আড়ালে আবডালে - পর্ব ১৮ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


রিং হতে হতে ফোনটা কেটে যায়। এরকম একবার, দু'বার, তিনবার হয়। নিহি ফোন রিসিভ করে না। শুধু চুপচাপ ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। আর ভাবতে থাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমানের থেকে দূরে যেতে হবে। তিনবারের পর আর ফোন আসেনি ঐ নাম্বার থেকে। আছরের নামাজ মসজিদ থেকে পড়ে বাড়িতে ফিরে আমান। আমানকে দেখে নিহি বলে,
"কল এসেছিল।"
"কার?"
"আপনার।"
"কী বলল?"
"রিসিভ করিনি আমি।"
"কেন? রিসিভ করতেন।"
"কারো পার্সোনাল কল আমি রিসিভ করি না।"
"পার্সোনাল কল? কী করে বুঝলেন?" ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে আমান।
"জান দিয়ে নাম সেভ করা যখন, তখন অবশ্যই পার্সোনাল কলই হবে?"

আমান হাসে। বলে,
"মানুষটা স্পেশাল। তবে পার্সোনাল না। ওয়েট।"
বালিশের পাশ থেকে ফোন নিয়ে আমান নাম্বারটিতে কল ব্যাক করে। রিং হচ্ছে। আমান লাউডস্পিকারে দেয়। নিহি চলে যাওয়া ধরলে আমান নিহিকে আটকে দিয়ে বলে,
"শুনে যান।"
যাওয়ার রাস্তা আমান বন্ধ করে রেখেছে। তাই বাধ্য হয়ে নিহি বসে থাকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হওয়ার পর আমান সালাম দেয়।
"আসসালামু আলাইকুম আম্মু।"

'আম্মু!' আম্মু ডাক শুনে নিহি আকাশ থেকে পড়ে। তার মানে যাকে নিহি গার্লফ্রেন্ড ভেবেছিল আসলে সে গার্লফ্রেন্ড নয়। মা! নিহি মনে মনে তওবা কাটে। না জেনে, আগেই ভুলভাল ভাবার জন্য। নিহির রিয়াকশন দেখে আমান হেসে ফেলে। ঐ পাশ থেকে সালামের উত্তর নিয়ে আমানের মা বলেন,
"কেমন আছো? ফোন ধরোনি কেন? মায়ের যে কত টেনশন হয় বোঝো না?"
"স্যরি আম্মু। আমি নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম।"

নিহির যা শোনার তা শোনা হয়ে গেছে। তাই আমানকে সরিয়ে নিহি বাইরে চলে আসে। উল্টা-পাল্টা ভাবার জন্য নিজেই নিজেকে বিড়বিড় করে গালি দেয়। আবুল খেয়াল করে বলে,
"আপামুনি মনে মনে কী কন?"
"কিছু বলি না আবুল ভাই। আপনার কাজ শেষ?"
"হ। আমি এহন যামুগা। টুকটুকির লেইগা বইসা আছি।"
"একটু আগেই না দুজনে ঝগড়া করলেন?"
উত্তরে আবুল সব কয়টা দাঁত বের করে হেসে বলে,
"আমরা ঝগড়া করি আবার একটুপর মিইলা যাই। তাছাড়া আপনেরে তো কথা দিছি আর ঝগড়া করমু না।"

ওদের কথার মাঝে টুকটুকি কাজ শেষ করে চলে আসে। মাথায় কাপড় দিতে দিতে বলে,
"আপাজান যাইগা। আল্লাহ্ বাঁচায় রাখলে আবার কালকে দেখা হইব।"
নিহি হেসে বলে,
"ঠিকাছে। সাবধানে যেয়ো। আল্লাহ্ হাফেজ।"

টুকটুকি আর আবুল চলে যাওয়ার পর নিহি দরজা আটকে দেয়। পাশের রুমে গিয়ে বসে থাকে। আমান ফোনে কথা বলা শেষ করে নিহিকে ডাকে। ডাক শুনেও নিহি চুপ করে বসে থাকে। নিহি যে ইচ্ছে করেই ডাকের উত্তর নিচ্ছে না সেটা আমান বুঝতে পারে। তাই নিজেই ঘর থেকে বের হয়ে আসে। নিহি যে ঘরে বসে আছে সেই ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
"চোরের মতো লুকিয়ে আছেন কেন?"

