৪১!!
দরজার নকের শব্দে ঘুমগুম চোখে পড়িমরি করে উঠে বসলো ভোর। ঘুমের ঘোরে ও কোথায় আছে সেটা কিছু ঠাহর করতে পারলো না প্রথমে। দরজায় আবার নকের শব্দে ভোর তড়িঘড়ি করে উঠে এসে দরজা খুলে দিতে দিতে ভাবতে লাগলো রুমের দরজাটা তো খোলাই ছিল। হালকা করে ভেজিয়ে দিয়ে রোদের জন্য অপেক্ষা করছিল ভোর। রোদের চিঠিটা পড়ে রোদের গিফ্টবক্সটা পাশে রেখে ক্লান্তিতেই চোখ জোড়ায় ঘুম নেমে এসেছিল ভোরের। তাহলে দরজাটা বন্ধ করলো কে? আর এখনই বা নক করছে কে? রোদ কি ফিরলো তার অভিমানের মেঘ কাটিয়ে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দরজা খুলেই মা আর বড়আম্মুকে দেখেই মুখটা পাংশু হয়ে গেল ভোরের। ভোর মুখটা কালো করে চুপচাপ গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ছে দেখে ভোরের মা হায় হায় করেই তেড়ে এলেন। ভোর কিছুটা বিরক্ত হয়েই মায়ের দিকে তাকালো এবারে।
-কি হয়েছে মা? এতো বকবক করো কেন সারাদিন? একটু ঘুমাতে দাও তো। ঘুম পাচ্ছে আমার।
-শুনেছ ভাবি তোমার ছেলের বউয়ের কথা শুনেছ? শাশুড়িদের সামনে ঘুমের কথা বলতে লজ্জা করছে না মেয়ে? বাবা মা কি কিছুই শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠায় নি শ্বশুরবাড়িতে?
-মা? কিসব বলছো? তুমি কি ঘুমের ঘোরে কথা বলছ নাকি?
-এই মেয়ে চুপ। এখন আমি তোমার শাশুড়ি মা হই। তোমার মা আমি রিসেপশনের পরে। এখন তাড়াতাড়ি উঠো? ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে রান্নাঘরে কাজ করবে এসো। নতুন বউয়ের এতো বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার মানে কি?
-বেলা করে ওঠা মানে? সকাল হয়ে গেছে?
-নাহ মা। আটটাও বেজে গেছে। সকাল হয়নি এখনো।
-কিন্তু রোদ?
-রোদ কোথায়? রাতে কখন ফিরেছে? আর এতে সকালেই বা গেল কোথায়?
-কি জানি!
-এদের দুটোকে নিয়ে আমি পাগল হয়ে যাবো ভাবি দেখো। একজন জেদ করে বিয়ে করে এখন উধাও। আরেকজনের ঘুমই ভাঙ্গে না। এই মেয়ে? যা চেইঞ্জ করে নাস্তা করবি চল?
ভোর ফ্রেশ হতে গিয়েও পুরোটা সময় ভেবেছে রোদের কথা। ছেলেটা এতো রাগ করে আছে যে রাতে সত্যি সত্যিই বাসায় ফিরে নি? মেঘ কি ফিরেছিল রাতে? কথাটা কাউকে জিজ্ঞেস করতে হলো না ভোরের। নিচে ড্রইংরুমে আসতেই দেখলো মেঘ আর বৃষ্টি দুজনে সবার সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
ভোরকে দেখে সবাই ভোরকেও সেখানে এনে বসালো। সবাই কতো মজা করছে। শুধু রোদের কোনো খবরই যেন। ছেলেটা গেলটা কোথায়?
দুপুরবেলা রিসেপশনের কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে রোদ। আতিক আহমেদ কিছু বলার চেষ্টা করতেই রোদ 'জরুরি কাজ ছিল' বলে রুমে চলে গেছে। ততক্ষণে ভোরকে সাজিয়ে স্টেজে নিয়ে এসে বসানো হয়েছে। তাই ভোর কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। রিসেপশনের যাবতীয় ফর্মালিটি শেষ করতে করতে বিকেল হয়ে গেছে। সব গেস্টদেরকে একে একে বিদায় দিয়ে যখন ভোর নিজের রুমে এসেছে ততক্ষণে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। সারাদিন পুতুলের মতো স্টেজে বসে থাকতে থাকতে বেচারির কোমড়ে খিল ধরে গেছে মনে হয়। রুমে এসেই তাই বিছানায় সোজা হয়ে গা এলিয়ে দিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ভোর। অবশ্যই ভোরের এই শান্তিটুকু বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। পাঁচ সাত মিনিট পরেই রুমের দরজাটা খুট করে খোলার শব্দ পেয়েই ভোর পড়িমড়ি করে উঠে বসে রোদকে দেখে থতমত খেয়ে গেল। রোদও একনজর ভোরের দিকে তাকিয়ে কাবার্ড থেকে একটা পাঞ্জাবি বের করে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। ভোরও এতোক্ষণে রোদের সাথে আলাদা করে কথা বলার সুযোগটা পেয়ে হাত ছাড়া করলো না।
-সরি।
-তোর সম্ভবত টায়ার্ড লাগছে। রেস্ট কর।
-এই রোদ? শোনো না? সরি তো?
-ওকে।
-আরে? এটা কেমন কথা হলো? আমি সরি বলছি তুমি পাত্তাই দিচ্ছ না?
-বললাম তো ইটস ওকে। আর কি করবো? অদ্ভর তো!
-তুমি কাল রাতে আসো নি কেন?
-পড়ে পড়ে ঘুমালে কি করে বুঝবি এসেছিলাম কি না?
-আমি মোটেও পড়ে পড়ে ঘুমাই নি। তুমি আসোই নি।
-তাহলে আমার ভূতে এসে রুমের দরজা ভেতর থেকে লক করে গেছে না? নাকি দরজার দুটো হাত আর দুটো পা গজিয়েছে?
-তুমি সত্যি এসেছিলে? তাহলে ডাকো নি কেন আমাকে?
-আমি আসবো না শুনে খুশির ঠ্যালায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস তুই আর আমি তোকে ডেকে তুলবো? কেন রে? আমার একটুও মান সম্মান নেই?
-আমি খুশিতে ঘুমাচ্ছিলাম?
-নয়তো কি? একবারও কল করে বলেছিস তুমি আসছ না কেন? করেছিস?
-আমার মোবাইলটা তো----।
-তোর মোবাইল জাহান্নামে থাক না। এই রুমে টেলিফোন কানেকশন নেই?
-সরি তো রোদ। আমার একদম খেয়াল ছিল না। আর কখন ঘুমিয়ে গেছি টেরও পাই নি। সত্যি বলছি।
-তা বেশ তো। টায়ার্ড ছিলি ঘুমিয়ে গেছিস। ব্যাস শেষ। এখনও তো টায়ার্ড। সারাদিন রোবোটের মতো বসে ছিলি স্টেজে। এখন একটু শুয়ে থাক। আমি চেইঞ্জ করে নিয়ে বের হবো একটু।
-কোথায় যাবে আবার?
-সেটা কি তোকে বলতে হবে? সারাদিন বসে বসে তোর ঘুমানো দেখা ছাড়া আমার কি আর কোনো কাজ নেই নাকি?
-যেখানে ইচ্ছে যাও। কিন্তু আমাকেও নিয়ে যেতে হবে তাহলে।
-কি বললি? শুনতে পাই নি। আবার বল তো?
রোদ ভ্রু কুঁচকে ভোরের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করতেই ভোর বেচারি কিছুটা ভড়কে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো সাথেসাথেই।
-আমিও তোমার সঙ্গে যাবো। যেখানে যাবা আমাকে নিয়ে যেতে হবে।
-তোর জন্য একটা বক্স রেখে গিয়েছিলাম কাবার্ডে। বক্সটা খুলে দেখার পর্যন্ত সময় পেলি না, আর চাইছিস আমি তোকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবো? হাসালি ভোর। সত্যিই তোর ছেলেমানুষটা এ জীবনে যাবে না।
ভোর চুপসে মুখ নিচু করে তাকিয়ে আছে দেখে রোদ আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকলো। আর ভোরও তড়িঘড়ি করে গতরাতে পাওয়া বক্সটা খুলে দেখলো টুকটুকে লাল একটা শাড়ি। কি কেন কোত্থেকে এতো ভাবনায় না গিয়ে ভোর শাড়িটা পড়ে নিলো। আর সেটাও রোদ বেরিয়ে আসার আগেই। রোদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই ভোরকে দেখে চমকে গেল। এতো তাড়াতাড়ি মেয়েটা শাড়িটা পড়ে নিবে রোদ ভাবতেও পারে নি। একদম টুকটুকে রাঙা পরীর মতো লাগছে ভোরকে। রোদ ভোরের দিক থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলো। এই মেয়েটা বড্ড জ্বালিয়েছে রোদকে গত কয়টা দিন। একটু শাস্তি তো ভোরের পাওনা আছেই। রোদ বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে ভোর এবারে এগিয়ে এসে রোদের সামনে দাঁড়ালো।
-আমিও যাবো বললাম না?
-আয়।
শেষমেশ রোদের সাথে আসতে পেরে দারুণ আনন্দ হচ্ছে ভোরের। রোদ বাসায় বলে এসেছে আজ ওরা ফিরবে না। রোদের সাথে বের হতে পেরে কোথায় যাচ্ছে সেসব নিয়ে ভোর বিন্দুমাত্রও মাথা ঘামালো না। আর রোদ গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছে ভোরকে এভাবে নিয়ে এসে কাজটা কেমন হলো? একটু বোকা বোকা কাজ করে ফেললো না? মেয়েটাকে আরো একটু শায়েস্তা করা উচিত ছিল না? এখন তো সেই আগের মতোই কথায় কথায় ঠিকই রাগ করে কান্নাকাটি করে না খেয়ে থাকবে।
-জানো রোদ? অর্ধেক সত্য মিথ্যের চেয়েও কতোটা কষ্টদায়ক? সেদিন তুমি অর্ধেক সত্যিটা জেনে যতটা কষ্ট পেয়েছ ঠিক ততটা আমিও কষ্ট পেয়েছি তোমার আর বৃষ্টি আপুর ব্যাপারটা নিয়ে। আমার যেমন বুঝতে ভুল হয়েছিল, তেমনি তোমারও সেদিন একটা ভুল হয়েছিল রোদ।
-মানে?
-জানো কিছু মানুষ নিজের সব থাকার পরেও অন্যের খুশি দেখে হিংসেয় জ্বলেপুড়ে মরে? নিজের ভালো জিনিসটাও অন্যের সামান্য একটা জিনিসের কাছে তুচ্ছ মনে হয়। জানি না কেন এই মানুষগুলো নিজের হাজারো থাকা স্বত্ত্বেও অন্যের সুখ দেখে মনে করে তার জীবনে সুখের ছিঁটেফোঁটাও নেই। কেন এমনটা করে ওরা কে জানে? এমনই একটা অভ্যেস আছে রিদিরও। জানো ওর আর নির্বাণ ভাইয়ার অনেকদিন রিলেশন। তবু মেয়েটা অন্যের সাথেই নিজের রিলেশনের কম্পেয়ার করে সব সময়। এই যেমন ধরো, একদিন আমাদের এক কোচিং ফ্রেন্ডকে ওর বয়ফ্রেন্ড একটা টেডি গিফ্ট করেছিল। রিদি তো রেগে মেগে নির্বাণ ভাইয়ার সাথে রীতিমতো ব্রেকাপ করে ফেলার অবস্থা। অথচ ছেলেটা ওকে কতো ভালোবাসে, কত টেইক কেয়ার করে জানো? সেদিন তুমি যখন আমাকে কোচিংয়ের সামনে ড্রপ করে দিয়ে চলে গিয়ে আবার কল করলে তখন রিদিও সেখানে ছিল। আমাকে বারবার প্রশ্ন করছিল তুমি কে, কি হও আমার। আমি কি বলতাম বলো? তোমাকে ভালোবাসি বলতাম? একটা ছোট্টো মিথ্যে বলে একটা সম্পর্ককে ভেঙ্গে যেতে না দিয়ে কি খুব খারাপ কাজ করেছি? ওকে সত্যিটা বলি নি বলে কে তোমার জন্য আমার ভালোবাসাটা কমে গেছে? নাকি ওর কাছে আমাকে তোমার ভালোবাসার পরিমাপের সার্টিফিকেট নিতে হতো? বলো?
-হোয়াট?
-অথচ আমি রিদিকে তুমি আমার কাজিন বলায় তুমি এতোগুলো দিন আমার মনে রাগ করে রইলে। একবারও জানতে চাইলে না কেন বলেছি। এর চেয়ে একটা চড় মেরেই নাহয় বলতে ভালো না বাসলে মুখের উপরে বলে দে। আমিও বলে দিতাম সবটা। একটা চড় নাহয় হজম করে নিতাম। কিন্তু তুমি কি করলে? নিজের কাছ থেকে আমাকে দূর করে দিলে! তুমি সবসময় বলো না রোদ যে আমি তোমাকে ভালোবাসি না? আসলে কি জানো? তুমিই আমাকে কখনো ভালোবাসো নি। ভালোবাসলে এভাবে নিজের থেকে আলাদা করে দিতে চাইতে না। কক্খনো চাইতে না।
-ভোরপাখি?
-ভেবো না রোদ। আমি কিচ্ছু মনে করি নি। তুমি কাল যে কতো রাতে এলে, আমি টেরও পেলাম না, এই শাস্তিটাও মাথা পেতে নিলাম। ভুল তো আমিও করেছি। মানছি। তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে নিবে ভেবে ভুল করেছি আমি। কিন্তু তুমি আমাকে নিজের থেকে সরিয়ে দিতে চেয়ে আমাকে সেই ভুলটা করার জন্য প্রশ্রয় দাও নি তুমি? আমি যদি তোমাকে ভুল বুঝে অন্যায় করে থাকি, তাহলে ইচ্ছে করে সেই ভুলটা বুঝিয়ে তুমি দোষ করো নি রোদ? তুমি ভালোবাসো বলে তোমার রাগ করার অধিকার আছে, আমার কি অভিমান করাও অধিকার নেই?
-ভোর?
ভোরের কান্নাভেজা প্রত্যেকটা শব্দ রোদের বুকের ভেতরটা এতোক্ষণ ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছিলো। রোদ তবুও থেমে থাকে নি। যত দ্রুত পেরেছে গাড়ি ছুটিয়ে এসেছে ওদের বাড়িটায়। গাড়িটা থামলেও ভোর বাইরের দিকে মুখ করে কাঁদছিল নিরবে। রোদ আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে এসে ভোরকে গাড়ি থেকেই পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে সোজা রুমে নিয়ে এসে নামালো। কোথায় এসেছে বুঝতে পেরেও চুপ করে ছিল ভোর। রোদ এবারে ভোরের বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ভোরের সামনে বসে ভোরের মুখটা দুহাতে তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো।।
-ভুল তো দুজনেই করেছি ভোরপাখি। তাই সেসব নিয়ে আর না ভেবে মূহুর্তটাকে নিজেদের মতো উপভোগ করতে পারি না আমরা ভোর? সব ভুল বোঝাবুঝি ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করতে পারি না বউটা? প্লিজ?
-কি?
-এতোদিনের অপেক্ষার পর আমি আমার বউটাকে পেলাম। এবার কি আমি তাকে নিজের করে পেতে পারি ম্যাডাম? নাকি আরো কিছুক্ষণ মান অভিমান চলবে?
-জানি না।
-জোর করবো না তোকে ভোর। নাহয় আরে কিছুদিন, কিছু বছর অপেক্ষায় থাকবো। কখনো যদি তোর অভিমান ভাঙ্গে। কখনো যদি ভালোবেসে ধরা দিতে আসিস। হাহ!
-আবার কোথায় যাচ্ছো তুমি?
-আমি ছাদে আছি। যদি মনে হয় মাফ করতে পারবি তাহলে চলে আসিস। আমি অপেক্ষায় থাকবো।
-তুমি যাও। আমি আসছি।
-ওকে।
রোদ আর কিছু না বলে ছাদে চলে এসেছে। মাথার উপরে তারাভরা আকাশটা দেখতে দেখতে সময়ের হিসেব করছে রোদ। একেকটা সেকেন্ডকেও আজ রোদের একেকটা বছরের মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছে। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর পিছন থেকে চুড়ির খনখন শব্দে রোদ টের পেল ভোর এসেছে। মুখ ফিরিয়ে ভোরের দিকে তাকিয়েই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো রোদের। অবশ্য ভোরের দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু জোড়াও আপনাআপনি কুঁচকে গেল রোদের। একপা দুপা করে এগিয়ে এসে ভোরের গালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিলো রোদ। ভোর একটু কেঁপে উঠে গায়ের চাদরটা আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। রোদ ভোরের কানের নিচে হাত ডুবিয়ে ভোরের লজ্জারাঙা মুখটা তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো।
-এই গরমের দিনেও তোর গায়ে চাদর? কি রে ভোরসোনা? শরীর খারাপ করছে নাকি?
ভোরের গলায় কথাগুলো জড়িয়ে আসতে চাইছে রোদের আদরমাখা স্পর্শে। কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে রোদের বুকে মুখ লুকিয়ে নিলো ভোর। রোদ আলতো হাতে ভোরের চুলে বিলি কেটে দিয়ে ভোরের মুখটা তুলে ধরে আবার নিজের মুখের কাছে নিয়ে এলো।
-গতকালের রাতটা আমি ইচ্ছে করেই তোর কাছে আসি নি। কেন জানিস? কারণ তোর কাছে এলেই তোকে নিজের করে পাওয়ার আমার অপূ্র্ণ ইচ্ছেটাকে তো আমি কিছুতেই আটকাতে পারতাম না। চেয়েছিলাম তুই নিজে থেকে আমার কাছে ধরা দে। আর যখন ধরা দিবি তোর রোদের কাছে তখন তোর রোদ এমন কিছু করবে যাতে তুই চমকে যাস। বাড়িতে তো তোকে চমকে দেয়ার মতো ব্যবস্থা করার সু্যোগও ছিল না তেমন। তাই এখানেই আমাদের বাসর সাজিয়েছি। কেমন লেগেছে বল তো?
-হুম? এখানে? ছাদে?
-হুম। প্রথমে ভাবলাম রুমেই ব্যবস্থা করি সব। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম ভোর আর রোদ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে সেই ঘটনার সাক্ষী আকাশের ওই চাঁদ, সূর্য, তারা না থাকলে কি হয়? ভালোবাসার চাদরে এই ভোরের রোদ একে অন্যের সাথে জড়িয়ে থাকবে সেটা দেখতে দেখতে রাত পেরিয়ে ভোর হতে হবে না? তবেই না আমাদের এতোদিনের অপেক্ষাটার অবসান হবে বল?
-যাহ! কিসব বলো তুমি? আর এই? এই ছাদে ঘুমাবো নাকি আজকে? কিসব বলো?
-আরে? ঘুমাচ্ছে কে আজ রাতে? তুই তো তোর ভাগের ঘুম কালই সেরে নিলি।আর আমি? বউকে ভালোবাসায় মাতাল করে না তুলে ঘুমিয়ে রাত কাটাবো? এতোটা বোকা পেয়েছিস আমাকে?
-ধ্যাত। ছাড়ো তো। আমি রুমে গেলাম। তুমি ছাদে বসে তারাই গুনো। আমার এতো চাঁদ তারা গোনার সময় নেই।
-আরে? চাঁদ তারা গোনার সময় আপনাকে দিলে তো ম্যাডাম। আজকে তোমাকে গোনা শিখাবো কত রকম করে বউকে আদর করে জব্দ করা যায়। ওকে? লেটস স্টার্ট।
-রোদ?
ভোর কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল রোদের ঠিক পিছনের দিকে ছাদের ডেকোরেশনটার দিকে চোখ পড়তেই। এতোক্ষণ একদম অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। এবারে রোদ ছোট্ট একটা সুইচে চাপ দিতেই আলোয় ভরে গেল ছোট্ট জায়গাটা। প্যান্ডেলের মতো করে রঙিন কাপড় দিয়ে ছোটো ঘরের মতো করে বানানো হয়েছে জায়গাটায়। চারপাশে ধবধবে সাদা পর্দাগুলো ছাদের বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে নাচানাচি করছে যেন। ভোর ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ঘরটাতে ঢুকেই দেখলো বেডিং পাতা আছে ছাদের সেই ছোট্ট কুঁড়েটাতে। প্যান্ডেলের থামের গা ভর্তি ফুলের শিকল দিয়ে প্যাঁচানো। কেমন একটা রূপকথার গল্পের বাগান বিলাসের মতো লাগছে ভোরের। ভোরের মগ্ন হয়ে সাজানো ঘরটা দেখার ফাঁকেই টের পেল রোদ ভোরের গা থেকে চাদরটা সরিয়ে নিয়ে নিজেই থেমে গেছে একটু। ভোর সেটা বুঝতে পেরে বেডিংটার উপরে বসে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসলো। রোদও এতোক্ষণে বিস্ময়টা সামলে এগিয়ে এসে ভোরের কাঁধে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আলতো করে।
-আচ্ছা তাহলে ম্যাডামও আমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে পেঁচিয়ে আলগোছে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে এসেছে। আর আমি এতোক্ষণ খেয়ালও করি নি ব্যাপারটা? এটা কিছু হলো ভোর? কোথায় ভাবলাম একটু গল্প করবো। এখন তো গল্পের সময় পাবো বলে মনে হচ্ছে না।
-তুমি একটু থামবে? কিসব বলো সবসময়? তুমি কি বাঁধে না? নাকি লজ্জা শরম সব-----।
-নিজের বউকে ভালোবাসবো তাতে লজ্জার কি আছে? আর তুই মানিস আর না মানিস। আমার খুব জলদি ওদের চারজনকেই চাই।
-কাদের চারজনকে?
- ওমা! আমার সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা আর রাত। সবাইকে চাই। সো সেই ব্যবস্থাটাও এখন থেকেই করতে হবে তাই না?
-রোদ? ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।
-এখন থেকে আমার সব ভালোই ভালো হবে সুইটহার্ট।
ভোর বেডিং থেকে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতেই রোদের হাতে ধরা পড়লো। রোদও আর দেরি না করে ভোরকে নিয়ে ভালোবাসার সাগরে পাড়ি জমালো। এতোদিনের সমস্ত অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দুজন ভালোবাসার মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে অপেক্ষা করবে ভোরের প্রথম রোদের জন্য। অপেক্ষায় থাকবে আঁধার কেটে সকাল হওয়ার। এভাবেই বেঁচে থাকুক সমস্ত ভোরের রোদেরা, নিজেদের ভালোবাসায় ডুবে থাকুক অনন্তকাল।।
***(সমাপ্ত)***