের জন্যও ভোরের দিকে তাকাচ্ছে না দেখে ভোরের একটু অভিমানই হলো এবারে। রোদের মুখটা এক হাতে নিজের দিকে ফিরিয়ে এবারে রোদের চোখে চোখ রাখলো ভোর। না চাইতেও রোদের চোখ জোড়া আটকে গেল ভোরের মায়াকাড়া চোখের গভীরতায়।
-এই এই? তুমি তাকাও না কেন আমার দিকে?
-তাকিয়ে কি হবে ভোরপাখি?
-অনেক কিছুই তো হতে পারে। তার জন্য তো তাকাতে হবে আমার দিকে, নাকি?
-আচ্ছা? কি কি হবে শুনি?
ভোর রোদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মিষ্টি করে হেসে রোদের চোখের আরো গভীরে তাকালো। সেই তপ্ত দৃষ্টি উপেক্ষা করার শক্তি বা ক্ষমতা কোনোটাই কি রোদের আছে? রোদের হাত ফসকে মোবাইলটা বিছানায় পড়ে যেতেই রোদ ভোরের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে ভোরকে নিজের কোলের উপরে বসিয়ে নিল। ভোরও রোদের ঠোঁটের কোণে ফুটে থাকা বাঁকা হাসিটার দিকে নজর রেখে রোদের গলা ধরে ঝুলে রইলো। না রোদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য ছটফট করছে, আর না নিজে সরে আসছে। ভোরের এমন কাজে রোদ কিছুটা অবাকই হলো এবারে। মেয়েটার মনে লি চলছে সেটা পড়তে পারছে না রোদ। আর পারছে না বলেই রোদের কেমন একটা চাপা অস্বস্তি হচ্ছে। রোদ ভোরের ঠোঁটের দুষ্টু হাসিটা বিশ্লেষণ শেষ করার আগেই ভোর একটু এগিয়ে এসে রোদের কানের কাছে মুখ নিলো।
-দেখেছ? এবারে তুমি ফেল করেছ। তো বলো তোমার পানিশমেন্ট কি হওয়া উচিত?
-হুম? কি?
ভোরের কথাটার মানে বুঝতে রোদের তেমন বেগ পেতে হলো না। মেয়েটার দুষ্টুমিটা এতোক্ষণে টের পেল রোদ। পিচ্চিটা এভাবে ওকে বোকা বানাবে সেটা রোদ হয়তো কল্পনাও করতে পারে নি। তার উপরে রোদকে চমকে দিতে পেরে ভোর এতো খুশি হয়েছে যে হাসতে হাসতে রোদের গায়েই গড়িয়ে পড়ছে। রোদ ভোরকে বিছানার সাথে জাপটে ধরে ভোরের ছোট্ট ছোট্ট হাতদুটো নিজের হাতের বাঁধনে আটকে ভোরের একদম মুখের কাছে মুখ নিয়ে এলো। ভোর এই অবস্থায়, রোদের নিচে চাপা পড়ে থেকেও হাসছে দেখে রোদ নিজেও হেসে ফেললো।
-বড্ড বেশি দুষ্টু হয়েছিস না ভোরপাখি? ভয় করছে না আমাকে আজ?
-উঁহু। তুমি দুষ্টুমি করতে পারলে আমি পারবো না কেন? আর আমাকে হারিয়ে তুমি জিতবে কি করে? আমি না জিতলে তুমিও জিতবে না। উঁহু।
-তুই জিতলেই তো আমিও জিতে যাই রে ভোরপাখিটা।
-তাহলে আমাকে তখন ছবি তুলতে দিলে না কেন? এতো দুষ্টুমি করলে কেন?