নিহি তেলেবেগুনে ক্ষেপে গিয়ে বলে,
"লুকাব কেন? তাও আবার চোরের মতো! আমি কী চুরি করেছি?"
"কিছু চুরি করেননি। শুধু চোরের মতো হাভভাব শুরু করেছেন।"
নিহি কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হতেই আমান থামিয়ে দিয়ে বলে,
"ওয়েট। ঝগড়া কিন্তু আমি করব না। যাই হোক, কনফিউশন দূর তো?"
"কীসের কনফিউশন?"
"এইযে আমার জান কে নিয়ে।"

নিহি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
"আপনার জান আপনার মা না হয়ে গার্লফ্রেন্ড হলেও বা আমার কী? এনিওয়ে, ভুল ভাবার জন্য স্যরি।"
"এখন আমাকে কি ইট'স ওকে বলতে হবে?"
"ইচ্ছে হলে বলবেন। আর ইচ্ছে না হলে বলবেন না।" কপাল ভাঁজ করে বলে নিহি।

নিহির মুখভঙ্গি দেখে আমান হাসে। নিহি আরো বিরক্ত হয়। আমান বলে,
"ওয়েদার সুন্দর আজ। চলেন ছাদে যাই।"
নিহি চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলে,
"হোয়াট! কী বললেন? ওয়েদার সুন্দর? ছাদে যাব আপনার সাথে?"
"এগুলোই তো বললাম মনে হয়।"
"হাহ্! আপনার স্বামী স্বামী ফিলিংস আসলেও আমার বউ বউ ফিলিংস আসে না।"
কথাটা বলে নিহি খাট থেকে নামে। আমানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আমান বলে,
"এগুলো আবার কেমন ফিলিংস?"
নিহি না তাকিয়েই বলে,
"জানি না।"

আমান নিহিকে আর বিরক্ত করে না। রুমে চলে যায়। নিহি ড্রয়িংরুমে বসে বসে টিভি দেখে। মনটা একটুও ভালো লাগছে না। টিভি দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। আজান দিচ্ছে শুনে নিহি টিভি বন্ধ করে সোফাতেই বসে থাকে। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব। তিতির বিকেলে আজ কার সঙ্গে কার্টুন দেখল? ভাবির সঙ্গে গল্প করার জন্য মনটা কাঁদছে। বাবার কি রাগ কমেছে? এত প্রশ্ন মনের মধ্যে অথচ একটা ফোন দেওয়ার সাহস হচ্ছে না। আমান অজু করে এসে দেখে নিহি গালে হাত দিয়ে বসে আছে আনমনে। ভেজা হাতে গাল থেকে হাতটা সরিয়ে দেয়। হুট করে কাজটা করায় নিহি বিরক্ত নিয়ে তাকায়। কিন্তু আমান নামাজ পড়তে যাচ্ছে বিধায় কিছু বলে না। আমান জিজ্ঞেস করে,
"নামাজ-কালাম নাই? মুসলিম আপনি?"
"কেমন ধরণের প্রশ্ন এসব? অবশ্যই মুসলিম আমি।"
"তাহলে আজান দেওয়ার পরও টিভির সামনে কেন? অজু করে নামাজ পড়তে বসেন।"
নিহি চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
"রাগ দেখাতে চাই না। তাও আপনি রাগিয়ে ছাড়েন। সমস্যা কী আপনার? চোখে দেখতে পান না? কাল থেকে যে এক পোশাক পরে আছি দেখেছেন আপনি? গোসল করা হয়নি আমার। এই অবস্থায় নামাজ পড়ব কীভাবে? আপনার পাঞ্জাবি পরে?"
"ইচ্ছে থাকলে আমার পাঞ্জাবি পরেই নামাজ পড়তেন। ইচ্ছে শক্তিটাই আসল। আপনার যদি ইচ্ছে থাকত তাহলে আপনি এই ছোট কারণটাকে ইস্যু করতেন না।" শান্তভঙ্গিতে কথাগুলো বলে আমান নামাজ পড়তে চলে যায়।

মাগরিবের নামাজ পড়ে আমান মার্কেটে যায়। রেডিমেড কিছু জামা-কাপড় কিনে নিহির জন্য। তার মধ্যে সুতী শাড়িই কেনে সবচেয়ে বেশি। মোট ছয়টা শাড়ি, তিনটে থ্রি-পিছ, একটা সুয়েটার কিনে। জামা-কাপড় কেনা শেষ হলে কসমেটিক্সের দোকানে যায়। আইলাইনার, কাজল, লিপস্টিক, লোশন,মেরিল, পাউডার, শ্যাম্পু, তেল, সাবান, কন্ডিশনার আর হাতের চুড়ি কেনে। সব কেনাকাটা শেষ করে বাড়িতে ফিরে। নিজের কাছে এক্সট্রা যে চাবি ছিল ঐটা দিয়েই দরজা খুলে ভেতরে যায়। বাড়িতে নিহিকে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। শেষমেশ বেডরুমে লেপ সরাতেই দেখতে পায় নিহি গুটিসুটি হয়ে লেপের ভেতর শুয়ে আছে। একটুখানি হয়ে শুয়েছে যে বোঝাই যায়নি লেপের মধ্যে কেউ আছে। তারচেয়েও বেশি অবাক হয় নিহিকে দেখে। কারণ নিহির পরণে আমানের পাঞ্জাবি আর ট্রাউজার। আমানের প্রচুর হাসি পাচ্ছে নিহিকে দেখে। নিহি তো ঘুমে কাঁদা। আমান ডাকে।
"নিহু, এই নিহু।"
নিহি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে উত্তর নেয়,
"হু।"
"উঠুন।"
"পরে।" ঘুম জড়ানো কণ্ঠে আবার উত্তর দেয় নিহি।
আমান এবার লেপ, বালিশ সব সরিয়ে ফেলে। নিহি শীতে আরো গুটিসুটি হয়ে শোয়। আমান হাল ছাড়ে না। নিজের ঠান্ডা হাত নিহির গালের ওপর রাখতেই নিহি লাফ দিয়ে ওঠে। ঘুম তো উড়ে গেছে। কিন্তু নিহির চোখেমুখে এখন প্রচণ্ড রাগ। আমান এতক্ষণ হাসলেও নিহির রাগ দেখে থেমে যায়। ভয় পাওয়ার ভান ধরে বলে,
"আমি ভয়ে পেয়েছি।"
নিহি চোখ পিটপিট করে তাকায়। ঘুমের রেশ কাটেনি এখনো। মাথা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বলে,
"ঘুমে বিরক্ত করলে খামচি দিয়ে মেরে ফেলব।"
আমান শব্দ করে হেসে হেসে বলে,
"খামচি দিয়ে বুঝি মেরেও ফেলা যায়?"
নিহি বিরক্তস্বরে বলে,
"উফফ!"

আমান বলে,
"আচ্ছা আর বিরক্ত করছি না। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।"
"ঘুমাব।"
"হ্যাঁ, ঘুমাবেন। তার আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন। আপনার জন্য কিছু জিনিস এনেছি। দেখুন পছন্দ হয় কী-না।"
"পরে দেখব।"
"না, এখনই।"
"বিরক্ত করবেন না তো।"
"আচ্ছা করব না। তাও ফ্রেশ হয়ে আসুন।"

আমানের সঙ্গে তর্ক করতে করতেই নিহির ঘুম চলে যায়। মনে মনে আমানকে গালি-গালাজ করতে করতে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে। আমানের বডি ফিটনেস ভালো। তাই নিহির গায়ে আমানের পাঞ্জাবি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিই ঢিলে হয়েছে। আমান অনেক কষ্টে হাসিটাকে চাপিয়ে রাখছে। নিহি ফ্রেশ হয়ে আসার পর আমান জিজ্ঞেস করে,
"আমার পাঞ্জাবি পরেছেন কেন?"
"আপনি তখন কী বলেছেন মনে নেই?" অন্যদিকে তাকিয়ে বলে নিহি।

আমান মৃদু মৃদু হাসে। জিজ্ঞেস করে,
"গোসল করেছেন?"
"হু। নামাজও পড়েছি।"
"লক্ষী মেয়ে।"
নিহি কিছু বলে না। আমান প্যাকেটগুলো নিহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
"দেখুন।"
নিহি প্যাকেট থেকে সব বের করে। অবাক হয়ে বলে,
"এত শাড়ি?"
"বিয়ের পর মেয়েদের শাড়িতেই সুন্দর লাগে।"
"আপনি আবারও বিয়ে নিয়ে সিরিয়াস!"
"জীবনে বিয়ে কয়বার হয়?"
"ছাড়ুন! মেয়েদের এত কসমেটিক্স চিনেন কীভাবে?"
"চিনতে হয়।"
"আগে গার্লফ্রেন্ডের জন্য কিনেছিলেন?"
"গার্লফ্রেন্ড কোনোকালেই ছিল না। এসব কিনিওনি এর আগে। আজই প্রথম। মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে শপে যেতাম। তখন মা এসব কিনত আর বলত, 'চিনে রাখ। বিয়ের পর বউকে কিনে দিতে হবে তো!' সেই থেকেই মাথায় গেঁথে রয়েছে।"
"ওহ। আপনার মা জানে?"
"কী?"
"আমার কথা।"
"এখনো না। আগে আপনার মা কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটা শুনি। তারপর জানাব।"
"যদি আপনার ফ্যামিলি আমায় মেনে না নেয়?"
"হোয়াটএভার! আমি একজন প্রতিষ্ঠিত ছেলে। পরিবারের ওপর ডিপেন্ডেন্ট নই আমি। নিজের বউকে নিজের উপার্জনে খাওয়ানোর এভিলিটি আমার আছে।"
"ভালো।"
"হুম। আপনি পোশাক পাল্টে নিন। আমি অন্য রুমে যাচ্ছি।"
________________________

পরেরদিনও নিহি কলেজে আসে না। উপমা একাই যায় কলেজে। উপমাকে একা দেখে আপনা-আপনি কপালে ভাঁজ পড়ে অনলের। কালও নিহিকে ছুটির সময় দেখেনি। আজও উপমা একাই এসেছে। অনল উপমার কাছে গিয়ে জানতে চায়,
"নিহি কোথায়?"
অনল নিহির খবর জানতে চাইছে শুনে অবাক হয় উপমা। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে রাগ নিয়ে বলে,
"তা দিয়ে আপনি কী করবেন?"
অনল উপমার প্রশ্নের জবাব দেয় না। আবার জিজ্ঞেস করে,
"নিহি আসবে না আজ?"
"না, আসবে না।"
"অসুস্থ?"
"জানিনা।"
"প্লিজ বলো।"
"কী ব্যাপার বলুন তো? হঠাৎ ওর খবর জানার জন্য এমন উতলা হয়ে পড়েছেন কেন? নতুন কোনো রিভেঞ্জ নেওয়ার ফন্দি এঁটেছেন নাকি?"

অনল এবার নিরবে ফ্যালফ্যাল করে উপমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর কিছু না বলেই সেখান থেকে চলে যায়। বিরক্তিতে উপমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, 'যত্তসব।'
কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে পায়চারি করছে অনল। পাশেই বসে আছে সাকিব, সুমাইয়া, লিসা আর মিলন। অনেকক্ষণ যাবৎ বসে বসে অনলের অস্থরিতা দেখছে। অনল ভেবেই পাচ্ছে না এত অস্থির কেন লাগছে ওর? কার অনুপস্থিতি এত পোড়াচ্ছে। সাকিব এগিয়ে এসে বলে,
"অস্থির লাগছে দোস্ত?"
"বুঝতে পারছি না রে।"
"নিহির কথা ভাবছিস?"

সাকিবের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
"কখনোই না। বাই দ্যা ওয়ে, আমি ইরার কাছে যাচ্ছি। ওর সঙ্গে দেখা করলেই সব অস্থিরতা কেটে যাবে। বাই।"
অনল চলে যাওয়ার পর তাচ্ছিল্যভাবে হাসে সাকিব। সঙ্গে সুমাইয়াও। সুমাইয়া সাকিবের উদ্দেশ্যে বলে,
"গাধাটা এখনো বুঝতে পারছে না কার অনুপস্থিতিতে 'ও' এত অস্থির। ঠিক মানুষকে না খুঁজে ভুল মানুষের কাছে যাচ্ছে অস্থিরতা কমাতে। ছেড়ে দে। সময় হলে একাই বুঝবে সব।"


টিং টং করে বেশ কয়েকবার কলিংবেল বাজার শব্দ পেয়েছেন নিজাম ইসলাম। তমা তখন রান্না করছিল। সালেহা বেগম নিজাম ইসলামের পাশে বসে টেলিভিশন দেখছে। কলিংবেল বাজার শব্দ তিনিও শুনেছেন। কিন্তু ইচ্ছে করেই দরজা খুলে দেননি। নিজাম ইসলাম পত্রিকা পড়ছিলেন। বারবার কলিংবেলের শব্দে তার মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে। নিহির বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলেই নিজাম ইসলাম সালেহা বেগমকে এড়িয়ে চলছেন। মূলত এজন্যই এখন সালেহা বেগমও প্রতিশোধ নিচ্ছেন। সেটা নিজাম ইসলামও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন। পত্রিকার এক পাতায় চোখ বুলিয়ে আর না পেরে নিজেই দরজা খুলতে যান। দরজা খুলে দেখেন লাল সুয়েটার পরা এক বাচ্চা ছেলে। নিজাম ইসলামকে দেখে বাচ্চাটি থতমত খেয়ে যায়।
"কাকে চাও?" জিজ্ঞেস করেন নিজাম ইসলাম।
ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে অকপটে বলে,
"আঙ্কেল স্কুলে যাচ্ছিলাম আমি। খুব পানি পিপাসা পেয়েছে। একটু পানি খাওয়াবেন?"
"ওহ, আচ্ছা। ভেতরে আসো।"

নিজাম ইসলাম ছেলেটিকে ভেতরে নিয়ে আসেন। তমার উদ্দেশ্যে বলেন,
"বৌ মা এক গ্লাস পানি দিয়ে যেও তো।"
এরপর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলেন,
"তুমি বসো।"
ছেলেটি সোফায় বসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে মনে হচ্ছে। হয়তো নিহিকেই খুঁজছে। নিজাম ইসলাম আবার পত্রিকা পড়ায় মনোযোগ দেয়। তমা পানি নিয়ে আসে। ছেলেটিকে দেখে বলে,
"তুমি?"
"জি। আঙ্কেল আমার জন্যই পানি আনতে বলেছিলেন। দিন পানি দিন।"

তমা দেওয়ার আগেই পানির গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোক পানি পান করে। হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁটের ওপর লেগে থাকা পানিটুকু মুছে বলে,
"আপু দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে যান। আমি চলে যাব।"
নিজাম ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলে,
"ধন্যবাদ আঙ্কেল।"
ছেলেটার ছটফটানি দেখে তমা অবাক হয় ভীষণ। দরজার কাছে যেতেই ছেলেটি ফিসফিস করে বলে,
"আপনি নিহি আপুর ভাবি না?"
তমা কপাল কুঁচকে বলে,
"হু। তুমি কে?"
ছেলেটা ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করতে করতে বলে,
"আমার নাম বলা বারণ। এই চিঠিটা নিহি আপুকে দিয়ে দেবেন।"
"তোমার নিহি আপু এখানে থাকে না।"

ছেলেটি অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,
"তাহলে কোথায় থাকে?"
"ঠিকানা বলা যাবে না। আচ্ছা এটা বলো, এই চিঠিগুলো কে দেয়? বললে আমি তোমায় চকোলেট কিনে দেবো।"
ছেলেটি হেসে বলে,
"এই চিঠিগুলো কে দেয় তা না বলার জন্য আমি ভাইয়ার কাছে যা চাই, তাই-ই পাই। আচ্ছা, আমি তাহলে এখন থেকে আপনাকেই দেবো চিঠিগুলো। আপনি নিহি আপুকে দিয়ে দেবেন।"
এরপর এক দৌঁড়ে সিঁড়ি থেকে নামতে থাকে।
"আরে শোনো!" তমার ডাকের কোনো সাড়াশব্দ না দিয়েই চলে যায় ছেলেটি।


সকাল ১১টা

ফজরের নামাজ পড়েই ঘুমিয়েছে আমান। আর উঠেনি। অফিসেও যায়নি আজ। নিহি সঙ সেজে বসে রয়েছে। কাজ করার মতো কোনো কাজ নেই। সব কাজ আবুল আর টুকটুকি করছে। নিহি শুধু সোফায় বসে বসে ওদের কাজকর্ম দেখছে। আমান হাই তুলতে তুলতে ব্রাশ হাতে ড্রয়িংরুমে আসে। নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
"এভাবে বসে আছেন?"
নিহি বিরক্ত নিয়ে বলে,
"আপনার সমস্যাটা কী হ্যাঁ? আমি যা করি তাতেই আপনার সমস্যা?"
"সমস্যার কথা কখন বললাম?"
"ছাড়ুন। নিজের কাজে যান।"
"আপাতত কোনো কাজ নেই আমার। আমার পি.এ এসে পড়বে। সে আসলে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েন। আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি।"
আমান চলে যাওয়ার সময় নিহি বলে,
"হ্যাঁ, আপনার কামলা দেওয়ার জন্যই তো আমি এখানে বসে আছি।"
আমান ভ্রু কুঁচকে ফিরে একবার নিহির দিকে তাকায়। তারপর ব্রাশ করতে করতে ওয়াশরুমে চলে যায়। নিহি আগের মতোই আবার চুপচাপ বসে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই কলিংবেল বাজে। নিহি যাওয়ার আগেই আবুল দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। নিরব আবুলকেই জিজ্ঞেস করে,
"স্যার বাসায় আছেন?"
"হ, ঘরেই আছে।" আবুলের উত্তর।

নিরব ড্রয়িংরুমে এসে একবার নিহির দিকে তাকায়। তারপর আমানের ঘরে চলে যায়। একটা মানুষ বাড়িতে এসেছে। তাকে নাস্তা-পানি দেওয়া উচিত। আমানের ওপর রাগ করে থাকলে চলবে না। তাই নিহি কিচেনে গিয়ে নিরবের জন্য চা বানিয়ে আনে। চা রেখে আসার সময় নিরব ড্যাবড্যাব করে নিহির দিকে তাকিয়ে থাকে। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,
"আপনি কে? না মানে, আপনাকে তো এর আগে কখনো দেখিনি।"
"আমিও তো আপনাকে আগে কখনো দেখিনি।"
নিরব এবার দাঁত বের করে হাসে। হাসতে হাসতে বলে,
"আপনি ভীষণ রসিক মানুষ।"
"দাঁত না কেলিয়ে চা খান। নয়তো ঠান্ডা হয়ে যাবে।"

নিরবের দাঁত কেলানো চওড়া হাসিটা বন্ধ হয়ে যায় নিহির কথার ধরণে। কিছুক্ষণ পর আবারও দাঁত বের করে হেসে হেসে বলে,
"বললেন না তো আপনি কে?"
"আমার ম্যাম।" ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে উত্তর দেয় আমান।
নিরব মাথা চুলকে বলে,
"আপনার ম্যাম মানে স্যার? তাহলে আমার কী?"
উত্তরে নিহি বলে,
"ঘোড়ার ডিম! আমি কারো ম্যাম নই। আমি নিহি।"
"কিন্তু উনি কে স্যার?" প্রশ্ন করে নিরব।
আমান অকপটে বলে,
"আমার স্ত্রী।"

নিহি চকিতে ফিরে তাকায় আমানের দিকে। এত অকপটে স্বীকারোক্তি কেন উনার? এত সহজে কী করে সব মেনে নিলেন উনি?
.
.
.
চলবে..................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন