প্রিয়তির চোখ দুটো জ্বালা করছে। কিন্তু মনে মনে নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করল। রিদুর দিকে না তাকালো না। রিদুর চোখ মুখের দিকে তাকানোর শক্তি নেই ওর। তাই রিদুর দিকে না তাকিয়েই বলল,
" তারপর?"
" প্রেমার খোঁজ করছিলাম পাগলের মতো। দিনে কতবার যে ওর ফোন নাম্বারে কল করতার তার ইয়াত্তা ছিলো না। বার বার অনলাইনে ঢুকে ওর ফেইসবুক আইডি চেক করতাম কিন্তু তা ডিএকটিভ ছিলো। নিরুপায় হয়ে তোমার খালার বাসায় গেলাম। তোমার খালার সাথে আমার মোটামুটি ভালো সম্পর্ক ছিলো। সে হিসাবে কখনো কখনো তার বাসায় যেতাম। কিন্তু তোমার খালার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। তোমার খালাতো বোন রুমকি যে কিনা প্রেমারই বয়সী।
একদিন রুমকিকে একা পেয়ে তার কাছে প্রেমার কথা জানতে চাইলাম। কিন্তু সে বলতে চায়নি। এক রকম পায়ে ধরার মত করে অনুরোধ করলাম। পরে সে বলল, প্রেমা বাড়ি চলে গেছে। আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না। আমি তাকে বললাম প্রেমার সাথে একবার কথা বলিয়ে দিতে তারপর আর তাকে বিরক্ত করব না। সে প্রেমা ফোন বন্ধ পেয়ে প্রেমার বড় বোনের নাম্বারে কল করল। তখন তো জানতাম না তুমি প্রেমার বড় বোন। প্রেমার বড় বোন মানে তোমার মাধ্যমে জানলাম প্রেমা খুব অসুস্থ। আমি প্রচন্ড ভয় পেলাম। রুমকিকে হাত জোড় করে বললাম, যেভাবে হোক প্রেমার সাথে একবার কথা বলিয়ে দিতে। রুমকির মাধ্যমে সেদিন প্রেমার সাথে কথা বলতে পারলাম। কিন্তু প্রেমা আমার কন্ঠ শুনেই বলল, দেখো ফোনে কথা বলতে পারছি না। কয়েকদিন পর যেনো আমি এ শহরে এসে ওর সাথে দেখা করি। তখন সবটা খুলে বলবে। প্রেমা দেখা করবে শুনে প্রাণে যেনো প্রাণ ফিরে পেলাম।
প্রায় সতেরো দিন পর প্রেমা একটা রেস্তরাঁয় দেখা করল। আমি প্রেমাকে দেখেই বললাম, কী হয়েছে প্রেমা? কেন এড়িয়ে যাচ্ছো আমায়? আমার কী কোনো ভুল হয়েছে? প্রেমা খানিক সময় চুপ থেকে বলল, দেখো হৃদয় ভুল আমাদের দুজনেরই হয়েছে। তোমার সাথে বেশ কয়েকবার অবাধ মেলামেশার কারণে আমি প্রেগনেন্ট হয়ে যাই। আমি বিস্ময়ে বললাম, কী বলছো? এটা কী সত্যি? প্রেমা বলল, হ্যাঁ। আমি বললাম তাহলে তুমি আমার থেকে পালিয়ে কেন বেড়াচ্ছো? আমাকে তোমার বলা উচিত ছিলো। তুমি চিন্তা করো না আমি যত দ্রুত সম্ভব আমার পরিবারকে তোমার বাড়িতে পাঠাবো। আমরা দ্রুত বিয়ে করে নিবো। প্রেমা বলল, দেখো হৃদয় আমি এখন বিয়ে করতে আগ্রহী নই। বিয়ে জীবনের একটা ঝামেলাময় অধ্যায়। এত দ্রুত আমি সাংসারিক ঝামেলায় জড়াতে চাই না।
আমি বললাম, তাহলে আমাদের সন্তানের কী হবে? প্রেমা বলল, তুমি চিন্তা করো না আমি অলরেডি এবরশন করে ফেলেছি। ভ্রুন যত বড় হবে এবরশনে তত ঝামেলা প্লাস কষ্টদায়ক। আমি প্রথম মাসে পিরিয়ড মিস করার পর টেস্ট করে পজেটিভ জানার পরই বাচ্চা নষ্ট করার ঔষধ খেয়ে বাচ্চা এবরশন করে ফেলেছি। ঝামেলা ছাড়াই সমস্যার সমাধান হয়েছে। যদিও অতি মাত্রায় ব্লাড লস হবার কারণে কদিন খুব অসুস্থ ছিলাম সে কারণেই খুলনা থেকে চলে এসেছি। আমি প্রেমার কথা শুনে কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। শুধু বললাম, তুমি চাইলে বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসতে পারতো। হয়তো পরিবারে একটু ঝামেলা হতো কিন্তু তারা মেনে নিতো। আমরা বিয়ে করে নিলেই সমস্যার সমাধান নীরবে হতো। আমার সন্তানকে খুন করার প্রয়োজন হতো না তোমার।
প্রেমা বলল, ক্ষ্যাত মার্কা কথা বলো না। আমার জীবনে কিছু স্বপ্ন আছে। এত দ্রুত বিয়ে করে বা বাচ্চা নিয়ে তা নষ্ট করতে পারব না। তাছাড়া আমার বড় বোনের, বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়নি আমি সবার ছোট হয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়বো? আর বিয়ের কয়মাসের মাথায় বাচ্চা হলে লোকে কী বুঝতো না। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমি বর্তমানে সংসার নামক খাঁচায় বন্দী হতে চাই না।
তোমার সাথে সম্পর্ক হবার পরই বুঝতে পারি তুমি বিয়ে করতে চাইবে এমন টাইপ ছেলে। তাই বাচ্চার কথা জানাইনি। চুপচাপ চলে এসেছি। আমার পক্ষে সম্পর্ক কন্টিনিউ করা সম্ভব না। এখন থেকে আমি নিজেকে নিয়ে থাকতে চাই। প্রেম ভালোবাসা আমার কাছে জাস্ট টাইম পাস। নিজের টাইম পাস করার চক্করে যখন ঝামেলায় পড়ে যাই তখন নিজের উপরই রাগ হয়। আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না হৃদয়। এসব বিয়ের ইমোশনে তুমি আমায় বাঁধতে পারবে না।
প্রেমার কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে বসে ছিলাম। প্রচন্ড অপমানবোধ হচ্ছিলো। নিজের ভিতরে জমা হওয়া প্রচন্ড রাগ চেপে রাখতে পারিনি। সেটা আগুনের ফোয়ার মত বাইরে বের হয়ে আসল। প্রেমাকে পর পর তিন চারটা চড় মেরে বসলাম। আমরা বেস্তরাঁয় কর্ণারের একটা টেবিলে বসেছিলাম। কিন্তু চড়ের শব্দে পুরো রেস্তরাঁর লোক আমাদের দিবে বিস্ময়ে তাকিয়েছিলো। আমি বেশ জোরেই বললাম, তুই যে একটা এক নাম্বারের বেশ্যা তা কিছুদিন আগেই জেনেছিলাম। ছেলের সাথে টাইম পাস করাই তোর ধান্ধা। আমার ফ্ল্যাটের আরো একটা ছেলের সাথে তোর সম্পর্ক হয়েছিলো সেটাও আমি জেনেছি। তাও তোকে ভালোবেসে অন্ধ বিশ্বাস করে এ পর্যন্ত এসেছি। কিন্তু তুই নিজেই প্রমাণ দিলি তুই কী? শোন তোর গর্ভের বাচ্চাটা যে আমার ছিলো তারও কোনো প্রমাণ নেই। হতে পারে অন্যের জিনিস তুই আমার নামে গছাচ্ছিস। তারপর প্রেমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি ওখান থেকে চলে আসলাম। যেহেতু প্রেমা আমাকে ওর বাড়ির ঠিকানা কখনো দেয়নি তাই তোমাদের বাড়ি চেনা সম্ভব ছিলো না বা তোমার পরিবারকে প্রেমার বিষয়ে জানানো সম্ভব হয়নি। তাও তোমার খালাকে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার খালাতো বোন রুমকির অনুরোধে তা করিনি। সম্পর্ক চলাকালীন যতবার প্রেমার কাছে বাড়ির ঠিকানা চেয়েছিলাম ও কৌশলে বিষয়টা এড়িয়ে যেতো।
এ ঘটনার পর বেশ কিছুদিন খুব ভেঙে পড়েছিলাম। স্বাভাবিক হতে মোটামুটি সময় লাগল। তারপর তোমার সাথে পরিবার বিয়ে ঠিক করল। আমার জীবনে নতুন করে বসন্ত আসল। তোমায় প্রচন্ড ভালোবেসে ফেললাম। এখানেও নিয়তি আমার সাথে ভালো লুকোচুরি খেলল। যখন তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম তখন প্রেমা ছিলো না, এনগেজমেন্ট এর সময়ও ছিলো না। তোমার বাবা বলেছিলেন, কী একটা জরুরি কাজে তোমার বোন ঢাকায় আটকে গেছে। বিয়েতে আসবে। তোমার খালা, তিনি তো এমনি বিয়ের দিন এসেছিলেন। যেহেতু বিয়ের আগে সবকিছু সম্পূর্ণ ঘরোয়া ছিলো তাই তেমন লোক ছিলো না, দুই পরিবারেরই।
বিয়ের আগেও তোমার সাথে যতবার কথা বলেছি বা দেখা করেছি একবারও প্রেমার সাথে কথা হয়নি, দেখা হয়নি। তোমার বোনের নাম প্রেমা শুনে প্রথমে খানিক খটকা লেগেছিলো। পরোক্ষণে ভাবলাম পৃথিবীতে বা এই শহরে একই নামের লোকের তো অভাব নেই। তাছাড়া তোমার চারিত্রিক গুন, স্বভাব, চেহারা দেখে কখনো মনে হয়নি তোমার ছোট বোন প্রেমার মত মেয়ে হতে পারে। তোমাদের চেহারায়ও সামান্যতম মিল নেই। প্রেমাকে প্রথম দেখলাম আমাদের বিয়ের দিন।
কিন্তু বিয়ের দিন প্রেমাকে দেখেও কোনো পদক্ষেপ নেয়ার মত পথ ছিলো না। ভরা মজলিসে কী করতাম আমি। আমার সবচেয়ে বেশি খটকা লাগতো এটা ভেবে যে, আমি নাহয় প্রেমার কথা জানতাম না কিন্তু প্রেমাও কী আমার কথা জানতো না? প্রেমা কী আমার নাম শোনেনি বিয়ের আগে? ছবি দেখেনি? বিয়ের কার্ডে আমার নাম এবং ছবি ছিলো তাও কি একবার দেখেনি ও। আমি প্রেমার বিষয়ে সঠিকভাবে কিছু না জানলেও প্রেমা তো আমার বিষয়ে বিস্তারিত সব জানতো। ওর কাছ থেকে তো আমি আমার বিষয়ে কোনো কথা লুকাইনি।
এসব প্রশ্নের উত্তর পেলাম বিয়ের মাসখানিক পর। কিন্তু ততদিনে আমি তোমার সাথে বিয়ে হবার পর আমার জীবনে আমি স্বর্গসুখ অনুভব করতে লাগলাম। জীবনের আসল মানে পেলাম, ভালোবাসা, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য পেলাম। বিয়ের একমাস পর প্রেমার সাথে একাকি কথা হয়েছিলো আমার। তখনই ওকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন সব জেনেও ও চুপ ছিলো। তখন প্রেমা বলেছিলো আমার সাথে ওর কিছু হিসাব করা বাকি আছে। সে হিসাবের জন্যই ও সব জেনেও চুপ ছিলো এবং বিয়ের আগে আমার সামনে আসেনি। ও হিসেবটা সুদে আসলে উসু্ল করার জন্য চুপ ছিলো বিয়ের আগে।
হৃদিতার এনগেজমেন্ট এর দিন প্রেমার টার্গেট বাবা নয় বরং আমি ছিলাম। প্রেমা গোপনে আমাকে ডেকেছিলো একাকি রুমে। ওর প্ল্যান এমন ছিলো যে, ও ভরা মজলিসে এটা প্রমাণ করবে, আমি ওকে রেপ করতে চেয়েছি। কিন্তু আমার কপাল ভালো ছিলো আর বাবার খারাপ। কিছু কাজে বাবা ঐ রুমে যায়। অন্ধকার রুমে প্রেমা আমাকে মনে করে বাবার উপর হামলা করে। ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে যায়। প্রেমা নিজেও এতে হতাশ হয়েছিলো কিন্তু নিজেকে বাঁচানোর জন্য তখন দোষ আমার বাবার উপর চাপিয়ে দিয়েছিলো। প্রেমা এখন পর্যন্ত যা করেছে সবটা আমার উপর শোধ তুলতে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না কিসের শোধ তুলছে ও? দুই বছর আগে আমার ভালোবাসাকে প্রত্যাখান ও করেছিলো, আমার সন্তানকে ও মেরেছিলো, আমাকে ছেড়ে ও চলে গিয়েছিলো! প্রতিশোধ তো আমার নেয়ার কথা তাহলে ও কিসের শোধ তুলছে?"
প্রিয়তি রিদুর দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে শুয়ে পড়ল। রিদু প্রিয়তির কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
" জান প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না। আমি মানছি আমি যা করেছি তা অন্যায়। তুমি চাইলে আমাকে শাস্তি দিতে পারো। তোমার কাছ থেকে বিষয়টা লুকানো আমার একদমই উচিত হয়নি। আমার তোমাকে অন্ধকারে না রেখে পুরোটা বলে দেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু তোমার সাথে বিয়ে ঠিক হবার পর, কয়েকদিন কথা বলার মনে হয়েছিলো আমি সারা জীবন তোমার মত কাউকে খুঁজছিলাম। এমন একজন বন্ধু যে আমাকে আমার চেয়ে ভালো বুঝবে। এ কারণে তোমাকে হারানোর ভয়ে রিয়ার কথা বললেও প্রেমার কথা বলতে পারিনি। প্লিজ প্রিয়তি তুমি আমাকে শাস্তি দাও। তাও এমন নীরব থেকো না।
প্রিয়তি চোখ বন্ধ করেই রইল। ওর নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছিলো। রিদু বেশ অবাক হলো প্রিয়তি ঘুমিয়ে গেছে দেখে। রিদু আর কিছু বলল না, চুপচাপ শুয়ে পড়ল প্রিয়তির পাশে।
২১!!
রাত তিনটা,
বাইরে ঝড়ের তান্ডবে সব কিছু মনে হয় লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। প্রবল বাতাসে কয়েকটা গাছ ভেঙে পড়ার আভাস পেয়েছে প্রিয়তি। প্রকৃতি বোধ হয় আর প্রিয়তির মনের তান্ডব বুঝতে পেরেছে। তাই তো প্রবল ঝড়ের পাশাপাশি হচ্ছে মুষলধারে বৃষ্টি। প্রিয়তির রুমের সাথে লাগোয়া ব্যালকনি বৃষ্টির পাানিতে ভরে গেছে। ব্যালকনি থেকে কিছু পানি দরজার ফাঁক দিয়ে রুমে আসছে। প্রিয়তি একমনে সেদিনে তাকিয়ে আছে। কতক্ষণ পর পর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। পুরো রুম আলোয় আলোকিত হয়ে যাচ্ছে তখন। সেই আলোয় প্রিয়তি দেখছে নিজের জীবনের সবচেয়ে বিপর্যস্ত রাতটাকে।
ঝড় শুরু হবার পর রিদু ঘুম থেকে উঠে রুমের দরজা, জানালা ভালোভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। প্রিয়তি তখন ঘুমের ভান ধরে পড়ে ছিলো। রিদু লাইট নিভিয়ে শুতেই প্রিয়তি আবার চোখ মেলে তাকালো। চোখের কোন বেয়ে জল পড়ছে। প্রিয়তি কোনো শব্দ করছে না। কিছু কান্নায় কোনো শব্দ হয় না। কিন্তু হৃদয় পোড়ায়, প্রচন্ডভাবে দাহ্য করে হৃদয়ের পুরোটা। বাইরের ঝড় সবাই দেখে কিন্তু ভিতরের ঝড়? সম্পর্কগুলো কেমন যেনো হুট হাট ঝড় এসে লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায়। দেখলে মনে হয় সুন্দর ফুলের মালায় গাঁধা। কিন্তু মানুষ ভুলে যায় সম্পর্কের মালা গাঁথতে যে সুতা ব্যবহার করা হয় তা খুব নাজুক হয়। একটু টোকা লাগলেই সুতাটা ছিড়ে সম্পর্কটা বিখরে এলোমেলো হয়ে যায়।
প্রিয়তি ভাবছে আজকের মত এক ঝড়ের রাতেই রিদু আর ওর বাসর হয়েছিলো। বৃষ্টিভেজা বাসর। ওদের বিয়ের দিন সকাল থেকে ঝরঝরা রূপালী রোদ থাকলেও বিয়ের কিছুক্ষণ আগে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। প্রিয়তি তখন সবাইকে বলতে শুনেছে বিয়ের দিন বৃষ্টি হওয়া খুবই শুভ। এতে নাকি সংসার বরকতময় হয়। লোকের কথায় প্রিয়তি যা লজ্জা পেয়েছিলো সেদিন। কনে বিদায়ের সময়ও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয়েছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি অনবরত পড়ছিলো নিজ আনন্দে। প্রিয়তির মনে হচ্ছিলো এগুলো বৃষ্টি নয়, বিয়ের খুশিতে আনন্দ ঝড়ছে আকাশ থেকে।
রাত বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টির মাত্রাও বাড়ছিলো। ওদের দুজনকে বাসরঘরে একসাথে দেয়ার আধাঘন্টা পর শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। দুজন হাত ধরে ব্যালকনিতে গিয়ে গল্প করছিলো, বৃষ্টির অল্প অল্প ঝাপটায় গল্পের মহল ভালোবাসার রাজ্যে রূপ নিলো। সে কি আবেগময় মোহময়ী ভালোবাসা। প্রিয়তির চোখে, মুখে, শরীরে বৃষ্টির যতগুলো ফোটা স্পর্শ করেছিলো রিদু সবগুলো ঠোঁট দিয়ে শুষে নিয়েছিলো। স্পর্শময় শিহরিতো সে ভালোবাসা। আজও মনে পড়লে প্রিয়তির সারা শরীর অবশ হয়ে যায়। সেরাতে ঝড়ে হয়েছিলো মধুর মিলন আর আজ রাতের ঝড়ে প্রিয়তি বিচ্ছেদের গন্ধ পাচ্ছে। তীব্র গন্ধ পাচ্ছে হৃদয় পোড়ার।
হৃদয় পুড়লেও রিদুর সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলার মতো সাহস হচ্ছিলো না ওর। কী বলবে প্রিয়তি? কী জিজ্ঞেস করবে রিদুকে তেমন কিছুই ভেবে পাচ্ছিলো না। তাই চুপ করে ঘুমের ভান ধরে পড়ে ছিলো। প্রিয়তি মনে মনে বলছে,
" এক মুহূর্তে জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। এমন জীবন তো আমি চাইনি। আমি যেমন সাধারণ তেমন সাধারণ একটা জীবন চেয়েছিলাম কিন্তু------।" একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে প্রিয়তি চোখ বন্ধ করল। চিন্তা যতই থাক ক্লান্ত শরীর জেগে থাকার পারমিশন দিচ্ছে না।
সকাল আটটা।
রিদু ফোনের দিকে তাকিয়ে ধরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলো। এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে ও। আজ অফিসে জলদি যেতে হবে। এতদিন ছুটি নিয়েছে। এটা ভেবে হালকা অভিমান হলো প্রিয়তি আজ ওকে নামাজ পড়তেও উঠালো না? প্রতিদিন সকালে প্রিয়তিই ঘরের সবাইকে ফজরের নামাজ পড়তে জাগায়। তারপর নাস্তা বানিয়ে রিদুকে খাইয়ে অফিসে পাঠায়। আর আজ প্রিয়তি। রিদু পাশে তাকাতেই দেখলো প্রিয়তি এখনো ঘুমিয়ে আছে। রিদুর বিষয়টা বেশ অবাক লাগল। ছয় মাসের বেশি সময় হলো ওদের বিয়ের। বিয়ের পর প্রিয়তিকে কখনো ফজরের নামাজের পর ঘুমাতে দেখেনি। কিন্তু আজ?
রিদু প্রিয়তির গায়ে হাত দিতেই আৎকে উঠলো। গা বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আছে। রিদু প্রিয়তিকে ডাকল কিন্তু………
—————
রিদু প্রিয়তির নাম ধরে বেশ কয়েকবার ডাকলো। কিন্তু প্রিয়তি সারা শব্দ করছে না। রিদু প্রিয়তির নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখলো নিশ্বাস চলছে, তবে শরীর বেশ ঠান্ডা। রিদু প্রিয়তির গায়ে হাত দিয়ে আলতো করে কয়েকবার নাড়া দিলো। আর ডাকল,
" জান! জান! প্রিয়তি!"
প্রিয়তি পিট পিট করে চোখ মেলল। দেখে মনে হয় চোখ মেলতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। ঠোঁট নেড়ে কিছু বলল কিন্তু শব্দ হলো না। রিদু জোরে জোরে ওর মাকে ডাকল। দিলারা বেগম রুমে এসে বলল,
" কী হলো চিল্লাচ্ছিস কেন?"
রিদু থমথমে গলায় বলল,
" মা দেখো না প্রিয়তি কেমন করছে? ওর শরীর কেমন ঠান্ডা হয়ে আছে। কথা বলছে না। শুধু চোখ পিট পিট করছে।"
দিলারা দ্রুত প্রিয়তি গায়ে হাত রাখলো। বেশ কয়েকবার প্রিয়তিকে ডাকলেন কিন্তু প্রিয়তি চোখ পিট পিট করে তাকানো ছাড়া কোনো উত্তর দিতে পারল না। দিলারা বলল,
" হৃদয় তুই ওকে নিয়ে সামনে আয়। আমি তোর বাবাকে বলছি দ্রুত গাড়ির ব্যবস্থা করতে। হসপিটালে নিতে হবে দ্রুত। আর তোর খালাকে বলছি হসপিটালে আসতে।"
রিদু বলল,
" মা খালাকে বিরক্ত করো না। এমনি কাল রকিবের আকদ। এখন তাকে আমাদের ঝামেলায় না জড়াই।"
" তা অবশ্য ঠিক বলছিস।"
হসপিটালে নিয়ে আসার পর ডাক্তার ভালো করে দেখে বললেন,
" আসলে ভয়ের কিছু নেই। শরীর প্রচন্ড দুর্বল। প্রেসার ভয়ানক মাত্রায় লো হয়ে গেছে। শরীরে স্যালাইন দিয়েছি একটা। বাকি বার বার খাবার স্যালাইন, গ্লুকোজ খাওয়াবেন । শরীরে স্যালাইন শেষ হলে পুষ্টিকর এবং পানিজাতীয় খাবার খাওয়াবেন। প্রেসার অতিমাত্রায় লো হয়ে যাবার কারণে শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো। আর এই দুর্বলতার কারণে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছিলো। উনি কী ঠিকমত খায় না?"
দিলারা বলল,
" হ্যাঁ ঠিকমতই তো খায়। তাছাড়া মাস দুই আড়াই আগে ওর একসিডেন্ট হয়েছিলো, তখন মিসক্যারেজও হয়েছিলো, তখন প্রচুর ব্লাড লস হয়েছিলো। কিন্তু কাল তো একদম সুস্থ ছিলো।"
ডাক্তার বলল,
" সে ধাক্কার কারণে শরীর এখনো খুব দুর্বল আর মনে হয় কোনো বিষয় নিয়ে খুব টেনশন করেছেন। যার কারণে হঠাৎ প্রেসার এত লো হয়েছে। কয়েকদিন টানা বিশ্রাম নিলে আর খাওয়া দাওয়া করলে ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া ওনার তেমন কোনো মেডিসিনের প্রয়োজন নেই। বিকালের দিকে স্যালাইন শেষ হলে বাসায় নিয়ে যাবেন।"
রিদু বুঝতে পারলো প্রিয়তি কিসের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনে রিদুসহ বাকি সবাই যেনো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
ডাক্তার চলে যেতেই রিদুর বাবা হারুণ সাহেব বললেন,
" কেমন মেয়েকে ছেলের বউ করে আনলাম? রোজ রোজ তাকে নিয়ে হসপিটালে দৌঁড়াতে হয়। ডাক্তার আর ঔষধের পিছনে কারি কারি টাকা ঢালতে হচ্ছে। রিদু ওর বাবার দিকে চোখ বড় করে তাকাতেই তিনি বললেন, এমন চোখে আমার দিকে তাকাবি না। তোর চোখ রাঙানীকে আমি ভয় পাই না। ভুল তো কিছু বলিনি! আড়াইমাস আগে ওর বোনের কারণে আঘাত পেলো, অসুস্থ হলো। অথচ ওর পরিবার একটা টাকা খরচ করেছে? উল্টা আরো কত কত কথা শোনালো। মেয়ের পিছনে একটা টাকা খরচ করেছে? বরং আমার বংশধর আসতে গিয়েও তাদের কারণে আগমনের আগেই বিদায় নিলো। তখন ওর পিছনে পানির মতো টাকা গেছে।
তারপর ওর নাকি মন ভালো না সে কারণে ঘুরতে গিয়ে কারি কারি টাকা ভেঙে আসলি। তখন অসুস্থতায় অনেকদিন অফিসে যাসনি, ঘুরতে যাবার বাহানায় বন্ধ দিলি, এখন আবার আজ থেকে বন্ধ দিলি। মানে আয়ের কিছু হচ্ছে না শুধু ব্যয় আর ধারদেনা বাড়ছে। এই যে টাকা গুলো খরচ করেছিস তার তো বেশিভাগই তোর ধার করা। বিয়ের সময় কত টাকা দেনা হলো, আর তোদের বিয়ের পর একটার পর একটা ঝামেলার কারণে পানির মত টাকা যাচ্ছে আর আজ এখন আবার। এত টাকা তো গাছে ফলে না। লোকের ঘরে বউ আসে, লক্ষ্মী আসে, ঘরে আয় বাড়ে কিন্তু আমার ঘরে উল্টো আসার পর থেকে খরচ বেড়েই যাচ্ছে, ধারদেনা, অশান্তি বেড়েই যাচ্ছে। ওকে একবারও বলেছিস তুই কত টাকা দেনা আছিস? স্ত্রীর কর্তব্য শুধু স্বামীর টাকায় ঘোরাঘুরি করা আর শপিং করা না, তার ভিতরের খবরটাও রাখা।"
রিদু বেশ রাগ করেই বলল,
" বাবা প্লিজ চুপ করো। ও শুনতে পেলে কী ভাববে? এমন সময় কেউ এসব কথা বলে? তাছাড়া দেখতে গেলে ওর জীবনের সব বিপদের জন্য দায়ী আমিই। কেন? কী কারণ তা নাহয় পরে বলবো? এখন প্লিজ তোমরা এসব টাকা টাকা করা বন্ধ করো। আর বাবা বিয়ের পর স্ত্রীর সমস্ত দায়িত্ব তার স্বামীর, তবে ওর পরিবার কেন ওর চিকিৎসার টাকা দিতে যাবে? আর আমরাইবা তা নিব কেন? আমরা কী এতটা ছোটলোক?"
হারুণ সাহেব আর কোনো কথা বললেন না। ওখান থেকে চলে গেলেন। ঘরের মধ্যে দিন দিন এতো ঝামেলা তার ভালো লাগছে না। প্রিয়তি নামের মেয়েটা তার ঘরে প্রবেশ করার পর থেকে শনির দশা লাগছে তার ঘরে। যেমন সম্মান হানি হয়েছে, তেমন টাকা পয়সা যাচ্ছে। নেহাৎ মেয়েটাকে দেখলে তার মায়া লাগে। মেয়েটা শ্যামলা বরন মুখে প্রচুর মায়া। মুখের আদল অনেকটা তার মায়ের মতোন। সে কারণে কিছু বলে না। নয়তো এসব কথা মুখের উপর বলে দিতো অনেক আগে।
২২!!
প্রিয়তিকে বাড়িতে নিয়ে আসতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। প্রিয়তিকে রুমে শুইয়ে দিয়ে রিদু কাউকে ফোন দিলো। কথা বলতে বলতে ব্যালকনিতে চলে গেলো। প্রিয়তি রিদুর দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার পাশ ফিরে টেবিল ল্যাম্পটার দিকে একমনে তাকিয়ে রইল।
রিদু ওর অফিসের বসের সাথে কথা বলছে। তিনি প্রচন্ড রেগে আছে। অবশ্য তার রাগের যথেষ্ট কারণ আছে। নেহাৎ রিদু খুব দক্ষ মেধাবী দেখে এখনো ওকে চাকরি থেকে বাতিল করেনি। নয়তো এতক্ষণে রিদুর চাকরি চলে যেতো। রিদু তাকে বোঝানোর খুব চেষ্টা করছে। কিন্তু রিদুকে কথা শোনাতে তিনি বিন্দু মাত্র ছাড় দিচ্ছেন না। রিদুর অনেক বোঝানোর পর অবশেষে তিনি এই শর্তে মানলেন ছুটির দিনগুলোতে রিদুকে অফিসের পেনডিং কাজগুলো করতে হবে। রিদু শর্ত মেনে নিলো। এ ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না রিদুর। কারণ এ মুহূর্তে ওর চাকরি যাওয়া মানে মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়া। ধার দেনায় ডুবে আছে। সেসব শোধ করতে হবে। তাছাড়া সংসারের খরচ তো আছেই।
বসের সাথে কথা বলে রিদু প্রিয়তির পাশে বসলো। গতকাল রাতের পর প্রিয়তির সাথে কোনো কথা হয়নি ওর। প্রিয়তির পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
" জান!"
" প্রিয়তি নিশ্চুপ।"
" তুমি এমন চুপ থাকলে আমার কেমন লাগে তা কী তুমি বোঝো না?"
" প্রিয়তি নিশ্চুপ।"
" এতটা টেনশন নিলে যে নিজেকে অসুস্থ করে ফেললে? আমাকে শাস্তি দেয়ার পথ হিসাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো?"
" প্রিয়তি নিশ্চুপ।"
" প্রিয়তি আমায় শাস্তি দাও তবুও এমন নিশ্চুপ থেকে নিজেকে কষ্ট দিও না।"
" প্রিয়তি নিশ্চুপ।"
রিদু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
" আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে এসে তোমাকে কিছু কথা বলবো। তারপর সিদ্ধান্ত তুমি নিও।"
রিদু ওয়াশরুমে চলে যেতেই প্রিয়তির চোখের কোন বেঁয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে বালিশেই হারিয়ে গেলো। লোকে সত্যি বলে, মানুষের কষ্টের, গুমরে কাঁদার সবচেয়ে বড় সাক্ষী বিছনার বালিশগুলো। কত মানুষের চোখের জল, বুকের কষ্ট যে বালিশের বুকে সমাহিত তা কেবল বালিশগুলো জানে। মানুষের মত বালিশগুলোতে যদি প্রাণ থাকতো, তবে তারা মানুষের কষ্টের গোপন সাক্ষী হতে গিয়ে নিজেরাই কষ্টে মরে যেতো। তারা যদি বলতে পারতো, তবে হয়তো তারা প্রতিটা মানুষের কষ্টের বর্ণনা সুনিপূণ এবং পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতো। বালিশ প্রাণহীন বলেই কষ্টগুলো খুব যত্নে নিজের মাঝে নিয়ে নিতে পারে।
প্রিয়তি বালিশের পাশে থাকা নিজের ফোনটা হাতে নিলো। কাউকে কল করবে ভাবছিলো। কল করতে নিয়ে দেখল ফোনটা বন্ধ হয়ে আছে। হয়তো চার্জ নেই। কিন্তু প্রিয়তির এখন বিছানা থেকে উঠে ফোনে চার্জ দিতে ইচ্ছা করছে না। তাই ফোনটাকে পাশে রেখেই চোখ বন্ধ করলো। রিদু ফ্রেশ হয়ে এসে আবার প্রিয়তির পাশে বসে বলল,
" একটু ফ্রেশ হয়ে নিতে। ভালো লাগত। সারাদিন একই কাপড়ে আছো। জামটা পাল্টে হাত মুখে ধুয়ে মাথায় একটু পানি দাও। দেখবে শরীর হালকা লাগবে।"
প্রিয়তি উঠতে নিলে রিদু ধরলো ওকে। উঠে বসার পর রিদু বলল,
" তোমার ওয়াশরুমে যেতে হবে না। বালতিতে পানি এনে আমি তোমার মাথায় পানি দিয়ে, কাপড় পাল্টে দিচ্ছি।"
প্রিয়তি রিদুর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে উঠে নিজের কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। রিদু চুপ করে বসে রইল।
প্রিয়তির শরীর এখনো কাঁপছে। শরীর যে প্রচন্ড দুর্বল তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা জেদের বশে নিজের কাজ নিজে করছে। রিদু দরজার সামনে গিয়ে বলল,
" প্রিয়তি তুমি কাপড় পাল্টে বের হও। আমি ড্রেস ধুঁয়ে দিব।"
কিছুক্ষণ পর প্রিয়তি বের হয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে নিজের ভেজা কাপড়গুলো মেলে দিলো। রিদু তখনই প্রিয়তিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
" ও জান তুমি এত রাগ করে আছো? হয় ক্ষমা করো নাহয় শাস্তি দাও। তাও এ নীরবতার দেয়াল ভাঙো।"
প্রিয়তি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে না। সে শক্তি ওর নেই। রিদু জড়িয়ে ধরেই বলল,
" সৃষ্টিকর্তা তো বোধ হয় অলরেডি শাস্তি দিয়েছেন এবার তুমি দাও। তাও এমন চুপ থেকে কষ্ট দিও না।"
প্রিয়তি এবার হালকা গলায় বলল,
" সৃষ্টিকর্তা কী শাস্তি দিয়েছেন?"