১৫!!
অফিসে পা রাখতেই জুঁইয়ের চোখে পড়ে , অফিসের স্টাফরা তাকে দেখে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করা শুরু করে দিয়েছে । ওদের তাকানোর স্টাইলই বলে দিচ্ছে নিশ্চয়ই ওরা কিছু জানতে পেরেছে নয়তো কিছু বুঝতে পেরেছে । জুঁই সোজা নিজের কেবিনে গিয়ে বসে । মনে মনে তার একটাই সংকা , হঠাৎ তাকে দেখে সবার এমন রিয়েকশন কেন ।
একটু পরেই মোহি ফাইল নিয়ে রুমে আসে ।
- ম্যাডাম আসবো ?
- জ্বি আসুন ।
- ম্যাডাম এটায় সাইন লাগবে ।
- আচ্ছা ,
জুঁই সাইন করছিল আর তখন মোহি হাত কচলাচ্ছে । মোহির হাত কচলানো দেখে জুঁই বুঝে যায় সে কিছু বলতে চাচ্ছে ।
- আপনি কি কিছু বলবেন মোহি ?
- না মানে আসলে ম্যাডাম ,
- বলুন কি বলবেন ?
- না মানে সবাই বলছিল ,
- কি বলছে সবাই ?
- না মানে ম্যাডাম৷, নাফিস স্যার,,,,,,,,,,,,
তখনই জুঁই বুঝে যায় ঘটনা কোথায় গিয়ে গড়িয়েছে । সাথে সাথে জুঁই ফাইল মোহির দিকে এগিয়ে দেয় ।
- সাইন করা শেষ , নিয়ে স্যারের রুমে যেতে পারেন ।
- জ্বি ম্যাডাম ।
যাওয়ার সময় মোহি ইফসিকে আদর করে যায় । দরজার কাছে গিয়ে একবার জুঁইয়ের দিকেও তাকিয়ে যায় । মোহি মাথাতেই আনতে পারে না ঘটনার সূত্র কোথা থেকে আর অফিসে এইসব নিয়ে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করা স্টাফরাই বা এইসব কোথায় পায় । মোহির কাছে জুঁই একজন আদর্শ নারী যে কিনা একা একজন মেয়ে মানুষ হয়ে নিজে এবং তার বাচ্চাকে নিয়ে সার্ভাইব করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । সেই আদর্শ নারীর নামে এত লো ক্লাস ম্যান্টালিটির কথা একেবারেই বেমানান । তবুও মোহির কেন জানি মনে হচ্ছিলো কিছু তো আছে , কিছু তো আছে যা লুকায়িত । কারণ সব মিথ্যা হলেও চোখ মিথ্যা হয় না । আর সেদিন পার্টিতেও মোহি দেখেছিল নাফিসের সাথে জুঁইকে যেতে । তার জন্যই সব হিসেব যেন মিলেও মিলছে না তার কাছে । কথা না বাড়িয়ে সেদিনকার মত মোহি জুঁইয়ের রুম থেকে বেরিয়ে যায় ।
অন্যদিকে নাফিসও বুঝে গেছে অফিসে কিছু তো একটা চলছে । নাফিসকে দেখলেও স্টাফরা একটু আধটু আলাপ আলোচনা করে । অবশ্য তা নাফিসের অগোচরেই যা নাফিসের চোখে অনায়াসে লাগে । তবে নাফিস অনেকটা এক ঘেয়ে হয়ে গেছে । সব কিছুতেই সে ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখায় । তার কাছে সব থেকে important হচ্ছে সে নিজেই । কিন্তু নাফিস ভুলে যাচ্ছিলো যে সমাজ বলেও কিছু একটা থাকে । আর সে সেই সমাজেই বসবাস করা এক নাগরিক । যা তার কাছে সহজ মনে হয় আসলে কিন্তু তা সহজ নয় ।
লাঞ্চ আওয়ারে জুঁই ক্যানটিনে পা রাখবে তখনই তার কানে কিছু আসে । ভেতরে কয়েকজন ফিমেইল স্টাফ বলাবলি করছিল ,
- যা বলছি একদম ঠিক বলছি ।
- তুমি কি করে বুঝলে ?
- না বুঝার কি আছে , দেখো না তোমরা স্যার ইফসিকে নিয়ে কি করে । আর স্যার নাদিরা ম্যাডামের দিকে কেমন করে তাকায় ।
- হ্যাঁ তা তো দেখিই ।
এদের মাঝে আরেকজন বলে ওঠে ,
- আমি তো আরও কিছু দেখেছি ।
- কি দেখছো তুমি আবার ?
- স্যার কিন্তু ম্যাডামের বাসায় যায় ।
তখন সবাই এক সাথে বলে ওঠে ,
- কিহহহহ ,
- হ্যাঁ , স্যার ম্যাডামের বাসাতেও যায় , থাকেও ।
- তুমি জানলা কিভাবে ?
- ম্যাডামের পাশের ফ্ল্যাটেই আমার খালার বাসা । সেদিন আমি খালার বাসাতেই ছিলাম । স্যারও আসছে আর আমিও দরজা খুলছি তখনই দেখছি ।
- ম্যাডাম জানে না ওটা যে তোমার খালার বাসা ।
- নাহ , কখনো দেখাই হয় নাই ।
- ম্যাডাম কিন্তু চুপ চুপ করে থাকে অথচ তলে তলে তার কত কিছু চলে ।
- তা নয়তো কি , আর নাফিস স্যার উনিই বা কেমন । দেশে কি মেয়েদের আকাল পড়েছে নাকি , গেছে এক বাচ্চার মায়ের কাছে ।
- আরে পুরুষের নজর , কতই বা ভালো হবে আর । থাকতে পারলেই চলে । বিছানা অবদি যাবে , কাজ শেষ তো তার পরদিন বলে হু ইজ সি ?
তারপর সবাই মিলে সেখানে হেসে দেয় । তাদের মাঝে অন্যজন বলে ,
- তবে কিন্তু বুঝা যায় না যে উনি এক বাচ্চার মা । বডি ফিট আছে , দেখতে আমাদের থেকেই ইয়াং লাগে ।
- এটাই তো ওনার প্লাস পয়েন্ট ।
- মাহবুব স্যার যদি বিবাহিত না হতেন হয়তো মাহবুব স্যারও ফেসে যেতেন ।
তারপর আবারও সবাই হেসে দেয় । আর এদিকে জুঁইয়ের কলিজা ফেটে যাচ্ছে । যেই স্টাফরা তাকে দেখলে সম্মানের সহিত ম্যাডাম বলে মাথা নিচু করে থাকে আজ সেই স্টাফরাই তার অগোচরে তাকে নিয়ে নোংরা মন্তব্য করছে । পরিস্থিতি আজ কোথায় এসে ঠেকেছে । এরা যখন জানে তখন তো তাহলে পুরো অফিসই জানবে এইসব । জুঁই পারে না সেখানেই চিৎকার করে কাঁদে । তখন শুধু মন থেকে একটা কথাই বেরিয়ে আসে । আর তা হচ্ছে ,
- এইসব কিছুর জন্যে একমাত্র নাফিস দায়ি । আমার সব কিছু শেষ করে দিয়ে আমায় একা করে ফেলে গেছিলো । আবারও এসেছে ফিরে আমার সম্মানটুকু শেষ করতে ।
সেখানে আর এক মিনিটও দাঁড়ায় নি জুঁই । সোজা নাফিসের রুমে ঢুকে যায় জুঁই । চোখে তার অঝোর শ্রাবণ । যেন থামার নাম নেই তার । পাগলের মত অবস্থা , মনের মাঝে কি চলছে তা একমাত্র সেই কেবল জানে ।
নাফিস তখন ফাইল ঘাটছে । জুঁই সোজা রুমে গিয়ে নাফিসের হাত থেকে ফাইল টা ছিনিয়ে নিয়ে নিচে ফেলে দেয় । জুঁইয়ের এম্ন আচরণে অনেকটা অবাক হয়ে যায় নাফিস । কারণ আর যাই হোক জুঁই কখনো এতটা বেয়াদবি করে না । তখন নাফিস তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় । জুঁই তখন অশ্রুসিক্ত চোখে নাফিসের পানে চেয়ে আছে ।
- কি হয়েছে , এমন করলে কেন ?
জুঁই তখনও অত্যন্ত সভ্যতার সাথে তাকিয়ে আছে নাফিসের দিকে । অন্যদিকে নাফিস তার কাদম্বরীর চোখে পানি দেখে পুরাই অবাক । না চাইতেও কেন জানি বুকটা তারও ফেটে যাচ্ছে তখন ।
- কি হয়েছে জুঁই ?
- বলেছিলাম না দূরে থাকতে , বলেছিলাম না আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকতে ।
- হয়েছে কি ?
- কেন আমায় সবার সামনে ছোট করলে ? আমি তো বেশ আছি আমার যন্ত্রণা গুলোকে আঁকড়ে ধরে । বেশ তো আছি আমার মেয়েকে নিয়ে । কেন এলে নাফিস আবার । দূরে যখন চলেই গেছো ফিরে কেন এলে ।
- কেউ কিছু বলেছে ?
- দেশে কি মেয়েদের আকাল পড়েছে নাকি তুমি এক বাচ্চার মায়ের কাছেই কেন এলে নাফিস ?
- জুঁইইইইইই !!
- চিৎকার করে লাভ আছে ? সবাই এটাই বলছে । তুমি আমার বাসায় যাও এটা সবাই জানে নাফিস । সবাই ভাবছে আমি তোমার সাথে,,,,,। আমাদের মাঝে কোন অবৈধ সম্পর্ক আছে । আর কত ছোট হতে হবে আমাকে । আর কত নিচে নামাবে সবার সামনে নাফিস ?
- কে বলেছে এইসব , বলো কে বলেছে ?
- যেই বলে থাকুক না কেন ? কথাটা তো সত্যিই ।
- যে এইসব বলেছে তার জিব টেনে ছিড়ে নিবো আমি ।
- অনেক হয়েছে নাফিস , অনেক হয়েছে । আমি একা আছি , বেশ আছি । ফেলে যখন গেছিলে তখন যখন আমার ভবিষ্যত ভাবো নি এখন কেন এতটা সময় পর আমার ভবিষ্যত ভাবতে হবে তোমাকে । যখন পায়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম , তখন তো তোমার কষ্ট হয় নি । তবে আজ কেন আমার কান্নায় তোমার মন ভাঙে নাফিস ।
জুঁইয়ের কথায় আজ আর উত্তর দিতে পারে না নাফিস । আজ যে তার কোন উত্তর নেই । ঠিকই তো , আজকে জুঁই ভুল কিছু বলছে না তো ? সব তো সঠিক কথাই বলেছে সে । তাহলে আজ কেন নাফিসের ভেতরের সব কিছু গুড়িয়ে যাচ্ছে । তখন জুঁই আবারও বলে ওঠে ,
- আমার ভাগ্য এত খারাপ কেন , বলতে পারো নাফিস ? কেন এত খারাপ আমার ভাগ্য । আমি অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে ফেললাম , তারপর তোমাকে ভালোবেসেও হারাতে হলো , ভাগ্য আর বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বিয়ে করে অন্যের ঘরে গেলাম সেখানেও শান্তি মেলে নি । ফারুকটা যেমনি ছিল , আমার জীবন সাথী তো হয়েছিল তাকেও হারাতে হলো । আমার জন্যে নাকি তারা ছেলে হারিয়েছে এই অপরাধের জন্য আমাকে আর আমার ৮ মাসের বাচ্চাটাকে বের করে দেয় বাসা থেকে । জীবনের সাথে প্রতি মুহুর্তে লড়াই করতে হয়েছে আমায় । একদিকে অফিস অন্যদিকে বাচ্চা , উফফফফ কি দুঃসহ স্মৃতি সেইসব যা আজও তাড়া করে বেড়ায় আমায় । ঢাকা ট্রান্সফার হয়ে এলাম । ভাই ভাবী ধরে নিলো তাদের সংসারে আমরা মা মেয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি । নিজের বাবার বাড়ি থাকতে একই শহরে মেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকতে হচ্ছে আমাকে । আমার তাহলে শান্তি কোথায় ? অসময়ে আবার তুমি আমার শহরে পা দিলে যখন আমি আর একা নেই । এরপরেও নিজেকে বিকিয়ে দেয়নি কারো কাছে । এখন কিনা শুনতে হয় আমি খারাপ চরিত্রের নারী । তাও আবার তোমারই জন্যে , কেন নাফিস কেন ?
নাফিস তখন জুঁইয়ের সব কথা গুলো মন দিয়ে শুনে নেয় । ডেস্কের উপর দুই হাত ভর দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে নাফিস । জুঁই অনবরত কেঁদে যাচ্ছে । তখন জুঁই আবারও বলে ওঠে ,
- আমি তোমার দুটো পা ধরি নাফিস , দয়া করে দূরে থাকো । আমার আর আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকো । না হয় আমি আর আমার মেয়ে এমন কোথাও চলে যাবো যে তুমি দেখতেও পাবে না । মনে রেখো এই কথাটা ।
এই বলে জুঁই চলে যেতে নিলে নাফিস খপ করেই তার হাতটা ধরে নেয় । তারপর এক টানে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসে সে জুঁইকে ।
- কে কি বলেছে ?
-...............
- বলো , কে কি বলেছে ? আর হ্যাঁ কারো কথায় তো আমি এখন আর কিছু করবো না । বিগত তিন বছর আগে একজনের কথা শুনে বলি দিয়েছিলাম নিজের ভালোবাসাকে , বলি দিয়েছিলাম নিজের হাসি আনন্দকে । বহুত হয়েছে । আর না , এইবার যা করবো সব নিজের মত করে করবো । বলো কে কি বলেছে ।
-................
জুঁই তখনও চুপ করে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে । এমতাবস্থায় ,
- ক্যান্টিনে বসে কয়েকজন স্টাফ এইসব নিয়ে আলোচনা করেছে , সেই মুহুর্তে ম্যাডামও সেখানে গিয়ে সব টা শুনে নেয় স্যার ।
নাফিস আর জুঁই কারো কন্ঠ শুনে দরজার দিকে তাকায় । সেখানে মোহি দাঁড়িয়ে ছিল । তখন মোহি আরও কিছু কথা বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে যায় ।
- সরি স্যার , সরি ম্যাডাম আমি আপনাদের বিনা পারমিশনে আপনাদের সব কথা শুনে নিয়েছি । খুব কষ্ট হচ্ছে বিশ্বাস করুন । আর স্যার কিভাবে পারলেন এই মোমের পুতুলের মত একজন মানুষকে এইভাবে কষ্ট দিতে ?
- মোহি আপনি এখানে ?
জুঁইয়ের প্রশ্নের উত্তরে মোহি আবারও বলে ওঠে ,
- আপনি আমার কাছে আইডল ম্যাডাম । যে নারী প্রতিকূলতা ডিঙিয়েও নিজেকে আর নিজের মেয়েকে নিয়ে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত লড়াই করে যাচ্ছে সে নারী আর যাই হোক খারাপ চরিত্রের না । স্যার ওরা ক্যান্টিনে আপনাকে আর ম্যাডামকে নিয়ে বাজে বাজে কথা বলেছে । তখন ম্যাডামের পিছনে আমিও ছিলাম । ম্যাডাম এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে আমাকে খেয়ালই করেন নি । মাহবুব স্যার নেই । নয়তো আমি সরাসরি স্যারের কাছেই যেতাম । তাই ভাবলাম আপনাকে এসে বলি কিন্তু এখানে এসে আমি যা শুনলাম নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছি না । কিভাবে পারলেন স্যার এই মানুষটাকে ঠকাতে ?
- মোহি , আপনি এখন যান । কাজ করুন গিয়ে ।
এই কথা বলে জুঁইও চলে যেতে নিলে নাফিস মোহির সামনেই হাতটা আরও শক্ত করে ধরে রাখে জুঁইয়ের । তার পর পরই নাফিস মোহিকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
- মিস মোহি , জীবনের একটা ভুলই কি সব কিছু নষ্ট করে দিতে পারে ? আমি মানি আমি খুব খারাপ একটা কাজ করেছিলাম তাই বলে কি আমি তা সুধরাতে পারবো না ?
- আপনার একটা ভুল যে এই মানুষটাকে কোথায় নিয়ে দাড় করিয়েছে তা কি বুঝতে পারেন স্যার ?
- পারি বলেই এই হাতটা আর ছাড়তে চাইছি না ।
- এইভাবে কিছুই হবে না স্যার , উল্টো ম্যাডাম সবার কাছে খারাপ প্রমাণিত হচ্ছে দিন দিন । যদি সত্যিই নিজের ভুলটুকু বুঝতে পারেন তাহলে ম্যাডামকে সম্মানের সহিত নিজের করে নিন । আপন করে নিন তাকে । ইফসির মাথার উপর বাবার ছায়া হয়ে দাঁড়ান । ম্যাডামের এই ফিকে রঙ বদলে রঙিন রঙে রাঙিয়ে দিন তাকে ।
মোহির কথা শুনে আরও অবাক হয়ে যায় জুঁই । সে যেই জিনিসটা মাটি চাপা দিতে এখানে এসেছে সেই জিনিসটা মোহি আরও প্রকাশ্য করে দিতে চাইছে ।
- মোহি মাথা ঠিকাছে আপনার ? না জেনেই এইসব বলছেন আপনি
- ম্যাডাম সবটা শুনে , নিজের মত করে বুঝেই এই কথা গুলো বললাম যাতে বাহিরে যারা আপনাকে আর স্যারকে নিয়ে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছে তাদের এইসব বন্ধ হয়ে যাক ।
মোহির কথায় নাফিস জুঁইকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয় । তারপর জুঁইয়ের হাতটা আলতো করে ধরে সে । সোজা জুঁইকে নিয়ে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে । জুঁই পুরাই অবাক , তাদের পিছনে পিছনে মোহিও যায় । আজকে হয়তো কিছু একটা করে ফেলবে নাফিস ।
ক্যান্টিনে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নাফিস । নাফিসকে এইভাবে দেখে সবাই ভড়কে যায় । সাথে জুঁইকে দেখে আরও ভড়কে যায় । সেই ৪/৫ জন তখন কথা বলছিল তারাও সেখানেই ছিল । সবার নজর নাফিসের হাতের দিকে । সে জুঁইকে ধরে রেখেছে । তারপর নাফিস বলা শুরু করে ,
- এইসব গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করা বন্ধ করুন । অফিসে কেন আসেন ? নিশ্চয়ই নিজের কাজ করতে । কাজ রেখে অন্যদের নিয়ে এত মাতামাতি কিসের জন্য ? আর হ্যাঁ , ফিমেল স্টাফরা , নিজেরাও তো মেয়ে । নিজে একজন মেয়ে হয়ে অন্য একজন মেয়েকে নিয়ে এত কিসের কথা । এর বয়সে এ যা করেছে না তার ১ ভাগও কেউ করেন নি এখানে । আর হ্যাঁ , এর সাথে আমার অবৈধ সম্পর্ক নেই । খুব শীঘ্রই আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবো । আর হ্যাঁ , পৃথিবীতে মেয়েদের আকাল পড়েনি । আকাল পড়েছে এর মত মেয়ের । আর এই দুর্মূল্যের বাজারে এর মত নারীকে আমি কিভাবে আমার থেকে দূরে রাখি বলেন ? তিন বছর আগে করা ভুল টা না হয় তিন বছর পরেই ঠিক করলাম । আর হ্যাঁ , নেক্সট টাইম এই অফিসে শুধু আমাদের নিয়ে কেন অন্য কাউকে নিয়ে কেউ গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করবেন না । যে বা যারা করবেন তাকে এখান থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে আমার এক সেকেন্ডও লাগবে না । এক্ষেত্রে আপনাদের মাহবুব স্যারও কিছুই করতে পারবে না আপনাদের জন্যে । কথাটা মাথায় রাখবেন প্রত্যেকে ।
নাফিসের এমন কথায় সমস্ত স্টাফরা একদম চুপ মেরে যায় । সবার সামনে থেকে নাফিস জুঁইকে নিয়ে ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে । মোহি সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হালকা মুচকি হাসি দিয়ে বের হয়ে যায় ।
জুঁই যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে । নাফিসকে কি বলবে কিছুই মাথায় আসছে না তার । নাফিস সবার সামনে ডিক্লেয়ার করে দিয়েছে সে তাকে বিয়ে করবে । কিন্তু এটা কি আদৌ সম্ভব । নাফিস সোজা জুঁইকে নিয়ে জুঁইয়ের কেবিনে যায় । সেখানে গিয়ে জুঁইয়ের হাত ছেড়ে দেয় সে । উন্মাদের মত এপাশ ওপাশ হাটাহাটি করে । নাফিসের এমন আচরণে জুঁই চুপ করে মাথা নিচু করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে । কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করে নাফিস এসে জুঁইকে জড়িয়ে ধরে । তারপর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে ।
- এই কাদম্বরী , আমি ভালোবাসি তোমায় । তুমি বুঝেছো আমার কথা ? আমি ভালোবাসি তোমায় । অনেক ভালোবাসি । ছেড়ে দিয়েও ভালোবেসে গেছি আর এখনও ভালোবাসি । ফিরিয়ে দিও না আমায় । আমি ফিরে এসেছি তোমার কাছে । আমায় আঁকড়ে নেও তোমাতে কাদম্বরী , আমায় আঁকড়ে নেও তোমাতে ।
জুঁই আর শান্ত থাকতে পারে নি । দুই হাত দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে নাফিসের শার্ট । নাফিসের বুকের মাঝে মাথা রেখে চাপা স্বরে কেঁদে দেয় জুঁই । আজ জুঁই কাঁদকাঁদছে , অনেক কাঁদছে । তার ভালোবাসাকে সে আর আটকে রাখতে পারে নি । দুজনের এমন মিলনে ছোট ইফসিটা টুক টুক করে চেয়ে আছে । এ যেন এক অসম্পূর্ণ মিলনের সম্পূর্ণতা । এ যেন হাজারো তৃষ্ণার পর এক পরিপূর্ণতা । তখন জুঁইও বলে ওঠে ,
- আর পারলাম না , পারলাম না আমি আর । ভালোবাসি তোমাকে আমি । হ্যাঁ নাফিস ভালোবাসি তোমাকে আমি ।
জুঁইয়ের এমন কথায় জুঁইকে আরও শক্ত করে নিজের মাঝে চেপে ধরে নাফিস । আর বাচ্চা ইফসিটা মায়ের কান্না দেখে নিজের ঠোঁটটাও ফোলাতে থাকে । তার চোখেও পানি এসে জমে গেছে । হয়তো একটু পরেই ভ্যা করে কেঁদে দিবে বাচ্চাটা ।।
১৬!!
সেদিনকার মত সব মিটে যায় । নাফিস অফিস শেষে বাসায় এসে চুপ করে নিজের রুমে বসে আছে । মাথায় সাজিয়ে নিচ্ছে সব কিছু । কারণ এখন নিজেকে সব থেকে বেশি শক্ত রাখতে হবে । তার মতামতের কথা সবাইকে জানাতে হবে । আর এইবার যাতে কোন রকম বাঁধা না আসে , সেই দিকটাও তাকেই দেখতে হবে । আজ অফিসে সবার সামনে জুঁইকে নিয়ে যেসব কথা সে বলেছে , তার প্রতিটা কথা সত্যি করতে হবে । জুঁইকে এক নতুন পৃথিবী দিতে হবে । ইফসিকে বাবার ছায়া দিতে হবে । ভালোবাসার মানুষ হয়ে নিজের সবটুকু দিয়ে জুঁই আর ইফসিকে এই নির্মম পৃথিবীর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে ।
নাফিসের এইসব ভাবনার মাঝে শান্তা মানে নাফিসের ছোট বোন নাফিসের রুমে প্রবেশ করে । ভাইকে এইভাবে চিন্তিত দেখে ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসে শান্তা । পাশে বসে ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখে সে ,
- কিরে ভাইয়া ? কি হয়েছে ?
-.....................
- এই ভাইয়া কি হয়েছে ?
- একটা ডিসিশন নিয়েছি ।
- কি ডিসিশন নিয়েছিস ?
- আমি জুঁইকে বিয়ে করবো । ইফসির দায়িত্ব নিবো ।
ভাইয়ের কথা শুনে একটু ভড়কে যায় শান্তা । বিয়ে করবে তার ভাই তাও আবার জুঁইকে তাও আবার বাচ্চা সমেত । শান্তা একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভাইয়ের কথা শুনে নিজের মতামত পোষণ করে ।
- তোর জীবন , তুই যেভাবে গুছিয়ে নিবে তাতে অন্তত আমাকে আপুকে আর বাবাকে তোর পাশে পাবি । জুঁই আপুকে যদি বিয়েও করিস , তাতেও আমাদের আপত্তি নেই তবে সমস্যা তো অন্য জায়গায় ।
- মা , তাই তো ?
ভাইয়ের কথায় মাথা নিচু করে রাখে সে । নাফিস আবারও বলা শুরু করে ।
- তিন বছর আগে আমি কিছু করতাম না বলে মায়ের কথার নিচে পড়ে নিজেকে এক প্রকার কবর দিয়ে দিয়েছিলাম । একটা নিষ্পাপ মেয়েকে বিনা অপরাধে শাস্তি দিয়েছি অনেক । আর না , টাকা-ই যদি মায়ের কাছে সব হয় তাহলে আমি বর্তমানে এই সংসারে সবার খাওয়া পরার দায়িত্ব নিয়েছি । সেক্ষেত্রে আমার কথাই তাকে শুনতে হবে ।
- তুই যদি স্ট্রং থাকিস তাহলে মনে হয় না মা জোর খাটাতে পারবে ।
- হ্যাঁ ,
- এক কাজ করি আমি আপুর সাথে কথা বলে রাখবো , কাল বিকেলে আমরা জুঁই আপুর বাসায় যাবো ।
- নাহ থাক , বাসায় যেতে হবে না ।
- এই তোর হবু বউকে আমরা তুলতে যাবো না , বুঝলি । ইফসিটা তো অনেক কিউটরে ভাইয়া ।
- হ্যাঁ , একদম জুঁই । পুরো জুঁইয়ের ডুপ্লিকেট ।
- হা হা ,
- ঝুঁটি করলে যা সুন্দর লাগে না মেয়েটাকে । আমাকে পেলে সে তার মাকেও ভুলে যায় ।
- তাই ?
- হু ,
- ঠিকাছে , আমরা কাল আপুর বাসায় যাবো , আর হ্যাঁ কাল রাতেই তুই কথা তুলবি , আপু আর ভাইয়াকেও বলবো থাকতে ।
- দেখি ,
- দেখি না । বলবি , সবাই থাকলে মা আর বেশি তার জোর খাটাতে পারবে না ।
দুই ভাই বোন যুক্তি করে সব ঠিকঠাক করে আরেক বোনকেও সব জানিয়ে দেয় । নাফিসের পরিবারে সবাই এক পাশে শুধু নাফিসের মা-ই আলাদা একা এক পাশে । আর এটাই তাদের ভয়ের কারণ ।
পরদিন বিকেলে ডোরবেলের আওয়াজ পেয়ে জুঁই গিয়ে দরজা খুলে । দরজায় নাফিসকে দেখে হাল্কা হাসি দেয় সে । এ সময় নাফিস আসবে ভাবে নি সে । দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই নাফিস জুঁইকে বলে ,
- ঘুমাচ্ছিলে নাকি ?
- হ্যাঁ , একটু শুয়েছিলাম । উঠে নামাজ পড়লাম ।
- বুড়ি টা কোথায় ?
- মুড অফ , ঘুম থেকে উঠছে তার জন্যে । ভেতরে আসবে না ?
- মেহমান আসছে তো !
- কে আসছে ?
- এই যে এনারা এসেছেন ।
বলে পিছনে হাত দিয়ে দেখায় নাফিস । নাফিস সরে গেলে জুঁই নাফিসের দুই বোন শান্তা আর শাম্মিকে দেখতে পায় । শান্তা আর শাম্মিকে দেখে জুঁই পুরাই থ হয়ে যায় । আর ওরা দুজনও এত বছর পরে জুঁইকে এইভাবে দেখে অবাক হয়ে যায় । শান্তা দৌড়ে এসে জুঁইকে জড়িয়ে ধরে । জুঁইয়ের গালে একটা চুমু খায় শান্তা ।
- আপু তুমি কেমন আছো গো ?
জুঁই জবাব দিবে কি ? সে তো পুরাই থ । পিছন থেকে শাম্মিও এসে জড়িয়ে নেয় জুঁইকে । শাম্মিও বলে ওঠে ,
- কেমন আছো কাদম্বরী ?
শাম্মি জুঁইকে কাদম্বরী বলে ডাকতো । তার ভাই ডাকতো আর জুঁইও দেখতে এতটাই মিষ্টি যে , যে কেউই তাকে আদর করতো । জুঁই হালকা করে সবার চোখের আড়ালে আড় চোখে নাফিসের দিকে তাকায় । আর নাফিসও মুচকি হেসে চোখ মেরে দেয় জুঁইকে । তারপর ওরা দুজন এক সাথে বলে ওঠে ,
- কি গো বলো না কেমন আছো ?
- হে , ওহ । হ্যাঁ ভালো আছি । তোমরা কেমন আছো গো ?
- আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আমরা । এখন থেকে হয়তো আরও ভালো থাকবো ।
- ভেতরে আসো ।
জুঁই ওদের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায় । শান্তা আর শাম্মি বেশ হেসে হেসে ভেতরে ঢুকে যায় । তখন শাম্মি বলে ওঠে ,
- আপু তোমার মেয়ে কইগো ?
শাম্মির মুখ থেকে এই কথা শুনে একটু বিচলিত হয়ে জুঁই নাফিসের দিকে তাকায় । নাফিস তখন চোখের ইশারায় জুঁইকে বুঝায় সবটা । জুঁই তখন নিজের চোখ জোড়া শান্ত করে বন্ধ করে ফেলে ।
- ইফসি কই আপু ?
শান্তার কথায় জুঁই উত্তর দেয় ,
- ওই রুমে , বসে আছে ।
- আমরা যাই তাহলে ?
- যাও ।
শান্তা আর শাম্মি ওই রুমে যায় ইফসিকে দেখতে । আর এই ফাঁকে জুঁই নাফিসকে বলে ওঠে ,
- ওরা কি সবটা জানে নাফিস ?
- শান্তা আগে থেকেই জানতো আর গতকাল রাতে শাম্মি জেনেছে ।
- নাফিস , যা হচ্ছে তা কি ঠিক হচ্ছে ?
জুঁইয়ের এমন কথায় নাফিস জুঁইয়ের কাছে এসে জুঁইকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় । আলতো করে জুঁইয়ের ঘাড়ের চুলের মাঝে নিজের মুখ ডোবায় । তখন বলে ,
- যা হচ্ছে একদম ঠিক হচ্ছে । ভালো যখন বাসি তাহলে প্রকাশ করতে ক্ষতি কোথায় ।
- কিন্তু নাফিস আমি যে ,,,,,,,,,,,,,
তখন নাফিস তার হাত দিয়ে জুঁইয়ের ঠোঁট জোড়ায় বাঁধা দেয় ,
- আর কিছু বলো না প্লিজ । তুমি কি , তুমি কেমন আমি সব জানি । দয়া করে এইসব আর বলো না । প্লিজ
- আমার ভয় হয় নাফিস । সুখের দিন গুলো স্থায়ী হবে তো ?
- ইনশাআল্লাহ হবে ।
- আমার কপালে তো সুখ সয় না নাফিস ।
- এইবার থেকে সইবে , দেখে নিও ।
শান্তা আর শাম্মি তখন রুমে ইফসিকে ইচ্ছামত চটকাচ্ছে । যেন মনে হচ্ছে এটা তাদের ভাইয়ের আপন সন্তান । আর ইফসিকে কোলে তুলে নিয়ে ওরা দুজন নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে ।
- এই শান্তা এটা এত কিউট কেন রে ?
- একদম জুঁই আপুর মত না ?
- হ্যাঁ , একদম ।
- ইশশ , মাশা-আল্লাহ , এই বুড়ি ফুপি ডাকো তো আমাদের ।
- হ্যাঁ , এই ফুপি ডাকো তো মা ।
শান্তা আর শাম্মি ইফসিকে দিয়ে ফুপি বলানোর চেষ্টা করতে ব্যস্ত৷। কিন্তু ইফসি বুড়ি যে মুখে খিল দিয়েছে তো দিয়েছেই । সে এক্কেবারে চুপ হয়ে আছে । কিচ্ছু বলে না সে । শান্তা ওর গালে ঠোঁটে চুমা দেয় । শাম্মি ওর ঝুঁটিতে চুমা দেয় । আর ইফসি বুড়ি চুপ করে ওদের আদর খাচ্ছে কিন্তু কথা বলে না ।
- এই আপু ,
- হু ,
- বাবা ওরে দেখলে কি যে করবে , আল্লাহ জানে ।
- হ্যাঁ , এটা এত কিউট মাশা-আল্লাহ আমার তো মনে হচ্ছে এখনি খেয়ে ফেলি ।
এমন সময় জুঁই আর নাফিস রুমে পা রাখে । পেছন থেকে তারা দুজনেই শান্তা আর শাম্মির কার্যকলাপ দেখছে । নাফিস এগিয়ে গিয়ে ওদের কাছ থেকে ইফসিকে নিজের কোলে তুলে নেয় । নাফিসকে দেখে ইফসি ভুবন মাতানো হাসি দেয় । নাফিসের গলা জড়িয়ে ধরে ইফসি । এটা দেখে শান্তা আর শাম্মি অবাক । ওরা বলে ,
- দেখেছো , কি পঁচা মেয়ে । আমাদের সাথে একটু হাসলোও না আর এখন পাপার কোলে গিয়ে কি হাসি
ওদের মুখ থেকে পাপা কথাটা শুনে জুঁইয়ের বুকে ধক করে একটা ধাক্কা দেয় । ওরা যে এতটা আপন করে নিবে ইফসিকে এটা জুঁই এখনও ভাবতেই পারে নি । ওদের কথা শুনে নাফিস জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে হাল্কা হেসে দেয় । তার এই হাসি যেন বলে দিচ্ছিলো " জুঁই দেখেছো তো সব ঠিক হচ্ছে " , " জুঁই বলেছিলাম না সব ভুলিয়ে দিবো " , " জুঁই আমি পারবো তুমি দেখো , আমি পারবো " ।
তারপর নাফিস ইফসিকে অনেক আদর করে দেয় আর বলে ,
- পাপা ডাকো তো মা , ডাকো তো পাপা ।
ইফসিও অনায়াসে পাপা বলে ডেকে উঠে । বাচ্চাটা পাপার মানে বুঝার আগেই তার পাপা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় না ফেরার দেশে । আর যতটুকু ছিল ততটুকু ইফসিকে ততটা খেয়ালই করেনি ফারুক ।
এদিকে ইফসির মুখে পাপা শুনে নাফিস কেন জানি ইফসিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রাখে । নাফিসের চোখের কোণে পানি জমে যায় । নাফিস আবারও বলে ,
- আবার বলো তো মা , বলো তো পাপা । বলো মা পাপা বলো ।
ইফসি আবারও পাপা বলে ওঠে । তখন ওরা হেসে দেয় । এরপর নাফিস ইফসিকে বলে ,
- মা , ফুপি বলো । এইযে এরা ফুপি । ডাকো তো মা , ফুপি বলে ডাকো ।
ইফসি কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মায়ের দিকে তাকায় । তখন জুঁই এগিয়ে এসে ইফসিকে কোলে তুলে নেয় ।
- আম্মুন , ডাকো তো একটু । ফুপি বলে ডেকে দেও তো ।
মায়ের কথায় ঠোঁট ফুলিয়ে " পুপি " বলে ডেকে উঠে ইফসি । ইফসির মুখ থেকে শব্দটা বের হবার সাথে সাথে শান্তা ইফসিকে কোলে তুলে নেয় আর অজস্র চুমায় ভরিয়ে দেয় ইফসির ছোট ছোট গাল গুলো । শাম্মিও আদর করে দেয় । এ যেন এক ভালোবাসার পরিবার হতে দেখা যাচ্ছে যা ভবিষ্যতে জুঁইয়ের সময় পরিবর্তন করতে ছুটে চলছে ।
সেদিন রাতে সবাইকে নিয়ে ড্রইং রুমে বসে নাফিস । এদিকে শান্তা শাম্মি আর শাম্মির স্বামী এরা জানে সবটা । এখন শুধু নাফিসের বাবা মাকে জানানোর পালা । নাফিসের মা আর বাবা পাশাপাশি বসে আছে । আরেক সোফায় ওরা তিন জন বসা । আর সিংগেল সোফায় নাফিস বসা । তখন নাফিসের মা বলে ওঠে ,
- তুই কি কিছু বলবি ?
মায়ের কথায় মাথা তুলে তাকায় নাফিস । তারপর মাথা নাড়িয়ে মুখ দিয়ে বলে ,
- হ্যাঁ ,
- ওহ , বল কি বলবি ।
- বাবা , আমি ঠিক করেছি আমি বিয়ে করবো ।
আনিস বেপারি আর রেহানা বেগম এক সাথে বলে ওঠে ,
- আলহামদুলিল্লাহ ভালো তো ।
তখন নাফিসের মা রেহানা পারভিন বলে ওঠে ,
- আমি কালই তোর খালার সাথে কথা বলবো , সব ঠিক করে ফেলবো ।
এই কথা শুনে আনিস বেপারির মুখে কালো মেঘ ভর করে । কারণ তিনি রেহানা পারভিন এর বাপের বাড়ির দিকে কখনোই সম্মতি পোষণ করেন নি । তখন নাফিস আবার বলে ওঠে ,
- আমার কথা শেষ হোক , তারপর বলো মা ?
- আচ্ছা বল কি বলবি ?
- বিয়ে করবো বলেছি , খালার মেয়েকে করবো বলি নি ।
- তাহলে কাকে করবি ? পছন্দ আছে নাকি ?
তখন নাফিস দৃঢ় কন্ঠে বলে ,
- আমি জুঁইকে বিয়ে করবো । আর এটাই আমার শেষ কথা ।
জুঁইয়ের নাম শুনে রেহানা পারভিন যেন আকাশ থেকে পড়ে । ছেলে এটা কি বলে ? তখন তিনি সাথে সাথে বলে ওঠে ,
- এত বছর পরে জুঁই এলো কই থেকে ?
- যেখান থেকেই আসুক , ও-কেই বিয়ে করবো আমি ।
- শুনছিলাম তো বিয়ে হয়েছে ওই মেয়ের ।
- হ্যাঁ , একটা বাচ্চাও আছে । স্বামী মারা গেছে ।
- কিহহ , তুই শেষে কিনা এক বাচ্চার মাকে বিয়ে করবি ।
তখনই আনিস সাহেব বলে ওঠে ,
- জুঁই আর নাফিস তখন বিয়ে করলেও তো ওদের একটা বাচ্চা থাকতো ।
- তুমি চুপ থাকো , খবর দার কথা বলবা না । নাফিস এইসব বাদ দে । ওই বিবাহিত এক বাচ্চার মাকে বিয়ে করবে আমার ছেলে কখনো না ।
তখন শান্তা বলে ,
- তোমার সমস্যা কি মা ? ভাইয়ার জীবন ভাইয়া যা পারে করবে । তোমার তো সমস্যা হওয়ার কথা না ।
- হ্যাঁ মা , এটা তো ঠিকই এটা ভাইয়ার জীবন , ভাইয়া যা ভালো বুঝবে করবে ।
রেহানা পারভিন দুই মেয়েকেই ধমক দিয়ে উঠেন ,
- একদম চুপ , কি বুঝিস তোরা এইসবের । হ্যাঁ , কি বুঝিস ? একদম চুপ ।
- মা , শুনো । ভুলে যেও না তোমার জন্যেই কিন্তু এইসব হয়েছিল । এখন ভাইয়া যা চায় তাই হোক । আমাদের আপত্তি নেই এতে ।
তখন আনিস বেপারিও বলে ওঠে ,
- হ্যাঁ , আমারও আপত্তি নেই ।
তখন নাফিস অত্যন্ত ভদ্রতার সহিত তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
- মা মনে পড়ে , তিন বছর আগে এমন এক রাতের বেলায় তোমাদের নিয়ে বসেছিলাম । আমার মুখ থেকে কথাটা বের হওয়া মাত্রই তুমি মা কি করেছিলে ? তখন নির্বোধ ছিলাম , আয় রোজগার ছিল না । আমার উপর আমার বোনদের দায়িত্ব এই সেই বলে নিজেকে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দিছো । তোমার ভাবনাকে সম্মান দিয়ে নিজের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে দিছি । তোমার ইচ্ছাতে সম্মতি পোষণ করে একটা নিষ্পাপ মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়েছি । তবে মা এখনকার আর তখনকার সময়ের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ । ভুলে যেও না আমি তোমারই ছেলে । তুমি যতটা দূর আগাবে আমিও ততটা দূর আগাতে পারি বরং তার চাইতে বেশি পারি । তাই বলছি , আমায় রাগিয়ে দিও না । এই পুরো সংসারটা আমার টাকায় চলে । এইযে কাপড় পরে মানুষকে দেখাও তাও আমার টাকায় ।
- নাফিসসস ,
- বাস্তব কথা বললাম । খোটা দেই নি । তোমরা আমার মা বাবা । তোমরা হাজার পাবে আমার কাছে এটা সত্যি । তবে আমি আমার জীবনে সবটা হারাতে পারবো না মা । বিয়ে জুঁইকেই করবো , এটাই ফাইনাল ।
নাফিস এই কথা বলে সবার সামনে থেকে উঠে চলে যায় । আর রেহানা পারভিন যেন এই মুহুর্তে বিষ খেয়ে বিষ হজম করছেন ।
অফিসে সবাই এখন নাফিস আর জুঁইকে দেখলে মাথা নিচু করে থাকে । হয়তো লজ্জা নয়তো রাগ । তবে নাফিস এইসবের কিছুই তোয়াক্কা করে না । যে পুরুষ নিজের মাকেই তোয়াক্কা করে নি সে আর অন্যদের কি তোয়াক্কা করবে । নাফিসের এমন ডিসিশনে মাহবুব স্যার , মোহি এমনকি নাফিসের পরিবারের সবাই শুধু তার মা ছাড়া সবাই রাজি ।
অন্যদিকে , জুঁই তার মাকে সবটা জানিয়েছে । সে অন্তত এতটুকু জানে যে তার মায়ের কাছ থেকে সে সর্বদিক থেকে সাপোর্ট পাবে । তাই ভাই আর ভাবীকে না জানিয়ে আগে মাকে জানিয়েছে । সেদিন সন্ধ্যায় জুঁইয়ের মা জুঁইয়ের বাসায় আসে । তখন মাকে খোলসা করে সবটাই জানায় সে ।
- তুই কি রাজি আছিস মা ?
- বার বার ফিরিয়ে দিয়েছি মা , বিশ্বাস করো । অনেক বার ফিরিয়ে দিয়েছিলাম । পরে দেখলাম মানুষটাকে আর আমার এই হতভাগ্য জীবনটাকে আরেকটা সুযোগ দিয়েই দেখি না । অন্তত ইফসিটা তো বাবার ছায়া পাবে ।
- হ্যাঁ রে মা , মানুষ একা বাঁচতে পারে না । একজন পুরুষ লাগেই জীবনে । আমি তো ভেবেই পাই নি যে নাফিস এতদিন পর এইভাবে তোকে আপন করে নিবে ।
- হ্যাঁ মা । সে একটুও বদলায় নি মা ।
- আল্লাহ পাক যেনো এইবার তোর ভাগ্যে ভালো কিছু রাখে রে মা । আমি যাতে মরার আগে দেখে যেতে পারি ।
- এইসব বলো না মা । তুমি ভালো থাকো এটাই অনেক আমার জন্যে ।
- নাফিসকে একবার আসতে বল , দেখি ও-কে ।
- ও তো মনে হয় বাসায় মা ।
- তাহলে থাক ।
হঠাৎ করেই জুঁইয়ের কিছু মনে পড়ে যায় । আর জুঁই বারান্দায় চলে যায় । মেয়ের এমন ভাবে উঠে জানালার কাছে যাওয়া দেখে জুঁইয়ের মা অবাক হয়ে যায় । উঠে মেয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় ।
- কিরে মা , এইদিকে চলে এলি যে ।
- বেনারসি পরে নিজের ভালোবাসাকে মাটি চাপা দিয়ে বউ বেশে ফারুকের ঘরে গিয়েছিলাম মা । কিন্তু আল্লাহ পাক কি খেলাই টা না খেলে দিলেন আমার সাথে । আল্লাহ পাক আমার ভাগ্যটাকে কি দিয়ে গড়েছে আমি আজও বুঝলাম না মা ।
- কাঁদিস না মা , আর কাঁদিস না । আল্লাহ পাক তোকে তো কম কাঁদায় নি হয়তো সামনে তোর অনেক সুখ আছে ।
- আমার তো আবার সুখে এলার্জি মা , দেখো না কোন সুখই কপালে সয় না ।
- আয় খেতে আয় ।
এই বলে জুঁইয়ের মা ইফসিকে কোলে নিয়ে সামনের রুমে যায় । আর জুঁই চাপা স্বরে কেঁদে দেয় । এমন অবস্থাতেই নাফিসের ফোন এসে জুঁইয়ের মোবাইলে । নাফিসের ফোন পেয়ে নিজেকে শান্ত করে গলা ঠিক করে ফোনে হাত দেয় জুঁই ।
- হ্যালো আসসালামু আলাইকুম !
- ওয়ালাইকুম আসসালাম , কাঁদছো কেন ?
- কই না তো ,
- কই কি আবার , কাঁদছিলে তুমি । কন্ঠই বলে দিচ্ছে ।
- এমন কিছুই না ।
- আমি আমার কাদম্বরীর নিঃশ্বাসটাও চিনি ।
- বাদ দাও , কি করো ?
- কি করি ?
- হু কি করো ?
- বলবো ?
- হু বলো ,
- বলবো ?
- হ্যাঁ , বলো না ।
- শুনবে?
- হ্যাঁ ,
- তবে শুনো ,
" ওগো আমার কাদম্বরী
শুনতে কি পাও তুমি
তোমার আলতা রাঙা পায়ে
নুপুর পরিয়ে তার তালে
মাতাল মোর মন
আমি তোমারও সনে
থাকিবো সদা
ইহাই আমার পন
লাল শাড়িতে বউ সাজিয়ে
আনবো আমার ঘরে
তোমার রূপে দেখো গো
আমি যাতে না যাই মরে "
নাফিসের এই কাব্যে জুঁইয়ের যেন কলিজা ফেটে যাচ্ছে । নাফিসকে কেন যেন দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তার । খুব ইচ্ছে হচ্ছে আজ নাফিসকে দেখতে । তখনই নাফিস হেসে বলে ,
- কেমন হলো ,
তখনই জুঁই তার বক্তব্য রাখে ,
- নাফিস আমি তোমাকে দেখতে চাই , এক্ষুনি এই মুহুর্তে দেখতে চাই ।
- এখন ?
- হ্যাঁ , প্লিজ আসো । আমি তোমাকে দেখতে চাই ,
- আচ্ছা তবে আজ কাদম্বরী এত রোমান্টিক হলো কি করে ,
- আসবে কিনা বলো ?
- আচ্ছা বাবা , আসতেছি ।
- আমি অপেক্ষায় আছি ।
" তুমি অপেক্ষায় রত থাকো
কাদম্বরী
আমি গাজরা হাতে আসবো
তোমার কাছে
নিতে তোমায় আপন করে
আমার এই মনে "
এই বলে নাফিস লাইন কেটে দেয় । আর জুঁই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে নাফিসের আসার পথে ।