-কারণ তোকে জ্বালাতন করতে আমার ভিষণ ভালো লাগে।
-হুম। তোমাকে জ্বালাতেও আমার অন্নেক ভালো লাগে।
-হুম সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। আমি তো জ্বালানোর জন্য হলেও তোকে আদর করি, ভালোবাসি। আর তুই? তুই খালি সবসময় এতোটা কাছে এসেও আবার দূরে সরে গিয়ে আমার অন্তরের ক্ষতটা আরো বাড়িয়ে দিতেই পারিস। একটু ভালোবেসে সেটা সারাতে পারিস না শুধু।
-কি?
-এই যে এতোটা নিবিড় হয়ে কাছে এলি? আমার সাথে মিশে একাকার হয়ে গেলি। একটু ভালোবেসে দিলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যেত তোর? যদি ভালোই না বাসবি এতোটা কাছে আসিস কেন বল?
-কেউ তো ইচ্ছে করে দূরে চলে যাচ্ছে। তাহলে তাকে ভালোবাসবো কেন আমি? হুহ। বাসবো না ভালো। ছাড়ো---।
-একটা কথা বল তো ভোর? ---তোর কি সত্যিই----?
-কি সত্যিই?
-সত্যিই মেঘকে তোর পছন্দ?
রোদের প্রশ্ন শুনে আর মুখের ভঙ্গিমা দেখে ভোর বহুকষ্টে নিজের হাসি চাপলো। ভোরের চোখে চোখ রেখে রোদ আবার প্রশ্নটা করলো।
-কি রে বল না? তোর মেঘকে সত্যিই ভিষণ পছন্দ?
-কোথা থেকে পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে না? তুমি পাচ্ছো?
-কি?
-বলছি কারো কি খুব হিংসে হচ্ছে মেঘ ভাইয়াকে? আমি তো বলেছি ভাইয়াকে কালো শার্টে কিউট লাগে। যেমন এ কালো টিশার্টটায় তোমাকে এত্তোগুলো কিউট লাগছে।
ভোরের এমন কথায় রোদ হাসবে নাকি কাঁদবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না। মেয়েটা ওকে রাগানোর জন্য কথাগুলো বলেছিল তখন? নাকি হেয়ালি করে মনের কথাগুলোই বলেছিল? যে কথাগুলো রোদ এতোদিনেও বুঝতে পারে নি?
-আরে! এভাবে কি দেখছ? আমাকে তো সারাদিন ধরেই দেখছ আজ। আর কতো দেখবে?
-সত্যি করে বল ভোর। তুই কি আসলে মেঘকে পছন্দ করিস? আমাকে বল? আমি একটুও রাগ করবো না। প্রমিস।
-ধ্যাত! এই মেঘটা এলো কোথা থেকে আবার? আর এই? তুমিও এতো মেঘ মেঘ করছ কেন হ্যাঁ? আমি মেঘকে পছন্দ করলে কি তুমি ওর আর আমার বিয়ের ঘটকালি করবে? নাকি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে-----?
-ভোর?
ভোরের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই রোদ ভোরের ঠোঁটজোড়া কামড়ে ধরলো। ভোর খেপে গিয়ে কিসব বলছিলো নিজেও জানে না। তাই হুট করে রোদের এমন স্পর্শে কেঁপে উঠে চোখ বুজে নিলো। আর রোদও কিছুক্ষণ পরে সরে এসে ভোরের কপালে নিজের কপাল ঠেকালো।
-এমন কথা ভাবলেও না খুন করে ফেলবো তোকে বুঝলি? তুই শুধু আমার ভোর। আমার ভোরের আদর মাখা ঠোঁটে শুধু আমার নাম থাকবে। আর শুধুই আমার রাজত্ব চলবে আমার এই ছোট্ট ভোরটার মনে। তোর মুখে আর কারো নামও আমি সহ্য করতে পারবো না। মরে গেলেও না। আর কোনোদিন যদি এসব উল্টোপাল্টা বকেছিস তো----। তো তোকে খুন করে জেলে যাবো, ফাঁসিতে চড়বো। তবু আমার ভোরকে আমি কাউকে দিবো না। কাউকে না।
-আরে!
-আর একটা কথাও বলবি না তুই ভোর। আর একবার উল্টোপাল্টা কিছু বললে আমি এমন কিছু করে বসবো যেটা তোর হয়তো ভালো না ও লাগতে পারে। তাই দয়া করে চুপ করে থাক।
-কিন্তু----আমার মোবাইল?
-কি?
-আমার মোবাইলটা তো তোমার কাছেই রয়ে গেছে।
-ওহ! দাঁড়া বিছানাতেই কোথাও আছে। এই তো।
রোদ হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়ে ভোরকে ধরিয়ে দিয়ে চুপচাপ ভোরের বুকে মাথা রেখে শুয়ে রইলো। রোদের প্রচন্ড মন খারাপ করছে। কেন করছে রোদ নিজেও হয়তো জানে না। তার ছোট্টো পরীটার থেকে দূরে চলে যাওয়ার চিন্তায়? নাকি ছোট্টো পরীটার তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তায়? রোদের এমন চুপ করে যাওয়ায় ভোর মোবাইলটা একপাশে রেখে রোদের চুল টেনে দুষ্টুমিতে মাতলো। তাতেও রোদের কোনো রেসপন্স না পেয়ে রোদকে হালকা করে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করলো নিজের উপর থেকে।
-এই? আবার ঘুমিয়ে যাচ্ছ তুমি? একটু আগে না বললে লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে?
-ঘুমাচ্ছি না। বল কি বলবি।
-আমার গিফ্ট কই? তুমিও হেরে গেছ, আমিও। এখন তুমি আমাকে গিফ্ট দিবা।
-দুজনেই হেরে গেলে তোকে গিফ্ট দিতে হবে কেন?
-ওমা! আমি ছোট্টো না? আমাকে চকলেট গিফ্ট দিবা তো। এবারে আসার পর চকলেট দাও নি তুমি। আমি রাগ করবো কিন্তু---।
-ঠিক আছে দিবো। এখন চুপ করে থাক তো বাবা।
-না এখন এখন এখন। আমার এখনই চকলেট চাই।
-ভোর? থামবি তুই? চুপ করতে বললাম না তোকে?
-তুমি বললেই আমি চুপ করবো নাকি? ইশ! আমাকে চকলেট না দিলে আমি এখন আরো জোরে কাঁদবো----।
ভোর কিভাবে কাঁদবে সেটা অভিনয় করে দেখানোর জন্য মুখ খোলার আগেই রোদ ভোরের ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের বাঁধনে আটকে নিয়ে ছোটো করে একটা কামড় দিয়ে আবার আগের মতোই ভোরের বুকে মাথা রাখলো। মনের অযাচিত ভয়গুলো ভুলে ভোরের বুকের ঢিপঢিপ শব্দ শোনায় মন দেয়ার চেষ্টা করলো রোদ। আর ভোরও আবার তর্ক না জুড়ে রোদের চুলে গোছা নিয়ে আলগোছে খেলা করছে আর ভাবছে। তার ভাবনাগুলোর সবটাই এবার রোদকে ঘিরে।
১৬!!
-ভোর?
লম্বা একটা ঘুম ভাঙ্গার পর আড়মোড় দিয়ে জোর গলায় ভোরের নাম ধরে ডাকতে দিয়েই আবার থেমে গেল রোদ। ভোর যে বাসায় নে কথাটা বেমালুম ভুলে গেছিল সে। ভোর তো এখন স্কুলে মডেল টেস্ট দেয়ায় ব্যস্ত। কথাটা খেয়াল হতেই বিছানায় হেলান দিয়ে নিজের মোবাইল নিয়ে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করলো রোদ। একটু পরে বিরক্ত হয়ে মোবাইলটা রেখে শাওয়ারে ঢুকলো। ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে শাওয়ার করলো রোদ। সময়টা যেন আজ কাটতেই চাইছে না রোদের। অথচ গত চারটা দিন কত তাড়াতাড়ি কেটে গেল! আগের কটা দিনের মতো গতকাল রাতেও ভোর আর রোদ প্রায় রাতটা শেষ হওয়া পর্যন্ত ছাদে বসে গল্প করেছে। ভোরের কোলে মাথা রেখে ওর বকবকানি শুনতে রোদের এতো ভালো লাগছিল যে রাতটা কি করে কেটে গেছে টেরই পায়নি দুজনের কেউই। ভোরের আলো ফোটার আগে ভোরকে রুমে দিয়ে এসে নিজেও একটু ঘুমিয়ে নিয়েছে রোদ। তারপর সাড়ে এগারোটা করে ভোরকে স্কুলে দিয়ে এসেছে। গত কয়টা দিনের মতো আজও ভোরের দুটো টেস্ট। দুপুর বারোটা থেকে আড়াইটা একটা, আরেকটা তিনটা থেকে সাড়ে পাঁচটা। ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময় আজও রোদ ভোরকে আনতে পৌঁছে যাবে স্কুলের সামনেই। এদিকে এখন সবে মাত্র পাঁচটা বাজে ঘড়িতে। কেন যে সময়টা কাটছে না কে জানে?
রোদ শাওয়ার নিয়ে, চেইঞ্জ করে একদম বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হওয়ার পরেও যখন দেখলো মাত্র পাঁচটা পাঁচ বাজে ঘড়িতে তখন যথেষ্ট বিরক্তই হলো। ভোরের স্কুলে পৌঁছতে বড়জোর পাঁচ মিনিট সময় লাগবে রোদের। শেষে কি মনে হতে এখনই বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো রোদ। আজ নাহয় সে তার পাগলিটার জন্য কিছুক্ষণ আগে গিয়েই অপেক্ষা করবে। কথাটা ভেবেই নিজের রুম থেকে বেরিয়ে নিচে ড্রইংরুমে এসে ভোরের মায়ের কাছে এলো। ভোরের মা রোদকে দেখে একটু অবাকই হলেন কেন জানি। রোদ সেটা বুঝতে পারলেও কিছু জিজ্ঞেস না করে একটু জড়িয়ে ধরলো উনাকে।
-আমি বের হচ্ছি ছোটোমা।
-এখন কোথায় যাচ্ছিস রোদ? দুপুরে তো খেলিও না কিছু? কিছু খেয়ে নে আগে?
-আমি ভোরকে নিয়ে আসি। ওর সাথেই খাবো।
-ভোরকে নিয়ে আসবি মানে? ভোর না ওর বান্ধবীর বড় বোনের বিয়েতে গেছে? তোকে তো নাকি বলেছিল আগেই?
ছোটোমার মুখে কথাটা শুনেই রোদের বুকটা হঠাৎ ধ্বক করে উঠলো। ভোর তো ওকে এসব কিছুই বলে নি। কিন্তু কথাটা বললে ছোটোমা চিন্তা করবেন ভেবে রোদ দু মিনিট চিন্তা করে আবার তাকালো ছোটোমার দিকে।
-তোমাকে এ কথা কে বললো ছোটোমা? ভোর? যাওয়ার আগে বলেছে?
-না। একটু আগেই তো ওর এক বান্ধবী কল করে বললো। কি যেন নাম মেয়েটার! ওহ হ্যাঁ? আভা।
-ভোরের সাথে কথা হয়নি তোমার?
-না তো। নেটওয়ার্কে ডিস্টার্ব করছিল। মেয়েটা কথাগুলো বলতে বলতেই লাইনটা কেটে গেল। টেলিফোনে কল করেছিল তো। তাই আবার যে কল করবো সেটাও পারছি না। আর তোকে তো নাকি বলেছে---।
-হ্যাঁ? হ্যাঁ ছোটোমা।
-কি হয়েছে বলতো রোদ? ভোর কি তোকে বলে নি ও যে ওর বান্ধবীর বাসায় যাবে?
-বলেছিল ছোটোমা। আমিও তো তাই তাড়াহুড়ো করে বের হচ্ছি। আমার ওকে দিয়ে আসতে হবে। তারপর আবার ম্যাডামকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে না বলো?
-তুই সত্যি বলছিস তো রোদ?
-আরে হ্যাঁ গো মা। জামাইয়ের উপরে একটু ভরসা রাখুন শাশুড়ি মা।
-আবার তুই দুষ্টুমি শুরু করলি রোদ? এবার কিন্তু আমি ভোরের উপরে রাগ করেছি অনেক রোদ। ফিরে আসুক। অনেক বকবো ওকে আমি। তুই কিন্তু কিচ্ছু বলতে পারবি না। এভাবে হুট করে না বলে যাওয়ার কি ছিলো? তোর সাথেই যখন যাবে আমরা কি বারণ করতাম বল তো বাবা?
-আরে মা জননী? রাগ করো না প্লিজ? সামনে তো পরীক্ষা। তাই হয়তো ভেবেছে তোমরা বকা দিবে। তাই বলে নি আর কি। আর আমি তো আছি বাবা। এতো টেনশন করো না। আর আসলে আচ্ছা করে বকে দিও আমার বউকে। এখন আমি যাই? পরীক্ষা শেষ হলে কোথায় দাঁড়িয়ে থাকবে বলো?
-কিছু খেয়ে নে আগে?
-আরে না গো ছোটোমা। এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে।
-আচ্ছা। সাবধানে যা।
-হুম।
রোদ ভোরের মাকে কোনো মতে বুঝিয়ে নিজে বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসে নিজের মোবাইলটা বের করলো। নাহ! ভোর এখনো কল দেয় নি। এই মেয়ের এতো সাহস হয় কি করে না বলে বান্ধবীর বোনের বিয়েতে যাওয়ার? কথাটা ভাবতেই রোদের চোয়াল জোড়া আপনাআপনিই শক্ত হয়ে এলো। তোর বিয়েতে যাওয়ার সাধ আমি ছুটিয়েই ছাড়বো আজ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই রোদের মোবাইলের স্ক্রিনে 'ভোরপাখি' নামটা ভেসে উঠতেই রোদ কলটা রিসিভ করলো। সামনে থেকে কিছু বলার আগেই রোদ নিজেই ভোরকে ধমকে উঠলো।
-তোর এতো সাহস হয় কি করে ভোর যে তুই কাউকে কিছু না বলে কার না কার বিয়ে খেতে চলে গেলি? এতো বেশি বান্ধবী হয়েছে না তোর? তোর বান্ধবীগিরি আমি ছোটাচ্ছি দাঁড়া। আয় একবার তুই বাসায়। থাপড়ে যদি তোর গাল আমি ফাটিয়ে না দেই আজকে দেখিস। এক্ষুণি যেখানে আছিস সেখান থেকে স্কুলের সামনে আসবি তুই। নইলে আমি গিয়ে ধরে আনা লাগলে কারো সাধ্য নেই আজ তোকে আমার হাত থেকে বাঁচাবে। স্বয়ং আমার নিজেরও নেই। ভোর? কথা কানে যাচ্ছে না তোর? কথা বলছিস না কেন? কোথায় আছিস বলবি তুই?
এতোক্ষণ রাগের বশে ভোরকে ইচ্ছে মতো বকে দেয়ার পরও ভোরের কোনো রেসপন্স না পেয়ে রোদের কেমন একটা লাগলো। খুব মন দিয়ে শুনে বুঝতে পারলো গাড়ি চলার শব্দ হচ্ছে কোথাও। কিন্তু ভোর কথা বলছে না কেন? রোদ আরো কয়েকবার ভোরের নাম ধরে ডাকলো। কিন্তু আশেপাশে গাড়ির শব্দ ছাড়া আর কিছুর শব্দ হচ্ছে না দেখে রোদ কিছুটা ভয় পেল এবারে। মেয়েটার কি কিছু হয়েছে? কথাটা ভাবতে ভাবতেই কলটা ডিসকানেক্টেড হয়ে গেল। রোদ ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে ভোরের স্কুলের দিকে যেতে যেতে বেশ কয়েকবার কল করলো ভোরের নাম্বারে। কিন্তু কলটা একবারও রিসিভ করলো না মেয়েটা। রোদ শেষ একবার কল করতে করতে ভোরের স্কুলের সামনে গাড়িটা পার্ক করে গাড়ি থেকে নেমে এলো। গেইটে দারোয়ান জানালো ভোর আর আভা বেশ অনেকক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে স্কুল থেকে। রোদের হঠাৎ করেই কেমন ভয় ভয় করছে। কি মনে হতেই ছুটে গিয়ে আবার গাড়িতে গিয়ে বসলো রোদ। আভাদের বাসা রোদ চিনে। আগেও একবার ভোরকে আনতে গিয়েছিল ওদের বাসায়। স্কুলের কাছেই বাসাটা। রোদ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়ি ছুটিয়ে আভার বাসার দরজায় গিয়ে বেল বাজালো। বেশ কয়েকবার বেল বাজানোর পর দরজা খুলে বের হলো ভোরের বান্ধবী, আভা।
-ভোর কোথায়?
রোদকে দেখামাত্রই আভার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝড়া শুরু হয়েছিল। এবারে রোদের প্রশ্নে মেয়েটার গাল বেয়ে অশ্রুর বন্যা বয়ে গেল যেন। সেটা খেয়াল হতেই রোদ থমকে গেল। রোদ মেয়েটার দিকে এক পা এগিয়ে এসে আরো জোর গলায় প্রশ্ন করলো রোদ।
-আমার ভোর কোথায় মিস আভা? ও কি আপনার বাসায় এসেছে? ভোরকে বলুন আমি নিতে এসেছি ওকে।
-ভাইয়া। ভোর--। ভোরকে---।
-দেখুন কোনো বান্ধবীর বোনের বিয়ে টিয়ে নেই এটা আমি জানি। থাকলে ভোর আমাকে অবশ্যই বলতো। ওকে প্লিজ বলুন বাইরে আসতে। আর আপনি এমনভাবে কাঁদছেন কেন? আমি আপনাকে কিছুই বলছি না। প্লিজ কাঁদবেন না। আমি ভোরকে নিয়েই চলে যাবো----। আপনার ভয় পাবার কিছু নেই।
-ভাইয়া? এক--একটা লোক--একটা লোক কোথা থেকে এসে আমাদের সামনে গাড়ি থামায়। আমি আর ভোর দুজনেই কিছু বুঝতে পারছিলাম না। লোকটা ভোরকে আমার সামনে থেকেই--- তুলে নিয়ে গেছে------।
আভার কথা শেষ হওয়ার আগেই রোদের শক্ত হাতের একটা থাপ্পড় এসে পড়লো আভার গালে। হঠাৎ থাপ্পড়ে মেয়েটা টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়লো। রোদ আরো এক পা এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। মেয়েটা গালে হাত দিয়ে আবার ফোঁপাচ্ছে দেখে রোদের মাথায় রক্ত উঠে গেল।
-ইয়ার্কি করার জায়গা পান না আপনি আমার সাথে? ভোরকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে না? কার এতো সাহস আমার ভোরের গায়ে হাত দেয়ার? কার এতো বড় বুকের পাটা আমার কলিজায় হাত দিবে? খুন করে ফেলবো না আমি তাকে? দেখুন আপনাদের ছেলেমানুষি করার অনেক টপিক থাকতে পারে, কিন্তু আমি এখন ফাইজলামি করার বা এসব ইয়ার্কি হজম করার-কোনোটারই মুডে নেই। আপনি শুধু ভোরকে আমার সামনে নিয়ে আসুন। বাকি ওর কিডন্যাপিং এর কাহিনী আমিই দেখে নিচ্ছি----।
-ভাইয়া বিশ্বাস করুন। আমি সত্যি বলছি। ভোরকে লোকটা জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে। আমি কি করে আপনাকে বিশ্বাস করাই বলুন?
-তাহলে ভোরের বাসায় কেন কল করে বলেছিলেন যে ভোর কোনো বিয়ের ফাংশানে গেছে?
-আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম ভাইয়া। লোকটা বলেছে ভোরের বাসায় কথাটা জানালে ভোরকে মেরে ফেলবে। আর ওই লোকটা বলেছে------।
-ইচ্ছে করছে আপনার গালে আরো দুটো চড় লাগাই। ভোরকে তো আমি খুঁজে বের করবোই। তার পর যেন কোনোদিন ওর আশেপাশেও আপনাকে আমি না দেখি। কথাটা মাথায় রাখবেন।
-আম সরি ভাইয়া।
-আর একটা কথা জেনে রাখুন মিস আভা। আমার ভোরের যদি আজ কিছু হয় তবে আপনাকেও আমি ছাড়বো না। কিছুতেই না।
-ভাইয়া আপনি যত ইচ্ছে রাগ করুন। শুধু প্লিজ ভোরকে খুঁজে পেলে আমাকে একবার জানিয়ে দিবেন। প্লিজ?
রোদ রেগে গিয়ে আভাকে কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতেই আবার ভোরের নাম্বারটা থেকে কল আসছে দেখে রোদ কলটা রিসিভ করে নিজের গাড়ির দিকে ছুটলো। হঠাৎ কি মনে হতে আবার আভার দিকে ফিরে তাকালো রোদ।
-গাড়িটা কোনদিকে গেছে অন্তত এটুকু বলতে পারবেন দয়া করে?
-এই দিকে---।
আভা হাত বাড়িয়ে সামনের দিকে ইশারা করতেই রোদ ছুটে গিয়ে আবার গাড়িতে বসতে বসতে কানে ব্লুটুথ হেডফোনটা লাগিয়ে নিয়ে গাড়িটা স্টার্ট দিলো। অপর পাশ থেকে কিসের আওয়াজ হচ্ছে সেটা বুঝতেও পারছে না রোদ। এর মধ্যে হঠাৎ ভোরের কণ্ঠটা শুনে চমকে উঠলো রোদ।
-কে আপনি? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? গাড়ি থামান বলছি। নইলে আমি কিন্তু চিৎকার করবো।
-আর একটা টু শব্দ করলেও ঘাড়ের উপর থেকে মাথাটা একদম নামিয়ে দিবো মেয়ে। পুঁচকে একটা বাচ্চা মেয়ে এতো বকবক করে! কান ঝালাপালা করে দিলো! আর একটাও কথা বললে কথা বলার অবস্থাতেই আর থাকবে না মেয়ে। তাই চুপচাপ যেমন আছো, তেমনি পড়ে থাকো। আর কোনো ঝামেলা না বলে দিলাম। বসের কাছে নিয়ে গেলেই সবটা জানতে পারবে। ততক্ষণ চুপ করে থাকো। নইলে অন্যভাবেও চুপ করার উপায় আমার জানা আছে।
লোকটার কণ্ঠটা চেনাজানা কারো বলে মনে হলো না রোদের। তবু বুকের ভিতরে ধ্বক করে উঠলো। অপরপাশ থেকে ভোরের ফোঁপানোর শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না তেমন। শুধু গাড়ির চলার শব্দ ছাড়া। এতো ট্যাফিকের শব্দ ছাপিয়েও শুধু ভোরের বিড়বিড় করা একটা কথাই থমকে থাকা রোদের কানে এসে পৌঁছালো।
-রোদ আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে।